বায়তুল মোকাদ্দাস বলছি…

আল আক্বসা- কেমন আছে ফিলিস্তিন?

Date

Author

Blog Duration

20 minutes

পৃথিবীর বয়স ঠিক কতো আমি জানি না। আমার অবশ্য জানার কথাও নয়। তবে প্রসঙ্গ আসছে কারণ এই পৃথিবীর শুরুর দিকের যা, আমিও কোনো না কোনোভাবে এসবের সাথে যুক্ত।

পৃথিবীর প্রথম মানুষ এবং নবী হযরত আদম আলাইহিস সালাম যখন আমার ভিত্তি স্থাপন করলেন, আল্লাহর ইবাদতগাহ হিসেবে আমি যখন প্রথম অস্তিত্ব লাভ করলাম, খুব কিছু তখন পৃথিবীর বুকে ছিলো না। হ্যাঁ, গাছ-পালা পশু-পাখি অনেক কিছুই হয়তো ছিলো। ছিলো স্বল্পসংখ্যক মানুষও। তবে সবই ছিলো প্রাকৃতিক। মানুষের ছোঁয়াহীন আল্লাহ প্রদত্ত।

অস্তিত্বে আসার একদম শুরুর দিকেই আমি জানতে পারি, পৃথিবীর ঠিক মধ্যভাগে আমার থেকে বেশ দূরে মাত্র বছর চল্লিশেক আগে একটি ঘর নির্মিত হয়েছে। কাবা। জমিনের বুকে ফেরেশতা নির্মিত আল্লাহর প্রথম ঘর। আমি আজকের ফিলিস্তিন নামের ভূখণ্ডে। প্রথমটি ছিলো আরবেরই আরেক প্রান্তে মক্কায়। কাবার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিলো আল্লাহর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশালী ফেরেশতা জিব্রাইলের আলাইহিস সালাম হাতে। এই হিসেবে মানুষ নির্মিত প্রথম ঘর- আল্লাহর ইবাদতগাহ তো আমিই।

আল্লাহর প্রিয় কোন বান্দার হাতে প্রথম আমার ভিত্তিস্থাপিত হয়েছিলো সেটা নিয়ে আজকের বিতর্কের বাজার বেশ জমজমাট। বিতর্কে তো লাভ নেই, উচিত বরং সঠিক তথ্যটা জানা। প্রথম মানব আদমের হাতেই আল্লাহ তায়ালা আমাকে অস্তিত্বে আসার সুযোগ লাভে ধন্য করেছেন। জন্মের পর থেকে নিয়ে কতোবার কতোজনের হাত হয়েই তো আমার পুন:নির্মাণ হলো। সংস্কার ঘটলো। আজ স্মৃতি হাতড়াতে বসে বারবার চোখ ইতিহাসের বর্ণিল পাতায় উঁকি-ঝুকি মারছে।

হযরত আদমের পর তার সন্তানেরা, পৃথিবীব্যাপী মহাপ্লাবনের পর হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, তারও পর হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম, হযরত ইবরাহীমের সন্তান ইসহাক আলাইহিস সালাম, উমর বিন খাত্তাব রা., উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক, তার সন্তান আল ওয়ালিদ। আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আল মানসুর, আল মাহদি। ফাতিমি খলিফা আলি আজ জাহির, বীর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী …একের পর এক মহামানব আর আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আমার অবয়ব নির্মাণে, সংস্কার ও উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।

তালিকা তো বড় দীর্ঘ। অন্য নামগুলো না হয় গোপনই থাকলো। কেমন নির্লজ্জ আত্মমগ্ন হয়ে আমি কেবল নিজের সম্পর্কে বলে যাচ্ছি। কোনো মানে হয়!

আমার চেয়ে অসহায় সত্তা পৃথিবীর বুকে আর একটিও নেই

আল্লাহর অবাক সৃষ্টি এই পৃথিবী এবং মানব জাতির শত-সহস্র বছর বা যুগের জ্বলজ্যান্ত ইতিহাসের আমি এক নীরব সাক্ষী। নিয়ত পরিবর্তনশীল পৃথিবী আর মরণশীল মানুষ হয়তো নিজের অতীতকে বা ক্ষণস্থায়ী বাস্তবতাকে ভুলে যায়। ভুলে থাকতে পারে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে হাজার বছর কাটিয়ে দেওয়া আমি তো আর এক পলকের জন্যও চোখ বন্ধ করি নি। কিছু দেখা যেমন বাদ রাখি নি, কিছু ভুলেও তো যাই নি। পাথর ভেবে মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত উপেক্ষা করে চলে, আমি তো আর পারি না চারপাশের ঘটনাগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে। নিষ্ঠুর অন্যায় আর আল্লাহর নাফরমানি বা তাঁকে ভালোবাসার অনন্য ইতিহাসকে ভুলে যেতে।

কিছুই ভুলতে না পারা হাসি-কান্না, ইবাদত-গোয়ার্তুমি, প্রেম ও বিদ্বেষের হাজারো ঘটনা-দুর্ঘটনার উপাখ্যান নিয়ে আমি আজ পাথুরে এক কিংবদন্তী।

কেবল মানুষের ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা বলছি কেনো। আমার নিজের শরীর বা বাহ্যিক অবয়বের সাথে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, গৌরব ও সম্মান, এবং উপেক্ষা, ধ্বংসোন্মাদনা ও কলংকের যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে সেসবকেই বা ভুলে যাই কী করে। ক্ষত তো একটুও শোকোয় নি, দিনদিন বরং আরো গভীরতর হচ্ছে। মানুষ বলতে পারে। হাসতে পারে, কাঁদতে পারে। আমাদের তো আর সে ক্ষমতা নেই। আমি কেবল পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাতে পারি। বিচার জানাতে পারি। যুগ যুগ ধরে এভাবেই নিজের আর পৃথিবী ও মানবজাতির বিষয়ে এক আল্লাহর সাথে যোগাযোগ রেখেই আমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে।

এই গৌরব, এমন ভালোবাসা, এতোসব অন্যায় আর নিষ্ঠুরতার সংমিশ্রণ মানবজীবনে ঘটে না। সবমিলিয়ে কেমন অনুভব, প্রশান্তি এবং একইসাথে কী অসীম শূণ্যতা আমার সত্তায় ভর করে আছে পৃথিবীর মানুষ তার তল খুঁজে পাবে না।

এতোসবের পরও আজকের বাস্তবতা হলো আমার চেয়ে অসুখী, আমার চেয়ে অসহায় সত্তা পৃথিবীর বুকে আর একটিও নেই। কেউ নয়। কোনো কিছুই নয়। হতে পারে না।

রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি

বালু-মাটি আর পাথুরে জমিনের এই ভূখণ্ডে একটা একটা করে পাথরের টুকরো দিয়ে আমি যখন অস্তিত্ব লাভ করছিলাম, পুলকের আমার সীমা ছিলো না। আল্লাহর জামিনে, আল্লাহর ইবাদতগাহ হবার সৌভাগ্য কী বিশাল ব্যাপার কে অনুমান করতে পারে। আল্লাহর সেরা সব বান্দা আর বন্ধুরা, তার প্রতিনিধি আর ফেরেশতারা আমার বুকে দাঁড়িয়ে-বসে ইবাদত করবেন, দুআ ও জিকিরে মশগুল হবেন- আমি হবো সেসবের প্রত্যক্ষ ও একান্ত সাক্ষী; কী অসীম গৌরব আমার! তখনও পর্যন্ত আমার কল্পনায় আসে নি বিপরীত বাস্তবতা বলেও একটা ব্যাপার আছে। ভালোর বিপরীতে মন্দের মতো গৌরবের বিপরীতে কলংকেরও শত-সহস্র অধ্যায় আমাকে অবলোকন করতে হবে।

নিবেদন আর নিমগ্নতায় লুটিয়ে পড়া কপালগুলোকে যেমন আশ্রয় দেবো, নাফরমানি আর ঘৃণার বিষকেও বুকে ধারণ করতে বাধ্য হবো।

আল্লাহর বান্দারা আমার বুকে ও শরীরজুড়ে যেমন দীনের পথে আহ্বানে নিজেদের বিলিয়ে দেবেন, কিছু মানুষ আবার আমার শরীরেই ধ্বংস, খুন-খারাবিতে মত্ত হবে। সব দেখবো, শুনবো, গ্রহণ করবো এবং সহ্য করবো, নিরাকার আল্লাহর সমীপে কেবল আকুল তাকিয়ে থাকা ছাড়া করার কিছুই থাকবে না আমার। সবরকম বাস্তবতার মুখোমুখিই আমাকে হতে হলো। ধীরে ধীরে। বছরের পর বছর ধরে।

রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির মতো কখনো খুশিতে আপ্লুত হলাম, প্রাপ্তিতে তৃপ্ত হলাম। উপেক্ষায় ক্ষতবিক্ষত হলাম। আঘাতে জর্জরিত হলাম। ঘৃণায় নাকাল হলাম। হতেই থাকলাম।

আমার করার রইলো না কিছুই। যেমন নেই আজও।

নির্মাণ, সংস্কার, পুন:নির্মাণ

পুরাতন জেরুসালেমের এক ছষ্ঠাংশজুড়ে আমার অবস্থান। প্রায় ১,৪৪,০০০ স্কয়ার মিটার। মূল ভবন লম্বায় ৮৩ মিটার, প্রস্থে ৫৬ মিটার। মসজিদ ও চত্বও মিলিয়ে পাঁচ লাখ লোক একসাথে এখানে নামাজ আদায় করতে পারে। মক্কায় মসজিদুল হারামের মাত্র ৪০ বছর পর আমার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। যদিও বিজ্ঞ আলেম সমাজ ও ইতিহাসবেত্তাদের এ নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ আছে। কেউ বলেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর হাতে আমার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। কেই বলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর হাতে। আসলে বারবার সংস্কার, পুন:নির্মাণ ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন মতামত আলোয় আসার সুযোগ পেয়েছে।

হযরত আদমের পৃথিবীতে আগমনের সময়ই আমি অস্তিত্ব লাভ করি। তবে নির্মাণের পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর সময় প্রথমবারের মতো আমি ব্যাপক আলোচনায় আসার সুযোগ পাই। আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। হযরত ইবরাহীমের পর তার সন্তান হযরত ইসহাক এবং তার নাতি হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর সময়েও সে ধারা অব্যাহত ছিলো এবং আমার জৌলুস কেবলই বাড়ছিলো। এরপর হযরত ইয়াকুবের সন্তান হযরত ইউসুফ যখন মিশরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, দারিদ্রে জর্জরিত হযরত ইয়াকুবের পরিবারকে তিনি মিশরে ডেকে পাঠান। আমার দেখভালের দায়িত্ব তখন বর্তায় হযরত ইবরাহীমের উম্মতের ওপর। নবীদের হাত থেকে এই প্রথম আমার দায়িত্ব সাধারণ উম্মতের হাতে ন্যাস্ত করা হলো বা আল্লাহ পাকের ইচ্ছাতেই এসব হয়ে গেলো।

ফিলিস্তিনের পথে

ইসরায়েলি সম্প্রদায় যারা উন্নত জীবনের খুঁজে মিশরে উপস্থিত হয়েছিলো, চারশ বছর তারা সেখানে অবস্থান করে এবং কালক্রমে তাদেরকে দাসে পরিণত হতে হয়। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম যখন তাদেরকে ফেরআউনের কবল থেকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা জঘন্যতম দাসত্বের কবল থেকে মুক্তি পায়।

এই ইসরায়েলিদের আল্লাহ যখন ফিলিস্তিনে ফিরতে নির্দেশ করলেন, এই বদবখতরা তা প্রত্যাখ্যান করলো।

শাস্তি হিসেবে সিনাই উপত্যকায় আল্লাহ পাক ৪০ বছর পর্যন্ত এদেরকে উদভ্রান্তের মতো ঘোরালেন। এই শাস্তি শেষ হলো যখন হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর অধীনে এদের নতুন একটা প্রজন্ম পৃথিবীর বুকে পা রাখলো এবং দাউদ আলাইহিস সালাম এদেরকে ফিলিস্তিনের পথে অগ্রসর করালেন।

নবী দাউদ আলাইহিস সালাম ফিলিস্তিনের একাংশে নিজের রাজ্য স্থাপন করলেন এবং জেরুসালেমে শাসন পরিচালনা শুরু করলেন। জেরুসালেম শহরের মূল স্থপতিও তিনিই।

তাঁর ছেলে হযরত সুলাইমানের হাতে তার প্রজাবর্গ এবং একদল জ্বিনের কায়িক পরিশ্রমে আমার অবয়বে ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়ন সাধিত হয়। পরবর্তীতে এটা শাসকদেরও কার্যালয়ে পরিণত হয়।

ধ্বংসের মুখোমুখি

হযরত সুলাইমানের ইন্তেকালের পর তার সা¤্রাজ্য তার দু’ ছেলের অধীনে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেকেই নিজের সুবিধা মতো রাজধানী স্থাপন করে শাসনকার্য চালাতে থাকেন। তবে মাত্র দুশো বছরের বেশি তাদের সা¤্রাাজ্য টেকে নি। বেবিলিয়ানদের আক্রমণের সামনে তারা দেশ রক্ষা করতে ব্যর্থ হন।

খৃস্টপূর্ব ৫৮৬-৫৮৭ সালে। বেবিলিয়ান স¤্রাট নেবুচাদনেজ্জারের নেতৃত্বে বেবিলিয়ানরা পুরো ফিলিস্তিন নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়। বেবিলিয়ানরা ফিলিস্তিনের দখল নেয়ার পরপরই আমি আরো একবার ধ্বংসের মুখোমুখি হলাম। আল্লাহর অবাধ্য বান্দাগুলো বড় নিষ্ঠুরভাবে আমার অস্তিত্বকে ধূলোয় মিশিয়ে দেওয়ার দু:সাহসিক অপতৎরতায় লিপ্ত হয়।

ধর্মভীরু পারস্যবাসীরা একসময় বেবিলিয়ানদের পরাজিত করে ফিলিস্তিনের দখল নিলে পুনরায় আমার নির্মাণ এবং সংস্কার সাধিত হয়।

তবে তাদের পরই বারবার ফিলিস্তিনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে থাকে। আমিও নতুন নতুন শাসকের অধীনে এসে কখনো নির্দয়রকম ধ্বংস, কখনো পরম ভালোবাসায় নির্মিত ও সংস্কার সাধিত হতে থাকি। এসব ঘটতে থাকে ৭০ খৃস্টাব্দের দিকে শহরে রোমানদের অধীনে বিদ্রোহ ঘটার মধ্য দিয়ে।৩১৫-৩২৫ খৃস্টাব্দের দিকে রোমান শাসক কনসটেনটিন যখন খৃষ্টবাদে দীক্ষিত হলো, রোমান জাতি এবং রোমানদের অধীনস্থ অন্যান্য জাতিবর্গ এমনকি ইহুদিরাসহ কেউই আর আমার প্রতি তেমন শ্রদ্ধাশীল রইলো না।

ইবাদত-আরাধনা ও নিবেদনের জায়গা হিসেবে তাদের মনে আমার আর কোনো স্থান রইলো না। বরং শহরবাসীর ময়লা-আবর্জনা ফেলার রীতিমতো একটা ভাগাড়ে পরিণত হলাম আমি।

নিত্যব্যবহার্য একটা জিনিস কিছুদিন ব্যবহারের বাইরে রাখলে তাতে যেমন মরচে পড়ে, নিজস্ব রূপ ও জৌলুস হারিয়ে আবেদনহীন হয়ে পড়ে; আমার অবস্থাও দাঁড়ালো তেমন একটা গুরুত্বহীন বস্তুর মতোই। প্রতিনিয়ত খোদাপাগল বান্দাদের জিকিরে গমগম করতে থাকা, তাদের কোলাহলে মুখরিত হতে থাকা আমি যেনো নির্জীব এবং প্রায় অঘোষিত নিষিদ্ধ এলাকায় পরিণত হলাম।

বিশ্বমানবতার ত্রাণকর্তা ও আমার রক্ষক

আমার এ অধপতিত অবস্থা কছু ব্যতিক্রম ছাড়া বহাল রইলো আরবের মরুতে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু অঅলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন পর্যন্ত। তিনি আগমন করলেন বিশ্বমানবতার ত্রাণকর্তা হিসেবে। আমারও রক্ষক এবং পুনরুদ্ধারকারী হিসেবে।

নানা কারণে নবীজী মুহাম্মাদের জীবনে আমি একটি গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ স্থান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছি বারবার। প্রথমত আমি ছিলাম তাঁর পূর্ববর্তী অসংখ্য নবী-রাসূলের আবাসস্থল। তাদেরই উত্তরসুরী হিসেবে তিনি পৃথিবীর বুকে পা রেখেছিলেন।

ইসলাম তো নতুন কোনো ধর্মমত নয়। বরং পৃথিবীর শুরু থেকে চলে আসা দ্বীনে এলাহিরই পরিপূর্ণ এবং সর্বশেষ সংস্করণ।

ইসলাম সে ধর্মেরই সর্বশেষ ধারা যে ধর্মের প্রচারে আদিষ্ট হয়েছিলেন এবং জীবন কুরবান করেছিলেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম, নূহ আলাইহিস সালাম, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, মুসা আলাইহিস সালাম, দাউদ আলাইহিস সালাম, সুলাইমান আলাইহিস সালাম এবং ঈসা আলাইহিস সালামসহ শত-সহস্র নবী-রাসূল।

তাছাড়া হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তান হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

প্রথম কেবলা

নবীজী মুহাম্মাদের হিজরতের প্রথম দু’ বছর পর্যন্ত আমিই ছিলাম মুসলিমদের নামাজের দিক নির্ণয়ের কেন্দ্র তথা কেবলা। ইসলামের প্রথম কেবলা।শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদের জীবনে আমার তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠার সবচে’ বড় কারণ ছিলো মেরাজের ঘটনা। মহিমান্বিত সে রাতে তিনি আমার বুকেই সকল নবী-রাসূলের ইমামতি করেছিলেন এবং সপ্তাকাশ-জান্নাত-জাহান্নাম এবং সবশেষে আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হয়েছিলেন।

মেরাজের ঘটনা

ইসলামের তখনও সূচনাকাল। মক্কায় এক রাতে নবী মুহাম্মাদ গেলেন কাবা যিয়ারতে। নামাজ-জিকির শেষে কাবাচত্বরেই একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এলেন এবং তাকে নিয়ে জেরুসালেমের পথে রওয়ানা হলেন। কাবা আর আমার তখনকার সময়ের হিসেবে সাধারণ দূরত্ব ছিলো কমপক্ষে চল্লিশ দিনের। এরপর তিনি সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়লেন এবং আকাশপানে যাত্রা করলেন।

তাঁর এ যাত্রায় বাহন ছিলো রফরফ আর বোরাক নামের আল্লাহর বিশেষ নেয়ামতপ্রাপ্ত দুটো প্রাণী, যাদের গতি ও ক্ষিপ্রতা ছিলো অকল্পনীয়।

মেরাজের সে রাতের যাত্রা এতোটাই মহিমান্বিত ছিলো যে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনেই এর বর্ণনা প্রদান করলেন। সাধারণ এক জড়বস্তু হওয়া সত্ত্বেও আমার নামটাও সে সূত্রে কুরআনের সোনালী অক্ষরে চির দিনের মতো অম্লান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করলো।

আল্লাহ সুরা বণী ইসরাইলে বর্ণনা পেশ করলেন-

‘মহান সে স্বত্তা যিনি তার বান্দাকে এক রাত্রে ভ্রমণ করালেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্বসার পথে, যে মসজিদের চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি। তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয় তিনি উত্তম শ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা।’

ইসলামের শাসন

নবীজী মুহাম্মাদের ইন্তেকালের অল্প কিছুদিন পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর জেরুসালেম শহরটি শান্তিপূর্ণভাবে এবং কোনোরকম রক্তপাত ছাড়া নিজের অধীনে নিয়ে নিতে সক্ষম হলেন। চল্লিশ হাজার সাহাবা তখন জেরুসালেম উপস্থিত ছিলেন। জেরুসালেম বিশেষত আমাকে উদ্ধারের জন্য তারা সিরিয়া হয়ে এখানে এসেছিলেন। তৎকালীন খৃস্টান যাজক জীবন-সম্পত্তি এবং শহরের নিরাপত্তার শর্তে হযরত উমরের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণের অঙ্গীকার করলে তিনি তা মেনে নেন। কোনোরকম রক্তপাত ছাড়া জেরুসালেম এবং সাথে আমাকেও তিনি উদ্ধার করলেন।

হযরত উমরের বাহ্যিক গঠন এবং ব্যক্তিত্ব এতোটাই প্রভাবক ছিলো যে তাকে দেখামাত্র সমগ্র শহরবাসী তার অধীনতা এবং ইসলামের শাসন মেনে নেয়। জন্মলাভের শুরুর দিন থেকে যে সৌভাগ্য বরণের জন্য অধীর আগ্রহে প্রহর গুণছিলাম, মেরাজের রজনীতে সে সুসংবাদের নিশ্চয়তা পেয়ে আপ্লুত হয়েছিলাম, অবশেষে সেই মহান দিন আমার দুয়ারে এসে হাজির হলো। সৃষ্টির শুরু থেকে চলে আসা দীনে হানিফের পূর্ণাঙ্গ রূপ ইসলামের অধীনতা এবং শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মতের স্মারক ও ইবাদতগাহে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমার স্বপ্নের ষোলকলা পূর্ণ হলো। পবিত্র কাবা এবং মসজিদে নববীর পর তৃতীয় স্থাপনা হিসেবে অসীম এক সৌভাগ্যের দূত আমি হতে পারলাম

মেরাজের রাতে নামাজ

৬৩৭-৬৩৮ হিজরীতে হযরত উমর যখন জেরুসালেম এসে পৌঁছলেন, আমার বিদ্যমানতা স্বত্ত্বেও নামাজ পড়ার মতো কোনো জায়গা বা ব্যাবস্থা সেখানে ছিলো না। আমাকে তিনি দেখতে পেলেন রোমানদের নিদারুণ অবজ্ঞা, স্থানীয় ইহুদি-খৃস্টানদের চরম উপেক্ষা ও অবহেলায় ফেলে রাখা প্রায় ময়লার ভাগাড় হিসেবে পরিত্যক্ত এক জায়গা হিসেবে।

আল্লাহর নির্দেশে তৈরি এবং হাজারো নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত একটি মসজিদের এহেন হালত দেখে তিনি নিজ হাতে ঝাড়– তুলে নিলেন। আমার চত্ত্বরের চারপাশটা পরিষ্কার করলেন উপস্থিত সাহাবাদের সহায়তায়। এরপর বিজ্ঞ সাহাবাদের মতামত নিয়ে ঠিক সেখানে নামাজে দাঁড়ালেন, যেখানে দাঁড়িয়ে নবীজী মেরাজের রাতে নামাজ পড়েছিলেন।

তাঁর উঁচু লয় ও ভরাট কণ্ঠে সুরা সাদ তেলাওয়াত করলেন, গাম্ভীর্য-শ্রদ্ধা-ভয় ও ভালোবাসা মেশানো এমন তেলাওয়াত এরপর আর কখনো আমার শোনা হয় নি।

ছোট্ট একটা ঘটনা

এ সময় ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটলো। মজার তবে তাৎপর্যপূর্ণও। সাহাবাদের সাথে ইহুদি থেকে ইসলাম গ্রহণ করা এক নওমুসলিমও মদীনা থেকে এসেছিলেন। হযরত উমর যখন আমার চত্তরের ঠিক কোথায় নামাজের জন্য জায়গা বানানো যায় এ নিয়ে পরামর্শ করছিলেন, ক’াব আল আহবার নামের সে নওমুসলিমটি বললেন- এটা আমার পাথর নির্মিত মূল অংশের পেছনে হলে ভালো হবে। তাতে পুরো জেরুসালেম আপনার সামনে থাকবে। উমর রা. তৎক্ষণাৎ ভুলটা ধরে ফেললেন।

একটু রেগেই বললেন- তুমি কি এখানে তোমার ইহুদি মতবাদের গোলামি করতে এসেছ? এটা বললেন কারণ, ওভাবে মসজিদ বানালে মুসল্লিদের সামনে প্রথমে আমি তারপর থাকতো কাবা শরীফ। দুটোকেই কেবলা হিসেবে মেনে নেওয়ার একটা ব্যাপার সামনে চলে আসতো, যা অবাস্তব। অনুচিত। কেবলা তো একটাই। তাই তিনি এমনভাবে মসজিদটি বানাতে বললেন যাতে শুধু কাবাই মূল এবং একমাত্র কেবলা থাকে। আমি নিজেই ছিলাম এসবের নির্বাক এবং একইসাথে গৌরবান্বিত সাক্ষী।

আমার চারপাশে বসবাসরত ইহুদি এবং খৃস্টান উভয় জাতিই হযরত উমর ও মুসলিমদের আগমনে এবং ইসলামের অনুশাসনে প্রীত হয়েছিলো। ইসলাম তাদের মুক্তিসনদে পরিণত হয়েছিলো।

ডোম অব দ্য রক

ডোম অব দ্য রক
ডোম অব দ্য রক

৬৯১-৬৯২ খৃস্টাব্দে খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান ডোম অব দ্য রকের নির্মাণ শুরু করেন। অস্তিত্বে আসার পর থেকে নিয়ে আমার শরীরে এখনো পর্যন্ত যা সবচে’ বড় এবং বাহারি সংযোজন। দৃষ্টিনন্দনও।

অনেকে তো ভুল করে সোনালী গম্বুজাকৃতির এই স্থাপনাকেই মূল আকসা মসজিদ মনে করে।

যে জায়গা ও পাথরের ওপর থেকে মহানবীর আকাশযাত্রা তথা মেরাজ শুরু হয়েছিলো, যেখানে হযরত উমর নামাজ পড়েছিলেন, সেখানেই এই ডোম অব দ্য রক নির্মিত হয়। মহামূল্যবান সব পাথর, ধাতু ও সোনা-রোপার মিশেলে। কথা হলো, কোন পাথরের ওপর কখন কার হাতে নির্মিত হলো সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাতে বিশেষ কোনো তাৎপর্যও নেই। তবে যেহেতু আমার নির্দিষ্ট এরিয়ার ভেতরেই এটি নির্মিত হয়েছে সুতরাং এটা আমারই অংশ।

কিছুটা অনুজ্জ্বল ছাই কালো পাথরের মূল অংশ আর সোনালী বর্ণের এই চোখ ধাঁধানো অংশ এই দুটো মিলেই আজকের আমি বা মসজিদে আকসার অস্তিত্ব

ক্রুসেড

প্রথম ক্রুসেডের সময় ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমদের হাত থেকে আমার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের হাতে। কী বলবো সেদিনের কথা? এমন নৃশংস হত্যাকা- বা রক্তের হোলি খেলা বিশ্ব কি দেখেছে কখনো? আল্লাহর ঘর মসজিদকে পাশে ফেলে যেভাবে এবং যে পরিমাণে ওরা মুসলিম নিধনে মেতে ওঠেছিলো ইতিহাস কি পারবে সেসব ভুলে যেতে?

বাইরের কথা তো বাদই দিলাম- ওরা ঘোষণা দিয়ে হাজার হাজার মুসলিমকে মসজিদে জমা করেছে। এই যে আমার চত্বরটা জেরুসালেমের বিশাল অংশজুড়ে ছড়িয়ে আছে, ওরা যখন ঘোষণা দিলো সাধারণ মুসলিমদের কাউকে ওরা বন্দী বা নির্যাতন করবে না- তো এই চত্বরেই আশ্রয়ের খোঁজে জড়ো হয় শিশু-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজারো মুসলিম।

একটুও দ্বিধা না করে, আল্লাহর ভয়-ডরের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে অসহায় নারী-পুরুষ-শিশুদেরকে ওরা আমার পবিত্র চত্বরেই খুন করে। রক্তে ভেসে যায় আমার পুরো আঙিনা।

বর্বরতার এমন দিন ইতোপূর্বে আমার জীবনে আর আসে নি। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর আমি শুধুই এক প্রাসাদে পরিণত হলাম, রাজ-রাজা বা বিশপরা যেগুলোকে নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহার করে।

আমার মূল অংশের নাম বদলে ওরা রাখলো সোলোমান’স টেম্পল, যা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম নিজেও রাখেন নি। ডোম অফ দ্য রকের নাম রাখলো ‘টেম্পলাম ডুমিনি’ বা প্রভুর ঘর।

আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান নির্মিত এই মসজিদটিকে ওরা খৃস্টান চার্চে পরিণত করলো। চত্তরের কিছু অংশকে ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করা হলো। পরবর্তীতে যা বর্বর নাইট টেম্পলারদের হেড কোয়ার্টারে রূপান্তরিত হয়।

আল্লাহর ইবাদতগাহের এমন করুণ পরিণতি ইতোপূর্বে হয়েছে?

টানা ৮৮টি বছর এমন হালতেই আমার দিন গুজরান করতে হয়েছে। কী-ইবা করার ছিলো আমার এ ছাড়া! অবশেষে আল্লাহ তাঁর এক বিশেষ বান্দাকে পাঠালেন। বীর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ঠিক নব্বই বছরের মাথায় আমাকে উদ্ধার করলেন চরমতম জিল্লতির হাত থেকে। সাথে জেরুসালেমকেও মুক্ত করলেন জালেমদের কবল থেকে।

হযরত উমরের রা. জেরুসালেম বিজয়ের তিন শতাব্দী পর তাঁর মতো করেই তিনি জেরুসালেমকে উদ্ধার করলেন। না কোনো সাধারণ মানুষ, না কোনো সেনা- কারো গায়েই কোনো আঘাত না করে। সম্পূর্ণ বিনা রক্তপাতে।

কোনোরকম প্রতিশোধ পরায়ণতা ছাড়াই। অথচ কিছুকাল পূর্বেই তার নিজের ভাইদের রক্তে জেরুসালেমের জমিন ভেসে গিয়েছিলো। তিনি পূর্বসুরীদের সুন্নাহের অনুসরণ করলেন। প্রকৃত আল্লাহভীরু মুমিনের পরিচয় দিলেন। বুকে পাথর চেপে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলেন মানবতাকে।

আমার জন্য হযরত উমরের মতো বিশেষ কাজটাও তিনি করলেন। নিজ হাতে নোংরা প্রাঙ্গন ও ভেতরের অংশ পরিষ্কার করলেন। ক্রুসেডার ও নাইট টেম্পলারদের বানানো টয়লেট এবং খাদ্য গুদাম অপসারণ করলেন। দামি কার্পেটে ফ্লোরটি আচ্ছাদিত করলেন। নিজ হাতে পবিত্র ও সুগন্ধী গোলাপজল ছিটিয়ে দিলেন আমার পুরো অস্তিত্বজুড়ে।

আল্লাহর রহমত আর তাঁর এক প্রিয় বান্দার অবাক ভালোবাসায় আমি আরো একবার স্নাত হলাম।

শিক্ষা-দীক্ষা ও ভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ

হযরত উমরের পর আরো একবার আমার এবং জেরুসালেম শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর মুসলিম জাতি একে পরিণত করলেন নিরাপত্তা, শান্তি, ন্যায় ও প্রগতির এক বিরল কেন্দ্রে। আমি নিজে পরিগণিত হতে থাকলাম শিক্ষা-দীক্ষা ও ভ্রাতৃত্বের অনন্য বন্ধনের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে। সারা বিশ্ব থেকে মানুষ ছুটে আসতে লাগলো আমাকে আর নবীদের পুণ্যভূমী জেরুসালেমকে ধন্য করতে।

ক সময়ের পবিত্র কিতাবের অনুসারী হিসেবে গোটাবিশ্বের মুসলিমদের মতো ইহুদি-খৃস্টানরাও পেলো যথাযথ মর্যাদা ও নিরাপত্তা। আট শতাব্দীর এমন লাগাতার সম্মান ও গুরুত্ব অতীতে কখনো জোটেনি- না আমার কপালে, না জেরুসালেমের।উমাইয়া খলিফাগণ নিজেদের পুরা শাসনকালজুড়ে আমাকে এবং জেরুসালেমকে আশ্চর্য সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রেখেছেন।

শহরের পরিচালক হিসেবে বরাবরই মুসলিমরা এ দিকে খেয়াল রেখে গেছেন। নিজেদের মর্যাদা এবং সদ্ভাাবের কারণে ইহুদি-খ্রিস্টানদের জন্যও আমার দরজা তারা উন্মুক্ত রেখেছেন। যাই হোক, সুসময়ের কথা বলে তো শেষ করা যায় না।

ঐশ্বর্যময় কাল খুব দ্রুত ফুরোয়, রেখে যায় অনেক স্মৃতি আর অনিঃশেষ দুঃখ। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটলো না।

ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র

সবকিছুই একসময় বদলায়। পট পরিবর্তিত হয়। ভালো সময়ের পর খারাপ সময় আসে, দিনের পর যেমন রাতের আঁধার। আমার সৌভাগ্যের চাকাও একদিন উল্টো ঘুরতে শুরু করলো, ইউরোপে থাকা জায়োনিস্ট মুভমেন্ট বা ইহুদি আন্দোলন যখন দাবি ওঠালো মুসলিম ফিলিস্তিনে তারা নতুন এক ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করবে।

তারা কিছুই ছিলো না, তবে তাদের ছিলো নিঃশর্ত পশ্চিমা সমর্থন। বিশেষত বৃটিশদের। রাষ্ট্রের স্বার্থে যারা ধর্মকে জলাঞ্জলি দিতে পারে, নিজেদের প্রয়োজনে অন্য দেশগুলোকে পারে নরকখণ্ডে পরিণত করতে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উমাইয়া খিলাফতের পরাজয়ের বিপরীতে জায়োনিস্ট মুভমেন্ট শক্তিশালী হলো। আট শতাব্দী পর ফিলিস্তিনে মুসলিম শাসনের পরিবর্তে বৃটিশ ম্যান্ডেড জারি হওয়ার মধ্য দিয়ে ইহুদিরা নতুন স্বপ্নে বিভোর হওয়ার সুযোগ পেলো।

১৯১৭ সালে সেখানে পৌঁছে ৯০ ভাগ আরব আর মাত্র ৫৬ হাজার ইহুদি অধ্যুষিত ফিলিস্তিনে স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মিশন শুরু করলো। বৃটিশ শাসনাধীন জেরুসালেমে কেবল আমার ওপরই মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণ ওরা অনুমোদন করেছিলো।

এরও বছর কয়েক পর আমার দেখভাল ও নিরাপত্তার দায়ভার কিছু শর্তে জর্ডানের বাদশাহর হাতে ন্যাস্ত করা হয়।

চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ

১৯৪৮ সালে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনের ভাগ্য জাতিসংঘের হাতে ছেড়ে দেয়। ৬ ভাগেরও কম ভূমির বাসিন্দা ইহুদিদের নামে ৫৪ ভাগ জমিন বরাদ্দ দিয়ে স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করলে আরব ফিলিস্তিনিরা তা প্রত্যাখ্যান করে। তবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো।

সে বছরই পশ্চিমা ষড়যন্ত্র, ইহুদিদের সন্ত্রাসী কর্মকা- এমনকি আত্মঘাতি হত্যাযজ্ঞ এবং পরে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সুযোগে আটাত্তুর ভাগ ভূমির জবরদস্তিমূলক দখলের মধ্য দিয়ে ইহুদিরা নিজেরাই ইসরায়েল নামে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। জেরুসালেমের প্রায় ৮৫ ভাগ জমিন তারা দখল করে নেয়।

র্জডানের নেতৃত্বে বাকি আরবের নিয়ন্ত্রণ তখন কেবল পশ্চিম তীরে, পূর্ব জেরুসালেমের মাত্র ১১ ভাগ জমিন তাদের আওতাধীন ছিলো- পুরনো জেরুসালেম এবং আমিও যার অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ১৯৬৭ সালে আরো একটি যুদ্ধের সুযোগে ইসরায়েল পূর্ব জেরুসালেমও দখল করে নেয়। ইসরাইলের সীমানাকে আরো বর্ধিত করে পুরো জেরুসালেম এবং আমাকেও ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে।

সবরকম বিধিনিষেধ আর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আজ এখনো পর্যন্ত এই উদ্ভট দাবি থেকে ইসরাইল সরে আসে নি।

জেরুসালেমের এই দখলদারিত্বের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং স্থানীয় আরব মুসলিমদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ইসরাইলি সরকার এরপর শুধু আমার নিয়ন্ত্রণটুকু মুসলিমদের অধীনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অন্তত কাগজে-কলমে।এতোসবের পরও আমার চত্বরের ভেতরেই ইহুদিদের জন্য একটি ইবাদতগাহ নির্মাণের ইসরাইলি পদক্ষেপের অপচেষ্টা করা হলে মুসলিমদের প্রতিরোধে তা মুখ থুবড়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আইন পাস করতে বাধ্য হয় যে, আমার নির্ধারিত চত্বরের ভেতর ইহুদি কোনো স্থাপনা ইসরাইল সরকার করতে পারবে না। তবে ইহুদি এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকেরা পশ্চিম গেট দিয়ে কেবল ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে।১৯৬৭ সাল থেকেই ইসরাইলি নেতৃবর্গ বরাবর চেষ্টা করে এসেছে আমার চত্তরে ইহুদিদের ইবাদতের ব্যবস্থা করে দিতে। ইসরাইলের সমর্থক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন আমার একাংশে ইহুদি ইবাদতগাহ নির্মাণের পক্ষে তাদের দাবি-দাওয়া প্রচার এবং জনমত গঠনে লেগে আছে।

১৯৬৯ সালে কট্টরপন্থী ইহুদিদের ইন্ধনে দ্যানিস মাইকেল রোহানের লাগানো এক অগ্নিকাণ্ডে আমার একটি মিম্বর পুড়ে যায়। ধর্ম পরিচয়ে সে ছিলো খৃস্টান। পরে তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়- সে বিশ্বাস করতো মুসলিমদের হাতে নির্মিত ও সংস্কারকৃত মসজিদে আকসা পুড়িয়ে দিলে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পৃথিবীতে পুনরাগমন ত্বরান্বিত হবে। ইহুদিরা নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী সেখানে ধর্মীয় কেন্দ্র বা উপাসনালয় বানাতে পারবে, ফলে জেরুসালেমের বিরোধ মিটে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।…

ব্যক্তি যে ধর্মেরই হোক, অগ্নিকাণ্ডের ধরন যেমনই হোক পুরো ব্যাপারটায় যে ইহুদিদের যোগসাজশ ছিলো পরবর্তী বছরগুলো তা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যাই হোক, সে মিম্বরটি বিশেষ যত্নে নির্মাণ করেছিলেন বীর মুজাহিদ সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ.। অনন্য সৃজনশৈলী নিয়ে বিশ্বের সুন্দরতম স্থাপতের একটি ছিলো এটি। সীডরসহ দুষ্প্রাপ্য সব গাছের দশ হাজার কাঠের টুকরো, হাতির দাঁত এবং ঝিনুকের সংমিশ্রণে এক ফোঁটা আঠা বা একটামাত্র তাঁরকাটার ব্যবহার ছাড়াই এটি তৈরি করা হয়েছিলো আশ্চর্য এক কুশলতায়। পুরো পৃথিবীতেই যা ছিলো বিরল। আগের মতো না হলেও এর সাধারণ মেরামত করার জন্যও সময় লেগে গিয়েছিলো বিশ বছর। প্রয়োজনীয় আসবাবের অপ্রতুলতা এবং দখলদার ইসরাইলের বাধার কারণেই।

ফিলিস্তিনে ইন্তিফাদা

অগ্নিকাণ্ডের দায় পুরোপুরি অস্বীকার করলেও পুনঃনির্মাণে বরাবর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তারা নিজেদের দ্বান্দ্বিক ও স্বার্থপূর্ণ অবস্থানকেই স্পষ্ট করে তুলেছিলো। ১৯৮৭ সালে চারজন ফিলিস্তিনি নাগরিককে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে জেরুসালেমসহ পুরো ফিলিস্তিনে ইন্তিফাদা শুরু হয়

ফিলিস্তিনের ইতিহাসে এটাই প্রথম ইন্তিফাদা বা জনসাধারণের কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে তোলা গণঅভ্যুত্থান। উদ্দেশ্য একটাই- আমাকে মুক্ত করা। ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা।

২০০০ সালে তৎকালীন ইসরাইলী প্রেসিডেন্ট এ্যারিয়েল শ্যারন এক হাজার নিরাপত্তারক্ষী এবং পুলিশ বাহিনীর বিশাল বহর নিয়ে আমার আঙিনায় উপস্থিত হয়। এর প্রেক্ষাপটেই সূচনা ঘটে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার।

প্রথমবারের মতো এবারও ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে নেমে আসে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা- কর্ম প্রত্যাহার, খাদ্য সরবরাহে বাধা ইত্যাদি অমানবিক সব নিপীড়ন। তবে এসবের চেয়েও কঠোর ব্যাপার ছিলা- আমার বুকে এবং চত্বরজুড়ে তাদের নামাজ ও ইবাদত বন্ধ করে দেওয়া। বিশেষ করে ১৮-৫০ বছর বয়সী ফিলিস্তিনিদের আমার চত্বরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। ঘোষণায় দিন-রাতের বিশেষ কিছু মুহূর্ত বলা হলেও সেটা মূলত সর্বক্ষণের জন্যই এবং অঘোষিতভাবে আজও সমানভাবেই কার্যকর হচ্ছে।

২০১৩ এর নভেম্বরে ইসরাইলের পার্লামেন্টে একটি বিল পাস হয়, যেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিদেরকেও আমার চত্বরে ইবাদতের অনুমতি প্রদান এবং ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালের পর থেকে কট্টর ইহুদিদের লাগাতার লবিংয়ের সুস্পষ্ট ফসল ছিলো এই বিল। এরপরই এক বছরের সময় হাতে নিয়ে ২০১৪ সালের অক্টোবরে হঠাৎ তারা আমার সবগুলো গেট বন্ধ করে দেয়। ফিলিস্তিনি জনতা এবং বিশ্বমুসলিমের প্রবল প্রতিরোধের মুখে যদিও তারা সে অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়, তবে অপচেষ্টা তো থেমে নেই।

এর আগে ২০১৩ সালের মার্চে জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে জেরুসালেমের পবিত্র স্থাপনাসমূহ বিশেষ করে আমার যত্ন-আত্তি, সংস্কার এবং তদারকির দায়িত্ব ভার গ্রহণের জন্য বিশেষ এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এখনো পর্যন্ত কাগজে-কলমে হলেও সে দায়িত্ব তাদের হাতেই ন্যাস্ত এবং তারা যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়েই সেটা পালনের চেষ্টা করে যাচ্ছে

আর কতোকাল অপেক্ষা করবো একজন উমরের জন্য? একজন সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর জন্য?

জটিল এক সমীকরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবী এখন ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে। আমার অবস্থাও তাই তথৈবচ। আগে সবই হতো খোলাখুলি। প্রেমকে প্রেম, ঘৃণাকে ঘৃণা হিসেবে সহজেই আলাদা করা যেতো। আজকাল সেটা করা যায় না। জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলি বা ঘরোয়া হালচাল, কোথাও আর কিছু সোজা-সাপ্টা নেই। কোনটা সত্য কোনটা মেকি, কোনটা বাস্তব কোনটা অভিনয় আমার পক্ষে ঠাহর করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

এইটুকু শুধু বুঝি, আমি সত্যিকার খোদাপ্রেমীদের অধীনে নেই। আমার চারপাশে প্রতিমুহূর্তে রহস্যের খেলা চলে। কোনোটাই আমার পক্ষে নয়। আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের অনুকূলেও নয়। আমার এবং জেরুসালেমের জন্য সত্যিকার একজন অভিভাবক দরকার। লড়াকু বীর দরকার। এক হাজার বছর তো পেরুলো। আর কতোকাল অপেক্ষা করবো

একজন উমরের জন্য? একজন সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর জন্য? আর কতোকাল??…

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *