মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. আলোকিত জীবন সংগ্রামী নেতৃত্ব by শাকিল আদনান
অর্পণ
নদী যতো বড় হয়, স্রোত ততোই আড়ালে পড়ে যায়। অদৃশ্য স্রোতের বড় নদীর মতো তারাও হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি মুসলমানের পরম নির্ভরতার আশ্রয়। খুঁড়িয়ে হলেও আমাদের আজকের এই যে এগিয়ে চলা- এর ভিত নির্মাণ ও পথ তৈরির কাজটুকুও তো তারাই করে গিয়েছিলেন। দাওয়াহ ও রাজনীতি এবং শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা- ইসলামের এই সামগ্রিক পাঠ আর দিকহারা উম্মাহর দায়িত্ব নিজ গরজে তারা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সামলে রেখেছিলেন এবং এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কাছে আমাদের আজন্ম ঋণ-
মুজাহিদে আজম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.
আমীরে শরীয়ত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.
মুফতি আমিনীর বড় হওয়া, গড়ে ওঠা সবই তাদের ছায়ায় এবং ছোঁয়ায়। জীবনের প্রতি মুহূর্তের মতো নিজের সকল কাজেও তিনি এই মুরব্বিদ্বয়কে সামনে রাখতেন, স্মরণ করতেন। আমার অযোগ্য হাতে করা কালের মহানায়ক মুফতি আমিনীর এই জীবনীগ্রন্থটি তার ও আমাদের এই দুই মহান মনীষীর নামেই অর্পণ করছি। আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করুন।
-শাকিল আদনান
‘কিতাব যদি পড়তে হয়, আমিনীর মতো পড়ো। ছাত্র যদি হতে হয়, আমিনীর মতো হও। আল্লাহর কুদরতি পায়ে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলেই কেবল কামিয়াবির খানিকটা মিলতে পারে। আমিনীকে দেখে তোমরা সবক নাও।’
-মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ (হাফেজ্জী হুজুর) রহ.
লেখকের নিবেদন
পরদিন ইতিহাস পরীক্ষা। রাজ-রাজাদের গল্প পড়ে রাতে তাই শাহী মেজাজে ঘুমুতে গেলাম। পরীক্ষার টানা ধকলে ঘুমও এলো চটজলদি। সেদিনই ছিলো আবার বহুল আলোচিত ত্রৈবারো’র [১২/১২/১২ইং] সমাহার। ইতিহাসের এমন বর্ণিল পাতায় সমকালের সবচে’ কালো অধ্যায়টি যোগ হতে যাচ্ছে, কে কল্পনা করেছিলো? সাইলেন্ট করা মোবাইল আমার সারারাত কাঁদলো। কাঁদলো শীতের আকাশ। হতচ্ছরা আমিই কেবল অচেতন ঘুমে। বজ্রপাত হলে যেমন বিভীষিকা তৈরি হয়, সকালবেলা আমার অবস্থাও হলো সেরকম। মুফতি আমিনী আর নেই। আমাদের এতিম করে তিনি মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। চিরদিনের জন্য। কোথাও, কখনো আর তাকে পাওয়া যাবে না। পল্টন বা বায়তুল মোকাররমে কুরআন হাতে তিনি আর গর্জে উঠবেন না। লালবাগে তার ভরাট কণ্ঠ থেকে আর শোনা যাবে না হাদীসের বাণী। বক্তৃতার মঞ্চে তিনি আর ঝড় তুলবেন না। গুরুগম্ভীর বয়ানে তোলপাড় করবেন না কারো হৃদয়। জিকির আর দীর্ঘ কান্নায় দোলাবেন না কোনো মজলিস। কী করে মেনে নিই, কী করে বিশ্বাস করি! তবু, সেদিন সকালে সব ছাপিয়ে আমার ভেতরে জেগে উঠেছিলো দুটো অসমাপ্ত গল্পের থিম। নিরেট স্বার্থপরের মতো। এককালে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে প্রবল বিতৃষ্ণ ছিলাম। সঙ্গত কারণেই এক্ষেত্রে তার প্রতিও কিছু অভক্তি কাজ করেছে। ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। তবে অভক্তির সে দায় শোধরাবার সুযোগ পেলাম কই? নানা কাজে কাছে না হলেও কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে অনেকবার। দীর্ঘ একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। পারলাম না তো। পরীক্ষার সকালে হাতে আমার বই উঠলো না। স্মৃতি আওড়ালো না নাম-সনের হিসেব। শোকের দহনে, অপরাধবোধের ক্ষরণে মিইয়ে রইলাম পুরোটা সময়। মহাকাল বুঝি এভাবেই প্রতিশোধ নেয়?
ইন্তেকালের পরপর মুফতি আমিনীকে (রহ.) উৎসর্গ করে মাসিক নতুন ডাকের পক্ষ থেকে একটা স্মারক করেছিলাম। ম্যাগাজিন সাইজে প্রায় দু’শ পৃষ্ঠার হলেও বেশ অতৃপ্তি নিয়েই কাজটি সমাপ্ত করতে হয়েছিলো। অতৃপ্তি তাঁর সামগ্রিক জীবনের চিত্র হাতের নাগালে না পাওয়ায়, অতৃপ্তি বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মহান এই কর্মী ও কামিল পুরুষের জীবন ঠিকঠাকভাবে তুলে ধরার অক্ষমতায়। স্মারক প্রকাশের পর আমাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতির পাশাপাশি একই অতৃপ্তির ছাপ দেখেছি দেশ-বিদেশের অজস্র আমিনীভক্তের চোখে-মুখেও। পরের সময়টা আমার জন্য ছিলো অপেক্ষা আর একটা গোপন আকাঙ্খার। অপেক্ষা ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে মুফতি আমিনীর পরিপূর্ণ জীবনী হাতে পাওয়ার। আকাঙ্খা মহান সে খেদমতে কোনোভাবে নিজের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার। আক্ষেপের ব্যাপার- তিন তিনটি বছরেও না শেষ হয়েছে আমার অপেক্ষা, না বাস্তব রূপ পেয়েছে ব্যক্তিগত আকাঙ্খা। এই ভূমিকা এবং বাকি কৃতিত্বটুকু মাকতাবাতুল হেরার স্বত্তাধিকারী এবং ঢালকানগর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতি হাবীবুল্লাহ মিসবাহ ভাইয়ের। স্মারক দেখে তিনিই প্রস্তাবটি দিলেন। কিছু না ভেবে আমিও চ্যালেঞ্জটি নিয়ে ফেললাম। এরপর এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে সে চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে! এতো বিশাল একটা কাজ একা আঞ্জামের উদ্যোগ নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়- এটুকু যখন উদাহরণসহ বুঝেছি, তখন আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিলো না। পরেরটুকু শুধুই ইতিহাস। যাই হোক, মোটামুটিভাবে হলেও বিশাল ক্যানভাসের এই কাজটির সমাপ্তিরেখা অবশেষে টানতে পারলাম, আলহামদুলিল্লাহ। সকল শুকরিয়া মহান আল্লাহর।
লেখালেখির কাজ ও চরিত্রচিত্রণে অপূর্ণতার আক্ষেপ থাকেই। যথেষ্ট সময় ও পরিশ্রম ব্যয়ের পরও তাই আমারও কিছু, কিছু নয় যথেষ্ট আক্ষেপই রয়ে যাচ্ছে। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি যখন মুফতি আমিনীর মতো কেউ হন, বাস্তবতা এবং সতর্কতার জায়গাটা তখন সীমাহীন জটিল হয়ে সামনে আসে। আর সে জায়গা নিশ্চিত করা একা কারো কাজ নয়, সম্ভবও নয়। নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে এবং পরিচিত-অপরিচিত অনেকের সহায়তা নিয়ে আমি কেবল চেষ্টাটুকু করে গেছি। কতোটুকু হলো সেটা বিবেচনার ভার এখন আপনার হাতে। অপূর্ণতার সবটুকু দায় নিজের কাঁধে নিয়ে আমার পাশে থাকা, সাহায্য করা বা পাওয়া সকল চেনা-অচেনা ব্যক্তিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। স্মরণ করছি আমার নতুন ডাকের সব বন্ধু ও সহকর্মীকে, যাদের সঙ্গ ও সহযোগিতা ছাড়া এই কাজ করা সম্ভবই হতো না। শ্রদ্ধা রইলো মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) দেশ-বিদেশের অজস্র ভক্ত-শাগরেদ, বিশেষত তাঁর পরিবার ও দলের সম্মানিত সদস্যবৃন্দের প্রতি- যাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও তথ্যসহায়তা ছাড়া এই কাজ অধরাই থেকে যেতো। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী ভাইয়ের প্রতি, বইটির সংকলন ও প্রকাশনায় নিজের দোয়া ও পারিবারিক ইজাযত প্রদান করে আমাকে তিনি চির কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তাঁর ও মুফতি আমিনীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ওপর রহম করুন।
এই বই রচনার ক্ষেত্রে নতুন ডাক স্মারক সংখ্যাটিকেই ভিত্তি হিসেবে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি তথ্যসাহায্য নেয়া হয়েছে বড় কাটারা মাদ্রাসার বিশেষ স্মারক ডায়রি, জামিয়া ইউনুসিয়া, বি.বাড়িয়ার স্মারক ডায়রি, নবপ্রকাশের মুফতি আমিনী : জীবন ও সংগ্রাম, বড়দের ছেলেবেলা এবং মাকতাবাতুল হেরা, ঢাকার আকাবির সিরিজ থেকে। সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি রইলো আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। নতুন ডাক স্মারক সংখ্যার সম্পাদকীয়তে মুফতি আমিনীর ইন্তেকাল নিয়ে ক’টি কথা বলেছিলাম। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় সেখান থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি।
‘মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. বিদায় নিলেন বড় অসময়ে। বিশ্বাস থেকে নয়, অসময়ের প্রসঙ্গ উঠছে কারণ আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। ক’মাস আগেই চলে গেছেন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। তার বিদায়ের মঞ্চ প্রস্তুত ছিলো। আমরা কেঁদেছি, ভেঙে পড়িনি। মুফতি আমিনী তো আমাদের কান্নারও সুযোগ দেননি। তার ইন্তেকালে অনেককে বিভ্রান্ত হতে দেখেছি, এমনকি কাছের মানুষদেরও। তারা বলেছেনÑ‘হুজুর নিজেও বুঝতে পারেননি, তিনি চলে যাবেন’। আসলে সাময়িক এই আবেগের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। ইন্তেকালের দিন দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নির্ধারণের বৈঠক, ডিসেম্বরের শেষে গৃহবন্দিত্ব থেকে বেরুনোর প্ল্যান আপাত সে ধারণাকেই জোরালো করে। কিন্তু বিপরীত চিত্রও আছে। মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার আমল, বিশেষ করে মোনাজাতে কান্না উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ইন্তেকালের দিন তিনি রীতি ভেঙে জানাযা পড়ালেন। দুটো ক্লাস নিলেন একমাস পর। ক্লাসের আলোচনাগুলোও ছিলো যেনো ‘শেষ আর বিদায়ের’ আবহ সঙ্গীত। সুতরাং বুঝতে না পারার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। তবে?
ইন্তেকালের পর মুমিনের ইলম ও আমলের ধারা বন্ধ হয়ে যায়। মুফতি আমিনী সাহেবের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ছিলো নিশ্চয়ই। তাই তিনি আমল আর ইলমচর্চা বাড়িয়েছেন। শেষজীবনে বেশক’টি গুরুত্বপূর্ণ বইও লিখে গেছেন। এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত দিক বা নিজস্ব অর্জন। কিন্তু যে রাজনীতি ও আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন আজীবন, সেটা তার রাজনীতি বা তার আন্দোলন ছিলো না; ছিলো ইসলামের এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে কারো না কারো মাধ্যমে। তিনি চাননি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করে যেতে বা এমন কিছু বোঝাতে, যাতে তার ইন্তেকালের পর এ মহান আন্দোলন গতি হারায় বা থমকে দাঁড়ায়। হয়তো আল্লাহ পাকেরও তাতে সায় ছিলো। আমার উপলব্ধিতে তার শেষ জীবনের কার্যক্রম এ-ই মিন করে। এই সত্য তার কাছের মানুষেরা, আন্দোলনের সহকর্মীরা যতো দ্রুত ও ভালো করে বুঝবেন, ততোই মঙ্গল। একজন নেতার সার্থকতা এখানেই। নিশ্চয় এর মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকবেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.।’
শেষের আগে ছোট্ট অনুরোধ- চূড়ান্ত সতর্কতা সত্ত্বেও মানুষ হিসেবে আমাদের যে কোনো কাজে ভুল থেকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, নজরে এলে অনুগ্রহ করে আমাদের জানাবেন। পরবর্তী সংস্করণে অবশ্যই আমরা সেগুলো শুধরে নেবো, ইনশাআল্লাহ। সবাইকে শুভেচ্ছা।
-শাকিল আদনান
১৫/০২/২০১৭
প্রবাল, মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
অবতরণিকা
সমকালীন বাংলাদেশে ইসলামের স্বপক্ষে যে নির্ভীক কণ্ঠস্বরটি সবচে’ বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো, বাংলাদেশে ইসলামী কর্মসাধনার যে সামগ্রিক ও সমন্বিত রূপটি চোখে পড়ে এর সাহসী মুখপাত্র; বাংলাদেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ, তৌহিদী জনতার পবিত্র সংস্কৃতি, আলেম-ওলামা-পীর-মাশায়েখ- মসজিদ-মাদ্রাসা-খানকাহ ইত্যাদির অতন্দ্র প্রহরী মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. বিগত ১২ ডিসেম্বর ২০১২ রাতে মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে ইহজগত ত্যাগ করার পর থেকে এ দেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে যে ভয়ানক শূন্যতা নেমে এসেছে- সচেতন মানুষমাত্রই তা খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছেন। মনে হয়- ১৬ কোটি মানুষ যেনো অসহায় হয়ে গেছে। লক্ষ বক্ষ, কোটি কণ্ঠ মিলেও আজ একজন আমিনীর মতো হুংকার ছাড়তে পারছে না। মুফতি আমিনী কী ছিলেন তা সময়ই বলে দেবে। আমি কেবল এটুকুই বলবো যে, এমন যুগসচেতন সাহসী আলেম প্রতিদিন জন্মায় না। হাজার বছর অপেক্ষা করে পুষ্পকানন যেমন লাভ করে একটি চক্ষুষ্মান ফুল, তেমনই আমিনীর মতো সন্তান লাভ করতেও দেশের মাটিকে অপেক্ষা করতে হয় বহু যুগ।
প্রতিভাবান লেখক ও গবেষক, মাওলানা শাকিল আদনান (সম্পাদক, নতুন ডাক) মাওলানা মুফতি আমিনী রহ. এর জীবনী রচনা করেছেন। পাশাপাশি আধুনিক বাংলাদেশের আলেম, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের অভিমত, স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন সংগ্রহ করে তার রূহানী উস্তাদ, গুরু ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুফতি আমিনী রহ. এর ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন তৈরি করে ঈর্ষণীয় এ সময়টিকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।
পৃথিবীতে কেউই থাকে না। একদিন আমরাও থাকবো না। সত্য চিরন্তন। চিরন্তন মানুষের সাহস, দৃঢ়তা, নীতি ও আদর্শ। আগামি দিনে সত্যের সংগ্রামে, নীতির যুদ্ধে, আদর্শের লড়াইয়ে প্রতিটি প্রজন্ম অতীত দৃষ্টান্ত থেকে হাত বাড়ালেই যেনো আলো পেতে পারে, মহানায়কদের জীবন-কর্ম-অবদান ও লিগ্যাসি গ্রন্থিত করে রাখার এটিই উদ্দেশ্য। শাকিল আদনান এই কাজটিই করেছেন। আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আল্লাহ সবাইকে কবুল করুন।
–মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, স্বনামধন্য লেখক ও গবেষক।
সহকারী সম্পাদক- দৈনিক ইনকিলাব
মুসলিম জীবনের ঘোষণাপত্র- চিরন্তন বিধান by মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.
অবিচার, নির্যাতন আর বাতিলের রীতি-নীতি ও আইন সবখানেই মানুষকে কোণঠাসা করে রেখেছে সন্ত্রাস ও দাপটের জোড়ে। অশ্লীল কর্মকা- নিরাপদ আশ্রয়ে দৃষ্টিকে সংরক্ষণের অবকাশ দিচ্ছে না। চিন্তা-অনুভূতিকে দিচ্ছে না পালানোর সুযোগ। নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও ঘৃণ্য সন্ত্রাসের বাজার এখন উত্তপ্ত। প্রচার ও প্রকাশনার সমস্ত উপকরণ, বিনোদন ও সংস্কৃতির নাম বেচে বেচে চরিত্র হননের তাবৎ পথ উন্মুক্ত করেছে। এ প্রজন্মের যুবকদের হৃদয়-মগজ ধোলাই করে খোদাভীতি ও আখেরাতের ফিকিরও মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি আল্লাহ-রাসূলের নামটি পর্যন্ত মুছে ফেলার অপপ্রয়াস চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সকল পরিস্থিতির চাহিদা কি এটাই যে, আমরা আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে একদম নিরাশ হয়ে বসে থাকবো? হাত-পা নাড়ানো বন্ধ করে দেবো? এবং এ যুগেও ইসলামী আইনের সফল কার্যকারিতা সম্পর্কে মুখ খুলতে লজ্জা পাবো?
মনে রাখতে হবে, অতীত বর্তমানের পরিস্থিতি যতোই ভয়াবহ হোক বা হতে থাকুক, আমরা যে দীনের ওপর ঈমান এনেছি, সে দীনের দৃষ্টিতে হতাশা ও নৈরাশ্য রীতিমতো কুফরের বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্ব, তার পরিপূর্ণ কুদরত এবং তার সত্তা ও গুণাবলির ওপর ঈমান রাখে, অন্ধকার থেকে ঘোর অন্ধকার অবস্থাতেও নৈরাশ্যের গহ্বরে পতন তার জন্য অসম্ভব। কেননা দীনে ইসলামকে আল্লাহ আমাদের জন্য আইন ও বিধান হিসেবে মনোনীত করে ঘোষণা করেছেন- ‘আজ তোমাদের ধর্মকে আমি পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকে পূর্ণাঙ্গ এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম ইসলামকে’।
তা হলে কি আল্লাহ পাকের এ সত্য জানা ছিলো না, এমন এক দুঃসময় আসন্ন, যাতে এই দীনের বিধি-বিধানের ওপর আমল এবং সে বিধানকে প্রতিষ্ঠা করা দুষ্কর? জানা কথা, আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের প্রতি যে বিধান ও আইন অবতীর্ণ করেছেন, তা এই জ্ঞানসহই করেছেন যে, ভবিষ্যতে কী কী পরিস্থিতি আসবে এবং সেসব পরিস্থিতিতে দীনি আইনের বাস্তবায়নের উপায় কী হবে।
উভয় জাহানের সরদার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির যে তমাশাচ্ছন্ন যুগে এ পৃথিবীতে পদার্পণ করেছেন, তা কোনো মানুষের কাছেই অস্পষ্ট নয়। বর্তমান থেকে সহস্রগুণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো সে সময়ে ইসলামী বিধানের ওপর আমল করা। আল্লাহর নামটি নেওয়া ছিলো অপরাধ। আল্লাহর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর ঘরে সিজদা দিতে গিয়ে পিঠে নাপাক ভূরির স্তুপ নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিলো। নিছক পাথরের প্রভুত্বের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের অপরাধে সমগ্র জগতই তার রক্তপিয়াসী, প্রাণের শত্রুতে পরিণত হয়েছিলো। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো জীবন ধারণের তাবৎ উপায়-উপকরণের পথ পর্যন্ত। তথাপি সারওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার নিবেদিতপ্রাণ সাহাবায়ে কেরাম সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ইসলামের ওপর আমল করে দেখিয়েছেন এবং দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ইসলামী আইনের প্রাধান্য।
আজকের পরিস্থিতির নাজুকতা যতোই গভীর হোক, ইসলাম ও ইসলামের আইনের ওপর দৃঢ় থাকার সমস্যা ও ঝুঁকি নিশ্চয় ইসলামের প্রথম যুগের চেয়ে হাজার অংশে কম। আজ আমরা নামাজ রোজাসহ যাবতীয় ইবাদত অঞ্জাম দিতে পারি নির্বিঘেœ। কেউ বাধা দিতে পারে না। তা হলে কী এমন প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়িয়েছে যে, ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার দাবিতে আমাদের কণ্ঠ উচ্চারিত হতে পারছে না?
মনে রাখতে হবে, আজকের সব ধরনের নাজুকতার একটি মাত্র চিকিৎসা হলো ইসলাম ও ইসলামী আইন। মনগড়া বিধিবিধানের পৃথিবী ফুরিয়ে এসেছে, সংকীর্ণ হয়ে এসেছে তার অবস্থান ও বি¯িতৃতির পরিসর, সাথে সাথে প্রশস্ত হচ্ছে ইসলামী আইনের সুসময় এবং উপযুক্ত সময়। ইসলামী আইনের সার্বজনীনতা, কার্যকারিতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং তার সফলতা ও সুফলগুলোকে জাতির সামনে পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরার এবং এই পবিত্র ও কল্যাণময় আইন প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতি বলছে, এদেশ ঘুরে ফিরে একদিন ইসলামী আইনের দিকে আসবে। এ প্রসঙ্গে বুযুর্র্গানে দীনের ভবিষ্যদ্বাণীও রয়েছে।
আমি তো বরং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে এতোদূর পর্যন্ত বলতে চাই যে, ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশী সুধীবৃন্দ যদি শুধুমাত্র একদিনের জন্যও এক হয়ে যেতে পারেন, তবে সেদিনই এদেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য। কিন্তু নিতান্তই পরিতাপের বিষয় যে, ইসলামের শত্রুরা এই ভেদ উপলব্ধি করেই বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আমাদের মাঝে বিভেদের মহামারী ছড়িয়ে দিয়েছে এবং পরম উদাসীনতায় সে মহামারীর নিকৃষ্টতম শিকারে পরিণত হচ্ছি আমরা সবাই। সজাগ ও সতর্ক হওয়ার সময় এখনই। মানসিক দ্বন্দ্ব ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চোরাগলির পথ পরিত্যাগ করে শাহাদাতের জান্নাতি অনুপ্রেরণায় এখনই সবাইকে প্রস্তুত হতে হবে। একথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায় যে, ইসলামী আইন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ এক চিরন্তন ও শাশ্বত বিধান। দুনিয়ার যাবতীয় তন্ত্রমন্ত্রের সকল অপূর্ণতা ও দোষ ত্রুটি থেকে তা চিরমুক্ত ও চিরপবিত্র। এই ইসলামী আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া পৃথিবীতে আদ্ল-ইনসাফ ও প্রকৃত শান্তির প্রত্যাশা কল্পনাবিলাস ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কেননা ইসলামী আইন ও নীতিমালা মহাপ্রজ্ঞাময় সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা ও সূক্ষদর্শী রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত এক শাশ্বত পয়গাম। তথাকথিত কতিপয় বুদ্ধিজীবীর মস্তিষ্কপ্রসূত ধ্যানধারণা নয়। কোনো সংসদ বা এসেম্বলী নিরূপিত কিংবা কোনো ক্বওমের দিকপাল ও নেতা নির্ধারিত নিষ্ফল কল্পনা বিন্যাসও নয়। এবং ইসলামী আইন পাশ হওয়ার জন্য কোনো সংসদের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং সংসদই ইসলামী আইনের শরণাপন্ন হতে বাধ্য। মেজরিটির মাধ্যমে যদি সংসদে এমন আইন পাশ হয় যা ইসলামের পরিপন্থী, তা হলে জনগণের উপর তা বাধ্যতামূলক হওয়াতো দূরের কথা, কোনো মুসলমানের পক্ষে সে আইন পালন করাই হবে না জায়েজ বা হারাম। বরং এ হলো এমন এক সত্তার পাঠানো পয়গাম, যিনি সবকিছু জানেন এবং সবকিছুর খবর রাখেন। যিনি সর্বকালের সকল জাতি তথা গোটা বিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং যার সৃষ্টিনৈপুণ্য সকল অপূর্ণতা ও আবিলতা থেকে চির মুক্ত। যিনি সমগ্র মানবজাতির প্রকৃত রোগ ও বাস্তব প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। অবতরণের কাল থেকে শুরু করে মহাপ্রলয়ের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি আগামী প্রজন্মের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত সে নীতিমালায় রয়েছে সমূহ কল্যাণ ও হিদায়াতের ফল্গুধারার পুঙ্খানুপুঙ্খ দিক নির্দেশনা।
কল্যাণ ও হিদায়াতের নূরে জ্যোতির্মান এই ইসলামী আইনের বিপক্ষে মানবরচিত কতোগুলো বস্তাপঁচা দিকদর্শনকে আইন বলে আখ্যা দেওয়াও হবে চরম নির্বুদ্ধিতা ও মারাত্মক ভুল। ন্যায়সঙ্গত ও ইনসাফভিত্তিক আইন কেবল তাই হতে পারে যা অবতারিত হয়েছে মানুষের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে। যাতে রয়েছে মানুষের বুনিয়াদি অধিকার সংরক্ষণের পূর্ণ নিশ্চয়তা এবং মানবজীবনের সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। আল্লাহ প্রদত্ত এই আইনই দিতে পারে প্রকৃত আজাদী ও স্বাধীনতা। চির কাঙ্খিত আদ্ল-ইনসাফের এবং চির বঞ্চিত সুখ-শান্তির বিজয়বার্তা। মানুষকে দিতে পারে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের আলোকসন্ধান এবং পরস্পর গড়ে তুলতে পারে প্রেম ও ভালোবাসাবোধের মহিমায় মহীয়ান এক জান্নাতি পরিবেশ।
ইসলামী আইনের সামগ্রিক ও সর্বব্যাপকতা মানবজীবনের সবক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। সুতরাং এমন আইনের পরিবর্তে মানবরচিত কোনো আইন তালাশ করার পেছনে কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। আল্লাহ প্রদত্ত আইনের জায়গায় যে ব্যক্তি মানবরচিত আইনকে স্থান দেয়, সে মূলত নিজের বিবেক বুদ্ধিকে আল্লাহর ইলমের ওপর প্রাধান্য দিতে চায় এবং নিজের চিন্তাপ্রসূত মতামত ও ধ্যানধারণাকে আল্লাহর আইনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে, যা কোনো মুসলমানের পক্ষে অকল্পনীয়।
ইসলামী আইন সম্পর্কে যাদের ধারণা খুবই সংকীর্ণ, সর্বোপরি আপন আপন যুগের জন্য ইসলামী আইনকে পাশ কাটিয়ে মনগড়া আইনকে যারা উপকারী ও উপযোগী মনে করে, ইসলামের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এ কথা বেশ জোড় দিয়ে বলা যায় যে, যারা ইসলামী আইন সম্পর্কে অসন্তোষ পোষণ করে, তাদের মাথায় হাজারো ইসলামী লকব বা উপাধি থাকলেও তারা ইসলাম এবং মুসলমানদের গ-ির আওতাভুক্ত নয়।
ইসলামী আইনের সর্বজনীনতা ও সর্বব্যাপীতা সম্পর্কে ইসলামী আইনবিদ হযরাতুল উস্তায আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরীর (রহ.) একটি যুগ সম্মত ও সর্বোত্তম বিশ্লেষণ এখানে তুলে ধরছিÑ ‘ইসলামের বিধানগুলো যেহেতু মানুষের রচিত নয় বরং সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী ও অন্তর্জামী খোদার রচিত, কাজেই যে যে বিষয় মানুষের উন্নতির পরিবর্তন পরিবর্ধনে আবশ্যক, সে সে বিষয়ে মূলনীতিসমূহের পরিবর্তন ব্যতিরেকে শাখানীতি রচনার যথেষ্ট অবকাশ রাখা হয়েছে। এবং যে যে বিষয়ে পরিবর্তনের কোনো আবশ্যকতা নেই, সে সে বিষয়কে সম্পূর্ণ অপরিবর্তনীয় রাখা হয়েছে। এ বিষয়টিকে নবী করীম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বুঝিয়েছেনÑ‘আমাকে আল্লাহ তায়ালা যেমন ব্যাপক শরীয়ত দান করেছেন, ভাষাও তদ্রুপ ব্যাপকভাবে দান করেছেন’।…
যারা বলে ইসলামী আইন কেবল ইবাদত বন্দেগি এবং ব্যক্তি জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরেই সীমাবদ্ধ, রাজনীতি এবং প্রশাসনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের এই অন্তসারশূন্য উক্তির সাথে ইসলামের দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। বরং তা পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত ধ্যান-ধারণা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতির বিষাক্ত পরিণাম, যা আগামী প্রজন্মের মাঝেও বাতিল ধ্যান-ধারণা সৃষ্টির ভিতকে ইতোমধ্যে মজবুত করে ফেলেছে আমাদের অসতর্কতার সুযোগে। এদের সুরেই সুর মিলিয়ে যারা বলে ধর্ম হলো ব্যক্তিগত ব্যাপার, রাজনীতি এবং প্রশাসনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্ম এবং রাজনীতি দুটি আলাদা জিনিস। ধর্ম উন্নতি ও প্রগতির অন্তরায়। তাদের ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি যে একেবারে অযৌক্তিক ও ভ্রান্তিপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা এসব কিছুর জবাবে শুধু বিনীতভাবে অনুরোধ করবোÑ দেখুন আপনাদের ভদ্রতার কাছে আমাদের দাবি, এসব অজ্ঞতাপূর্ণ উক্তি প্রত্যাহার করুন। ইতিহাস সাক্ষীÑ আরব, ইরান, তুরস্ক, স্পেন, আফ্রিকা, হিন্দুস্তান ও আফগানিস্তান ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলো শাসিত হয়েছে এই ইসলামী নীতিমালা ও আইন কানুন অনুয়ায়ী। সেদিন মাটির পৃথিবীতে বসে মানুষ অনুভব করেছিলো বেহেশতের সুখ ও শান্তি। সর্বোপরি রচিত হয়েছিলো বকরি-বাঘে এক ঘাটে পানি পান করার মতো নজীরবিহীন ও বিস্ময়কর ইতিহাস।
এখনও যদি শান্তি ও নিরাপত্তার আকাঙ্খা আমাদের মনে জাগরুক থাকে, উভয় জাহানের কল্যাণের জন্য যদি আমরা প্রত্যাশী হই, তবে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিকল্প কোনো পন্থা নেই। আজ এই নরকসম পৃথিবীতে ইসলামই শুধু পারে জান্নাতি পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ইসলামী আইন-বিধি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উপকারিতা জনসমক্ষে হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরা। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘আর আপনি আপনার উপদেশ দেওয়াকে অব্যাহত রাখুন। আপনার উপদেশ তাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে’।
তাই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে বর্তমান সময়ের চাহিদার সাথে মিল রক্ষা করে মানুষের সামনে পেশ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ের চাহিদা মোতাবেক ইসলামকে কাঁটছাট করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। সে চেষ্টা যদি কেউ করতে যায় তবে তা ইসলামের তাহরীফ তথা বিকৃতি সাধনেরই নামান্তর হবে। আজকের পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনারা সবাই সজাগ। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র, যেগুলোর পতনের দিন ঘনিয়ে এসেছে কিংবা ইতোমধ্যে হয়েও গেছে, পৃথিবীকে যে ক্ষতি ও সমস্যা উপহার দিয়েছে, তার একমাত্র ক্ষতিপূরণ ও সমাধান দিতে পারে শাশ্বত ও চিরস্থায়ী বিধান ইসলাম, সর্বকালের প্রযোজ্য বিধান যার মাঝে বিদ্যমান। ইসলামই পারে ধ্বংস, পতন ও জাহান্নামের পথ থেকে টেনে তুলে মানুষকে উপহার দিতে স্বাধীনতা। অন্য কোনো আদর্শ-দর্শন ও বিধান তা দিতে পারেনি কোনোকালে, পারবেও না আর কোনো দিন।
[দুই যুগ আগে প্রদত্ত বিশেষ একটি বক্তৃতার ভাবসংক্ষেপ]
সমকালীন দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতি- চল্লিশের দশকে বাংলাদেশ
আক্ষরিক অর্থে বিশ্বমানচিত্রে তখন বাংলাদেশ নামের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। স্বাধীন-স্বনির্ভর বাংলাদেশ তো নয়ই, পূর্ব পাকিস্তানও নয়; বাংলাদেশ তখনও ইংরেজের অধীনে ভারতবর্ষের একটা প্রদেশের অংশ মাত্র। চল্লিশের দশকে বাংলাদেশ বলতে আমরা এখানে তখনকার বাংলা আর বর্তমান বাংলাদেশ নামের ভূখ-টিকেই বোঝাতে চাইছি। গেলো শতাব্দীটি আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচে’ ঘটনাবহুল। এতো লড়াই-সংঘাত, এতো ভাঙা-গড়া পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। দু’ দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বমানচিত্রের ব্যাপক কাটাছেঁড়ার প্রতি লক্ষ করলে আশা করি আপনিও এই সত্যকে কবুল করবেন। অন্যদিকে, ঘটনাবহুল বিংশ শতাব্দীর সবচে’ উত্তাল সময়পর্ব ছিলো আবার এই চল্লিশের দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের নৃশংস নাৎসি বাহিনীর পতন, কয়েক শতাব্দীজুড়ে বিশ্বের ব্যাপকতম মানচিত্র নিজেদের অধীনে রাখা বৃটিশ সা¤্রাজ্য এবং সমাজতন্ত্রের উত্থানে কয়েক দশকজুড়ে বিশ্ব নেতৃত্বে ছড়ি ঘোরানো সোভিয়েত ইউনিয়নকে পেছনে ফেলে দৃশ্যপটে যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাব, আলোচিত চীনা বিপ্লব এবং ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ইসরাইল নামক চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্রের অবৈধ জন্মের মতো ঘটনাগুলো এই দশকজুড়ে পৃথিবীকে উত্তাল করে রেখেছিলো। একই সময়, কয়েক যুগের লাগাতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের এই উপমহাদেশও বৃটিশরাজের
কবল থেকে নিজেকে উদ্ধারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব এবং স্বাধীকারের লড়াই একীভূত হয়ে এই অঞ্চলের মানুষদের জন্যও চল্লিশের দশকটিকে দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছিলো। চল্লিশের উত্তাল দশকটি কেবল মানুষ বা সময়কে উদ্বেলিত করেই ক্ষান্ত হয় নি; বদলে দিয়েছে মানচিত্র, বিশ্বনেতৃত্বের মঞ্চ এবং কোটি মানুষের জীবনধারাও।
১৯৪২ সালে জার্মানির মিত্র জাপান কলকাতায় বোমা বর্ষণ করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশও এসময় আক্রান্ত হতে শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধের বিচারে হামলাগুলো খুবই সীমিত এবং সাধারণ হলেও জাপানি বিমানগুলো ঠিকই চক্কর দিয়ে বেড়াতো পুরো উপমহাদেশের আকাশজুড়ে। বিশ্বযুদ্ধের তিন-সাড়ে তিন বছরে নানা সময় তারা বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বৃটিশ সেনা ছাউনি ও স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছিলো, প্রতিবাদে ইংরেজ সরকারের বিমানবিধ্বংসী কামানগুলোও থেকে থেকে গর্জে ওঠতো। সরাসরি যুদ্ধ বা প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার এ উপমহাদেশের মানুষকে খুব একটা হতে হয় নি, তবে ভয়ংকর আশংকাটা শীঘ্রই সামনে চলে আসে। যুদ্ধের অজুহাতে খাদ্যপণ্য পরিবহনের বাহনগুলো ইংরেজ সরকার তুলে নিলে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে খাদ্য বিনিময়ে দীর্ঘসূত্রিতা এবং এক পর্যায়ে তীব্র সংকট তৈরি হয়। ১৯৪৩ এ উপমহাদেশ বিশেষত বঙ্গদেশ নামের এই অঞ্চলে শুরু হয় তীব্র মন্বন্তর তথা দুর্ভিক্ষ। পাকিস্তান আমলের বিশিষ্ট আমলা আজিজুল জলিল তার স্মৃতিকথায় লিখেন- ‘১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তর আমাদের শিশুচোখের সামনেই ঘটল। দৈনিক দেখতাম অভাবনীয় করুণ দৃশ্য। হাড্ডিসার মানুষেরা কোনমতে একটু খাবার পাওয়ার আশায় রাস্তার মোড়ের ডাস্টবিন হাতড়াচ্ছে। এদের বেশির ভাগ নিকটবর্তী গ্রাম থেকে শহরে এসেছে খাবারের খোঁজে। এতই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল এরা যে, যদিওবা কোন কাজ থাকত তা এদের পক্ষে করা সম্ভব হত না। এই ভয়ানক দৃশ্য কোনদিনই ভুলব না। আর কোনদিন যেন দেখতেও না হয়। আমার মনে আছে মা এবং আরো অনেকে আমাদের এলাকার ক্ষুধার্তদের জন্য রুটি আর ভাত রান্না করতেন। জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বৃটিশ সরকার নৌকা
এবং অন্যান্য যানবাহন নিয়ে নিয়েছিলো এর ফলে খাদ্য সামগ্রি চলাচল ব্যাহত হয়ে অভাব দেখা দেয় এবং দাম বেড়ে যায়। অন্য কারণ ছিল অতি মুনাফার জন্য ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানো এবং সরকারি রিলিফের অভাব। আসলে কিন্তু বাংলায় তখন মোট খাদ্য সামগ্রীর অভাব ছিল না। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সে সময় কলকাতা আর্ট কলেজের শিক্ষক। তিনি কাঠকয়লা দিয়ে আঁকলেন মন্বন্তরের উপর তাঁর সেই বিখ্যাত স্কেচগুলি- ক্ষুধার্ত মানুষ আর কুকুর কাড়াকাড়ি করছে রাস্তার মোড়ের ডাস্টবিনের ছিটেফোটা খাবার নিয়ে।’…
আজকে আমরা যেভাবে, যে বাস্তবতার ভিত্তিতে দুই বাংলাকে পৃথকভাবে চিনি ও জানি, এই বিভাজন এক কালে ছিলো না। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা ‘বাংলা’ প্রদেশ হিসেবে পৃথক যে মানচিত্র এখন আমরা দেখি, ‘বঙ্গ’ বা বাঙলাদেশ নামে সেটি একটাই ভূখ- ছিলো পৃথিবীর বুকে। ১৯০৩ সালে বৃটিশ সরকার শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাকে পৃথক করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯০৫ সালের অক্টোবরে এটি পাস হওয়ার কথা ছিলো। ইংরেজের অধীনতা এবং হিন্দু জমিদারদের নিষ্পেষণে জর্জরিত মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের জনগণের জন্য খুব দরকারি হলেও সেজন্য তারা আন্দোলন করেনি বা দাবিও তোলেনি। তবে পশ্চিমবঙ্গের সুবিধাবাদী হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও জমিদাররা প্রয়োজনীয় এই বিভাজন শেষ পর্যন্ত হতেও দেয়নি। এই অঞ্চলের মুসলিমদের সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যাপারে হিংসা এবং নিজেদের ব্যবসায় ও ক্ষমতার কেন্দ্রে ঘাটতি সৃষ্টির আশংকায় তারা সুতীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে এবং এই আইনটি ভেস্তে দেয়। পুরো বঙ্গকে নিজেদের দেবীর সাথে তুলনা করে ভক্তি ও ভালোবাসায় দেশ ডুবিয়ে দিয়েও যখন সুবিধে করতে পারছিলো না, বাঁধিয়ে দেয় দাঙ্গা। সাথে নিরপরাধ ইংরেজ নাগরিক হত্যাসহ সহিংস অপতৎপরতা। লর্ড কার্জনের প্রস্তাবিত এই আইন শেষ নাগাদ আলোর মুখ দেখার আগেই রদ হয়ে যায়।
রাষ্ট্রক্ষমতা হারানোর দেড়শো বছরের মাথায় একটু আশাবাদী হয়ে উঠতে থাকা মুসলিম সমাজ হিন্দুদের এই জিঘাংসা ও বিদ্বেষের ধরন দেখে নিদারুণভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। শুরু হয় নিজেদের স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম গড়ে তোলার নতুন সংগ্রাম। এই সংগ্রামই এরপর মুসলিম লীগ নামে বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৪০ সালের মার্চে মুসলিম লীগের হয়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক পার্লামেন্টে লাহোর প্রস্তাবে ভারত বিভাগের দাবি উত্থাপন করলে হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষের ধারাবাহিক আন্দোলনই আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হয়। পর্দার অন্তরালে তখন প্রদেশ বিভাজন, মানচিত্রে কাটাছেঁড়াসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সম্পত্তির ভাগ-বন্টনের নানারকম খেলা চলতে থাকে উভয় শিবিরে। ইংরেজের ছত্রছায়ায় দুই শতাব্দীজুড়েই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উপেক্ষা ও জুলুম এবং সবশেষে ক্ষমতা ভাগাভাগির এই পর্যায়েও চূড়ান্ত স্বার্থপরতার মানসিকতা দেখে বাধ্য হয়েই মুসলিম নেতৃবৃন্দ ভারত ভাগের পক্ষে আওয়াজ তুললেও শেষ দিনটি পর্যন্ত তারা অবিভক্ত ভারতবর্ষের ব্যাপারেই আন্তরিক ছিলেন। লোভী ও স্বার্থপর আখ্যা দিয়ে ভারতভাগের পুরো দায় মুসলিম নেতাদের ওপর চাপিয়ে দিলেও কয়েক দশকের মধ্যেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে যে- হিন্দু নেতারাই আসলে স্বার্থের কলকাঠি নেড়ে সব এলোমেলো করেছেন। জিন্নাহ সাহেবদের তুলনায় নেহেরু-প্যাটেল সাহেবরাই যেকোনো উপায়ে ক্ষমতার মসনদে বসতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, হিন্দু ও ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই সেটা কবুল করেছেন। আজিজুল জলিল লিখেছেন- ‘সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ফেডেরাল গঠনতন্ত্রের অধীনে ভারতের ঐক্য বজায় রাখতে রাজি ছিলেন, শর্ত একটাই- তাতে যদি মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হয়। এক সময়ের কবি ও কংগ্রেসনেত্রী সরোজিনী নাইডু জিন্নাহকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত বলে উল্লেখ করেছেন। তিরিশ বছর পর প্রকাশনার নিয়মে প্রকাশিত ব্রিটিশ সরকারের কাগজপত্রে এবং মওলানা আজাদের মৃত্যুর পঁচিশ বছরর পর প্রকাশিত ‘ভারত স্বাধীনতা অর্জন করল’ বইতে দেখা যায়- কংগ্রেসের বয়স্ক নেতৃবৃন্দ, (প-িত নেহেরু এবং প্যাটেলসহ) যাঁরা অনেক দিন জেলে ভুগেছেন; ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন- দরকার হলে দেশ ভেঙে।’
একইভাবে আমাদের এই বাংলার বিভাজনের ক্ষেত্রেও হিন্দু নেতারা মুসলিম নেতৃবৃন্দের ওপর দায় চাপিয়েছেন। অথচ কংগ্রেসের তৎকালীন কলকাতার নেতৃবৃন্দের বিবৃতি এবং হিন্দু ও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কলমেই পরিষ্কার- অবিভক্ত বাংলা এমনকি স্বাধীন বাংলার ব্যাপারেও শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ সাহেব আন্তরিক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি নিজের গভীর ভালোবাসার কথা লিখে গেছেন- ‘পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কী করবো? আমাদের অনেকের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা-৩২)। ৩৬ নং পৃষ্ঠায় তিনি আরো লিখেছেন ‘অখ- ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম।’ পাকিস্তানের প্রতি গভীর আবেগ সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান অখ- বাংলার প্রতি ভালোবাসার কথাও জানিয়েছেন। এটি কেবল তার একার নয় পাকিস্তান আন্দোলনের তৎকালীন প্রধান সব নেতার মতামত হিসেবে সহজেই বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রমাণ সহকারেই।
তিনি লিখেছেন- ‘এই সময় শহীদ সাহেব (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী), হাসিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎবসু ও কিরণশঙ্কর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যায় কিনা? শহীদ সাহেব দিল্লীতে জিন্নাহর (কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ) সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তার অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাংলাদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এ ফর্মুলা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে। যতদূর আমার মনে আছে তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তানে না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎবসু দিল্লীতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎবসু নিজে লিখে গেছেন যে, জিন্নাহ তাকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফর্মুলা মানতে পারবেন না। শরৎবাবু কংগ্রেস নেতাদের সাথে দেখা করতে যেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটল তাকে বলেছিলেন, ‘শরৎবাবু পাগলামী ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই। মাহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরু কিছুই না বলে তাকে সরদার প্যাটলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটল তাকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎবসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে এ কথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন এ কথাও স্বীকার করেছিলেন’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা-৭৪)।
এ নিয়ে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান তার বইয়ে এরপর লেখেন- ‘শরৎবসুকে ১৯৪৭ সালের ৮ জুন লিখিত এক চিঠিতে গান্ধী জানিয়ে দেন যে, তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে নেহেরু ও প্যাটেলের সাথে আলোচনা করেছেন এবং এই উদ্যোগের প্রতি তাদের সম্মতি নেই। গান্ধী তার এই চিঠিতে শরৎবসুকে অখ- স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ত্যাগ করার জন্য বাংলা ভাগের বিরোধিতা হতে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।’ (বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্ঠা ২৮২-২৮৩)। স্বার্থ আর রাজনীতির ব্যাপারকে পাশ কাটালেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়- ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে গিয়ে হিন্দু নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ যে বঙ্গকে মা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, বন্দে মাতরম সঙ্গীতে সর্বস্ব উজাড় করে হলেও মা ও দেবীর সম্মান রক্ষার শপথে বলীয়ান হয়ে উঠেছিলেন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধিয়ে পুরো অঞ্চলজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন; সেই তারাই আবার ৪৭ সালে এসে কী করে বাংলাকে পৃথক করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন? ভুল স্বীকার তো পরে, প্রপাগা-াটুকুও আজ পর্যন্ত তারা বন্ধ করেন নি। এখনো মুসলিম নেতৃবৃন্দকেই দায়ী করে যাচ্ছেন।
উত্তাল সেই দশকজুড়ে নেতারা যখন মানচিত্রের এমন কাটাছেঁড়া ও দেশভাগের নানারকম দরকষাকষিতে ব্যস্ত; স্বাধীনতার আনন্দ ও অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের শংকার দোলাচল এবং নতুন দেশে নতুন বাসস্থান তালাশের ঝঞ্জাট সব মিলেমিশে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম নাগরিকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো। দাঙ্গা-হাঙ্গামার নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা আর বাবা-দাদার বাসস্থান ও কাছের আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে নতুন ঠিকানার খোঁজে পথে নামতে বাধ্য হওয়ায় তাদের জীবন হয়ে উঠেছিলো বিভীষিকাময়। এতোসব বিড়ম্বনা সত্ত্বেও এই দশকটি তাদের জীবনে এনে দিয়েছিলো মুক্তিও। নিজের পথে নিজের মতো করে চলার এবং নিজের ইচ্ছেমতো বলার স্বাধীনতাও। সবমিলিয়ে হিন্দু-মুসলিমসহ উপমহাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনেই চল্লিশের দশকটি হয়ে উঠেছিলো তাৎপর্যময়। ভীষণরকম।
চল্লিশের দশকটি বাংলাদেশের জন্য কেবল দুইশ’ বছরের পরাধীনতার কবল থেকে মুক্তি বা নতুন জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কালই ছিলো না। ছিলো স্বর্ণযুগ। আধুনিক কবিতার। চিত্রকলার। গণসঙ্গীতের। ছোটগল্প এবং উপন্যাসসহ শিল্প-সংস্কৃতির প্রায় সকল মাধ্যমেরই। ফররুখ আহমেদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওলীউল্লাহ এবং আবুল ফজলের মতো ব্যক্তিত্বরা দেখিয়েছিলেন- ইসলামের মর্মবাণী ও ভাষাকে উচ্চকিত রেখেও কী করে আধুনিক শিল্প ও সাহির্ত চর্চা করা সম্ভব। কতোটা মৌলিকভাবে সম্ভব। কবিতার বাঁক বদলানো রীতি ও নিপুণ গদ্যে তাঁরাসহ আরো অনেকেই রীতিমতো বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। নানাভাবে এড়ানোর চেষ্টা করা হলেও তাদেরকে শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায় নি। সম্ভবও নয়।
চল্লিশের দশকে পাকিস্তান সৃষ্টির ঘটনাটি যতোটা মহৎ ও মহিমাময়, আছে স্বপ্নভঙ্গের কালো অধ্যায়ও। লাহোর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে এই দশকের শুরুতেই বাংলাদেশের মানুষ যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলো, স্বাধীনতা লাভের পরপরই বাংলা ভাষার বিরোধিতার প্রশ্নে বিষাদে ছেয়ে যায় তাদের মন। পথ হারাতে শুরু করে মুসলিম লীগও। স্বপ্নভঙ্গের করুণ সুর ছড়িয়ে দিতে দিতেই বিদায় নেয় ঘটনাবহুল চল্লিশের দশক।
নাসিরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নামকরণ
হাজার বছরের সংস্কৃতি এবং গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রয়েছে ঘটনাবহুল ও বর্ণিল অতীত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া যার অন্যতম। বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অবদান অসামান্য। স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধ এবং অধর্ম ও অন্যায়ের মোকাবেলায় এই জেলার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নানা ধর্মের, নানান মত ও পথের লোকজন এখানে প্রাচীনকাল থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছেন। শান্তি-সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের লীলাভূমি এই জনপদ- ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জ্ঞানী ও গুণীর দেশ, আলেম ও মুজাহিদের দেশ। গত এক শতাব্দীতে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণীর বিভিন্ন অবদানের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া আজ উপমহাদেশ তো বটেই, বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। কোনো কোনো মতে- সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাবে পূজা-অর্চনায় বিঘœ সৃষ্টি হতো। এ কারণে রাজা লক্ষণ সেন আদিসুরের কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার শহরের মৌলভীপাড়ায় বাড়ি তৈরি করে। কালক্রমে সেই ব্রাহ্মণদের বাড়ির নামেই এ এলাকার নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসেবে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় এবং সম্ভাব্য সঠিক মতানুসারে- দিল্লী থেকে আগত ইসলামের প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ নানান অভিযোগে অতিষ্ঠ হয়ে শহর থেকে এসব ব্রাহ্মণ পরিবারকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন, যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। কথিত আছে- দরবেশ সাহেব ‘ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাও’ বলে হুকুম করেছিলেন এবং তার সেই উক্তি থেকেই কালক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি।
ইতিহাসের এক ঝলক
এ অঞ্চল প্রাচীন বাংলার সমতট নামক জনপদের অংশ ছিলো। মধ্যযুগে আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিলো সরাইল পরগনার অর্ন্তগত। ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্তে জানা যায়- পাঠান সুলতান শেরশাহ রাজস্ব আদায় ও শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে প্রথম পরগনার সৃষ্টি করেন। সুলতানি আমলেই সরাইল পরগনার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক কারণে সরাইল পরগনাও নানা সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বাংলার বার ভূঁইয়ার শ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া মসনদ-এ আলা ঈসা খাঁর বংশ পরিচয় থেকে জানা যায়- ভারতের বাইশওয়ারা রাজ্যের এক যুবরাজ কালিদাস গজদানী সৈয়দ ইবরাহীম মালেকুলওলামা (রহ.) এর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান খাঁ নাম ধারণ করেন। সোলায়মান খাঁ ১৫৩৪ খৃস্টাব্দে এই বঙ্গ অঞ্চলে আগমন করেন। তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের পর থেকে সর্বপ্রথম সরাইল পরগনার জায়গীর প্রাপ্ত হন। সোলায়মান খাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পাঠান বাহিনী মিথ্যা সন্ধির প্রস্তাবে তাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। এসময় ঈসা খাঁর বয়স ছিলো দশ বছর। পরবর্তী কালে স্বীয় প্রতিভাবলে তিনি ভাটীরাজ্যের এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হন। ভাটী রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষায় ঈসা খাঁর সঙ্গে মোঘল বাহিনীর যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঈসা খাঁ তখন সরাইলে অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যও সুপ্রাচীন। এ শহরকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
১৭৯৩ খৃস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা ময়মনসিংহ জেলার অর্ন্তভুক্ত ছিলো। ১৮৩০ সালে সরাইল, দাইদপুর, হরিপুর, বেজুরা ও সতরকন্ডল পরগনা ময়মনসিংহ থেকে ত্রিপুরা জেলার অধীনে দেওয়া হয়। ১৮৬০ সালে নাসিরনগর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা এর অধীনস্থ হয়। ১৮৭৫ সালে ইংরেজ সরকার নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসেবে ঘোষণা করে। শুধু একটি থানার নাম হিসেবে মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক এ নামটি আজও টিকে আছে। তারও আগে ১৮৬৮ খৃস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরটি পৌরসভায় উন্নীত হয়। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অর্ন্তগত হয়। ১৯৬০ সালে ত্রিপুরা জেলার পূর্ব পাকিস্তান অংশেরও নামকরণ হয় কুমিল্লা। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি মহকুমা শহর হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা উত্তর বংলাদেশের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য ও বীরত্বগাঁথা
ইতিহাসের নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তবেই আজকের পর্যায়ে এসেছে এক কালের নাসিরনগর ও আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া। যুগে যুগে বহু সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের সাক্ষী এই শহর। ঈসা খাঁর প্রথম ও অস্থায়ী রাজধানী ছিলো সদর এলাকা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার উত্তরে, সরাইলে। বৃটিশ আমলে ইংরেজ ম্যানেজার মিস্টার হ্যালিডের কুঠি সরাইল থেকে শহরের মৌড়াইলে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি ভেঙে সরকারি অফিস ঘর করা হয়েছে। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ সেনাদের মুনিপুর অধিকারের সময় তাদের সামরিক সদর দফতরও ছিলো এই শহরেই। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সৃষ্ট তথাকথিত স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে উল্লাস কর দত্ত বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে আন্দামানে দীপান্তরিত হয়েছিলো, যা সেসময়ের তুমুল আলোচিত ঘটনা। ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ ও গোপাল দেব প্রমুখ প্রকাশ্য দিবালোকে তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি.সি.বি স্টিভেনসকে তারই বাসগৃহে গুলি করে হত্যা করে, পুরো উপমহাদেশে সেসময় যা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ১৯৩০ সালে কৃষক আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতা আব্দুল হাকিম খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান। শহরজুড়ে সৃষ্টি হয় তুমুল উত্তেজনা।
এ সময় বৃটিশ সৈন্যদের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে চারজন বেসামরিক লোক প্রাণ হারান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল আখাউড়ার দরুইন যুদ্ধে শহীদ হন। এক কালে কাদিয়ানীদের প্রধান আখড়া ছিলো ব্রহ্মণবাড়িয়া। আলেম সমাজের নেতৃত্বে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের তুমুল প্রতিরোধে তারা একসময় নিজেদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। শায়খ আবু তাহের মুহাম্মদ ইউনুস, ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলামসহ বরেণ্য আলেমদের নেতৃত্বে বিধর্মী ও বাতিল শক্তিদের হটিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া খাঁটি মুসলিম ও আলেম সমাজের পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) নেতৃত্বে বাবরি মসজিদ অভিমুখী লংমার্চ, নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন, ২০০১ এর ফতোয়া আন্দোলন, এরপর নারীনীতি ও শিক্ষানীতির মতো তাৎপর্যপূর্ণ এবং সফল আন্দোলনগুলোতে অসামান্য ত্যাগ ও কুরবানীর মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিণত হয়েছে সাহসিকতা ও বিপ্লবের বিস্ময়কর এক জনপদে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবস্থান ও আবহাওয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবস্থান বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে। আদিকাল থেকে এটি নদ-নদী অধ্যুষিত ভাটীরাজ্য হিসেবে পরিচিত। ¯্রােতস্বিনী মেঘনা অববাহিকায় কালীদহ সায়রের পলি ও বালি সঞ্চিত নীচু ভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ অঞ্চল। তবে উত্তর পূর্বাঞ্চলে কিছু উঁচু ভূমির নিদর্শন রয়েছে। পাহাড়ি টিলার লালমাটি আদি স্থলভূমি ও জনপদের প্রমাণ বহন করে। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ পূর্বাংশের অধিকাংশ এলাকা এখনো বর্ষার পানিতে প্লাবিত হয়ে থাকে। মেঘনা, তিতাস, সালদা, হাওড়া, বুড়ি ও লোহুর নদী বষার্কালে এখনো উপচে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে কুমিল্লা, পশ্চিমে নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ এবং উত্তরে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার অবস্থান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বরেণ্য ব্যক্তিত্ব
শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষা-সাহিত্য ও ইসলামী আন্দোলনে দেশের অন্যতম অগ্রণী জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কৃতী ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, ওস্তাদ ও ইসলাম প্রচারক ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম (রহ.), কাজী মাসুদুর রহমান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ব্যারিস্টার এ রসুল, নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কথা সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণ, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, কবি আবদুল কাদির, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.), সাবেক সচিব ও আলোচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আকবর আলী খান এবং এই সময়ের সেরা কবি আল মাহমুদ।
জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জাতীয় অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রাখছে। তিতাস গ্যাস ফিল্ড, সালদা গ্যাস ফিল্ড, মেঘনা গ্যাস ফিল্ড দেশের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাসের সরবরাহ যোগায়। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের ২য় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আশুগঞ্জ সার কারখানা দেশের ইউরিয়া সারের অন্যতম বৃহৎ শিল্প কারখানা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং দলমত নির্বিশেষে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল মিলনস্থল হিসেবে এদেশের মানচিত্রে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কয়েক শতাব্দী ধরেই তাঁত বস্ত্রের জন্য বিখ্যাত। উনবিংশ শতাব্দীতে সরাইলে তানজেব নামক বিখ্যাত মসলিন বস্ত্র তৈরি হতো। এখনও নানারকম কারুশিল্পের জন্য জেলাটির খ্যাতি রয়েছে।
স্মৃতির ব্রাহ্মণবাড়িয়া
এখন প্রায় বিস্মৃত হলেও মিন্নাত আলী নামটি একসময় বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে খুবই পরিচিত ছিলো। ষাটের দশকের প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে লিখেছেন- ‘স্মৃতির শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া’। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সমিতির উদ্যোগে প্রকাশিত ‘শাশ্বত ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ স্মারকটিতে তার এই স্মৃতিচারণ সংকলিত হয়। দারুণ গদ্যে লেখক কেবল তখনকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্রই তুলে ধরেন নি; শত বছরের মুসলিম ঐতিহ্য, ইংরেজ শোষণ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাড়াবাড়িও তুলে এনেছেন চমৎকারভাবে। বিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জানতে হলে আপনাকে মিন্নাত আলীর কাছে ফিরতেই হবে। মিন্নাত আলী লেখেন- ‘হিসাব করে রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। ত্রিশ ত্রিশটি বছর ধরে আমি বাহ্মণবাড়িয়া শহরে বসবাস করছি। আশ্চর্য! তিরিশটি বছরে কত বিবর্ণ দিন, কত উজ্জ্বল মুহূর্ত- কত অবিস্মরণীয় ঘটনা, কত নির্মম দুর্ঘটনা- সুখ ও শোক, ভোগ ও দুর্ভোগ, নানা শ্রী ও বিশ্রী সব স্মৃতি- বিস্মৃতি। ইতিহাসের নিষ্ঠুর কষ্টিপাথরে এসবের সত্যতা টিকুক আর না-ই টিকুক- আমার স্মৃতির সত্যতা যে ষোল আনাই ঠিক এ আমি হলফ করেই বলবো। জীবিকার জান্তব অর্থে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে আমার আর্থিক সম্পর্ক তিরিশ বছরের হলেও তার সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ কিন্তু তারো এক যুগ আগে থেকে। এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় স্বপ্নের মাধ্যমে। বাস্তব ‘স্বপ্ন’ না হলেও আজ এই মুহূর্তে পঞ্চাশ বছর আগেকার রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলি আমার কাছে স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছে।
মেঘনার উপর পুল হবে, নদীর মাঝখানে ইয়া মোটা মোটা পিলার বসানো হচ্ছে। শত শত শ্রমিক- ইঞ্জিনিয়ার রাত-দিন সমানে কাজ করে যাচ্ছে। বিচিত্র সব হৈ- চৈ, কলরোল- কলরব। মেঘনা পারের লোকদের কাছে এ এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা, কৌতূহলোদ্দীপক অনুভূতি। আমি, আজিজ আর আতর মিয়া মেঘনা পুল তৈরি দেখার কৌতূহল নিয়ে সকালে মেঘনা পাড়ি দিয়ে আশুগঞ্জ এলাম। (নিশ্চয় গুদারা ছিল, অথবা পয়সা দিয়ে নদী পার হয়েছিলাম, এখন অত সব মনে পড়ছে না) তখন তো আশুগঞ্জে উঁচু রেললাইন হয়নি। স্টেশনটাও উপরে ওঠেনি। আমরা নদীর পাড়ে কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আশুগঞ্জ স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে রেললাইন দিয়ে হাঁটতে থাকি। তিন অবোধ বালকের সে এক উদ্দেশ্যহীন, উদ্বেগহীন, অনিশ্চিত যাত্রা।
গল্প করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন তালশহর স্টেশনে পৌঁছি, তখন অভূতপূর্ব ভয়ের সাথে আমরা সচকিত হয়ে উঠি- সব্বনাশ, আমরা যে অনেক দূর চলে এসেছি! এখন বাড়ি, ভৈরব ফিরবো কেমন করে? আতর মিয়া আশ্বাস দিয়ে বললো- ঘাবড়িও না, তালশহর স্টেশনের কাছে বড়হরণ নামে এক গ্রাম আছে শুনেছি। সেখানে নাকি আমার এক দুলাভাইয়ের বাড়ি। চলো, সেখানে গিয়ে খোঁজ করি। তারপরের ঘটনা সব মনে নেই, তবে এটুকু এখনো পষ্ট দেখতে পাচ্ছি- রেললাইনের পাশেই বড়হরণ গ্রামে এক মসজিদঅলা বাড়িতে আমরা উঠেছি- আতর মিয়ার ‘বুবাই’ আমাদের খুব আদর করে খাওয়ালো, সন্ধ্যার পর তার দুলাভাই আমাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে এলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে- মেলা দেখাবে বলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেলা- এস ডি ও’র মেলা এই প্রথম দেখলাম। সেদিন বিস্ময়ভরা বড় বড় চোখ দিয়ে কৌতূহলী তিন বালক কী কী দেখেছিলাম, পঞ্চাশ বছর পরে আজ তার অনেক কিছুই মনে করতে পারছি না। চোখের সামনে ভাসছে শুধু দুটি ছবি- আশ্চর্য এক পুতুল নাচ। পুতুল নাচ দেখে আলোয় আলোময় মেলার মাঠ থেকে ফেরার পথে জমির উপর দেখি অস্থায়ী এক ‘সিনেমা হল’। আমরা বানান করে পড়লাম, সে রজনীতে প্রদর্শিত ‘টকী’র নাম- ‘সীতা’। এন এম খানের মেলার মাঠ থেকে সেই শীতের রাতে আমরা হেঁটে হেঁটে জগৎবাজারে এক দোকানে আসি এবং গদীঘরে রাত কাটাই। এসব তো ১৯৩৫ সালে আমি যখন ভৈরব প্রাইমারী স্কুলে শিশুশ্রেণীতে পড়ি তখনকার ঘটনা। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সময় জগৎবাজারে ‘মোল্লা রিপেয়ারিং হাউস’টা দেখেছি। কিন্তু অধুনা সভ্যতা ও সমৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান স্পর্শের পর সেদিন জগৎবাজারে গিয়ে দেখি, সেখানকার ইয়া আলিশান বুড়ো বটগাছটা নেই, নেই আতর মিয়ার সেই স্বাস্থ্যবান, হাস্যোজ্জ্বল দুলাভাইও- ভাঙ্গা পড়ো-পড়ো মোল্লা রিপেয়ারিং হাউসটিকে কোনমতে আগলে রেখেছে মোল্লার নাতি-পুতিরা।
দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে দেখি ১৯৪০ সালে। সারা বাংলা-আসামের হাইস্কুলগুলি তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন [অবশ্য ঢাকা শহরের স্কুলগুলি ছাড়া]। ভৈরব স্কুলের ছেলেরা বরাবর মহকুমা শহর কিশোরগঞ্জেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যায়। কিন্তু সেবার ফুটবল খেলতে গিয়ে কিশোরগঞ্জের এক স্কুল টীমের সাথে ভৈরব স্কুল টীমের দারুণ মারামারি হয়- ভৈরব স্কুল আর কিশোরগঞ্জ যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে ভৈরবের নিকটবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পরীক্ষা কেন্দ্র ঠিক করে। ১৯৪০ সালে আমার এক বড় ভাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আসে। আমি তখন ক্লাশ ফাইভের ছাত্র।
সে সময় তাঁর সাথে, কেমন করে, মনে নেই, আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছিলাম। ভৈরব স্কুলের ছাত্রদের থাকার জায়গা করা হয়েছে লোকনাথ দিঘীর দক্ষিণে রাস্তার পাশেই এক ব্রাহ্ম মন্দিরে। হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে আমি ‘ব্রাহ্ম মন্দিরে’ই এক রাত কাটিয়েছিলাম। বেশ মনে আছে, মন্দিরটার দক্ষিণে-পশ্চিমে ডোবা-গর্ত, ঝোপ-ঝাপ, পাশেই ধোপা বাড়ি। এখনো চোখের সামনে ভাসছে- ডোবাটা, ডোবার পাশে বেত ঝোপের আড়ালে ধোপার ঘরবাড়ি, উঠান, উঠানে কাপড়চোপর শুকাচ্ছে, দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে ছোট ছোট কাচ্চা-বাচ্চারা।
তখনো শহরে বিজলী বাতি নেই, নেই মানুষের ভিড়, রিকশার বিরক্তিকর অসহ্য চাপ। পুরনো সিনেমা হল (চিত্রালয়) তখন দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না- তবে ফারুকী মার্কেট বলে কোন কিছু ছিল না। রাস্তার পশ্চিমে ওই জায়গাটা ছিল দুর্গন্ধময়, এঁদো পুকুর-ডোবা। রাস্তার পশ্চিমে লাল লোহার ভাঙ্গা রেলিং, ডোবার পশ্চিমে ঘরবাড়ি। কালীবাড়ি মোড়ের পর থেকে রেল লাইন পর্যন্ত বড় রাস্তার পূব দিকটায় বড় নর্দমা খাল- পশ্চিমে ডা: নন্দলাল বাবুর চেম্বার, ক’টি ছোট ছোট দোকানঘর, উমেশবাবুর একতলা-দোতলা বাড়ি, তারপর রাস্তার পাশে নর্দমা-খাল, খালের উপর উজ্জ্বল ফার্মেসি, দক্ষিণে স্টেশন রোড পর্যন্ত ঘোষ-গোয়ালাদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি।
রেললাইন পার হলেই বাঁয়ে ‘জর্জ হাই ইংলিশ স্কুল’- টিন ও বেড়ার লম্বা ঘর। স্কুলের সামনে ছোট মাঠ, মাঠের পরে পুকুর ও গর্ত (এই মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে ১৯৪৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ করা হয়)। এই জর্জ হাই স্কুলেই ভাই ও ভৈরবের আর ছাত্রদের সাথে সন্ধ্যার পর এক ফাংশনে পল্লীকবি জসীমঊদ্দীনকে দেখেছিলাম বলে মনে পড়ছে। উৎসুক হয়ে কবির জলদ কন্ঠের বক্তৃতা শুনেছিলাম, শুনেছিলাম কবির কন্ঠে গান- ওরে ও রঙ্গিলা নায়ের মাঝি, তুমি অফর বেলায় নাও বাইয়া যাওরে…
তারপর বড় হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আসি ১৯৪৬ সনে- ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে। এর আগেও গলানিয়ার পথে ভৈরব থেকে রেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছি দু’য়েকবার। মনে পড়ছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে সুরকি বিছানো পথে হাঁটতে হাঁটতে এসেছি ঘোড়াপট্টি। এখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি যাবে সরাইল। গাড়িতে উঠে বসে আছি- আরো যাত্রী হলে ঘোড়া ছুটবে খট খট করে। জায়গাটা ময়লা, দুর্গন্ধময়। দোকানপাট, হোটেলঘর, ছোট ছোট ভাঙ্গা টং- সব মিলিয়ে প্রাচীনকালের জরাজীর্ণ অতীতের ক্ষয়িষ্ণু ধ্বংশাবশেষ যেনো। এখনো চোখে ভাসে- ঘোড়ার গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু যেতেই খালের উপর ইয়া বড় উঁচু লোহার পুল- দু’পাশে লোহার রেলিং। শহরে ঢুকবার পথচারী ও যানবাহন চলাচলের একমাত্র রাস্তা এই খালপাড়ের পুল।
উঁচু পুল পার হয়ে উত্তর দিকে নিচে নামছি- বামে খাল, খালের পারে লাল ঘরবাড়ি, সদর পোস্ট অফিস। ডানে এবড়ো-খেবড়ো কাঁচা রাস্তা চলে গেছে খাল বরাবর থানার দিকে; একটু সামনে যেতেই ডানে রাস্তার নিচে দেখা যায় ছোট গম্বুজঅলা সুন্দর মসজিদ- নাম আরাফিয়া মসজিদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম মসজিদ। দেড়শো বছর আগে তৈরি। জঙ্গি মা ফারাহ ও ডেঙ্গু মাই ফারাহ নামে দু’ভাই এর প্রতিষ্ঠাতা। এরা মাইমল (জেলে)। তারপর বাঁ দিকে চলে গেছে লাল সুরকির রাস্তা। এই তে-রাস্তার উপর একটা নিমগাছ- ‘নিমতলায়’ রাস্তার পূর্ব পাশে নর্দমার উপর টিন-তরজার ছোট ছোট দোকানঘর। হোটেল-রেস্টুরেন্টই বেশি। বড় রাস্তার পশ্চিমে বিরাট কাঁচারি পুকুর- পুকুর পাড়ে ‘টাউন হল’, তার পাশে মিউনিসিপ্যালিটির দোতলা অফিস; উত্তর-পশ্চিম কোনায় ইয়া বড় বটগাছ, বটগাছের পাশে মোক্তার লাইব্রেরীর একতলা দালান।
সামনে এগুচ্ছি, ডান দিকে রাস্তা চলে গেছে ‘কোর্ট রোড’ নামে; বাঁ দিকের লাল সুরকির রাস্তা গেছে এস ডি ও’র কোর্ট ওই লাল বিল্ডিংটা পর্যন্ত। আর একটু উত্তরে যেতেই যেতেই বাঁয়ে কাঁচারি পুকুর। তার পাড়ে ট্রেজারী বিল্ডিং- রাস্তার ডানদিকে বিরাট বটগাছ। বটগাছের পাশ দিয়ে সরোজিনী বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে; স্কুলের গেইটটার আর একটু সামনেই মহকুমার সদর হাসপাতাল।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে এসে আমরা উঠি অন্নদা স্কুলের বোর্ডিংয়ে। স্টেশন থেকে রিকশায়ই আসি। শহরে রিকশার চলাচলই বেশি- ঘোড়ার গাড়ি নেই, থাকলেও শহরে নয়। সরাইল বুঝি যায়। অন্নদা স্কুলের বোর্ডিং বলে পরিচিত হলেও -পরে জেনেছি- এর আসল নাম ‘আসমাতুন-নেসা মুসলিম ছাত্রাবাস’। গোকর্নের নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা (১৮৬২-১৯২২) তাঁর মা’র নামে এটি স্থাপন করেছেন। বেশ মনে আছে আমার পরীক্ষার সিট পড়েছিল অন্নদা স্কুলের বর্তমান বিল্ডিং-এর সামনে মাঠের পূর্ব দিকে একটি লম্বা বেড়ার ঘরে। ১৯৪১-৪৩ সালে যুদ্ধের সময় ফেনী কলেজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসে। তখন কলেজের ক্লাস করার জন্য এই বেড়ার শেড তৈয়ার করা হয়েছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তখন হিন্দুরাই প্রধান। উকিল-মোক্তার ডাক্তার-মাস্টার সবাই হিন্দু; ওদিকে দোকানপাট, ব্যবসায়-বাণিজ্য, হোটেল-রেস্টুরেন্ট এগুলোও ওদেরই হাতে। মুসলমানদের মাঝে তখন সবে আত্ম-সচেতনতার ভাব জেগে উঠছে। অন্নদা স্কুলের কাছেই লোকনাথ দীঘিটা। সকালে পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত। ওদিকে যাওয়ার ফুরসত নেই। বিকালে প্রায়ই দেখতাম দীঘিটার চার পাড় দিয়ে ধুতি পরিহিত যুবা বৃদ্ধরা হাঁটাহাঁটি করছে- বৈকালিক ভ্রমণে জায়গাটাকে নয়নাভিরাম করে তুলছে। আশ্চর্য, কোন লুঙ্গি নেই, পাজামাও নেই! (মুসলমান নেই)।
দীঘির দক্ষিণ দিকে বেশ বড় মাঠ- দীঘির পাড় থেকে অনেক নিচুতে এই মাঠের পূর্বে ও পশ্চিমে ইয়া বড় বড় দুটি কড়ই গাছ। অনেক উঁচু। মাঠের পশ্চিম কোনায় খুপড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে সেখানে ধুতি পরিহিত যুবারা ভলিবল খেলছে। পূর্ব কোনায় কড়ই গাছটার পাশে ঝাঁপড়ি বেড়ার ভিতর ‘হার্ড টেনিস লন’। সেদিন আমি কোন মুসলমানকে টেনিস লন, ভলিবল খেলা বা লোকনাথ দীঘির পাড়ে সান্ধ্যভ্রমণে দেখিনি। আমরাও বিদেশি (?) মুসলমান ছেলে বলে ওদিক মাড়াতে সাহস করিনি।
সেদিন ছাত্র হয়ে যেখানে ঢুকতে সাহস করিনি, কালচক্রের ঘূর্ণনে এক যুগ পরে ‘প্রফেসর’ হয়ে সেখানে শুধু প্রবেশই করিনি- নিয়মিত টেনিসও খেলেছি। তখন কৌতূহলী মন ও চোখ দিয়ে ‘হার্ড টেনিস লনে’র মাঝামাঝি জায়গায় শ্বেতপাথরে খোদাই নাম ফলকটা পড়েছি- ঈড়হংঃৎঁপঃবফ ঁহফবৎ ঃযব ঢ়ধঃৎড়হধমব ড়ভ ধহফ ড়ঢ়বহবফ নু ই. ঈ. উবু, ও.চ.ঝ.উ.চ.ঙ, ইৎধযসধহনধৎরধ ড়হ ১ংঃ উবপবসনবৎ, ১৯৩৬। ১৯৩৬ এর পর কত দশক, কত যুগ পার হয়ে গেছে!
গত তিন-তিনটি দশক ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে প্রতিনিয়ত দেখে আসছি, দেখছি। চোখের সামনেই দিনে দিনে তিলে তিলে তিলোত্তমা শহরে রূপ নিচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তা হলেও ট্যাংকের পাড়ে যখন দাঁড়াই, চোখের সামনে দেখি একদিকে আল্লাহর ঘর সুরম্য মসজিদ, আরেক দিকে নগর সভ্যতার রমণীয় নিদর্শন আধুনিক ‘অডিটোরিয়াম’। কিন্তু এসব ছাপিয়ে আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ইয়া বড় বড় আকাশ-ছোঁয়া দুটি কড়ই গাছ, কড়ই গাছের পাশে সুন্দরভাবে ঘেরাও করা ‘টেনিস লন’- যেখানটায় কোন এক মহকুমা পুলিশ অফিসার তাঁর কীর্তিকে অমর করার অভিলাষে সন-তারিখসহ পাথরে খোদাই করে নিজের নামটা লিখেছিলেন।’…
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দর্শনীয় স্থাপনা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী এবং দর্শনীয় কিছু স্থাপনা হলো- সরাইলে অবস্থিত আরফাইলের মসজিদ, সদর থানার উলচাপাড়া মসজিদ, কালভৈরব মন্দির, ঐতিহাসিক হাতিরপুল, অখাউরায় খরমপুরের শাহ সূফী কেল্লা শহীদের মাজার, কসবার কৈলাঘর দুর্গ, কুল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কবর, সৌধ হিরন্ময়, শহীদ মিনার, তোফায়েল আজম মনুমেন্ট, শহীদ স্মৃতিসৌধ, ভাদুঘর মসজিদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু এবং আর্কাইব মিউজিয়াম।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার বিবেচনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি বিশেষ অঞ্চলের স্বীকৃতি পেতে পারে অনায়াসেই। গেলো শতাব্দীতে আমাদের ইলমি অঙ্গনের জন্য ১৯৮৪ সালে জেলার মর্যাদা পাওয়া এ অঞ্চলের অবদান সবিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। হাজী ইউনুস, ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম, মুফতি নুরুল্লাহ আর বড় হুজুর সিরাজুল ইসলাম সাহেবের মতো বরেণ্য আলেমদের কল্যাণে বরাবরই আলোচনায় থেকেছে এই জেলাটি। আর মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) নেতৃত্বে বিগত দুই দশকের ভূমিকায় এটি তো বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। অনেক আগে থেকেই এখানকার মানুষেরা ধার্মিক, শান্তিপ্রিয়। এ জেলার আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সাধারণত অন্যান্য জেলায় তেমন দেখা যায় না। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এখানকার লোক হক ও হক্বানিয়্যাতের জন্য নিবেদিত। আত্মত্যাগী। জিহাদী জযবায় উদ্যমী। তাগুত ও বাতিলের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন। বাতিলের সামনে কখনও মাথা নত করে না।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- তাদের ঐতিহ্য আদিকাল থেকেই। বৃটিশ কর্তৃক নবুওয়্যাতপ্রাপ্ত ভ- কাদিয়ানীর আবির্ভাব ঘটলে তার মোকাবেলায় দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) এগিয়ে আসেন। তার কুরআন-হাদীসভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ অগ্নিঝরা বক্তৃতার সামনে কাদিয়ানীর ভ-ামী মাকড়সার জালের ন্যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। জামিয়া ইউনুসিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হাজী মুহাম্মাদ ইউনুস (রহ.)ও তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর এ সময় ফখরে বাঙ্গাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতী সন্তান মাওলানা তাজুল ইসলাম দারুল উলূম দেওবন্দে আল্লামা কাশ্মীরীর নিকট অধ্যয়নরত। কাদিয়ানীদের মোকাবেলায় বিভিন্ন সভা সমিতি, সেমিনার ও কনফারেন্সে আল্লামা কাশ্মীরী তার প্রখর মেধাসম্পন্ন এ তুখোড় ছাত্রটিকে পাঠিয়ে দিতেন। ছাত্রটিও তার উস্তাদের সুধারণার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হন। কথায় বলে, যেখানে বাতিল সেখানেই হক। যেখানে নমরূদ সেখানে ইবরাহীম। যেখানে ফেরআউন সেখানে মুসা। দেশে আসার পর হযরত ফখরে বাঙ্গাল তার চারপাশে কাদিয়ানীদের উৎপাত দেখতে পান। তিনি ওয়াজ-নসিহত, বাহাস-মুনাযারা তথা যুক্তি-তর্ক এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের জীবনব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর আজীবন সে জিহাদি সিলসিলা অব্যাহত রাখেন। প্রখ্যাত মুবাল্লিগ হযরত মাওলানা আলী আকবরের (রহ.) জন্ম এখানেই।
প্রথিতযশা মুফতি ও শায়খুল হাদীস আল্লামা নুরুল্লাহ (রহ.) এখানকার এক প্রাণপুরুষ। মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহ.) কুরআনের খেদমতে নিবেদিত এক মহান ব্যক্তিত্ব। এ সিলসিলারই সর্বশেষ অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন মুফতি ফজলুল হক আমীনী (রহ.)।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াই বাংলাদেশের অন্যতম জেলা যাতে আজ পর্যন্ত কোনো সিনেমা হল নেই। সিনেমা হল না থাকাটা নয়, হতে না পারার কারণটাই গুরুত্বপূর্ণ। ২০০১ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক সব ধরণের ফতোয়া অবৈধের রায় ঘোষিত হলে ইসলামপ্রিয় জানবাজ মুসলমানেরা সারাদেশের ন্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেও প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশের নির্মম গুলিতে নয়জন মরদে মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদের আগুন। পরবর্তী ঘটনাবলী তো বিশ্ববাসী সবাই অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বরাবরই আলেমদের প্রভাব ছিলো এবং আছে। সুতরাং বড় হওয়া, গড়ে ওঠা এবং পরবর্তীকালে নিজের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিঃশর্তভাবে এই জেলার মানুষকে মুফতি আমিনী (রহ.) পেয়েছেন একনিষ্ঠ সমর্থক ও সহযোগী হিসেবে।
মুফতি আমিনীর (রহ.) বংশধারা
শেকড়ের খোঁজ
বাংলায় ঊর্ধŸতন তৃতীয় পুরুষকে বলা হয় প্রপিতামহ। পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহ। মুফতি আমিনীর প্রপিতামহ মহিউদ্দিন বেপারী ওরফে মুদ্দি বেপারী আমিনপুর নামে তাদের গ্রামটির গোড়াপত্তন করেন। সঙ্গে ছিলেন তার দু’ভাই হুদি বেপারী এবং মন্দি খনকার। কৌতুকপ্রিয় বাঙালির নাম সংক্ষেপনের খেসারত দিতে গিয়ে তাদের মূল নামগুলো উদ্ধার করা আজ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তিতাসের উত্তর তীরঘেষা এ আমিনপুরে তারা দক্ষিণ তীরের রসুলপুর থেকে এসেছিলেন। ব্যবসায়িক স্বার্থে। দূর-দূরান্তে পাট ও কাঠের চালান দেওয়া-নেওয়ার সুবিধার্থে তিতাসতীরের এখানে এসে তারা বসত গড়েন। মনুষ্যবসতিশূন্য এ অঞ্চলের নাম রাখেন আমিনপুর। এটি তখন বাঁশবাগান আর ঝোপঝাড়ে ঘেরা পশু-পাখির অভয়ারণ্য। রসুলপুরেরও আগে তাদের ঊর্ধŸতন প্রজন্ম তথা চতুর্থ প্রজন্মের অবস্থান ছিলো পয়াগে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এর অবস্থান। এই চতুর্থ প্রজন্মের পুরুষরাও তিন ভাই ছিলেন। হার মাহমুদ, জার মাহমুদ এবং রজব আলী। বর্তমানে আমিনপুরে তাদের মৌলিক অবস্থান হলেও রসুলপুর, পয়াগ এবং আশপাশে আরো দু’একটি গ্রামে এ বংশের উত্তরাধিকারীরা ছড়িয়ে আছেন। আপাত অর্থহীন এ ইতিহাস টেনে আনার কারণ হলো, মুফতি আমিনী এমন একটি বংশে জন্মগ্রহণ করেন, যারা কমপক্ষে এক-দেড়শত বছর ধরে এ অঞ্চলে দাপটের সাথে বসবাস করে আসছিলেন। এবং ধর্মকর্মে, শিক্ষায়, সচ্ছলতায় তারাই এগিয়ে ছিলেন সমসাময়িক অন্য সবার থেকে।
পরিবার ও বংশীয় আভিজাত্যের বিষয়টিও ফেলনা নয়। বাদশাহ ফকির হলেও যেমন তার বাদশাহী স্বভাব ছাড়তে পারে না, ফকীর বাদশাহ হয়ে গেলেও তার পুরনো খাসলতগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারে না। বংশ এবং বংশীয় প্রভাবের বিষয়টি ইসলাম শুধু স্বীকারই করে না, খুব গুরুত্বও দেয়। প্রশাসন ও বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে ইসলাম এ নিয়ে বর্ণনা করেছে বিশেষ তাৎপর্য। বিষয়টি আধুনিক বিজ্ঞানেও প্রমাণিত। ডিএনএ’র রহস্য আবিষ্কারের পর থেকে পুরো বিষয়টিরই একটি জাদুকরি মোড় নিয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, একজন মুফতি আমিনীর গড়ে উঠার পেছনে তার এ বংশীয় ঐতিহ্য সহায়ক হয়েছে অনেক দিক থেকেই।
ইলম ও বুজুর্গির ধারা
ধর্মকর্ম ও বুযুর্গির দিক থেকে এ বংশের খ্যাতি কয়েক পুরুষ আগে থেকেই। মুফতি আমিনীর (রহ.) দাদা হাজী সিরাজ আলী মোল্লা সেই উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে জাহাজে করে চার চারবার হজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এবং তখন থেকেই এ বাড়িটি হাজীবাড়ি হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে। মুফতি আমিনীর বাবা ওয়ায়েজ উদ্দিন মোল্লাও হজ করেছেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমকালীন আকাবিরের সোহবতে ধন্য একজন পরিপূর্ণ আবেদরূপে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি পীরজী হুজুরের (রহ.) সাথে বাইয়াতের সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি জামিয়া ইউনুসিয়ার সকল মুরব্বিগণের দীনি কার্যক্রমের সহযোগী ছিলেন। ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে গভীর সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। আলেম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের অত্যন্ত মহাব্বত করতেন, তাদের খেদমত করার চেষ্টা করতেন। তবে সে তুলনায় এ বংশের ইলমি উত্তরাধিকার তেমন সমৃদ্ধ নয়। মুফতি আমিনীর পূর্বে মধ্যম মানের আলেম হিসেবে পরিচিতি ছিলো তার মামা মরহুম ইদ্রিস মিয়ার। মুফতি আমিনীর মা- মোছাম্মৎ ফুলবানু নেছাও ছিলেন খুবই পরহেযগার, আমলি ও দরাজ হৃদয়ের নারী।
এসব ছাড়াও এক্ষেত্রে সবচে’ বড় ও গুরুত্বের দাবি রাখে যে বিষয়টি তা হলো, দেশ-বিদেশের হাজারো ওলামায়ে কেরামের আতিথ্য গ্রহণের সৌভাগ্য। মুফতি আমিনীর বাবা ছিলেন যাকে বলে আলেম অন্তপ্রাণ। দেশ-বিদেশের সমসাময়িক এমন কোনো আলেম ছিলেন না, যাদের পদচারণা পাওয়ার সৌভাগ্য থেকে হাজীবাড়ি বঞ্চিত হয়েছে। বিখ্যাত জামেয়া ইউনুসিয়ার সুবাদে পীরজী আব্দুল ওয়াহহাব, শামসুল হক ফরিদপুরী এবং হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) হরদম যাতায়াত ছিলো। এ বাড়িতে তারা জায়গিরও ছিলেন বেশ কিছুদিন। এ মহান পুরুষরা ছাড়াও নানা সময়ে এ বাড়িতে আগত ওলামায়ে কেরামের তালিকায় আছেন হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী, শায়খ আবু তাহের মুহাম্মদ ইউনুস, খতিবে আজম সিদ্দিক আহমদ, ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম, মাওলানা আতাহার আলী, বড় হুজুর আল্লামা সিরাজুল ইসলাম (রহ.)সহ তৎকালীন অগণিত ওলামায়ে কেরাম। যাদের প্রত্যেকেই কাশফওয়ালা আলেম ছিলেন। মুফতি আমিনীর বড় ভাই জনাব নূরুল হক কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বলছিলেন- বাবার ঐকান্তিক কামনার পাশাপাশি এসব যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের দুয়াই আমিনীর বড় হতে পারার এবং এমন আম কবুলিয়াতের বড় রহস্য।
দুটো ভবিষ্যৎবাণী
একজন মুফতি আমিনী একদিনেই গড়ে ওঠেন না। অনেক দুয়া, অনেক পরিশ্রম এবং আল্লাহ পাকের রেজামন্দির বদৌলতেই এ স্তরে কেউ পৌঁছতে পারে। সুতরাং কারো শৈশব, পড়াশুনা এবং চারিত্রিক বৈচিত্র্য দেখে তার ভবিষ্যৎ অনুমান করা হয়তো অসম্ভব কিছু নয়। আমাদের চোখের সামনে হরদমই এসব ঘটে থাকে। তবে মরহুম মুফতি আমিনীকে নিয়ে যে দুটি ঘটনা ও ভবিষ্যৎবাণী এখানে উল্লেখ করতে যাচ্ছি এগুলো তা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এবং দুটো ঘটনাই প্রতিনিধিত্ব করে আলাদা দুটো সময়ের, আলাদা দুটো আবহের। মুফতি আমিনীর বাবা মরহুম ওয়ায়েজ উদ্দিন আলেমদের শুধু ভালোই বাসতেন না; প্রতিটি মুহূর্ত আলেমদের সাথে কাটাবার, তাদের রূহানী ফয়েজ লাভ করার সুতীব্র কামনাও হৃদয়ে লালন করতেন। প্রসিদ্ধি আছে, প্রায়ই তিনি জামেয়া ইউনুসিয়ার দরসে হাদীসে গিয়ে ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম বা বড় হুজুর সিরাজুল ইসলামের সবকে গিয়ে বসে থাকতেন। তার ছেলেদের এমন আলেম হওয়ায় আশাবাদ ব্যক্ত করতেন। দুয়া চাইতেন। বড় ভাই জনাব নূরুল হকের কাছে একদিন ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম বললেনÑ নূরুল হক, আলেমদের প্রতি তোমার বাবার যে মহাব্বত, গোটা বাংলদেশের আর কারো মধ্যে এমন দেখা যায় না। এর পরিণাম অবশ্যই ভালো কিছু হবে। এবং জনাব নূরুল হকের ভাষ্যমতে ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলামের উল্লেখিত এই ভালো পরিণামই ছিলেন মুফতি আমিনী। মুফতি আমিনী বয়সে তখন একদম শিশু।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো অনেক পরের। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম-বুযুুর্গ আব্দুল্লাহ দরখাস্তী মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসতেন। একবার অনেকে মিলে তার কাছে আবদার করলেন রমজানের একমাস ঢাকায় থেকে যেতে। এটি গেলো শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ের ঘটনা। তিনি রাজি হলেন। তার থাকার জায়গা প্রস্তুত করা হলো চকবাজার শাহী মসজিদের তৃতীয় তলায়। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) একদিন অন্যরকম একটি দরখাস্ত পেশ করলেন আব্দুল্লাহ দরখাস্তীর কাছে। আহ্বান জানালেন তার প্রিয় একজন ছাত্রকে একঘন্টা করে একমাস পড়াতে। প্রিয় সেই ছাত্রটি অতিঅবশ্যই ফজলুল হক। তিনি রাজি হলেন। শুরু হলো নিয়মিত পড়াশুনা।
লালবাগের ছাত্র ফজলুল হক শাহী মসজিদে গিয়ে ফজর পড়ে সবক নেওয়া শুরু করলেন। ঘটনা সেখানেই। ফরিদপুরী (রহ.) একদিন বড় ভাই নূরুল হককে নির্দেশ দিলেন সাথে যাবার জন্য। তিনি গেলেন। সেদিন খুলনা থেকে তৎকালীন বড় তিনজন আলেম এলেন আব্দুল্লাহ দরখাস্তীর সাক্ষাতে। নামাজের পরপরই সাক্ষাৎ করতে চাইলেও বাধ সাধলেন খাদেম। জানিয়ে দিলেন, এক ঘন্টার আগে কারো কামরায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। যথারীতি এক ঘন্টা অতিবাহিত হলো। ছাত্র ফজলুল হক কামরা থেকে বেরুলেন। সাথে আব্দুল্লাহ দরখাস্তীও। ছাত্রের সাথে সাথে নীচে নেমে এলেন। গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন মোড় নেওয়ার আগ পর্যন্ত যতোক্ষণ ছাত্রটিকে দেখা যায়। আলেমদের জামাতটি তো বিস্ময়ে থ, ব্যাপার কি! কামরায় গিয়ে অন্য সবকিছুর আগে তারা এ রহস্যের বিষয়ে জানতে চাইলেন। রেগে গেলেন আব্দুল্লাহ দরখাস্তী। বললেন- তোমরা এসব জানতে এসো না। তোমরা তো জাহেরি ইলম নিয়ে আমার কাছে এসেছো। ওর ব্যাপারটা আমি জানি। এই ছেলে একদিন এমন স্তরে উন্নীত হবে, ইস্ট-ওয়েস্টের (উপমহাদেশ বা পৃথিবীর) সবাই তাকে সম্মান করবে। ছাত্র ফজলুল হক তখন একাডেমিক পড়াশুনার শেষ পর্যায়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে গেলেন, গড়ে উঠলেন অনন্য এক রাহবার হিসেবে।
অনন্য উত্তরাধিকার
মুফতি আমিনী সাহেবের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে প্রধান সূত্র হিসেবে আমরা তার বড় ভাই জনাব নুরুল হককে নির্বাচিত করেছি। ৯০ ছুঁইছুঁই এই প্রবীণকে আমরা তার মতো করেই কথা বলতে দিয়েছি। সাথে থাকা স্থানীয় এক হাফেজ সাহেব মাঝে মধ্যে অনর্থক প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ায় আমাদের সামনেই ক’বার তিনি খুব রেগে গেলেন। ধমকে উঠলেন বিচলিত হওয়ার মতো করেই। একটুপর আবার একদম স্বাভাবিক হয়ে দুঃখও প্রকাশ করলেন। এভাবে বলতে বলতেই একসময় তথ্যটি দিলেন। বললেন, আমিনীর সাহস ও জালালি তবিয়তের মূল ও প্রাথমিক উপাদান পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আমার খুব রাগ । আব্বাকেও রাগতে দেখেছি। তবে বেশি রাগ ছিলো আম্মাজানের। এর নির্যাসটাই পেয়েছে ফজলু। পরে এর সাথে আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস, কুরআন-হাদীসের ভালোবাসা এবং বুযুর্র্গদের দুয়া মিলে অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের রূপ পরিগ্রহ করে।
হাজীবাড়ি হাজীপরিবার
বাবা ওয়ায়েজ উদ্দিন এবং মা ফুলবানু নেসার সংসারে আমিনী সাহেবরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। দুই ভাই, তিন বোন। নূরুল হক, ফজলুল হক, আমেনা বেগম, মোমেনা বেগম ও উম্মে রূমান। এক বোন জন্মের পরপরই মারা যায়। তাকে হিসেবে ধরা হয়নি। এ পাঁচ জনের মধ্যে ‘ফজলু মিয়া’ নামের ছেলেটি ছিলেন তিন নাম্বার। পাঁচ ভাই-বোনের অন্য চার জনই বর্তমানে জীবিত । বিদায় নিয়েছেন কেবল তাদের সবার হৃদয়ের মধ্যমণি মুফতি আমিনী। বাবার মৃত্যু ৮৮-৮৯ এর দিকে, মুফতি আমিনী লালবাগের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নেওয়ার পর। মায়ের ইন্তেকাল আরো অনেক পরে। দু’হাজার একে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর। অর্থাৎ তার জীবনের সবচে বড়দুটো অর্জনের পরপরই সবচে বড় দুটো কুরবানী আল্লাহ পাক তার কাছ থেকে নিয়েছেন।
শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ হিসেবে খ্যাত জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ এই ক্ষেত্রটি মুফতি আমিনীর জন্য অতিঅবশ্যই একটি উত্তম তাকদীরী ফয়সালা ছিলো। ঐতিহ্য, আভিজাত্য আর সচ্ছলতা শুধু নয়, এই পরিবার আজীবন তাকে ছায়া দিয়ে গেছে মহীরুহের মতো। কখনো এক মুহূর্তের জন্যও তাকে পেছনে ফিরে তাকাবার সুযোগ দেয়নি। তার গতিময় অগ্রযাত্রায় একটুও যাতে ছেদ না পড়ে সেজন্য সবসময়ই এই পরিবার সচেষ্ট ছিলো অসম্ভবরকম। বাবা-মা থেকে শুরু করে ভাই-বোন সবাই, পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যই একান্তভাবে কামনা করে গেছেনÑ তাদের সন্তানটি, তাদের ভাইটি যেনো নবীর সত্যিকার একজন ওয়ারিস হিসেবে গড়ে ওঠে। একজন বড় আলেম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সত্যিই এ এক বিরল বাস্তবতা।
যে কারো বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার পরিবারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু একটা সময়ে গিয়ে পরিবারের সদস্যরা চায় ছেলে এবার কিছু দিক। অথবা পরিবেশের কারণেই এ অনিবার্য বাস্তবতাটা সামনে এসে যায়। কিন্তু যাদের সন্তান হবে এমন কালজয়ী, অনন্য এক ব্যক্তি, তারাও তো একটু ব্যতিক্রমই হবেন। এই পরিবারটিও তাদের ‘ফজলু মিয়া’কে গড়ে তুলছিলেন সব দায় থেকে মুক্ত করেই। নইলে মুফতি আমিনী তো এমন স্তরে পৌঁছেছিলেন যে, অর্থবিত্ত হরদম তার পায়ের কাছে লুটোপুটি খেতো। এরপরও তিনি না নিজের জন্য কিছু করেছেন, না পরিবারকে কিছু দিয়েছেন। সব বরং ব্যয় করেছেন ইসলামী আন্দোলনের পেছনে। ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে। তার এই দেওয়া এবং দিতে পারার মানসিকতা যে উদারতা ও মহত্তের পরিচয় বহন করে, তা ভাষার বর্ণনায় তুলে আনা মুশকিল অবশ্যই। কিন্তু নিজের স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবা, ভাই-বোনকে কিছু দেওয়ার দায় থেকে মুক্ত থাকার পরিস্থিতি যারা তার জন্য তৈরি করে রেখেছিলেন তারাও নিঃসন্দেহে অনেক কৃতিত্বের দাবিদার। যে বাড়ির ছেলেটি জাতীয় সংসদের সদস্য হতে পারার গৌরব পর্যন্ত অর্জন করেছেন, তার বাড়িটা আজো কেনো বৃটিশ আমলের জীর্ণতা নিয়ে ধুকবে? তাই আমাদের মতো অবুঝদের প্রশ্নে বড় ভাই যখন বলে ওঠেন, আমরা টাকা-পয়সার জন্য আমিনীকে গড়ে তুলিনি। আমরা আল্লাহর রাস্তায় ওকে কুরবান করে দিয়েছি। বাবা সবসময় কঠোর ভাষায় বলতেন, ওর কাছে কখনো কিছু চাইবা না বা এমন পরিস্থিতিও সৃষ্টি করবা না যাতে সে বাড়ির বিষয়াদি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। আজো আমাদের এবং বাড়ির এ জীর্ণদশা সত্ত্বেও এ নিয়ে আমাদের কারো কোনো চাওয়া নেই, আক্ষেপ নেই। আমরা তো দেখেছি ও কী করছে আর কী করতে পারছে। নিজের জন্য কিছু কি করতে দেখেছেন? ওর বিরল অর্জনগুলোই আমাদের স-ব।
নদীর তীরবর্তী শহুরে সুবিধাবঞ্চিত একটি গ্রাম হলেও আর দশটা পরিবার থেকে এই হাজী পরিবার ব্যতিক্রম ছিলো। ব্যতিক্রমের অর্থ এই নয় যে, শিক্ষায়-সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রশ্নে ওরা শতভাগ স্বার্থকতার পরিচয় দিয়েছে। তবু সবসময় ইলমি ও আমলি মানুষদের আনাগোনায় এসবের সহযোগী ও মুনাসিব একটা আবহ এ বাড়িতে ঠিকই গড়ে উঠেছিলো। তাই স্থানীয়ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও উদার নৈতিকতায় এ পরিবারের অগ্রগামিতা সহজেই অনুমেয়। এ উৎকর্ষতার বরকত ছিঁটেফুটে হলেও মুফতি আমিনী (রহ.) পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। আর কে না জানে- ছোটবেলার এ ছোট্ট আবেশের রেশটুকু রয়ে যায় আজীবন।
মুফতি আমিনী রহ.- জন্ম, শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
আমিনপুর
জানুয়ারি ২০১৩। জ্যাম-কুয়াশার বিড়ম্বনা কাটিয়ে বাসটি অবশেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছলো। পৌষের নিস্তেজ সূর্য ততোক্ষণে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। বাস ছেড়ে সঙ্গীকে নিয়ে দ্রুত অটো ধরলাম। লক্ষ্য এবার আমিনপুর। তিলোত্তমা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের আওতাভুক্ত একটি ওয়ার্ড হলেও আহামরি কিছু নয়। খুবই সাধারণ। আমি বরং বলবো- রূপসী বাংলার চিরায়ত রূপ ছেড়ে শহুরে হয়ে উঠার যন্ত্রণাকাতর বাংলাদেশের অসংখ্য গ্রামের একটি এই আমিনপুর। তবে অন্যরকম ব্যাপারটা টের পেতে শুরু করলাম একটু পর থেকেই। পৌষের ঠা-া বাতাসকে পাশ কাটিয়ে ¯িœগ্ধ একটা আবহ আমার ভেতরকার বালককে জাগিয়ে তুললো মুহূর্তেই। আন্দাজের ভরে পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, এদিকে কাছে কোথাও নদী আছে?…‘হ্যাঁ, আছে তো।’ বয়ষ্ক এক মুরব্বি উত্তর দিলেন। দু’ পাশের ফসলি জমির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরো বললেন- ‘বর্ষায় এগুলোও বেশ কিছুদিনের জন্য নদীর পেটে চলে যায়।’ ধারণা সত্যি হওয়ার পুলক নিয়ে আমি আবারো তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম নদীর?..জবাবে যা শুনলাম, আমার জন্য তা চমকাবার মতোই ব্যাপার হলো। আমি বড় হয়েছি দেশের বিখ্যাত-দীর্ঘতম নদী ব্রহ্মপুত্রের তীরে। আমার পুরোটা শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিতালী করে। নদীর আবহাওয়া ও চরিত্র আমার অস্তিত্বের শেকড়ে গাঁথা। লোকটির কাছে নদীর নাম শুনে তাই মুহূর্তেই হারিয়ে গেলাম বিংশ শতাব্দীর সেই চল্লিশের দশকে।
নদীর নাম তিতাস! চমৎকার নদীটির চমৎকার এ নাম অনেক কবি সাহিত্যিকই নানাভাবে তাদের লেখায় এনেছেন। তবে তাদের সবার চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকবেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম এ ঔপন্যাসিক তার প্রিয় তিতাসকে বিখ্যাত করে গেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি লিখে।
কিন্তু কি আশ্চর্য, কলকাতায় মাসিক মোহাম্মদির অফিসে বসে অদ্বৈত যখন লিখছেন-‘তিতাস একটি নদীর নাম। কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়, রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়ে ঘুম পাড়াইতে বসে’।…ঠিক সে সময়ই তিতাসতীরের আমিনপুরে জন্ম নেয় একটি শিশু। নাম তার ফজলুল হক। বাবা-মা আদর করে ডাকেন ‘ফজলু’। রূপ-রঙের বাহার নেই, শরীর-স্বাস্থ্যের চমক নেই। নিতান্তই সাধারণ এক পল্লীবালক। তবে নদীতীরের আর দশটি ছেলের মতোই চঞ্চল, বাউ-ুলে আর খেলাপাগল সে ছেলেটাই একসময় বদলে যেতে শুরু করলো। সোনার কাঠি-রুপার কাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠার মতোই সে জেগে ওঠলো প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে। এরপর পুরো জীবনজুড়ে সৃষ্টি করে গেলো ইতিহাস। একের পর এক। সে ইতিহাস সংগ্রামের, বিজয়ের। ইতিহাস ধারাবদলের। খেলাপাগল দুরন্ত মনকে পাঠে নিমগ্ন করে, ফুল-পাখির সৌন্দর্যভাবনাকে ধর্মতত্ত্বের গভীরে ডুবিয়ে দিয়ে, নদীর বৈরি স্রোতের বিপরীতে লড়াই করার উদ্দাম সাহসকে নেতৃত্বের গুণে রূপান্তর করে সে যা যা করলো, গোটা উপমহাদেশের মানুষের মতো এই তিতাসকেও তা মনে রাখতে হবে অনন্তকাল।
নদীর অবদানের কথা আমি এতো করে উল্লেখ করছি কারণ, আমাদের গ্রামীণ জীবনে নদীর প্রভাব অনেক। নদী কেবল নেয় না, যা দেয় তা কেবল অসামান্যই নয়; অতুলনীয়ও। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের শৈশবের খোঁজ করতে গিয়ে চঞ্চল, খেয়ালি আর দুরন্তপনার যে ছাপ লক্ষ্য করি; এর সাথে পরবর্তী জীবনে তার প্রখর মেধা, অনন্য ব্যক্তিত্ব, অমিত সাহস এবং উদারতা ও সারল্যের অতুলনীয় নমুনার সূত্রটা ঠিক মিলছিলো না। এই নদীর খোঁজ আপাত এই বিপত্তির হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করলো। সন্দেহ নেই, বাড়ির পাশ দিয়ে কুলকুল রবে বয়ে চলা এই তিতাসের কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন ভাবনা, কৌতূহল আর সাহসের খোরাক। নদীর বিশালতাই তার অবচেতন মনে গেঁথে দিয়েছিলো বড় হবার স্বপ্ন। এবং দুষ্টু পল্লীবালকদের সাথে খেলাধুলা আর দুরন্তপনায় মেতে থেকেই তিনি অর্জন করে নিয়েছিলেন মানুষকে প্রভাবিত করার, সংগঠিত করার এবং সামনে এগিয়ে নেবার নেতৃত্বগুণ। এসব নিয়ে গভীরে ডুবে যাওয়া আমার ভাবনার ছেদ কাটলেন মধ্যবয়ষ্ক ড্রাইভারÑ ‘নামেন ভাই, এসে গেছি।’ খেয়াল করে দেখি সহযাত্রী সবাই নেমে দাঁড়িয়েছে। আমিও নামলাম। রাস্তার পাশেই ছোট্ট একটা খাল পূর্ব থেকে বাঁক নিয়ে সোজা দক্ষিণে এগিয়ে অদূরের তিতাসে পড়েছে। খালের ওপর দিয়ে ব্রিজ হয়ে একটি রাস্তা পশ্চিমে গেছে। আমরা দক্ষিণের পথ ধরলাম। একপাশে খাল অন্যপাশে হাজীবাড়ির তিন পুরুষের ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্যবসা- পাশাপাশি ক’টি স’মিল।
গাছ-কাঠ কেটে সাড়িবদ্ধভাবে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। ২০-৩০ গজ পর থেকেই শুরু হয়েছে হাজীবাড়ির সীমানা। যুগ যুগ ধরে পরিচিত এই হাজীবাড়িই আজকাল খ্যাতি পেয়েছে আমিনী বাড়ি হিসেবে। অনেকগুলো ছোট বড় ঘর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে কয়েক পুরুষের ঐতিহ্য নিয়ে। দু’একটি ছাড়া সংস্কার হয়নি একটিতেও। মুফতি আমিনীর হাতে গড়া মাদ্রাসার শিক্ষককে নিয়ে নির্ধারিত ঘরের দিকে এগুলাম। চারপাশে দেয়ালঘেরা জীর্ণপ্রায় একতলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে পড়ন্ত বিকেলের একরাশ বিষণœতা নিয়ে। বাঁ দিকের কোণার রুমে শুয়ে আছেন মরহুমের বড় ও একমাত্র ভাই জনাব নূরুল হক। নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সের এ প্রবীণ আমাদের দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এরপর আমাদের নিয়ে ডুব দিলেন ছ’যুগ আগের সুদূর অতীতে। সঙ্গে ছিলেন মরহুম মুফতি আমিনীর মামাতো ভাই এবং স্থানীয় সব কাজের একান্ত সহযোগী আনিসুর রহমান। ক্ষেত্র আমিনপুর। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি অতিঅবশ্যই বাংলার সিংহখ্যাত মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)।
শুভজন্ম
বেশিরভাগ সূত্রে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) জন্ম ১৯৪৫ সালে। তার প্রকাশিত বই পুস্তকসহ সবখানেই এই তথ্য ও হিসেব দেওয়া। কিন্তু তার বড় ভাই জনাব নূরুল হকের ভাষ্যমতে প্রকৃত সত্য অন্যরকম। গ্রামাঞ্চলের মানুষ জন্ম-মৃত্যুর হিসেব নিয়ে সাধারণত মাথা ঘামায় না। তাদের প্রয়োজননির্ভর জীবনে এসব হিসেবের কোনো মানে নেই। সে হিসেবে মুফতি আমিনীর জন্ম তারিখও টুকে রাখা হয়নি। কিন্তু তার বড় ভাইয়ের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠের দাবি- ফজলুর বয়স আরো বেশি। অন্তত পাঁচ বছর। তার যুক্তি, ভারত বিভাগের বিখ্যাত বছর ১৯৪৭ এ তাদের বর্তমান একতলা বাড়িটির ছাদ ঢালাই দেওয়া হয়। ফজলুর বয়স তখন ৫-৬ বছর। সুতরাং মুফতি আমিনীর জন্ম ৪২ এর দিকে। তার এ দাবি আরো দৃঢ় হয় এ কারণে যে, জীবদ্দশায় মুফতি আমিনী সাহেবও কাছের মানুষদের বলতেন- তার জন্ম ৪৫ এ নয়, আরো আগে।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) শৈশবে অত্যন্ত চঞ্চল ও বাউ-ুলে মানসিকতার ছিলেন। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো বা খেলাধুলা আর নদীতে সাঁতরানোর মতো বিষয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসতেন বালক ফজলু মিয়া। গ্রামের, বিশেষ করে নদীতীরের ছেলেরা একটু বেশিই দুরন্ত হয়। শৈশবের একটি ঘটনা প্রসঙ্গে মুফতি আমিনী (রহ.) বলেছিলেন- ‘আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন একটি পাগলা কুকুর স্কুলের মাঠে এসে একজনকে কামড় দেয়। এরপর থেকে কুকুরটি যখনই স্কুলের মাঠে আসতো, এলোপাতাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতো। সবাই ভয়ে কাঁপতো। আশপাশের লোকজন ভয়ে দৌড়ে পালাতো। তখন প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে ঘণ্টা বাজিয়ে স্কুলভবনের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হতো। আমার কাছে বিষয়টি অত্যন্ত খারাপ লাগতো। মনে মনে ভাবতাম, কী করা যায়, কিভাবে পাগলা কুকুরের আতঙ্ক থেকে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদেরকে মুক্ত করা যায়। নানা জল্পনা-কল্পনা করতে লাগলাম।
পরদিন যখন পাগলা কুকুরটি এসে স্কুলের মাঠে দৌড়াতে লাগলো, আমি একটি বড়ো লাঠি নিয়ে কুকুরটিকে ধাওয়া করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে কুকুরটিকে একদম এলাকাছাড়া করলাম। তারপর থেকে পাগলা কুকুরটি আর কোনোদিন স্কুল প্রাঙ্গণে আসেনি। সেদিন থেকেই শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীর নজরে পড়ে গেলাম। সবাই আমার এ সাহসের তারিফ করে নেতা বলে সম্বোধন করতে লাগলো।’ তখন থেকেই তার মেধা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষণ ফুটে ওঠতে থাকে। প্রচুর খেলতেন তবে হেরে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না আদৌ। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তার এ দুরন্তপনা অবশ্যই সহায়ক ছিলো। তবে এসবের মধ্যেও তিনি চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। প্রচলিত অর্থে স্কুল তখন ছিলো না। টুলে পড়ানো হতো। সেখানেই তিনি পড়েছেন। এরপর পীরজী মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাবের পরামর্শে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় অন্য এক ইতিহাস। সত্যিই কি?…
জামেয়া ইউনুসিয়ার বিদঘুটে তিন বছর
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হওয়ার পাশাপাশি ইউনুসিয়া তখন দেশেরও প্রধানতম দীনি শিক্ষাকেন্দ্র। দেশসেরা সব আলেম তখন ওখানেই পড়ান। বাবা ওয়ায়েজ উদ্দিন সেখানেই ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেন। বয়স তখন ৯-১০ বছর। ফখরে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম, হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ও হযরত মাওলানা আবদুন নূর প্রমুখকে এখানে তিনি ওস্তাদ হিসেবে পান। তবে ইতিহাসের চাকা তখন সামনে ধাবিত হতে প্রস্তুত হওয়ার পরিবর্তে পেছনে ঘুরতে শুরু করলো। প্রখর মেধার দ্যুতি ছড়িয়েও বালক আমিনী না পারলেন পাঠে মনোযোগী হতে, না পারলেন খেলাধুলার প্রচ- নেশা থেকে নিজেকে বের করে নিতে। ফলে বাবা-মায়ের স্বপ্ন-আকাঙ্খা ক্রমশই দুঃস্বপ্নের অমাবশ্যায় হারিয়ে যেতে শুরু করলো। সব চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সিদ্ধান্ত হলো নদী আর বাড়ির পরিবেশের বাইরে কোথাও পাঠানোর। শেষ চেষ্টার মতো। প্রচুর তালাশ এবং আবারো বড়দের পরামর্শে যাত্রা এবার মুন্সিগঞ্জের মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায়। এরপর থেকে ইতিহাস হয়তো সত্যিই বদলে যেতে শুরু করলো!
উচ্চশিক্ষা ও বিস্ময়কর পাঠমগ্নতা
বদলে যাওয়ার শুরু
বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসা। বর্তমানে মুন্সিগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত এ মাদ্রাসাটি ছাত্রদের তরবিয়তের প্রশ্নে তখন ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলো। হাফেজ হাজী মুহসিনুদ্দীনের (রহ.) দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মাদ্রাসাটি দ্রুত উন্নত হতে থাকে। পড়াশুনায়, তরবিয়তে, স্থাপত্যেও। মুরব্বীদের সাথে পরামর্শ করে বালক আমিনীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মোস্তফাগঞ্জে নিয়ে আসা হয়। চিন্তাগ্রস্ত বাবা ওয়ায়েজ উদ্দিন হাজী মুহসিনের কাছে সব খুলে বলেন। শেষ চেষ্টার কথা জানিয়ে যান ছেলেকেও। হাজী মুহসিন তার অভিজ্ঞ চোখে সহজেই ব্যাপারটা বুঝে নেন। শুরু হয় তার ক্যারিশম্যাটিক ভূমিকা।
ঢাকায় শিক্ষা জীবনের আট বছর
হাজী মুহসিন প্রথম এক সপ্তাহ বালক আমিনীকে কোনো সবক দেন নি। পড়তে বলেন নি একবারও। খেলা আর বালকসুলভ চঞ্চলতার ঘোর থেকে তাকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দিলেন। নিজের সাথে খাবার খাইয়ে স্বাভাবিক হওয়ার, নিজেই নিজের করণীয় নির্ধারণ করার স্বাধীনতা দিলেন। এবার কাজ হলো। বাবা-মায়ের ঐকান্তিক কামনা আর বুযুর্র্গদের দুয়ার বরকতে বদলে যেতে শুরু করলো বালক আমিনী। ক্লাসে বসতে লাগলো। নিজের ভেতরগত টানেই শুরু হলো অধ্যবসায়। পরের গল্পটা সবার জানা। গল্প?..হ্যাঁ গল্পই তো! কিছু বাস্তব কিছু অবাস্তব মিলেই তো গল্প হয়। তার পড়াশুনা, মনোযোগ, কিতাব-বইপ্রীতি আমাদের কাছে গল্পের মতোই। মোস্তফাগঞ্জে মাত্র ৩ বছরের পড়াশুনায় নিজের ভেতর কিতাব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার যে ঝোঁক, যে নেশা তিনি তৈরি করলেন, এই নেশার ঘোরেই কেটেছে তার পুরোটা জীবন। কিতাব আর বিনিদ্র রজনী তার চেতনার অস্তিত্বে মিশে গিয়েছিলো। বদলে যাওয়ার গল্পটা আসলে এখান থেকেই শুরু।
মুফতি আমিনীর শিক্ষা জীবনের বাকি অংশটুকু বিখ্যাত। মোস্তফাগঞ্জে নাহবেমীর পর্যন্ত ৩ বছর অধ্যয়নের পর তিনি চলে আসেন ঢাকার সে সময়ের সেরা মাদ্রাসা বড় কাটারায়। পীরজী হুজুর, সদর সাহেব এবং হাফেজ্জী হুজুর সবাই তখন বড় কাটারায়। এরপর সদর সাহেবসহ তারা লালবাগে এলে নিয়ে আসেন প্রিয় ছাত্রটিকেও। শুধুু ভালো ছাত্র হিসেবে নয়, পূর্বপরিচিতি এবং বাবা ওয়ায়েজ উদ্দীনের নেক আকাক্সক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই বালকটির প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন সদর সাহেব এবং হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)। এখানেই তিনি ঢাকার মুরব্বী মুফতি দীন মুহাম্মদ খান, মুফতি আবদুল মুঈয (রহ.), কিংবদন্তি মুহাদ্দিস মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ (রহ.), প্রচারবিমুখ দরবেশ মাওলানা আবদুল মজিদ ঢাকুবী (রহ.), আরিফবিল্লাহ মাওলানা সালাহুদ্দীন (রহ.) এবং শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের (রহ.) মতো পরশপাথরের সংস্পর্শ লাভ করেন। তাদের কাছ থেকেই তিনি নিবিড় পাঠমগ্নতা, গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, আল্লাহকে পাওয়ার ও আল্লাহমুখী হওয়ার ব্যাকুলতা এবং বাতিলের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ার নিঃসংকোচ মানসিকতার মতো অনন্য গুণাগুণ অর্জন করেন। দেশসেরা আলেমদের সংশ্রব, সুনজর, হাফেজ্জী হুজুর ও ফরিদপুরীর (রহ.) বিশেষ তত্ত্বাবধান, প্রখর মেধা আর কঠোর পরিশ্রমে গড়ে ওঠা মানসিকতার কল্যাণে তরতর করে এগিয়ে গেলেন মুফতি আমিনী (রহ.)। মেহনতের উপমায়, মেধার প্রখরতায়, বুদ্ধির ঝিলিকে আশপাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখলেন শিক্ষা জীবনের পুরো আট বছর। ’৬১ তে ভর্তি হয়ে ’৬৮ এ তিনি লালবাগ জামিয়া থেকে তাকমিল সম্পন্ন করলেন অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে।
এই আট বছরে কখনো তার সিরিয়াল ছোটে নি। সকল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতেন। মুতালাআয় এতো খ্যাতি লাভ করেছিলেন যে, তার গভীর ও একাগ্র অধ্যাবসায় সম্পর্কে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) বলতেন- ‘আগার মুতালাআ কারনা হে তো আমিনী কী তরহ্ কারো’ অর্থাৎ যদি মুতালাআ ও পড়াশোনা করতে হয়, তা হলে আমিনীর মতো করো।’ ছাত্র জীবনেই তিনি জীবন্ত উপমা হয়ে উঠেছিলেন।
পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা
এরপর শামসুল হক ফরিদপুরীর নির্দেশে পাড়ি জমালেন পাকিস্তানে। ফরিদপুরী (রহ.) করাচি নিউ টাউনের আল্লামা ইউসুফ বানুরীকে (রহ.) জানালেন, ২ বছরের জন্য আমার এক ছাত্রকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। উপমহাদেশের তখনকার শ্রেষ্ঠতম এই আলেম সানন্দে রাজি হলেন। এই ছাত্রকে পেয়ে বিস্মিত হলেন তিনিও। প্রতিষ্ঠানের নাম- জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানুরী টাউন করাচি। এটা তার শিক্ষা জীবনের পঞ্চম প্রতিষ্ঠান। মুহাদ্দিসুল আসর আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রহ.) নিজেই এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.) এর নিকট একাধারে ছয় বছর হাদীস অধ্যয়ন করেছেন। আলেমদের মাঝে এ কথা প্রসিদ্ধ, আল্লামা কাশ্মীরীর ইলম কেউ আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়নি। কেউ যদি হয়েই থাকেন, তিনি আল্লামা ইউসূফ বানুরী (রহ.)। আল্লামা বানুরী (রহ.) এর নামে করাচির ঐ এলাকার নামকরণ করা হয় বানুরী টাউন।
প্রায় ৫০-৫৫ রাষ্ট্রের ছাত্ররা আন্তর্জাতিক মানের এ জামিয়ায় পড়াশোনা করতো। তিরমিযী শরীফের শরাহ ‘মাআরিফুস সুনান’ এর গ্রন্থকার হিসেবে বানুরীর প্রসিদ্ধি বিশ্বব্যাপী। বিশেষভাবে সৌদি আরব, মিসর, ইরাকসহ আরববিশ্বে। বানুরীর মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব তার এ প্রতিষ্ঠানে অনেক বড় মুহাদ্দিস ও মুফতিকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার মধ্যে মুফতি আযম ওয়ালী হাসান খান টুনকি (রহ.), মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী দা. বা., বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ আল্লামা আব্দুর রশীদ নোমানী (রহ.), আল্লামা কাশ্মীরীর (রহ.) প্রত্যক্ষ শাগরিদ মাওলানা ইদরীস মিরাঠী (রহ.), মুফতি আহমাদুর রহমান (রহ.) ও ড. আব্দুর রাজ্জাক দা.বা. প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ওলামায়ে কেরাম। এখানে আমিনী (রহ.) উলূমুল হাদীস এবং উলূমুল ফিকহ বা ইসলামী আইনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন, বিশেষত আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রহ.)-এর মতো জগৎবিখ্যাত আলেম, জাহেদ ও আল্লাহ ওয়ালাদের মুহাব্বত-নেক নজর লাভে ধন্য হন।
মাত্র এক বছরের মাথায় মুফতি আমিনীকে ডেকে আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রহ.) জানালেন- তুমি এবার দেশে চলে যাও। এখানের শিক্ষা তোমার শেষ। দেশে গিয়ে এবার খেদমতে নিয়োজিত হও। তরুণ আমিনী দেশে ফিরলেন তার মনুষ্যদেহে মুফতি নামের সোনার পালক যোগ করে, যে পালকে ভর করে আকাশে আকাশে উড়ে বেড়িয়েছেন পরবর্তী চার দশকেরও বেশি সময়।
ফজলুল হকের আমিনী হয়ে ওঠা
মুফতি আমিনীর মূল নাম ফজলুল হক। ডাক নাম ফজলু মিয়া। এ নাম থেকে তার আমিনী নামে বিখ্যাত হওয়া নিয়ে নানা গল্প ছড়িয়ে আছে। আমিনপুর থেকেই তার আমিনী হয়ে ওঠা। তবে আমিনপুরী না হয়ে আমিনী হওয়ার কৃতিত্ব শামসুল হক ফরিদপুরীর (রহ.)। তিনিই তাকে প্রথমে ফজলু পরে আমিনী নামে ডাকা শুরু করেন। একসময় তা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রাবস্থায়ই। এবং আমাদের তিতাসতীরের-আমিনপুরের ফজলু মিয়া হয়ে ওঠেন আমিনী । মুফতি ফজলুল হক আমিনী।
প্রিয় উস্তায, ভালোবাসা নিয়ো
ছোটবেলা থেকেই ওলামাবেষ্টিত পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। ইউনুসিয়া, মোস্তফাগঞ্জ, বড় কাটারা ও লালবাগ দেশসেরা এ চার প্রতিষ্ঠানে তৎকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠ সব আলেমের সংশ্রব, তত্ত্বাবধান সবই তিনি পেয়েছেন। পাওয়ার চেয়ে বেশি তিনি আদায় করেছেন। তবে বাংলার প্রধান দু’ নক্ষত্র হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী ও হাফেজ্জী হুজুরের বিষয়টি তার জীবনের সাথে অন্যভাবে জড়িত। নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বালক ফজলুকে তারা মুফতি আমিনী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সে ইতিহাস সবারই জানা। তবে এ দু’জনের প্রতি তার যে কৃতজ্ঞতাবোধ আর ভালোবাসা ছিলো তা-ই বা আড়ালে থাকে কী করে। পাকিস্তান গমনের পরপরই হযরত ফরিদপুরী (রহ.) ইন্তেকাল করেন। করাচি খবর পৌঁছার পর যেটা হয়েছিলো আমাদের পক্ষে তা অনুমান করা সত্যি মুশকিল। প্রিয় শাইখের বিয়োগসংবাদ শুনামাত্র তিনি হুঁশ হারালেন। খাওয়া-গোসল বন্ধ হলো। নামাজ-ইবাদতের জোয়ারে ভাটা এলো।
দিন যায়, বেলা বয়ে চলে, তার স্বাভাবিক হওয়ায় নাম নেই। অজানা ঘোরে কেটে গেলো ৮-১০ দিন। এরপর ধীরে ধীরে ছাত্রটি সুস্থ হতে লাগলো। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো তার কর্মকা-। কিছুদিন পর বাড়ি থেকে চিঠি এলো বড় ভাইয়ের ঘরে ভাতিজার জন্মের সুসংবাদ নিয়ে। শোকগ্রস্ত আমিনী জবাব পাঠালেন প্রিয় উস্তাযের নামানুসারে ওর নাম শামসুল হক রাখার প্রস্তাব করে। এই শামসুল হকই বর্তমানে হাজীবাড়ির কাঠব্যবসার পঞ্চম উত্তরাধিকার। হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর আমিনীর (রহ.) অবস্থা হয় আরো সঙ্গীন। মশহুর আছে টানা কয়েক বছর কান্নার ভেতর দিয়ে কেটেছে তার সকাল-দুপুর। শুধু তার মানসিকতার কথাই বলি কেনো, তার জীবনের প্রতিটি বয়ানের ছত্রে ছত্রে, তার আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে, তার লিখিত সংকলিত প্রতিটি বইয়ের উৎসর্গপত্রে ছড়িয়ে আছেন এই মহান মনীষীদ্বয়। শায়খপ্রীতির এই তো নমুনা !
নয় মাসের ঐতিহাসিক সফর
দেশে ফেরার পর আলু বাজারে ইমামতি ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুফতি আমিনীর কর্মজীবন। কদিন পর হাফেজ্জী হুজুর তাকে ডেকে নেন জামেয়া নূরিয়ায়। শিক্ষকতার জগতে প্রবেশ করেন মুফতি আমিনী। দিন এগুচ্ছে। এগুচ্ছেন তিনিও। দেশের পরিস্থিতি তখন বেজায় খারাপ। পাকিস্তানীদের জুলুম-শোষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। বাঙালির ক্ষোভও এবার মাত্রা ছাড়ালো। মৌখিক দাবি আর কাগুজে আবদার ছেড়ে তারা জবাব দেওয়া শুরু করলো অস্ত্রের ভাষায়। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলো। বাদ থাকলো না মাদ্রাসাগুলোও। সময়ব্যয়ের কার্পণ্যে মর্যাদা যাদের মনীষীস্তরের, তারা কী করে অবসর যাপন করেন? হাফেজ্জী হুজুর প্রিয় ছাত্রকে পরামর্শ দিলেন এবার কুরআন হিফজের পর্বটা শেষ করে ফেলতে। আমিনী সাহেবের জীবনে মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়া প্রথম শিক্ষক বাংলার বিখ্যাত হাফেজ হাজী মুহসিনুদ্দীন তখন চাঁদপুরের মোমিনপুর মাদ্রাসায়। যুদ্ধের আঁচ তখনো সেখানে লাগেনি।
মাদ্রাসাও চলছে ভালোই। মুফতি সাহেব রওয়ানা হয়ে গেলেন। হাজী মুহসিন প্রিয় ছাত্রকে এবার নতুন ছাঁচে গড়তে লাগলেন। তখনই ইতিহাসটা রচিত হতে থাকলো। মাত্র কয়েক মাসে তিনি হিফজ সমাপ্ত করলেন প্রথাগত সব ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেই। তিনি তখন বিয়েযোগ্য পূর্ণ তরুণ এবং পরে সে বছরই বিয়ে করেন। হাজী মুহসিন তার অভিজ্ঞ চোখে দেখা একযুগ আগের স্মৃতি রোমন্থন করলেন আয়েশী ঢংয়ে, স্রোতের গতিতে ছাত্র মুখস্থ করছে পবিত্র কুরআন। এ ছিলো তার মাত্র ন’মাসের সফর। হিফজ সম্পন্ন হওয়ার পর তার মোস্তফাগঞ্জের এককালের সাথী এবং মুফতি আমিনীর শিক্ষক হাফেজ আব্দুর রবের কাছে পাঠিয়ে দিলেন শোনাবার জন্য। হাফেজ আব্দুর রব সাহেব তখন ঐতিহ্যবাহী হাটহাজারী মাদ্রাসায়। মুফতি আমিনী কুরআন শুনিয়ে ঢাকায় ফিরলেন সে বছরই। আকাশে উড্ডয়নের ঠিক আগ মুহূর্তে যেনো ঝলমলে ডানায় যোগ হলো পৃথিবীর সবচে’ মূল্যবান পালকটি, তিনি হাফেজ হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন মাত্র নয় মাসে।
বিস্ময়কর অধ্যবসায় ও পাঠমগ্নতা
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) মুতালাআ ও অধ্যবসায় ছিলো বিস্ময়কর। জীবনজুড়ে কখনো তিনি সারারাত ঘুমান নি, এমনকি অসুস্থ অবস্থায়ও। হয়তো কিতাব পড়ে নয়তো ইবাদতে বিভোর থেকে রাতগুলো কাটিয়ে দিতেন। বাসায় হোক বা মাদ্রাসায়, দেশে হোক বা বিদেশে, সফরে থাকুন বা হযরে, সুস্থ থাকুন বা অসুস্থ; তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলো কিতাব। জীবনজুড়ে তার এমন পাঠমগ্নতা এবং মুতালাআর অজ¯্র বিস্ময়কর ঘটনা তার কাছের মানুষদের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরার প্রয়াস নিলাম।
অভিমানের কান্না
তার সহপাঠীদের অন্যতম লালবাগ জামেয়ার বর্তমান সদরুল মুদাররিসীন আল্লামা আবদুল হাই বলেন- মুফতি আমিনী যখন পড়তে বসতেন, তখন দুনিয়ার অন্য সবকিছু বেমালুম ভুলে যেতেন, শুধুমাত্র কিতাবই তার খোরাক হতো। পরীক্ষায় কখনো তিনি ১ম স্থান লাভ করতেন আবার কখনো আমি লাভ করতাম। একবার তিনি পরীক্ষায় ১ম স্থান লাভ করতে পারেন নি। আমি ১ম স্থান লাভ করেছিলাম। সেই দুঃখে তিনি ওই সময়ে, যখন লালবাগ শাহী মসজিদের বারান্দায় ছাদ ছিলো না, মধ্যরাত পেরিয়েও সিজদায় পড়ে কাঁদতে লাগলেন। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। তিনি সিজদাতেই পড়ে রইলেন। তাকে সান্ত¡Íনা ও প্রবোধ দিতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি আপন সিজদায় নিমগ্ন হয়ে থাকলেন!
ট্রেন আসে যায়, যাত্রী বিভোর কিতাবে
বিশিষ্ট আলেম, জামেয়া ইমদাদিয়া কল্যাণপুরের প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু তাহের জিহাদী বলেন- মুফতি আমিনী (রহ.)-এর ইবাদত এবং মুতালাআ সম্পর্কে বলবো, তিনি ‘আদর্শ ছাত্র’ নামে বাংলায় এবং উর্দুতে ‘আকাবির কা তরজে মুতালাআা’ বই দুটির রচয়িতা এবং উদাহরণও। বই দুটির সঙ্গে মুফতি আমিনীর জীবনের আমি হুবহু মিল পেয়েছি। বইতে যদিও তিনি লিখেছেনÑ আকাবিরদের মুতালাআর কথা, তার নিজের নয়, অথচ বাস্তব জীবনের সঙ্গে মুফতি আমিনীর পুরোপুরি মিল আমরা খুঁজে পাই। মনে হয় বর্তমান সময়ে তার কিতাবের নমুনা তিনি নিজেই। তার মুতালাআর ব্যাপারে আমার উস্তাযের কাছে শোনা একটি ঘটনা। তিনি একবার ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাওয়ার জন্য ট্রেনের সিটে গিয়ে বসলেন। বসে কিতাব হাতে মুতালাআয় লেগে গেলেন। গাড়ি চলছে। চলছে তার মুতালাআ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে স্টেশন দিয়ে যাত্রী নামানো-উঠানো হলো। মুফতি আমিনী এর কিছুই টের পাননি! গাড়ি আবার ছেড়ে দিলো। পরের স্টেশন আখাউড়ায় এসে যখন থামলো তখন মুফতি আমিনী জানতে পারলেন, তিনি গন্তব্য ছেড়ে এসেছেন। আমিনীর এমন মুতালাআর দৃষ্টান্ত আরও অনেক শুনেছি।
আরেকটি ঘটনা। তিনি তখন ’৯১-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনের আগে টাকা দাখিল করার সময় কর্মীদের খরচবাবদ কিছু টাকা তিনি আমার হাতে দেন। টাকা হাতে অফিসে বসে থাকি। পরে অফিসের কাজ সেরে তার জামাতা মাওলানা যুবায়ের ও জসিমের হাতে সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রাত্রিযাপনের জন্য আমিনী সাহেব আমাকে নিয়ে মাদ্রাসা দারুল আরকামে যান। আমাদের থাকার জন্য ব্যবস্থা হলো মাদ্রাসার দফতরে।
আমিনী সাহেব শুলেন দফতরে থাকা মাদ্রাসার মুহতামিমের ডেস্কের পাশে. ভেতরে । রাত তখন গভীর। হঠাৎ আমিনী সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে বেরুলেন। তার মতো ভিআইপি ব্যক্তির এতো গভীর রাতে বাইরে বেরুনোটাকে আমি নিরাপদ নিশ্চিত করতে তাকে অনুসরণ করলাম। দেখলাম, ছাত্রহোস্টেলের বারান্দায় জ্বালানো বৈদ্যুতিক বাল্বের আলোয় কিতাব হাতে বসে গেছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম, আপনি সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে একটু বিশ্রাম করুন। ঘুমান। তিনি বললেন, আজ সারাদিন রাজনৈতিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় দিনের বেলায় কোনো কিতাব মুতালাআ করতে পারিনি, যার কারণে আমার মাথা ব্যথা করছে। এখন যদি অল্পসময়ের জন্যও কিতাব মুতালাআ করতে পারি, তবে ব্যথাটা একটু কমবে। আমি ঘুমাতে পারবো। এই বলে আমাকে ঘুমোতে যেতে বললেন। আর তিনি মাদ্রাসার দারুল আরকামে যখন সব ছাত্র ঘুমে, তাদের রেখে যাওয়া কোনো একটি কিতাব হাতে নিয়ে মনোযোগসহ মুতালাআ করতে লাগলেন। এই হলো তার কিতাব মুতালাআর ধরন!
তিনি সব বিষয়ের সবরকমের কিতাবই মুতালাআ করতেন। বিশেষ করে, তিনি আকাবির ও আসলাফের জীবনী বেশি বেশি অধ্যয়ন করতেন। যেমন আপবিতি, হায়াতুস সাহাবা, হেকায়েতে সাহাবাসহ বিভিন্ন বুযুর্র্গানেদীনের কিতাব। বিশেষ করে ইন্তেকালের দু’মাস আগে আমি তার রুমে গেলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, মাওলানা! হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিবের বিয়ের কাহিনী শুনুন। এই বলে তিনি কিতাব বের করে আমাকে শুনালেন। সেটি ছিলো একটি আরবি কিতাব। দুই কি আড়াই পৃষ্ঠাব্যাপী লিখিত আরবি ঘটনাটির শুরু-শেষ হুবহু বিশ্লেষণসহ আমায় পড়ে শোনালেন। এটাই ছিলো আমার জীবনে মুফতি আমিনীর (রহ.) মুখ থেকে শোনা সর্বশেষ আরবি কোনো কিতাবের অনুবাদসহ এবারত।
কিতাবের পাতাই কাফন যাদের…
মুফতি আমিনীর আর একজন জুনিয়র সহপাঠী স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন- আমিনী সাহেবের কাছে আমি মাঝে মাঝে কিতাব বোঝার জন্য যেতাম। ওই ছাত্রজীবন থেকেই তিনি পান খেতেন। বিকেলবেলা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কৌতুক এবং হাসি-আনন্দের আড্ডাও হতো। সেসময় প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ জোহর মাদ্রাসায় ছাত্রদের বক্তৃতার প্রশিক্ষণ হতো। অনেক সময় আমাকে সভাপতি করা হতো। কখনো উস্তাযগণও অংশগ্রহণ করতেন। মুফতি আমিনী সাহেব ওই প্রশিক্ষণে তখন উর্দুতে বয়ান করতেন। তিনি কথায় কথায় কিতাবের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলতেন, অমুক কিতাবের অমুক পৃষ্ঠায় এটা রয়েছে। দরসের সিলেবাসের বাইরে অন্যান্য কিতাবও তিনি প্রচুর পরিমাণে পড়তেন। কখনো মাদ্রাসার বাইরে পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে গিয়েও মুতালাআ করতেন। মাদ্রাসা ছুটি হলে আমরা বাড়ি চলে যেতাম আর তিনি সদর সাহেব হুজুরের সঙ্গে গওহরডাঙ্গা চলে যেতেন এবং কিতাব মুতালাআ করতেন। কোনো কোনো সময় লালবাগ ও কাটারা মাদ্রাসার কুতুবখানায় কিতাব নিয়ে নিমগ্ন হয়ে থাকতেন। ছাত্রজীবন থেকেই কিতাব মুতাআলার প্রতি এতো জওক ও শওক আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দান করেছিলেন যে, কিতাব ছাড়া তিনি থাকতেই পারতেন না। জীবনভর এবং ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি কিতাবের সঙ্গ ছাড়তে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা। ছাত্রজীবনে একবার তিনি লালবাগ শাহী মসজিদের বারান্দায় রাতের বেলা কিতাব পড়ছিলেন। তখনকার সময় মসজিদের বারান্দায় ছাদ ছিলো না। তিনি কিতাব মুতালাআয় বিভোর ছিলেন। ইতোমধ্যে প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া শুরু হলো। তার কোনো খবর নেই। শেষপর্যন্ত তিনি বৃষ্টিতে ভিজে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলেন। কিতাব মুতালাআয় তার এতোই মগ্নতা ছিলো যে, সেরকম উদাহরণ খুবই বিরল।
অনেকসময় বাড়ি যাওয়ার জন্য তিনি ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে কিতাব মুতালাআয় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ট্রেন এসে কখন যে চলে গেছে তার কোনো খবর ছিলো না। পরে মাদ্রাসায় চলে আসতেন। পরের দিন আবার যেতেন। কয়েকদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। পরে আর বাড়িই গেলেন না। মাদ্রাসায় থেকেই কিতাব মুতাআলা করে দিন কাটিয়ে দিলেন।
জীবন্ত কুতুবখানা
মুফতি আমিনীর (রহ.) ¯েœহভাজন ছাত্র, লেখক মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল লেখেন-‘তার অনুসন্ধিৎসা, গভীর অধ্যয়ন, মুতালাআর একাগ্রতা, জ্ঞানের গভীরতা সর্বোপরি তার ইলম ও ব্যক্তিত্বের বিশালতার কথা আপাত: প্রতিপক্ষ ও বিদ্বেষ ভাবাপন্নরা পর্যন্তও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। স্মরণযোগ্য যে, লালবাগ জামেয়া, জামেয়া নূরিয়া এবং জামেয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদ্রাসার তিনটির সুবিশাল কুতুবখানার দরসি ও গায়রে দরসি অধিকাংশ কিতাবেই মুফতি আমিনীর (রহ.) কলমের আঁচড় রয়েছে। ছোট্ট একটি ঘটনা প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
জীবনের প্রায় শেষ ভাগে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) তখনও চলাফেরা করতে পারেন। কী এক প্রয়োজনে একদিন লালবাগ দফতরে আসলেন। আমিনী সাহেবের কামরায় বসে বসে দুইজন দীর্ঘসময় কথাবার্তা বলছিলেন। ঘটনাক্রমে আমারও সেখানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। কথাবার্তার এক পর্যায়ে শায়খুল হাদীস সাহেব জামেয়ার কুতুবখানার জিম্মাদারকে তালাশ করলেন। তাকে ডাকা হলো। শায়খুল হাদীস তার মাধ্যমে একে একে কয়েকটি কিতাব আনিয়ে কোনো এক মজমুন যেন তালাশ করতে লাগলেন। কিন্তু পাচ্ছিলেন না। পেরেশান হয়ে একটির পর একটি কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যাচ্ছিলেন। এই বৃদ্ধ বয়সে শায়খুল হাদীস (রহ.)-এর ইলম অন্বেষণের নেশা ও ব্যাকুলতা মুফতি আমিনীর মতো উপস্থিত সকলকেই হতবাক ও মোহাবিষ্ট করছিলো।
এক পর্যায়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মুফতি আমিনী (রহ.) জানতে চাইলেন, হুজুর কি নির্দিষ্ট কোনো মজমুন তালাশ করছেন? তিনি একটি হাদীস উল্লেখ করে বললেন, এই হাদীসটির হাওয়ালা তালাশ করছি। লালবাগের কুতুবখানাতেই তা আমি পড়েছি। আমিনী সাহেব কুতুবখানার জিম্মাদারকে একটি কিতাবের নাম উল্লেখ করে তার জিলদে সানী আনতে বললেন। তা আনার পর কিতাব খুলে নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বের করে মুফতি আমিনী (রহ.) যখন শায়খের সামনে দিলেন, তখন হাওয়ালাটি পাওয়ার আনন্দে শায়খুল হাদীসের চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠলো। বহু খোঁজাখুঁজির পর অমূল্য ধন-রতেœর খাজানার সন্ধান পেলেও মানুষ এতো খুশি ও আনন্দিত হতে পারে কি না সন্দেহ।
নির্জন রাত বিমুগ্ধ লগন
সৌদি প্রবাসী আলেম, আরবি সাহিত্যিক ও গ্রন্থপ্রণেতা মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী বলেন- রাজনৈতিক প্রখরতা, সত্য ও ন্যায়ের বাস্তবায়নে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা, অন্যায় ও ইসলামবিরোধী যেকোনো হুমকির মুকাবেলায় বজ্র হুঙ্কার, পরম প্রভুর সান্নিধ্যের আকুল কাতরতা আর অদ্ভুত সেই পাঠমগ্নতা। জীবিত থাকতেই তিনি যে পাঠমগ্নতার জন্য ‘মিথ’ হয়ে উঠেছিলেন সে সম্পর্কে দুটি ঘটনা আজ তুলে ধরবো।
ছাত্রজীবনের কথা। সম্ভবত দাওরায়ে হাদীসের ছাত্র তিনি। কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের একটি সুন্দর অভ্যাস আছেÑ পড়াশোনার নিয়মতান্ত্রিক সময়ের বাইরে গিয়েও ভালো ছাত্ররা কিছু সময় বের করে নিজেদের একান্ত অধ্যয়নের জন্য। এর অন্যতম একটি সময় হচ্ছে, বাদ এশা লালবাগ মাদ্রাসার ভালো ছাত্ররাও অন্যদিনের মতো এশার নামাজের পর শাহী মসজিদের আঙিনায় গিয়ে হাজির। তাদের মধ্যে আছেন ছাত্র আমিনী। বারান্দায় সবাই পড়াশোনায় মগ্ন। ধীরে রাত যতো বাড়ছে, অধ্যয়নরতদের সংখ্যাও আস্তে আস্তে কমে আসছে। অবশেষে একে একে সবাই চলে গেলো। রয়ে গেলো কেবল একজন, পাঠমগ্ন ছাত্র আমিনী।
একসময় মসজিদের খাদেম এসে বারান্দার সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে চলে গেল। সিঁড়ির একটি লাইট জ্বালিয়ে রাখা দরকার, তাই সেটি জ্বালানো রইলো। আমিনী সাহেব সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন একইরকম মগ্নতা নিয়ে। অল্প আলোয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে, সমস্যা নেই- চোখ ছোটো করে পড়ে যাচ্ছেন। মশা কামড়াচ্ছে, তিনি নির্বিকার।
লালবাগ মাদ্রাসার সেই সময়কার প্রিন্সিপাল বের হয়ে সেদিক দিয়ে অজুখানায় যাচ্ছিলেন। আমিনী সাহেবকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার এখনো ঘুমাতে যাওনি? যাও, শুয়ে যাও। নমনীয় হয়ে আমিনী সাহেব উত্তর দিলেন, জি হুজুর, এই তো যাচ্ছি। একটু বাকি আছে, শেষ করে এখনই চলে যাবো।
প্রিন্সিপাল সাহেব খানিকপর অজু সেরে নিজ কামরায় চলে গেলেন। আমিনী সাহেব তখনো দাঁড়িয়ে। প্রিন্সিপাল সাহেব স্নেহবশত ফের তাগাদা দিয়ে গেলেন- যাও, শুয়ে যাও। আমিনী সাহেব বললেন, জি হুজুর, যাচ্ছি, একটুখানি বাকি, শেষ করেই চলে যাচ্ছি। সেই ‘একটুখানি’ আর শেষ হলো না। প্রিন্সিপাল সাহেব তাহাজ্জুদের সময় বের হয়ে এসে দেখেন, আমিনী সাহেব তখনো দাঁড়িয়ে, সেই অবস্থায়, সেই স্থানেই। তার মধ্যে তাড়াহুড়োর একটি ভাবÑ যেন এখুনি পড়া শেষ করেই চলে যাবেন।
প্রিন্সিপাল সাহেব হেসে জানতে চাইলেন, কী খবর ফজলুল হক? এখনো যাওনি! আমিনী সাহেবের সেই একই উত্তর, জি হুজুর, এইতো চলে যাচ্ছি। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, ক’টা বাজেÑ খেয়াল আছে কিছু? আমিনী সাহেব বললেন, এইতো এশার নামাজ কিছুক্ষণ আগে শেষ হলো। প্রিন্সিপাল সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘এশার নামাজ কিছুক্ষণ আগে শেষ হলো? তাই? আরে বেটা! কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান দেবে।’ হঠাৎ এমন কথা শুনে আমিনী সাহেব বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন!
উপরের ঘটনায় আলোচিত এই প্রিন্সিপাল সাহেব তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক মুরব্বী হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)। মুফতি আমিনী সাহেব পরবর্তীতে তার জামাতা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তিনি তার পরবর্তী জীবনে এই অদ্ভুত পাঠমগ্নতা দিয়ে অনেককেই অবাক করেছেন।
আরও একবার। এবার আর ছাত্রজীবনের কথা নয়। তখন তিনি মুফতি ফজলুল হক আমিনী। কোনো এক প্রোগ্রামে যাওয়ার কথা। ট্রেন ছাড়বে রাত একটার দিকে। এগারোটা কিংবা সাড়ে এগারোটার দিকে তার একটু ফুরসত মিললো বিশ্রাম নেবার। তিনি বিশ্রাম নিতে গেলেন। অভ্যাসবশত বিশ্রাম নিতে গিয়েই কিতাবের পাতায় ডুবে গেলেন। তারপর একসময় যখন সেই মগ্নতা ভেঙে উঠলেন তখন রাত তিনটা। এরইমধ্যে পেরিয়ে গেছে কয়েক ঘণ্টা। তাঁর পাঠমগ্নতা ছিল এতোটাই গভীর। তিনি তার এই মগ্নতা কেবল পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, রাজনীতি, অধ্যাপনাসহ প্রতিটি ভুবনেই ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমৃত্যু তিনি বিভোর ছিলেন ইবাদতের সাধনায়। খোদার এই মগ্নসাধক আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন, আমাদের জীবনচলার বাঁকে বাঁকে আমৃত্যু দিকনির্দেশনার বাতিঘর হয়ে তিনি অমর থাকবেন।
হাসপাতালেও কিতাব
মুফতি আমিনীর (রহ.) ছাত্র ও তরুণ রাজনীতিবিদ মাওলানা আনছারুল হক ইমরান বলেন- ২০০৭ সালে একবার হুজুরের ব্রেইন স্ট্রোক হলো। ইবনে সিনা হাসপাতালে হুজুরের খেদমত করছিলাম আমি। হঠাৎ দেখলাম, তিনি বিছানার আশপাশে হাত বাড়িয়ে কী যেন খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী খুঁজছেন? কোনো কথা বললেন না। শুধু বললেন, কিতাব। চোখে সমস্যা ছিলো। মুখের ভাষাও ছিলো অস্পষ্ট। ডাক্তাররা তাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য কয়েকটি ইনজেকশন পুশ করলেন। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিলো না। হুজুরের ছোট ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী ও মেয়ে জামাই মাওলানা সাখাওয়াত সারারাত আপ্রাণ চেষ্টা করলেন ঘুম পাড়াতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলেন। তিনি শুধু হাত বুলাচ্ছিলেন দেয়ালে। আর মুখে ছিলো একটি আওয়াজ- ‘কিতাব! কিতাব!!’ কিতাব মুতালাআর প্রতি তার এমন আগ্রহ সত্যিই আমাকে সেদিন বিস্মিত করেছে। এই অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি হাসপাতালের বেডে বসে খাতায় নোট করতেন। পরে জানতে পারলাম, ওটা ছিল- ‘মেছালী খেলাফত ও সিয়াসাত’ নামক গ্রন্থের পা-ুলিপি। যা বর্তমানে ‘আদর্শ রাজনীতি আদর্শ রাষ্ট্রনীতি’ নামে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং মূল উর্দু পা-ুলিপিটিও প্রকাশের পথে।
এই ছেলে কতো পড়ে!
মুফতি আমিনীর জামাতা, বিশিষ্ট আলেম ও বক্তা মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন সাহেব লেখেন- মুফতি আমিনী ব্যক্তিগত জীবনে সাদাসিধে, সদালাপী, অতিথিপরায়ণ, সময়-সংযমী, রাসুলপ্রেমিক এবং আকাবিরের কর্মপন্থা অবলম্বনে একজন অনুসৃত ব্যক্তি ছিলেন। মুতালাআয় গভীরতা ও একাগ্রতার প্রশ্নে তাকে দেশসেরা মনে করা হতো। মুতাকাদ্দিমীন-মুতাআখখিরীন সকল স্তরের লেখকবৃন্দের কিতাব মুতালাআ করেছেন। জেলখানার বন্দী জীবনে এবং গৃহবন্দী থাকাকালীন সময়ে কুরআন ও সীরাতুন্নবী সা. বিষয়ক কিতাবাদির অধ্যয়নই ছিল তাঁর আত্মার খোরাক। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি কিতাব ছাড়া প্রশান্তি অনুভব করতেন না। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) তার মুতালাআর প্রসঙ্গ টেনে নূরীয়া মাদ্রাসা মসজিদে ছাত্রদেরকে মুতালাআর প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন। অধিক মুতালাআর সুবাদে তিনি ছাত্র জমানায়ই এক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষের খেতাব অর্জন করেন।
কেন পড়বো কীভাবে পড়বো
এভাবেই গভীর মুতালাআ এবং নিবিড় অধ্যবসায়ের কল্যাণে তিনি সবমহলে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেছেন। তার এক খাস শাগরেদ বলেন- মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) বহু বিষয়ে বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। কোরআন-সুন্নাহ-উসূল-ফিকহ-ইতিহাস-দর্শন ও সাধারণ জ্ঞানের ওপর তার পড়াশোনা, গবেষণা ও চর্চা ছিলো অসাধারণ। তার নিজ মুখে শুনেছি, ‘তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমাত’ কিতাব নতুন বের হলে কুরবানীপূর্ব ছুটিতে ক্লাস না থাকায় চলে যেতেন লালবাগের কেল্লামাঠে (লালবাগ কেল্লায়)। সেখানে বসে বসে কিতাবটি শেষ করেন। শেষ বয়সেও দেখেছি, অসুস্থতার কারণে রাত জাগতে পারতেন না, তবু ঘুম বিসর্জন দিয়ে সারারাত কিতাব পড়ায় কাটিয়ে দিয়েছেন। এরপর রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদে মনোনিবেশ করতেন।
তিনি কেবল অক্ষর আর বিষয়বস্তু পড়ে যেতেন না। চিন্তা করতেন, গবেষণা করতেন প্রতিটি লাইনে, প্রতিটি বাক্যে। কিতাব পড়াকালে দেখা যেতো একটি পৃষ্ঠাই দীর্ঘ সময় পড়ছেন। আবার অল্প দিনেই ১০-২০ খ-ের বড় বড় কিতাব শেষ করতেন। মুফতি আমিনী (রহ.) কত বড় আলেম ছিলেনÑ সেটা আমাদের মতো ছোট মুখে বললে তাকে হেয় করা হবে। তার মুখ থেকে শোনা কথাটিই আমি আওড়াচ্ছি। তিনি গেলো রমজানের ইসলাহী মজলিসে বলেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, মুতাকাদ্দিমীন-মুতাআখখিরীনের এমন কোনো কিতাব নেই যেটা আমি পড়িনি।’ তার অধ্যবসায়ের গভীরতা এবং জ্ঞানের পরিধি এ কথা থেকেই অনুমেয়।
মুফতি আমিনীর প্রধান মুরব্বি ও আসাতেযা
ব্যক্তি না থাকলেও মুফতি আমিনীর ব্যক্তিত্ব আমাদের সামনেই। ইলম ও প্রজ্ঞা, মেহনত ও দরদ, সাহস ও লিল্লাহিয়্যাত এবং যোগ্যতা ও নিবেদনের যে স্তরে নিজেকে তিনি উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ভয়-ডর আর পারিপার্শ্বিক সব দুর্ভাবনাকে পেছনে ফেলে সারাজীবন নিজেকে তিনি যেভাবে কেবল এগিয়ে নিয়ে গেছেন- বর্তমান বা নিকট অতীতে এর নজির পাওয়া কঠিন। এমনি এমনিই তো আর এতোসব গুণের অধিকারী তিনি হয়ে যান নি। আল্লাহর অনুগ্রহ, নিজের চেষ্টা এবং পরিবারের দুআ-প্রচেষ্টা ও কুরবানির পরও জীবনে এমন কিছু মানুষের দরকার হয়, যারা ঠিক সময়ে ঠিক রাস্তাটি বাতলে দেবেন। বড় হওয়ার স্বপ্ন মনে গেঁথে দেওয়ার পাশাপাশি সিঁড়িটিও ধরিয়ে দেবেন। ¯েœহ-শাসন-ভালোবাসা ও দুআ নিয়ে এমন যে মানুষগুলো আমাদের পাশে থাকেন- তারা শিক্ষক। উস্তায ও অভিভাবক। মুফতি আমিনীর জীবনেও এমন সেরা কিছু মানুষ এসেছিলেন বা এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বলেই তিনি মুফতি আমিনী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। উস্তাযদের প্রতি আজীবন মুফতি আমিনীর (রহ.) অসামান্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিলো। তাদের শিক্ষার বাইরে তিনি কখনো পা দেন নি। কাছের মানুষদেরও এ নিয়ে সবসময় সতর্ক করে গেছেন। মুফতি আমিনীর দীর্ঘ ছাত্রজীবনে উস্তাযদের তালিকা যথেষ্ট লম্বা। এখানে আমরা খুব সংক্ষেপে কেবল এমন ক’জন ব্যক্তিকেই উপস্থাপন করেছি, মুফতি আমিনীর বর্ণাঢ্য জীবনজুড়ে যাদের ভূমিকা ছিলো সবচে’ বেশি। তালিকায়নও শৈশব থেকে নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা এবং পরবর্তী জীবনের প্রতি লক্ষ্য করেই করা হলো। এখানে আলোচিত এই ছয় মনীষীই ছিলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) জীবন গড়ার প্রধান কারিগর। মুরব্বি এবং অনুপ্রেরণার আশ্রয়। সূত্র হিসেবে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত বেশ কিছু বই, মাদ্রাসার স্মারক এবং সংশ্লিষ্ট মনীষীদের একান্ত ক’জন শাগরেদের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।
ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.)
পরিবার ও জন্মস্থান
গত শতাব্দীতে যে ক’জন আলেমের হাত ধরে বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা এবং দেওবন্দের আধ্যাত্মিক বিপ্লব গতি লাভ করেছে, ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) তাদের প্রধানতম পুরুষ। মেধা ও মেহনত, ইলমি কামালাত ও কুরবানির অত্যাশ্চর্য এক উদাহরণ ছিলো তার জীবন। ফখরে বাঙ্গাল বা বাংলার গর্ব উপাধিটিও তার বিশাল ও বিস্তৃত কর্ম-অবদানের বিপরীতে সামান্যই বলা চলে। তিনি এবং সমসাময়িক ক’জন মিলেই কুসংস্কার ও শিরকের মোড়কে আবৃত হতে থাকা বাংলাদেশের ইসলামচর্চাকে আবার বিশুদ্ধ ধারায় ফিরিয়ে আনা এবং প্রকৃত দীনি শিক্ষা-আন্দোলনের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। ১৩১৫ হিজরি মোতাবেক ১৮৯৬ খৃস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার ভুবন গ্রামে বাংলার এই মহান পুরুষ মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা আনোয়ার আলী।
প্রাথমিক শিক্ষা
মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। শৈশব পেড়িয়ে, তার বয়স যখন সাত বছর- প্রথমবারের মতো তিনি স্কুলের বারান্দায় পা রাখেন। ভর্তি হওয়ার মাত্র ছ’ বা ন’ মাসের মধ্যে কৌতূহলে বিভিন্ন ক্লাসের বই দেখতে দেখতে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যভুক্ত সব বই-ই তার মুখস্থ হয়ে যায়। ছেলের মেধায় বিস্মিত তার বাবা এরপর আর বিলম্ব না করে তাকে ধর্মীয় শিক্ষায় আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। তিনি শ্রীঘর মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়াশোনা করার পর বর্তমান সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল মাদ্রাসায় ভর্তি হন।
বাহুবল মাদ্রাসা থেকে যথাসময়ে সুনামের সাথে উত্তীর্ণ হন মাওলানা তাজুল ইসলাম। এরপর তদানীন্তন বাংলা আসামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৩৩৭-৩৮ হিজরিতে সিলেট আলিয়ার সর্বশেষ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন।
উচ্চশিক্ষা
মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) ১৩৩৮ হিজরিতে বিশ্বখ্যাত দীনি শিক্ষাকেন্দ্র, উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। এখানে তিনি লম্বা একটা সময় অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকেন। দারুল উলুম দেওবন্দে তিনি উচ্চতর হাদীস, তাফসির, ফিক্হ, আকাইদ ও আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। ১৩৪২ হিজরিতে দারুল উলুমের সর্বশেষ পরীক্ষায় মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পড়াশোনায় তার মনোযোগ ও একাগ্রতা, মেহনত ও নিবেদন আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। দেশে ফেরার পথে কালজয়ী এই আলেম মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) সম্পর্কে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ.) প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন- ‘দারুল উলুমের ইলমের ভা-ার তাজুল ইসলামের সাথে বাংলায় চলে যাচ্ছে!’
বিস্তৃত কর্মজীবনের এক ঝলক
নিজের স্বপ্ন, বাবার ইচ্ছে আর উস্তাযদের পরামর্শে শিক্ষাজীবন শেষ করা মাত্রই তিনি ঠিক করে নেন দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং ইসলামি শিক্ষায় অনগ্রসর বাংলায় যোগ্য আলেম তৈরি করার পেছনেই তিনি জীবন কুরবান করবেন। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে কুমিল্লাস্থ জামিয়া মিল্লিয়ায় শায়খুল হাদীস হিসেবে ইলমি খেদমত শুরু করেন। ১৩৪০ হিজরিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় অধ্যক্ষের পদ শূণ্য হলে সব পক্ষের আগ্রহ ও আবেদনের প্রেক্ষিতে মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) এই পদে আসীন হন। তিনি ৪২ বছর একটানা এই জামিয়ার প্রধান শায়খুল হাদীস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দীনি দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছেন যোগ্যতা ও নিবেদনের অনন্য উপমা। তার আরকেটি বড় অবদান ছিলো বাংলাদেশ বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসন গেড়ে বসা কাদিয়ানীদের মূলোৎপাটন। বৃটিশ কর্তৃক নবুওয়্যাতপ্রাপ্ত দাজ্জাল কাদিয়ানীর আবির্ভাব ঘটলে তার মোকাবেলায় দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) এগিয়ে আসেন। তার কুরআন-হাদীসভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ অগ্নিঝরা বক্তৃতার সামনে কাদিয়ানীর ভ-ামি মাকড়সার জালের ন্যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এ সময় ফখরে বাঙ্গাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গর্বিত সন্তান মাওলানা তাজুল ইসলাম দারুল উলূম দেওবন্দে আল্লামা কাশ্মীরীর নিকট অধ্যয়নরত। কাদিয়ানীদের মোকাবেলায় বিভিন্ন সভা সমিতি, সেমিনার ও কনফারেন্সে আল্লামা কাশ্মীরী তার প্রখর মেধাসম্পন্ন এ তুখোড় ছাত্রটিকে পাঠিয়ে দিতেন। ছাত্রটিও তার উস্তাদের সুধারণার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হন। দেশে আসার পর হযরত ফখরে বাঙ্গাল তার চারপাশে কাদিয়ানীদের উৎপাত দেখতে পান। তিনি আজীবন ওয়াজ-নসীহত, বাহাস-মুনাযারা, যুক্তি-তর্ক ও প্রয়াজনীয় ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করেও তাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এ এক দারুণ বিজয়।
ইন্তেকাল
১৯৬৭ সালের ৩ রা এপ্রিল মোতাবেক, বাংলা ১৩৭৩ সালের ২০ই চৈত্র রোজ সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই মহান মনীষী, বাংলার গৌরব মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.) পরপারে পাড়ি জমান। ইন্তেকালের সময় তার বয়স হয়েছিলো ৭১ বছর।
মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর
পরিবার ও জন্মস্থান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ার আরেকজন বরেণ্য শায়খ ছিলেন মুফতি নূরুল্লাহ (রহ.)। যে ক’জন আলেমের হাত ধরে সীমিত পরিসরের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি আজকের এই বিশাল মহীরুহ হিসেবে রূপ লাভ করেছে, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (রহ.) ছিলেন তাদের অন্যতম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানার অন্তর্গত দশদোনা গ্রামে ১৮৭৩ ইং সাল মোতাবেক বাংলা ১২৮০ ’র কোন এক শুভ লগ্নে বরেণ্য আলেম মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন মুন্সী মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ এবং মাতা আমেনা বেগম। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র পুত্র সন্তান। দুধপানরত অবস্থায় তার মাতা ইন্তেকাল করেন। ৭-৮ বছর বয়সে তাকে এতিম করে তার পিতাও পরপারে পাড়ি জমান। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো তিনিও শৈশব না পেরুতেই এতিমে পরিণত হন। বাবা-মায়ের ইন্তেকালের পর তিনি দাদা-দাদির নিকট লালিত-পালিত হন।
প্রাথমিক শিক্ষা
পিতা আব্দুল মজিদের কাছেই তিনি প্রাথমিক দীনি শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। পাশাপাশি বাড়ীর পাশ্ববর্তী স্কুলে ভর্তি হয়ে জাগতিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বাসগাড়ী গ্রামের মৌলভী ইয়াকুব আলী (রহ.) এর নিকট আরবি, উর্দু, ফারসি শিক্ষা লাভ করেন। কিছুদিন পর তিনি কানাইগর মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এভাবেই অনেকটা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই তার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হয়। তিনি প্রস্তুত হন আরো বড় পরিসরে উচ্চ পর্যায়ের পড়াশোনার জন্য।
উচ্চ শিক্ষা
মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (রহ.) প্রথমে ভারতের রামপুরা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পরে তিনি আরো ভালো লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ মাদ্রাসায় গমন করেন এবং সেখানে একাধারে পাঁচ বছর অতিবাহিত করেন। দরসি ও গায়রে দরসি যেকোনো কিতাব পাঠের সময় তিনি এতোটা বিভোর হয়ে যেতেন যে দুনিয়ার আর কিছুর প্রতি কোনো খেয়াল থাকতো না। প্রচুর মুতালাআ করতেন। সময় পেলেই দেওবন্দের লাইব্রেরিতে কিতাবের ভুবনে হারিয়ে যেতেন। বুযুর্গদের মালফুজাতের ব্যাপারেও তার আগ্রহ ও নিবেদন ছিলো ঈর্ষণীয়। দেওবন্দে পাঁচ বছরের লাগাতার অধ্যবসায়ে হাদীস, তাফসির ও ফিক্হসহ ইলমে আকাইদে বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করে তিনি দেশে ফেরেন।
কর্মজীবন
দেওবন্দ থেকে ফিরে ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইউনুসিয়ার নাজিমে তালিমাত মাওলানা মতিউর রহমান সাহেবের অনুরোধে মাওলানা সিরাজুল ইসলাম জামিয়ার শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৩৫০ হিজরি থেকে ১৪২৫ হিজরি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এখানে শিক্ষকতা করেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি একবারের জন্যও নিজের কর্মস্থল পরিবর্তন করেন নি। শিক্ষকতা জীবনে তিনি প্রায় সকল বিষয়েই সাবলীল দরস দিতেন। নাহু-সরফ, হাদীস, তাফসির ও আদব ইত্যাদি। ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলামের ইন্তেকালের পর প্রায় ৪০ বছর একাই সম্পূর্ণ বুখারি শরিফ তিনি পড়িয়েছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে নিয়ে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামিয়া ইউনুসিয়ার মোহতামিমের দায়িত্বও তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন। এতোটা দীর্ঘ সময় বিশাল একটি জামিয়ার পরিচালনা সুচারুরূপে করতে পারা কতোটা কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের, বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রই তা বুঝতে পারার কথা।
ইন্তেকাল
এই মহান মনীষী ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখ রোজ শনিবার সকাল ৯:২০ মিনিটে হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও ভক্তবৃন্দকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আপন প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন। তিনি সুদীর্ঘ হায়াত পেয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ১৩৩ বছর, কারো মতে ১১৮ বছর।
বরেণ্য উস্তায হাফেজ ক্বারী মুহাম্মাদ মুহসিন (রহ.)
পরিবার ও জন্মস্থান
বাংলাদেশে কুরআনের হিফজ এবং ইলমে ক্বেরাতের চর্চা ও প্রসারে যাদের অবদান অসামান্য এবং দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর পড়াশোনা সত্ত্বেও হাফেজ-ক্বারী হিসেবে উপমহাদেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, মুহাম্মাদ মুহসিন সাহেব (রহ.) ছিলেন তাদের অন্যতম। বিংশ শতাব্দীর শূন্য দশকে ১৯০৪ সালের এক দারুণ ও বরকতময় দিন সোমবার দিবাগত রাতে তিনি চাঁদপুর জেলার তৎকালীন রামচন্দ্রপুর (পরে তিনি যে এলাকার নাম রাখেন মোমিনপুর), সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন। ইলম ও বুযুর্গির ধারা তাদের বংশে আরো পূর্ব থেকেই চলে আসছিলো। তিনি ছিলেন সে ঐতিহ্যেরই গর্বিত উত্তরাধিকার। তার পরিবার শুরু থেকেই তাকে দীনের পথে এবং ইলমে লাদুন্যি অর্জনের জন্য কুরবান করার শপথ নিয়ে রাখেন। আল্লাহর রহমত এবং নিজের সাধনায় এরপর নিজ জীবনের গৌরবগাঁথা তিনি নিজেই রচনা করেন।
প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষা
পরিবারের ইচ্ছায় ১৯২১-২২ সালে তিনি সেখানকারই বিখ্যাত মোমিনবাড়ি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। উপমহাদেশের বিখ্যাত ক্বারী এবং বাংলাদেশের কুরআনে কারীমের সাত ক্বেরাতের ইমাম ক্বারী ইবরাহীম সাহেবের (রহ.) কাছে তিনি ইলমে তাজবিদ ও ক্বেরাতের দীক্ষা নেন। ক্বেরাতের শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর প্রিয় উস্তায ও পরবর্তীকালে শশুর ক্বারী ইবরাহীম সাহেবের পরামর্শে তিনি হাটহাজারি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য পরে রওয়ানা হন দারুল উলুম দেওবন্দের পথে। দারুল উলুম দেওবন্দে গিয়ে তিনি মদীনাফেরৎ মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীর প্রথম দিককার ছাত্র হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। দেওবন্দ থেকেই নিজের উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি নিজ এলাকা চাঁদপুরে চলে আসেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন
উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেওবন্দ থেকে ফিরে আসার পরপরই চাঁদপুর শহরের বড় এক মসজিদে তিনি ইমাম হিসেবে নিয়োগ পান। শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। কিন্তু তার পরিবার এতে পুরোপুরি সন্তুষ্ঠ হতে পারে নি। বিশেষ করে তার দাদি বললেন- শুধু ইমামতি বা সাধারণ মানুষদের দীন শেখাবার জন্য তোমাকে মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিত করা হয় নি। তোমাকে কুরআনের খেদমতে জীবন কুরবান করতে হবে। তিনিও নিজেকে সেমতেই প্রস্তুত করেন। এর পরপরই হাফেজ্জি হুজুরের (রহ.) এর পক্ষ থেকে ঢাকায় তার ডাক আসে এবং তিনি লালবাগ মাদ্রাসায় চলে আসেন। এখান থেকে হাফেজ্জি হুজুর এবং শামসুল হক ফরিদপুরীর (রহ.) পরামর্শে তিনি তৎকালীন বিক্রমপুর এবং বর্তমান মুন্সিগঞ্জের মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায় তাশরিফ রাখেন। চলতে থাকে তার লাগাতার ইলমি সাধনা। এখানেই মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) তার কাছে প্রাথমিক তরবিয়ত লাভ করেন এবং কিতাব বিভাগের প্রাথমিক কিাবগুলোর দরস নেন। এরপর দুনিয়ার নিয়মে একসময় মাদ্রাসা কমিটির সাথে তার মতবিরোধ হয় এবং হাফেজ্জি হুজুরের অনুমতি নিয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরেন। ঘন ও নিবিড় গাছ-গাছরা ও আগাছায় ঢাকা প্রায় জঙ্গলমত এক পতিত জমিতে তিলে তিলে তিনি একটি মক্তব গড়ে তোলেন, কালক্রমে যা মোমিনপুর মাদ্রাসা হিসেবে সারাদেশে বিখ্যাত হয়ে ওঠে এবং ছনের ছোট্ট কুঠুরি থেকে বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এখানেই টানা চার দশকের বেশি সময় তিনি আদর্শ মানুষ ও আলেম তৈরি এবং কুরআনের খেদমতে লেগে থাকেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত এখান থেকে তিনি অন্যকোথাও যান নি বা এই প্রতিষ্ঠান ছ্ড়াা অন্য কিছুও ভাবেন নি। মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) কর্মজীবনে এসে হযরত হাফেজ্জি হুজুরের নির্দেশে এখানেই মাত্র নয় মাসে তার কাছে কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন এবং ইলমে ক্বেরাতের দীক্ষা নেন। এরপর ক্বারী মুহসিন সাহেবের নির্দেশে তারই সহকর্মী হাটহাজারী মাদ্রাসার মাওলানা আব্দুর রব সাহেবের কাছে আমিনী (রহ.) পুরো কুরআন শোনান। এসময় আমিনী সাহেবের দাওরের সাথী ছিলেন ক্বারী মুহসিন সাহেবের পর দীর্ঘদিন মোমিনপুর মাদ্রাসার ইহতেমামের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা মাওলানা খালেদ মুহসিন দা. বা.। ক্বারী মুহসিন সাহেব প্রতিষ্ঠিত মোমিনপুর মাদ্রাসা আজও সগৌরবে চাঁদপুরসহ সারাদেশের অসংখ্য ছাত্রের ইলমি পিপাসা এবং কুরআনের বরকত বিলিয়ে চলেছে। দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠানটির অসংখ্য শাখা-প্রশাখা গড়ে ওঠেছে।
ইন্তেকাল
আজীবন কুরআনের আলো বিলিয়ে চলা ইসলামের এই মহান সাধক ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসের ৫ তারিখ জুমাবার দিন ইহলোক ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমান। দীর্ঘ ৯৫ বছরের জীবনে ইলম সাধনা এবং কুরআনের জ্যোতি বিলিয়ে যাওয়ার বাইরে কখনো তিনি অন্যকিছুর সাথে জড়ান নি। দুনিয়াবিমুখতা, ইবাদত ও সুন্নাতের পাবন্দি, তার মেহনত-মুজাহাদা ও বুযুর্গি চাঁদপুরসহ সারাদেশে আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে।
আমীরে শরিয়ত হযরত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী (রহ.)
পরিবার ও জন্মস্থান
মানুষ মাত্রই সসীম। সীমিত তার আয়ু এবং সামর্থ্য। তবু কিছু মানুষ নিজের পরিশ্রম ও সাধনায়, কর্মে ও অবদানে নিজের সময়কে অতিক্রম করে যান। হয়ে ওঠেন কালজয়ী। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)ও ছিলেন এমনই একজন সফল মানুষ। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম এই ওলী, জন্মগত বুযুর্গ, বাংলার আমীরে শরীয়ত ১৩১৩ হিজরি সনে নোয়াখালি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সম্মানিত পিতা ছিলেন হযরত মুনশী ইদরীস সাহেব (রহ.)।
শৈশব ও প্রাথমিক পড়াশোনা
ধার্মিক পরিবারে জন্ম লাভ করায় স্বভাবতই ছোটবেলা থেকে তিনি উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। অনর্থক খেলাধুলায় মজে থাকার ব্যাপারে তাঁর খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। পড়াশোনার প্রতি ছিলো তার দুরন্ত আকর্ষণ। প্রাইমারি শিক্ষা লাভের পর হাফেজ্জী হুজুরের সম্মানিত পিতা তাঁকে লক্ষীপুর থানাধীন চন্দ্রগঞ্জ পশ্চিম বাজারের তদানীন্তন বিখ্যাত একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এখানে তিনি শেখ সাদীর (রহ.) ইতিহাস বিখ্যাত গুলিস্তাঁ ও অন্যান্য প্রাথমিক কিতাবসমূহ পাঠ করেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর যে ভবিষ্যতে একজন শ্রেষ্ঠ বুযুর্গে পরিণত হবেন এটা বাল্যকালেই তাঁর পবিত্র নুরাণী চেহারা দেখো অনুমান যেতো বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।
কাগজের প্রতি সম্মান এবং জীবনের নতুন মোড়
ইলমের উপকরণ হিসেবে খাতা-কলম ইত্যাদির প্রতি তার ছিলো সজাগ দৃষ্টি। তিনি খুব যতœ সহকারে এসবের হেফাজত করতেন। সারাজীবনই এ বিষয়ে মানুষদের সতর্ক করে গেছেন। এ নিয়ে অত্যাশ্চর্য এক ঘটনা আছে তারই জীবনে। একদিন তিনি দেখতে পেলেন অপবিত্র স্থানে এক টুকরো কাগজ পড়ে আছে এবং তাতে মহান আল্লাহর নাম বিজড়িত আয়াত বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লেখা। কাগজটিতে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা লেগে আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে কাগজের টুকরোটি তুলে নেন এবং নিজ হাতে খুবই যতেœ সেটা পরিষ্কার করে তাতে সুগন্ধি মেখে সুন্দর করে রেখে দেন। এর পরপরই তার জীবনে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। নিজের হৃদয়ে তিনি আল্লাহ পাকের অপার ভালোবাসার ঝরণাধারা অনুভব করতে শুরু করেন। তিনি কুরআন শরীফ মুখস্থ করার জন্য এবং ইলমে দীনের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। স্বয়ং হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) মনেও বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে, কাগজের টুকরো এবং আল্লাহর নামের প্রতি শ্রদ্ধার এ ঘটনার কারণেই তাঁর কুরআন মুখস্থের সৌভাগ্য হয়েছিলো। কুরআনের বদৌলতে তাঁর হাফেজ্জী উপাধিটিও বাংলাদেসহ বিশ্বজুড়ে ব্যাপকরকম সমাদৃত হয়েছে।
কুরআন হিফজ ও উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ সফর
ছোটবেলা থেকেই হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। কুরআন হিফজের উদ্দেশ্যে তাই তিনি সেই বাল্যবয়সেই বর্তমান ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের অন্তর্গত ঐতিহাসিক পানিপথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৩৩০ সালের কথা এটা। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) পরিবারের সদস্যদের কিছুটা বুঝতে দিয়ে বাকিটা গোপন করে সুদূর ভারতের পথে রওয়ানা হয়ে যান। আশংকা ছিলো বাড়ি থেকে অনুমতি মিলবে না তাই এই কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। পকেটে মাত্র দেড় টাকা সম্বল করে সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনি বেরিয়ে পড়েন।
আশ্চর্য সফর এবং অগ্নি পরীক্ষা
বাড়ি থেকে বেরিয়ে পানি পথে পৌঁছার পুরো সফরটিই ছিলো গায়েবি মদদে ভরপুর এবং অশ্চর্য ঘটনাবলিতে মোড়ানো। চাঁদপুর থেকে তিনি প্রথমে খুলনা পৌঁছেন। খুলনা থেকে পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দেন সুদূর কলকাতার উদ্দেশ্যে। প্রায় ৪০ মাইল হেঁটে তিনি যখন যশোরে পৌঁছেন, হঠাৎ এক পাগলা কুকুর এসে তাঁর পা কামড়ে দেয়। ব্যথায় তিনি ছটফট করতে থাকেন, এসময় এলাকার মানুষ ছুটে আসে, সাথে কুকুর দংশনের তদবীর জানা এক লোকও হাজির হয়। লোকটির তদবিরে সাময়িক সুস্থতা লাভ করলেও লোকটি তাকে উন্নত ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য খুলনা ফেরৎ যেতে বলে। তিনি ফের খুলনায় এসে শোনেন, এখানে কুকুর-দংশনের কোনো চিকিৎসা নেই। এখানে কেনো, আশপাশের কোথাও নেই। সেখানের এক ডাক্তার তাকে জানালেন ভারতের উত্তর প্রান্তে কাসুরী পর্বতে অবস্থিত একটা হাসপাতাল ছাড়া উপমহাদেশের কোথাও কুকুর দংশনের কোনো চিকিৎসা নেই। কী করে তিনি সেখানে যাবেন? পকেটে একটা কানাকড়িও তো নেই। তখনই আল্লাহর মদদ সামনে এলো।
‘ যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’
এরপর আল্লাহর গায়েবি মদদ সামনে আসতে শুরু করে। সেখানকার ডাক্তার তার কথা শুনে তাকে তৎকালীন ডিসির সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। সহৃদয় ডিসি সাহেব তার সব কথা শুনে তাকে কাসুরী পাহাড়ের নিকটস্থ সর্বশেষ স্টেশন পর্যন্ত সরকারি খরচে যাওয়া আসার টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন এবং সঙ্গে সাত-আট টাকা পথ খরচাও দিয়ে দেন। ঘটনাক্রমে হফেজ্জী হুজুরের রওয়ানা হওয়া সে পথটি ছিলো তার উদ্দিষ্ট পানিপথে পৌঁছারই পথ।
হাসপাতালে পৌছে তিনি মুসলিম একজন বিদেশী ডাক্তারের সাক্ষাত পান। তার সেবা ও চিকিৎসায় দ্রুত আরোগ্য লাভ করে রওয়ানা দেন তার লক্ষ্যের পথে।
পানিপথের উদ্দেশ্য যাত্রা
ঐতিহাসিক পানিপথে পৌঁছে তিনি সেখানের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ক্বারী আব্দুর রহমান সাহেবের সুযোগ্য পুত্র ক্বারী আব্দুস সালাম সাহেবের কাছে উপস্থিত হয়ে সবকিছু খুলে বলেন। তিনি তাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। স্বপ্নে লালিত সুযোগ লাভ করে তিনি নতুন জীবন শুরু করেন। পড়াশোনায় তার মনোযোগ ছিলো উপমাতুল্য। দিনরাত মেহনতে লেগে থাকতেন। খাবার-গোসল কিংবা অন্যান্য স্বাভাবিক প্রয়োজনের প্রতিও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকতো না। গল্প-গুজব কিংবা দুষ্টুমি ছিলো তার সহ্যক্ষমতারই বাইরে। এভাবেই লাগাতার মেহনতে মাত্র আড়াই বছর বয়সেই অত্যন্ত সুচারুরূপে তিনি ত্রিশ পারা কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন।
সাহারানপুরের পথে
ভারতবর্ষের প্রধান দুটো শিক্ষা কেন্দ্র ছিলো দারুল উলুম দেওবন্দ এবং মাজাহেরুল উলুম সাহারানপুর। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি যদিও দারুল উলুম দেওবন্দকেই ঠিক করে রেখেছিলেন তবে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মাযাহেরুল উলুম সাহারানপুরকেই বেছে নেন। তার পীর ও মুর্শিদ হাকীমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলী থানভীর (রহ.) পরামর্শক্রমেই তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। এখানে তিনি আরবি, ফার্সি ও উর্দু সাহিত্য, ইলমে তাজবিদ বা ক্বিরাত শাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, চরিত্র বিজ্ঞান, অলংকার, ইতিহাস, তাফসির, ফিকহ ও উসুলে ফিকহ এবং হাদীসসহ দীনের মৌলিক সব বিষয়েই প্রভুত জ্ঞান অর্জন করেন।
অবশেষে দারুল উলুম দেওবন্দে
মাযাহেরুল উলুমে সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর তিনি বিশেষ বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান লাভ ও গবেষণার জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। তখন চলছিলো ১৩৪১ হিজরি। তিনি উচ্চস্তরের ক্লাস তাখাস্সুসে ভর্তি হয়েছিলেন। হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মিরীর অনুপস্থিতিতে হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানীর কাছে তিনি আরো একবার বুখারী শরিফের সবক গ্রহণ করেন। তার বরেণ্য উস্তাযবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী, ক্বারী মুহাম্মাদ তায়্যিব এবং সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)সহ তৎকালীন উপমহাদেশের মহান সব ওলামায়ে কেরাম।
কর্মমুখর জীবন
হযরত হাফেজ্জি হুজুরের কর্মজীবন ছিলো অবিশ্বাস্যরকম বিস্তৃত ও বর্ণাঢ্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামেয়া ইউনুসিয়ায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ঢাকায় এসে বড়কাটারা মাদ্রাসা, লালবাগ মাদ্রাসা এবং সবশেষে কামরাঙ্গিরচরে জামিয়া নূরিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তিনি নিজেকে কুরবান করে দেন। ইলমে দীন শেখা ও আদর্শ আলেম তৈরি তার জীবনের প্রধান ব্রত থাকলেও কেবল এই কাজেই তিনি নিজেকে সীমিত করে রাখেন নি। দেশজুড়ে একের পর এক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, আলেম ও সাধারণ জনগণের আধ্যাত্মিক সংস্কার ও চিকিৎসার কাজ, দেশ বিদেশে ইসলামের দাওয়াতি কাজে তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এর বাইরে তার সবচে বড় কাজ ছিলো দেশের রাজনীতিকে কলুষতামুক্ত করে দেশে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের আলোয় দেশকে আলোকিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং খানকার সব দায়িত্ব সামলে তিনি ইসলাম ও দেশবাসীর স্থায়ী মুক্তির প্রচেষ্টায় সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ডাক দিয়েছিলেন অভূতপূর্ব তাওবার রাজনীতির। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইলমের খেদমত, আলেম ও জনসাধারণের ইসলাহ এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। কুরআনের ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখতে তিনি এতোটাই মরিয়া ছিলেন যে দেশে-বিদেশে আজো তিনি হাফেজ্জি হুজুর হিসেবেই খ্যাত হয়ে আছেন এবং থাকবেন অনন্তকাল, ইনশাআল্লাহ।
ইন্তেকাল
ইন্তেকালের কিছুকাল আগ থেকেই তার আচরণ, কথাবার্তা এবং নসিহতে এমন একটা ভাব প্রকাশ পাচ্ছিলো যে তিনি কোথাও যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এই পৃথিবীর বুকে খুব বেশি দিন তিনি আর অবস্থান করবেন না। বার্ধক্যে মাঝেমধ্যেই তার শরীরে নানারকম অসুখ-বিসুখ জেগে ওঠতো। এবার তো এমন হলো যে তাঁকে হাসপাালে ভর্তি করা লাগলো। ১৯৮৭ সালের ২৪ এ এপ্রিল রোজ শুক্রবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাঁকে পিজি হাসপাতালে নেয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেসে ডাক্তাররা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে অনুরোধ করেন এবং তাই করা হয়। কয়েকদিনের চিকিৎসায় শরীরে কিছুটা উন্নতি বোঝা গেলেও পুনরায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়ায় তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রমজানের তখন ৬ষ্ঠ দিন।
৮ই রমজানের দিন তার শরীরের অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। দুপুরের আগে আগে বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন জোহরের নামাজের সময় হলো কি-না। সময় হওয়া মাত্রই তিনি নামাজ শুরু করেন। তার পাশে থাকা লোকেরা জানাচ্ছিলেন- এমন মনোযোগ ও একাগ্রতার নামাজ তারা জীবনে দেখেন নি। নামাজের মধ্যেই তিনি হয়তো মহান প্রভুর ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। নামাজের পরপর তাই চিরবিদায়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। খাদেমকে হাতের ইশারায় ডেকে বললেন- এই মুহূর্তে এই ঘরে তুমি আর আমি আছি। একটুপর আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো। মুসলিম ভাইদের জন্য এসময় তিনি অল্প কিছু নসিহত রাখেন। বলেছিলেন- ঈমান, ইসলাম এবং নামাজ রোযার ব্যাপারে কেউ যেনো কোনো গাফলতি না করে এবং ব্যক্তির ওপর ভরসা না করে সবসময় যেনো আল্লাহর ওপর ভরসা করে। এরপর তিনি খাদেমকে সুরা ইয়াসিন পাঠ করতে বলে নিজেও তেলাওয়াত শুরু করেন। খাদেম বলেন- দেখলাম তার চোখে অশ্রু আর মুখে আল্লাহর পবিত্র কালাম। এসময় অলৌকিক জিকিরের আওয়াজে পুরো কক্ষটি গুঞ্জরিত হতে শুনলাম। এমন কুদরতি মুহূর্তেই হাফেজ্জি হুজুর নশ্বর দুনিয়ার বুক থেকে চির বিদায় গ্রহণের জন্য তৈরি হলেন। নবীজীর শানে দরুদ পাঠ করলেন। নিজ হাতে সাদা চাদরে পুরো শরীর ঢেকে ডান কাতে শোলেন। তার কণ্ঠ থেকে তখনও তেলাওয়াত ও জিকিরের আওয়াজ গুঞ্জরিত হচ্ছিলো। আল্লাহ আর তার প্রিয় রাসুলের নাম স্মরণ করতে করতেই তিনি দুনিয়াকে বিদায় জানালেন। দিনটি ছিলো ৮ই রমজান মোতাবেক ১৯৮৭ সালের ৭ মে রোজ বৃহস্পতিবার। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মুজাহিদে আযম শামসুল হক ফরিদপুরী সদর সাহেব
পরিবার ও জন্মস্থান
১৮৯৬ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২রা ফাল্গুন তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ থানায় পবিত্র শুক্রবার দিন মহান বুযুর্গ ও সমাজ সংস্কারক আলেম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিলো মুন্সি মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ। মাতা ছিলেন আমিনা খাতুন। ঠিক নবীজীর বাবা-মায়ের নামে নাম।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
শিশুকাল থেকেই তিনি ছিলেন তুলনামূলক শান্ত-ধীর-স্থির স্বভাবের। সারাক্ষণ কী এক ভাবনায় ডুবে থাকতেন। পরিচ্ছন্ন থাকতেন। শিশুসুলভ দুষ্টুমি বা ঝগড়া-ফাসাদে তাকে খুব একটা মত্ত হতে দেখা যেতো না। ৪ বছর বয়সেই তিনি মায়ের কাছে কায়েদা পড়ার মাধ্যমে কুরআন পড়া শুরু করেন। তার বাবাও তাকে ইসলামের প্রাথমিক বিষয়-আশয় শেখাতেন।
নামাজের প্রতি আগ্রহ
আশ্চর্য শোনালেও সত্য- মাত্র চার বছর বয়স থেকেই তিনি নামাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে তার এই আগ্রহ উত্তরোত্তর কেবল বেড়েছে। একা একাই পোষাক পরে, মাথায় টুপি লাগিয়ে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। মুসল্লিদের দেখে দেখে নামাজের অনুকরণ করতেন। একটু বড় হলে মাকে ফজরের সময় ডেকে দেওয়ার কথা বলে রাখতেন। একদিন ইচ্ছে করে তিনি না ডাকায় নামাজ ছুটে যায়। ঘুম থেকে জেগে তিনি ভীষণ কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেদিন খাবারও গ্রহণ করতে চান নি।
জেনারেল শিক্ষা
একজন হিন্দু প-িতের হাতে তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। প-িত মশাই তাকে খুব ভালোবাসতেন বলে জানা যায়। কারণ একে তো তিনি পড়াশোনায় খুব মানোযোগী ছিলেন তথাপি আদব-লেহাযেও ছিলেন খুবই যতœবান। হিন্দু সহপাঠীর আধিক্যে কখনো কখনো তাদের ঈর্ষার পাত্রও হতে হয়েছে তাকে। একবার তো পরীক্ষার আগে ওরা তার সব বই লুকিয়ে ফেলেছিলো যাতে তিনি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করতে না পারেন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। সবাইকে অবাক করে বরাবরের মতোই তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেন।
কুরআনের মহাব্বত এবং আরবি শিক্ষা
কুরআনে কারিমের প্রতি বাল্যকাল থেকেই তার ছিলো গভীর মহাব্বত ও ভালোবাসা। মাঝে মাঝে তিনি নির্জন স্থানে গিয়ে কুরআন শরীফে চুমু খেতেন এবং বুকে লাগিয়ে প্রবলভাবে কাঁদতেন। কখনো কখনো কুরআন বুকে নিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে কান্না জুড়ে দিতেন। বলতেন- মাওলা হে, তোমার এই পবিত্র কালাম বোঝার তাওফিক আমাকে দাও। এসময় লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি আরবি পড়াও শুর করেন। ঘটনাক্রমে তার পিতা এ সংবাদ পেয়ে তা থেকে বিরত হওয়ার জন্য কঠিন হুঁশিয়ারি দেন এবং বলেন আরবি পড়া বন্ধ না করলে তিনি তার লেখাপড়াই বন্ধ করে দেবেন। হুমকি দেন ত্যাজ্যপুত্র করারও। এতে তিনি মনে ভীষণ আঘাত পান এবং দেশে পড়াশোনা ছেড়ে কলকাতায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
হযরত থানবীর সাক্ষাৎ এবং নতুন সংকল্প
কলকাতায় অবস্থানকালে একবার খবর পেলেন উপমহাদেশের প্রধানতম আলেম হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি (রহ.) কলকাতায় আসছেন। রেঙ্গুন যাবার পথে সেখানে তিনি যাত্রা বিরতির চিন্তা করেছিলেন। শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) তার বই পড়ে ইতোমধ্যেই ভীষণ ভক্তে পরিণত হয়েছিলেন। খবর শুনে তিনি যেকোনো মূল্যে সাক্ষাতের ইচ্ছে করেন। অন্য অনেক লোকের মতো তিনি সেবার হযরত থানবির সাথে মোসাফা করার সুযোগ পান এবং এই সুযোগে বলেন যে, দীনে ইলম শেখার জন্য তিনি ব্যাকুল কিন্তু বাবা-মায়ের অনুমতি না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সেদিনের বয়ানে থানবি (রহ.) বিষয়টি নিয়ে আফসোস করেন। তার আবেগ ঝরা সেদিনের ইলমি বয়ান শুনে থানবি (রহ.) ইলমে দীন শেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। মনে মনে তখনই সংকল্প করেন- প্রাতিষ্ঠানিকভাবে না হলেও তিনি ধর্মীয় বই পড়েই তার ইলমের ক্ষুধা মেটাবেন। শুরু হয় থানবির (রহ.) বই পড়া। ক্লাস-পরীক্ষার পড়া উপেক্ষা করে সারাদিন তিনি ইসলামি বই নিয়ে মেতে থাকতেন। অবশ্য কখনই তার পরীক্ষা খারাপ হয় নি। বরং তিন ঘন্টার পরীক্ষা এক ঘন্টায় দেওয়া সত্ত্বেও বরাবরই তিনি লেটার মার্কসহ দারুণ ফলাফল করতেন।
অবশেষে দেওবন্দের পথে
ব্যাপার যা-ই হোক দুধের স্বাদ তো আর ঘোলে মেটে না। তিনিও আর তৃপ্ত হতে পারছিলেন না। কলকাতা প্রেসিডেন্সির পড়া শেষ করেই তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের পথে রওয়ানা হয়ে যান। হাতে তেমন কোনো টাকা না থাকলেও তাতে তিনি পিছপা হন নি। তিনি যখন সেখানে পৌঁছেন রজব মাস চলছিলো। ভর্তি শুরু হতে তখনো দু’ মাস বাকি। সে দু’ মাস তিনি হযরত থানবির কাছে থানভবনে কাটাবার ইচ্ছে করে সেখানে চলে যান। ভর্তির সময় ঘনিয়ে এলে তিনি হযরত থানবির সাথে পরামর্শ করেন এবং সে মোতাবেক প্রাথমিকভাবে সাহারানপুরে ভর্তি হন। জামাতে মেশকাত পর্যন্ত এখানে পড়ে হাদীসের কিতার বপড়ার জন্য তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং এখানে দু বছর লাগাতার হাদীসের দরস নেন। হযরত থানবির খনকায় গমন এবং নিজের ইলমের পিপাসা মেটাতে তিনি যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তা আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি পায়ে হেঁটে থানাভবনে হাজির হতেন। যাওয়া আসায় তার অতিক্রম করতে হতো ৩৫ মাইল পথ। সাহারানপুর-দেওবন্দে থাকার বছরগুলোয় কোনো বৃহস্পতিবার তার এই যাতায়াত বাদ পড়ে নি।
কর্মমুখর জীবন
ঘটনাক্রমে হযরত হাফেজ্জি হুজুর এবং শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) একই সময়ের ছাত্র ছিলেন এবং একই মুরব্বি তথা হযরত থানবির (রহ.) পরামর্শে জীবন পরিচালনা করতেন। তাদের কর্মজীবনও একসাথে শুরু হয়। প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় এরপর ঢাকার বড়কাটারা এবং লালবাগ মাদ্রাসায়। ইলমের খেদমত, যোগ্য আলেম তৈরি, সকলশ্রেণীর মানুষের আত্মশুদ্ধি, দেশ-বিদেশে ইসলামের দাওয়াত এবং দেশের নেতা-নেত্রীদের দীনি পরামর্শন প্রদান এবং অনৈসলামিক বিষয়ে সতর্ক করার পেছনে তারা দুজনই জীবন কুরবান করে গেছেন। হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) প্রকাশ্য রাজনীতিতে জড়ান নি। তবে এসব বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং তার দায়িত্বও পালন করতেন। তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো সাধারণ মুসলিমদের প্রয়োজনে প্রচুর সংখ্যক পুস্তক রচনা। সে সময়ে বাংলায় আলেম সমাজের কোনো দীনি খেদমত ছিলো না। তিনি একাই সেই গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। রচনা করেন বহু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি ও বই। আজও সমানভাবেই তার রচনাগুলো মুসলিম জনসাধারণের উপকার করে যাচ্ছে।
ইন্তেকাল
সারাদেশ তখন উত্তাল। পাকিস্তানের জুলুম লাগাম ছাড়িয়ে গেলে বাংলার মানুষ চুপ হয়ে থাকে নি। ১০৪৭ এ পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর থেকে দিন যতো গড়িয়েছে, ভাই থেকে পাকিস্তানিরা ততোই শাসক হয়ে উঠতে চেয়েছে। শামসুল হক ফরিদপুরীর (রহ.) মতো মহান এবং তুমুল জনপ্রিয় আলেমদের তারা ভুল পথে ব্যবহার করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত পারে নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এলাকার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান বিরোধিতার প্রথম পর্যায়ে ফরিদপুরী (রহ.) পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন এবং ইসলামের পক্ষে দুই ভাইকে মেলাবার চেষ্টা করেন। তবে খুব দ্রুতই পাকিস্তানিদের মতলব বুঝতে পেরে তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে নেন। বঙ্গবন্ধু নিজে এসব লিখে গেছেন তার আত্মজীবনীতে। যাই হোক, স্বাধীনতা ও নতুন একটা জাতির জন্মের সেই উত্তাল সময়েই ২১ জানুয়ারি মোতাবেক ১৯৬৯ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। রয়ে যায় কেবল তার ইলমি মিরাস ও স্বল্পায়ু জীবনের অসামান্য সব কীর্তি।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রহ.)
পরিবার ও জন্মস্থান
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ বানুরী রহ ১৩২৬ হিজরি মোতাবেক ১৯০৮ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান ছিলো পাকিস্তানের সেরহিন্দের নিকটস্থ গ্রাম বানূর, এই সূত্রেই পরে তিনি বানুরী হিসেবে খ্যাতি পান। তার পিতা ছিলেন সাইয়েদ যাকারিয়া বাদশাহ। পিতা-মাতা উভয় দিক থেকেই সাইয়েদ বংশের গর্বিত উত্তরাধিকার লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন মাওলানা বানুরী (রহ.)। তার পিতা ছিলেন একাধারে বিজ্ঞ আলেম, আমলি বুযুর্গ, নামি ডাক্তার এবং স্বপ্নের তাবিরের স্বনামধন্য ব্যাখ্যাকার। প্রচুর কিতাবও তিনি রচনা করেছেন। অন্যদিকে তার মাতা ছিলেন আফগানিস্তানের কাবুলের মুহাম্মদ যাঈ নামে খ্যাত শাহী খান্দানের সন্তান।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
চমৎকার এক সময় ও পরিবেশে জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন মাওলানা বানুরী (রহ.)। তার বংশের নারী-পুরুষ প্রায় সবাই ভালো মানের আলেম এবং উঁচু স্তরের বুযুর্র্গ ছিলেন। ইলম-আমলের এমন বরকতি পরিবার কমই দেখো যেতো। তাদের গ্রামে বেনামাজি কোনো লোক বসবাস করারই সুযোগ পেতো না। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন- মুহতারাম আব্বা এবং আমার এক মামার কাছে আমি পবিত্র কুরআন পড়েছি। আমির হাবীবুল্লাহ খানের আমলে কাবুলের এক মক্তবে আরবি ব্যাকরণের প্রাথমিক কিতাবাদি পড়েছি। এছাড়া, ইসলামি ফিক্হ, উসুলে ফিক্হ, মানতেকসহ অন্যান্য ইসলামি শাস্ত্রের কিতাবাদি পেশোয়ার ও কাবুলের উস্তাযবৃন্দের কাছে অধ্যয়নের সৌভাগ্য লাভ করেছি।’ সম্পূর্ণ দীনী পরিবেশে দীনে ইলম চর্চার মধ্য দিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন।
গভীর ইলমসাধনা
হযরত মাওলানা বানুরী (রহ.) বলতেন- আমি নিজের পুরো মেধা ও শক্তি মাসায়েল বের করার পেছনে ব্যয় করেছি। হাজারো পৃষ্ঠা এবং সম্ভাব্য সকল কিতাব ও অধ্যায় আমি তন্ন তন্ন করে উদ্দিষ্ট সে মাসআলা খুঁজে বেড়াতাম। ক্লাসে যে উস্তাযই যেকোনো কিতাবের সূত্র উল্লেখ করতেন সাথে সাথে সেটা নোট করে পরে সেখান থেকে মাসআলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা পড়ে নেওয়া আমার নিত্য অভ্যেসে পরিণত হয়েছিলো। দরসের আগেই সংশ্লিষ্ট কিতাবের সহযোগী গ্রন্থ পাঠ করে দরসে বসতাম। হেদায়ার বছর ফাতহুল কাদির, বাহরুর রায়েক এবং বাদায়ে- তিনটি কিতাবেরই প্রায় দুই সবকের সমান পাঠ করে তবেই দরসে অংশ নিতাম। মেশকাতের বছর বেদায়াতুল মুজতাহিদ এবং হুজ্জাতিল্লাহিল বালেগা মুতালা করতাম। ছাত্রাবস্থায়ই চার মাযহাবের বিখ্যাত প্রায় সব কিতাব আমি মুতালাআ করে শেষ করেছি। কখনো এমনও হতো যে, একটা বিষয়ে তাহকিক বা একটা মাসআলার খোঁজে আমাকে হাজার দু’ হাজার পৃষ্ঠা পর্যন্ত মুতালাআ করতে হচ্ছে। তাতেও আমি ক্লান্তি অনুভব করতাম না।’
মাদ্রাসা ও আসাতেযা
হযরত মাওলানা বানুরী (রহ.) তৎকালীন ভারতবর্ষ এবং আজকের আফগানিস্তানের কাবুল, পাকিস্তানের পেশোয়ার এবং ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ এবং ডাভেল মাদ্রাসায় তৎকালীন বিখ্যাত সব উস্তাযের নিকট শিক্ষা লাভের সুযোগ গ্রহণ করেন। তার উস্তাযগণের মধ্যে ছিলেন মাওলানা আনোয়র শাহ কাশ্মিরী, মাওলানা গোলাম রসূল খান, মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলভী, মুফতি আযীযুর রহমান, মুফতি মুহাম্মদ শফী এবং মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী (রহ.) সহ প্রখ্যাত সব আলেম ও বুযুর্গ। হযরত মাওলানা ইউসুফ বানুরী (রহ.) উস্তাযগণের কাছ থেকে ইলমি ফয়েজ ছাড়াও তাদের কাছ থেকে আদব-কায়দা, আমল ও দীনি জীবনযাপনের একেকটা করে কাজ ও পদক্ষেপ শিখে নিতেন। তার সবচে বড় শায়েখ ছিলেন হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ.)। তার কোনো সবক বা বয়ান তিনি কিছুতেই মিস করতেন না। উস্তাযের প্রতিটি আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি তিনি রপ্ত করে নিতেন এমনকি তার বলা কথাগুলো শব্দে শব্দে হৃদয়াঙ্গম করে নিতেন। সারাজীবন উস্তাযদের প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি বজায় রেখেছিলেন। কাশ্মিরী রহ এর সাথে একবার তিনি কাশ্মির সফরে যাবার সুযোগ লাভ করেছিলেন। তিনি বলতেন- সেখানকার দারুণ আবহাওয়া, পরিবেশ এবং উন্নত খাবারে ঘুম ও আলসেমি আমাকে নাকাল করে ফেলার উপক্রম করতো, তবে কখনো আমি দু আড়াই ঘন্টার বেশি ঘুমাতাম না। প্রচ- শীত উপেক্ষা করে রাত দুটো-তিনটের সময় জেগে তার ওজুর পানি গরম করতাম। সফরের একটি দিনও এমন হয়নি যে, কাশ্মিরী (রহ.) জেগে ওঠেছেন অথচ আমার পানি গরম করা তখনো শেষ হয় নি।’ তার সমসাময়িক উস্তায ও সহপাঠীরাও বলতেন- উস্তাযের ভক্তি ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয় উপমা।
কর্মসাধনা
বহুগুণের আধার ছিলেন হযরত মাওলানা ইউসুফ বানুরী (রহ.)। যোগ্য আলেম তৈরি করা, সাধারণ জনগণের আধ্যাত্মিক উন্নতি, ইসলামি পুস্তক রচনা, দাওয়াতি কাজ, দীনি শিক্ষা বিস্তারে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের মতো বহুবিধ ও বিচিত্র কাজে সারাক্ষণ তিনি ব্যস্ত থাকতেন। তবে সব ছাপিয়ে যোগ্য ছাত্র তৈরি এবং ইলমি গবেষণাই তার জীবনের সবচে বড় এবং উল্লেখযোগ্য দিক হয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে দেশ-বিদেশের অজ¯্র সাধারণ ছাত্রকে তিনি ইলম ও আমলের মহান মহান দিকপাল পরিণত করেছেন। সীমাচীন ব্যস্ততা ও কাজের চাপ সত্ত্বেও তিনি দীনি গবেষণা থেকে কখনো বিরত বা পিছপা হননি। উপমহাদেশের এই সময়ের বরেণ্য বহুসংখ্যক আলেমই তার ছাত্র। ফকিহুল আসর জাস্টিস মাওলানা তাকি উসমানি (রহ.) তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন- তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষিপ্ত কোনো নিবন্ধে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন তার শায়খ হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মিরীর প্রতিচ্ছবি। ইলমে হাদীস তার বিশেষ বিষয় ছিলো, তার সময়ে এই বিষয়ে তার চেয়ে যোগ্য কাউকে পাওয়া ছিলো দুষ্কর।
তার স্মৃতিশক্তি, অধ্যয়নের গভীরতা, পাঠের আগ্রহ, আরবি বক্তৃতা ও রচনার দক্ষতা, কাব্যরুচি, আকাবির ও আসলাফের প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা, ওলামায়ে দেওবন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা ও সমর্থন, জযবা ও লিল্লাহিয়্যাত, চারিত্রিক পবিত্রতা ও নির্মলতা সব সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন আল্লাহওয়ালা ও যোগ্যতম আলেমের উপমা। আল্লাহ পাক তাকে যেসব যোগ্যতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তিনি চাইলেই প্রাচুর্যপূর্ণ এবং স্বাচ্ছন্দময় জীবন যাপন করতে পারতেন। তবে তিনি শাহ সাহেবের সাহচর্য লাভ এবং দীনে ইলমের পিপাসা নিবারণ এবং ইসলাম ও উম্মাহর খেদমতে সব কুরবান করে দিয়েছেন। মাত্র চারবারের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে আশরাফ আলী থানবি (রহ.) তাকে মুজাযে সোহবতের সনদ প্রদান করেছিলেন। আল্লাহ পাক তার কাজের সৌভাগ্যের পাশাপাশ প্রচুর বরকতও দান করেছিলেন। তার ইলম ও ফযলের সবচে বড় কীর্তিটি হলো তিরমিযি শরীফের প্রায় তিন হাজার পৃষ্ঠার ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মায়ারেফুস সুনান’। এর বাইরেও খতমে নবুওয়ত, মওদুদিবাদসহ সমকালীন অনেক বিষয়েই তিনি দারুণ সব গ্রন্থ রচনা করে গেছেন।
ইন্তেকাল
১৩৯৭ হিজরির শাওয়ালে তিনি দারুল উলুম করাচির সবকের ইফতেতাহ করেন। পরের সপ্তায় ইসলামী মুশাওয়ারাতি কাউন্সিলে যোগদানের জন্য ইসলামাবাদ রওয়ানা দেন। প্রথম দুদিনের অধিবেশনে তিনি ঠিকঠাক উপস্থিত থাকলেন, ভাষণও দিলেন। এরপর অসুস্থতা বোধ করায় ডাক্তারি চেকআপ শেষে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কয়েকদিন সেখানেই শারীরিক কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে অবশেষে যিকাদাহ মাসে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে জান্নাতের পথে পাড়ি জমান। আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে তাকে উঁচু মাকাম দান করুন।
বিয়ে এবং পারিবারিক জীবন
বিয়ে : রংধনুর পাঁচ রঙ!
১৯৭০ সালে করাচি থেকে ফিরে তিনি হাফেজ্জী হুজুরের নির্দেশে জামেয়া নূরিয়ায় শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সময়ে শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। তবে এই তোড়জোড়টা একই সময়ে দুই দিক থেকে শুরু হওয়ায় বিপত্তি বাধে দারুণরকম। সাধের বিয়ে পরিণত হয় উত্তেজনাপূর্ণ টানাপোড়েনে। শুনুন ঘটনা-
বাইয়াতের প্রশ্নে মুফতি আমিনীর বাবা ওয়ায়েজ উদ্দিন ছিলেন পীরজী আব্দুল ওয়াহহাব সাহেবের মুরীদ। সমসাময়িক অন্যান্য আলেমের সাথেও তার ছিলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তবে একটু বিশেষ সম্পর্ক ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মরহুম বড় হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেবের সাথে। প্রায় প্রতিদিন জামেয়ায় যাতায়াত-কথাবার্তার কারণে সম্পর্কটা একটু বেশিরকমেরই ব্যক্তিগত হয়ে যায় এবং কোনো একদিন বড় হুজুর মেধার দ্যুতি ছড়ানো আমিনীর সাথে তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব করেন। স্বাভাবিক কারণেই সানন্দে ‘হ্যাঁ’ মত জানিয়ে দেন জনাব ওয়ায়েজ উদ্দিন। কথা পাকাপাকি দু’পক্ষ থেকেই।
এদিকে হাফেজ্জী হুজুর করে রেখেছেন অন্য প্ল্যান। হবু জামাতার সাথে কথা বলেছেন আগেই। এবার চিঠি পাঠালেন বাড়িতে। তারই ছাত্র ও খাদেম মুফতি আমিনীর বড় ভাই জনাব নূরুল হককে লেখা চিঠিতে তার পিতা ওয়ায়েজ উদ্দিনকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে আসার আহ্বান জানান। বিয়ের প্রসঙ্গটি জানিয়ে তাকে দায়িত্ব দেন বাবার সম্মতি আদায়ের। খবর শুনেই বেঁকে বসলেন জনাব ওয়ায়েজ উদ্দিন। দু’পক্ষই পরস্পরের প্রতিটি সদস্যের খোঁজ খুব ভালো জানতেন। সুতরাং বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন ঢাকায় তিনি যাচ্ছেন না। ছেলের বিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই করাবেন। কাহিনী মোড় নেয় অন্যদিকে। জনাব নূরুল হক তখনো হাফেজ্জী হুজুরের বিয়ের প্রস্তাবটি বাবার কাছে পেশ করেননি। নিজের অনুমান থেকেই তিনি এমনটা বলে ফেলেছিলেন। পরে নূরুল হক এবং তার আলেম মামা জনাব ইদ্রিস মিয়া মিলে তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, বিয়ে নয় অন্য প্রয়োজনেও হতে পারে এবং না যাওয়াটা বড় বেমানান। অবশেষে পিতা-পুত্র রওয়ানা হন ঢাকার পথে। তারা মেহমান, মেজবানের দায়িত্বে হাফেজ্জী হুজুর। আপ্যায়নের পর যথারীতি প্রস্তাব পেশ করেন হাফেজ্জী হুজুর। অপর পক্ষের কোনো সাড়া নেই। তিনি তো আগে থেকেই নিজ সংকল্পে অটল। হযরত হাফেজ্জীর বুজুর্গি, পুরনো সম্পর্ক কিছুই তাকে টলাতে পারে না। ওদিকে দুই ভাই এবং হাফেজ্জী হুজুরের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান চলছে হরদম। কোনো উন্নতি নেই। দিন যায়। একদিন, দুই দিন. তিন দিন…এবং অবশেষে বাপ-বড়বেটার অনেক যুক্তিতর্কের পর চতুর্থদিন এশার সময় আশঙ্কার কালো মেঘ থেকে মুক্ত হলো আকাশ। পাথরে ঝর্ণার প্রবাহ ছুটলো। দুই মানবমানবীর পবিত্র হৃদয়ের মেলবন্ধনের খবর নিয়ে তারায় তারায় কানাকানি চললো। চাঁদ ছড়ালো আলো। বাংলার আকাশ-বাতাসে কম্পন তোলা সিংহপুরুষটির বিয়ে হয়ে গেলো মাত্র তিনজন ব্যক্তির উপস্থিতিতে। বড় অনাড়ম্বরভাবে। বড়ই নীরবে।
মুফতি আমিনী (রহ.) এবং হাফেজ্জী হুজুরকন্যা মুবারকা সাহেবা-এর চার দশকের বেশি সময়ের সংসার আলোকিত করে জন্ম নেন ৬ সন্তান। দুই ছেলে, চার মেয়ে। ছেলে দু’জন হলেন আবুল ফারাহ ও আবুল হাসানাত। মেয়েরা হলেন যয়নাব, আয়েশা, যাকিয়া এবং ফারহানা। বর্ণিল শৈশব-কৈশর ও সফল শিক্ষাজীবন শেষ করে সবাই এখন কর্ম ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তারা ছাড়াও মুফতি আমিনী (রহ.) ১৭ জন নাতি-নাতনী এবং তৃতীয় প্রজন্মেরও দু’জন উত্তরাধিকারীকে দেখে গেছেন। আল্লাহ তায়ালা এ পরিবারটির ওপর বরকত নাজিল করুন।
মুফতি আমিনী (রহ.) পারিবারিক জীবন
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর পারিবারিক জীবন বলতে কেবল বাবা-মা-ভাই-বোন বা স্ত্রী-সন্তান বললে ভুল বলা হয়। সমগ্র জীবনটা যিনি দীনের সেবায়, মুসলিম সমাজ এবং ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়ার পেছনে কুরবান করে দিয়েছিলেন তার পারিবারিক গ-িটা এতো ছোট হয় কী করে? মুফতি আমিনীর জামাতা ও বড়কাটারা মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা সাইফুল ইসলাম সাহেব লেখেন- ‘মুজাহিদে মিল্ল¬াত মুফতি আমিনীর পরিবার প্রচলিত অর্থের পরিবার ছিল না। তার পরিবার ছিল দেশজুড়ে পরিব্যাপ্ত। দীনি শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যন্ত ছিল এর বিস্তৃতি। তিনি তার কর্ম, বক্তব্য, সফর, সামাজিক ও রাজনৈতিক বহুমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে তার পরিবারের এই ব্যাপক পরিধি নির্মাণ করে গেছেন।
হযরতের ব্যাপাারে একটি কথা প্রসিদ্ধ যে, তিনি পরিবার বিমুখ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি পরিবার বিমুখ ছিলেন না। দীনী খেদমতকে পরিবারের ওপর প্রাধান্য দিতেন। তাই তার সময়গুলো দীনী প্রতিষ্ঠান, দীনী আন্দোলন, গভীর অধ্যয়ন ও মুতালাআতে অধিক ব্যয় করতে দেখা গেছে। আকাবিরের সুন্নত তো এমনই। তিনি তার অর্থ-সম্পদের সিংহভাগ দীনী আন্দোলনে খরচ করেছেন। এছাড়া ধনী পিতার ওয়ারিস হিসেবে প্রাপ্ত অন্যান্য সম্পত্তিগুলো ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে দীনী আন্দোলনের ফান্ড তৈরির জন্য বিক্রি করেছেন। এই পৃথিবীতে তার একমাত্র ক্রয়কৃত মূল্যবান জমিটিও ২০১১ সালে নারীনীতি ও শিক্ষানীতির ঐতিহাসিক আন্দোলন ও হরতালের জন্য ব্যায় করে গেছেন। হরতালপরবর্তী প্রায় ৫০০-৫৫০ জনের অসংখ্য মামলায় ব্যয় মেটাতে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত নিজের টাকাই ব্যয় করেছেন। পাশাপাশি চলমান আন্দোলন ও মামলার ব্যয় মেটাতে কোটি টাকার অধিক পরিমাণ ঋণ নিজের কাঁধে গ্রহণ করেছেন।
মুজাহিদে মিল্লাতের পেছনে দায়িত্ব পালনকারী একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বিগত ৩ সরকারের আমলসহ মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। হযরতের বাসায় সমবেদনা জানাতে এসে একটি কথা বারবার আওড়াচ্ছিলেন, ‘হুজুর সংসার বিমুখ মানুষ ছিলেন। তিনি সংসারকে গুরুত্ব দিতেন না। আসলেই তিনি সংসার বিমুখ ছিলেন…।’ কথাগুলো সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে নিন্দনীয় হতে পারে। কিন্তু হযরতের ক্ষেত্রে অবশ্যই তার উল্টো। কারণ, তার সাংসারবিমুখতা ছিল দীনের খেদমতের খাতিরে। পরিবারের জন্য সময় ও অর্থ ব্যয়ে সংকোচননীতি অবলম্বন করার কারণে তাকে বাহ্যিকভাবে সংসার বিমুখ মনে হতো।
আমার বিয়ের পরপর আল্ল¬ামা ইসহাক ফরিদী (রহ.)(চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম, বরেণ্য আলেম ও লেখক) -এর সাথে একবার দেখা করতে গেলে বললেন, ‘সাইফুল মিয়া, তোমার শ্বশুর সাহেবের পকেটের হালতের মতোই হালত আমার পকেটের। তবে মুফতি সাহেব হুজুরের সৌভাগ্য যে, ঘরে একজন দক্ষ পরিচালিকা আছেন। তিনি মুফতি সাহেবের সামান্য দিয়েই ঘরের জরুরত ঘুচিয়ে দিতে পারেন। এদিক দিয়ে আমি আরো দুর্বল। তাছাড়া মুফতি সাহেবের ঘরের লোক তো বুযুর্গের আওলাদ। এমনিতেই তারা কানাআত ও তাওয়াক্কুল (অল্পেতুষ্টি ও আল্ল¬াহ ভরসায়) অভ্যস্ত…।’ আমি পরবর্তী প্রায় দশ বছর ধরে এর যথার্থতা দেখেছি। দেখতে পাচ্ছি আজও।
প্রথমে কুরআন তারপর পরিবার
সাইফুল সাহেব আরো লেখেন- সন্তানের প্রতি প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত ভালোবাসা সবাই লালন করে। কিন্তু আল্ল¬াহ ওয়ালারা দীনী মুহাব্বতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। হযরত মুজাহিদে মিল্লাতের মাঝে বর্তমান যুগেও এই বিরল দীনী মুহাব্বত জাগ্রত ছিলো। এর প্রকাশ্য অনেক উদাহরণ রয়েছে। দেশ ও বিশ্ববাসী ২০১১ সালে কুরআনবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রত্যক্ষ করেছে। কলিজার টুকরা সন্তানকে গুম করে হত্যার ভয় দেখিয়ে জালিম নব্য ফেরআউন হকের আন্দোলন হতে মুজাহিদে মিল্লাতকে (রহ.) পিছু হটাতে চেয়েছিল। কিন্তু মুজাহিদে মিল্ল¬াত (রহ.) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাকে বা আমার এক ছেলে নয় আমার গোটা পরিবারকে হত্যা করলেও কুরআনের আন্দোলনে আপোষ করব না।’ গুম হওয়ার পর ৮ম দিন রাতে হাসানাত ভাইকে জীবিত ফেরৎ পাওয়ার ব্যাকুলতায় আমি যথাযথ আদব রক্ষা করে হযরতকে একটু নরম পন্থা অবলম্বন করতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি সেদিন কঠোর ভাষায় আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেদিনের কথাগুলো শুনে মুজাহিদে মিল্লাতের প্রতি আমার দীনী শ্রদ্ধা ও আযমত কয়েক লক্ষ গুণ বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেছিলেন ‘আমার ছেলে কুরআনের ইজ্জতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না। আমার ছেলের জন্য আমার চেয়ে তোমার মায়া বেশি, এটা মনে করো নাকি? কুরআনের ইজ্জতের জন্য আন্দোলন করলে আমার সবই বাঁচবে। কুরআনের বে-ইজ্জতকারীদের সাথে আপোষ করলে আমরা আখেরাত হারাব, দুনিয়া হারাব। এমনকি আমার ছেলেও হারাব। তুমি এখন যাও। দুআ করতে থাকো….।’ একেই বলে আল্লাহর জন্য মুহাব্বত। সন্তানদের প্রতি দীনী মুহাব্বতের আরো অনেক ঘটনা রয়েছে।
শিশুদের প্রতি কোমল হও
‘পরিবারের ছোটদেরকে ডাকার ক্ষেত্রে তার স্বর ও ভঙ্গি ছিল মমতামাখা। পরিবারের শিশুদের প্রতি তার হৃদয়কাড়া সান্নিধ্যপ্রদান ছিলো অবিশ্বাস্য ধরনের। বাইরের কেউ দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে, সেই গম্ভীর শিক্ষক, দীর্ঘ মোনাজাতকারী সুফী, তেজস্বী বক্তা ও নিবিড় অধ্যয়নশীল ব্যক্তিটিই এই শিশুদের মাঝে একজন খেলার সঙ্গী, আনন্দের খোরাকদাতা। আল-হামদুলিল্ল¬াহ, হযরতের চার কন্যা, দুই পুত্রের মাধ্যমে ১৭ জন নাতি-নাতনীর দাদা-নানা ছিলেন মুজাহিদে মিল্লাত (রহ.)। আর দুই জন প্রপৌত্রের প্রপিতামহ ছিলেন তিনি। পরিবারের পাশাপাশি মাদ্রাসায়ও শিশুদেরকে শারীরিক শাস্তি দেয়ার ঘোরবিরোধী ছিলেন আমাদের হযরত।
জিন্দেগীর আখেরি বাইতুল্লাহর সফরে ভিসা না পাওয়ায় হযরতের সফর সঙ্গী হতে পারিনি। ২০১০ সনের সেই রমজানের শেষ দশকে মদীনা শরীফে অবস্থান করছিলেন। একজন নাতি দুনিয়ায় আসার সময় তার এক কন্যার অসুস্থতার খবর পেয়ে বেহুশ হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। দুর্ঘটনার ব্যাপারে কাউকে জানান নি। কিন্তু বেহুশ হয়ে পড়ে যাওয়ার কারণে চেহারার একপাশে সম্পূর্ণ নীল হয়ে গিয়েছিল। দেশে ফেরার পর রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখলেও সহধর্মিণীর চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি সেই আঘাতের চিহ্ন। জিজ্ঞাসার পরে কারণ বলেছেন। আর আমি হতভাগা এই ঘটনা জানলাম ইন্তিকালের একমাস পরে। পরিবারের কাছে অসুস্থতার খবর শুনলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতেন। অসুস্থতার ক্ষেত্রে ওষুধপত্রের চেয়ে তিনি বিভিন্ন খাস দোয়াকে প্রাধান্য দিতেন।
পারিবারিক অনেক বিষয়ে ‘তোমরাই পার্থিব বিষয়ে বেশি অবগত’ রাসূলের সা. এই বাণী অনুসারে অবস্থান নিতেন। যেমন কেউ বাচ্চার নাম চাইলে বলতেন, তোমরা দুই-তিনটা নাম বাছাই করো। আমি একটাকে পছন্দ করে দিবো। ঘর-গৃহস্থের বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর ছেড়ে দিতেন। সবাইকে যার যার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরে ভিত্তিতে কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন।
কারো ব্যাপারে কোনো অভিযোগ জানালে বিশেষ হেকমত ছাড়া অন্যের সামনে তাকে নসীহতও করতেন না। অন্যের সামনে নসীহত করতে গেলে দোষ প্রকাশ করা হয়ে যাবে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি ভিন্নপন্থা অবলম্বন করতেন। হয়তো একান্তে তাকে তার ভুল ধরিয়ে দিতেন। অথবা মাদ্রাসায় ছাত্র বা শিক্ষকবৃন্দের মজলিসে দোষী ব্যক্তিকে গোপন রেখে নসীহত করতেন। যেমন বলতেন, ‘আজকাল আমাদের অনেকে ….. করে। অনেক উস্তাযের মাঝে ….. বিষয়টি দেখা যাচ্ছে বা শোনা যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক…।’ এভাবেই তিনি লাঠি না ভেঙে সাপ মারতেন। রাজনৈতিক সহকর্মীদের ক্ষেত্রে এমনকি পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও তার এই নীতি ছিলো। এর গভীর হেকমত এ ছিলো যে, এই দোষে আরো কেউ দোষী হলে তাদের জন্যও এই নসীহত কার্যকর হতো। দোষী ব্যক্তির ইজ্জতও রক্ষা হতো। এটাই ছিলো আকাবিরের জীবনী ও তাদের মালফুজাতের অধ্যয়নে ডুবে থাকা মুজাহিদে মিল্ল¬াতের হেকমতপূর্ণ ইসলাহী পদ্ধতি।’
সন্তানদের প্রতি মহাব্বত
হযরতের জামাতা মাওলানা যোবায়ের আহমদের ভাষ্য- ‘আমরা তার কাছাকাছি থাকার সুবাদে জানি যে, তিনি তার ছেলে-মেয়েদের প্রতি এবং নাতি-নাতনিদের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল ছিলেন। তাদের কারো সাধারণ কোনো অসুখ-বিসুখ বা সামান্য বিপদ-আপদে অস্বাভাবিক অস্থির হয়ে পড়তেন তিনি। অথচ বাবা হয়েও তা আমাদের কাছে সামান্য বিষয় মনে হতো। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমার দাওরার বছর, আমি হুজুরকে বাসা থেকে মাদ্রাসায় নিয়ে আসতাম। একদিন দেখলাম, হুজুর চোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে উঠলেন, আমি পাশে বসা। কিছু বলার সাহস হলো না। মাদ্রাসায় যখন আসলেন, ছাত্ররাও দেখলো যে, হুজুরের চোখে পানি। কিছুটা কৌতূহল জেগে উঠলো, কী হয়েছে হুজুরের, তার চোখে পানি কেন? হুজুর একটু পরপর বাসায় ফোন করছেন, জানতে চাইছেন এখন কী অবস্থা, জ্বর কমেছে…? খবর নিয়ে জানলাম, তার বড়ো মেয়ের জ্বর হয়েছে। আর তাই হুজুর এতো বিচলিত। সেই মুফতি আমিনীর ছোটো ছেলে যখন গুম হয়েছে এবং এ ঘটনা এমন শক্তির হাতে ঘটেছে যেখান থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু সেই বাবাই আজ তার অতি প্রিয় ছেলের জন্য মোটেও বিচলিত নন, বরং ইস্পাত কঠিন শক্ত ও দৃঢ় মন নিয়ে নিজের আদর্শের মিশনে অটল অবিচল। তার মানে এই নয় যে, তিনি সন্তানের মায়া ভুলে গেছেন। বরং তিনি তার খাস কামরায় যখন মুনাজাতে হাত ওঠাতেন, ছেলে হাসানাতকে ফিরে পাবার জন্য তার নাম ধরে আল্লাহর দরবারে এমনভাবে কাঁদতেন, যেভাবে কোনো অবুঝ শিশু তার মায়ের কাছে কিছুর জন্য বায়না ধরেছে। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য সেই ব্যাকুল কান্নার হৃদয়ভাঙা আওয়াজ পাশের দফতরে শোনা যেতো।
একদিন আমরা কয়েকজন পরামর্শ করলাম যে, আমাদের ছোটোভাই হাসানাতকে ফিরে পাওয়ার জন্য হুজুরকে একটু নমনীয় হতে বলি, আন্দোলন থেকে সামান্য সরে আসতে পরামর্শ দিই (যেভাবে অপহরণকারীরা হাসানাতকে বলেছিল) এতে হয়তো হুজুরের কষ্টও কমে আসবে এবং আমরাও আমাদের ভাইকে আমাদের মাঝে নিরাপদে ফেরত পাবো। কিন্তু তার সামনে কথাটি বলবে কে? সবাই বললো, বড়ো জামাতা হিসেবে আমাকেই কথাটা বলতে হবে। আমিও পূর্ণ আস্থা নিয়ে কথাটি বলার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। হুজুর যখন জায়নামাজ থেকে উঠে নিজের রুমে চেয়ারে এসে বসলেন, তখনও তাঁর চোখে পানি। আমাকে দেখে মলিন মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। আমি ভাবলাম, হুজুরের মন হয়েতা এখন নরম আছে, তাই কথাটা এখনই বলে ফেলা দরকার। আমি এ প্রসঙ্গটি শুরু করেছি মাত্র, শেষ করতে পারিনি। তিনি আমার ওপর এতোবেশি নারাজ হলেন যে, এর আগে আর কখনো তাকে এমন অসন্তুষ্ট হতে দেখিনি। তিনি আমাকে বললেন, ‘যুবায়ের, অন্তত তোমার কাছ থেকে এমন কথা আমি আশা করিনি। তুমি এ বিষয়ে আর একটি কথাও বলবে না, এখন তুমি চলে যাও।’ আমি মাথা নিচু করে চলে এলাম। কিছুসময় পর তিনি আমাকে এবং আমার সঙ্গে যারা ছিলেন, সবাইকে ডাকলেন। অনেক কথা বললেন, বোঝালেন এবং বললেন, ‘তোমাদের সবার মনের অবস্থা আমি অনুভব করি। তবে তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো, হাসানাতের কোনো ক্ষতি হবে না। ছেলের কারণে আল্লাহর কুরআনের বিষয়ে কোনো আপস করা যাবে না। আল্লাহ আমাকে পরীক্ষায় ফেলেছেন, ইনশাআল্লাহ আমি উত্তীর্ণ হবো। কুরআন রক্ষার আন্দোলন থেকে আমি এক ইঞ্চিও পিছপা হবো না।’ আমরা দেখলাম, কদিন পর বাস্তবেও তা ঘটেছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, কান্নাকাটি এবং দুআ ও মুনাজাতের মধ্য দিয়ে টানা ১২টি দিন অতিবাহিত হওয়ার পর এক বিভীষিকাময় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়ে হাসানাত তার বাবার বুকে ফিরে এসেছিলো। আমরা আমাদের ছোটোভাইকে আমাদের মাঝে ফিরে পেয়েছিলাম। হযরত মুফতি আমিনীর কথা হুবহু সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
পরিবারের প্রশ্নে আজীবন নবীজীর সুন্নাতের অনুসরণ
বিশেষ এক স্মৃতিচারণে আলেম ও বক্তা মাওলানা আবু তাহের জিহাদী সাহেব বলেন- ‘আমি নিজে তাকে যেমন পেয়েছি, তার সন্তানদেরও প্রশ্ন করেছি, তোমাদের সঙ্গে তিনি কেমন ছিলেন। আমি মনে করি, মাঝে মাঝে তিনি যে একজন বড়মাপের নেতা এ কথা ভুলে যেতেন। তখন নেতা নয় বন্ধু হয়েই আমাদের সঙ্গে থাকতে চান। নেতা হিসেবে তিনি যেমন আপসহীন, তেমনি বন্ধু হিসেবে ছিলেন উদার। আর সন্তানদের কাছে কেমন তার কনিষ্ঠ পুত্র মাওলানা আবুল হাসানাতকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন- আব্বা ফ্যামিলির সবাইকে সমানভাবে সময় দিতেন। সন্তানদের কাছে যেমন ছিলেন একজন আদর্শ পিতা, তেমনি নাতি-নাতনীর কাছে ছিলেন একজন আদুরে দাদা বা নানা। নাতি-নাতনীর আবদার তিনি উড়িয়ে দিতেন না। যেমন, কখনো তার মিষ্টি খাওয়ার আবদার করলে শত ব্যস্ততা থাকলেও নিজে না হোক, কাউকে পাঠিয়ে দিয়ে হোক, মিষ্টির ব্যবস্থা করতেন। আমার মনে পড়ে, তিনি যখন ফতোয়াবিরোধী আন্দোলনের রায়ে কয়েক মাস জেল খেটে বেরুলেন, আমরা তখন কেন্দ্রে সাক্ষাৎ করছি। ইতোমধ্যে তার মেয়ের ঘরের এক নাতি এসে নানা বলে হজরতের কোলে বসলেন। নানাও জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং খোঁজ-খবর নিলেন। আমরা উপস্থিত সকলেই তখন নানা-নাতীর এই প্রীতিকর অবস্থা অবলোকন করি।
মুফতি সাহেবের এক ছাত্র বলেন- মুফতি আমিনী সাহেব ১৯৮৪ সালের দিকে একবার স্বপরিবারে মিরপুর চিড়িয়াখানায় যান। তাঁদের ও আত্মীয় স্বজনের বাচ্চাদেরকে আগলে রাখার জন্য তিনজন ছোট ছাত্র সঙ্গে নেওয়া হয়। সেই তিনজনের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। ছাত্রাবাসের কোনো উস্তায অথবা মুফতি আমিনী সাহেবের ঘনিষ্ঠ কোনো ছাত্র হয়তো আমাদের নির্বাচন করেছিলেন। সেদিন একেবারে কাছ থেকে হৃদয়ঙ্গম করি, তিনি কী পরিমাণ স্নেহপরায়ণ পিতা ও বন্ধুসুলভ উস্তায।’ পারিবারিক জীবনের প্রতি পদে পদে এভাবেই তিনি নববী সুন্নতের একনিষ্ঠ অনুসরণ করে গেছেন। কোমলতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত আচরণের মাধ্যমেই তিনি সবকিছুর সুরাহা করতেন।
শিক্ষকতা ও মাদ্রাসা পরিচালনা
কর্মজীবনের একঝলক
গৌরবময় শিক্ষাজীবন শেষে মুফতি আমিনী (রহ.) প্রিয় উস্তাযের সান্নিধ্যে ফিরে আসতেই স্বস্তি বোধ করলেন। সদর সাহেব দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ায় হাফেজ্জি হুজুরই তখন তার প্রধান উস্তায ও মুরব্বি। হাফেজ্জি হুজুরের নির্দেশে ১৯৭০ সালে মাদ্রাসায়ে নূরিয়ায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। ১৯৭২ সালে ঢাকার আলু বাজার মসজিদে খতিব ও ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। আলু বাজার মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার ৩ বছরের মাথায় প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় ইমামতি থেকে অবসর নেন। তবে ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আলু বাজারে তাঁর সাড়া জাগানো সাপ্তাহিক তাফসীরের ধারা অব্যাহত ছিলো। ১৯৭৫ সালে তিনি জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগের শিক্ষক ও সহকারী মুফতি নিযুক্ত হন। তার ক্রমশ সাফল্য লাভের ধারা এরপর আর নিম্নগামী হয়নি। ১৯৮৪ সালে মুফতি আবদুল মুঈযের (রহ.) ইন্তেকালে তার ওপর লালবাগ জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রধান মুফতির দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৯৮৭ সালে আমীরে শরীয়ত হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) ইন্তেকালের পর থেকে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। শুরু হয় সমৃদ্ধি ও পূর্ণতার পথে তার অব্যাহত এগিয়ে চলা।
১৯৭০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা ৩২ বছর পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পাকিস্তান ঈদগাহ মাঠে তিনি ঈদের জামাতে ইমামতি করেছেন। ১৯৮০-৯০ পর্যন্ত লালবাগ মোড়ে লোক দিয়ে একটি লাইব্রেরিও তিনি পরিচালনা করিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে বিশেষ পরিস্থিতিতে বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মুহতামিম ও মুতাওয়াল্লির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, তথ্যস্ত্রাস ইত্যাদি সয়ে নিয়ে কৃতিত্ব ও আমানতদারির সাথে মৃত্যু অবধি তিনি এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। পাশাপাশি কাকরাইল দারুল উলুম ঢাকা, দারুস সুন্নাহ আল ইসলামিয়া দাউদকান্দি কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাজীপাড়া মাদ্রাসাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু মাদ্রাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। জীবনের শেষের কয়েক বছর (ঢাকায় থাকলে) বড় কাটারা মাদ্রাসার মসজিদে জুমার নামাজে ইমামতির দায়িত্ব আঞ্জাম দিতেন।
বড়কাটারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সাইফুল ইসলাম বলেন- ‘রাজনীতি ও আন্দোলনের ময়দানে ব্যস্ত একজন মুফতি আমিনী দুটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এবং একাধিক মাদ্রাসার মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করতেন আপন দায়িত্ববোধ নিয়ে। সফর বা দূরের কোনো প্রোগ্রামে গেলে দ্বিতীয় স্তরের দায়িত্বশীলের কাছে বলে যেতেন। না থাকলে ফোন করতেন। এক ধরনের ছুটি নেয়ার মতো। শেষ বয়সেও যখন হাজার কাজে ব্যস্ত, তখনও এক এক জামাতের ছাত্রদের ডেকে খোঁজ নিতেন। উস্তাযদের মধ্যে কোনো বিরূপ আচরণ দেখলে তা সাথে সাথেই শুধরে দিতেন। কখনো সরাসরি ডেকে নিয়ে। আবার কখনো মজলিসে নাম উল্লেখ না করে কী ভুল কোনটা করা উচিত কোনটা অনুচিত ইঙ্গিত করে বলে যেতেন। হুজুর মাদ্রাসার আসবাবপত্র ব্যবহারে খুবই সচেতন ছিলেন। গত রমজানে এক বৈঠকে কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমার এই রুমে (লালবাগে নিজের ব্যক্তিগত রুম) যতো জিনিস আছে সবই আমার নিজের টাকা দিয়ে কেনা। বড় কাটারায় দশ বছর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে গেলেন কিন্তু এক টাকাও বেতন নেননি। ২০০৩ সালে যখন এই মাদ্রাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখনি দুটি শর্ত দেন। এক. বিনা বেতনে আমি দায়িত্ব পালন করবো। দুই. আমার ছেলে-জামাইদের মধ্যে কেউই মাদ্রাসার দোকান-বাড়ি ভাড়া নিতে পারবে না। লালবাগের উস্তায হুজুরের এককালের একান্ত একজন খাদেম আমাদের শুনিয়েছেন, মাদ্রাসার দায়িত্ব যখন হুজুরের হাতে শুরু, হুজুর কমিটি বাতিল করে দেন। কমিটিশূন্য মাদ্রাসা। আবার রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় অতো অনুদান আসে না। হুজুরও যার তার কাছে আবেদন করতে পারেন না। তখন কেমন অবস্থা যেতে পারে সবার বোধগম্য। বোর্ডিং সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। অন্যগুলো সামাল দেওয়া গেলেও এটাতো মুশকিল ব্যাপার। হুজুর সারাদেশে প্রোগ্রাম করতেন, কিছু হাদিয়া পেতেন। তা যেভাবে নিয়ে মাদ্রাসায় ফিরতেন, ওভাবেই পরদিন অন্য প্রোগামে যাওয়ার সময় মুষ্ঠিবদ্ধ করে বোর্ডিংয়ে দিয়ে চলে যেতেন। তার পরেও সংকট কাটলো না। আর কী করা। নিজের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সবার আবদার সেটা করতে না পারলেও ফ্যামিলির সোনা-গয়না বিক্রি করে বোর্ডিংয়ের খরচ চালালেন। এ ছাড়া পরিবারের লোকদের একান্ত আলাপে জানতে পেরেছি, অনেক সময় ১০-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত এক হাতে মাদ্রাসায় দান করে দিয়েছেন।’ মুফতি আমিনীর (রহ.) শিক্ষকতা ও মাদ্রাসা পরিচালনা নিয়ে তারই ক’জন ছাত্র ও শাগরেদের ভাষ্য তুলে ধরছি।
মুফতি আমিনী (রহ.) আদর্শ শিক্ষকের উপমা
মুফতি আমিনীর (রহ.) শিক্ষকতা জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বড়কাটারা মাদ্রাসার মুহাদ্দিস বরেণ্য আলেম মাওলানা আবুল কালাম সাহেব লেখেন- ‘যেহেতু আমি হযরতের প্রাক্তন যুগের একজন নগণ্য ছাত্র, তাই যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও হযরতের শিক্ষকতার জীবনসংক্রান্ত কিছু লিখতে মনে প্রবল উৎসাহ বোধ করছি। এ বিষয়ে কলম ধরার পূর্বে একটি কথা হৃদয়পটে উদিত হলো। সেটা বলে নেয়াই ভালো মনে করছি। আমার ছোট বয়সের কথা। আমি তখন ঢাকার দক্ষিণে বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ি থানার অন্তর্গত আবদুল্লাহপুর হিফজখানায় অধ্যয়নরত। তখন প্রায়ই দুজন সিনিয়র ছাত্রের পারস্পরিক আলাপচারিতায় শুনতাম, লালবাগে সদর সাহেবের একজন খাস ছাত্র আছে ফজলুল হক নামে। সে দিনরাত কিতাব ছাড়া কিছু বুঝে না। মাদ্রাসার সিড়ি বেয়ে ওঠানামার সময়ও কিতাব হাতে গভীর অধ্যয়নে বিভোর থাকে। গায়ে ছেড়া জামা, কোন খবর নেই তার। শুধু কিতাব নিয়েই ব্যস্ত সে। এ কথাগুলো ছাত্রদ্বয়ের সংলাপে প্রায়ই শুনতাম। তখন ফজলুল হক নামক ছাত্রটিকে একনজর দেখতে মন চাইতো। কালক্রমে হিফজ সমাপনের পর প্রথমে কামরাঙ্গীরচর নূরিয়া মাদ্রাসায় এবং দু’বছর পর লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ায় ভর্তি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করলাম। তখন হযরত সদর সাহেব (রহ.) বেঁচে নেই। বরং আমি রাজধানীতে আসার বহু পূর্বেই তিনি জান্নাতবাসী হয়ে যান। আর তখন মুফতি আমিনী (রহ.) হযরত হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা, অনলবর্ষী বক্তা, মুফাসসিরে কুরআন, মুফতি ফজলুল হক নামে সারাদেশে বিখ্যাত। আমিনী হয়েছেন আরো পরে।
দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে পরবর্তী বছর উপস্থিত হলো। হিদায়াতুন্নাহু জামাতে ভর্তি হলাম। বড় মাপের আসাতিযায়ে কিরামের নামে কিতাবগুলো বণ্টিত হলো। পূর্ণ উৎসাহে র্দস আরম্ভ হলো। দেখতে দেখতে কয়েক মাস অতিক্রান্ত হলো। এদিকে মুরব্বি হুজুরগণের সম্মিলিত সিদ্বান্তে মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে লালবাগ জামেয়ার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। জামেয়ার সহকারী মুফতির গুরুদায়িত্ব দেয়া হলো তাকে। আর নীচের দিকে আমাদের জামাতের ইলমুস সীগা এলো তার নামে, যা তখন আমরা পড়ছিলাম জনৈক মুহাক্কিক হুজুরের কাছে।
কিতাব অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলো। যাই হোক, ঐ হুজুরের পরিবর্তে আমিনী সাহেব আমাদের দরসে তাশরীফ আনলেন। তখন পূর্ববতী উস্তাযজ্বীর কাছে উক্ত কিতাবের একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল কায়েদা পড়ছিলাম। সকলে মিলে আমিনী হুজুরকে অনুরোধ করলাম উক্ত কায়েদাটি হতে সবক আরম্ভ করার জন্য। হযরত বললেন, তোমরা তো কায়েদাটি ঐ উস্তাদের নিকট পড়েছ। তা হলে আবার…। আমরা আরয করলাম, হুজুরের কাছে আরেকবার পড়তে মন চাচ্ছে। তখন হযরত আমাকে বললেন, আবুল কালাম! কায়েদাটি শুনাও তো, দেখি তুমি কী বুঝেছো। আমি শুনালাম। হযরত আরেকজনকে নির্দেশ দিলেন-শুনাও তো, দেখি তুমি কীরকম বুঝেছো। এভাবে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে শুনলেন। এরপর কায়েদাটিকে নতুন করে খুলে খুলে, ভেঙ্গে ভেঙ্গে এমন সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন, মনে হলো কায়েদাটি পূর্বে চাদের ক্ষীণ আলোতে দেখেছিলাম আর এখন সূর্যের প্রখর আলোতে পরিষ্কারভাবে বুঝে নিলাম। হযরত তখন একটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন যা এখনো আমার কানে ঝংকৃত হচ্ছে। বলেছিলেন, তো ইস কায়েদা কে দু জুয হোয়ে…। দরস্ সমাপ্ত হলো, আমিনী সাহেব উঠে গেলেন। এদিকে জামাতের সকলে পুলকিত মনে আমিনী হুজুরের গুণকীর্তন ও প্রশংসায় মেতে ওঠলো।
এ তো গেল প্রথম দিনের দরস। পরদিন হতে হযরত নিয়মিত সবক পড়াতে থাকেন। সবক পড়ানোর পাশাপাশি প্রতিদিন আকাবির ও আসলাফের ঘটনাবলী ও জীবনীর উপর সংক্ষেপে সারগর্ভ আলোচনা পেশ করতেন। যার মধ্যে অসংখ্য কিতাবের রেফারেন্স পেশ করতেন। আমরা শুনে হতবাক হয়ে যেতাম যে, হযরতের মুতালাআ কতো গভীর! একদিন নিজেই বলে ফেললেন, আমি তোমাদের উপকারার্থে সবক পড়ানোর সাথে সাথে আকাবিরে উম্মতের সংক্ষিপ্ত হালাত পেশ করে যাচ্ছি। বাস্তব কথা, সেগুলো শুনার পর আমাদের হৃদয় জগতে বিপ্লব ঘটে যেত। যাই হোক, এভাবে জামাতে জালালাইন পর্যন্ত হযরতের নিকট কিতাব পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে তার নিকট আরো যে কিতাবগুলো অধ্যয়ন করেছি তা হলো তরজামায়ে কুরআন, কুদূরী, শরহে বেকায়া, শরহে আকয়েদে নাসাফী। আকাবিরগণের সামনে নবীন উস্তায ফজলুল হকের জন্য এগুলো কম ছিলো না। হযরতের পাঠদানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, প্রতিটি বিষয় পড়ানোর পূর্বে তার সারসংক্ষেপ সহজ সরল ভাষায় মুখস্থ পেশ করতেন। যেন শরবত তৈরী করে মুখের সামনে গ্লাস ধরতেনÑএবার পান করো। অথচ তিনি এত কর্মব্যস্ত থাকতেন, রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রায়ই ওয়াজ মাহফিলে যেতে হতো। এযুগের ন্যায় মসজিদে মসজিদে সাপ্তাহিক তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো না। বরং আমার জানামতে অল্প কিছু মসজিদেই তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো। এতদসত্ত্বেও হযরতকে প্রতি সপ্তাহে কয়েকটি মসজিদে তাফসীর করতে হতো। এহেন ব্যস্ততার মধ্যে সে যুগে জামেয়া কুরআনিয়ার ন্যায় একটি প্রতিষ্ঠানে কিতাব পড়ানো সুকঠিন ছিলো বটে। কিন্তু নবীন উস্তায ফজলুল হকের পক্ষে সফলভাবে সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। অবশ্য হযরত সদর সাহেব হুজুর ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর রূহানী তাওয়াজ্জুহই যে এক্ষেত্রে দারুণভাবে কাজ করেছে, এতে আর সন্দেহ কী। এত ব্যস্ততার মধ্যেও সবক পড়াতেন ধীরে সুস্থে। স্থির চিত্তে বুঝিয়ে দিতেন। তরজমায়ে কুরআনের প্রারম্ভে মাযামীনে কুরআন তথা কুরআনের তাফসীর সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী লিখিয়ে দিয়েছিলেন, যা ছোটখাটো একটি গ্রন্থের আকার ধারণ করেছিলো।
ছাত্রদের নিজ সন্তানের ন্যায় আদর করতেন। পড়–য়া ছাত্রদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। ছাত্রদের কোন সমস্যা দেখলে দূর করার চেষ্টা করতেন। সাধ্যানুযায়ী আর্থিক সাহায্য করতেন। এ আদর্শ বস্তুত হযরত সদর সাহেব (রহ.) থেকে লাভ করেছিলেন। এমনকি একবার আফসোস করে বলেও ফেলেছিলেনÑ
‘জেহেন তো বনা হোয়া হায় লে কিন মা হাওল নেহী হায়’…
অর্থাৎ হযরত সদর সাহেব (রহ.) এর সাহচর্যের বরকতে আমার মধ্যে ছাত্রসেবা ও জনসেবার মানসিকতা তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু পরিবেশ নেই।
আমাকে এত আদর স্নেহ করতেন, মনে হতো সমস্ত ছাত্রদের মধ্যে আমাকেই বেশি ভালোবাসছেন। একবার হযরতের খেদমতে দরখাস্ত করলাম, তার ডায়েরিটা দেয়ার জন্য। হযরত খুশি হয়ে তা আমার হাতে দিলেন। তাতে খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে শুরু করে হিজরী ১২শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত মুসলিম রাজা বাদশাহর দেশ বিজয়ের ধারাবাহিক তালিকা রেফারেন্সসহ উল্লেখ ছিল। এবং আকাবিরে উম্মতের শিক্ষামূলক কিছু ঘটনা উল্লেখ ছিল যা বিভিন্ন কিতাব থেকে হযরত নোট করেছিলেন। আমি সবকিছু নকল করে হযরতের হাতে ফিরিয়ে দিলাম। পাঠজীবনের এই স্মৃতিগুলো মনের আকাশে বার বার উদিত হচ্ছে। স্মৃতিগুলো মনে হলে হৃদয় ভেঙ্গে পড়ে। দোয়া করি রাব্বুল আলামীন যেন হযরতকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম নসীব করেন।’
শিক্ষকতার মূলনীতি
মরহুম মুফতি আমিনীর বিশেষ ছাত্র, শ্রীপুর মফিযিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি শামীম আহমাদ বলেন- ‘ আমি ’৮৪-’৮৫ সনের দিকে লালবাগ মাদ্রাসায় ভর্তি হই। আমার বয়স তখন আনুমানিক ১২ বা ১৩ বছর হবে। গ্রামে ক্লাস থ্রি শেষ করে আমি লালবাগে চলে আসি। ১২-১৩ বছর বয়স মোটামুটি বোঝার মতোই বয়স। তখন আমি আমিনী সাহেবকে কিতাবখানায় ক্লাস নিতে দেখতাম। কী কিতাব পড়াতেন তা হয়তো বলতে পারবো না। তবে আমি এতোটুক বলতে পারি, আমি যখন হেফজ শেষ করি তখন মুফতি আমিনী সাহেব বুখারী শরীফ পড়াতে শুরু করেন।
হুজুরের কাছে আমি বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ পড়েছি। নিচের কোনো ক্লাসে তাকে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। এবং এ দুটি ক্লাসের স্মৃতি সামনে রেখে বলবো যে, আসলে তার মতো আদর্শ শিক্ষক তো হয় না। সবকিছু তিনি বুঝিয়ে বলতেন। বিশেষকরে একটা কথা বেশি বলতেনÑ যে ছাত্র শিক্ষকদের কাছে পড়া আয়ত্ত করতে না পারে, তাকে ক্লাস থেকে বের করে দাও। কারণ, সে কেনো পড়া বুঝলো না এবং কোনো প্রশ্নও করলো না। তিনি এটাই বলতেন। শিক্ষার নিয়ম এমনই। কোন ছাত্রের যদি কোনো পড়া বুঝে না আসে, তা হলে তার উচিত প্রশ্ন করা। আর হুজুরের একটা অভ্যাস ছিলো, ছাত্রদের যদি কোন পড়া বুঝে না আসতো সেটা তিনি বারবার বুঝিয়ে বলতেন এবং এতে হুজুর কখনো কোনো প্রকার রাগ করতেন না। আবার হুজুর এটাও বলতেন যে, এটা কোন পীরের দরবার না। এখানে প্রশ্ন করতেই হবে। আর পীরের দরবারে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। সেখানে শুধু শুনতে হবে। কাজেই, পড়া বুঝে না আসলে হুজুর প্রশ্ন করলে অনেক খুশি হতেন।
রাজনীতি বা বয়ানের শত ব্যস্ততা সত্তেও কখনো তিনি মুতালাআ ছাড়া ক্লাসে এসেছেন, এমনটি হয়নি। সবসময় তিনি মুতালাআ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এমনও হয়েছে, রাতে এশার নামাজ পড়ে খানা খেয়ে মুতালাআয় বসেছেন, মুতালাআ করতে করতে ফজরের আজান দিয়ে দিতো কিন্তু তিনি টের পেতেন না। আর লালবাগের কুতুবখানার অধিকাংশ কিতাবগুলোর পৃষ্ঠায় পানের দাগ দেখা যেতো। যা দেখে বুঝা যেতো যে, হুজুরের সবধরনের কিতাব মুতালাআ করা।
এমনিতে খুব দাপুটে আর গম্ভীর হলেও হুজুর ক্লাসে একদম ফ্রি ছিলেন। ক্লাসে তার রাগ কিংবা জালালী তবিয়ত এগুলো কখনো প্রকাশ পেতো না। অনেক সময় ক্লাসে ছাত্ররা বিভিন্ন প্রশ্ন করতো হুজুর উত্তর দিতেন। আমার মনে পড়ে একবার এক ছাত্র ক্লাসে বললো, হুজুর আমাদের কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে শুনান। হুজুরও সাথে সাথে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলেন। তিনি কোন ধরনের রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করেননি।
রাজনীতিক বা শিক্ষক পরিচয়ের বাইরে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি বলবো, তিনি ছিলেন অসাধারণ। নিজ পরিবারের সাথে তিনি কম সময় দিতেন। বাহির থেকে মেহমান আসলে বা কোন ছাত্র আসলে যেকোনো মুহূর্তে তিনি সময় দিতেন। যদি ব্যস্ততা থাকতো বা সফর থাকতো তা হলে রাতে, অনেক সময় ভোরে সফর থেকে ফিরে প্রথমে তিনি ক্লাস করে নিতেন এবং পরে বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ আরাম করে আবার চলে আসতেন মাদ্রাসায়। মোটকথা, মাদ্রাসা এবং ছাত্র শিক্ষকদেরকে বেশি বেশি সময় দিতেন। ক্লাসের বাইরেও তিনি ছাত্রদের সবসময় খোঁজখবর নিতেন। কখনো দেখা যেতো, তিনি হঠাৎ মাগরিবের পরে সব রুমে রুমে যেতেন। এবং সবার খোঁজ নিতেন। পড়ালেখা, হুজুরদের নেগরানি ইত্যাদি সব খবরাখবর নিতেন সুযোগ পেলেই। এবং এটাও বলতেন যে, কোনো সমস্যা থাকলে সরাসরি আমাকে জানাবে।
আমার কাছে এটাই সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, তিনি এতো ব্যস্ত থাকার পরেও কোনোদিন সুন্নতের খেলাফ কিছু করেননি। বরং সুন্নত পালনে ব্যাকুল ছিলেন সবসময়। এর চেয়ে বড়ো কারামাত আর কি হতে পারে? আরো যে সকল বিষয় লক্ষণীয় তা হলো, তিনি সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকার পরেও রাতে ইবাদতে ও কান্নাকাটির মধ্যে ব্যস্ত থাকতেন। এবং এ কথাও বলতেন যে, আন্দোলন করো আর যাই করো, দোয়া এবং দাওয়া দুইটাই সমানরকম প্রয়োজন।
বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকরা ছাত্রদের বাহিরের পরিবেশ থেকে দূরে রাখেন। বিশেষ করে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই ইত্যাদি পড়তে নিষেধ করেন। কিন্তু মুফতি আমিনী যেহেতু নিজেই রাজনীতি করতেন বা দল পরিচালনা করতেন তাই প্রশ্ন হয়, ছাত্রদের আমালিয়্যতের দিকটার জন্য তার বিশেষ নির্দেশ কী ছিলো?… এক্ষেত্রে আমি যা দেখেছি যে, তিনি ছাত্রদের বেলায় বাধ্যবাধকতাটা বেশি করতেন না। তবে নামাজ, তাহাজ্জুদ, কোরআন তিলাওয়াত এদিকটা বেশি খেয়াল রাখতেন। এবং তিনি সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বলতেন যে, পুকুরে মাছ থাকবে কিন্তু কেও বুঝবে না কি পরিমাণ মাছ আছে পুকুরে। তার নিদের্শ ছিলো এমন যে, যখন ছাত্রদের রাজনীতির মাঠে প্রয়োজন হবে তখন তারা একসাথে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আবার আন্দোলন শেষ হওয়ামাত্র ক্লাসে বসে পড়বে। তিনি এমন বুঝাতেন যে, তুমি রাজনীতি করবে ঠিক কিন্তু এমনভাবে করবে যেনো তোমার পড়ায় কোনো ক্ষতি না হয়।
মনে পড়ে, আমার হিফজ যখন শেষ হয়ে আসে তখন একদিন আমি নাস্তা খেতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় হুজুর আমাকে দেখে ডাক দিলেন এবং বললেনÑএদিকে আসো, আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসো। এসময় হুজুর আমার হাতে ১০০ টাকা দিলেন। আমি নাস্তা আনার পরে বাকি টাকা হুজুরকে ফিরত দিলে হুজুর আমাকে বললেন এটা দিয়ে তুমিসহ তোমরা সকল ছাত্ররা নাস্তা খেয়ে নাও। সেসময় ১০০ টাকা অনেক টাকা। এভাবেই আমার সাথে তার সম্পর্ক হয়। তখন থেকেই আমাকে ডাক দিতেন। পরে কিতাবখানায় এসে সম্পর্ক আরো বেড়ে যায়।
সরাসরি খেদমতের সুযোগটা আমি মিজানের বছর থেকে পেয়েছি। সফরের ক্ষেত্রে। সফরের ধারাটা মূলত মিজান থেকেই শুরু হয়েছে। হেদায়াতুন্নাহু ও কাফিয়ায় একটু বেড়ে যায় এর পরে দাওরা এবং ইফতার বছর আমি হুজুরের সাথে সফরে গিয়েছি সবচেয়ে বেশি। সফররের সময় হুজুর গাজীপুরে আমাদের বাসায় প্রায় ৬Ñ৭ বার এসেছেন। আমার মাদ্রাসার প্রথম কাজ তিনি শুরু করেন। বর্তমানে মাদ্রাসা দুই তলা হয়ে গেছে।
হুজুর সফরে যাবার পথে গাড়িতে কিতাব মুতালাআয় করতেন। সব ধরনের কিতাবই সাথে থাকতো। প্রয়োজনীয় কিতাবের পাশাপাশি নতুন কোনো কিতাব পেলে তিনি তা মুতালাআ করতেন। অনেক সময় হুজুর টানা ১০/১৫ দিনের সফরে যেতেন। আমরা যারা সাথে থাকতাম তারা আসলেই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তিনি মোটেও ক্লান্ত হতেন না। আমার মনে হয়, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা বিশেষ নেয়ামত। এসময়ের একটা ঘটনা বলি, একবার হাফেজ্জী হুজুর রাত ১২টার পরে তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়ালেন। তখন আমিনী সাহেবও তার পেছনে নামাজে দাঁড়ালেন। নামাজে দেখা গেলো হাফেজ্জি হুজুর ১.২.৩.৪ পারা পড়তে পড়তে ৫ পারাও শুরু করে দিলেন। আমিনী সাহেবও তার পিছনে নামাজ পড়েছেন। আমরা হলে তো নামাজ রেখে চলে আসতাম। তাই মনে হয়, আমিনী সাহেবের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো রহমত ছিলো।
একজন আলেমের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বিরল ঘটনা। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায়ও তার মাঝে কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখিনি। নামাজ, কিতাব মুতালাআ, ক্লাস এগুলোতে তার যে রুটিন ছিলো, তখনও ধারাবাহিকভাবে সেগুলো অব্যাহত রেখেছেন।’
এমন নিবেদন আজকাল কোথাও আর দেখা যায় না
হযরতের আরেকজন ছাত্র মুফতি সুহাইল আহমাদ লেখেন- ‘আমরা নিয়ত আশ্চর্য হতাম, ইসলাম ও জাতির চিন্তা মাথায় নিয়ে দল, জোট এবং আলেমদের কল্যাণে প্রায় প্রতিদিন বড় থেকে বড় প্রোগ্রাম করেও প্রাত্যহিক তাদরীসের খেদমতে কতো নিবিড় এবং নিবিষ্ট মনে হাজির হয়ে যেতেন! যেন এই তাদরীসের কাজ ছাড়া তিনি আর কিছু করেন না, একদম বোঝেন না। এটাই মুফতি আমিনীর (রহ.) বিশেষ সার্থকতা যে, তাদরীসের খেদমত অন্য কারো থেকে কম না করেও দেশ, মানবতা এবং ইসলামের স্বার্থরক্ষার সৎগ্রামে নেতেৃত্ব দিয়েছেন অত্যন্ত সক্ষমভাবে।
মুফতি আমিনী নিজে যেমন শিক্ষাজীবনে শিক্ষকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে গড়ে উঠেছিলেন, বিশেষত আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)- এই জগতদ্বিখ্যাত মনীষীদ্বয়ের সমীপে নিজের সত্তাকে সমর্পণ করে দিয়ে নিজে একজন আদর্শ মানবে পরিণত হয়েছিলেন; তেমনি শিক্ষকতা জীবনে মনস্তাত্বিকভাবে প্রতিটি ছাত্রকে দীনের সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছিলেন একজন প্রকৃতই ‘আদর্শ শিক্ষক’। তিনি যে একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো তাঁর রচিত উর্দূ গ্রন্থ ‘তরীকে মুতালাআ’ এবং বাংলা ‘আদর্শ শিক্ষক’। এ যাবৎকালে ছাত্রদের দিকনির্দেশনা মূলক যত কিতাব পত্র, বই-পুস্তিকা রচিত হয়েছে, ‘আদর্শ ছাত্র’ সেসব গ্রন্থগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ যুগের প্রতিজন শিক্ষার্থীর হাতে হাতে বইটি থাকা অপরিহার্য বলেই আমি মনে করি। বইটিতে হাতেখড়ির বয়স থেকে নিয়ে শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এমনকি একজন আলেমের আমৃত্যু কর্মকা-ের পুরোপুরি পথনির্দেশনা দেওয়া আছে।
হুজুরের ক্লাসের প্রতিটি আলোচনায় ছাপ থাকত তার অগাধ পা-িত্য, পড়াশোনা এবং নিরলস অধ্যয়নের। ফলে যে বিষয়ের আলোচনা করতেন, সে বিষয়ের আভ্যন্তরীণ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবেই সামনে যেতেন। এ কারণে যেসব ছাত্ররা অন্যান্য ক্লাসে মনোযোগহীন, তারাও হুজুরের ক্লাসে যাবার অপেক্ষায় উম্মুখ থাকত। লালবাগ ও কাটারা মাদ্রাসায় জুনিয়র জামাতগুলোর যেসব ছাত্ররা হুজুরের দরস পায়নি, তাদের আক্ষেপ ও মনস্তাপের দহন থেকেই বোঝা যায় তার দরসের মান কত বেশি ছিল। আমরা যারা বড় কাটারা মাদ্রাসায় পড়েছি, প্রতিদিনই আমাদের দরসে বুখারীর জন্য লালবাগ যেতে হত। অবাক হতে হয়, আমাদের একজন দুর্বল সাথীও রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে লালবাগ মাদ্রাসায় আমিনী হজুরের দরসে যেতে কখনো অলসতা কিংবা অনীহাভাব দেখায় নি। আমরা সবাই সোৎসাহে এবং আনন্দচিত্তে চলে যেতাম যেন হুজুরের প্রতিটি দরসই বিশেষ আয়োজন। এক একটি জমকালো অনুষ্ঠান। সেসব সোনালি দিনগুলোর কথা কখনো ভুলতে পারব না।
হুজুর ক্লাসের খুব গুরত্ব দিতেন। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় অনেক বড় বড় প্রোগ্রাম করেও মাগরিব বাদ নিবিষ্ট মনে, যথানিয়মে দুইÑআড়াই কিংবা তিনঘন্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে দরস দিয়ে যেতেন। এ যে কেমন উঁচু মাপের সহনশীলতা, তা কি ভাবা যায়? যেন পড়ানোই তার শুধুমাত্র পেশা এবং কাজ। আর কিছুই তিনি করেন না বা পারেন না।
মুফতি আমিনী শুধু কিতাবই পড়াতেন না। বরং ছাত্রদেরকে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাঠের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনাও করতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেনÑ এরা যে কেনো বোঝে না! জোটে যাওয়ার অর্থ তো নারী নেতৃত্ব মেনে নেওয়া নয়। দফয়ে মাজাররত আওলা মিন জালবে মানফাআত অর্থাৎ বড় ক্ষতি থেকে হেফাজতে থাকার জন্য সাময়িকভাবে ছোট ক্ষতিকে স্বীকার করে নেওয়া। আমরা স্বতন্ত্রভাবে নিবার্চন করা মানে আওয়ামী দুঃশাসন আহবান করা। এটা তো বোঝার বিষয়!
হুজুরের দরস দানের পদ্ধতি অনন্য বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর রাখে। সুকঠিন একটি বিষয়কে পানির মতো করে বুঝাতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। কোনো একটা বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করলে জবাবে তিনি প্রায়ই বলতেনÑআরে বেকুব, এটা বুঝলানা!..এরপর তিনি এমন একটি সমাধানসূচক কথা বলতেন যে, প্রশ্নকারী পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে যেত। দরসে হুজুরের হাত নাড়ানো ও অন্যান্য অঙ্গভঙ্গি ছিল বড়ই চমৎকার। সেগুলো নিজে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া অনুমান করা কিংবা লিখে ব্যক্ত করা আমার পক্ষে অন্তত কিছুতেই সম্ভব নয়। আমার এবং আমাদের অন্তর দর্পণে সেসব সুুখম্মৃতি চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।’
লেখক মাওলানা মিরাজ রহমান বলেন- ‘ আমরা যারা কওমি মাদ্রাসায় পড়েছি, শিক্ষকতার মতো মহান কর্মে জড়িত রয়েছি কোনো না কোনো কওমি মাদ্রাসায়; একটি বিষয়ে সবাই আমরা একমত, দরস-তাদরিস একটি একক মনোযোগ্য বিষয়। অন্য আরো কয়েকটি কাজ যেমন একসঙ্গে করা যায়, অন্য পেশায় যুক্ত থেকে কওমি মাদ্রাসায় দরস-তাদরিস হয় না। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার ঘটে কারো কারো ক্ষেত্রেÑ আমার একটি ‘অপারগতা’ ছিলো; আমি ভাবতামÑ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে আমিনী হুজুর কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব দরস প্রদান করেন। ২০০৯-২০১০ সালে লালবাগ মাদ্রাসায় ‘তাকমীল’ জামাতে ভর্তি হয়ে আমার সে ‘অপরাগতা’ দূরিভূত হলো। আমি দেখলাম, একজন আলেম সরকারী এমপি হয়ে, একজন আলেম সারাদিন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করার পরও সারারাত কিভাবে রোখারী শরীফের দরস প্রদান করেন। আমি অবাক হলাম, একজন আলেম সারাদিন সফর করার পর, হাজার হাজার মানুষকে সাক্ষাৎ-সহযোগিতামূলক উপদেশ প্রদান করার পরও শেষ রাতে তাহাজ্জুদে তার রোনাজারি অবলোকন করে। আমর সৌভাগ্য, আমার চৌদ্দ পুরুষের সৌভাগ্য এবং সৌভাগ্য আমার উত্তরসূরিদেরÑহযরত আমিনী হুজুরের ছাত্রত্ব নসিব হয়েছে আমার।
মাদ্রাসা পরিচালনায় তার ত্যাগ
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) মাদ্রাসা পরিচালনা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বড়কাটারার সিনিয়র উস্তায মাওলানা শহিদুল আনোয়ার বলেন- ‘মহান আল্লাহর হাজারও শুকরিয়া, আমাদের খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেই মহান কাফেলার একজন মহান উত্তরসূরি, আকাবীরের প্রতিচ্ছবী শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ও হযরত হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) কলিজার টুকরা ও আকাবীরে দেওবন্দের প্রধানতম নিদর্শন শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে। তিনি একাই আকাবিরগণের অনেক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। দরস-তাদরীস, ওয়াজ-নসীহত, লেখা-লেখি ও বিপ্লব-সংগ্রাম সবই আমরা তার মাঝে দেখতে পাই পূর্ণমাত্রায়। যেন তিনি অনেক সমুদ্রের এক মোহনা। একদিকে দেখা যায় তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক ও আদর্শ প্রিন্সিপাল। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর বুখারী শরীফের দরস প্রদানের বর্ণীল অতীত ফেলে এসেছেন, তবু থেমে থাকেনি তাঁর ইসলামী আন্দোলনের মিশন। এ দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে যখনই কেউ কোন মন্তব্য করেছে, তখনি লালবাগ জামেয়ার সেই কামরা থেকে প্রতিবাদের এমন ঝংকার বেজে উঠেছে যে, এক হুংকারেই নাস্তিক্যবাদ, বাম ও রামপন্থীদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি ছিলেন একজন সৎ, নিঃস্বার্থ, নিষ্ঠাবান, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সফল পরিচালক। তিনি একাধারে দীর্ঘকাল লালবাগ ও বড় কাটারা মাদ্রাসাসহ দেশের আরও বিভিন্ন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও সদর ছিলেন। তার দায়িত্বকালীন সময়ে বাংলাদেশের বৃহৎ এ দুটি প্রতিষ্ঠানে আভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা কখনও দেখা দেয়নি। বরং সকল ছাত্র শিক্ষক একবাক্যে তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন।
এই অধম লেখক বড়কাটারা মাদ্রাসায় দীর্ঘ আট বছর যাবৎ শিক্ষকতায় নিয়োজিত। তার দক্ষতা ও যোগ্যতাকে পরিমাপ করার ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস আমার হয় না। কারণ, যেখানে জীবন্ত উদাহরণ উপস্থিত সেখানে বাক্য ব্যয় অনর্থক। তথাপি যেহেতু লিখতে বসেছি, তাই হযরতের ব্যাপারে দু-চারটি কথা না লিখলে আত্মা তৃপ্তি পায় না। প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি শিক্ষক, ছাত্র এমনকি স্টাফদেরও কখনও প্রতিষ্ঠানের প্রধান সুলভ ধমক দেননি। বরং অসংখ্য ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর সংশোধনের উদ্দেশ্যে যদি কখনও কিছু বলতেন, তা ছিল পিতৃস্নেহ, আদর আর ভালোবাসা মিশ্রিত। ছাত্র-শিক্ষকদের যেকোন সমস্যার শেষ আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। সব সময় তিনি ছাত্র শিক্ষকদের জন্য এই দুয়া করতেন যে ‘হে আল্লাহ এই মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক সকলকে তুমি ছাহেবে নিসবত তথা তোমার প্রিয় ওলি বানিয়ে দাও।’ কোন এক রমযান মাসে তারাবীহের নামায শেষ করার পর বড়কাটারা মাদ্রাসার দফতরে গিয়ে দেখি হুজুর তারাবীহের নামাযান্তে উপস্থিত সকলকে নিয়ে এই দোয়া করছেন যে ‘হে আল্লাহ এই মাদ্রাসার সকল শিক্ষককে তুমি হালাল পন্থায় সম্পদশালী করে দাও। এবং প্রত্যেকের জন্য ঢাকা শহরে নিজস্ব বাড়ির ব্যবস্থা করে দাও, যাতে তারা কারো মুখাপেক্ষি না হয়ে পারিবারিক চিন্তামুক্ত হয়ে মাদ্রাসার জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে পারে এবং এ জামেয়ার ছাত্রদেরকে তুমি আনোয়ার শাহ্ কাশ্মিরীর (রহ.) ন্যায় বিজ্ঞ আলেম ও জুনায়েদ বোগদাদী রহ-এর ন্যায় আবেদ বানিয়ে দাও।’ তিনি এই ভাবে ছাত্র শিক্ষকদের জন্য কোনো সময়ে একাকী আবার কোনো সময় সম্মিলিতভাবে সকলকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতেন এবং সবসময় এই কথা বলতেন যে, দুয়ার মাঝেই সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। তার জীবনের অনেক কঠিন মুহূর্তে তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি। বরং যেকোন বিপদ এলে তৎক্ষণাৎ নামায আদায় করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে চিৎকার করে কেঁদে সাহায্য ফরিয়াদ করেছেন।
রাজনীতি ও আন্দোলন : সংগ্রামী নেতৃত্বের কথকতা
বিস্ময়কর আবির্ভাব
গত দুই যুগ ধরে মুফতি আমিনীর রাজনীতি ও ইসলামী আন্দোলন আলোচনায় থেকেছে সবসময়। তার নেতৃত্ব, নিষ্ঠা ও ত্যাগের ধরনই এমন ছিলো যে, এর কোনো বিকল্পও ছিলো না- না মিডিয়ার কাছে, না আমাদের। বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি ও আন্দোলনের ইতিহাসে তার আবির্ভাব ও অবদান নিয়ে এখন আর প্রাথমিক আলোচনার অবকাশ নেই। তবে গবেষণা ও মূল্যায়নের প্রশ্নে আমার বিবেচনায় তার রাজনীতি ও আন্দোলনের এ দু’যুগকে তিনটি ধাপে ভাগ করতে হবে। একটি এবং প্রথম ধাপ হবে ১৯৮১ থেকে ৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জীর ইন্তেকাল পর্যন্ত। এ সময়টায় তার পাওয়ারফুল কণ্ঠ ও স্বভাবসুলভ মেধা থেকে থেকেই দ্যুতি ছড়ালেও তিনি মূলত শিক্ষানবিশ ছিলেন। প্রচলিত রাজনীতির ধরন, চেনা-অচেনা অলিগলি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে ওঠা-বসার মধ্য দিয়ে শিখেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন অভিজ্ঞতার ভা-ার। আর দ্বিতীয় ধাপে ’৮৭ থেকে ’৯৭ পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন, কমিটি ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষকে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী রাজনীতির সাথে পরিচয় করাতে করাতে তিনি একজন যোগ্য ও অনন্য নেতায় পরিণত হয়েছেন। বাবরি মসজিদ অভিমুখে লংমার্চ, তসলিমাবিরোধী আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ও জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারার মতো আন্দোলনগুলো তো পুরো উপমহাদেশের ইতিহাসেই বিরল। অন্যদিকে ওলামা কমিটি, জমিয়তুল আনসার, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, ইসলামী মোর্চার মতো বিভিন্ন কমিটি ও শক্তিশালী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার অচিন্তনীয় সাংগঠনিক দক্ষতার প্রকাশ ঘটেছে এবং তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দেশসেরা সংগঠক হিসেবে।
১৯৯৭ সালে চারদলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে একজন জাতীয় নেতা হিসেবে তার পথচলা শুরু। এরপর তো কেবল এগিয়ে যাওয়ার পালা। ইসলামি ঐক্যজোট ও চারদলীয় জোট গঠন, নির্বাচন ও সংসদ সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে একরকম ভূমিকা রাখলেন। অন্যদিকে ফতোয়াবিরোধী ঐতিহাসিক আন্দোলন এবং সর্বশেষ নারীনীতি ও শিক্ষানীতির প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতা হিসেবে নিজেকে পাহাড়সম উচ্চতায় উন্নীত করলেন। পুরো জাতি অবাক হয়ে দেখলো, একা একটা মানুষ কতোটা সাহস, ঈমানী শক্তি আর কুরআনের ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখতে পারেন। কীভাবে পারেন। শুধু রাজনৈতিক বোধ থেকে এসবের বিবেচনা ও মূল্যায়ন যদিও অনুচিত, তবু এগুলো তার রাজনৈতিক অর্জন হিসেবেই বিবেচিত হবে অনন্তকাল। ইসলামী আন্দোলনের প্রসঙ্গটি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রেখেও আমরা নির্দ্বিধায় এমন মন্তব্য করতে পারি। ইসলামী রাজনীতি ও দীনি আন্দোলনের বিস্তৃত ময়দানে মুফতি আমিনীর আবির্ভাব, অবদান, ত্যাগ ও নিবেদন নিয়ে তারই ¯েœহধন্য, সময়ের আলোচিত ক’জন ইসলামী রাজনীতিক ও আলেমের মূল্যায়ন-স্মৃতিচারণ পেশ করছি আপনার করকমলে।
নতুন সূর্যোদয়
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর একান্ত শাগরেদ, লেখক মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল লেখেন- ‘ছাত্র অবস্থাতে মুজাহিদে আজম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরীর (রহ.) ঐতিহাসিক জিহাদী ভূমিকা, বিশেষত তৎকালীন সামরিক শাসক লৌহমানবখ্যাত আইয়ুব খানের ইসলামবিরোধিতার মুকাবেলায় সোচ্চার প্রতিবাদের ঘটনাগুলো খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করলেও এবং আকাবির ও আসলাফের জিহাদী ভূমিকা ও প্রেরণা অন্তরে ধারণ ও লালন করলেও সরাসরি রাজনীতির ময়দানে সরব ছিলেন না। অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা, ইলমের সুবিশাল জগতে পরিভ্রমণ করা, আদর্শ ও আখলাকি ছাত্র, মানুষ গড়ে তোলার কর্মক্ষেত্রে তখন তিনি এতই বেশি নিমগ্ন ছিলেন যে, ইচ্ছা থাকলেও অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার ফুরসতই তার ছিলো না। কিন্তু ১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) যখন তওবার রাজনীতির যুগান্তকারী আহ্বান নিয়ে বাংলাদেশের ঘুমন্ত মানুষকে জাগানোর উদ্যোগ নিলেন, তখন সেই আহ্বানের অন্যতম প্রধান সারথি হয়েই তিনি রাজনীতির ময়দানের সক্রিয় পথচলা শুরু করেন।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন গঠিত হলে তিনি মনোনীত হন সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল। এরপর থেকে বাংলাদেশে ইসলামের পক্ষে আন্দোলনের যতো স্রোতধারাই সৃষ্টি হয়েছে, প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা এবং গতি প্রকৃতির তারতম্য থাকলেও প্রতিটি রাজনীতি ও আন্দোলনের সিংহভাগ জুড়েই ছিলেন মুফতি আমিনী (রহ.)। তিনি রাজনীতির দ্বারা পরিচালিত হতেন না বরং তাকে ঘিরে রাজনীতি আবর্তিত হতো। অনেক সময় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ের প্রধান কারিগর ছিলেন তিনি। হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) ইন্তেকালের পর বাংলাদেশে ইসলামী আইন ও আদর্শের ইস্যুতে প্রতিটি আন্দোলনে তার সরব পদচারণা ছিলো অনস্বীকার্য। তিন দশকের অধিক সময়ের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তিনি এমন এক অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল যে, বাংলাদেশের আপামর ইসলামপ্রিয় জনতার অবিসংবাদিত নেতা, মুসলমানদের কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচিত হতেন। তাগুতের যেকোনো অপতৎপরতায়, ইসলাম ও মুসলমানদের যেকোনো দুর্দিনে মানুষ তাকিয়ে থাকতো ঈমানের তাকতে বলিয়ান এই সিংহ শার্দূল কী বলেন, সেই দিকে। তার একেকটি কথায় উজ্জীবিত হয়ে উঠতো গোটা মুসলিমসমাজ। তার নির্দেশনা ও দেখানো পথে নির্দ্বিধায় জীবন বিলিয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়তো লক্ষ হাজার জানবায মুসলিম। তার বজ্র হুংকারে কেঁপে উঠতো বাতিলের রাজপ্রাসাদ, জালিম ও অত্যাচারী শাসকের প্রাণাত্মা।
১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর ইবলিসের প্রেতাত্মা ব্রাহ্মণ্যবাদীরা হিংস্র হায়েনার থাবায় যখন ভারতের অযোধ্যায় মুসলমানদের সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী, মুসলমানদের শৌর্যবীর্যের প্রতীক বাবরি মসজিদকে গুড়িয়ে দিলো, সভ্যতার সকল সীমারেখাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে তারা যখন পৈশাচিক নাচন আরম্ভ করলো, তখন একজন মর্দ্দে মুমিন হিসাবে তাদের সেই অসভ্য নর্তন কুর্দনকে সহ্য করা মুফতি আমিনীর পক্ষে সম্ভব হলো না। উস্তায শায়খুল হাদীসকে সামনে রেখে আল্লাহর মুহাব্বতে ঐশ্বর্যবান লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৩ সালের ২ জানুয়ারী ঢাকা থেকে অযোধ্যা অভিমুখী ঐতিহাসিক লংমার্চ করে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
একইভাবে ১৯৯৪ সালে ইসলামবিরোধী অপশক্তির শিখ-ি কুখ্যাত কুলাঙ্গার তসলিমা নাসরিন যখন মুসলমানদের আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র সংবিধান পবিত্র কুরআন পরিবর্তনের আওয়াজ তোলার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করলো, ইসলামের অবমাননা করলো, নবী-রাসুলদের নিয়ে কটূক্তি করলো, তখনও মুফতি আমিনীর (রহ.) হুঙ্কার ও আন্দোলনের তীব্রতার তোড়ে এমনভাবে ভেসে গেলো যে, আর মাথা তোলার দুঃসাহস পায়নি। জনরোষ থেকে বাঁচতে সেই যে দেশান্তর হলো আজও নাকি দেশে ফেরার আকুতি তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। কিন্তু দেশে ফেরার সাহস বা পথ খুঁজে পায় না। ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদী সরকার এবং তাদের তাঁবেদার বাংলাদেশের ইসলামবিদ্বেষী বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও কেনো তার পক্ষে কথা বলে না, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে সাহস পায় নাÑ এই আক্ষেপ আহাজারীও তার কণ্ঠে শোনা যায়। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সকল দল ও মতের সমন্বয়ে তখন গঠিত হয় ‘ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা’। পরে ইসলামী মোর্চা, ক্রমান্বয়ে তা এখন ‘খেলাফতে ইসলামী’। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সভাপতি ও আমীরের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। পরবর্তীতে দেশ ও ইসলামের প্রয়োজনে আওয়ামী দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গড়ে ওঠা ৪ দলীয় ঐক্যজোটের তিনি অন্যতম রূপকার ও শীর্ষনেতা ছিলেন। শুরুতে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব এবং ২০০১ সালের পর থেকে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার নেতৃত্বগুণ ও সূক্ষ্ম পরিচালনায় খুব অল্পসময়ের ব্যবধানে এই সংগঠনটি ইসলামী রাজনীতির ময়দানে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়।
২০০১ সালের ১ জানুয়ারী হাইকোর্ট থেকে ‘সবধরনের ফতোয়া অবৈধ ও দ-নীয় অপরাধ’ সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহবিরোধী রায় ঘোষিত হলে সর্বপ্রথম তিনিই গর্জে ওঠেন। রায় প্রদানকারী দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানাকে মুরতাদ ঘোষণা করে পাল্টা ফতোয়া প্রদান করেন। সারাদেশে আন্দোলনের ডাক দেন। ২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশে গণবিস্ফোরণ ঘটে। গঠিত হয় ‘ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি’। সর্বসম্মতিক্রমে তিনি নির্বাচিত হন এই সংগঠনের আমীর। আর এই পদে তিনি আমৃত্যু অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তৎকালীন আওয়ামী সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ৩ ফেব্রুয়ারি এনজিও নেতা-নেত্রীরা ঢাকায় পাল্টা সমাবেশ আহ্বান করলে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে তিনি একইদিন ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেন। হরতালের সময় মোহাম্মদপুরে পরিকল্পিত পুলিশ হত্যাকা- ঘটিয়ে তার দায় ভার চাপানো হয় ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির নেতৃবৃন্দের ওপর। অশীতিপর বৃদ্ধ শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)-কেও হত্যা মামলার আসামী করা হয়। রংপুর সমাবেশ করে ফেরার পথে ৪ ফেব্রুয়ারি শায়খুল হাদীসকে এবং ঢাকা থেকে মুফতি আমিনী (রহ.)-সহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। প্রতিবাদে সারাদেশ ফুঁসে ওঠে। মুফতি আমিনীর জন্মস্থান বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৬ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডাকা হয়। সারা বাংলাদেশের মুরব্বী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর আল্লামা সিরাজুল ইসলাম মুফাসসির সাহেবের সক্রিয় সম্পৃক্ততায় তাতে অন্যরকম গতি সঞ্চার হয়। হরতাল পালনে ইসলামপ্রিয় জনতা রাজপথে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেয়। আওয়ামী সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে পুলিশ ও বিডিআর হিংস্র হায়েনার মতো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাখির মতো গুলি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬জন হাফেজ-আলেমের প্রাণ কেড়ে নেয়। এই ঘটনা আওয়ামী সরকারের পতনকে তরান্বিত করে। দীর্ঘ চার মাস কারা ভোগের পর তিনি আবার রাজনীতির ময়দানে ফিরে আসেন। ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় নির্বাচনে তিনি ইসলামী ঐক্যজোট মনোনীত এবং চারদলীয় ঐক্যজোট সমর্থিত প্রার্থী হিসাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও সদরের আংশিক) সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদসদস্য মনোনীত হন। তার দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ পরিলক্ষিত হয়।
পরবর্তীতে ২০০৭ সালে সামরিক গোষ্ঠী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমলে জাতীয় নারী উন্নয়ননীতিতে কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বেশ কিছু ধারা সংযুক্ত হলে সামরিক শক্তির বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে আবার রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলেন। জাতীয় মসজিদের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত খতিব মুফতি নূরুদ্দীনের নেতৃত্বে নারী উন্নয়ননীতি পর্যালোচনা ও সুপারিশ কমিটি গঠন করতে সরকার বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত সরকার কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা-উপধারাগুলো বাদ দিয়ে নারীনীতি প্রণয়ন করে।
আবার যখন আওয়ামীলীগ ক্ষমতার মসনদে সমাসীন হয় তখন একসঙ্গে অসংখ্য ইসলামবিরোধী জাতীয় ইস্যু তৈরি করে। ড. কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশনের আদলে প্রথমবারের মতো ইসলামবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করার পাশাপাশি নারী উন্নয়ননীতির ইসলাম, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ধারা-উপধারাগুলো আবার সংযুক্ত করে পাশ করা হয়।
অন্যদিকে ফতোয়াবিরোধী রায়টিকে নিয়ে হাইকোর্ট আবার নতুন করে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে। প্রধানত এই তিনটি ইস্যু নিয়ে ২০১১ সালে মুফতি আমিনী (রহ.) আবার ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সারাদেশে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ৪ এপ্রিল দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হারতাল আহ্বান করেন। উল্কার মতো শহর থেকে শহরে মঞ্চ থেকে মঞ্চে ছুটে বেড়ালেন। ইসলামপ্রিয় জনতার মধ্যে আবার প্রাণ সঞ্চারিত হলো। জ্বালাও পোড়াও, ভাংচুর অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতা ছাড়াই ৪ এপ্রিলের হরতাল এমন নজিরবিহীন স্বতঃস্ফূর্ত সর্বাত্মকভাবে পালিত হলো, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সফল হরতালের মডেল হয়ে আছে। এরপরই আসলো তার ওপর বিরাট এক ঈমানী পরীক্ষা। হরতালের ব্যাপক সাফল্য এবং মুফতি আমিনীর জনপ্রিয়তা সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিলো। তিনি সারাদেশে আবার সভা-সমাবেশ ও সফরের কর্মসূচি দিলেন।
৬ এপ্রিল যশোরের মহাসমাবেশে নজিরবিহীন লোকসমাগম সরকারের মাথা খারাপ করে দিলো। সকল বিভাগীয় ও বৃহত্তর জেলা শহরগুলোতে সমাবেশের দিন ১৪৪ ধারা জারি করেই ক্ষান্ত হলো না, মুফতি আমিনীকে আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করার জন্য ১২ এপ্রিল ছোট ছেলে হাফেজ মাওলানা আবুল হাসানাতকে সরকারি গোয়েন্দা বাহিনীর লোক দিয়ে গুম করা হলো। মুফতি আমিনী মুখোমুখি হলেন স্নায়ু বিধ্বংসী এমন এক কঠিন পরীক্ষার, যা শুধু তাকিয়ে অবলোকন করা যায়। হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একদিকে কুরআনের ইজ্জত, তাঁর সারাজীবনের লালিত আদর্শিক চেতনা, অন্যদিকে প্রিয় সন্তানের সংকটাপন্ন জীবন। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি পল কাটে সীমাহীন যাতনা, অব্যক্ত যন্ত্রণা, মনের সঙ্গে মনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে সঙ্গী করে। বারবার সেজদায় লুটিয়ে কাঁদেন শুধু আল্লাহর দরবারে। সাহায্য চান শুধুই তার কাছে। গুমরে ওঠা ব্যথা বেদনাকে মনের প্রকোষ্ঠে অবদমিত করে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দোলাচলকে হৃদয়ের গভীরে চেপে রেখে সকলের সামনে অবিচল কণ্ঠে এই দীপ্ত ঘোষণা শুধু তিনিই দিতে পারেন, আমার এক সন্তান শুধু নয়, আমাকে ও আমার গোটা পরিবারকেও যদি নিঃশেষ করে দেয়া হয়, তা হলেও কুরআনের ইজ্জতের প্রশ্নে আমি কারো সঙ্গে আপস করবো না। পরিণতি যা হয় হবে, সবকিছু জেনে বুঝেই আমি আল্লাহর রাস্তায় জেহাদে নেমেছি। এই পথে পরাজয়ের কোন শঙ্কা আমার নেই।
২০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে ওলামা সমাবেশে বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা একজন পিতা হয়ে চিৎকার করে আল্লাহর দরবারে আহাজারী করলেন, হে আল্লাহ, শেখ হাসিনা আমার ছেলেকে গুম করেছে, তুমি তার ছেলেকে গুম করে দাও। এর ঠিক ৩দিন পর সন্ত্রস্ত হাসিনার কর্মচারীরা গভীর রাতের নির্জনতায় সুনসান রাজপথে মুফতি আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাতকে রেখে গেলো। কিন্তু সরকার তারপর থেকেই তাকে গৃহবন্দির অক্টোপাশে বন্দি করে। এরপর থেকে আমৃত্যু তাকে এই বন্দি দশাতেই কাটাতে হয়েছে।
এই দীর্ঘ একুশ মাস তিনি বন্দি অবস্থা থেকেই দেশের মানুষকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে রাত-দিন কান্নাকাটি এবাদত বন্দেগীতে বেশি সময় কাটালেও সারাদেশ থেকে আগত আলেম-ওলামা নেতাকর্মী ও সাধারণ লোকদের সঙ্গে সাক্ষাত, কথাবার্তা ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার পাশাপাশি বুখারী শরীফের দরস, ইসলাহী মজলিস, দলীয় সভা ও প্রয়োজনে সাংবাদিকদের ডেকে মিডিয়ার মাধ্যমে জাতির সামনে তার বক্তব্য তুলে ধরতেন নিয়মিত। গৃহবন্দিত্ব তার কর্মব্যস্ততাকে কমিয়ে দিতে পারেনি।
আলোয় ভুবন ভরা
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) জামাতা, তরুণ রাজনীতিক ও বক্তা মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন বলেন- ‘ইসলামী আইন ও আদর্শের বিভিন্ন ইস্যুতে আপোষহীন সংগ্রামী এই সাধকের রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা শুরু হয় হাফেজ্জী হুজুরের হাত ধরে। ১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন গঠিত হলে তিনি মনোনীত হন এ সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল। এ বছর ও ’৮৬-তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর পক্ষে দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) ইন্তেকালের পর ১৯৮৭ সালে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্ব এবং মুসলমানদের ঈমান আকিদা সংরক্ষণের জন্য মুফতি আমিনী ১৯৯১ সালে দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে গঠন করেন ওলামা কমিটি নামে একটি ইসলামী সংগঠন। তিনি এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমীর নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ লংমার্চসহ ১৯৯৪ সালে নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। মৃত্যুকালে তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর, ওলামা কমিটি বাংলাদেশের উপদেষ্টা ও খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর এবং আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চারদলীয় জোট পরবর্তীতে আঠারোদলীয় জোটের অন্যতম প্রধান রূপকার ও শীর্ষ নেতা ছিলেন।
জাতীয় নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দর্শন
বড়কাটারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মাওলানা সাইফুল ইসলাম সাহেব লেখেন- ‘১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি জাতীয় রাজনীতির অন্যতম কর্ণধার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ২০০১ সালে হাইকোর্ট থেকে ‘সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ’ সংক্রান্ত কোরআন-হাদীস বিরোধী রায় ঘোষিত হবার পর তিনিই প্রথম গর্জে উঠেছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রায় প্রদানকারী দুই বিচারপতিকে কুরআন-হাদীসের আলোকে মুরতাদ হওয়ার ফতোয়া ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর এই ঘোষণায় দেশব্যাপী আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তিনি তৎকালীন সরকারের কোপানলে পড়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দীর্ঘ চার মাস তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ২০০১ সনে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি চারদলীয় ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বি-বাড়ীয়া-২ (সরাইল ও সদরের আংশিক) নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১১ সালে সরকার সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা-বিশ্বাস বাদ দিয়ে কুফরী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ স্থাপন, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদন ও ইসলামবিরোধী সেক্যুলার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলে এর প্রতিবাদে তিনি দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। তখনকার প্রতাপশালী সরকার প্রথমবারের মতো কোনো বিরোধী আন্দোলনের মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছিল। হামলা-মামলা, ভয়-ভীতি, লোভনীয় অফার মুজাহিদে মিল্লাতকে আন্দোলন থেকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। একই বছর ৪ এপ্রিল তার ডাকে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা নজীরবিহীন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। এভাবে তিনি আবারো ইসলামবিদ্বেষী আওয়ামী সরকারের চরম রোষানলে পড়েন। এই হরতাল ঘোষণা তখনকার পরিস্থিতিতে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই তিনি হরতাল ঘোষণার পর থেকে হরতাল পালন পর্যন্ত একটানা ৩২ দিন নফল রোজা রেখে দেশব্যাপী ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে আন্দোলনের ভিতকে মজবুত করে তোলেন। তাকে ইসলামী আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে তার ছোট সাহেবজাদা আবুল হাসানাত আমিনীকে গুম করা হয়। সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনসহ নারীনীতি, শিক্ষানীতির আন্দোলন থেকে বিরত না থাকলে সরকারী প্রশ্রয়ে বিভিন্ন মহল হতে তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়।
ছেলে গুম থাকা অবস্থায় তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, আমার এক হাতে কুরআন আরেক হাতে পরিবার, আমার পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেলেও কুরআনের পক্ষে কথা বলেই যাবো। কুরআনের জন্য পুরো পরিবারকে কুরবানী দিতে রাজি। কুরআনের পক্ষে বক্তব্য রাখায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। এই মর্দ্দে মুজাহিদ সেদিন হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, কুরআনের জন্য আমি ফাঁসির মঞ্চে যেতেও প্রস্তুত।
দেশব্যাপী তার প্রতি তৌহিদী জনতার ব্যাপক ও প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকায় তাকে সরাসরি কারারুদ্ধ করতে না পেরে সরকার নতুন ফন্দি আঁটে। নিরাপত্তার নামে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। প্রায় দীর্ঘ ২১ মাস মৃত্যু অবধি তিনি গৃহবন্দী ছিলেন।
হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর এদেশের ইসলামী রাজনীতির শূন্য ময়দানে সকল আলেম-ওলামাকে নিয়ে দীনি ইস্যুতে অনেক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্বদান করেন মুজাহিদে মিল্লাত (রহ.)। তার জীবনের শেষ দুই যুগ এদেশে ইসলাম ও দেশবিরোধী সকল ছোট-বড় অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদে সকল অপশক্তি ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। তিনি মুসলমান জনতা ও ওলামা সমাজের বিশ্বস্ত নেতা ও মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। বিশেষত এদেশে ওলামায়ে দেওবন্দের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে তার অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি হয়ে উঠেন দেশের সকল অঞ্চলের গ্রহণযোগ্য নেতৃস্থানীয় ওলামা মাশায়েখের প্রাণের স্পন্দন। প্রধানত তার আমলের ইখলাস, আপোষহীন অবস্থান ও ইলম-হিকমতপূর্ণ বয়ান-বিবৃতি ও যথাযথ কর্মসূচি, আন্দোলনের ময়দানে তার পরীক্ষিত আমানতদারী, অনমনীয়তা ছাত্রদের মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ৭০, ৮০ ও ৯০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এদেশে একটি বাতিল ফেরকার ছাত্র সংগঠন স্ব-নামে বে-নামে কওমি মাদ্রাসায় বিপজ্জনক সাংগঠনিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। যা প্রতিরোধ করা আলেম সমাজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনী (রহ.)-এর রাজনীতিতে ধারাবাহিক সরব উপস্থিতিতে সেসব বিপদজনক সংগঠন কওমি মাদ্রাসা থেকে লেজ গুটাতে বাধ্য হয়। কারণ, তখনকার সেসব সংগঠনের প্রতি ছাত্রদের আকর্ষণ ছিল প্রধানত তিনটি কারণেÑ ১. ইসলামী রাজনীতির প্লাটফর্ম হওয়া, ২. প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য ও কর্মসূচি থাকা, ৩. অর্থনৈতিক সাপোর্ট থাকা।
মুফতি আমিনী (রহ.)-এর রাজনীতিতে প্রথম দুই উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকায় ছাত্র সমাজ সেসব আক্বিদাভ্রষ্ট সংগঠনের প্রতি আগ্রহ হারায়। কারণ, অন্যসব সংগঠনে মূল দুটি বিষয় মুফতি আমিনীর তুলনায় কমই ছিল। তৃতীয় বিষয়টির প্রতি অধিকাংশ একনিষ্ঠ কর্মীর আগ্রহও নেই। কারণ, ছাত্রত্ব ও দীনি সংগঠনের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-আশয় অনেক সময় অনৈক্য, নৈতিক অধঃপতনের কারণ হয়ে দাড়ায়। ইসলামী জনতা, ওলামায়ে কেরাম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের মাঝে তার ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার নেপথ্যে আরো কিছু বিষয় ছিলো।
তিনি আল্লাহ তা’আলার নিকট জবাবদিহি এবং শরীয়তের হুকুম পালনের জন্য রাজনীতি করতেন। ‘আমর বিল মা’রুফ ও নাহী আনিল মুনকার’-এর ফরয দায়িত্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে ও আল্লাহর জমিনে ইসলামী হুকুমত তথা খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াত কায়েমের চেষ্টার ফরযে আইন আদায়ের জন্য রাজনীতি করতেন। প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন দীনি ওয়াজ, তাফসীর ও ইসলামী সম্মেলনের বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে ইসলামী রাজনীতির স্বার্থকতার সাথে সমকালীন বিষয়গুলো তুলে ধরতেন। বিশ্বের বিখ্যাত ইসলামী খেলাফত ও রাষ্ট্রনীতির গ্রন্থগুলো পঠিত থাকা এবং অতীত ও নিকট অতীত আকাবিরগণের বিশেষত: আকাবিরে দেওবন্দের জ্ঞান ও দর্শনের গভীর ও ব্যাপক অধ্যয়নকারী হওয়ায় সময়োপযোগী কর্মসূচি দিতে সক্ষম হতেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যস্ত থাকার পরও আদর্শ ও সফল শিক্ষক এবং মাদ্রাসার পরিচালক হিসেবে দুটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের কাছে বিশেষভাবে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। নিজে আদর্শ শিক্ষক, ইমাম-খতিব হওয়ায় নিকট হতে সমাজের পরিস্থিতি সরাসরি অবলোকনের সুযোগ পেতেন। তাই এদেশের ইসলামী জনতা ও আলেম-ওলামার চিন্তা, রুচি ও সামর্থ্য বুঝে বক্তব্য ও কর্মসূচি দিতে পারতেন। ব্যক্তি জীবনে সারা জীবন পূর্ণরাত জাগরণকারী মুতালাআ ও ইবাদাতে মগ্ন থাকায় অভ্যস্ত ছিলেন। সহীহ আকিদার কোনো সংগঠন বা সংগঠকের সমালোচনা করাকে ঘৃণা করতেন। শুনতেও বিরক্তি প্রকাশ করতেন।
সহকর্মীদের পরামর্শ প্রদানের সুযোগ দিতেন এবং তাদের কথা গুরুত্ব সহকারে শুনতেন। স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ এই রাজনীতিতে তিনি উদারতার সাথে দলমত নির্বিশেষে সবার উপকার করতেন। সুযোগ হলে উৎসাহ নিয়ে সাহায্যে এগিয়ে যেতেন। প্রতিপক্ষের বিপদে সাহায্য করার সুযোগ পেলে বেশি গুরুত্ব দিয়ে উপকারের চেষ্টা করতেন। সমকালীন সকল ওলামা-মাশায়েখ এবং তাদের অন্যান্য খেদমতের ময়দানকে (মাদ্রাসা-মসজিদ, খানকা, তাবলীগ ইত্যাদিকে) মূল্যায়ন করতেন। তাই তারাও তাঁর হিতকামনা করতেন। পারস্পরিক সমর্থন ও সহযোগিতাকে অপরিহার্য মনে করতেন।
মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনী (রহ.) এর রাজনীতির আরো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রাজনীতির ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ থেকে এ বিষয়ে আরো সুস্পষ্ট ব্যাপক ধারণা লাভ করা যাবে। যেমনÑ সিয়াসত ও খিলাফত তথা রাষ্ট্র ও রাজনীতি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিয়াসত ও খিলাফতের অধিকাংশ মাসআলাই সরাসরি কুরআন-হাদীসে স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়নি। অবশ্য এসব বিষয়ের মৌলিক বিধান বিবৃত হয়েছে। ইসলামী রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির বিস্তারিত বিধি-বিধান বিজ্ঞ ফোকাহায়ে কেরামের ইজতিহাদ নির্ভর। তাই এসব বিষয়ে একাধিক মতামত থাকা স্বাভাবিক। বিশেষভাবে ইসলামী রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিষয়ে না জানা আলেম ও সাধারণ মুসলমানরা এ নিয়ে চরম বিভ্রান্তিতে আছেন। তাছাড়া ফিকহ্ ও ফতোয়ার কিতাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির মাসআলাগুলো খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য রচিত হয়েছে। প্রচলিত বর্তমান ফেৎনার জমানায় রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিষয়গুলো অনেকটাই ইজতিহাদী বিষয়। তাই বর্তমানে প্রচলিত রাজনৈতিক বিষয়ে মতামতের ভিন্নতা অনেক বেশি।
মুফতি আমিনী (রহ.) এর চিন্তাধারা ছিল যে, যে সকল যোগ্য ওলামা- ফোকাহাগণ যথাযথ পন্থায় ইজতিহাদ করেন এবং এতে যদি তাদের দুনিয়াবি বা ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত না থাকে, তা হলে তারা হকের ওপর রয়েছেন মনে করতে হবে। এমন মতামত অনুসরণযোগ্য। যেমনÑ আমাদের আকাবিরের মাঝে হযরত হাকীমুল উম্মাত থানভী (রহ.) ও তাঁর শাগরেদগণ ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র জিহাদ করেননি এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট কায়েমের আন্দোলনের পক্ষে মতামত ও কর্মসূচি নিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে হযরত শায়খুল হিন্দ ও তাঁর শাগরেদবৃন্দ উপর্যুক্ত দুটি বিষয়ে উল্টো মতামত ও কর্মসূচি নিয়ে ময়দানে ছিলেন। কিন্তু উভয় পক্ষের আকাবির একে অপরের মতামত গ্রহণ না করলেও পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, ভিন্নমত পোষণকারীরা যথাযথ পন্থায় স্বার্থহীনভাবে কুরআন-হাদীসের আলোকে ইজতিহাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তাই তাদের মাঝে কখনো আন্তরিক ঝগড়া হয়নি। মুফতি আমিনী (রহ.) বলতেন, তাদের মাঝে মতের ভিন্নতা ছিল; মনের ভিন্নতা ছিল না। এই ইখতেলাফই উম্মতের জন্য রহমত।
তিনি সাহাবায়ে কেরামের মাঝে সংঘটিত মতবিরোধ ও লড়াইয়ের ব্যাপারে গবেষণামূলক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন। আশা করি, এটি পড়লে দুজন আলেম বা নেক বান্দার মাঝে মতবিরোধ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থেকে বাঁচা যাবে। সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে মন্দ ধারণা করে ঈমান হারানোর বিপদ হতে আত্মরক্ষা হবে। স্বার্থ রক্ষার মতবিরোধ ও দীনের খাতিরে মতবিরোধের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। মূল্যবান নিবন্ধটি লালবাগ জামেয়া থেকে প্রকাশিত ফতোয়ায়ে জামেয়ার ৪র্থ খ-ে ছাপা হয়েছে।
মুুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনী (রহ.)-এর সময়ে যেসকল ওলামায়ে কেরাম স্বার্থহীন যথাযথ ইজতিহাদের ভিত্তিতে তাঁর মতের বিরোধী ছিলেন, তিনি তাদের মতামতকে রদ করতেন না। কিন্তু জাহালাত প্রসূত স্বার্থযুক্ত মতামত দিলে তা খ-ন করতেন, যথাযথ জবাব দিতেন। মুফতি আমিনী (রহ.) আকাবিরের মতবিরোধের ইতিবাচক দিকগুলো লুফে নিতেন। এ-বিষেয়ে লিখিত হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া (রহ.) এর ‘আল ই’তিদাল ফি মারাতিবির রিজাল’ হযরত মুুফতি মাহমূদ গাংগুহী (রহ.) রচিত ‘হুদুদুল ইখতিলাফ’ এবং শায়খ আওয়ামাহ দা.বা. রচিত ‘আদাবুল ইখতিলাফ’সহ মূূল্যবান অনেক কিতাব নিয়মিত মুতালাআ করতেন।
গণতন্ত্র ও নারীনেতৃত্ব: ইসলাম কী বলে?
ফেৎনাযুক্ত এই যুগে রাজনৈতিক ভিন্ন ইজতিহাদি মাসআলাকে অনেকেই অজ্ঞতাবশত গোমরাহী মনে করে নিজেরাই গোমরাহ বনে যায়। এমন দুটি বিষয়ে আমি হযরতকে আমার জাহালাত দূর করার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলে তিনি আমাকে অত্যন্ত সহজতর পদ্ধতিতে বুঝিয়ে দেন। প্রশ্নগুলো মূলত: গোমরাহ আক্বীদার রাজনৈতিক দলের বই পড়ে সৃষ্টি হওয়ায় সরাসরি হযরতকে প্রশ্ন করি। ২০০৩ সালে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে এসব প্রশ্নের উত্তর জেনেছিলাম। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিলÑ ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র কেমন? যদি তা খারাপ হয়ে থাকে তা হলে ওলামায়ে কেরাম কেনো এই পন্থার রাজনীতি করেন?
জবাবে তিনি বলেনÑ বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো, সহজে বলছি। আমাদের আক্বীদা হলো, নবীজী ও খোলাফায়ে রাশেদীনের পদ্ধতির রাষ্ট্র ব্যবস্থাই একমাত্র খিলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। খিলাফত ছাড়া সব রাষ্ট্রব্যবস্থাই হয়ত কুফরি অথবা পথভ্রষ্ট। বর্র্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রধান রাষ্ট্রব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র (উবসড়পৎধপু) ও সমাজতন্ত্র (ঝড়পরড়ষরংস)Ñ উভয়টাই কুফরি রাষ্ট্রব্যবস্থা। আরেকটা হলো বর্তমানের রাজতন্ত্র। এটাও প্রচলিত আছে। এই তিন মতবাদেই গোটা পৃথিবী চলছে। আমরা কেনো করিÑ এটা বলার আগে জানতে হবে, আমরা ঘৃণার সাথে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাজনীতি করি। কারণ, গণতন্ত্র ছাড়া বাকি দুটিতে পদ্ধতিতে নাগরিকের মতপ্রকাশের কোনো স্বাধীনতা নেই। দশজন মতবিনিময়ের জন্য একত্রিত হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কোনো অন্যায়ের বিরোধিতা করলে চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। সমাজতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের এটাই বিশেষ গুণ। পক্ষান্তরে গণতন্ত্র কুফরি মতবাদ হলেও তাতে ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, অন্য দুই মতবাদে ইসলামের দাওয়াত দেয়া, অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরোধিতা করার কোনো সুুযোগ নেই। গণতন্ত্রে তা আছে। তাই আমরা খিলাফতের অনুপস্থিতিতে ঘৃণাসহ ইসলামী হুকুমত কায়েম করার প্রচেষ্টার সুযোগ থাকায় বাধ্য হয়ে গণন্ত্রকে অপর দুটির তুলনায় ভালো মনে করি। কারণ তা কুফরী মতবাদ হলেও এখানে ইসলামের কাজ করার সুযোগ আছে।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলÑ নারী নেতৃত্ব হারাম বলেন, আবার চার দলীয় জোটের নেতা একজন নারী। এভাবে নারী নেতৃত্বকে বৈধতা দেয়া ক্ষতিকর কি না? হযরত বললেনÑ ভালো প্রশ্ন করেছ। ভালোভাবে লক্ষ্য করো, নারী নেতৃত্ব হারাম। এতে দ্বিমত করাও আমি হারাম মনে করি। চার দলে আমি বা ওলামায়ে কেরাম তো নারী নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। খেয়াল করো, আমার দলের প্রধান তো কোনো নারী নয়। আমার দলের নাম তো বি.এন.পি নয়। আমার দলের গঠনতন্ত্রও ভিন্ন। আর জোটের অন্যান্যদের গঠনতন্ত্র ভিন্ন। তাদের দলের নিয়মে আমার দল চলে না। আমাদের মাঝে তো আদর্শের ঐক্য নয় বরং আন্দোলনের কৌশলগত ঐক্য হয়েছে। আরো লক্ষ্য করো যে, একটি দল ইসলাম বিরোধিতায় ও ইসলামবিরোধী আইন করতে বেপরোয়া। অপর আরেকটি দল তুলনামূলক ইসলাম বিরোধিতায় প্রকাশ্যে কমই আসে। ইসলামবিরোধী আইন করে না। আর তাদের মাঝে ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াই আছে। তাই হেকমতের দাবি হলো, ইসলামবিরোধী শক্তিকে পরাস্ত করতে এবং ইসলামবিরোধী শক্তির ক্ষমতা খর্ব করতে আদর্শিক নয় বরং কৌশলগত একটা ঐক্য দীনি স্বার্থেই প্রয়োজন। আর বর্তমানে আমাদের মিত্রদল বি.এন.পি কখনো ইসলামবিরোধী হলে আমরা তারও কঠোর বিরোধিতা করবো, ইনশাআল্লাহ। এ ছাড়া যুগে যুগে সাহাবা ও আকাবিরে কেরাম একই সময়ে প্রতিদ্বন্দী দুটি ইসলামবিরোধী শক্তি সক্রিয় থাকলে তুলনামূলক কম ক্ষতিকর পক্ষের সাথে কৌশলী মিত্রতা করে বেশি ক্ষতিকর পক্ষকে দমন করার পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। এটাই সাহাবা ও আকাবিরের কৌশল।
অসাধারণ প্রজ্ঞা ও কৌশল
মুফতি আমিনীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অরো কিছু ভাষ্য তার শাগরেদ আল আমীন আজাদের কলমে- ‘ইলমের পাশাপাশি তার হিলমও ছিলো অতুলনীয়। উপস্থিত যেকোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি দারুণ দক্ষ ছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনগুলোতে সাংবাদিকদের জটিল প্রশ্নের উত্তর তিনি অনায়াসেই দিয়ে দিতেন। চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামীর ব্যানারে ওলামায়ে কেরাম সেখানে সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। নেতৃত্ব দেন আহমদ শফী সাহেব। আন্দোলন বড় আকার ধারণ করেছিলো। সারাদেশের ওলামা মাশায়েখ একে একে এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আহমদ শফী সাহেবের ডাকে চট্টগ্রামের সকল মাদ্রাসার প্রিন্সিপালসহ ৭০টি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালগণ হাটহাজারী মাদ্রাসায় জমায়েত হন। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক ওলামায়ে কেরামও শরীক হন। আমিনী সাহেবকেও দাওয়াত করা হয়। হুজুর বলেন, হাফেজ্জী হুজুরের মতো আবার সেই একযোগে আন্দোলন হবে ভেবে আমি সেখানে যোগ দিই। আমরা সিলেট থেকে প্রোগাম শেষ করে সারারাত সফর করে হুজুরের সাথে উপস্থিত হই। প্রোগ্রাম শুরু হয় সকাল দশটায়। আলেম ছাড়া সেখানে অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ। হুজুর স্টেজে ওঠেন। হুজুরের সাথে থাকতে হয় বিধায় আমি মিটিংয়ে বসতে পারি। বক্তৃতা শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা শেখ আব্দুল্লাহকে আলেম না হওয়া সত্ত্বেও মঞ্চে নিয়ে আসা হয়। অনুষ্ঠানের চিত্র তখন থেকেই পাল্টাতে শুরু করে। শেখ আব্দুল্লাহকে বক্তৃতা করতে দেওয়া হয়। বেশ দীর্ঘ বক্তব্য করেন। বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর ধর্মপরায়ণতার বিবরণসহ গুণগান গাইলেন। আমি হুজুরের দিকে লক্ষ করলাম। দেখি, দুই কানে দুই হাত দিয়ে রেখেছেন। তার বক্তৃতা শুনছেন না। শেখ আব্দুল্লাহর বক্তৃতা শেষে নাম ঘোষণা করা হয় হুজুরের। হুজুর ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললেন, আমি বক্তৃতা করবো না। এরপরও পীড়াপীড়ি করলে দাঁড়িয়ে শুধু এতোটুকু বলেই চলে আসেনÑ ‘যে মঞ্চে আওয়ামীলীগ বক্তৃতা করে সেখানে আমি বক্তৃতা করি না।’ শেখ আব্দুল্লাহর বক্তৃতার সময় আমিও তার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে চেয়েছিলাম। অনেকেই তার বক্তৃতা সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু কে কী করবেন দিশা পাচ্ছিলেন না। হুজুরের উপস্থিত এই সাহসী জবাবে সবাই হতবাক। মজলিসের লোকজন বলাবলি করছে, আমিনী সাহেব একটা উপযুক্ত কাজ করেছেন। যথার্থ কাজ করেছেন।
৪ এপ্রিল হরতাল ঘোষণার পর দেশব্যাপী যখন হরতাল সফলের গণসংযোগ চলছে, তখন বেফাক আহুত ২৭ এপ্রিল মহাসমাবেশের ব্যাপারে দেশের দলমত নির্বিশেষে সকল ওলামায়ে কেরামকে আহবান করে বেফাক। মিটিং হবে ঢাকার পীরজঙ্গী মাদ্রাসায়। সাধারণত হুজুর বেফাকের মিটিংয়ে সশরীরে হাজির হন না। সেদিন গিয়েছিলেন সবাই আসবে বলে। যে রুমে হুজুরকে বিশ্রাম করতে দেওয়া হয় সেখানে আরো অন্যান্য আলেমরা বসা। কে যেনো কথা প্রসঙ্গে আওয়ামীলীগের কথা বললে হুজুর উচ্চস্বরে বললেন, ‘আজকের মিটিংয়ে আওয়ামীলীগের কেউ আসলে তার দিকে প্রথম জুতাটা আমার পড়বে। হুজুরের ব্যঘ্রগর্জন শুনে সবাই নিশ্চুপ। এভাবে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠার কারণ আমরা তখন বুঝতে পারিনি। মিটিং থেকে ফিরে হুজুর বললেন, মিটিংয়ে যেনো আওয়ামীলীগের কেউ না আসেÑ আগে থেকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য এভাবে জোর আওয়াজ করেছি। ফলে হুজুরের আগাম প্রতিবাদের কারণে আসার পরিকল্পনা থাকলেও সেদিন কোনো আওয়ামীলীগার আসেনি।
৪ এপ্রিল হরতাল ঘোষণার পর দেশের প্রথম সারির একজন আলেম হুজুরকে বিচারপতি আব্দুর রউফের মাধ্যমে অনুরোধ করিয়ে তার বাসায় আমন্ত্রণ করেন। হুজুর তার বাসায় যান। হুজুরের সাথে আমরাও ক’জন ছিলাম। সেখানে ওই আলেমের সমমনা অন্যান্য দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। আমিনী সাহেবকে বাসায় আমন্ত্রণের মূল লক্ষ্য ছিলো ৪ এপ্রিলের হরতাল আরো পিছিয়ে দেওয়া। পিছিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী ছিলো সেটা না বলাই ভালো। দীর্ঘ আলোচনা হলো। সবাই এক একটি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, হরতালটা ৪ এপ্রিল নয় আরেকটু পিছিয়ে দিলে ভালো হয়। সবার কথা শেষ হলে হুজুর হরতাল ৪ এপ্রিল দেওয়ার স্বপক্ষে নিজস্ব যুক্তি উত্থাপন করে তাদের দাবি বাতিল করে দেন। কঠোরভাবে এবং উচ্চকণ্ঠে কথা বলার কারণ উল্লেখ করে পরে বলেন- ‘এভাবে শক্ত করে না বললে তারা আরো অনুরোধ করতো।’ কঠিনভাবে বলায় তারা পুনরায় অনুরোধের সাহস করেনি। এমন অনেক আচরণ-উচ্চারণের বহু ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে, যা তার বুদ্ধিমত্তা ও উপস্থিত জ্ঞানের সাক্ষ্য বহন করে।
সাহসের সমাচার
মাওলানা জুনায়েদ গুলজার বলেন- ২০০৭ সালে বাংলাদেশে যখন তত্ত্বাবধায়কের আবরণে সেনাশাসন চলছিলো। রাজনৈতিক পরাশক্তি বলে খ্যাত বড় বড় নেতা নেত্রীরাও মুখ খোলার সাহস পায়নি। সেই কঠিন মুহূর্তেও এই বিপ্লবী নেতার গর্জন বন্ধ হয়নি। ফখরুল-মঈনুলের ইসলামবিরোধী নারীনীতিমালার বিরুদ্ধে এই বিপ্লবী সিপাহসালার শুধু বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং তিনি রীতিমত রাজপথে লাড়াইতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে জরুরী সরকারের আমলে এই নীতিমালাটি স্থগিত করা হয়েছিলো।
মুফতি আমিনী (রহ.) ব্যক্তি স্বার্থে রাজনীতি করতেন না। তাই তিনি সংসদ সদস্য হয়েও দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি ইসলামের স্বার্থে নিজের এমপির পদ থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণাও তিনি দিয়েছেন। আলিয়া মাদ্রাসা পাঠ্য পুস্তুক থেকে মওদুদীর ভ্রান্ত আকিদা সম্বলিত বই পুস্তুক বাদ দেয়ার কৃতিত্বও মুফতি আমিনীই অর্জন করেছিলেন। সুদখোর মহাজন বলে খ্যাত ড. ইউনূস যখন শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলো, তার প্রশংসায় যখন গোটা জাতি পঞ্চমুখ। এমনকি সকল নেতানেত্রী আজকে যারা ইউনূসের বিরুদ্ধে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অনেক লম্বা লম্বা কথা বলছেন, এরাই ড. ইউনূসের প্রশংসায় ব্যস্ত ছিলেন। তখন ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু মুফতি আমিনী (রহ.)। মুফতি আমিনী তখন দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন এবং যেদিন দেশের মাটিতে পা রাখলেন, হযরত শাহজালাল অন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছাত্র জনতার ঢল নেমেছিলো। সেদিন ইলেক্ট্রিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরাও সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো। সবার জানার আগ্রহ ছিলো ড. ইউনূস নিয়ে এই মহান নেতার কী মন্তব্য। হুজুর তখন পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করে বলেছিলেনÑযে যাই বলুক ড. ইউনূস একজন সুদখোর। তার নোবেল বিজয়ে দেশের কোনো সম্মান হয়নি বরং শতকারা ৯০% মুসলমানের এই পবিত্রভূমিকে কলঙ্কিত করা হয়েছে’। গোটা পৃথিবী যখন একদিকে ধাবমান মুফতি আমিনী ঈমানী চেতনা প্রকাশ করে সেদিন বিশ্ববাসীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে তাদের বুঝিয়ে দিলেনÑ মুসলমান কখনো সত্য কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না। কারো রক্তচক্ষুকেও পরোয়া করে না।
মুফতি আমিনীর (রহ.) ঘনিষ্ঠ শাগরেদ, তরুণ রাজনীতিবিদ ও লেখক আনসারুল হক ইমরানের টুকরো স্মুতিচারণ-
ভগবান যেন আবারও আমিনীকে এমপি বানায় : একবার সরাইল উপজেলা ইউএনও অফিসে স্থানীয় হিন্দু সংখ্যালঘুদের ঢেউটিন, নগদ টাকা বিতরণ করছিলেন হুজুর। সারিবদ্ধ হয়ে তারা তা গ্রহণ করছিলো। টাকা হাতে পেয়ে হঠাৎ এক বৃদ্ধা হিন্দু মহিলা বলে উঠলো, জীবনে প্রথম কোনো এমপির কাছ থেকে টাকা পেলাম। আগেকার এমপিদের নামই শুনেছি মাত্র, টাকা তো দূরের কথা তাদের চেহারাও দেখিনি কখনো। ভগবান যেন আবারও আমিনীকে আমাদের এমপি বানায়। অনেক হিন্দু লোক তাদের দূর্গা পুজার জন্য অনুদান নিতে লালবাগে এসে এই বলে হুজুরকে অনুরোধ জানাতো, তাদের পূজা ম-পে যেনো হুজুর উপস্থিত হন। হুজুর হেসে বলতেন, আমার নবী সা. সারাজীবন মূর্তি থেকে দূরে ছিলেন। সুতরাং আমার দ্বারা এইসব উৎসবে উপস্থিত হওয়া কোনোদিনই সম্ভব না। প্রয়োজনে আরো ১০ হাজার টাকা বেশি নিয়ে যান। তবে এ কথা সত্য, তিনি সংসদসদস্য থাকাকালীন তার এলাকার সংখ্যালঘুরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অনুদান পেয়েছেন। স্থানীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হয়েছি।
আল্লাহ অত্যাচারীদের ভালোবাসেন না
একবার সফরে গিয়ে ময়মনসিংহে ভালুকা থানায় উপস্থিত হলেন তিনি। হুজুর আসছেন শুনে মুহূর্তেই থানার অফিসার ইনচার্জ গায়েব হয়ে গেলেন। এসআইকে হুজুর বললেন, অফিসার ইনচার্জ কোথায়? তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলো। বেশ কিছুক্ষণ পর অফিসার ইনচার্জ উপস্থিত হলো। তার সারা শরীর থেকে ঘাম ঝরছিলো। সালাম দিয়েই বলতে লাগলো, স্যার বিশ্বাস করুন, সেইদিন আমি যা করেছি সব উপরের নির্দেশে। হুজুর বললেন, কোন্ দিন? ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে হরতালের সময় আমি মোহাম্মদপর থানার দায়িত্বে ছিলাম। সেদিন নূর মসজিদে পুলিশ কনস্টেবল বাদশা মিয়া হত্যাকা-ের পর উপরের মহলের হুকুমে পরদিন আল্লামা আজিজুল হক সাহেবের মাদ্রাসায় তল্লাশী চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেফতার, হয়রানী ও মাদ্রাসায় সংরক্ষিত কুরবানীর ছুরি জব্দ করে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজানোর দায়িত্বে ছিলাম আমিই। কিন্তু বর্তমান চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে আমাকে বদলী করে এই থানায় পাঠায়। আমি মনে করেছি, আপনি আমার ব্যাপারটি জেনে গেছেন এবং আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এখানে এসেছেন। তাই আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। হুজুর হেসে বললেন, আমাদের রাজনীতি হলো আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। ব্যক্তিগত আক্রোশ নিয়ে প্রতিশোধের রাজনীতি করা আমাদের লক্ষ্য নয়। অনুতপ্তকারীদের জন্য ক্ষমা করাই হলো আমাদের নবীর পরম শিক্ষা। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে সতর্ক থেকো। মনে রেখো, আল্লাহ অত্যাচারীদের ভালোবাসেন না।
সাইনবোর্ডে নয়, কাজে বিশ্বাসী
চারদলীয় জোট আমলে সংসদসদস্য হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় সপ্তাহে একবার যাওয়া ছিলো তার নিয়মিত রুটিন। আবার কাজ থাকলে কখনো ২-৩ বারও যেতেন। একবার গেলেন বাহাদুরপুর গ্রামে। জীর্ণশীর্ণ রাস্তা পার হয়ে আমরা গেলাম পুকুরপার ঘেঁষা একটি ছোট মাদ্রাসায়। গ্রামের উৎসুক মানুষগুলো র্দীঘসময় ধরে এখানে অপেক্ষমাণ হয়ে আছেন, এমপির মুখ থেকে কিছু কথা শোনার জন্য। হুজুর দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এলাকাবাসী। আপনারা আমাকে গত নির্বাচনে ভোট দিয়ে এমপি নির্বাচিত করেছেন। আমি আমার এলাকাবাসীর মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আপনারা দুআ করুন। তারপর গ্রামের কবরস্থান পাকা করতে ও একটি ছোট ব্রিজের জন্য অনুদান বরাদ্দ দিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, পাশের গ্রামে আপনি যে ব্রিজটির কাজ শুরু করেছিলেন এক বছর আগে। সেটার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। কয়েকদিন আগে মন্ত্রী সাত্তার সাহেব এটা উদ্বোধনও করেছেন। এভাবে প্রায়ই তিনি আপনার প্রকল্পগুলো শুভ উদ্বোধন করে থাকেন। এতে তার নাম ডাক হচ্ছে। হুজুর বললেন, উদ্বোধন করুক, তাতে সমস্যা কী? আপনারা আমাকে নির্বাচিত করেছেন এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে। আমি কাজে বিশ্বাসী, সাইনবোর্ডে নয়। সাধ্যমতো কাজ করে যাওয়াটাই আমার লক্ষ্য। সুতরাং কাজ হোক। কে উদ্বোধন করলো সেটা বড় কথা নয়।
আমার নামে প্রতিষ্ঠান করলে এলাকার বরাদ্দ বাতিল হবে
তার নির্বাচনী এলাকা ‘বুধল’ এ এক ব্যক্তি ‘মুফতি ফজলুল হক আমিনী ইসলামী ক্যাডেট মাদ্রাসা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো। এটা উদ্বোধনের কিছুদিন পর এই ভেবে হুজুরকে দাওয়াত করলো যে, হুজুর হয়তো নিজের নামে প্রতিষ্ঠান দেখে খুশি হয়ে বিশেষ সরকারি বরাদ্দ দেবেন। সে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ চেয়ে বসলো। হুজুর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, বরাদ্দ দিতে পারি, তবে শর্ত হলোÑ আমার নাম বাদ দিতে হবে। অন্যথায় অনুদানের বরাদ্দ তো দূরের কথা, আগের কোনো বরাদ্দ থেকে থাকলে সেটাও কেটে দেবো। বেচারা হুজুরের কথা শুনে অবাক হলো এবং হুজুরের কথা মেনে নাম বাদ দিলো। হুজুরের মর্জি মুতাবেক নতুন নাম দেওয়ার প্রস্তাব করলো, হুজুর তাৎক্ষণিক নিজের নামের জায়গায় হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর নাম বসিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন।
ঘটনার কয়েকদিন পর পাশ্ববর্তী গ্রাম সিরাজনগরে এক সমাবেশে তাঁর নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমার নামে কোনো প্রতিষ্ঠান, সংঘ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এমন করলে ওই এলাকার বরাদ্দ বাতিল হবে।’ তার এমন অটল ও দৃঢ় মনোভাবে দেখে সেদিন সেখানকার লোকদের বলতে শুনেছি, ‘আমরা যথোপযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছি।’ বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে এমন মানুষ আছে কি?
সমমনা সংগঠন বিষয়ক ভাবনা ও বিচার
কাতার প্রবাসী মাওলানা ইউসুফ নূর তার স্মৃতিচারণে বলেন- ‘২০০২ সালের শুরুতে আমি বাংলাদেশে যাই। মুফতি আমিনী (রহ.) তখন নির্বাচিত সংসদসদস্য এবং দুঃখজনকভাবে আমি তখন দেখি, এ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ইসলামী ঐক্যজোটের ভাঙন নিয়ে নানা অপপ্রচার এবং অভিযোগ চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আমি ব্যথিত মনে ভাবছিলাম, এ মানুষটিকে নিয়ে কেন এতো অভিযোগ কিংবা কেন এমন ষড়যন্ত্র! আবার কেনই-বা তার নেতৃত্বে আলেম ওলামা এভাবে ঐক্যবদ্ধ? মাইজদীর বিভিন্ন দেয়ালে আমি তখন মুফতি আমিনী সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাঙ্গাত্মক দেয়াললিখন দেখেছি। মাইজদী শহরে তার একটি কর্মসূচির পোস্টার-ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিলো, প্রচারমাইক এবং প্রচারকর্মীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছিলো। কর্মসূচির নির্ধারিত দিনে তিনি মাইজদী এলেন।
আমি হুজুরের সঙ্গে দেখা করার জন্য মাইজদী আল আমিন মাদ্রাসায় গেলাম। মাওলানা আজিজুল্লাহ সাহেবের সহায়তায় দেখা করার সুযোগ পেলাম। হুজুর তখন দুপুরের আহার শেষে বিশ্রাম করছিলেন। এই প্রথমবারের মতো আমি হুজুরকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। একই বছর আমি কাতারে তখন কাতার ইসলামিক প্রেজেন্টেশন সেন্টারে বাংলাদেশী দাঈ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম। সেই সুবাদে আমি হুজুরকে কাতার আসার ব্যাপারে আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি আমাকে তার ব্যক্তিগত কার্ড দিলেন এবং আমার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে খবরাখবর নিলেন। মুফতি আমিনী (রহ.) আমাকে বললেন, আপনি একজন বাংলাদেশী হয়ে সেখানে দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন শুনে আমি খুব খুশি হলাম। কাতার সফরের ব্যাপারে এখনই কোনো ওয়াদা দিতে পারছি না। পরবর্তীতে দেখা যেতে পারে।
এর মধ্যে খবর আসছিলো, বিভিন্ন স্থানে মুফতি আমিনীর বিরুদ্ধে একটি ইসলামী দলের কিছু লোক অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং ব্যানার-পোস্টার ছেঁড়া ও বিশৃঙ্খলার অভিযোগে পুলিশ তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। আমরা বাদ আসর হুজুরকে নিয়ে পুলিশ প্রটোকলসহ সমাবেশস্থলের দিকে রওয়ানা হলাম। সেখানে যাওয়ার পর সমাবেশ শুরু হলো এবং বক্তারা আজকের শহরে বিশৃঙ্খলাকারীদের ব্যাপারে বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। মুফতি ফয়জুল্লাহ তার বক্তৃতায় এক পর্যায়ে বললেন, আজকের সমাবেশ প্রমাণ করে, বাংলাদেশে মুফতি আমিনীর শত্রুদের কোনো স্থান নেই। এ কথা বলামাত্র তাকে শেষ করতে না দিয়ে মুফতি আমিনী চেয়ার থেকে উঠে মাইকে এলেন এবং বললেন, ‘যারা আজকে আমার বিরুদ্ধে এসব করছেন, তারা আমাদের শত্রু নয়। তারা আমাদেরই বন্ধু। তারা আমাকে ভুল বুঝেছেন। বন্ধুদেরকে কখনো শত্রু বলতে নেই। বরং তাদের ভুল বোঝাবুঝি দূর করা দরকার। আমি এটুকু সংশোধনী দেবার জন্যই উঠে এলাম।’ এই বলে তিনি আবার চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লেন। সমাবেশ চলতে থাকলো। চারদিক কানায় কানায় ভর্তি মানুষে।
তারপর প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মুফতি আমিনী রহ, বললেন, যে ঐতিহাসিক ফতোয়ার রায়কে কেন্দ্র করে আমরা আন্দোলন এবং চারদলীয় জোট গঠন করলাম, আমি এখনো বলবো, যদি ওলামায়ে কেরামের এ দাবীর প্রতি কোনো সম্মান না দেখানো হয়, তবে যেকোনো সময় জোট ভেঙে সংসদ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে আমার সমস্যা হবে না। তিনি সেদিন আরো বলেছিলেন, ইখতেলাফ এবং মতভেদ যুগে যুগে হয়েছে। আমরা আবার হয়তো একসঙ্গে কাজ করবো। কিন্তু এই যে অভদ্রতা, এটা তো আলেমদের শানে বেমানান। যারা আমাকে ভালোবাসেন, আমি তাদেরকে বলবো, আজকে যারা আমার নিন্দা করছেন, আপনারা তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করবেন। তারা আমাকে ভুল বুঝেছেন। এরা তো ওইসব লোক, যারা আমি জেলে যাওয়ার পর আমার পক্ষে স্লোগান দিয়েছে, রক্ত ঝরিয়েছে, তারাও জেলে গিয়েছে। আপনারা মনে করবেন না যে, চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসায় ইসলাম কায়েম হয়ে গেছে। বরং ভবিষ্যতে আবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।’
একই দিন বাদ মাগরিব আলআমিন মাদ্রাসায় আলেমদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নোয়াখালীর বিশিষ্ট আলেমগণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মুফতি আমিনী (রহ.) ওই বৈঠকে আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার কথা বলেন। একজন আলেম তার কাছে জানতে চাইলেন, আমাদের পারস্পরিক মতবিরোধ তো বাড়ছে, এভাবে চললে আর কবে আমরা সাফল্যের আশা করতে পারি? হুজুর তখন বললেন, আমরা তো এভাবেই পথ চলে এসেছি। সবাই ঐক্যবদ্ধ হবে, এ আশায় বসে থাকলে কোনোদিনই আন্দোলন করা যাবে না। তিনি বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন, এ মতবিরোধ যুগে যুগে থাকবে এবং সবাই এক বিষয়ে একমত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। হুজুরের এ সমাধানমূলক নির্দেশনা পেয়ে আমি আবারো অনুপ্রেরণা পেলাম যে, মতপার্থক্য থাকবে এবং এর দোহাই দিয়ে আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকা যাবে না।
ত্যাগ ও সংগ্রাম
ইসলামী আন্দোলনগুলোয় তার সম্পৃক্ততা, প্রভাব, নেতৃত্বের ধরণ ও ত্যাগ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাওলানা শহিদুল আনোয়ার বলেন- ‘১৯৯৭ সালে নাস্তিক মুরতাদ আজগর আলী গংরা কোরআনকে অবমাননা করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে তখন মুফতি আমিনীর নেতৃত্বে একটি তীব্র ইসলামী আন্দোলন চলছে। সেই সূত্রে উক্ত বছরের ১৫ই জুলাই একটি হরতাল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের ব্যায়-ভার বহনের কোন ফান্ড উপস্থিত নেই। আন্দোলনের অর্থ যোগান দেওয়ার জন্য তিনি ঢাকার কেল্লার মোড়ে তার স্ত্রীর নামে উত্তরাধীকার সুত্রে পাওয়া সেই জমিটুকুও তিনি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এমন কেউ কি আছে? যে দীনি আন্দোলনের জন্য নিজের সর্বস্ব বিলীন করতে প্রস্তুত? বরং আমরা তো এই ধরনের অঙ্গীকারে শুধুমাত্র হাত উত্তোলন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকি। কিন্তু ত্যাগের বাস্তব দৃষ্টান্ত হলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)। তার এই সংগ্রামী জীবন থেকে এই পথহারা জাতির অনেক কিছু শেখার রয়েছে।
আমার আরও একটি ঘটনা মনে পড়ে- ২০০১ এর ১লা জানুয়ারি বাংলাদেশের হাইকোর্ট থেকে সব ধরনের ফতোয়া প্রদান অবৈধ ঘোষণা করার পর রায় প্রদানকারী বিচারপতিদ্বয়কে সর্বপ্রথম মুরতাদ ঘোষণা করেছিলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী। তিনি এই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশের সকল ওলামায়ে কেরামকে এক মঞ্চে উপস্থিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ জন্য তিনি মাসব্যাপী বাংলাদেশের সকল জেলায় একাধারে সফর করেছিলেন। কোন কোন সফরে হুজুরের সফর সঙ্গী হওয়ার তওফীক আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। সফরের একটি ঘটনা বর্ণনা করছি। কোন একরাতে আমরা চট্টগ্রামের বৃহত্তম দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পটিয়া মাদ্রাসায় উপস্থিত হই। কিন্তু পটিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমিনী সাহেব হুজুরের উপস্থিতি টের পেয়ে কোনো কারণবসত গা ঢাকা দেয়। রাত তখন ১২টা কনকনে শীতের রাত। হুজুরসহ আমরা সকলে রাতের খাবার খেয়েছি যাত্রাপথে কোন হোটেলে। পটিয়া মাদ্রাসায় উপস্থিত হয়ে কাউকে না পেয়ে হুজুরের সাথে থাকা ওলামায়ে কেরাম পরামর্শ দিচ্ছিলেন পরবর্তী প্রোগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করার জন্য। কিন্তু হুজুর দৃঢ়কন্ঠে বলতে লাগলেন আমি-তো কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আসিনি। বরং আমি ছাত্রদের নিকট থেকে আগামী ২রা ফেব্রুয়ারি ঢাকার মহাসমাবেশে যাওয়ার অঙ্গীকার নেয়ার জন্য এসেছি। তাই আমার মতামত হল আমরা এখানেই রাত্রি যাপন করব। আপনারা সকলে মেহমান খানায় বিশ্রাম গ্রহণ করুন। এই বলে তিনি পকেট থেকে তসবীহ্ বের করলেন এবং ব্যাগ থেকে জায়নামায বের করলেন। এরপর মাদ্রাসা মসজিদের বারান্দায় জায়নামায বিছিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমরা সকলে মেহমান খানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ফযরের আজানের পর জাগ্রত হয়ে দেখি মুফতি আমিনী সাহেব সে জায়নামাজে বসে মোনাজাত করছেন এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছেন। আমাদের বুঝতে কষ্ট হল না যে তিনি সারা রাত নামায ও দোয়ার মধ্যে অতিবাহিত করেছেন।
এভাবে তাঁর সংগ্রামী জীবনের হাজারো রাত তিনি নামাযে দন্ডায়মান ও যিকির তিলাওয়াতে মশগুল থেকে অতিবাহিত করেছেন। তারপর মাদ্রাসার সকল ছাত্র শিক্ষকবৃন্দ মুফতি আমিনীর উপস্থিতি লক্ষ করে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ল। মুফতি আমিনী সাহেব ফজরের নামাযের পর মাদ্রাসা মসজিদের মিম্বারে বসে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বয়ান শুরু করলেন। উক্ত বয়ানের মাঝে ছাত্রদের মুহুর্মুহু ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনীতে মাদ্রাসার পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠল। এবং উপস্থিত সকলে চলমান আন্দোলনে হযরতের সাথে সার্বিকভাবে থাকার অঙ্গিকারাবদ্ধ হল। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বয়ান শেষ করার পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মুফতি আমিনী সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন। তখন আমি লক্ষ্য করলাম, সারারাতের সকল কষ্ট ভুলে গিয়ে তিনি তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কথা বলতে লাগলেন। তার চেহারায় বিন্দুমাত্রও কষ্টের ছাপ ছিল না। এটিই ছিল তার মহত্ত্বের অনুপম দৃষ্টান্ত। এজন্য তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কোন একজন বুযুর্র্গ যথার্থই বলেছেন যে ‘মুফতি আমিনী মূলত এ যুগের মানুষ নন, বরং তিনি সাহাবা এবং তাবেঈনদের যামানার একজন মানুষ, পৃথিবীতে এসেছেন পরে। কেননা আল্লাহ তায়ালা কিছু মানুষকে সঠিক মনুষত্ব দান করে সাহাবা ও তাবেঈনদের গুণে গুণান্বিত করেছেন। কিন্তু তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন অনেক পরে। যাতে এ প্রদীপগুলো পরবর্তী যামানার লোকদের অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে আলোর পথ দেখায়।
ফতোয়া অবৈধের রায়-বিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে সকল শীর্ষস্থানীয় ওলামার মতামতের ভিত্তিতে আন্দোলনের নেতা নির্বাচনের জন্য একদিন সন্ধ্যার পর লালবাগ মাদ্রাসার দপ্তরে বাংলাদেশের সকল শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম ও সমস্ত ইসলামী সংগঠনের চেয়ারম্যানগণের উপস্থিতিতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত এক জরুরী পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত বৈঠকে ছাত্রদের প্রবেশাধীকার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এই অধম হযরত মুফতি আমিনীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। সে সুবাদে বৈঠকে উপস্থিত থেকে দীনের জন্য হযরতের নিজেকে বিলীন করার দৃশ্যকে স্ব-চক্ষে অবলোকন করেছি। তিনি উপস্থিত মুরব্বিগণের অনুমতিক্রমে দাঁড়িয়ে বলছিলেন- ‘এই মুহূর্তে এই বৈঠকে বাংলাদেশের সকল মুরব্বীগণ উপস্থিত। আমার উচিত ছিল সকলের কাছে যাওয়া। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আমি যেতে পারিনি এ জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। সকলের খেদমতে আমার একটি কড়জোর অনুরোধ যে, বাংলাদেশ থেকে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে যার অর্থ হল কোরআন-হাদীস অবৈধ। দেশে কোরআন-হাদীস অবৈধ থাকবে আর আমরা মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা নিয়ে বসে থাকবো এটা কখনো হতে পারে না। এ রায়কে বাতিল করার জন্য যে আন্দোলন হবে এবং যে কমিটি গঠন হবে আমি সে কমিটির কোন পদ চাই না। বরং সেই কমিটির একজন কর্মী থাকতে চাই। এখানে উপস্থিত যেকোন মুরব্বির হাতে আমি বায়আত নিতে চাই। এবং তার নেতৃত্বে কাজ করতে চাই। আপনারা আমাকে একজন খাদেম হিসেবে রাখবেন। যদি তাজা রক্ত ঢেলে শাহাদাৎ বরণ করতে হয় তা হলে আল্লাহ যেন সর্বপ্রথম এই আমিনীকে কবুল করেন। নিজের ব্যক্তিগত কোনো ভুলের কারণে আল্লাহ যেনো শহীদী কাফেলা থেকে আমাকে ছিট্কে ফেলে না দেন।’.. এই কথা বলার সাথে সাথে উপস্থিত সকল ওলামায়ে কেরামের নয়নে অশ্রু এসে গেল। এবং পুরো বৈঠকে একটি নিরবতা বিরাজ করতে লাগল। হযরত খতিব সাহেব মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ.) এবং আমিনী সাহেবের পরম শ্রদ্ধেয় উস্তায শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) নিরবতা ভেঙ্গে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘আমিনী সাহেব, এই আন্দোলনের জন্য আমরা আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করলাম। আপনিই এই কমিটি তথা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর।’ মুরব্বিদ্বয়ের এ প্রস্তাবে উপস্থিত সকল ওলামায়ে কেরাম একবাক্যে সমস্বরে সমর্থন জানালেন। হযরত মুফতি আমিনী সাহেব বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় আমীর নির্বাচিত হন। এ হল মুফতি আমিনী সাহেবের আনুগত্যের উজ্জ্বল নির্দশন।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও স্বীকৃতি
মুফতি আমিনীর প্রভাব এবং নিবেদন নিয়ে আলোচনায় একজন বলেন- ‘কলকাতায় কিছুদিন অবস্থান করে শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে বনগাঁও এক্সপ্রেসে চড়ে যখন সীমান্তের উদ্দেশে রওয়ানা হই, তখন ট্রেনে পড়ার জন্য আমি কিছু দৈনিক পত্রিকা কিনে নিয়েছিলাম। সেগুলোর বেশ কয়েকটিতে সেদিন মুফতি আমিনীকে নিয়ে নেতিবাচক খবরাখবর ছাপা হয়েছিলো। একটি দৈনিকে ‘ইসলামের স্বপক্ষে কথা বলে মুফতি আমিনী বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্র বানাতে চান’ মর্মে সচিত্র সংবাদ ছাপা হয়েছিলো। আমার তখন অনুভব হলো, আমাদের দেশে তিনিই এমন এক প্রতিবাদী কণ্ঠ, যাকে নিয়ে এপারে কলকাতায়ও আলোচনা হয়। তিনি যে হকের পথে একজন নির্ভীক ও অবিচল সৈনিক, তা তাকে নিয়ে কলকাতায় সংবাদমাধ্যমে বিধর্মীদের সমালোচনা দেখে আরো স্পষ্ট হয়। পাকিস্তানসহ উপমহাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা মিডিয়ায় বাংলাদেশী আলেম ও ইসলামী নেতা হিসেবে একমাত্র তার বক্তব্যই মিডিয়ায় গুরুত্বের সাথে জায়গা পেতো।
গৃহবন্দি থাকাকালীন ফতোয়ার পক্ষে সুপ্রিমকোর্টে শুনানী শুরু হলে তিনি তার অনুসারী নেতাকর্মীদেরকে রাজপথে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দিতে বলেন। নির্ধারিত দিন হাইকোর্ট ঘিরে ফেলা হলো। সুপ্রিম কোর্ট ফতোয়ার পক্ষে রায় দিলো। তাতে তিনি অত্যন্ত খুশি প্রকাশ করেন। দারুল হাদীসে শুকরিয়া মাহফিল করেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘হযরত সদর সাহেব হুজুর বলতেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কাজ চালিয়ে যাওয়া। কাজে কামিয়াব হওয়া কিংবা না হওয়াÑএটা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। সদর সাহেব আরো বলতেন, এক ঘন্টার কাজের জন্য দশ ঘণ্টা দুআ করা আবশ্যক। তাই আমরা আন্দোলন করেছি, দুআ করছি, আজ এক যুগ পর আমাদের একটি আন্দোলন ‘ফতোয়া রক্ষার আন্দোলন’ সফল হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! বাকি দুটি আন্দোলন অর্থাৎ কুরআনবিরোধী নারীনীতি ও ইসলামবিধ্বংসী শিক্ষানীতির ব্যাপারেও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ আমার বিশ্বাস, আমরা সফল হবো। আল্লাহ আমাদের সফল করবেন।
মিডিয়ার প্রতি গুরুত্ব
মাওলানা আবু তাহের জিহাদী স্মৃতিচারণ করেন- ‘রাজনৈতিক জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি মিডিয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। মিডিয়ার ব্যাপারে তিনি বলতেন- মিডিয়া এমন একটা জিনিস, বর্তমান বিশ্বে তথ্যসন্ত্রাস বলে যেটা প্রচলিত, আলেম-ওলামা তথা মুসলমানদের হাতে এই মিডিয়া শক্তি না থাকায় তারা এই তথ্যসন্ত্রাসে আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের এগিয়ে আসা দরকার। বিশেষ করে, তরুণ আলেমদের এ ব্যাপারে উৎসাহও দিতেন। আলেম-ওলামা এ অঙ্গনে চলে আসলে জাতি সঠিক তথ্যটা জানতে পারবে। কারণ, আজকাল ভুল তথ্য, দলীয় প্রভাবসহ এমন বিভিন্ন কারণে মানুষ সঠিক তথ্য জানতে পারে না। সুতরাং, ওলামায়েকেরাম ও আল্লাহভীরু মানুষ যদি এ অঙ্গনে চলে আসেন তবে দেশ তথা গোটা বিশ্বের মানুষ সত্য ও সঠিকটি জানতে পারবে।
নিরন্তর পথচলা
আবু তাহের জিহাদী আরও বলেন- ‘মুফতি আমিনী (রহ.) সরাসরি রাজনৈতিক ময়দানে আসার পর বাংলাদেশে নাস্তিক-মুরতাদ এবং কাদিয়ানীসহ ধর্মবিদ্বেষী যেকোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে যখন ঈমানী অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন, তখন আমিনী সাহেবের সময়ে এমন কোনো ইসলামী আন্দোলন আমরা দেখিনি যে, হক-বাতিলের লড়াই চলছে অথচ তাতে আমিনী (রহ.)-এর কোনো অবদান নেই। সকল আন্দোলনেই ছিলো তার অসামান্য অবদান। এবং আন্দোলনগুলোতে আমরাও সর্বদা তার পাশে থাকাকে সৌভাগ্য মনে করতাম। বিশেষ করে, আমি প্রায় তার সবগুলো আন্দোলনেই পাশে ছিলাম। দেখা যায়, আন্দোলন শুরু হলে আমরা বিভিন্নজন বিভিন্ন দলে বিভক্ত থাকি, কিন্তু আমি আলহামদুলিল্লাহ কোনো আন্দোলনে আমিনী সাহেব থেকে বিভক্ত ছিলাম না। বিশেষ করে, তার তসলিমা নাসরিনবিরোধী আন্দোলনে তার পাশে থেকে কর্মী হিসেবে কাজ করেছি। তেমনিভাবে, কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলনেও তার পাশে থেকে নিরলসভাবে কাজ করেছি। লংমার্চে তার সঙ্গে ছিলাম। এমনকি এদেশে ড. আলি আজগর এবং এনজিওবিরোধী আন্দোলনসহ সবগুলি আন্দোলনে আমি তার একেবারে কাছে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করি। এবং আন্দোলন চলাকালীন তার কিছু স্মৃতি আমার খুব মনে আছে, যা এখনো অনুপ্রেরণা যোগায়।
একবার এনজিওদের সমাবেশ হবে মানিকমিয়া এভিনিউতে। সকাল দশটায়। সমাবেশে কয়েক লাখ নারী-পুরুষের সমাগম হবে। ইসলামবিদ্বেষী ও দেশবিরোধী এ সমাবেশের কথা যখন মুফতি আমিনী জানতে পারলেন, তখন একইদিনে একইস্থানে সকাল নয়টায় ইসলামী মহাসমাবেশের ডাক দিলেন! একইদিন একইস্থানে ইসলাম ও ইসলামবিরোধী পাল্টাপাল্টি ডাকা এই সমাবেশের খবর তখন ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, সুশীল-বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের সর্বস্তরের তৌহিদী জনগণ আমিনীর ডাকা এই পাল্টা সমাবেশের পক্ষাবলম্বন করলেন। আমিনীর ডাকা সমাবেশ তখন গণসমাবেশের রূপ নিলো। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সরকার দিশেহারা হয়ে সমাবেশ স্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে দিলেন এবং উভয়ের সমাবেশ বন্ধ রাখার জন্য চিঠি দিয়ে পাঠালেন। এনজিওরা পিছু হটলো। তবে, মুফতি আমিনী চিঠি হাতে ঘোষণা করলেন, এ সরকার যেহেতু ইসলামী সরকার নয়, তাই তার আনুগত্যও আমার জরুরী নয়। অতএব, তিনি যথাস্থানে যথাসময়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলেই ঘোষণা দিলেন। হয়েছেও তাই। সরকারের ১৪৪ ধারা সরকারেরই থাকলো। এনজিওরাও কেটে পড়লো। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে কয়েক লাখ তৌহিদী জনতার উপস্থিতিতে সমাবেশ সফল ও বাস্তবায়িত হলো। সেদিন সে সমাবেশে হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম আল্লামা আহমদ শফী, পীরসাহেব চরমোনাই এবং ছারছিনার পীরসহ তৎকালীন দেশের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বিগণ উপস্থিত হয়েছিলেন। সকাল নয়টা থেকে আসর পর্যন্ত দীর্ঘ ছিলো সমাবেশ। জুমার নামাজ সবাই মাঠেই আদায় করেছিলেন। মুফতি আমিনীর দৃঢ়তা এবং তার কর্মী ও সহযোগী আলেমদের সাহসিকতা সবই ছিলো লক্ষণীয়। এমন আন্দোলনের মাধ্যমে মুফতি আমিনী (রহ.) আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
তার সঙ্গে প্রায় সব জেলাতেই সফর করেছি। সবচে’ স্মরণীয় সফরের কথা যদি বলি, যখন তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় পটিয়ার শায়খ আইয়ুবের (রহ.) জানাজায় প্যারলে মুক্তি নিয়ে যান। এটাা ছিলো মুফতি আমিনী সাহেবের জীবনের শেষ সফর, আর আমার কাছে অত্যন্ত স্মরণীয় সফর। আমিনী সাহেবের সফরের নিয়ম হলো, তিনি আগে একজন আমির নিয়োগ করতেন। যার তত্ত্বাবধানে পুরো সফরটা পরিচালিত হবে। শেষ সফরেও এ বিষয়টি সামনে আসলো, তখন এ সফরে কাকে আমীর বানানো হবে তা নিয়ে আলোচনা উঠলো। তখন মুফতি আমিনী সাহেব আমাকে আমীর হিসেবে নিযুক্ত করলেন। পরে আমিই চট্টগ্রামে পৌঁছানো পর্যন্ত জামাতকে পরিচালনা করি।
তবে এ সফরের শুরু থেকেই আমার মনে হয়েছে, মুফতি আমিনী বুঝতে পেরেছিলেনÑ এটাই তার জীবনের শেষ সফর। সফরে সঙ্গীদের খোঁজ-খবর, খাওয়া-দাওয়া, আরাম-আয়েশের ব্যাপারে সচেতনতা তার আগে থেকেই। তবে এ সফরে তিনি আরও বেশি ছিলেন। এছাড়াও সঙ্গীদের সঙ্গে বিদায়ী আলোচনাসহ সবকিছুই এখনো আমাদের মনে দাগ কেটে আছে। সে সফরে পথিমধ্যে কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের আগ পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় থেমে থেমে অসংখ্য অপেক্ষমান ভক্ত ও অনুসারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারাও সীমাহীন উৎসাহ-উদ্দীপনায় আলিঙ্গন করে নিয়েছেন মুফতি আমিনীকে। আরও স্মরণীয় মজার ব্যাপার হলো, যখন পটিয়ার জানাজায় উপস্থিত লাখো মুসল্লিদের মাঝে গিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে থাকা সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী তখন হিমশিম খেয়ে গেলো। লাখো তৌহিদী জনতা একসঙ্গে আওয়াজ তুললেনÑ আমিনীর কণ্ঠ শুনতে চাই। আমিনীর চেহারা একবার দর্শন করতে চাই। এমনি এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শেষ হয় চট্টগ্রামের সফর। এটাই ছিলো তার জীবনের শেষ সফর এবং আমার জীবনের স্মরণীয় সফর।
সর্বপ্রথম বলবো- সফরে তিনি যে একজন নেতা আর আমরা তার কর্মী একথা তিনি একদম ভুলে যেতেন। তার উদারতা ও বন্ধুসুলভ আচরণ বিশেষ করে সফরে তার কথাবার্তা থাকতো ইলমি। তিনি আকাবির ও আসলাফদের ঘটনা ও ইতিহাস আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন উন্মুক্তভাবে। আমরা যে কেউ যেকোনো প্রশ্ন করতে পারতাম। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে তার জবাব দিতেন। সফরে বরাবরই তিনি সঙ্গীদের ব্যাপারে সচেতন থাকতেন। একবারের একটি ঘটনা মনে আছে। সম্ভবত পীরসাহেব চরমোনাইয়ের জানাজায় মুফতি আমিনী সাহেবের সঙ্গে যাওয়া। ঢাকা থেকে বরিশালের সফর। প্রথমে আমরা মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় যাই। তারা আমাদের অকল্পনীয় আপ্যায়ন করেন। এখানে এসেও মুফতি আমিনীর ভক্তদের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হই। পরে নির্দিষ্ট সময়ে জানাজায় উপস্থিত হই। জানাজা সেরেই আমরা গাড়ি চেপে মাওয়া আসলাম। ফেরিও রেডি ছিলো। মুফতি আমিনী সম্ভবত আগেই বলে রেখেছিলেন, আমার সঙ্গে মেহমান রয়েছেন সবাইকে খাওয়াতে হবে। তাই ফেরিতে উঠেই দেখি, আমাদের জন্য পদ্মার ইলিশ মাছ ভেজে রেখে দিয়েছেন। পরিমাণ এতো বেশি ছিলো যে, যার যেটা পছন্দ সে সেটা তুলে খাচ্ছে। তেলে ভাজা মচমচে তাজা ইলিশ ইচ্ছেমতো খেলাম। খেতে খেতে মুফতি আমিনী সাহেব আমাদের উদ্দেশ্য করে অনেক সুন্দর সুন্দর হাস্যকর কথা বলতে লাগলেন। আমরা হাসতে থাকলাম।
হুজুরের সফরসঙ্গীদের মধ্যে একজন লালবাগের শিক্ষক ছিলেন, যিনি কাঁটাযুক্ত ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করতেন না বলে ইতস্তত করছিলেন। হুজুর তখন তাকে মাছ খাওয়া শেখাচ্ছেনÑ আরে, তুমি এইভাবে খাও, দেখে-বেছে এভাবে মুখে দাও ইত্যাদি। আমরা দেখে হাসছিলাম। এমনি আনন্দে নিজের অর্থে তিনি আমাদের তৃপ্তি ভরে খাওয়ালেন। হুজুরের সঙ্গে নদীঘেরা পরিবেশে তাজা ইলিশ খাওয়ার এই আনন্দদায়ক ঘটনা আমার কাছে একটি ইতিহাস। এমনিভাবে, শায়খুল হাদীস আজিজুল হক (রহ.) এবং মুফতি আমিনী (রহ.)-এর সঙ্গে চট্টগ্রামের এক সফরে আমরা হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলে ঢুকেই মুফতি আমিনী বলে দিলেন, যার যা রুচি হয় নেবেন। দরকার হয় একেকজনকে একেক আইটেম দেয়া হবে। এই বলে তিনি শায়খুল হাদীস সাহেবকে নিয়ে এক টেবিলে বসলেন। শায়খুল হাদীস সাহেবকেও তিনি বিভিন্ন আইটেম সামনে ধরে ধরে খাওয়াচ্ছিলেন। এভাবে সঙ্গীদের খাওয়া-দাওয়াসহ সকল বিষয়ে মুফতি আমিনীর সচেতনতা ছিলো দেখার মতো।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) একজন আকাবিরের নমুনা ছিলেন। বিশেষ করে যে গুণটি আমাকে মুগ্ধ করছে সেটি ছিলো তার আপসহীনতা। দুনিয়ার কোনো মোহ তাকে তার আদর্শ থেকে নড়াতে পারতো না। জেলখানায় নিয়েও পারেনি। গৃহবন্দি রেখেও কেউ না। কোনো মহামূল্য প্রস্তাবেও তার আদর্শের বিচ্যুতি ঘটতো না। তার এই স্বভাবটি আমাকে মোহিত করে।
ইসলাম ও ধর্মীয় আদর্শের বিপক্ষ শক্তিকে তিনি কখনো আপসে আনতেন না। তবে ব্যক্তি হিসেবে সকলের সঙ্গে তার আখলাক ছিলো নমনীয়। যেমন, আমরা একবার কোথা থেকে যেনো আসতেছি, পথিমধ্যে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হয়। কাদের সিদ্দিকী তখন তাকে স্বাগত জানালেন। বাসায় নিয়ে গেলেন এবং আপ্যায়ন করলেন। শেষে একটি গামছাও তাকে উপহারস্বরূপ দিলেন। মুফতি আমিনী সাহেবও তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করলেন। এভাবেই দল-মতে ভিন্নতা থাকলেও মুফতি আমিনী (রহ.) ব্যক্তিগতভাবে কোনো ইতস্তত করতেন না।
গ্রেফতার ও জেল-জুলুম
বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও ২০০১- এর গ্রেফতারের বিবরণটা এখানে দেওয়া যাচ্ছে না, সন্দেহমুক্ত তথ্যের অপ্রতুলতার কারণেই। মৌখিক ও অনুমাননির্ভর বর্ণনাটা এক্ষেত্রে আমি যথার্থ মনে করছি না। তবে হয়রানিমূলক মামলার ধরন কী, এই বরেণ্য আলেমকে কীভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিলো, কেমন জুলুম ও বর্বর আচরণ তার সাথে করা হয়েছে- ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার গ্রেফতারের এই বিবরণ থেকেও আপনি মোটামুটি ধারণা পাবেন। এই মেয়াদে ১১ দিনের মাথায় মুক্তি পেলেও ২০০১- এ প্রথম মেয়াদে তাকে আটকে রাখা হয়েছিলো চার মাস চার দিন। রংপুর কারাগার থেকে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে লেখা মহান নেতা মুফতি আমিনী সাহেবের চিঠি থেকেও এ বিষয়ে পরিষ্কার একটা ধারণা পাবেন, যা বইয়ের শেষ দিকে ৫ নং পরিশিষ্টে যুক্ত করা হয়েছে। অধুনালুপ্ত লালবাগ জামিয়ার মাসিক ম্যাগাজিন ‘তরজুমানে ইসলাম’ এর সৌজন্যে ২০০৯-এর গ্রেফতারের বিবরণ এখানে তুলে ধরছি-
‘২০০৯-এর ১মে সন্ধ্যায় ঘড়ির কাঁটা যখন সাতটার ঘরে, হঠাৎ খবর পাওয়া গেলো বড় কাটারা মাদ্রাসায় কে বা কারা বোমা হামলা করেছে। এতে মাদ্রাসার দশ বার জন ছাত্র আহত হয়েছে। খবর শুনে লালবাগ মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকসহ ঢাকা ও সারাদেশের কওমি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। আহত ছাত্রদের তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলসহ স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর এমন অতর্কিত বোমা হামলার ঘটনা নিয়ে কাটারা মাদ্রাসার শিক্ষকগণ থানায় মামলা করতে গেলে কর্তব্যরত লালবাগ থানার ওসি জানান আপনাদের মামলা নেয়া হবে না। কারণ আপনাদের বিরুদ্ধেই কাটারায় বোমা হামলার মামলা করেছে আকবর হোসেন নামের একজন। সেখানে মুফতি আমিনীসহ আরো নয়জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন কাটারা মাদ্রাসার শিক্ষকগণ। তারা তখন একটি জিডি করে রাখার অনুরোধ জানান। মুফতি আমিনীও এরকম মিথ্যা-বানোয়াট-উদ্ভট মামলার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যান। তারপর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি জামিন নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৭ মে কী ঘটেছিলো?
সকাল ৯টায় মুফতি ফজলুল হক আমিনী ঢাকা সি এম এম কোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার জন্য লালবাগের বাসভবন থেকে রওয়ানা হন। কোর্টে পৌঁছান বেলা নয়টা ত্রিশ মিনিটে। সেখানে আইনজীবী এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহসহ প্রায় অর্ধশত আইনজীবী মুফতি আমিনীকে স্বাগত জানান। এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া জানান, তার মামলা কোর্টে উঠবে বেলা এগারোটা ত্রিশ মিনিটে। এই কথা শুনে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু বেলা এগারটায় জানানো হয় মামলার সময় পিছিয়ে দুইটা ত্রিশ মিনিটে ধার্য করা হয়েছে। মুফতি আমিনী তখন তার বাসভবনে ফিরে আসেন। এদিকে কাটারা মাদ্রাসা দখলকারীরা মাদ্রাসার শিক্ষকদেরকে ফোনে নানা কথা বলে হুমকি দিতে থাকেÑ আজকে তোদের শেষ দিন। তোদের নেতার দিন শেষ। এখন আমরা দখলে নেবো কাটারা মাদ্রাসা। এরকম নানা হুমকি- ধামকি দিচ্ছিলো। মুফতি আমিনী বাসায় আসার পথে ফোনে কাটারা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন হুমকির কথা শুনতে পান। তিনি তাদেরকে হুমকির জবাবে কিছু না বলার পরামর্শ দেন। বাসায় ফেরার পর তার পরিচিত কয়েকজন সাংবাদিক তাকে ফোন করে জামিনের ব্যাপারে জানতে চান। অন্য সময় সাধারণত এমন হয় না। তিনি কোর্টে গেলে নিয়মমাফিক পত্রিকার রিপোর্টাররা কোর্টে নিউজ সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। সিনিয়র সাংবাদিকদের এমন রহস্যজনক ফোনের পর তিনি খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। নিজের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, এ মামলায় গ্রেফতার করার কোনো সম্ভাবনাই নেই; জামিন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সরকার পক্ষ যেহেতু তার প্রতি বিরাগভাজন, তাই কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই তিনি জোহরের নামাযের পর আবার রওয়ানা হন কোর্টের উদ্দেশে। মামলা শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগেই তিনি কোর্টে পৌঁছে যান। কোর্ট প্রাঙ্গণে পৌঁছার পর দেখা যায় ভিন্ন দৃশ্য। শতশত পুলিশ ঘিরে রেখেছিলো পুরো কোর্ট প্রাঙ্গণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা আগে থেকে অপেক্ষা করছিলো। এছাড়া পুলিশ সেখানে প্রিজন ভ্যান প্রস্তুত করে রাখে। এসব আলামত দেখে স্বভাবতই সবার মনে প্রশ্ন জাগে, সবই কি তা হলে পূর্বপরিকল্পিত ছিলো? সরকার তাকে গ্রেফতারের জন্যই কি এই জামিন মামলার নাটক সাজিয়েছে? মুফতি আমিনী গাড়ি থেকে নামতেই সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু পুলিশ সুযোগ দেয় নি। পুলিশ বাহিনী তার গাড়ি থেকে একদম চার তলার আদালতের এজলাস পর্যন্ত দুই সারিতে দাঁড়িয়েছিলো। কারো সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে সোজা তাকে ম্যাজিস্ট্র্যাটের এজলাসের দিকে নিয়ে যায়। এসময় তিনি বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মুফতি আমিনীর আইনজীবীগণ কোর্টের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি সেখানে পৌঁছতেই তারা তাকে নিয়ে এজলাসে প্রবেশ করেন। এসময় আদালতের বাইরের প্রাঙ্গণে দাঁড়ানো দলীয় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। পুলিশের এমন আচরণে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন তারা। পুলিশের এহেন ন্যক্কারজনক আচরণে উদ্বিগ্নও হয়ে পড়েন। অন্যসময় মুফতি আমিনীর একান্ত সহকারী বা তার ছেলেকে আদালতের এজলাসে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হলেও এবার সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাকে একাই ভিতরে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। এমনকি এই মামলার অন্য দুই আসামি মাওলানা কামাল উদ্দিন সালেহ ও হাফেজ বদরুল ইসলামকেও এজলাস থেকে অন্যত্র সরিয়ে রাখা হয়। বেলা দুইটা ত্রিশ মিনিটে এজলাসে প্রবেশ করলে তাকে এক ঘন্টা বিনা কারণে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো।
অমানবিকতার নমুনা
মুফতি আমিনী একজন অসুস্থ মানুষ। একটু পর পর পানি খেতে হয়। ক্রমাগত পান খাওয়া তার অভ্যাস। কিন্তু সরকারের পোষা পেটুয়া বাহিনী এক ঘন্টা এবং মামলা চলাকালীন আধা ঘন্টা সময়ও তাকে এক বোতল পানি বা একটি পান খেতে দেয়নি। মুফতি আমিনীর একান্ত সহকারী আলতাফ হোসাইন বলেন- আমরা পুলিশকে বহুবার অনুরোধ করেছি, বারবার বলেছি হুজুর অসুস্থ; তার পানির প্রয়োজন- অন্তত এক বোতল পানি পৌঁছে দিন। কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা রাখে নি। শুধু বলেছে- উপরের নির্দেশ আছে ভেতরে হুজুরকে কিছু দেওয়া যাবে না। এসময় হুজুর বারবার দরজার দিকে তাকিয়ে পানির জন্য ইশারা করছিলেন, কিন্তু পুলিশ আমাদেরকে পানি পৌছাতে বাধা দিচ্ছিলো। এই দৃশ্য দেখে হুজুরের দুই ছেলে আবুল ফারাহ ও আবুল হাসানাতসহ সেখানে উপস্থিত অন্যান্য নেতা কর্মীরা প্রচন্ড ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হন। মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে অকারণে একঘন্টা আদালতে বসিয়ে রাখার পর সাড়ে তিনটায় বিচার কাজ শুরু করেন ম্যাজিস্ট্রেট তোফায়েল হাসানাত। প্রথমে মুফতি আমিনীর আইনজীবী এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন- এ মামলার বাদী আকবর হোসেন, যার কোনো হদিসই নেই। তিনি মামলা করার সময় এজাহারে যে ঠিকানা দিয়েছেন, খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে সেখানে এই নামে কেউ বসবাস করে না। বলা হয়েছে শ্রমিক লীগের নেতা। কিন্তু শ্রমিকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এই নামে তাদের কোনো নেতা নেই। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে এটি একটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও বানায়োট এবং ভিত্তিহীন মামলা। এমন দাবি করে এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া আমিনী সাহেবের জামিন আবেদন করেন। এ যুক্তিতর্কের বিপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হাস্যকর এবং ভুল তথ্য পরিবেশন করেন। সেই প্রেক্ষিতেই ম্যাজিস্ট্রেট জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে মুফতি আমিনীকে কারাগারে পাঠানোর রায় ঘোষণা করেন। এই সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার নেতাকর্মী ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
মুফতি আমিনীকে নিচে নিয়ে আসা হলে তিনি সবাইকে শান্ত এবং আল্লাহর উপর আস্থা রাখার কথা বলেন। এসময় পুলিশের আচরর ছিলো জঘন্য ও অসৌজন্যমূলক। তারা মুফতি আমিনীকে চার তলা থেকে সোজা নামিয়ে নিয়ে আসে। অথচ তিনি অসুস্থতার কারণে একতলা পর পর থেমে থেমে উঠেন। তার দুই ছেলে এবং একান্ত সচিব এর প্রতিবাদ করলে পুলিশ তাদের উপর চড়াও হয়। মুফতি আমিনীকে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় সাংবাদিকরা তাকে একটু পেছনে তাকাতে বলেন যাতে তারা শেষ মুহূর্তের ছবিটি তুলতে পারে এবং তা জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারে। তিনি পিছন ফিরতে যাবেন এমন সময় ভেতরে থাকা পুলিশ টেনে তাকে ভিতরে নিয়ে যায়। এবং ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি ছেড়ে দেয়। সেখান থেকে মুফতি আমিনীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশের এই সত্যকন্ঠকে গ্রেফতারের খবর দ্রুত বেতার টেলিভিশন ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। গ্রেফতারের প্রতিবাদে তৎক্ষণাত মুক্তাঙ্গনে এক বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মুফতি আমিনীর নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। চারদলীয় ঐক্যজোটের শীর্ষ নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া মুফতি আমিনী গ্রেফতারের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন- আওয়ামীলীগ তার চিরাচরিত চরিত্র প্রকাশ করেছে। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য ঘৃণ্য ষড়যন্তে লিপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন মুফতি আমিনীর গ্রেফতারের নিন্দা ও তার মুক্তির দাবি জানায়। দীর্ঘ ১১টি দিন বয়োবৃদ্ধ এই নেতাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কারাগারে আটকে রাখার পর অবশেষে জামিন দেওয়া হয়।
ফতোয়া-আন্দোলন (২০০১-২০১১ ইং)
জুবায়ের আহমদ
প্রাক কথন
ইসলামের সূচনা থেকেই ইসলামবিরোধীরা তার মূলে কুঠারঘাত করতে শুরু করেছিল। কখনো ইসলাম নামক বৃক্ষের শিকড় উপড়ে ফেলতে সর্বশক্তি ব্যয় করেছে, আবার কখনো তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ভেঙ্গে দিয়ে তাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। কিন্তু সব সময়ই ইসলাম নামক বৃক্ষের ছায়াতলে এমন কিছু মর্দ্দে মুজাহিদ ছিলেন যাদের কারণে শত্রুরা তার শিকড় কখনো উপড়ে ফেলতে পারেনি ।
যুগের সেই সব মহাপুরুষ, যারা ইসলামের জন্য নিজেদের সর্বস্বকে বিলীন করে দিয়ে জালিম শাহীর সামনে বুক চিতিয়ে সত্য কথা বলে, জুলুম নির্যাতন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে জেল-জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করে গুম, হত্যা ও ফাঁসীর মঞ্চকে উপেক্ষা করে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে নিজেদের নাম লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে শহীদ আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহমাতুল্ল¬াহি আলাইহি ছিলেন অন্যতম। সেই বিপ¬বী মহাপুরুষ, মজলুম জনতার মুক্তির দিশারীর সংগ্রামী জীবন থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের সর্বালোচিত ফতোয়া আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সামান্য আলোচনা করব ইনশাআল্ল¬াহ।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
বিগত ১-০১-২০০১ খ্রি. বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার ডিভিশন বেঞ্চ থেকে নওগাঁ জেলার কীর্তিপুরের আতিয়া নামক গ্রামের একটি ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট ঘোষণা করে যে, ‘সকল প্রকারের ফতোয়া অবৈধ ও দ-নীয় অপরাধ’।
এই রায় ঘোষণার পর বাংলার আলেম-ওলামা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু আদালতের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো দুঃসাহস কারো হচ্ছিল না। শহীদ মুফ্তী ফজলুল হক আমিনী (রহ.) সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হলেন, ওলামাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে প্রায় অনেকেই জবাবে বললেন, আমিনী সাহেব এটা তো কোর্টের ব্যাপার। আমিনী সাহেব বলেছিলেন রাখেন আপনাদের কোর্ট! আমি ফতোয়া দিচ্ছি আপনারা আমার পাশে থাকবেন। আমার জন্য দোআ করবেন।
ফতোয়া রক্ষার পাল্টা ফতোয়া
পরদিন পত্র-পত্রিকার পাতায় ইসলামী আন্দোলনরত অনেক আলেম-ওলামা এবং বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদগণের বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছিল। কারো বিবৃতি দ্বারা কেউ প্রভাবিত হয়নি, কারো বিবৃতি দ্বারা দেশে আগুন দূরে থাক ধোঁয়াও ওড়েনি। কিন্তু শহীদ আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)-এর বিবৃতি ও বক্তব্যে সারা দেশে আগুন জ্বলে ওঠে। দেশের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে কাঁপিয়ে দেয় তার বিবৃতি এবং বক্তৃতা। তিনি বলেছিলেন ইসলাম ও কুরআনের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে বিচারপতি দুজন মুরতাদ হয়ে গেছেন। অর্থাৎ তারা ইসলামের গ-ি থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে গেছেন। এখন যদি তারা তাওবা না করে তা হলে তাদের ফাঁসি দিতে হবে। সাথে সাথে এই কুখ্যাত রায় বাতিল করতে হবে।
আন্দোলনের সূত্রপাত
তারপর তিনি হাইকোর্টের এই কুখ্যাত রায় বাতিল এবং মুরতাদ দুই বিচারপতির ফাঁসির দাবিতে একটি গণ-আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ২ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক মহাসমাবেশ আহ্বান করেন। এই মহাসমাবেশ সফল করার লক্ষে সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরাম ও পীর মাশায়েখের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। এমনিতেই প্রবীণ আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখ হযরত আমিনী সাহেব (রহ.)-কে অত্যন্ত স্নেহ ও মুহাব্বতের দৃষ্টিতে দেখতেন। আর তাঁর সমবয়সী এবং তাঁর ছোটরা তাকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে তার কথা মানতেন। অপরদিকে মাত্র ২৪/২৫ দিনে সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় তিনি নিজে সফর করে বাংলার তাওহিদী জনতাকে ইসলামের পক্ষে, ফতোয়ার পক্ষে বুঝাতে লাগলেন। এই কুখ্যাত রায়ের বিরুদ্ধে দেশময় বড় বড় সভা সেমিনারে তিনি অগ্নিঝরা বক্তৃতার মাধ্যমে সারাদেশে আগুন জ্বালিয়ে দেন। যার কারণে বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে এই কুখ্যাত রায় বাতিল এবং মুরতাদ বিচারকদের ফাঁসির শ্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। সর্বস্তরের হক্কানি ওলামায়ে কেরাম এবং পীর-মাশায়েখ সকলে এসে হযরত আমিনী সাহেব (রহ.)-এর কাছে জিহাদের বায়আত নিচ্ছিলেন। তখনই গঠন হল ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটি। এই কমিটির সংগ্রামী আমির হিসাবে সকলেই বিনাবাক্যে শহীদ আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)-কে মেনে নিলেন। কেনো মানবেন না? তাঁর ভিতরে মুজাহিদে আজম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী এবং মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) মুহাব্বত ও বারাকাতের ঈমানী শক্তি ও সাহস জন্মেছিল, সেই জজবা ও চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। ফলে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হতে কেউ আসেননি, তাকেই বসতে বাধ্য করা হয়েছিল।
বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা
মুফতি আমিনী সাহেব (রহ.) সারাদেশে যে সকল ভাষণ প্রদান করছিলেন, তার কয়েকটি নমুনা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই। তিনি বলতেন ‘পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, হে নবী আপনি বলুন আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে ফতোয়া দিচ্ছেন।’ আর বাংলাদেশের আদালতে দুজন বিচারপতি রায় ঘোষণা করেছে সর্ব প্রকার ফতোয়া অবৈধ ও দ-নীয় অপরাধ। তা হলে এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের আদালতে আল্লাহর বিচার করা হবে। আপনারা কি তা সহ্য করতে পারবেন?
তিনি আরো বলতেন, ‘সরকার আমার নামে মামলা করেছে, আমি নাকি আদালত অবমাননা করেছি। আমি কখনো আদালত অবমাননা করিনি। তোমরা কুরআনের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে, ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে আদালতকে অপবিত্র করেছ আর আমি আদালতকে পবিত্র করার পন্থা বলে দিয়েছি। আমি বলেছি, এই রায় বাতিল করে দুই বিচারপতিকে ফাঁসি দিলে আদালত পবিত্র হবে। সুতরাং আদালত অবমাননা তোমরাই করেছ, আমি করি নাই।’
তিনি আরো বলতেন, ‘বাংলার মানুষ ঈমান, ইসলাম, কোরআন প্রিয় মানুষ, ঈমান আক্বীদা শিক্ষা করার জন্য যদি তারা তুরাগ নদীর তীরে সমবেত হতে পারে তা হলে ইসলাম ও কুরআন হেফাজতের জন্য কি তারা ২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সমবেত হতে পারে না। অবশ্যই পারে। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি ২০১১ইং রোজ শুক্রবার ঢাকার পল্টন ময়দানে ঈমান, ইসলাম, ফতোয়া ও কুরআন হেফাজতের জন্য নিজ খরচে কারা কারা যেতে প্রস্তুত আমি দেখতে চাই।
তিনি বলতেন, বর্তমান সরকারের এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে নফল হজ্জ্বের সওয়াব পাওয়া যাবে। কারণ ইমাম আবু হানিফা (রহ.) খেলাফতে আব্বাসীয়ার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে বলেছিলেন, ‘খেলাফতে আব্বাসীয়া যে কুকর্ম করছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে নফল হজ্জ্বের সওয়াব হবে।’ আর এখন কিন্তু কম হচ্ছে না। আমি ফতোয়া দিয়ে গেলাম, কোনো আলেম যদি এর বিপক্ষে ফতোয়া আনতে পারে তা হলে সে হাজির করুক।
এ জাতীয় ভাষণ শুনে সকল মুমিনের হৃদয়ের মাঝে ইসলামের জন্য শাহাদাতের তামান্না প্রবল থেকে প্রবলতর হলো। সকলেই তারিখের অপেক্ষায় রইল। অনেকে তো ২ তারিখের আগেই ঢাকা চলে আসল। এভাবে আস্তে আস্তে আশা শুরু হলো। নিজেদের মনে আশা, ইসলামের জন্য কিছু করে আল্লাহর দরবারে উসিলা হিসাবে পেশ করবেন।
পল্টনমুখী জনসমুদ্র
দেখতে দেখতে ২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার এসে গেলো। সকাল বেলা থেকেই মানুষের উপস্থিতি শুরু হলো। বেলা ১১টার দিকে পল্টন ময়দান লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। হযরত হারুন ইসলামাবাদীর (রহ.) ইমামতিতে উপস্থিত জনতা জুমার নামাজ আদায় করল। জুমার পর মহাসমাবেশ শুরু হলো। সূচনাতেই ওলামা এবং তাওহিদী জনতার আগমনে পল্টন ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। হযরত আমিনী সাহেব (রহ.)-ও এসে উপস্থিত হলেন। তার আগমনের সময় উপস্থিত জনতা ‘নারায়ে তাকবীর, আল্ল¬াহু আকবার, মুফতি আমিনী ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ ইত্যাদি শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলল।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাওহিদী জনতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকল। আস্তে আস্তে পল্টন ময়দানের আশপাশের এলাকাও লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। শুধু টুপি আর টুপিই দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ মহাসমাবেশ চলাকালে হযরত আমিনী সাহেব মাইকে একটি দুঃসংবাদ দিলেন, গাজীপুর চৌরাস্তা এবং কাঁচপুরে দেশের প্রত্যন্ত স্থান থেকে মহাসমাবেশের উদ্দেশ্যে আগত শত শত বাস সরকারি বাহিনী এবং সরকার দলীয় লোকেরা আটকে দিয়েছে। সে সকল মানুষ আমাদের কাছে আসতে পারছে না।
ঐতিহাসিক ভাষণ
সেই মহাসমাবেশে হযরত মুফতি (রহ.) যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন তার কিছু এখানে তুলে ধরা হলোÑ
তিনি বলেন, আজকের এই সমাবেশ বাংলাদেশের রাজনীতির মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে। তিনি মঞ্চের দিকে ইশারা করে বলেন। আগামী সংসদ সদস্যদের মঞ্চকে আপনারা ভালোভাবে চিনে রাখুন। যে দুই বিচারপতি ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করেছে, অচিরেই তাদের ফাঁসির রায় দিতে হবে এবং ফতোয়া বিরোধী রায় বাতিল করতে হবে। ফতোয়া ছিল ফতোয়া আছে ফতোয়া থাকবে, ফতোয়াই হবে সংবিধান। যেই ফতোয়াকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি পরিষ্কার ভাষায় বলছি এই ফতোয়াই হবে বাংলাদেশের একমাত্র আইন। আর এই আইনের দ্বারা সর্বপ্রথম বিচার করা হবে গোলাম রাব্বানী এবং নাজমুন আরা সুলতানার। এন.জি.ও.রা সরকারের সহযোগিতায় আগামী কাল ৩ ফেব্রুয়ারি মহাসমাবেশ আহ্বান করেছে। আমরা প্রতিরোধ করার জন্য আগামী কাল হরতাল ঘোষণা করলাম। তিনি আরো বলেন, জনকণ্ঠ পত্রিকা, ইসলামবিরোধী পত্রিকা, আলেম-ওলামাকে ফতোয়াবাজ বলে গালি দেয়। আমাকে ফতোয়াবাজ বলেছে। জনকণ্ঠকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। সর্বশেষ তিনি বলেন- বদরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬ামের যে বিজয় হয়েছিল, আজ আমাদের সেই বিজয়ের সূচনা হয়েছে। ইনশাআল্ল¬াহ আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে সেই বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে বাংলাদেশের সংসদে, বঙ্গভবনে, বাংলাদেশের সমস্ত স্তরে ইসলামের বিজয় পতাকা ওড়াতে হবে। এর জন্য শহীদ হতে কারা কারা রাজি আছেন?…
মহাসমাবেশ শেষে পরদিনের হরতাল সফল করার লক্ষ্যে বিশাল মিছিল বের হলো। মিছিল এগোতে থাকলে সরকারি পেটুয়া বাহিনী মিছিলের ওপর হামলা চালায়। তবে কেউ পিছু হটে নি বা পালিয়ে যায় নি। ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য এসে ঈমানী পরীক্ষায় সকলেই পাশ করলেন, উত্তীর্ণ হলেন।
হরতালের কর্মসূচি এবং কারাবরণ
পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই হরতাল সফলের জন্য মিছিল শুরু হয়ে গেল। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলোসহ সারাদেশে ওলামা-তোলাবা এবং তাওহিদী জনতা ব্যাপকভাবে পিকেটিং করেছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে হযরত মুফতি আমিনী (রহ.)-কে এবং রাতে হযরত শায়খুল হাদীস আল্ল¬ামা আজিজুল হক সাহেব (রহ.)-সহ অনেক ওলামায়ে কেরামকে সরকার গ্রেফতার করে। শায়খুল হাদীস (রহ.)-কে প্রথমে বরিশাল পরে ঢাকা এনে রাখে। কিন্তু হযরত আমিনী সাহেবকে রংপুর কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে পৈশাচিক বর্বরতা
৫ ফেব্রুয়ারি শায়খুল হাদীস (রহ.) ও মুফতি আমিনী (রহ.)-সহ সকল ওলামায়ে কেরামের মুক্তি এবং ফতোয়ার রায় ঘোষণার দাবিতে মুফতি আমিনীর জন্মস্থান, ঈমান, মুজাহিদ ও আলেম ওলামার শহর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওলামায়ে কেরাম ৬ ফেব্রুয়ারি হরতাল ঘোষণা করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি শান্তিপূর্ণ হরতালে সরকার বিদেশি হিন্দু, খ্রিস্টান প্রভুদের খুশি করার জন্য দেশের সীমান্ত প্রহরী মানুষরূপী হায়েনাদের মাধ্যমে গুলি করে ৬ জন হাফেজে কুরআনকে শহীদ করে। এদেশে ফতোয়ার জন্য ৬জন শহীদ হতে হলো কেনো? তখন কি ক্ষমতায় মুসা আ.-এর যামানার ফিরাউন ছিল, না ইব্রাহীম আ.-এর যুগের নমরুদ ছিল, না আসহাবে কাহাফের যুগের সেই নিষ্ঠুর বাদশাহ ছিল- কে দেবে জবাব?
তারপর ও কি আমাদের বিবেক খুলবে না? হায় আফসোস, হায় আফসোস, সাধারণ জনগণের কথা কী বলব। আলেম-ওলামাও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, ধিক! এই সকল আলেমদের ওপর। আল্ল¬াহ তাদের প্রতি রহম করুন। শায়খুল হাদীস (রহ.) ও মুফতি আমিনী (রহ.) দীর্ঘ ৪ মাস পর কারা নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলেন। তারপর নির্বাচন হলো। ক্ষমতারও রদবদল হলো।
অবশেষে সাফল্য
দীর্ঘ ১১ বৎসর পর ১২-০৫-২০১১ তারিখ সুপ্রিম কোর্টে আপিলের কারণে রায়টি নিয়ে পর্যালোচনা শুরু হয়। তখনও ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি রাজপথে নেমে আসে। ফলে আদালত ফতোয়ার পক্ষে রায় দিতে বাধ্য হয়। ফতোয়ার রায় ঘোষণার সময় আল্লামা শহীদ মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) গৃহবন্দি ছিলেন। লালবাগ মাদ্রাসার দারুল হাদীস কক্ষে তিনি শুকরিয়া মাহফিল আয়োজন করেন। তাতে তিনি বলেন আমাদের কাজ হচ্ছে লেগে থাকা ও দুআ করা আর আল্ল¬াহর কাজ হচ্ছে তা পূর্ণ করা। আমরা দীর্ঘ এক যুগ পূর্বে ফতোয়া আন্দোলন শুরু করেছিলাম। আর এখন তা কামিয়াব হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমরা অন্যান্য আন্দোলনেও কামিয়াব হব।
কোন পথে হাঁটছি আমরা?
আজ সেই মহান পুরুষ, সিপাহসালার, আমাদেরকে এতিম করে চলে গেছেন। আমরা আজ সত্যিই নেতা ও রাহবার হারা। গত কদিন পূর্বে মিরপুর স্টেডিয়ামে খেলার সূচনা করার জন্য ৪ ধর্মের গ্রন্থ পাঠ করে কুরআনকে অবমাননা করা হয়েছে। সেখানে উলঙ্গ বেহায়া, নির্লজ্জ নারীদের দ্বারা প্রকাশ্য নাচ গান প্রদর্শন করা হয়েছে। আফসোস, কোনো নেতাই তো কিছু বললেন না। কোন পীরও তো খানকাহ থেকে বের হলেন না। আহ, যদি তিনি থাকতেন তা হলে অবশ্যই তার ঈমান, জিহাদী চেতনা তাকে নির্বাক বসে থাকতে দিতো না। আজ আমরা মুফতি আমিনীর (রহ.)- অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছি।
ফতোয়া ও অর্থনীতি: প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা
বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি-আন্দোলনে অসামান্য অবদান এবং তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার কারণে মুফতি আমিনীর মৌলিক ইলমি অবদান প্রায় পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে। কাছের মানুষদের কাছে তার ইলমি ও আমলি পরিচয়টাই বড় ছিলো। তিনি উপমহাদেশের প্রথম সারির এবং প্রথম দিকের একজন মুফতি ছিলেন। গৌরবময় ছাত্রজীবন শেষে সত্তুর দশকের শুরু থেকেই তার ইলমি খেদমতের সূচনা ঘটে। আদর্শ ছাত্র তৈরি এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনে ইসলামের যাবতীয় বিধান নিয়ে সময়োপযোগী, যথার্থ ও চ্যালেঞ্জিং অজ¯্র ফতোয়া তিনি প্রদান করেছেন। ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় কোনো ব্যাপারই তার ফতোয়ার আওতার বাইরে ছিলো না; যোগ্যতা, সাহস ও তাৎক্ষণিকতায় তার সমতুল্যও কেউ ছিলো না। আজীবন তিনি নিজেও শিক্ষক ও ইলমের সাধক পরিচয়েই স্বস্তি বোধ করতেন। তার ইলমসাধনা, বিশেষত ফতোয়া ও অর্থনীতিতে তার অবদান বিষয়ে গতানুগতিক আলোচনায় না গিয়ে বরং বাংলাদেশের এই সময়ের স্বনামধন্য ক’জন মুফতির বিশ্লেষণ তুলে ধরাটাই যথার্থ মনে করছি।
শুরুতেই অর্থনীতি ও ফতোয়া বিষয়ে ইতিহাসভিত্তিক একটি পর্যালোচনা থাকলো তরুণ আলেম এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনীর শেষ জীবনের ¯েœহভাজন ছাত্র মাহমুদুল হাসান আরাবীর সৌজন্যে। ‘মুফতি আমিনী (রহ.) ও আধুনিক অর্থনীতিভাবনা’ শিরোনামের নিবন্ধে তিনি লেখেন- ‘সমাজবদ্ধ মানুষের পরিধি যখন থেকে বাড়তে শুরু করলো, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সমস্যার মতো অর্থনৈতিক সমস্যাও ব্যাপক আকার ধারণ করলো তখন থেকেই। প্রাচীন গ্রীক, রোমান ও চীনা সভ্যতা এবং ইসলামপূর্ব রোম ও পারস্য সভ্যতা; রঙ, বর্ণ ও নতুনের নির্মাণে এবং প্রাণ-ঐশ্বর্য ও সার্বিক উন্নয়নে প্রতিটি সভ্যতার সাফল্যের পাল্লাই নিজ নিজ সময়ে ছিলো আকাশচুম্বী। রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এসবক্ষেত্রে প্রতিটি সভ্যতাই স্বাতন্ত্র্যে ভরপুর ছিলো। ছিলো প্রাচুর্যময়। তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিলো। তাতে সমস্যা ছিলো। পূর্ণ হোক বা অপূর্ণ, কোনো না কোনো সমাধানও ছিলো নিশ্চয়ই!
প্রাচীন সভ্যতার অর্থনীতি, অর্থনৈতিক সমস্যা ও সমাধান আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। উদ্দেশ্য হলো, কালের যাত্রায় হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি সভ্যতা তার যাবতীয় সমস্যার সাথে সাথে অর্থনীতিসংক্রান্ত সমস্যায়ও সমানভাবে আক্রান্ত ছিলো। তবে, কৃষিভিত্তিক সে সব অর্থনৈতিক সভ্যতার সমস্যাবলি তেমন জটিল ছিলো না। যতোটুকু জানা যায়, দাসপ্রথায় আবর্তিত সে সব সভ্যতাসমূহের প্রধানতম খাসলত ছিলো, ভোগ-বিলাস, আমোদ-প্রমোদ, আলস্য ও কর্মবিমুখতা। তাই, কৃষির উন্নয়নে, প্রযুক্তিগত আবিষ্কারে তাদের ছিলো বেজায় অনীহা। সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের জন্য তো বৃহৎ কোনো পুঁজির প্রয়োজন পড়ে না। তাই সুসংগঠিত বৃহৎ কোনো পুঁজির সমাহারও ছিলো না। ফলে গড়ে উঠতো না সামাজিক কোনো বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এসব অর্থব্যবস্থায় তাই ছিলো না খুব বড় কোনো সমস্যাও। সরকারগুলোরও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে কোনো নীতিমালা তৈরির প্রয়োজন পড়েনি । প-িতগণও ছিলেন নিরব। মজার ব্যাপার হলো, তৎকালীন প্রতিটি সভ্যতার ধ্বংসের জন্য অর্থনৈতিক সমস্যাকেই দায়ী করা হয়। যেহেতু অর্থনীতির একমাত্র চালিকা শক্তি ছিলো কৃষি খাত, যুদ্ধবিগ্রহ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে অথবা ভোগে মত্ত ভূস্বামীদের অনাগ্রহের কারণে কৃষি খাতে বিপর্যয় নেমে আসলে তা মোকাবেলার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে হতে এক সময় সভ্যতাগুলোই বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতো।
খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইসলামের আগমন মানবেতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা-যা তর্কাতীতভাবে সত্য। ইসলাম তার পূর্বাপর প্রত্যেকটা সভ্যতার মাঝে টেনে দিয়েছিল সরল সীমান্তরেখা। বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলো সর্বোত্তম এক জীবনাদর্শ। ব্যক্তি, পারিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন জীবনাচারের মত অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দিয়েছিলো স্বতন্ত্র এক দিকদর্শন । আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন, সুদকে করেছেন হারাম। এই প্রত্যাদেশকে সামনে রেখে ইসলাম পূর্ববর্তী কৃষিভিত্তিক অর্থব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে গড়ে তুলেছিলো অভূতপূর্ব নতুন এক সভ্যতাÑ বাণিজ্যসভ্যতা । ইউরোপের লোকেরা যখন একটা কাষ্ঠখ-ও ভাসাতে জানতো না, মুসলিম ব্যবসায়ীরা হাজার জাহাজের বহর পরিচালনা করতো ভূমধ্য সাগর, লোহিত সাগর, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে। মুসলিম ব্যবসায়ীদের নৌ-বাণিজ্যের বিস্তৃতি ছিলো বার্সেলোনা, ইডেন, আলেকজান্দ্রিয়া, জেদ্দা ও চট্রগ্রামসহ তৎকালীন নামকরা নৌ বন্দরসমূহে । মক্কা, মদিনা, বাগদাদ ও দামেস্ক নগরী তখনকার জমজমাট বাণিজ্য শহর। শিল্প বিপ্লবপূর্ব (১৭৭৯) পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণকারী এই সভ্যতাই ছিলো বিপ্লবপরবর্তী প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির নির্দেশক। পৃথিবীশ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদগণ দেরিতে হলেও আজ তা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
শিল্প বিপ্লবোত্তর বিশ্বে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে যায়। নতুন নতুন সংজ্ঞা, ধারা-উপধারা বিশ্লেষিত ও সংযোজিত হতে থাকে অর্থনীতির ভাষাÑপরিভাষায় । ইসলামের দেখানো বাণিজ্যধারার পথ ধরে বিশ্ব প্রবেশ করে নতুন আরেক অর্থনৈতিক সভ্যতায়, যা ওপেন মার্কেট ইকোনমিকস বা মুক্তবাজার অর্থনীতি হিসেবে খ্যাত। সমাজে স্থায়ী আসন করে নেয় গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি । বিংশ শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে বিশ্বকে শাসন করেছে এই অর্থনৈতিক মতবাদ দুটি। ইতিহাসের আড়ালে পাথরচাপা পড়ে যায় বিশ্বকে সর্বপ্রথম মুক্ত বাণিজ্যের পথ দেখানো সর্বাধুনিক ইসলামী সাম্যবাদী অর্থব্যবস্থা। অবশ্য বিংশ শতাব্দির শেষ দিকে (১৯৯২) চরমভাবে পতন ঘটে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার । বিশ্বকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা । তবে সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাও যে বিশ্বকে অর্থনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থ হবে একদিন, তার কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই । ২০০৮ এর বিশ্বমন্দার মৃদু ঝাঁকুনিতেই পশ্চিমা সভ্যতার যে কম্পন দেখা গেছে, তাতে মনে করা যেতেই পারে অদূর ভবিষ্যতে করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে শোষণমূলক এই অর্থব্যবস্থার কপালে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার পতন, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার আশু পতনধ্বনি বিশ্বকে আগমনী বার্তা শোনাচ্ছে বিকল্প পদ্ধতি, গরিববান্ধব ইসলামী অর্থব্যবস্থা। মুসলিমবিশ্বের নামকরা মনীষীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যয়ন, সাধনা ও গবেষণার বিনিময়ে পুঁজিবাদী বিশ্বকে চোখ রাঙাচ্ছে সাম্যবাদী ইসলামী অর্থব্যবস্থা। সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বিশ্বের মোট সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগ জমা করে দিচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২ ভাগ লোকের হাতে । বাকি বিশ ভাগ সম্পদ বাদবাকি বিশ্বের ৯৮ ভাগ লোক দারিদ্র, ক্ষুধা, মন্দা, পুষ্টিহীনতা, ভগ্নস্বাস্থ্য ও রোগ-শোকের সাথে ভোগ করছে ।
গরিববান্ধব সাম্যবাদী ইসলামী অর্থব্যবস্থা সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা বলে। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় ধনীর হাতে থাকা সম্পদে গরিবের অধিকারকে স্মরণ করে । সমাজ বিপ্লবের পরিবর্তিত ধারায় মুসলিম বিপ্লবীদের কণ্ঠে বারবার ধ্বনিত হয়েছে ন্যায়ভিত্তিক সুষম অর্থব্যবস্থার এ অমৃত বয়ান-শ্রমিকের মজুরি তার ঘাম শুকানোর পূর্বেই আদায় করো।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই মনীষীর বহুমাত্রিকতা অনুসন্ধানের পরিবর্তে আমরা এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে তার ‘অর্থনীতিবিদ’ সত্তার খানাতল্লাশী করবো । আমরা পুর্বে উল্লেখ করেছিলাম, ম্যাক্রো মাইক্রো ইকোনমিকসÑব্যাস্টিক সামস্টিক অর্থনীতি, মাইক্রো ক্রেডিটÑক্ষুদ্রঋণ, স্যোশ্যাল বিজনেসÑসামাজিক ব্যবসা, ক্যাপিটালিজমÑপুঁজিবাদ, ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজারের সমন্বয়ে ওপেন মার্কেট ইকোনমিকস তথা মুক্তবাজার অর্থনীতির বিশ্বায়নের এই জটিল যুগে যে ক’জন ক্ষুরধার মস্তিষ্ক মুসলিম মনীষীর অদম্য সাধনায় পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা বিশ্ববাসীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে; ক্ষণজন্মা অর্থনীতিবিদ মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) সেই মনীষীদের অন্যতম ।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিম-লের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার যুগোপযোগী উদারনৈতিক মূলনীতির আলোকে ন্যায়ভিত্তিক সুষম অর্থবণ্টন পরিকল্পনায় তার ছিলো সুস্পষ্ট ধারণা । তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার সংমিশ্রণে প্রচলিত বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থা কোনোদিন ধনী-দরিদ্রের মাঝে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পারবে না । ঘুচিয়ে দিতে পারবেনা সম্পদের অসম বণ্টন ব্যবস্থাকে। দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা ৪০ শতাংশ লোকদের এই সংখ্যা দিনদিন বাড়বে বৈ কমবে না। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তিগত সম্পদের প্রবৃদ্ধিতে কোনো প্রকার সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ বা হস্তক্ষেপ করা চলবে না। প্রচলিত এই মতের সাথে ইসলাম একমত। তবে এতে নৈতিকতার মিশেল থাকা চাই । হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ধনিক শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্য বিশ্বকাপ, বিপিএল আয়োজন করার চেয়ে শতকোটি টাকায় গরিবের আবাসনের জন্য স্বল্পমূল্যের ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণ করাই নৈতিকতার দিক দিয়ে অধিক যুক্তিযুক্ত। প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্য, পোষাক, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির যে পূর্ণ অধিকার রয়েছে সে ব্যাপারে তার ছিলো স্বতন্ত্র অভিমত । ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় দেশীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি জাকাত ব্যবস্থা নিয়ে তার মতামত ছিল তাক লাগানোর মতো । হাদীস শরীফের মহাগ্রন্থ বুখারী শরীফের অর্থ সংক্রান্ত হাদীসের এক দরসে জাকাত প্রসঙ্গে তার বক্তব্য- দেখো, এই পোস্তা এলাকায় কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করে এরকম দু’শ’ বন্ধু আছে আমার। এদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ গড়ে দুই হাজার কোটি টাকা করে হবে। কল্পনা করো তো প্রত্যেক বছরে এদের উপর গড়ে জাকাত ফরজ হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা । এই টাকা দিয়ে প্রায় পঁচিশটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে, যার মধ্যে শতশত পরিবারের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেত। এভাবে তো কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের ভূমিহীন বাস্তুহারা সর্বহারা মানুষদের সমাজে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়া যায়। নি¤œবিত্ত পর্যায়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নতি ঘটত মধ্যবিত্তের পর্যায়ে, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি ঘটতো চোখে পড়ার মতো ।
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার অসারতা সম্পর্কে তার মনে কোনো দ্বিধা ছিলো না। থাকার কথাও নয়। এর শোষণমূলক নানা ফাঁক-ফোকড় ও দুর্বলতাসমূহ তিনি সুস্পষ্টভাবে মার্ক করে দিয়েছিলেন। সুদের বিনিময়ে পুঁজি সরবরাহ নীতির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এ অর্থব্যবস্থা কোনোভাবেই বৈষম্য দূরিকরণ, দারিদ্র বিমোচন, অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হতে পারে না। বিশেষকরে সুদের ব্যপারে ইসলামের কঠোর অবস্থান এবং মুফতি আমিনীর অবস্থানের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিলো না। সুদের ব্যাপারে ইসলামী অর্থব্যবস্থার কঠোর মনোভাব ও জিরো টলারেন্স নীতিদর্শনের অনুধাবন, গভিরতর অধ্যয়নের কল্যাণে তিনি তার সমসাময়িক অর্থনীতিবিদ ও ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন হিমালয়সম উচ্চতার ব্যবধানে। এক্ষেত্রে আমরা ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূসের প্রসঙ্গ স্মরণ করতে পারি। ক্ষুদ্রঋণনামক অভাবিত একটি অর্থনৈতিক পরিভাষা আবিষ্কার করে তিনি চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। দারিদ্রকে চিরতরে জাদুঘরে পাঠানোর এই শ্লোগানের পালে নতুন হাওয়া লাগে যখন সুইডিশ একাডেমী ২০০৬- এ তাকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ প্রদানের ঘোষণা করে। বিশ্বব্যাপী তুমুল আলোচনা শুরু হয় তাকে নিয়ে। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে তাকে নিয়ে বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এই আলোচনার মধ্যেই একটি বিবৃতি সবাইকে চমকে দিয়েছিলো। লালবাগ মাদ্রাসা থেকে তৎকালীন সাংসদ মুফতি আমিনী ঘোষণা করলেন, ক্ষুদ্রঋণের আড়ালে ড. ইউনূস গ্রামের সহজ-সরল মা-বোনদের সুদের কারবার শেখাচ্ছেন। দারিদ্র বিমোচনকারী নন, তিনি তো একজন সুদখোর মহাজন। তার শিষ্যদের বলেছিলেন, তোমরা সারাদেশে তাকে সুদখোর মহাজন বলে প্রচার করবে। বর্তমান সরকারের সাথে তার সম্পর্কটা অনেকের চোখেই ছিলো সাপে-নেউলে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন ড.ইউনূসের উপর গোস্বা করে তাকে সুদখোর মহাজন বললেন। তখন কিন্তু মুফতি আমিনী তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন!
প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দুর্নীতি বিস্তারের ভয়াবহতা এবং প্রতিরোধ পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে হতাশ কণ্ঠে বলেছিলেন, আসমান থেকে ফেরেশতা অবতীর্ণ হলেই কেবল বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। মুফতি আমিনী সাহেব বলেছিলেন, ফেরেশতার প্রয়োজন নেই বরং অর্থনীতিতে অভিজ্ঞ, খোদাভীরু তরুণ আলেমদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দিন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ব্যাংকিং সেক্টরে তরুণ আলেমদের অংশগ্রহণকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতেন। মনে করতেন, এভাবেই হয়তো খোদাভীরু সৎ লোকদের অংশগ্রহণে এই সেক্টরের বিদ্যমান অস্থিরতা দূরিভূত হবে। ডেসটিনি হলমার্কের মতো জালিয়াতি ও আধুনিক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রচলনে মুফতি আমিনীর ছিলো নানামুখী উদ্যোগ। এজন্য বিগত কয়েক বছর ধরে লালবাগ ও কাটারা মাদ্রাসার ইফতা বিভাগের তরুণ আলেমদের প্রচলিত অর্থব্যবস্থা ও ইসলামী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে তুলনামূলক অধ্যয়ন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য অর্থনীতি বিষয়ক সেমিনার সিরিজের আয়োজন করেন। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসারে আল আমিন ইসলামী ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক খোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন একসময়। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ক্ষণজন্মা এই মনীষীর তিরোধানে জাতি অনেক কিছুই হারিয়েছে। দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, ঋণ খেলাপি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এই সমাজে ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রচলনে সংগ্রামীরা হারিয়েছে অর্থনীতিবিদ মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে (রহ.)। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।’
উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম মুফতি
সময়ের আলোচিত মুফতি ও শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ লেখেন- ‘অনেকে মুফতি আমিনীকে শুধু রাজনীতিবিদ হিসেবে জানেন। অথচ তিনি ছিলেন হাদীসের দরসের হিরণ্যদ্যুতি, বক্তৃতার মঞ্চে বলিষ্ঠকণ্ঠ, আর লেখনির জগতে সিদ্ধহস্ত। ফতোয়ার ক্ষেত্রে তো প্রবাদতুল্য। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ইলমসাধনা একালের সবার জন্যই ছিলো অনন্য মাইলফলক। উচ্চ মর্যাদার অভিলাষে রাত্রি জাগরণের আদর্শ উপমা ছিলেন তিনি। শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনে বিনিদ্র রজনীর সাধনাই ছিলো তার বর্ণাঢ্য জীবনের মূল উপজীব্য। ইসলামী আন্দোলনের এ অগ্রনায়ক বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সভা, মিটিং সম্পন্ন করে গভীর রাতে মাদ্রাসায় পৌঁছলেও ইলমসাধনা অব্যাহত থাকতো। জাতীয় দুর্যোগের দ্বন্দ্বমুখর কঠিন মুহূর্তগুলোও তাকে মুতালাআ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আমি এখানে তার বর্ণময় কর্মজীবনের মৌলিক একটি দিক নিয়ে আলাপ করার প্রয়াস পাবো।
মুফতি আমিনী (রহ.) ছিলেন আমাদের আকাবিরদের আদর্শ উত্তরসূরি। উলুমে নবী ও আমলে নবীর একজন যথার্থ প্রতিচ্ছবি। তার কণ্ঠেই শোনা যেতো শাহ আব্দুল আযীয (রহ.)সহ সংগ্রামী আকাবির-আসলাফের প্রতিধ্বনি। আ. আযীয (রহ.) যেমন জালেম ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে ভারতবর্ষ জাগিয়ে তুলেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে মুফতি আমিনীও ইসলামবিরোধী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সবসময় ছিলেন প্রতিবাদী। তার নাম শোনামাত্রই বাতিল অপশক্তির ভিত প্রকম্পিত হয়ে উঠতো। বাংলার মাটিতে তিনি ছিলেন এক সিংহপুরুষ।
ফতোয়া মুসলমানদের জাতীয় অধিকার । ফতোয়া ছিলো, আছে, থাকবে-এ শ্লোগান নিয়ে মুফতি আমিনী (রহ.) সবসময় সোচ্চার থাকতেন। তিনি আল্লাহপ্রদত্ত বিধানাবলীকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাই যখন ২০০১ সালে ফতোয়া নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টে রায় দেয়া হলো, মুফতি আমিনী তখন জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাজপথে নেমে আসেন। মিছিল মিটিং আন্দোলন, সংগ্রাম শুরু করেন দেশব্যাপী। মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)সহ দেশের সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধভাবে এক প্লাটফর্মে এসে আন্দোলনের ডাক দিলেন। মুফতি আমিনী (রহ.) ফতোয়া জারি করলেন জালেম সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের। ওলামায়ে কেরামের আহ্বানের পাশাপাশি মুফতি আমিনীর এ ফতোয়া যেনো নতুন মাত্রা যোগ করলো। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো তার এ ডাক। শুরু হলো সর্বমহল থেকে তীব্র আন্দোলন । অবশেষে বাধ্য হয়ে হাইকোর্ট এ রায় স্থগিত করে। সেদিন তার এ আন্দোলন স্মরণ করিয়ে দিলো দেড় শতাব্দী আগের শাহ আ. আযীযের (রহ.)-ফতোয়ার কথা।
মুফতি আমিনীর (রহ.) সাথে আমার ব্যক্তিগত আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো। বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুতে কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ হয়েছে অনেকবার। এ সুবাদে আমি তার মাঝে বিশেষ একটা গুণ আঁচ করতে পেরেছি। যথা সময়ে কাজ আঞ্জাম, কর্মোদ্যমী হওয়ার পাশাপাশি যেকোনো বিষয়ে যথোপযুক্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার তুলনা পাওয়া দায়। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যে মানুষটির কন্ঠ গর্জে উঠেছিল তিনি মুফতি ফজলুল হক আমিনী। রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম করে বিষয়গুলোর ব্যাপারে শরয়ী বিধান জাতির সামনে তুলে ধরেছেন সর্বাগ্রে। কুরআন-সুন্নাহ ও ফিক্হ শাস্ত্রের বহু কিতাবের রেফারেন্সে তার বক্তব্য এত সুন্দর করে তুলে ধরেছেন যে, সরকারের হাতে মিডিয়া থাকার পরও শত চেষ্টা করেও তাকে তার দায়িত্ব থেকে বিন্দু পরিমাণ হটাতে পারেনি। অবশেষে সরকার মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে।
২০০১ সালে প্রদত্ত ফতোয়াবিরোধী রায়টি স্থগিত করা হয় মুফতি আমিনীর (রহ.) একান্ত সহকর্মী মুফতি তৈয়্যবের দা.বা. আপিলের কারণেই। কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর পর বর্তমান সরকার আবার তা শুনানির জন্য তোড়জোড় শুরু করে। উঠে-পড়ে লাগে ফতোয়াবিরোধী রায়টি বহাল রাখার জন্য। কিন্তু আবারো গর্জে ওঠে মুফতি আমিনীর প্রতিবাদী কণ্ঠ। বার্ধক্যের বাঁধা উপেক্ষা করে পূর্ণ যৌবনোদ্দীপনায় আবার রাজপথে নেমে আসেন। ইসলামবিরোধী নারীনীতি ও গণমানুষের স্বার্র্থবিরোধী রায় বাতিলের জন্য প্রাথমিক সব চেষ্টাই করেন তিনি। কিন্তু সরকার তাতে কান না দেয়ায় ৪ এপ্রিল তিনি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করেন। শুরু করেন দেশব্যাপী গণসংযোগ। ওলামাদের সমর্থন আদায়ে রাত দিন ঝটিকা সফর করেন। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায় তার এ ডাক। শুরু হয় আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। হরতাল ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয় নানা কৌশল। আন্দোলন বানচালে মিডিয়ায় শুরু হয় মিথ্যার বেসাতি। জঙ্গিবাদী, মৌল/উগ্রবাদিসহ শত গাল-মন্দকে উপেক্ষা করে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে যান ১৫ কোটি মুসলমানের। ক্ষমতার লোভ, অর্থের লিপ্সা কোনোটাই তাকে দমাতে পারেনি। অবশেষে সফল হরতাল পালিত হয় সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। ভিত কেঁপে ওঠে সরকারের। দুর্বার আন্দোলনের অগ্রদূত এ বীর সেনানিকে আর স্বাধীন রাখা নিরাপদ মনে করলো না সরকার। মানসিকভাবে যন্ত্রনা সৃষ্টির লক্ষ্যে গুম করলো তার প্রিয়পুত্রকে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় সরকার তার মনোবলে বিন্দুমাত্রও ফাঁটল ধরাতে পারেনি। গৃহবন্দি অবস্থায়ও তিনি নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সকল ওলামায়ে কেরামের।
ইসলামবিরোধী এ সকল কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আমার সামান্য অংশগ্রহণ ছিল। কখনো একাকী আবার কখনো মুফতি আমিনীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি যে স্পৃহা, বিশ্বাস, দৃঢ়তা ও সাহস নিয়ে কথা বলতেন তা পাহাড়সম মনোবলের অধিকারী হওয়া ছাড়া অসম্ভব। বিশেষকরে উত্তরবঙ্গের গণসমাবেশে তার বক্তৃতা জনমনে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। তিনি গর্জে উঠার সাথে সাথে যেনো সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে সারিবদ্ধভাবে কাতারে দাঁড়িয়ে গেলো। আর তিনি উত্তাল জনগণকে উদ্দীপ্ত করে গেলেন। তার সাহস আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছে সুপ্রিম কোর্টেও। ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মতামত প্রদানের জন্য মনোনীত পাঁচজনের মধ্যে আমি অধমও ছিলাম। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের ১ম এজলাসে প্রধান বিচারপতির সামনে বক্তৃতা উপস্থাপন ছিল স্বাভাবিকভাবে ভয় ও সাহসের ব্যাপার। কিন্তু আল্লাহর শপথ! ১৫ কোটি মুসলমানের জিম্মাদারী, ওলামাদের দায়িত্ব, আর বিশেষ করে মুফতি আমিনী সাহেবসহ বাংলাদেশের বড় বড় আলেমদের দোআ ও প্রেরণা পেয়েছি। দু’ট কথা বলার সুযোগ হয়েছে তাদেরই সাহস ও উৎসাহে।
মুফতি আমিনী (রহ.) আর নেই; কিন্তু তার রেখে যাওয়া আমানত আমাদের জন্য ছায়া হয়ে থাকবে। তার চেতনা ও আদর্শ আমাদের রাহনুমায়ি করবে। জীবনসংগ্রামে তার তেজদীপ্ত ভাষণই আমাদের উজ্জীবিত রাখবে।’
ইসলামী আইনশাস্ত্রে অসামান্য অবদান
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও দেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ঢাকাস্থ জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়ার প্রধান মুফতি- মুফতি হিফজুর রহমান সাহেব লেখেন- ‘মুফতি ফজলুল হক আমিনী একটি নাম। এক অনবদ্য ইতিহাস। একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশাল দারুল ইফতা। একটি নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন আপসহীন আদর্শ সংগঠন। ইসলামী জিহাদের এক দুর্জয় সিপাহসালারের নাম। জাগতিক ও দীনি শিক্ষায় যারাই ছাত্রজীবন ও পরবর্তীতে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন দেখা যায় তারা কোনো না কোনো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুফতি আমিনীর ব্যাপারেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। একজন জাদরেল মুহাদ্দিস ও প্রথিতযশা মুফতি হওয়ার জন্য যেমন প্রতিষ্ঠান এবং যে ধরনের মনীষীদের তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন তা অনায়াসেই তার ভাগ্যে জুটেছে। একাডেমিক অভিজ্ঞতার আলোকে কর্মজীবনে সতর্ক পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৯৭০ সনে তার কর্মজীবনের সূচনা। প্রথমে আমীরে শরীয়ত হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামিয়া নূরিয়ায়, ১৯৭৫ সনে জামিয়া কুরআনিয়ায় শিক্ষক ও সহকারী মুফতি হিসেবে ইসলামী আইন বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত হন। কথা আছে, প্রত্যেকটি জিনিস তার মূলের দিকে ধাবিত হয়। পানি গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত পানির দিকেই যায়। দায়িত্ব গড়িয়ে গড়িয়ে উপযুক্ত ব্যক্তির দিকেই আসে। জামেয়া লালবাগ দেশের অন্যতম শীর্ষ দীনি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এর ফতোয়া বিভাগটি একটি ব্যস্ততম বিভাগ। প্রত্যহ লিখিত, অলিখিত বেশুমার প্রশ্নাবলীর জবাব এখান থেকে পরিবেশন করা হতো। হাকীমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলীর (রহ.) উলূমের ওয়ারিস হযরত হাফেজ্জী হুজুর ও হযরত ফরিদপুরী (রহ.) ছাড়াও মুফতি দীন মুহাম্মদ ও মুফতি আব্দুল মুয়ীয (রহ.) অত্যন্ত যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার সাথে সুনিপুণভাবে এ গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিতেন। মুফতি আমিনী বড় বড় মুফতিদের নিকট থেকে এ বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের কারণে- বড় বড় মুফতিদের তত্ত্বাবধানে কাজ করে এ গুরু দায়িত্বে এসে তার প্রতিভাকে উন্নত থেকে উন্নততর করতে প্রয়াস পান। একজন বড় আলেমের জন্য নেহায়েত গণীমতের সম্পদ হলÑ বায়তুন খালি ও সানাদুন আলি তথা খালি ও নির্জন একটি ঘর এবং উঁচুমানের একটি সনদ। অবলীলায় মুফতি আমিনীর ভাগ্যে উভয়টি জুটে যায়। লালবাগের বিশাল কুতুবখানা, যেখানে দু®প্রাপ্য জানা অজানা হাজারো কিতাবের ছড়াছড়ি, যা তার জন্য সোনায় সোহাগার মতো কাজে আসে। মুফতি আমিনীর অনন্য একটি অভ্যাস ছিলো, সুদীর্ঘ রজনী জাগ্রত থেকে কিতাব অধ্যয়ন করা। কোনো জটিল বিষয় সামনে আসলে তার ঘুম হারাম হয়ে যেতো। তিনি নিরলসভাবে গবেষণা করতে থাকতেন। জটিল জটিল ও আধুনিক যুগ-সমস্যার সমাধান প্রদানে তার প্রসিদ্ধি দিগ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি দেশের একজন শীর্ষ মুফতিতে পরিণত হন। বিভিন্ন আমলে বিভিন্ন সরকারের ইসলামবিরোধী কর্ম-কা-ের প্রেক্ষিতে ইসলামী আইনের আলোকে বিশেষভাবে ফতোয়া প্রদানে ব্রতী হন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এটা আফজালুল জিহাদ। জেল-জুলুম ও তাগুতের চোখ রাঙানোকে সামান্যতম পরোয়াও করতেন না। আল্লাহর দীনের ব্যাপারে কাউকেই তিনি ভয় করতেন না। ২০০১ সনে ‘সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ’ রায় ঘোষিত হলে তিনি প্রথমে সিংহের ন্যায় গর্জে উঠেন।
বাস্তব কথা হল, ফতোয়া বা বিধানদাতা হলেন আল্লাহ পাক সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। তারপর প্রধান মুফতি ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সরাসরি আল্লাহর ফরমান, নির্দেশ ও ইশারা-ইঙ্গিতই ছিলো তার ফতোয়া। এরপর এই মহান দায়িত্বে সমাসীন হয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেইন, মুহাদ্দিসীন, মুফাস্সিরীন, ফুকাহায়ে উম্মতসহ ইসলামের অসংখ্য অগণিত দায়িত্বশীল বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। যুগে যুগে ফতোয়ার ধারাবাহিকতা চলে এসেছে। সীমাহীন বাধা ও অসংখ্য হীন ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন ভিন্ন করে ফতোয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে, গোটা দুনিয়ায়। ফতোয়ার বদৌলতেই আজ টিকে আছে ইসলামের স্রোতধারা। কেয়ামত পর্যন্ত এই অক্ষয় শক্তি দুর্জয় গতিতে সব বাধার প্রাচীর মাড়িয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবে। কোনো বাধাই তাকে স্তিমিত করতে পারবে না। বরং এর বিরোধীরাই পরাজিত হবে চূড়ান্তভাবে। এটাই মুসলমানদের দৃঢ় বিশ্বাস, ঈমানী আকীদা। ফতোয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে যুগে যুগে, দেশে দেশে, এবং এই বাংলাদেশেও। এখনো হচ্ছে সারা দুনিয়ায়, এই বাংলাদেশেও। বাংলাদেশে ফতোয়া আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়েছিলো ২০০১ সালে। আবার মুসলিম জনতার আন্দোলনের মুখে সে রায় বাতিল হয়। শেষ পর্যন্ত ফতোয়ার অনুসারীরাই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতিভাত হয় যে, মুফতি আমিনী একজন বিশিষ্ট মুফতি হওয়ার জন্য যা কিছুর প্রয়োজন ছিলো তা ছাত্র জীবন থেকে কর্মজীবন পর্যন্ত অনায়াসেই পেয়েছেন। দেশের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগের ফতোয়া বিভাগের জন্য তিনি ছিলেন অত্যন্ত উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে ফতোয়া-ফারায়েযের ক্ষেত্রে জাতির জন্য তার প্রয়োজন ছিলো অত্যাবশ্যকীয়। কঠিন কঠিন পরিস্থিতিতে সরকার বা বাতিলের রোষানলে পড়ার ভয়ে যেখানে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না সে নাজুক পরিস্থিতিতে মুফতি আমিনী বজ্রকণ্ঠে পুলিশ-আর্মি বেষ্টিত লাখো জনতার সামনে সিংহশার্দুলের ন্যায় গর্জে উঠে সঠিক ফতোয়াটি উপস্থাপন করতেন। তসলিমা নাসরিন, ড. আহমদ শরীফসহ স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে তিনি কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। এজন্য তিনি জেলও খেটেছেন। হযরত ইউসূফ আ., হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহ.), হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.), হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ.), হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.), হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.) প্রমুখ বিশ্ববরণ্যে মুজাহিদীনে ইসলামের ন্যায় তিনিও হাসিমুখে কারাবরণ করেছেন। আকাবিরের সুন্নত জিন্দা করে গেছেন।
লালবাগের ঐতিহ্যবাহী ফতোয়া বিভাগ থেকে হাজারও ফতোয়া পরিবেশিত হয়েছে। মুফতি দীন মুহাম্মদ, মুফতি আব্দুল মুঈয ও মুফতি আমিনী নিজ নিজ সময়ে প্রধান মুফতির গুরুদায়িত্ব সূচারুরূপে আঞ্জাম দিতে ব্রতী হন। কয়েক বছর থেকে এ ফতোয়াগুলোকে তারতীব দিয়ে মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়। তার জীবদ্দশায় ফতোয়ায়ে জামেয়া নামে বাংলা ভাষায় ছয় খ-ে তিন ভলিয়মে বিশাল এক মূল্যবান গ্রন্থ মুদ্রিত হয়ে আসে। তার বলিষ্ঠ সম্পাদনায় বিশাল এ ফতোয়ার কিতাবটি বাংলা ভাষায় নজিরবিহীন এক সংযোজন। প্রত্যেকটি ফতোয়ার সাথে ফিকহের গ্রহণযোগ্য একাধিক কিতাবাদির রেফারেন্স উল্লেখ করা আছে। সর্বমোট ৯৬ অধ্যায় বিন্যস্ত এ ঐতিহাসিক গ্রন্থের ফতোয়া সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। মুফতি আমিনী একজন প্রথিতযশা, যবরদস্ত মুফতি হিসেবে লেখার জগতে তার অনেক অবদান রয়েছে। তিনি একাধারে বাংলা, উর্দু এবং আরবি ভাষায় ছিলেন পারঙ্গম। প্রতিটি ভাষায় ফিক্হ ও ফতোয়া সংক্রান্ত তার একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। এ মুহূর্তে জাতির জন্য তার প্রয়োজন ছিলো অপরিসীম।’
বিস্ময়কর দীনি গবেষণা ও ফতোয়া-চর্চা
মুফতি আমিনীর (রহ.) ¯েœহধন্য ছাত্র, মাসিক আদর্শ নারীর সম্পাদক মুফতি আবুল হাসান শামসাবাদী লেখেন- ‘ইলমে নববীর খেদমতে তার অপরিসীম অবদান রয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া দানের ক্ষেত্রে। তিনি ইসলামী বিধান ও আইনবিশেষজ্ঞ মুহাক্কিক মুফতি ছিলেন। বক্ষমান নিবন্ধে তার জীবনের এ দিকটি সম্পর্কে কিয়ৎ আলোচনার আশা রাখি। ১৯৭০ সনে ঢাকার জামেয়া নূরিয়া কামরাঙ্গীর চর মাদ্রাসায় তার কর্মজীবন শুরু হয়। তখন বৈষয়িক তাদরীসের সাথে সাথে ইসলামী গবেষণা ও ইফতার খেদমতে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। এরপর ১৯৭৫ সনে তিনি জামেয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার মুদাররিস ও সহকারী মুফতি নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সনে তিনি লালবাগ জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রধান মুফতির দায়িত্ব লাভ করেন।
আল-হামদুলিল্লাহ, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত দীর্ঘ সাতবছর লালবাগ জামেয়ায় অধ্যয়নের সময় হযরত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) নিকট আমার কয়েকটি কিতাব পড়া এবং তার সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয়েছে। তখন তার ইলমি মুতালাআ, জ্ঞানগভীরতা ও অধ্যবসায় দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়েছি। ইসলামী গবেষক হিসেবে যে পরিমাণ মুতালাআ প্রয়োজন, মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে (রহ.) এক্ষেত্রে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বলতে হয়। দীনি গবেষণামূলক কিতাবের বিশাল ভা-ার ছিলো তার নিকট। তিনি সেগুলো মুতালাআয় রাত-দিন ব্যাপৃত থাকতেন। এ কিতাব মুতালাআ ওরাসাত তিনি যে মহামনীষী আকাবিরগণের জীবন থেকে লাভ করেছেনÑতা তার প্রকাশিত মূল্যবান কারনামা-গ্রন্থ ‘দরসুল বুখারী লি-সালাফিনাল আকাবির’ দ্বারা সহজেই অনুমেয়Ñ যা তিনি আরবি ভাষায় রচনা করেছেন।
আজ থেকে ৬৩ বছর পূর্বে মুফতি দীন মুহাম্মদের (রহ.) ফতোয়ার খিদমতের দ্বারা সূচিত লালবাগ জামেয়ার ফতোয়া বিভাগে যখন মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) নায়েবে মুফতি নিযুক্ত হন, তখন জামেয়ার মুহাদ্দিস ও তৎকালীন বাইতুল মুকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মুঈয (রহ.) জামেয়ার প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় দেখেছি, লালবাগ জামেয়ায় কোন ইস্তিফতা এলেই মুফতি মুঈয (রহ.) তা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) নিকট পাঠিয়ে দিতেন। তখন মুফতি আমিনী (রহ.) এর উত্তর লিখে মুফতি আবদুল মুঈয দ্বারা তাসদীক্ব করিয়ে ফতোয়ার খেদমত আঞ্জাম দিতেন।
আমাদের পারিবারিক নিবাস তখন উত্তর যাত্রাবাড়ীতে। সেসময় আমাদের এলাকায় একটি ফিতনা প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রতিরোধ করতে গেলে, সেই ফিতনার ধ্বজাধারীরা আমাদেরকে বাহাসের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসে। তখন এ সম্পর্কে ফতোয়া ও বাহাসের ব্যবস্থাপনার জন্য পরামর্শকল্পে হযরত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) শরণাপন্ন হই। তিনি লিখিত সে ইস্তিফতার যথাযথ ফতোয়া-উত্তর লিখে দেন এবং বাহাসের ব্যাপারে বলেন যে, তাদেরকে বলবেÑআপনারা যত বড় বিশেষজ্ঞ আনতে চান আনতে পারেন, আমাদের পক্ষ থেকে ‘ফজলুল হক’ নামে একজন ছাত্র আসবেন। তিনিই আপনাদের সাথে বাহাসের জন্য যথেষ্ট। তখন আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) ইলমি চেতনা, দৃঢ় মনোবল ও সাহসী পদক্ষেপ দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মহান আল্লাহর শোকর, তার লিখিত জ্ঞানগর্ভ ফতোয়া মহল্লার মজলিসে দেখানোর পর এবং তার বাতানো জবাব পেশ করতেই ফিতনাবাজরা পিছু হটে যায় এবং আমরা বিনাযুদ্ধে বিজয় লাভ করি। ১৯৮৪ সনে আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) লালবাগ জামেয়ার প্রধান মুফতির পদ অলঙ্কৃত করেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উক্ত মহান দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি ব্যাপকভাবে দীনি গবেষণা ও ইফতার খেদমত আঞ্জাম দেন। তেমনিভাবে তিনি ফতোয়া বিভাগের শিক্ষানবিশ মুফতিগণকে ফতোয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) সে সকল দীনি গবেষণা ও ফতোয়ার বিশাল ভা-ার লালবাগ জামিআর ফারিগীন আলেমগণের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে সন্নিবেশিত করে ‘ফাতাওয়ায়ে জামেয়া’ নামে প্রকাশ করা হয়। এভাবে এ যাবত ‘ফাতাওয়ায়ে জামেয়া’-এর মোট ৬টি খ- বের হয়েছে। ১ম খ- ১৪১৯ হিজরী সনে, ২য় খ- ১৪২০ হিজরী সনে, ৩য় খ- ১৪২১ হিজরী সনে, ৪র্থ খ- ১৪২৩ হিজরী সনে, ৫ম খ- ১৪২৬ হিজরী সনে এবং ৬ষ্ঠ খ- ১৪২৭ হিজরী সনে। এগুলোর প্রথম খ- মুফতি মুঈয (রহ.) ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) ফতোয়া সংকলিত রয়েছে এবং অবশিষ্ট খ-গুলোতে শুধু মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) ফতোয়া রয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ইস্যুতে বা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) প্রদত্ত ফতোয়া দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই ফতোয়ার ওপর ভিত্তি করে এদেশের জনগণের মধ্যে বিশেষ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। যা ইসলামের বিধানের হেফাজতে বেশ ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। এভাবে দীনি ইলমের র্দাস-খেদমত, ওয়াজ-নসীহত, দাওয়াত ও আন্দোলন ইত্যাদির পাশাপাশি ফতোয়ার ক্ষেত্রে এদেশের জনগণের ধর্মীয় ও জাতীয় জীবনে আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) এ অপরিসীম অবদান ভোলার নয় । তার এ সকল দীনি খেদমতের ফয়েজ ও বরকত বিভিন্নভাবে কিয়ামত পর্যন্ত বিরাজিত থাকবে ইনশাআল্লাহ। আর তিনি আলমে বরযখে এ সকল দীনি খেদমতের সাদকায়ে জারিয়ার অফুরন্ত ছাওয়াব লাভ করতে থাকবেন।’ আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন।
দাওয়াহ ও বক্তৃতা
এ-ই না হলে বয়ান!
দাওয়াতের প্রধান মাধ্যম যদি হয় বয়ান, রাজনীতির প্রধান বাহন তবে বক্তৃতা। মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) প্রথমত ছিলেন উম্মাহ-দরদি আলেম, পাশাপাশি ইসলামের বিপ্লব হৃদয়ে লালন করতেন খুব গভীরভাবে, ছিলেন সময়ের একজন সচেতন রাজনীতিক। ফলে সবক্ষেত্রে এবং সকল প্রয়োজনেই তাকে প্রচুর কথা বলতে হতো। এদেশের লাখো মানুষ সাক্ষী, ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত কর্মজীবনের চল্লিশটি বছরজুড়েই তিনি কথা বলে মানুষকে মুগ্ধ করে গেছেন। দীনি মাহফিলের ময়দান হোক, রাজনীতির মঞ্চ হোক, ছাত্রদের দরস হোক, শীর্ষ আলেমদের ইলমি বা ঘরোয়া বৈঠক হোক- যুক্তি, প্রজ্ঞা ও উপস্থিত বুদ্ধিতে সবাইকে তিনি মাতিয়ে রাখতে পারতেন। উদ্দীপিত করতে পারতেন। আল্লাহর প্রেম, রাসূলের ভালোবাসা, ইসলাম ও উম্মাহর দরদ তার বক্তৃতা ও বয়ানের পরতে পরতে এতো চমৎকারভাবে সাজাতে পারতেন, মুগ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো উপায়ই থাকতো না। শান্ত নদীতে তিনি যখন-তখন ঝড় তুলতে পারতেন। উত্তাল সমুদ্রের তরঙ্গমালা এক হুংকারে স্তব্ধ করে দিতে পারতেন। এক যুক্তিতে প্রতিপক্ষের হাজারো দলিল-দস্তাবেজের শেকড় উপড়ে ফেলতেন। কান্না ও চিৎকারে মানুষের হৃদয়ে তোলপাড় তৈরি করে ফেলতেন মুহূর্তেই। তার বয়ান-বক্তৃতার ঘোর, বিস্ময়, দিশেহারা এবং মায়াবি এমন অজ¯্র মুহূর্তের চিত্র হৃদয়ে ধারণ করে আজো উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে আছে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস।
মনে পড়ে- তখন সবেমাত্র হেফজ পড়ছি। চৌধুরিপাড়া মাদ্রাসায় খতমে বুখারি উপলক্ষে বার্ষিক মাহফিল হচ্ছে। মাঠ নেই, আয়োজন তাই মসজিদেই। সন্ধ্যার পর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভারত থেকে আগত প্রখ্যাত এক আলেম বয়ান করলেন। খতমে বুখারি উপলক্ষ থাকায় স্থানীয় মুসল্লিসহ ছাত্রদের আত্মীয়-অভিভাবক মিলিয়ে জনসাধারণের সংখ্যাই বেশি। বক্তার ভাষা যেহেতু উর্দু, বাধর্ক্যের কারণে আওয়াজও জোরালো নয়, আবার ইলমি বয়ান- সবমিলিয়ে মজলিসের অবস্থা প্রায় ঘুমন্ত। কোথাও কোনো নড়াচড়া নেই, মুসল্লিদের অনেকেই উসকুখুসকু করছেন। কিছুক্ষণ পরই মাইকে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নাম ঘোষণা করা হলো। তিনি মিম্বরে বসলেন। দেখলাম পুরো মজলিস নড়েচড়ে বসছে। সালাম দিয়ে খুৎবা শুরু করতেই রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করলো। টানা এক ঘন্টা তিনি বয়ান করলেন। সংসদ সদস্য হলেও রাজনৈতিক বা সাধারণ কোনো বিষয় নয়, সাবলীল ইলমি বয়ান। ফারেগিন ছাত্র ও উপস্থিত আলেমদের উদ্দেশ্যেই তিনি বয়ান করলেন। কিন্তু জোরালো কণ্ঠ, স্বরের উঠানামা, গণমানুষের ভাষা আর উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় পুরো মজলিস দেখলাম দুলছে। আশ্চর্য এক ঘোরে টানা এক ঘন্টা বিভোর হয়ে রইলো উপস্থিত সব মানুষ। আলেম ও মুসল্লি। বারান্দার কোণায় ঝিম মেরে থাকা এক বৃদ্ধকে হঠাৎ বলতে শুনলাম- কী লোকজন নিয়ে আসে বিদেশ থেকে, এ-ই না হলে বয়ান!…সে-ই প্রথম মুফতি সাহেবের নাম ও কণ্ঠের সাথে পরিচয়, শুরু মুগ্ধতা ও বিস্ময়েরও। মুফতি আমিনীর (রহ.) কাছের ক’জন শাগরেদ, ছাত্র ও ভক্তের টুকরো স্মৃতিচারণ তুলে দিচ্ছি।
কণ্ঠে যাদুর মায়া
শ্রীপুর মফিজিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতি শামীম আহমদ বলেন- ‘হুজুরের সাথে সফরে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় আমি গিয়েছি। কোনো জেলা বাদ পড়েছে বলে মনে হয় না। এ সফরগুলো কখনো রাজনৈতিক হতো, আবার কখনো শুধুই ওয়াজÑমাহফিল সংক্রান্ত। হুজুর কোন কোন জায়গায় রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে থাকতেন আবার কোথাও বয়ানকারী হিসেবে। তিনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, ওয়াজ হোক রাজনৈতিক আলোচনা হোক সবই মানুষের সামনে সমানভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। তার বক্তৃতা শুনলে মানুষ দিশেহারা হয়ে যেতো। আমার মনে পড়ে, একবার হাটহাজারিতে এক মাহফিলে হুজুর দুপুর ১২ টায় বক্তৃতা শুরু করলেন। তখন মাঠ অনেকটা ফাঁকা ছিলো। হুজুর আলোচনা শুরু করার সাথে সাথে মানুষ ছোটছুটি করে মাঠে আসতে লাগলো। তারা বলছিলো, আমাদের আমিনী সাহেব বক্তৃতা করছে। একবার ভাবুন! একটা মানুষ কতোটা জনপ্রিয় হলে কেউ এমন কথা বলতে পারে?
যুগোপযোগী বিষয়ের পাশাপাশি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক বিষয়ে বেশি বলতেন। বক্তৃতার সময় তিনি কোনো ভয় করতেন না। কী রাজনৈতিক কী ধর্মীয় সবক্ষেত্রে সমানভাবে সাহস নিয়ে কথা বলতেন। তসলিমাবিরোধী আন্দোলন, ফতোয়াবিরোধী রায়ের আন্দোলনসহ সবক্ষেত্রে তার অনেক সাহসী বক্তব্য পুরো জাতি শুনেছে। কোনো ভয় কিন্তু কখনোই তার মধ্যে থাকতো না।’
বিপ্লব ও দরদ
কাতার প্রবাসী মাওলানা ইউসুফ নূর বলেন-‘১৯৮৪ সাল। আমি তখন ১৪ বছরের প্রাণচঞ্চল কিশোর। নোয়াখালীর মাইজদীতে দত্তেরহাট দারুস সুন্নাহ মাদ্রাসার ছাত্র। শহরের কচি-কাঁচা মিলনায়তনে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর জনসভা। অনেক মানুষের সঙ্গে আমিও সেখানে উপস্থিত হলাম। সন্ধ্যায় মাগরিবের পর হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে আগত ওলামায়েকেরাম ও নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ, মাওলানা মোস্তফা আল হোসাইনিসহ আরো কয়েকজন। সভার শেষের দিকে মুফতি আমিনী সাহেব বক্তব্য রাখলেন। এবার যেন পাল্টে গেল পরিবেশ। তার বক্তব্যের প্রতিটি শব্দে শব্দে কেঁপে উঠছিলো সমাবেশস্থল। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। পুরো জনসভা শপথের তরঙ্গে উত্তাল হয়ে উঠলো তার বক্তব্যে।
আমার কিশোর মনে ঠিক তখন থেকেই এ মানুষটির অবয়ব গেঁথে গেলো। চোখে কালো চশমা, গায়ে কোট, গাম্ভীর্যমাখা চেহারা, সবল গঠন এবং সবমিলিয়ে তার যে শপথদীপ্ত অভিব্যক্তি, তা নিমিষেই অজস্র মানুষের মতো আমার মন কেড়ে নিলো। উপস্থিত সবার সঙ্গে আমি একদিকে যেমন স্লোগানে কণ্ঠ মেলাচ্ছি, ঠিক পাশাপাশি মঞ্চে উপস্থিত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর জিকিরমগ্ন চেহারার দিকেও তাকিয়ে থাকছি। ওই কৈশরে এভাবেই প্রথমবারের মতো কোনো আলেমের তেজস্বী বক্তব্য এবং শপথদীপ্ত গাম্ভীর্য দেখার সুযোগ হলো।
এর দু’বছর পরের কথা। নোয়াখালীর ইসলামিয়া আলিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে মুফতি আমিনী আবার তাশরীফ আনলেন। সেদিন তাকে দেখলাম সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। মাহফিলে সমবেত মানুষের জন্য তার সেদিনের বয়ান ছিলো পুরোটাই দীনি দিকনির্দেশনা এবং আত্মশুদ্ধিমূলক। খুব শান্ত ও স্থিরভাবে তিনি মুসলমানদের বিপক্ষে ইহুদী নাসারাদের নানা ষড়যন্ত্র নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বয়ান করলেন। আমার প্রথমবারের দেখা বিপ্লবী অবয়বের মুফতি আমিনীকে আজ দেখলাম ইসলাহী মুরব্বী রূপে। একদিকে তার রাজনৈতিক দৃঢ়তা এবং অন্যদিকে উম্মতের জন্য দরদমাখা নির্দেশনা।’
হকের আওয়াজ বুলন্দ করার যোগ্য ভাষা ও কণ্ঠ
শ্রীপুর জান্নাতুল আতফালের প্রিন্সিপাল মুফতি কাজী মুঈন বলেন- ‘তিনি জনগণের মানস-ভাষা বুঝতেন। যার ফলে সর্বস্তরের মুসলিম জনগণ তাঁকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতো এবং তার বক্তব্য শোনার জন্য লালায়িত থাকতো। আমার মতো অধমের পরম সৌভাগ্য যে, আল্লাহ তায়ালা চাঁদপুরের মোমিনপুর মাদ্রাসায় বাংলার শ্রেষ্ঠ হাফেজ মরহুম হাফেয মুহসিন সাহেবের কাছে হিফজ পড়ার সুযোগ হয়েছে। হযরত মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) সাহেবও তাঁর কাছে হিফজ করেছিলেন। তেমনিভাবে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের (রহ.) কাছে মরহুম আমিনী সাহেব হাদীসের কিতাবের দরস হাসিল করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমারও তা লাভ হয়েছে, আলহামদুল্লিাহ। তাছাড়া ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ উপলক্ষ্যে আয়োজিত লংমার্চে মুফতি আমিনী (রহ.) যেমন উস্তায শায়খুল হাদীস সাহেব হুজুরের সাথে নেতৃত্বে ছিলেন, অনেকের মতো আল্লাহ তায়ালা আমাকেও শরীক হওয়ার সুযোগ দান করেছিলেন। আমাদের শ্রীপুর, গাজীপুর অঞ্চলে হযরত কয়েকবার ওয়াজ মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। হক ও ন্যায়ের কথা নির্ভয়ে বলে যেতেন এবং সাধারণ মানুষের দীনি চাহিদা তৃপ্তিদায়ক ভাষা ও জবানে মেটাতেন। এভাবে মরহুম আমিনী সাহেব হুজুরকে নিকট থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তার খোলামেলা বয়ান, ইসলামবিরোধী যেকোনো কাজের প্রতিবাদে সাহসী ভূমিকার জন্য সারাদেশের মুসলিম জনতার মাঝে তার যে গ্রহণযোগ্যতা ও শ্রদ্ধাবোধ দেখেছি, খুব কম আলেমই তা অর্জন করতে পারেন। মুফতি আমিনী (রহ.) এক্ষেত্রে নিজেই নিজের উদাহরণ। অন্য একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য, বাতিলের বিরুদ্ধে হকের আওয়াজ বুলন্দ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে যুৎসই ভাষা ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন।’
আলেম ও লেখক আনসারুল হক ইমরানের স্মৃতিচারণ-
সুরের ওয়াজে বরকত নেই
‘২০০৯ সালের ঘটনা। সরাইল থেকে ওয়াজ মাহফিল শেষে ঢাকা ফিরছিলেন। হঠাৎ আমি গাড়িতে বলেই ফেললাম, হুজুর, আপনি ওয়াজে সুর দেন না কেন? অনেকেই তো সুর দিয়ে ওয়াজ করে। তিনি জবাবে বললেন, তা ঠিক আছে। আমার কাছের অনেক লোকও এমনটা করে। তবে আমি সবসময় এর ব্যতিক্রম আছি এবং থাকবো। মনে রাখবে, সুরের ওয়াজে কোনো বরকত নেই। শ্রোতারা মুগ্ধ হয় বটে। তবে তাদের মনোযোগ থাকে বক্তার সুরের প্রতি। বক্তা কী বলছেন সেটা তারা আঁচ করতে পারে না। তাই আমি কখনো সুর দিয়ে ওয়াজ করি না। কেন মানুষ কি শোনে না?
দাওয়াহ বনাম জীবিকা
যুবকদের ইসলামী জলসা, অনুষ্ঠান কিংবা দীনি যেকোনো আয়োজনে তিনি হাজির হতেন হাসিমুখে। একবার সরাইলে যুবকদের উদ্যোগে একটি মাহফিলে ওয়াজ শেষ করে গাড়িতে উঠলেন। একজন যুবক দৌড়ে ছুটে এলো গাড়ির কাছে। সে হুজুরের সঙ্গে মুসাফাহা করে হাতের মুঠোয় কিছু টাকা হাদিয়া দিলো। তিনি গাড়িতে আলো জ্বালিয়ে গুণে দেখলেনÑ দুই হাজার বা তার চেয়েও হয়তো আরো কম কিছু টাকা। সঙ্গে সঙ্গেই ছেলে আবুল হাসানাতকে ডেকে বললেন, এই টাকাটা ওদের দিয়ে দাও। অনেক কষ্ট করে ওরা সুন্দর একটি মাহফিল করেছে। যুবকদের এমন সুন্দর দীনি আয়োজনে আমি মুগ্ধ। অথচ তার কাছে তখন গাড়ির পেট্রোল বা তেলের টাকাটাও ছিলো না। তিনি যেখানে যেতেনÑ নিজের প্রাইভেট গাড়ি ছাড়াও পেছনে আরেকটা ভাড়া গাড়ি থাকতো। অতঃপর আল্লাহ পাকের অশেষ দয়ায় যেভাবেই হোক আমরা ঢাকায় পৌঁছেছি। এই ছিলো হুজুরের চরিত্র মাধুর্য। আজ এমন বক্তা পাওয়া বড় মুশকিল।
দাওয়াতি সফরেও কিতাব
মাওলানা মনির হোসাইনসহ আরো ক’জন আলেমের ভাষ্য- ‘৯৫-৯৭ সালে হুজুরের সঙ্গে আমার সফর করার সুযোগ হয়েছে। বেশির ভাগ সফর রাতে হতো। তিনি কখনো গাড়িতে ঘুমাতেন না। সর্বক্ষণই কিতাব মুতালাআ করতেন। তবে আমরা কখনো গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়লে হুজুর ডেকে বলতেন- ‘এই তোমরা ঘুমাইতেছ?’ তার ডাকে আমাদের ঘুম চলে যেতো।
হুজুর পান খেতেন আর মুতালাআ করতেন। তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ-মাহফিলে যেতেন। তবে টাকা-পয়সার কোনো চাহিদা তার ছিলো না। আজকাল তো বক্তারা এলেম-কালাম না থাকলেও একটু গলাবাজি করতে পারলেই তাদের হাজার হাজার টাকার ডিমান্ড চলে আসে। আর হুজুর এতো বড়ো আলেম হয়েও ওয়াজ করে কোনো জায়গা থেকে টাকা নিতেন না। একবার আমি হুজুরের সঙ্গে ময়মনসিংহে এক ওয়াজ মাহফিলে গিয়েছিলাম। হুজুরকে যে টাকাটা হাদিয়া দেওয়া হয়েছিলো, তার পুরোটাই তিনি ওই মাদ্রাসায় দান করে দিয়েছিলেন। অনেক মাহফিলে দেখেছি, টাকা কালেকশনের সময় হুজুর নিজের পকেট থেকে আগে দিতেন। তার আরেকটা বৈশিষ্ট্য ছিলো, তিনি কোনো জায়গায় সফরে গেলে একাকী খানা খেতেন না। সফরে যাদের নিয়ে যেতেন সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে খানা খেতেন। আগে খবর নিতেন গাড়ির ড্রাইভার খেয়েছে কি না। তাকেও সঙ্গে নিয়ে খানা খেতেন। এই ছিলো তার আদর্শ। আজ আমরা তো কে খেল আর কে খেল না তার খবরও রাখি না। নিজের পেট বাঁচাও নিয়ে ব্যস্ত।’…
আদর্শ রাহবার
ময়মনসিংহের পুস্তক ব্যবসায়ী ডা. আবু সাঈদ সরকার লেখেন- ‘হঠাৎ একদিন ভাইয়া জানালেন, মাখজান মাদ্রাসার সভায় মুফতি আমিনী সাহেব আসছেন। মাখজানে শুক্রবার দিনেরবেলায় সভা ঐবছর থেকেই চালু হলো। আর দিনেরবেলা সভা করার উপকারিতা নিয়েও মুফতি সাহেব অনেক কথা বললেন। আরো অনেক বক্তার বয়ান সেদিন শুনেছি, কিন্তু আজ পনের বছর পরও শুধু হযরতের কথাই মনে পড়ছে। হযরতের সেদিনের জ্বালাময়ী বয়ান আজও আমাকে উজ্জীবিত করে। হযরতের সেদিনের অনেক কথা আজও আমার মনে আছে। সেগুলো স্মরণ হলে জীবনপথের দিশা আমি সহজেই খুঁজে পাই। এশার নামাযের পর আখেরি মোনাজাত করে সেদিন যখন বাসায় ফিরছি, তখন ভাইকে বললাম সত্যি আমি আমার স্বপ্নের নেতা পেয়েছি। ধর্মের লাইনে আমি উপযুক্ত রাহবার পেয়ে গেছি।
১৯৯৯ সাল। বড় ভাই জানালেন মুফতি আমিনী সাহেব ময়মনসিংহের আমুয়াকান্দা মসজিদে সভায় আসছেন। প্রিয় আধ্যাত্মিক নেতা, প্রিয় রাহবারের পবিত্র জবানের অমীয় বাণী শ্রবনের সীমাহীন আগ্রহ নিয়ে ফুলপুর গেলাম। তার বয়ান শুনে পরিতৃপ্তও হলাম। বয়ানের এক পর্যায়ে তিনি একজনের লিখিত প্রশ্নের জবাবে অত্যন্ত সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। বিষয় ছিলো সিনেমা হলের মালিক কীভাবে তওবা করে মসজিদের সভাপতি হতে পারবেন।
২০০১ সালে কলেজে ভর্তির চিন্তা করছি। হঠাৎ জানতে পারলাম মুফতি আমিনী সাহেব শম্ভুগঞ্জ চামড়া বাজারে আসছেন। লাখো মানুষের ঢল নামলো সেদিন শম্ভুগঞ্জ বাজারে। আমিও উৎফুল্ল হৃদয়ে হযরতের বয়ান শুনলাম। এভাবে ভাইয়ার কাছে শুনে শুনে বিভিন্ন মাহফিলে হযরতকে দেখে এবং তার বয়ান শুনে আমি তার একান্ত ভক্ত হয়ে যাই। প্রায় প্রত্যেক বছর তিনি ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে আসতেন। আমিও তাকে কাছে পাই এক নজর দেখার জন্য। তার মোবারক যবানের কথা শোনার জন্য। সেসব মাহফিলগুলোতে ছুটে যেতাম। তার বয়ান থেকে দুনিয়া আখেরাতের অনেক পাথেয় সংগ্রহ করতাম।’
মুফতি ফজলুল হক আমিনী আশ্চর্য এক মানুষ ছিলেন। খুলনা-বরিশালে প্রোগ্রাম করে ঢাকায় ফিরে গাড়ি-ড্রাইভার পাল্টান, সফরসঙ্গী বদলান, পোশাক পরিবর্তন করেন এবং সমান উদ্দীপনা নিয়ে তখনই আবার রংপুরে রওয়ানা হন। পরিবর্তন হন না কেবল তিনি নিজে। তাঁকে কী নামে অভিহিত করা যায়? সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রওয়ানা হন। চট্টগ্রামে দিনভর রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করে রাত একটায় লালবাগ পৌঁছে ঘোষণা দেন, অযু করে সামান্য কিছু খেয়ে বুখারী শরীফ পড়াতে বসবেন। এরপর কথামতো ফজর পর্যন্ত বুখারী শরীফ পড়িয়ে বাদ ফজর আবার গাড়িতে চেপে বসেন, নতুন কোনো জেলায় প্রোগ্রাম করার জন্য।’ সাধারণ বিবেচনায় মানুষ কারো পক্ষে কি এটা করা সম্ভব?…কীভাবে সম্ভব? বিদায়ের আগের দিন পর্যন্ত এমন হাজারো বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে গেছেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)।
ইবাদত ও দুনিয়াবিমুখতা
মেঘে ঢাকা সূর্য
মুফতি আমিনী সাহেবের জামাতা মাওলানা সাইফুল ইসলাম সাহেবের বিশ্লেষণ- ‘দেশ-বিদেশে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর (রহ.) পরিচিতি ছিলো মূলত রাজনীতি ও আন্দোলনকেন্দ্রিক। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী ও প্রতিবাদী পুরুষ। গতানুগতিক হিসেবে এই পরিচিতির সাথে আমরা অর্থ-বিত্ত, স্বার্থপরতা এবং প্রচারপ্রিয়তার সম্পর্কই বেশি দেখি। কিন্তু মুফতি আমিনী (রহ.) তো ছিলেন ব্যতিক্রম, বরং সময়ের চেয়েও এগিয়ে থাকা একজন মানুষ। পরিচিতির চেয়েও তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো নিজের কাজ। দীনের খেদমত। রাজনীতি-আন্দোলন একদিকে; শিক্ষকতা-মাদ্রাসার দেখভাল, আমল ও মুতালাআ ছিলো অন্যদিকে। একই সত্ত্বায় বিপরীতমুখি অসংখ্য গুণ তিনি ধারন করতেন, তবে বুঝতে দিতেন না। তার কাছের মানুষেরা জানতেন, পরিচিতি যাই হোক; কিতাব-মাদ্রাসা-আমল আর আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটিই ছিলো তার জীবনের প্রথম ও প্রধান বিষয়। দিন-দুনিয়ার হাজার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে রাতগুলো তিনি কেবলই কিতাব-ছাত্র আর আল্লাহর সমীপে কুরবান করে দিতেন। এগুলোই ছিলো তার যাবতীয় কাজের জ্বালানি স্বরূপ। মুফতি আমিনীর (রহ.) রাজনীতিক ও ইসলামী আন্দোলনের নেতার পরিচয়ের কাছে আড়াল হয়ে যাওয়া তার আমল ও দুনিয়া বিমুখতার কিছু চিত্র তুলে ধরছি তারই ¯েœহধন্য ক’জন মানুষের কলমে।
আল্লাহর ভয় ও পরকাল-ভাবনা
হযরতের জামাতা, বড়কাটারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সাইফুল ইসলাম সাহেব লেখেন- ‘মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনী (রহ.) তার অন্তরে যুহদ ও দুনিয়া বিমুখতার সর্বোচ্চ স্তর লালন করতেন। তাঁর মুরব্বি ও সহকর্মীদের মতে, এই যুহদ ও তাকওয়ার কারণেই তাকে দেশি ও আর্ন্তজাতিক ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি ভয় করতো। তিনি স্বার্থপর, সুবিধাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের ইসলাম ও দেশ বিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিদিনের ওয়াজ, বক্তৃতা-বিবৃতি দ্বারা ইসলাম ও দেশের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টি করতেন। তাই অসৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শক্তিগুলো বিভিন্ন কৌশলে তাকে দমিয়ে রাখতে চাইত। ভয়, হামলা, মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক কূটচাল, দীনের লেবাসধারী হিংসুক শ্রেণির সাথে গোপন আঁতাত করাসহ সব পলিসিই তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ হতো। কখনো কখনো আসতো (দীনের খাতিরে) আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অগ্নি পরীক্ষা বা নেক সুরতের অফার। যেমনÑ ‘আপনি তো টাকা পয়সার মুখাপেক্ষী না। আপনার অধীনস্থ ১০০ মাদ্রাসার জন্য এই সামান্য … কোটি টাকার দান আপনার মাধ্যমে গ্রহণ করুন।’ অথবা ‘হুজুর, আপনি কেবল চুপ থাকলেই এই সামান্য…কোটি প্রাথমিক খরচ দেয়া হলো। যারা আপনার আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের দিবেন। এরপর যদি আপনিও কিছু নেন তা হলে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করব। সুযোগ দিলে যেমন বলবেন, তেমনই দিয়ে যাবো।’ জীবনে এমন অসংখ্য অফার প্রত্যাখ্যান করায় দুর্দান্ত প্রতাপশালী শত্রুপক্ষের অন্তরেও ভীতি ও ভক্তিমিশ্রিত শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার আন্দোলনের আরেক বড় উপাদান ছিল দুআ ও কান্নাকাটি। এসব মিলে তার সাধারণ প্রতিবাদী বক্তব্যগুলো বজ্র হুংকারে পরিণত হতো।
৮০ সালের গোড়ার দিক থেকে ২০১২ সালের শেষ পর্যন্ত ৩২ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন এই বহুগুণী মনীষীর। তিনি ইসলামী রাজনীতি করতেন, আর দেশের রাষ্ট্রনীতিসহ সবক্ষেত্রে ইসলাম বিরোধিতা, অসভ্যতা ও দুর্নীতির ব্যাপক চর্চা বর্তমানে আইনে পরিণত হয়েছে। এমন কলুষিত রাজনৈতিক পরিবেশে রাজনীতি করা আর অঢেল সম্পদশালী হওয়া সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। কারো ব্যাপারে ‘তিনি অনেক বড় রাজনৈতিক নেতা’ বললে বুঝতে হয় তিনি বিভিন্ন ক্যারিশম্যাটিক, ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি। বিপরীত প্রমাণাদি দিয়ে বুঝালেও এই দেশে এই যুগে তা কাউকে বিশ্বাস করানো যায় না।
এই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অতিগুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ অতিক্রম করেছেন। ধনী পরিবারের সন্তান মুফতি আমিনী (রহ.) ৮০ ও ৯০ দশকে বিশাল পৈত্রিক সম্পত্তির প্রায় সবই বিক্রি করে দীনি আন্দোলনে বিলিয়ে দেন। এরপর মূল ভিটা-বাড়ি সংলগ্ন মূল্যবান বাড়ি বিক্রি করেন ১৯৯৯-২০০১ সালের ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য। নিজের একটি মূল্যবান সম্পদ কোটি টাকার অধিক মূল্যে বিক্রি করে ২০১১ সালের ইসলামী বিরোধী নারীনীতির আন্দোলনে ব্যয় করেন। আর ইন্তিকালের পর তাঁর ঋণ পরিশোধের জন্য একটি সমিতির সদস্যপদ ৩৫ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে দেন তার ওয়ারিসরা।
এসব ঋণ পরিবারে ব্যয়ের জন্য ছিল না। দীনি আন্দোলনের জন্যই তিনি করেছিলেন। ইন্তেকালের সময় পৃথিবীতে তার সম্পদ বলতে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) থেকে ওয়ারিসসূত্রে প্রাপ্ত তার সহধর্মিণীর ২ শতক জমিতে অসম্পূর্ণ একটি দালান। তা-ও ঋণের টাকায় নির্মিত। এই জরুরত মিটানোর বাড়িটি করার ব্যাপারে শুরু থেকেই পদে পদে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিরুৎসাহিত করতেন। জাতীয় মসজিদের সাবেক খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ.)-সহ অনেক সহকর্মী অনেকটা চাপ প্রয়োগ করে এই ছোট দালান তৈরিতে তাঁকে উৎসাহিত করেন। ইন্তেকালের ৬/৭ বছর আগ পর্যন্ত একটি ক্ষুদ্র নড়বড়ে আধাপাকা টিনের ঘরেই পুরো জীবন কাটিয়ে দেন মুজাহিদে মিল্লাত (রহ.)।
পরিপাটি থাকা মানে আয়েশ নয়
দেশ-বিদেশের দোস্ত-আহবাব ও ছাত্র-শিষ্যদের দেয়া হাদিয়ার টাকা কম-বেশি সব সময়ই পেতেন। কোনো সময় সঞ্চয়ের চিন্তা করেননি। বড় বড় দান তিনি অতি গোপনেই করতেন। তার দানের পাত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাদ্রাসার গরীব ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ হতেন। তার নির্মোহ জীবন নিয়ে আলোচকদের অনেকে বলে থাকেন, ‘মুজাহিদে মিল্লাত তার মাঝে লালিত দুনিয়াবিমুখতা ও তাকওয়া পরিচ্ছন্ন চকচকে পোশাক দ্বারা মানুষের চোখে পর্দা ফেলে রাখতেন।’ কিন্তু তাঁর দুনিয়াবিমুখতার প্রতি গভীর পর্যবেক্ষণকারী একজন হলেন তাঁরই সহপাঠী এমদাদিয়া লাইব্রেরীর মালিক মাওলানা আব্দুল হালিম সাহেব। এ ব্যাপারে তিনি আমাকে বলেন, ‘মুজাহিদে মিল্লাত (রহ.) ধবধবে পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতেন ঠিকই। কিন্তু সেগুলো আয়েশী কিংবা আরামদায়ক ছিল না। তিনি শীতে-গরমে মোটা টেট্রন কাপড় পরতেন। আরাম উপভোগ করার অনুভূতি তাঁর কাছে সব সময় গৌণ থাকত। কাপড়ের বোতাম, ভাজ ইত্যাদির খবরও থাকত না অনেক সময়।’ ‘সুফী’ শব্দটি আল্লাহ ওয়ালাদের বিশেষণ এই জন্যই। কারণ তারা পশমী (মোটা) পোশাক পরতেন। আরাম-আয়েশ উপভোগের খবর থাকত না। হযরতুল আল্লাম জমীরুদ্দীন নানুপুরীর (রহ.) মুখে বিভিন্ন সময় শুনেছি যে, ‘আমিনী সাহেব অনেক বড় আল্লাহর ওলী। তাঁর বেলায়াত রাজনৈতিক লেবাস দ্বারা ঢাকা পড়ে আছে। তিনি হযরত হাফেজ্জী ও সদর সাহেবের মতো ব্যক্তিত্বদের পরশপাথরতুল্য সোহবত দ্বারা তিলে তিলে তৈরি হয়েছেন।’ ইন্তেকালের ৩ ঘণ্টা পূর্বে এক ছাত্র ৫০০০ টাকা হাদিয়া দেন। সেখান হতে দুই হাজার টাকা কাউকে দেয়ার পর যেই তিন হাজার টাকা ছিল, সেটাই ছিল মুফতি আমিনী (রহ.)-এর একমাত্র ব্যক্তিগত সম্পদ। এর বাইরে দুনিয়ার কোনো একাউন্ট, আলমারী বা কোথাও ক্যাশ টাকা রেখে যাননি। দেশি-বিদেশি গোয়েন্দারা তার আর্থিক দৈন্যতা দেখে অবাক হতো।
সম্মানি বিহীন খেদমত
আর্থিক অনটনের মাঝেও তিনি বড় কাটারা মাদ্রাসা, দারুল উলুম কাকরাইল, কাজীপাড়া মাদ্রাসা (বি-বাড়ীয়া), মাদ্রাসাতুস সুন্নাহ (দাউদকান্দি)-সহ কোনো মাদ্রাসা থেকে প্রিন্সিপাল বা মোতাওয়াল্লী হিসেবে কোনো প্রকার বেতন-ভাতা ও সম্মানি নিতেন না। লালবাগ মাদ্রাসায় তাঁর ধার্যকৃত সম্মানী ছিল মফস্বলের অনেক মাদ্রাসা প্রধানের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। ওয়াজ-মাহফিলেও তাকে অতিসামান্য পথখরচ দিয়ে নিয়ে যেতেন সারা দেশের মাহফিলের আয়োজকরা। সাধারণ আঞ্চলিক ওয়ায়েজদেরকেও এত অল্প খরচে নেয়া যেত না। যা পেতেন তা দিয়ে অনেক সময় গাড়ির খরচও মিটত না। কারণ, তিনি সব সময় দুই-তিন গাড়ি সফর-সঙ্গী নিয়ে চলাফেরা করতেন।
মাদ্রাসার সম্পদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তাকওয়া অবলম্বন করতেন। তার কামরাগুলোর যাবতীয় আসবাবপত্র নিজ অর্থে ক্রয় করতেন। মাদ্রাসার কোনো খাবার গ্রহণ করতেন না। করলেও তা কোনো না কোনোভাবে ফেরত দিতেন। রাজনৈতিক প্রভাবশালী হওয়ায় তদবির-সুপারিশ করার মাধ্যমে অর্থ আয়ের ব্যাপক সুুযোগ থাকলেও তিনি এগুলো মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। ২০০৩ সালের জুনে একবার আমার মামা আমার মাধ্যমে সওজ-এর এক কর্মকর্তার বৈধ বদলির তদবীর বাবদ ৯ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি চেক হাদিয়া দেন। মুজাহিদে মিল্লাত (রহ.) আমাকে ডেকে বললেন- ‘আমি জানি, এই ভদ্রলোকের বদলীর সুপারিশ বৈধ, তার হাদিয়াও তেমন খারাপ কিছু না। কিন্তু আমি চাই আমার আওলাদদের পেটে এমন মুশতাবিহ (সন্দেহযুক্ত) খাবার না যাক। তুমি মন খারাপ করো না। চেকটা ফেরৎ দাও। আল্লাহ বরকত দিবেন।’
মাদ্রাসার আসাতিযায়ে কেরামের খাস বৈঠকগুলোতে বলতেন- ‘মাদ্রাসার টাকা পয়সা আগুন। এগুলো থেকে সবাই সতর্ক থাকবা। খেয়ানত মানুষকে নিকৃষ্ট বানিয়ে ছাড়ে। মাদ্রাসার টাকা পেটে যাওয়া মানে আগুন খাওয়া।’ এভাবে সবাইকে সতর্ক করতেন।
জীবনের শেষ দিকে ওলামায়ে কেরামের অধিকাংশ বয়ানে ধন-সম্পদ, হালাল-হারামের আলোচনা মুখ্য বিষয় হতো। অন্য বিষয়ে আলোচনা হলেও এই বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনতেন। তাঁর দৃষ্টিতে বর্তমান সমাজে আলেমদের প্রভাবশূন্যতা ও দীনি দায়িত্বে উদাসীনতার একটি প্রধানতম কারণ দীনি খেদমতের চেয়ে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা বৃদ্ধি করা। দীনি খেদমতকে প্রাসঙ্গিক বিষয় আর অর্থ রোজগারকে মুখ্য বিষয় বানানো। বিভিন্ন মুশতাবিহ (সন্দেহযুক্ত) পদ্ধতির ব্যবসায় আলেমরা জড়িয়ে পড়ার কারণেই তারা দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাদের মূল পুঁজি ইলম, তাকওয়া ও বিশ্বস্ততা লোপ পাচ্ছে। এতে ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব উভয়ই অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। কারণ, মাল্টিলেভেল, মাইক্রো ক্রেডিট, ইসলামী বীমা, ফরয ইবাদতের খেদমতে খেয়ানত, সমিতির কারবারে নয়-ছয় হিসাব, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি গত কয়েক বছরে দেশে আলেমদের মাঝে ব্যাপকতা লাভ করেছে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ইসলামবিরোধী শক্তির ব্যাপক প্রস্তুতির মুকাবেলায় আলেমদের এই নৈতিক দুর্বলতা ও দীনি খেদমতের প্রতি উদাসীনতা দেখে তিনি মর্মাহত হতেন। তাই তার প্রায় সব বয়ানেই কুরআন-হাদীস ও আকাবিরের জীবনে দুনিয়াবিমুখতার সবকগুলো বলতেন। এমনকি একদিন দীর্ঘ প্রায় তিন ঘণ্টায় বড় কাটারার দফতরে হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া (রহ.) রচিত ‘হামারে আকাবির’ কিতাবটি পাঠ করে শোনান। এতে কেবল দীনের খাতিরে আকাবিরের দুনিয়া ত্যাগ করার ঘটনাবলি সমৃদ্ধ বয়ান রয়েছে।
মাদ্রাসার অভ্যন্তরে দায়িত্বে অবহেলা করে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত থাকা ইলম, আমল ও মাদ্রাসার জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন। সমিতির কার্র্যক্রমকে ক্ষতিহীন মনে করে কোনো এক সময় অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ১০-১৫ বছরে এগুলোতে নানা সমস্যার উদ্ভব হলে তিনি লালবাগ-কাটারায় সকল সমিতির কার্র্যক্রম এক সপ্তাহের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে বলেন। একটি সমিতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় তা সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের নির্র্দেশনা দেন। জরুরি একটি মজলিসে তাঁর অভিব্যক্তি ছিল এমন- ‘আমি মনে করেছিলাম মাদ্রাসায় সমিতির কার্যক্রম তেমন ক্ষতিকর না; কিন্তু এখন প্রমাণিত হলো এটাও মাদ্রাসার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’ মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনী (রহ.) আল্লাহ-রাসূলের প্রকৃত প্রেমিক ছিলেন। সাহাবা ও আকাবিরের প্রকৃত অনুসারী ছিলেন। এদেশে ইসলামী রেনেসাঁর কর্মীদের দলনেতা ছিলেন এই মহান কুতুব।
বিয়ের আগে হযরতের ঘর-দুয়ার নিয়ে দ্বিমুখী দুটো ঘটনা শুনেছি। একটি হযরতের ভাগিনা মাওলানা আশরাফুজ্জামান পাহাড়পুরী হতে শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, ২০০১ সালে খালুর অসুস্থতার সময় প্রেসিডেন্ট এরশাদ তার কিল্ল¬ার মোড়ের বাসায় আসেন। বাসার গেইটে প্রবেশ করে ছোট-ছোট ঘর দেখে ভিতরে হয়তো কোনো বড় বাড়ি আছে ভেবে বললেন, কোন দিক দিয়ে হুজুরের বাসা? উপস্থিত লোকেরা বললেন, এটাই তো হুজুরের বাসা। ভিতরে প্রবেশ করেই এরশাদ সাহেব বললেন, ‘ভাই কী অবস্থা, আপনি এমন ডেড়ায় থাকেন! আপনার টাকার অভাব আছে নাকি? আর আমি যে বড় অংকের টাকা পাঠাতাম সেগুলোই বা কী করলেন?’ খালুু বললেন- ‘ভাই, টাকা তো আপনি আমাকে দেননি। দিয়েছেন মাদ্রাসায়, দিয়েছেন আন্দোলনে।’…
তবে আমাকে এর উল্টো ধারণা দিয়েছিল একটি বাতিল ফেরকার গুপ্তচর। ১৯৯৩ সাল থেকে কয়েকবারই আমাকে শুনিয়েছে যে, ভারত সরকারের সাথে আঁতাতের বিনিময়ে ‘র’ ১০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি আমিনী সাহেবকে গিফ্ট করেছে। নাউযুবিল্লাহ। আমাদের সহপাঠীদের প্রায় সবাই তা প্রত্যাখ্যান করলেও কেউ কেউ এতে বিভ্রান্ত হয়েছিল বলে মনে পড়ে। কী আশ্চর্য! এর কয়েক দিনের মধ্যেই দৈনিক ইনকিলাবের উপসম্পাদকীয়তে একটি খবর আসে। খবর হলো, র’-এর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মোস্টওয়ান্টেডের তালিকায় দ্বিতীয় নাম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর। সেই উপসম্পাদকীয়তে এর প্রতিবাদ করা হয়। তাতে বলা হয় যে, মুফতি আমিনী দেশ ও ধর্মের স্বার্থে আপোষহীন হওয়ার কারণে এই তালিকা করা হয়েছে।
খাবার নিয়ে অভিযোগ নয়
তার খাবারের মেনু অত্যন্ত সরল ছিলো। এক পিছ মাছ বা গোশত আর এক পদের সবজি ও ডাল। তার পরিবারের জন্যও এই একই মেনু ছিলো। শেষজীবনে এমনই দেখেছি। তবে স্বাভাবিক ভাত-রুটির চেয়ে সবজি-তরকারি বেশি খেতেন। মাদ্রাসায় অবস্থানকালে সবসময় বাসা থেকে খাবার এনে খেতেন। মাদ্রাসার খাবার খেতে খুব কমই তাকে কেউ দেখেছেন। খাবারের স্বাদ নিয়ে তার কখনো অনুযোগ থাকতো না। সফরে কারো না কারো বাড়ি বা মাদ্রাসার মেহমান হতেন। মেজবানের সন্তুষ্টির খাতিরে হলেও তিনি যেকোনো বিস্বাদ খাবার গ্রহণ করতেও তিনি দ্বিধা বোধ করতেন না। খাবারের নোনতা, তিক্ততা, মিষ্টতা, ঝাল ইত্যাদি হওয়া নিয়ে তার কোনো বিরক্তি থাকতো না। তিনি খাবারের সময়েও যেনো দীনী ফিকিরে আচ্ছন্ন থাকতেন। তার ব্যাপারে প্রসিদ্ধি ছিলো, তাকে কোনো স্বাদহীন খাবার দেওয়ার পর সহধর্মিণী বা খাদেম বললেই হতো, ‘খাবারটা ভালো’। তা হলেই তিনি হেসে স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় সমর্থন করে বলতেন, আচ্ছা, খাবারটা খুব মজার। খুব ভালো। অথচ সেই খাবার অন্যদের জিহ্বায় একেবারেই স্বাদহীন মনে হতো।
সফরে তিনি সঙ্গীদের খাবারের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতেন। বৈষম্য পছন্দ করতেন না, পুলিশ বা খাদেমদের সাথে নিয়ে বসতেন। সফরে সঙ্গীদের উন্নত খাবার নিশ্চিত করতে প্রায়ই সম্পূর্ণ পকেট খালি করতেন। অনেক সময় ঋণ করে হলেও তা অব্যাহত রাখতেন। এমনকি একবার কুমিল্ল¬া শহরের বাইরে এক রেস্তোরায় খেতে বসে শহরের একজন শাগরেদকে ৩০০০ টাকা নিয়ে আসতে বললেন। ঋণ হিসেবে। শাগরেদ হাজির হয়ে টাকাগুলো দিলে প্রায় দুই হাজার টাকা হুজুর সঙ্গীদের শুধু চা-নাস্তার বিল পরিশোধ করলেন। বাকি এক হাজার টাকা রেস্তোরার কর্মচারীকে হাদিয়া দিলেন।
মাদ্রাসায় তার খানকার ন্যায় বাসায়ও বালিশের পাশে কিতাবের স্তূপ থাকত। শিয়রের সাথে থাকত কিতাবের তাক। আর নামাজ-তিলাওয়াতের মুসল্ল¬ার সামনেও থাকত কিতাবের আলমারী। বাসায় প্রথমে ৬০-৭০ স্কয়ার ফিটের একটা চিলেকোঠা বানিয়েছিলেন একেবারেই নির্জন মুতালাআ ও ইবাদতের উদ্দেশ্যে। বাসায় তিলাওয়াত করলেও জায়নামাজ পেতে কিবলামুখী হয়ে আদবের সাথে বসতেন।
১/১১ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সংবাদ দেখার উদ্দেশ্যে বাসায় কম্পিউটারের সাথে টিভি কার্ড লাগানো হয়েছিল। হযরত কয়েকদিন খবর দেখেছেনও। কিন্তু ছোটদের কেউ কেউ টিভির অন্য প্রোগ্রাম দেখেছে জানতে পেরে অত্যন্ত নাখোশ হন। প্রচ- রাগে নিজ হাতে সেই কম্পিউটার ছুড়ে মেরে ভেঙে ফেলেন। তার বাসার অতি সাদামাটা আসবাবপত্র দেখে তার অনেক রাজনৈতিক বন্ধু ও দূরাত্মীয়রা অবাক হয়েছেন। এই সাদামাটা বাড়ির জন্য বিপুল অংকের ঋণ করা হয়েছিলো। তিনি কেবল থাকার জন্য এই সামান্য আড়াই কাঠার জমিতে দুটি ফ্লোর করার পক্ষে ছিলেন। এর বেশি কাজ করতে বরাবরই সন্তানদের বারণ করতেন। ইন্তেকালের পর দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার সাদামাটা বাসস্থান ও আসবাব-পত্রহীন অনাড়ম্বর অবস্থা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়েন। এমন অভিব্যক্তি আরো অনেকেই প্রকাশ করেছেন।
এমপি থাকাকালে ৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটা সুপারিশ করার আবেদন করে আমার এক পড়শী ভাই। হযরত কয়েক দিন অপেক্ষা করালেন। ইতোমধ্যে একটি সফরে আমাকে সঙ্গে নিলেন, সফরে দুটি মাহফিলেই হালাল হারামের বয়ান করেন। ফেরার পথে আমাকে বললেন, বাবা, এই সুপারিশ না হলে কোনো ক্ষতি হবে তোমার? বললাম, জ্বি না। বললেন, আমি জানি, এই সুপারিশটা বৈধ, হারাম না। কিন্তু এজাতীয় সুপারিশ মুশতাবিহাত-সন্দেহযুক্ত, তাই না করাই ভালো। আর সবচে’ বড় ব্যাপার হলো, আমি চাই আমার তোমার আওলাদের পেটে যেনো হারাম তো দূরের কথা, মুশতাবিহাতের দানাও না ঢোকে।’
ইখলাস ও সরলতা
হযরতের ছাত্র, জীবনের শেষ ক’টি বছরের একান্ত খাদেম মাওলানা আল আমীন আজাদ লেখেন- ‘আল্লাহর সাচ্চা এই আবেদের জিকির-তিলাওয়াত-দুআ ও রোনাজারিই ছিলো প্রাত্যহিক আমল। প্রতি সপ্তাহে কুরআনের এক খতম করতেন। সফরে থাকলেও এর ব্যত্যয় ঘটতো না। আর বিশেষ সময়ে বড় কোনো মুসিবতে রোজা, বুখারী খতম ও কুরআন খতম করে দুআ করতেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও আল্লাহর দরবারে তার দুআ, তাহাজ্জুদ, কান্নাকাটি মিস হতো না। মাগরিবের পূর্বমুহূর্তে এবং শেষরাত্রের কান্নাকাটি খুব সহজেই তিনি ছাড়তেন না। বাদ আসর সাংগঠনিক কোনো মিটিং থাকলে তা আগে-ভাগেই শেষ করে জায়নামাজে বসে পড়তেন। দিনের পর দিন সফর করে যখন রাতে ঘুমাতে যেতেন, আমাদের বলে রাখতেন তাহাজ্জুদের সময় উঠিয়ে দিতে। আমরা তাকে উঠানোর পূর্বেই দেখতাম তিনি উঠে আল্লাহর দরবারে কাঁদছেন। কুরআনের প্রতি তার অসম্ভব টান ছিলো। তিলাওয়াত করতেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। তার মনোযোগপূর্ণ তিলাওয়াত পাষাণ হৃদয়কেও আকৃষ্ট করতো।
তার মুখে শোনা ঘটনা। ২০০১ সালে হাইকোর্ট থেকে সরকার ফতোয়া নিষিদ্ধ করলে তিনি এর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে তৎকালীন সরকারের কোপানলে পড়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। নিক্ষিপ্ত হন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাকে রাখা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সেলে। হুজুর বলতেন, নাম বললে সবাই চিনবে। সবাই ডা-াবেড়ি পরা। হুজুরকে পেয়ে তারা আনন্দিত হয়ে বলে, আপনি নাকি খুব সুন্দর তাফসীর করতে পারেন। আমাদেরকে একটু তাফসীর করে শোনান। অনেক পীড়াপীড়ির পর হুজুর সূরা ত্বহা তিলাওয়াত করে এর ব্যাখ্যা শোনাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তারা অভিভূত হয়ে মুখে থাকা সিগারেট ফেলে দিয়ে অজু করে আদবের সাথে এসে বসে। তখন তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিলো। সফর অবস্থায় গাড়িতে থাকলে দিনের বেলা কিতাব মুতালাআ আর রাতের আঁধারে জিকির করে সময় পার করতেন। শেষদিকে রাতেও মুতালাআর জন্য তার সিটের সামনে ছোট্ট একটি লাইট লাগিয়েছিলেন। ছোট্ট এই লাইটটির আলোয় তিনি মুতালাআ চালিয়ে যেতেন। ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, সাংগঠনিক, জাতীয় এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে আমরা তার রোজা, নফল ইবাদত এবং দুআর আশায় থাকতাম। গৃহবন্দিত্বের অনেক দিনই তার রোজাবস্থায় কেটেছে। ৪ এপ্রিল সারারাত খোদার দরবারে কেঁদেছেন। আর দিনের বেলায় রোজাবস্থায় ছিলেন। আমরা এগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাছাড়া সাধারণ ইবাদতগুলোতেও তার ছিলো একনিষ্ঠ মনোযোগ। তিনি মা’যূর হওয়ার কারণে জামাতে শরীক হতে পারতেন না। তবু জীবনের সায়াহ্নে জামাতের এতো পাবন্দ ছিলেন যা দেখে আমরা আশ্চর্য বোধ করতাম।
একবার ইজতেমায় যাচ্ছি। মহাখালী থেকে ইজতেমা মাঠ পর্যন্ত তীব্র যানজট। এদিকে আসর নামাজের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি রাস্তার সাইডেও নয়; মধ্যখানে। নামাজ আদায় করতে না পেরে হুজুর পেরেশান হয়ে যাচ্ছেন। কাজা হওয়ার ভয়ে আরো বেশি পেরেশান হচ্ছেন। পাশে কোনো মসজিদও নেই। জ্যামও ছুটছে না। এক পর্যায়ে বললেন। গাড়ি কিনারায় নেওয়ার ব্যবস্থা করো, ফুটপাতে রুমাল বিছিয়ে নামাজ পড়ে নিতে হবে। আমি এ কথা শুনে হতবাক। কতটুকু খোদাপ্রীতি থাকলে এটা সম্ভব! কিছুক্ষণ পর জ্যাম সামান্য নিরসন হলে একটি মসজিদ পেয়ে সবাই সেখানে নামাজ আদায় করে নিই।
আশেকে নবীর সাক্ষাত
নবীপ্রেমের আদর্শ এ মানুষটির রাসূলপ্রীতি নিজের সন্তান ও পরিবারের চেয়েও বেশি ছিলো। রাসূলের সত্তা বা রাসূলের আদর্শের ব্যাপারে কেউ কটু কথা বললে তিনি জ্বলে উঠতেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদীচী ও ধুমকেতু আয়োজিত নাটকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মন্দ গালি দেওয়ার খবর শুনে তিনি বেহুশ হয়ে পড়েন। অথচ এই লোকটিই নামাজের মধ্যে রুকু দিতে গিয়ে সেজদা, সেজদা দিয়ে গিয়ে রুকু দিয়ে ফেলতেন।
জীবনের সর্বশেষ উমরায় রওজা শরীফ যিয়ারতের সময় দুআ করছিলেনÑ আল্লাহ, তোমার নবীর একজন আশেকের সাক্ষাত লাভের তৌফিক দাও। যিয়ারাত শেষে জীর্ণশীর্ণ এক লোক এসে বলে, আপনি বাংলাদেশের মুফতি আমিনী না? তিনি বিনয়াবনত হয়ে বললেন, মুফতি আমিনী কি, আমার নাম ফজলুল হক আমিনী। তিনি তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলে ২৫ বছর বয়সে এখানে এসেছি। এখন আমার বয়স ৬০। রওজা ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না। সবসময়ই এখানে পড়ে থাকি। তিনি বুঝে নিলেন, দুআ কবুল হয়েছে।
২০০৯ সালে বড়-কাটারা মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগ মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে ১১দিন কারারুদ্ধ করে রাখে। কারারুদ্ধ অবস্থায় কুমিল্লার এক অখ্যাত মসজিদের ইমাম একটি চিঠি নিয়ে মাদ্রাসায় এসে বলে, আমিনী সাহেবের সাথে কারাগারে কি দেখা করা যাবে? মাদ্রাসার দায়িত্বশীলরা বললেন, না, পরিবার ছাড়া অন্য কাউকে দেখা করতে দেয় না সরকার। লোকটি তাই একটি চিঠি দিয়ে বললেন, এটা হুজুরের কাছে পৌঁছে দেবেন। চিঠিটি পেয়ে তারা খুললো। তাতে লেখা, আমি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছিÑ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি আমিনীকে গিয়ে বলো, কোনো চিন্তা না করতে। তার মাদ্রাসার ওপর আমার হাত আছে। কেমন নবীপ্রেম হলে এ ঘটনাগুলো ঘটতে পারে।
মুফতি আমিনী (রহ.) ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন উদার, মহৎ, সদালাপি ও অতিথিপরায়ণ। তার সরলমনা চলন-পরণ ও মানুষের সাথে খোলামেলা আলাপন সবাইকে মুগ্ধ করতো। তার আচরণে মানুষ খুব দ্রুত তার আপন হয়ে যেতো। বি-বাড়িয়ার আখাউড়ায় এক স্কুল ছাত্র। হুজুর ওয়াজ করে স্টেজ থেকে নেমে গাড়িতে উঠবেন। পথে এই স্কুলছাত্রসহ তার সহপাঠীরা হুজুরের সাথে মুসাফাহা করছে। হুজুরের অভ্যাসÑস্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা সাক্ষাত করতে আসলে তাদের মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দেন। এই ছাত্রের সাথে যখন হুজুর এই আচরণ করলেন, সে একদিকে যেমন অবাক অন্যদিকে আনন্দে উদ্বেলিত। সেদিনই হুজুরকে তার বাসায় নিয়ে গেলো। এইভাবে হুজুরের সাথে তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এরপর যখনই আখাউড়ায় যেতেন তার বাসায় থাকতেন। তখনও তার লেবাস-পোশাকে কোনো পরিবর্তন আসেনি। হুজুর কিছু বলতেন না। এটাও হুজুরের অভ্যাস ছিলো। সরাসরি কাউকে লজ্জা দিতেন না। হুজুরের যুক্তি ছিলোÑ সংস্পর্শে থাকতে থাকতে এক সময় পরিবর্তন আসবেই। ঠিকই আমরা ৬-৭ বছর পর গিয়ে দেখি ছেলেটির চেহারায় দাঁড়ি। বাবরী চুল। পরনে জুব্বা। সে সময় হুজুর আমদের এ ঘটনা শুনালেন। এমন অনেক ঘটনা আর স্মৃতির সমাহার জমে আছে হৃদয়ে। মনে পড়ে শত শত ঘটনা। আবার হুজুরের প্রতিটি আচরণ উচ্চারণ খুটে খুটে দেখার-বোঝার একটা অভ্যাসও ছিলো আমার। শিক্ষা গ্রহণের তাগিদে।
খুলনা বা যশোর যাচ্ছি হুজুরের সাথে। দুপুরের লাঞ্চের জন্য নামলাম ফরিদপুরের মুফতি আব্দুল কাদের (রহ.)-এর খাবাশপুর মাদ্রাসায়। মুফতি আব্দুল কাদেরের সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে চলে গেলেন শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর ঘরোয়া বিষয়ে। প্রসঙ্গ সদর সাহেবের দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে। হুজুর বলেন, আমিও হুজুরের এই দ্বিতীয় বিবাহের ঘোরতর বিরোধিতা করেছি। অনেক নিষেধ করেছি। কিন্তু যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, তখন আমি চুপ। কারণ, বড়দের সিদ্ধান্তের পর বাড়াবাড়ি করাটা বেয়াদবি। সিদ্ধান্তের পূর্বে এখতেলাফ করা যায়। এমন বিষয় হুজুর আমাদের বুঝাতেন হুদায়বিয়ার ঘটনা দিয়ে। হয়তো তার ওপর আমলেরই এটি একটি নমুনা ছিলো। বলতেন, হুদায়বিয়ায় সন্ধি করতে গেলে রাসূলের বিরোধিতা করেছেন অনেক সাহাবা। কিন্তু যখন সন্ধি করেই ফেললেন তখন কেউই একটা রা পর্যন্ত করেন নি। এটাই আদব।
রাত্রি জাগরণ ও কুরআনের প্রেম
মরহুমের ছাত্র ও তরুণ ছাত্রনেতা মোহাম্মদ খোরশেদ আলম স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন- ‘আমরা দেখতাম, হুজুর প্রথম রাতে মুতালাআ এবং লেখালেখি করে কাটাতেন। মধ্য রাতে নামাজ পড়ে ও কুরআন তেলায়াত করে এবং শেষ রাতে তাসবিহ-তাহলিল ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে কাটাতেন। এইভাবে প্রতিটি রাত অতিবাহিত করতেন। এইসময় প্রায় প্রতিদিন তিনি রোজা রাখতেন। এক রাতের ঘটনা, হুজুরের বাসা থেকে সেহরি আসেনি, হুজুরতো রোজা রাখবেন, এখন কি করা! তখন আমি বাজার থেকে দেশি মুরগী কিনে এনে পাকালাম, সঙ্গে সবজিও। তিনি দেশি মুরগী পছন্দ করতেন। সেহরি খাওয়ার সময় একজন হুজুরকে ঘটনাটা বললে তিনি শুনে অনেক খুশি হলেন।
এই দীর্ঘদিনের মধ্যে হুজুর আনুমানিক ৪-৫ দিন ভোররাতে জাগিয়ে দিতে বললেন। আমি জাগাতে গিয়ে শুধু একরাত্রে ঘুমে পেলাম, বাকি সবরাত্রে দেখলামÑতিনি নামাজে দাঁড়িয়ে আছেন নয়তো কুরআন তেলায়াত করছেন অথবা দু’হাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছেন। সাধারণত হুজুর সাতদিনে সাত মনজিল কুরআন তেলায়াত করতেন। মানে প্রতি সপ্তাহে এক খতম। কিন্তু গৃহবন্দি অবস্থায় তিনি কুরআন শরীফ তিনদিনে এক খতম করতেন। তার উস্তায শায়খুল হাদীস যেদিন ইন্তেকাল করেন, সেদিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত তিনি তার উস্তাযের জন্য কুরআন শরীফ এক খতম করেন।’ এভাবে, এভাবেই ইবাদত আর দুনিয়াবিমুখতার আশ্চর্য নজির গড়ে গেছেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)।
শায়খ ও পীর : বুযুর্গি ও আধ্যাত্মিকতা
দীনি কাজে আধ্যাত্মিকতাই শক্তির উৎস
বড় কাটারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সাইফুল ইসলাম সাহেবের ভাষ্য- ‘শিক্ষকতা ও রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে মুফতি আমিনী (রহ.)-এর যেই সত্তাটি সবচে’ বেশি কার্যকর ছিলো তা হলো, সুলুকের রাস্তায় তার সার্বক্ষণিক পথচলা। তার এই সত্তাটিকে সযতেœ সকলের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। তার খুব কাছে যারা পৌঁছতে পারেনি তারা এই সত্তাটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি। এক কথায় তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক ও রূহানিয়্যাতের পথচলায় সিদ্ধ মুসাফির। ‘ফুরসানুন নাহার ওয়া রুহবানুল লাইল’-এর তিনি ছিলেন উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দিনের পর দিন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিনিদ্র রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা নিকট অতীতে তার মতো আর কারো আছে কি না জানা নেই। বছরের অধিকাংশ সময় রোজা রাখা, নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আল্লাহর দরবারে মনের সকল অর্গল খুলে দিয়ে রোনাজারী করা, নীরবে-নিভৃতে একান্ত সাধনায় নিমগ্ন হয়ে যাওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো।
তরিকত ও মারিফত তথা সুলুকের পথের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা যখন তিনি দিতেন, তখন কিছুটা অনুমান করা যেতোÑ এই জগতের সঙ্গে সখ্যতা তার কতো গভীর। আকাবির আসলাফ, আধ্যাত্মিক জগতের সাধক মহাপুরুষদের প্রাণবন্ত আলোচনা যখন করতেন, মনে হতো চোখের সামনে ভেসে বেড়ানো দৃশ্যগুলোর তিনি বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন।
একজন ‘সাহেবে নিসবতের’ সব গুণাবলীই তার মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো। রিয়াজত ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ‘মুজাযে সুহবাত’। পরবর্তী সময়ে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর আরও কয়েকজন বিশিষ্ট খলীফা তাকে বায়আত করার অনুমতি প্রদান করেন।
তিনি প্রথমে হযরত শায়খুল ইসলাম যফর আহমদ উসমানী (রহ.)-এর হাতে ইসলাহী বাইআত গ্রহণ করেন। হযরত সদর সাহেব হুজুরের (রহ.) প্রত্যক্ষ নিবিড়-নিরবচ্ছিন্ন সোহবতে ছাত্র জীবনের শেষ আট বছর ইলম ও তাযকিয়া হাসিল করেন। সদর সাহেবের (রহ.) ইন্তেকালের পর থেকে হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) সরাসরি নেগরানীতে মাদ্রাসা পরিচালনা, শিক্ষকতা, বয়ান, তাফসীর ও রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করেন। এ সময় হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান খেলাফত আন্দোলনের ২য় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব (সেক্রেটারী জেনারেল) তার উপর ন্যস্ত করেন। পাশাপাশি প্রথমে জামেয়া নূরীয়া এরপর লালবাগ জামেয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। আর এসব দায়িত্বভার কুতুবুল আলম হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) মুফতি আমিনী (রহ.)-কে তার রুহানী ও ইলমি স্তরের ভিত্তিতেই অর্পণ করেছিলেন। লালবাগ জামেয়ার পরিচালনা, দেশের শীর্ষস্থানীয় দলের কর্মকা-ের মধ্যমণি ও হাফেজ্জীর মুখপাত্র হওয়া, দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করার পরও নিয়মতান্ত্রিক তাযকিয়ার মুজাহাদা করা তাঁর জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল। হযরত হাফেজ্জী হুজুরের মুজাযে সুহবত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তিনি। এরপর হযরতুল আল্লাম আব্দুল কবীর বাউতলী (রহ.)-সহ দেশ-বিদেশের বহু মাশায়েখের পক্ষ হতে তাসাউফের চার তরিকার ওপর তিনি খিলাফত লাভ করেন। জীবনের শেষ ১০-১২ বছরে আবেদন-নিবেদনের প্রেক্ষিতে হাজার হাজার আলেম ও দীনদার ব্যক্তিবর্গের ইসলাহী বাইআত গ্রহণ করেছেন। মাসিক ইসলাহী মজলিসও নিয়মিত জারি রেখেছিলেন। তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) নিসবতে বাইআত গ্রহণ করতেন। সহীহ আক্বীদার সকল তরিকাই অনুসরণযোগ্য মনে করতেন তিনি। পৃথিবীর সকল প্রান্তের আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলেমদের সাথে সম্পর্ক কায়েম করার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। দেওবন্দী মাশায়েখের মাঝে ভাগ-যোগ করা তিনি মনেপ্রাণে অপছন্দ করতেন। তাঁর টেবিল, আলমারীর ও হাতের নাগালে থাকা বৈচিত্র্যপূর্ণ কিতাবগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলেই তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রশস্ততা অনুমিত হত।
আকাবিরের মালফুজাতের প্রতি অদম্য প্রেম
তার টেবিল-আলমারির শোভা ছিল মনিষীদের জীবনী ও মালফুজাতের গ্রন্থসমূহ। হযরত থানভীর (রহ.) খুতুবাত, মালফুজাতের বড় বড় সেট, শায়খুল হাদীসের আপবীতী, মাদানীর নাকশে হায়াত, খুতুবাতে জমিয়াতে ওলামায়ে হিন্দ, হযরত কাশ্মিরীর মাজমূয়া রাসাইল, নাকশে দাওয়াম, তাযকিরাতুল খলীল, তাযকিরাতুর রশিদ, হায়াতুস সাহাবাহ, ফাযায়েলে আমাল, ওলামায়ে হিন্দ কী শানদার মাযী, তারীখে দারুল উলুম দেওবন্দ, মালফুজাতে ফকীহুল মিল্লাত, সাওয়ানেহে ওলামায়ে দেওবন্দ, হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগাহ ইত্যাদি গ্রন্থাবলীর অনুসন্ধানী অধ্যয়ন তার নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
তিনি তার জীবনে প্রাধান্য দিয়েছেন সেসব আকাবিরের কর্মপন্থা, যারা একই সাথে বহুগুণে গুণান্বিত হয়ে দীনের সব শাখায় অবদান রাখতে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি দীনের নির্দিষ্ট কোনো একটি শাখাকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য শাখাগুলোর ব্যাপারে উদাসীনতা করাকে দীনের জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন এবং একটা ধরে অন্যগুলোকে গুরুত্বহীন মনে করাকে গোমরাহী মনে করতেন। মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনী (রহ.) তাঁর শায়খ ও মুরব্বির পরিচর্যায় পর্যায়ক্রমে ‘জামে শাখসিয়্যিাত’-এ পরিণত হন। তিনি মুরব্বিগণের দিক-নির্দেশনা ছাড়া মাদ্রাসা বা রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। তাই সারা দেশের সকল ওলামা-পীর মাশায়েখের অন্তরে আল্লাহ তাআলা মুফতি আমিনীর (রহ.) প্রতি সুদৃঢ় দীনি মুহাব্বাত প্রোথিত করে দিয়েছিলেন। সকল স্তরের ওলামা ও দীনদার শ্রেণির মাঝে বাংলাদেশের ইসলামী শক্তির মুখপাত্র হিসেবে তার মর্যাদা অধিষ্ঠিত ছিল। কারণ, এ দেশে ইসলামবিরোধী প্রকাশ্য বা বর্ণচোরা যেকোনো শক্তিই অপকর্ম করলে মুজাহিদে মিল্লাতের (রহ.) আঘাতপ্রাপ্ত হতে বাধ্য ছিল। দীন ইসলামের স্বার্থের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাউকেই ছাড় দেননি। রূহানি শক্তি সমৃদ্ধ এই মহান নেতা যে জীবন, ইজ্জত, সম্পদ, পরিবার, সন্তান, সবকিছুকেই দীনের খাতিরে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেনÑ শত্রু-মিত্র সবাই তা অবলোকন করেছে। ইন্তিকালের ৫২ ঘণ্টা পূর্বে (১০-১২-১২ইং) সন্ধ্যায় কয়েক বছরে লেখা ‘রমাযান আওর রূহানিয়্যাত’ নামক তাসাউফ বিষয়ক একটি বড় গ্রন্থের পা-ুলিপি এই প্রবন্ধকারের হাতে ছাপার জন্য হস্তান্তর করেন। মুজাহিদে মিল্লাত রচিত ‘রমাযান আওর রূহানিয়্যাত’ নামক গ্রন্থটি ছাড়াও তার লেখা দুআ ও মোনাজাত, তিলাওয়াতে কুরআন, মা’আরিফুল মিরাজ, আল্লাহর পথে, দীনে এলাহী; অসৎ আলেম ও পীরসহ ইবাদত ও তাসাউফ বিষয়ক গ্রন্থাবলি পাঠ করলে আহলে ইলম যে কেউ তাঁর রূহানী ও ইলমি মাকাম সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবেন।’
দুআর বিকল্প নেই
স্মৃতিচারণে হযরতের এক মুশফিক লেখেন- ‘আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী বছরের প্রায় প্রতি রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাগলের মতো কেঁদে-কেটে দুআ করতেন। এ দুআ কখনও মাদ্রাসায় তার রুম বন্ধ করে করতেন, কখনও ছাত্রদের ডেকে এনে দফতরে সম্মিলতভাবে করতেন। দুআর সময় দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতেন। সে কান্না সহজে শেষ হতো না। রাত ৩টার আগেই সারা মাদ্রাসার ছাত্ররা উঠে এসে শাহী মসজিদের বারান্দায় তাহাজ্জুদ পড়তো। তেলাওয়াত করতো। এরপর সবাইকে নিয়ে দু’হাত আল্লাহর দরবারে তুলে ধরতেন। সামনে ছাত্ররা বসা। উল্টোদিকে একা তিনি। বাতিগুলো অফ থাকতো। রাজনীতির ময়দানে হুঙ্কার দেয়া মুফতি আমিনী সেই অন্ধকার শেষ রাত্রে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে অসহায়ের মতো, ভিক্ষুকের মতো চিৎকার করে কাঁদতেন। তার সঙ্গে পুরো মসজিদ যেন কাঁদতে থাকতো। মনে হতো, তার বুক ফেটে যাচ্ছে। কান্নায়-কষ্টে, আবেদনে-আবদারে, দুঃখে-কাতরতায় তিনি নুয়ে নুয়ে পড়তেন। এসব দুআয় দেশ, দেশের মানুষ, দেশের স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য বড়ো একটি সময় জোরে জোরে দুআ করতেন।
দিনে মর্দ্দে মুজাহিদ রাতে একনিষ্ঠ আবেদ
হযরতের একজন সফরসঙ্গীর স্মৃতিচারণ- সভা শেষ করে আমরা রুটিন অনুযায়ী ফিরে এলাম চট্টগ্রাম ষোলশহর মাদ্রাসায়। রাত প্রায় ১টা বাজে। খাবার ও রাত যাপনের ব্যবস্থা হলো এখানেই। সবাই ক্লান্ত শরীরে নিজ নিজ কামড়ায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। হুজুর আমাকে এবং হাসানাত ভাইকে তার সঙ্গেই থাকতে বললেন। আমি ভেবেছিলাম, সারাদিনের সফর করে ক্লান্ত দেহে হুজুর হয়তো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বেন। আমার দাঁত ব্যথা থাকায় ঘুম আসছিলো না। হুজুর যে খাটে ঘুমাচ্ছিলেন সেটার চারপাশে পর্দাঘেরা ছিলো। হঠাৎ দেখলাম, সেখানে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। একটু কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি কুরআনে কারীম তেলাওয়াত করছেন। ইতোপূর্বে তার সঙ্গে বিভিন্ন সফরে গেলেও কখনো রাতে থাকা হয়নি। কারণ, তিনি কোথাও গেলে থাকতেন না। ওয়াজ-মাহফিল কিংবা সভা-সমাবেশ শেষ করে যথারীতি ঢাকায় চলে আসতেন। সেদিনকার সেই দৃশ্য দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি যে বড় বড় হুঙ্কার দেন- এতো শক্তি সাহস কোত্থেকে পান? সেই রাতের পর থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাকে আর বেগ পেতে হয়নি। আসলে এইগুলিই ছিলো মুফতি আমিনীর রুহানি শক্তি। তিনি জাহেরি শক্তির থেকে বাতেনি শক্তিকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। মাওলার সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখাটাই ছিলো তার কাছে বেশি প্রিয়।
পরদিন সকালে ফজর পড়ে নাস্তার দাওয়াত ছিলো আল্লামা সুলতান যওক নদভীর দারুল মাআরিফে। নাস্তা শেষ করে সেখান থেকে সোজা চলে গেলেন রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায়। আগে থেকেই প্রোগাম ঠিক করা ছিলো যে, হুজুর শুধু ওলামায়েকেরামের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। কিন্তু এতো মানুষের সমাগম হয়েছিলো যে, তা আর সাধারণ সভায় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মাদ্রাসার সামনের মাঠে একটি সমাবেশই হয়ে গেলো। প্রোগাম শেষ করে বিকেলে জিরি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা তৈয়্যব সাহেবের সঙ্গে বৈঠক এবং ফটিকছড়ির অন্য আরেকটি মাদ্রাসায় সভা শেষ করে আমরা চলে এলাম বাবুনগর মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর আতিথ্য গ্রহণ করলাম। তিনি আমাদের বেশ খাতির যতœ করে রাত ও সকালে আপ্যায়ন করলেন। হুজুর বাবুনগর মাদ্রাসার ছাত্র ও আসাতিজায়ে কেরামের খেদমতে বয়ান করলেন। অতপর আমাদের গন্তব্য ছিলো নাজিরহাট মাদ্রাসা এবং সবশেষে রাতে হাটহাজারী মাদ্রাসা।
পূর্বেই একটি কথা আলোচিত হয়েছে যে, মুফতি আমিনী (রহ.)-এর মধ্যে বহুমাত্রিক প্রতিভা ও গুণের সমাবেশ ঘটেছিলো। তার একেকটি গুণ ও প্রতিভার বর্ণনা দিতে গেলে স্বতন্ত্র গ্রন্থের প্রয়োজন। উলুমুল হাদীস, উলুমুল ফিকহ তথা শায়খুল হাদীস ও মুফতি হিসাবে অনন্য সাধারণ খেদমত, দরস ও তাদরীসের বেনজীর অবদান, দাঈ তথা ইসলামের প্রচারক হিসাবে অনন্য এক ব্যাকুলতা ও আবেদন নিয়ে দেশময় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে ছুটে বেড়ানো, একজন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক হিসাবে তার সুনিপুণ দক্ষতা, একজন ওয়ায়েজ ও বক্তা হিসাবে অসাধারণ বাগ্মিতা, ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা সর্বোপরি যেকোনো দুর্দিনে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর নির্ভরযোগ্য অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা ও স্বীকৃতি তাকে অন্যরকম এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো।
রুহানিয়্যত ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা আসে না
মরহুমের এক খাস শাগরেদের স্মৃতিচারণ- ‘২০০৮ সালের কথা। হুজুর তখন আমাদের বুখারী পড়ান। প্রতিদিন সবক শেষে ছাত্রদের নিয়ে তিনি ইসলাম ও দেশের কল্যাণ কামনা করে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতেন। একদিন সবকে আমরা কয়েকজন হুজুরের কাছে বায়আত গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলাম। কারণ, আমরা জানতাম, হুজুর হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) অন্যতম খলিফা মাওলানা আবদুল কবীর (রহ.) ও আল্লামা আহমদ শফী দা.বা থেকে বায়আতের ইজাযতপ্রাপ্ত ছিলেন। হুজুর প্রথমে বায়আত করাতে রাজি থাকলেও আমাদের আগ্রহ ও পীড়াপীড়ি দেখে শর্ত জুড়ে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা কমপক্ষে একাধারে ১০ দিন নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়বে। আমি শুধু তাদেরই বায়আত করব।’ কে কার আগে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়বে ছাত্রদের মধ্যে শুরু হলো এই প্রতিযোগিতা। এ যেন এক মহা উৎসব। অবশেষে দাওরার অধিকাংশ ছাত্রই হুজুরের কাছে বায়আত গ্রহণ করে আত্মতৃপ্ত হল। হুজুর ঘোষণা করলেন, প্রতিমাসে একটি করে ইসলাহী জলসা হবে। আমাকে দায়িত্ব দিলেন সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য। মৃত্যু অবধি তিনি এটা জারি রেখেছিলেন।
এসব মজলিসে তিনি আমাদের শুধু এই নসীহতটি বেশি করতেন, ‘দেখ! রুহানিয়্যাত ছাড়া কোনো কাজে সফলতা আসে না। ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হতে হলে সবার আগে দরকারÑ রুহানিয়্যাত বা আত্মার পরিশুদ্ধী।’ আরও বলতেন, ‘আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন ছাড়া শুধুমাত্র জাহেরী শক্তি দিয়ে বর্তমানে টিকে থাকা মুশকিল। আধ্যাত্মিকতাই ছিলো আমাদের পূর্বসূরী আকাবিরের বড় শক্তি। এই শক্তির জোরেই ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলতেন, ‘শুধু সংগঠন আর ক্যাডার দিয়ে নয়, বিপ্লব হয় আধ্যাত্মিকতার দ্বারাই।’ এ জন্য বারবার তিনি মুজাদ্দেদে আলফে সানীর (রহ.) সংস্কার আন্দোলনের কথা উল্লেখ করতেন এবং পরে এ নিয়ে ‘দীনে এলাহী : অসৎ আলেম ও পীর’ নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেন।
হজ ও বিদেশ সফর
হজ ও ওমরা পালন
মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) বেশ কয়েকবার পবিত্র হজ্জ-ওমরা পালন করেছেন। আর্ন্তজাতিক সভা-সেমিনার, ওয়াজ-মাহফিল, দাওয়াহ-সেমিনার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি সৌদী আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত, মিশর, সিরিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছেন। ১৯৮৪ সালে ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের শান্তি মিশনেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন। হজ ও কাতারের দু’রকম দুটো সফরের ভাষ্য তারই দুই শাগরেদের কলমে তুলে ধরছি।
সৌদী প্রবাসী মাওলানা নাজমুল হুদা লেখেন- ‘হযরত একবার বায়তুল্লাহ’য় এলেন। খবর শুনে তাঁর খেদমতে হাজির হলাম। পরিচয় পেয়ে তিনি খুব খুশি হলেন। সেবার দীর্ঘ সময় হযরতের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি সবসময় তেলাওয়াত, নামাজ ও তাসবি হাতে নিমগ্ন থাকতেন। মাঝে-মধ্যে হুইল চেয়ারে করে হুজুরকে বায়তুল্লাহর তাওয়াফে নিয়ে যেতাম। একবার তিনি ধীর পদক্ষেপে পূর্ণ আত্মসমাহিত হয়ে আমার হাত ধরে তাওয়াফ করলেন, যেমন করে ছোট্ট ছেলে বাবার হাত ধরে। হঠাৎ হঠাৎ থেমে যেতেন এবং নিরিবিলি একটি জায়গা খুঁজে নিতেন, চারপাশের পরিবেশ নীরব না হলেও তিনি আশ্চর্য নিমগ্নতায় ইবাদতে বিভোর হয়ে যেতে পারতেন। কিতাবের বিভিন্ন পাতায় অসংখ্য জায়গায় রাসূলদের বিস্ময়কর কাহিনী পড়েছি এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। কিন্তু সেদিন তার হালত দেখে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। কী দেখলাম তা কিভাবে ব্যাখ্যা করি! শব্দ দিয়ে কী আর হৃদয়ের সব ছবি তুলে ধরা যায়? আমার মতো মানুষদের জন্য সেটা তো শুধুই অবলোকন ও অনুধাবনের বিষয়। এই পবিত্র বান্দার সান্নিধ্যে অল্প ক’টি মুহূর্তই আজ আমার জীবনের পরম সৌভাগ্যের। পরম পাওয়ার।
এখানে আরও একটি কথা বলে রাখা দরকার, তিনি ধর্মীয় ও জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও বায়তুল্লাহর সম্মান রক্ষার্থে সবসময় সবার অলক্ষ্যে কুরআন তেলাওয়াত, মুনাজাত ও অন্যান্য ইবাদত ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। আমার চোখে কাবা চত্ত্বরে সবার থেকে আলাদা করে দেখার মতো এটি ছিলো তাঁর স্বতন্ত্র একটি গুণ। অনেকে হযরতের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন এবং কথা বলার একটু সুযোগ খুঁজতেন। কিন্তু তিনি কারো সঙ্গে সালাম-মুসাফাহ ছাড়া অতিরিক্ত কিছু বলতেন না। এখানকার অধিবাসীদের অনেকে আনন্দে বলে উঠতেনÑ আরে! ইনি তো আমিনী সাহেব হুজুর। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে হযরতকে কতোবার দেখেছি! তবু লোক সমাগম করে কখনও তিনি কথা বলতেন না, সবসময় জিকির-আজকারের মাঝে নিজেকে পূর্ণ নিয়োজিত রাখতেন।
বায়তুল্লাহ শরীফে মুফতি আমিনী
হযরতের সঙ্গে এটি ছিলো আমার জীবনে কা’বা চত্ত্বরে প্রথম ও শেষ দেখা। আমার মাথায় একটি টুপি দেখে খুব পছন্দ করেছিলেন, পরে সেরকম কিছু টুপি হাদিয়া দিয়েছিলাম এবং আমার জন্য দিল থেকে দুআ করেছিলেন। আমার খোশনসিব, জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সেই টুপি হুজুরের মাথায় শোভা পেয়েছিলো; তার কিছুটাও যদি অধমের আমলনামায় কবুল হয়, তা হলে আমার জীবন ধন্য। আজ সেই প্রিয়মুখটি আর নেই। কিন্তু তাঁর পবিত্র দেহ-সত্ত্বা আজও আমার দু’চোখে ছবির মতো ভাসে। হযরতের কথা ভাবতে গেলে, সোনালি দিনগুলোর কথা মনে হলে- নিজের অজান্তে চোখের পাতায় পর্দা নেমে যায়। হৃদয় হাহাকার করে ওঠে।’
কাতারে দাওয়াতি সফর
কাতার প্রবাসী মাওলানা ইউসুফ নূর বলেন- ‘২০০৩ সালে কাতারের অরাজনৈতিক দাওয়াতি সংগঠন মারকাযে দাওয়াতুল হকের পক্ষ থেকে আমরা মুফতি আমিনীকে কাতারে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি আমাদের দাওয়াত কবুল করলেন। কাতার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মারকাযে দাওয়াতুল হকের ব্যবস্থাপনায় হয়েছিলো হুজুরের এ সফর। মুফতি আমিনী সাহেব এখানে আসার কিছুদিন আগে বাংলাদেশে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অফিস থেকে কাতারস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে নির্দেশনা পাঠানো হলো, যাতে হুজুরকে ভিআইপি হিসেবে কাতারে গ্রহণ করা হয়। এর পরপরই বাংলাদেশ দূতাবাস আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং হুজুরের সফরসূচীতে অংশ নেয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে।
মুফতি আমিনী কাতারে আসছেন, এমন সংবাদে কাতারের সর্বস্তরের বাংলাদেশীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। প্রতিদিন কয়েকশ’ মানুষ ফোন করে জানতে চাইতেন, হুজুর কবে আসবেন, কোথায় থাকবেন ইত্যাদি। হুজুর আসার কয়েক সপ্তাহ আগেই আমরা তার আপ্যায়নের তালিকা করে ফেলি এবং এ ব্যাপারে অনেক মানুষের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে হয়েছিলো। নির্ধারিত সময়ে রাত দু’টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে হুজুর কাতারে এসে পৌঁছান এবং কাতার এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর জনাব এনায়েত সাহেবসহ আমরা হুজুরকে অভ্যর্থনা জানাই। ভিআইপি লাউঞ্জে বসে দূতাবাসের পক্ষ থেকে যখন তাকে সফরসূচী দেওয়া হলো, হুজুর তখন বিনয়ের সঙ্গে তাদেরকে বললেন, ‘যেহেতু আমি দাওয়াতী সফরে এখানে এসেছি এবং দাওয়াতুল হকের আমন্ত্রণে এ সফর হচ্ছে, তাই আপনাদের যেকোনো প্রোগ্রামে তখনই শরিক হতে পারবো যদি মাওলানা ইউসুফ নূর সেখানে অনুমোদন করেন। আপনাদের ব্যাপারগুলো তার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলে ভালো হবে।’ হুজুরের সেদিনের বিনয়মাখা এমন জবাব আমি আজো ভুলতে পারিনি।
বিশাল গাড়িবহরসহ আমরা হুজুরকে তার জন্য নির্ধারিত দানা এ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসি। হুজুর আমাকে একান্তে বলেছিলেন, ‘আপনাদের দাওয়াতি কোনো প্রোগ্রাম বাতিল করে বা আপনাদের কাউকে কষ্ট দিয়ে দূতাবাসের কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেয়ার কোনো দরকার নেই। আমি আজ ক্ষমতায় বলে আমাকে তারা ভিআইপি হিসেবে সমাদর করছে। কিন্তু আপনারা যারা আমার বিপদ এবং দুর্দিনের সঙ্গী, আপনারাই আমার কাছে বেশি আপন। আপনাদের কর্মসূচিকে বেশি প্রাধান্য দেবেন।’ আমি যেন তখন এক অন্যরকম মানুষকে আবিষ্কার করলাম। সরকারি আপ্যায়ন এবং সরকারি কর্মসূচি বাদ দিয়ে তিনি আমাদেরকে যেভাবে গুরুত্ব দিলেন, তা অন্যান্য অনেক মনীষীদের বেলায়ও দেখা যায় না।
পরদিন দোহা ঐতিহাসিক আবু বকর সিদ্দীক মসজিদে আলোচনা সভার মাধ্যমে হুজুরের কাতার কর্মসূচির সূচনা হয়। আমি সেদিন সবার সামনে মন খুলে হুজুরের পরিচিতি তুলে ধরি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পাশাপাশি ইলম ও আমলে হুজুরের গভীরতা এবং এখলাস ও সাহসিকতার বিষয়গুলো আলোচনা করি। আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, তাকে শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সংসদসদস্য হিসেবে ভাবা নয়, বরং আমি যে কারণে তাকে ভালোবাসি, তা হলো, তিনি একজন প্রজ্ঞাবান আলেম এবং আমাদের আকাবিরদের সুহবতপ্রাপ্ত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। একজন নায়েবে নবী হিসেবে যেসব গুণাবলী থাকা দরকার, আমরা মুফতি আমিনীর মধ্যে তার সবগুলো দেখতে পেয়েছি বলেই তাকে এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি কখনোই হুজুরের রাজনৈতিক কোনো সংগঠনের সদস্য হইনি, কিন্তু তবু এসব কারণে হুজুরকে ভালোবাসি। যুগে যুগে বাতিল যখন যে আকৃতিতেই এসেছে, তার বিপরীতে হকও প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের যুগে বাতিলশক্তি যেকোনো রূপ ধরেই আসুক না কেন, হক হিসেবে হযরত মুফতি আমিনী এ যুগে তাদের মুকাবেলায় অটল ও অবিচল ভূমিকা রেখেছেন। সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর হুজুর ব্যক্তিগতভাবে আমার এ উপস্থাপনায় সন্তষ্টি প্রকাশ করে বলেছিলেন, কারো সামনে এভাবে প্রশংসা করাটা কি ঠিক! দশদিনের এ সফরে হুজুর প্রায় বারোটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন। এর মাঝে মাঝে বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শনসহ এখানে-ওখানে ভ্রমণ করেছেন। হুজুরের সবগুলো অনুষ্ঠানে হাজার হাজার বাংলাদেশির সরব উপস্থিতি ছিলো, যা সত্যিই বিস্ময়কর। বিদেশ-বিভূঁইয়েও তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতার এ এক অভূতপূর্ব নিদর্শন।
ইসলামী রাজনীতির দর্শন ও বড়দের সম্মান
মুফতি আমিনী (রহ.) তার এ সফরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে কথাটি বেশি বার বলেছিলেন, তা হচ্ছেÑ অন্যরা বলে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে বলি, দেশের চেয়ে ইসলাম বড়। অনেকে বলে, সবার উপরে দেশ। আমি বলি, সবার উপরে ইসলাম। আমরা প্রয়োজনে ইসলামের জন্য দেশ ছাড়তে প্রস্তুত ঠিক যেভাবে আমাদের নবী ইসলামের জন্য মক্কাভূমি ত্যাগ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি তার বিভিন্ন জেলজীবন নিয়ে স্মৃতিচারণ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গেও মূল্যবান বয়ান করেছিলেন।
কাতারের বিভিন্ন ঘরোয়া বৈঠকে তাকে শায়খুল হাদীস (রহ.) সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। দোহার ওলামা সম্মেলনেও তাদের বিভক্তি বিষয়ে অনেক প্রশ্ন এসেছিলো। তিনি সেদিন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আপানরা যদি শায়খুল হাদীস সাহেবের সঙ্গে আমার আচরণ দেখেন তবে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। হুজুর এবং আমার মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে, এটা মতবিরোধ নয়। কাজের ক্ষেত্রে এমন মতপার্থক্য হতেই পারে। আপনারা এগুলোকে কখনোই শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যাবেন না। চরমোনাই পীর সাহেব থেকে নিয়ে সবাই আমাদের মানুষ। কাউকে এমনভাবে শত্রু ভাববেন না যেন পরে তার কাছে আপনাকে লজ্জিত হতে হয়। সেদিনের বক্তব্যে মুফতি আমিনী সাহেব তার সব আসাতিযায়ে কেরামের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পুরো বয়ানেই তিনি গভীর ইলমি বিষয়ে আলোচনা করেন। আমার মতো আরো অসংখ্য মানুষ সেদিন অবাক হয়ে বলেছিলেন, হুজুর যে এতো গভীর ইলমি বিষয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন, তা আমাদের কল্পনায়ও ছিলো না। কাতারে হুজুরের এ সফরের পর তার সম্পর্কে সবধরনের সংশয়, অভিযোগ এবং বিদ্বেষ দূরীভূত হয়। সবার মনে তাকে নিয়ে স্বচ্ছ ভালোবাসা এবং গভীর শ্রদ্ধার নতুন চেতনা জাগ্রত হয়। শুধু তাই নয়, তিনি এখানে কাতারের পুরো সফরে নিজস্ব রাজনৈতিক দল এবং চিন্তাভাবনা সম্পর্কে কোনো আলোচনা কিংবা সমর্থন চাননি।
দেশের বাইরে ইলমি প্রভাব
কাতার ধর্মমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে বিশিষ্ট আলেম ও চিন্তাবিদ ডক্টর মুহান্না ইউসুফ আসসুলাইতির সঙ্গে হুজুরের সাক্ষাতপর্ব অনুষ্ঠিত হয়। মাত্র আধা ঘন্টা নির্ধারিত থাকলেও ডক্টর আসসুলাইতি হুজুরের সঙ্গে দুই ঘন্টার বেশি সময় নিয়ে আলোচনা করেন এবং তার প্রজ্ঞা ও ইলমি গভীরতা দেখে মুগ্ধ হন। ফতোয়া আন্দোলন, চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন এবং রাজনীতি প্রসঙ্গে হুজুরের বক্তব্য শোনার পর তিনি বলেছেন, ‘এটাই প্রমাণ করে আপনাদের মধ্যে ফকীহ রয়েছেন। একজন ওয়ায়েজ এবং একজন ফকিহের মধ্যে এখানেই পার্থক্য।’ হুজুর তাকে বলেছিলেন, আমরা বর্তমানে এমন একটি অবস্থানে আছি যে, আমাদেরকে অবহেলা করে কোনো শক্তি বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
এ সাক্ষাত-অনুষ্ঠানে হুজুরের মুখে বিশুদ্ধ আরবির প্রাঞ্জল উচ্চারণ এবং পা-িত্য দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। যেন তিনিও আমাদের মতো অনেকদিন ধরেই আরব দেশে বসবাস করছেন। হুজুরের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে ডক্টর আসসুলাইতি আমাদের কাছে মুফতি আমিনীর সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরা বিষয়টি দূতাবাসকে জানালে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত তার বাসভবনে আপ্যায়ন অনুষ্ঠানে হুজুরের সঙ্গে ডক্টর আসসুলাইতি এবং ডক্টর আলী ইদরিসকেও স্বাগত জানান। এই প্রথমবারের মতো কোনো কাতারি কর্মকর্তা বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের বাসায় অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন। সেদিনের সেই আপ্যায়ন পর্বটি অত্যন্ত হৃদ্যতা এবং আন্তরিকতায় অনন্য হয়ে উঠেছিলো। কাতারে দূতাবাসের উদ্যোগে কোনো বাংলাদেশি আলেমকে আপ্যায়নের ঘটনাও এটাই প্রথম।
কাতারে অবস্থানকালে এখানকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে হুজুরের সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। এসবের মধ্যে কাতারের বহুল প্রচারিত দৈনিক আশশারক অন্যতম। আশশারকের বিশেষ প্রতিনিধি তাহা হোসাইন হুজুরের সুদীর্ঘ সাক্ষাতকার নেন। ওইদিনই ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গেও তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। হুজুর খুব সাবলীলভাবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সেটির উত্তর দিয়েছিলেন। ব্যক্তি সাদ্দামের চেয়ে এখানে বিশ্বমুসলমানদের প্রতিও যে আঘাত হানা হচ্ছে, তিনি সেদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সাংবাদিক তাহা হোসাইন যাওয়ার সময় হুজুরের পা-িত্য এবং বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরের প্রশংসা করে বলেছিলেন, মুফতি আমিনী একজন সুযোগ্য এবং কৌশলী রাজনীতিবিদ।
আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো, সাহস নিয়ে সামনে চলো
কাতারের পুরো সফরে আমি হুজুরকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তার সাহচর্যে অনেক শিক্ষণীয় সময় কাটিয়েছি। আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলতে চাই, মুফতি আমিনীর (রহ.) ওই সান্নিধ্য থেকে আমি সবচে’ বেশি যে গুরুত্বপূর্ণ সবকটি শিখেছি তা হলো- অবস্থা যতোই প্রতিকূল হোক, কখনো হতাশ হওয়া চলবে না বরং সাহস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আপন মানুষ কষ্ট দিলেও সবর করা এবং যতোবেশি সম্ভব আল্লাহ পাকের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা। কাতারের সফরে তার কখনো রাতের ইবাদত কাযা হয়নি। কয়েক রাত হুজুরের সঙ্গে থাকার পর কাতার মারকাযে দাওয়াতুল হকের আমীর মাওলানা লুৎফুর রহমান বলেছিলেন, রাতের আমিনী সাহেবের কান্নাকাটি না দেখলে বোঝা যাবে না, আমাদের দেখা আমিনী সাহেব আর প্রকৃত আমিনী সাহেবের মধ্যে কতো পার্থক্য।’
প্রকৃত আলেম ও দাঈর সবকিছুই ব্যতিক্রম হয়। ইবাদত আর দাওয়াহর বিষয়ই তারা সবখানে, সবক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ বা সখ-আহ্লাদে কখনো তারা নিজের দায়িত্ব ভুলে যান না। পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসেবে যাদের আগমন, নবীজীর ওয়ারিস হিসেবে যাদের বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়া- তাদের দিনযাপন ও প্রাত্যহিক কাজের ধরন তো এমনই হবে।
লেখালেখি
বিভিন্ন ভাষায় রচিত বই ও কিতাব
নতুন ডাক স্মারক সংখ্যার কাজের সময় সহযোগী সম্পাদক মুফতি সুহাইল আহমাদকে আমিনী সাহেব লিখিত বইগুলোর সংক্ষিপ্ত একটা পরিচিতি লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। দারুণ নিপুণতায় কাজটা সে আঞ্জাম দিয়েছে। সুহাইল লেখেন- ‘অনেক মনীষীর ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে- তিনি শুধু একজন ব্যক্তিই ছিলেন না, ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। আর আমাদের বিশ্বাসে, শায়খুল ওলামা, ইমামুল উম্মাহ, মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) শুধু একজন ব্যক্তিই ছিলেন না। ছিলেন অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের আধার। কারণ, এদেশে যারা রাজনীতি করেন, তদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং ছাত্রজীবন থেকেই কমিউনিজমে আস্থাশীল কাজী জাফর আহমদ পর্যন্ত তাঁর শোকবাণীতে এটি স্বীকার করেছিলেন। বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের মাঠে যারা মুফতি আমিনীকে দেখেছেন তারা অবশ্যই বলবেন তিনি সত্যিকার অর্থেই রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক ছিলেন। অন্যদিকে যারা মুফতি আমিনীর কাছে পড়েছেন তারা বলবেন তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। যারা মুফতি আমিনীর একদম কাছের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন; তারা বলবেন তিনি ছিলেন রাতে আল্লাহপ্রেমিক সুফী-সাধক আর দিনে আল্লাহর রাহে নিবেদিতপ্রাণ একনিষ্ঠ মর্দ্দে মুজাহিদ। এতোসব গুণাগুণ আর এমন বিরলতর প্রতিভার সমন্বয় মহাকাল খুব কমই দেখতে পায়।
ছাত্রজীবন থেকেই কিতাবাদি-বইপত্র বিশেষত কুরআন-হাদীসের সাথে নিবিড় সম্পর্কের যে সুখ্যাতি তার ছিলো, আমৃত্যু সেটাকে তিনি কেবল পরিণতির দিকেই নিয়ে গেছেন। এতো যে পড়াশোনা করা যায়, অধ্যয়নের ধরন ও গভীরতাও যে এমন হতে পারে তাঁকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। এটাকেও বরং আকাবিরদের করা অসংখ্য অসম্ভব কাজের একটি মনে করা হতো। মুফতি আমিনীর যারা কাছের মানুষ ছিলেন বা ছাত্র, তারা জানতেন কারো কোনো লেখালেখি বা বই-পত্রিকা প্রকাশের খবর পেলে তিনি কতোটা খুশি হতেন। উৎসাহ ও দুয়া, সাহস ও সহযোগিতায় ভরিয়ে দিতেন। লেখালেখির প্রতি তিনি ছিলেন দারুণ অনুরাগী। প্রমাণ হিসেবে আরবি-উর্দু-বাংলায় রচিত তাঁর বিশাল রচনাসম্ভারই যথেষ্ট। তাঁর রচিত এবং প্রকাশিত বেশকিছু কিতাবপত্র ও বইয়ের পরিচিতি এখানে তুলে ধরা হলো।
দরসুল বুখারী লিসালাফিনাল আকাবির
এটি আরবি ভাষায় রচিত একটি অনবদ্য গ্রন্থ। সহীহ বুখারীর পূর্ববর্তী শায়খদের দরসদানের অবস্থাদি এতে বিবৃত হয়েছে। এটি বুখারী শরীফের মৌলিক কোনো ব্যাখ্যাগ্রন্থ নয়। বরং বুখারী শরীফ, সিহাহ সিত্তাহ ও ইলমে হাদীসের যেসব খেদমত আমাদের পূর্ববর্তী মনীষী করেছেন তার উপর রচিত একটি বিশদ প্রবন্ধ । এটি রচনা করতে গিয়ে তিনি যেসব কিতাবের সহায়তা নিয়েছেন সেগুলো হলোÑ হাদয়ুস সারী, ফতহুল বারী, ফয়জুল বারী, লামিউদ দুরারী, আল কাওকাবুত দুররী, বায়ানুল মাজহাদ, ফজুলল বারী, মুকাদ্দামাতুল বুখারী, ফতহুল মুলহিম, মাআরিফুস সুনান, আওজাযুল মাসালিক, আল আবওয়াব ওয়াত তারাজিম, ইনহাউস সাকান, ইলাউস সুনান, আল মাআরিফুল মাদানিয়্যাহ, আপবীতী, তাকরীরুল বুখারী, আল আজালাতুন নাফিয়াহ, আশরাফুস সাওয়ানিহ ইত্যাদি। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে দি ঢাকা প্রিন্টিং প্রকাশ নামের একটি প্রকাশনী। উন্নত কাগজে বাঁধাইকৃত ১৩৩ পৃষ্ঠার অনন্য এই গ্রন্থটির কেবল রিজার্ভ কপিই মজুদ আছে; বাজারে নেই।
আল কানূনুল ইসলামী দামিগুন লিল কানূনিল অজয়ী
এটি একটি পুস্তিকা। আরবিতে রচিত। এর বাংলা অনুবাদও বের হয়েছে। নাম ইসলামী আইন বনাম মানব রচিত আইন। এতে ইসলামী আইনের তাৎপর্য তুলে ধরে মানব রচিত আইনের ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। যেনো পাঠক খুব সহজেই উভয়টার পার্থক্য অনুধাবন করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি মূলত মুফতি আমিনীর লেখক জীবনের শুরুকালের একটি পুস্তিকা। তবে এটি এখন দু®প্রাপ্য।
তরীকে মুতালাআ
এর পূর্ণ নাম হলো সালাফ ও আকাবির কা তরীকে মুতালাআ আওর উনকা ইলমি ইনহিমাক। এই গ্রন্থটি উর্দু ভাষায় রচিত। ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এতে আকাবিরে দেওবন্দ ছাড়াও প্রায় সর্বযুগের ওলামা এবং অধ্যবসায়ী মনীষীদের গবেষণা ও তাদের গভীর পড়াশোনার সুবি¯তৃত পর্যালোচনা রয়েছে। রয়েছে নবীনদের জন্য পরামর্শও। গ্রন্থটি পাক-ভারতের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছে। ২১৪ পৃষ্ঠার এই কিতাবের আদি মূল্য ৩৮ টাকা।
আদর্শ ছাত্র
আর্দশ ছাত্র কীভাবে গড়া যাবে সেই চিন্তা-ভাবনা সবকালেই ছিল আমাদের আকাবির আসলাফের। এজন্যই তারা হলেন আদর্শ মানুষের বাস্তব নমুনা। তাদেরকে আদর্শ মানুষ হতে কী করতে হয়েছে, কী ধরনের চেষ্টা-প্রচেষ্টা মেহনত-মুশাক্কাত তারা বরদাশত করেছেন সেই ইতিহাস আজকের ছাত্র সমাজের সামনে উজ্জ্বল থাকা দরকার। কিন্তু সেই ইতিহাসের উজ্জ্বল উপস্থাপন কি আমাদের সামনে আছে?.. না নেই। যে কারণে ছাত্ররা অন্ধকারের ঘোরে নিমজ্জমান। ফল হিসেবে ছাত্ররা আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আদর্শ মানুষ হয়ে বের হতে পারছে না। এই চরম জটিলতা থেকে উত্তরণের জন্যই আল্লামা মুফতি আমিনী গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন। এটি মূলত উপরোল্লেখিত তরীকে মুতালাআরই বঙ্গানুবাদ। তবে পরবর্তীতে ব্যাপক সংযোজনের কারণে এটি শুধুমাত্র অনুবাদ থাকেনি বরং একটি নতুন গ্রন্থের অবয়ব পেয়েছে। এতে একজন ছাত্রের জন্য অনুসরণীয় করণীয় এবং বরণীয় সব তথ্য এবং দিকনির্দেশনা তিনি জমা করেছেন। ইতোমধ্যেই বইটি ছাত্র ও শিক্ষক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। যে কারণে প্রথম সংস্করণ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এর সবগুলো কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। এটি প্রথম প্রকাশ করে লালবাগ জামেয়ার ২০০৩ সালের বিদায়ী ফারেগীনরা। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে ২০০৯ সালের ফারেগীনরা। সাড়ে তিনশ’ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটির মূল্য ২০০ টাকা। এবং এখনো বইটি সমান গুরত্ব নিয়ে পাঠকমহলে সমাদর পাচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, এ যুগের প্রতিজন বিদ্যোৎসাহীর হাতে হাতে বইটি থাকা এবং এর গাইড লাইন মেনে চলা অপরিহার্য।
ফাতাওয়ায়ে জামেয়া
এটি লালবাগ জামেয়ার ফতোয়া সংকলন। মোট ৬টি খ-ে প্রকাশিত। অতিসম্প্রতি উক্ত ৬ খ-কে ৩টি ভলিয়মে প্রকাশ করেছে বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন্স ঢাকা। এর প্রায় প্রত্যেকটি ফতোয়াই মুফতি আমিনীর দক্ষ হাতে লিখিত ও সম্পাদিত। ইতোমধ্যে ফতোয়াগবেষক এবং সুধী মহলে গ্রন্থখানি বেশ সমাদৃত হয়েছে। হয়েছে আলোচিতও। বাংলাদেশের ইলমি জগতে নিঃসন্দেহে এটি ব্যতিক্রমী সংযোজন। ৮ শতাধিক পৃষ্ঠার প্রতিটি ভলিয়মের মূল্য ৫০০ টাকা।
আল্লাহর পথে
বাংলাদেশের সর্বমহলে একজন সাহসী ও জ্ঞানগর্ভ বাগ্মী হিসেবে আল্লামা মুফতি আমিনী (রহ.) ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দেশের আনাচে কানাচে প্রতিনিয়ত তিনি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের সামনে মূল্যবান বয়ান ও বক্তৃতা করে গেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মানুষও তার বক্তব্য শোনার জন্য উন্মুখ থাকতো। তার সেসব জ্ঞানগর্ভ কালোপযোগী সাহসী ও দ্বীপ্তিময় মূল্যবান ভাষণ ও নসীহতের সমন্বয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে আল্লাহর পথে। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০০৪ সালে। এরপর লালবাগ জামেয়ার ২০১১ সালের ফারেগীনদের উদ্যোগে দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। ৪২০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির মূল্য ৩০০ টাকা।
কারবালার শিক্ষা
শিয়া এবং খৃস্টান ঐতিহাসিকদের জঘন্য কলমের আঘাতে কারবালার ইতিহাস হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। উদ্ভট এবং চরম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে বহু নির্মল চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে। বিষাদ সিন্ধু মার্কা বইয়ের যাদুকরি বর্ণনাশৈলী সরলমনা মুসলমানদের মাঝে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেছে। এহেন মুহূর্তে তীব্র যে প্রয়োজনটা ছিলো, সেই প্রয়োজনটা প্রায় পুরোপুরিভাবেই মেটাতে সক্ষম হয়েছে কারবালার শিক্ষা। বইটি ইতিহাসের সত্যান্বেষী পাঠক ও সুহৃদ ব্যক্তিবর্গের হাতে হাতে থাকা অতীব জরুরি বলে মনে করছি। বইটি নাদিয়াতুল কুরআন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য ৭০ টাকা।
তিলাওয়াতে কুরআন
এটি উর্দু ভাষায় রচিত। কুরআনপাঠের প্রয়োজনীয়তা, ফজীলত এবং গুরত্ব কতটুকু তা বিশদভাবে বিধৃত হয়েছে গ্রন্থটিতে। তা ছাড়া এ সংশ্লিষ্ট প্রচুর তথ্য সংকলিত হয়েছে এতে। কুরআনের সাথে যাদের সম্পর্ক সুগভীর কিংবা যারা সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী, তাদের জন্য গ্রন্থটি অত্যন্ত মূল্যবান রতœ হিসেবে বিবেচিত হবে। বোদ্ধাদের মতে এটি পাঠ্য পুস্তকের মর্যাদা রাখে। এর দুটি প্রকাশিত অনুবাদ পাওয়া যায়। একটি বড় কাটারা মাদ্রাসার ২০১০ সালের বিদায়ী ছাত্রদের উদ্যোগে প্রকাশিত। অপরটি প্রকাশিত লালবাগ জামেয়ার একই বছরের ফারেগীনদের উদ্যোগে। ২৩২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা।
দীনে এলাহী, অসৎ আলেম ও পীর
গ্রন্থটি ২০১১ সালের শুরুতে প্রণয়ন করা হয়। যে সময়টিতে সরকার বেশ ক’টি ইসলামবিরোধী জাতীয় আইন পাশ করে ফেলেছে কিংবা প্রক্রিয়া চালাচ্ছিলো। হকপন্থী আলেমগণ মাঠে আন্দোলন করেছেন। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সরকার কূটচালের আশ্রয় নিলো। এদেশের কতিপয় মীর জাফর মার্কা আলেম সরকারের সহায়ক হয়ে বাদশাহ আকবরের দরবারী আলেম আবুল ফজল, ফয়েজী প্রমুখদের ভূমিকা গ্রহণ করে নিলো। সেই চরম মূহূর্তে আত্মভোলা ও আত্মঘাতি মুসলিম জাতিকে হুঁশিয়ার করার লক্ষ্যে মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী প্রণয়ন করেন যুযোপযোগী এই বইটি। বিষয়বস্তু এক হওয়ায় এর সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয় সদর সাহেব রচিত অসৎ আলেম ও পীর নামক পুস্তিকাটি। তাই এখন এর পুরো নাম ‘দীনে এলাহী অসৎ আলেম ও পীর’। ১৯০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির মূল্য ২০০ টাকা।
দুআ ও মুনাজাত
এটি উর্দুতে রচিত। সম্প্রতি এর বাংলা ভার্সনও বের হয়েছে। এতে দুআর প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা, গুরুত্ব ও মাসায়েল সুবিপুল পরিমাণে স্থান পেয়েছে । দুআ নিয়ে এমন মৌলিক রচনা সত্যিই বিরল। অন্যান্য ভাষায়ও এটি অনূদিত হওয়া দরকার। ঝকঝকে কাগজে মুদ্রিত ২৫৬ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য ২৫০ টাকা।
প্রকাশিতব্য গ্রন্থাবলি :
এই পর্যন্ত তার প্রকাশিতব্য চারটি গ্রন্থের খোঁজ মিলেছে আমাদের। এর মধ্যে সার্বিক বিবেচনায় সবচে সমৃদ্ধ, তথ্যবহুল ও প্রয়োজনীয় গ্রন্থটি হলো ‘মেছালী খেলাফত ও সিয়াসত’ (উর্দু)। রাজনীতি ও খেলাফাহ বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুদীর্ঘ এই গ্রন্থটির প্রশংসা করে গেছেন স্বয়ং মরহুম মুফতি আমিনী (রহ.)। এতে মুফতি আমিনীর ইজতিহাদি ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে খুব স্পষ্টভাবে। কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি ইতিহাসের শিক্ষা এবং তার তিন দশকের রাজনীতির অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত এই গ্রন্থটি আগামীদিনের ইসলামী রাজনীতিবিদ ও খেলাফাহ প্রত্যাশীদের জন্য অমূল্য সম্পদ। নতুন ডাক প্রকাশন থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে- ‘আদর্শ রাষ্ট্রনীতি আদর্শ রাজনীতি’ নামে।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) লিখিত আরেকটি অসাধারণ গ্রন্থ-‘মাআরিফুল মেরাজ ওয়াল ইসরার’। মেরাজ সম্পর্কে বাজারে প্রচলিত ঘটনা ও কল্পকাহিনীর বিপরিতে বাস্তব ঘটনা ও রহস্যাবলির এ এক দালিলিক সংকলন। উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি অনন্য উপহার।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) রচিত আরেকটি অসাধারণ গ্রন্থ- ‘রমজান আওয়ার রূহানিয়্যাত’। রমজান থেকে আমাদের আধ্যাত্মিক অর্জন কী হতে পারে কী ভাবে হতে পারে এর বিশদ বর্ণনা রয়েছে এই বইয়ে। রমজান আমলের মাস। দুআ ও রোনাজারির মাস। বাহ্যিক অর্জনের চেয়ে মুমিনের হৃদয়ের উন্নতি এ মাসে বেশি হতে পারে। হওয়া উচিত। এসব নিয়েই তিনি এ মূল্যবান বইটি রচনা করেছেন।
‘মাআরিফুস সিরাহ’ নবীজির জীবন ও কার্যাবলিকে বিষয় হিসেবে ধারণ করে প্রকাশিত বইয়ের বাস্তব কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবু একই বিষয়ে আরো একটি বই প্রণয়নের প্রয়োজন কেনো হলো বক্ষমান বইটিই এই প্রশ্নের যথাযথ জবাব বহন করে। পুরো জীবনের অসংখ্য পাঠ-অভিজ্ঞতার নির্যাস নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলোতে দরকারি এই বইটি রচনা করে গেছেন মুফতি আমিনী (রহ.)। নবীপ্রেমী প্রতিটি মুসলমানের জন্য এ এক অপরিহার্য খোরাক।
ইন্তেকাল
শোকাবহ সে রাতের কথা
হযরতের একান্ত খাদেম মাওলানা আল আমিন আজাদ সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন- ‘১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২। রাত ৮টা বেজে ৫৫ মিনিট। অন্যান্য দিনের মতোই হুজুর আমাকে ডেকে পাঠালেন। বাসায় যাবেন। প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে ঠিকঠাক করছি। হুজুরকে একটু ব্যতিক্রম মনে হলো। একদম নীরব। প্রতিদিন এসময় কতো কথাই তো বলেন। ব্যক্তিগত হোক, রাজনৈতিক হোক বা অন্য যেকোনোকিছু। আমি শুনতাম, প্রশ্ন হলে উত্তর দিতাম। কিন্তু সেদিন কিছুই বললেন না। শুধু আমার আপাদমস্তকে অন্যরকম এক নজর বুলালেন। আমি টের পাচ্ছিÑ হুজুর আমার প্রতি নজর বুলাচ্ছেন। কিন্তু চোখাচোখি হবে তাই হুজুরের প্রতি তাকাইনি। কেবল হালকা আওয়াজে দু’বার গলা খাকারি দিয়ে বেরিয়ে আসি। নীরব কক্ষে সেই গলা খাকারিটাই বড় করুণ শোনালো যেনো।
রিকশা যোগে সকাল সাড়ে এগারটায় সেদিন হুজুর বাসা থেকে মাদ্রাসায় এলেন। রুটিন অনুযায়ী প্রথমে পত্রিকা পড়লেন। কিছুক্ষণ পত্রিকা পড়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ব্যক্তিগত ইবাদতে। জোহরের পর দারুল ইফতার ক্লাস নেবেন কি নাÑ জানতে হুজুরের কাছে গেলাম। বড় কাটারা থেকে ছাত্রদের আসতে সমস্যা হবে ভেবে হরতালে হুজুর কোনো সময়ই ক্লাস নিতেন না। এদিকে আবার দীর্ঘ একমাস যাবত ইফতা বিভাগের ক্লাস নিতে পারছিলেন না। ঘরে গিয়ে দেখি, ভেতরের রুমে জায়নামাজে বসে কী যেনো পড়ছেন। এই সময়ে সাধারণত জায়নামাজে বসেন না। ভেতরের রুমে থাকলে হুজুরকে কেউ ডিস্টার্ব করে না। ফিরে আসতে চেয়েও কী ভেবে উঁকি দিয়ে বললামÑ
Ñক্লাস নিবেন হুজুর?
Ñহরতালে কাটারার ছাত্ররা আসতে পারবে?
Ñএই হরতালে তেমন সমস্যা হবে না।
Ñহ্যাঁ, তা হলে নিবো।
দারুল ইফতার ক্লাসে হুজুর একটি কথাই বারবার বুঝাচ্ছিলেন, অনেক কিছুই ঘটে যাবে যার কল্পনাও তোমরা করবে না। আর খিজির-মূসার আ. ঘটনা বলছিলেন। খিজির আ. এমন কর্মকা- করেছেন যেটা মূসা আ. ভাবতেও পারেন নি। ক্লাসে কথাগুলোতে অতীতকাল সূচক শব্দ ব্যবহার করছিলেন। যেমন- তোমাদের জন্য পর্যাপ্ত কিতাব দিয়েছি, তোমাদের মোটামুটি সব ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করে দিয়েছি ইত্যাদি। মাগরিবের পর বুখারীর দরস দিলেন। সাধারণত জানাযা পড়াতেন না, বাদ এশা আমেরিকা প্রবাসী প্রিয় এক শাগরেদের জানাযা পড়ালেন। কে জানতো, ঠিক একদিন পর আজকের জানাযার এই ইমামেরও জানাযা পড়তে হবে!
হুজুরকে বাসায় দিয়ে আসি রাত ৯টা ১৫ মিনিটে। মাদ্রাসায় এসে দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ক্লাসে হুজুর তাহাজ্জুদ আর আমলের প্রতি জোর দেওয়ার কথা বলেছেন বিধায় অনেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একজন তার মোবাইলে থাকা কৌতুক আর অপ্রয়োজনীয় সব ফাইল ডিলিট করে দিয়ে তাহাজ্জুদের প্রতিজ্ঞা করছে শুনলাম।
অসুস্থতার খবর
রাত ১১টা বেজে ১৫-২০ মিনিট। দপ্তরী মাসউদ ভাই জ্যাকেট পরতে পরতে দৌড়ে এসে চিৎকার করে বললেন- ‘আল আমীন, ৪-৫ জন ছাত্র নিয়ে দ্রুত হুজুরের বাসায় যাও, হুজুর মারাত্মক অসুস্থ। দ্রুত চলো! দ্রুত চলো! তিনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি ধীরে সুস্থে পায়জামা পড়ছি। ছাত্ররা আমার মন্থরগতি দেখে ক্ষেপে গেলো। ভেতরে তোলপাড় নিয়ে আমি ভাবছি, নিজেই যদি অস্থির হয়ে পড়ি তা হলে অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রƒষা করবো কীভাবে। বেরিয়ে একটি চলন্ত লেগুনায় ঝুলে কিল্লার মোড় পৌঁছতেই হুজুরের গাড়ি লক্ষ করলাম। হুজুরের ছেলে হাসানাত ভাই ড্রাইভ করছেন। হুজুর পেছনের সীটের বামপাশে বসা। জামাতা সাখাওয়াত সাহেব হুজুরকে ধরে রেখেছেন। হুজুরের মুখ অনেকটা হা অবস্থায়। আরোহী আর দু’জন পরিবারের নারী সদস্য। সবাই কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম হাসানাত ভাই! কোন হাসপাতালে? বললেন, ইবনে সিনা শংকরে। আগেরটাতেই। হুজুরের এই অবস্থা দেখে মুহূর্তেই আমার টনক নড়লো। বড় ধরনের কিছু কি! তৎক্ষণাত সেখানে থাকা ছাত্রদেরকে হাসপাতালের লোকেশন জানিয়ে দিয়ে বললাম- হেফজখানার ছাত্রদেরকে কুরআন পড়তে বলবে! আমি তখনই মটর সাইকেল যোগে হাসপাতালে ছুটলাম। পথে মাদ্রাসাগুলোতে ফোন করে হুজুরের অসুস্থতার খবর জানিয়ে দুআর আবেদন জানাতে থাকলাম। হাসপাতালে পৌঁছে জরুরী বিভাগে হুজুরকে পেলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি যান্ত্রিক সাহায্যে কৃত্রিমভাবে শ্বাস গ্রহণ করানো হচ্ছে। হুজুরের শরীরে কাপড় নেই; একটি লুঙ্গি পরা। হুজুরের বড় জামাতা যুবায়ের সাহেব আমাদের বললেন এখন শ্বাস কিছুটা কন্টিনিউ হচ্ছে। একটু ভালো। আমি হাসপাতালের ব্যাপার-স্যাপারে তেমন অভিজ্ঞ নই। তার কথার ভিত্তিতেই সকলকে বলতে থাকলাম- এখন একটু ভালো। ফোনের পর ফোন আসছিলো। সবাইকে আমি এই সংবাদই দিচ্ছিলাম।’…
জান্নাতের পথে যাত্রা
পরের ঘটনাপ্রবাহ বিশিষ্ট লেখক ও মরহুমের একান্ত শাগরেদ মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল সাহেবের বর্ণনায়Ñ ‘উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর শঙ্কার মধ্যে একেকটি মুহূর্তকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হচ্ছিলো। মনের ভেতর অজানা শঙ্কা ছটফট আর দাপাদাপি করছিলো। রাত তখন কত হবে? ১১টা কি সাড়ে ১১টা। ঘড়ি দেখার মানসিক সুস্থতায় কেউ নেই। আমরা কয়েকজন তখন ধানমন্ডি শংকরে ইবনে সিনা হাসপাতালের দুতলায় বসে দুশ্চিন্তার একেকটি লগন পার করছিলাম। উৎকণ্ঠিত মানুষের ভিড় ধীরে ধীরে বাড়ছিলো। ভেতরে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে সংজ্ঞাহীন শুয়ে আছেন আমাদের সকলের প্রাণ স্পন্দনের কেন্দ্রবিন্দু আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী। একটু ভালো সংবাদের প্রত্যাশা তখন আমাদের নতুন করে উদ্বেলিত করে। নিশ্চুপ একাগ্রতায় শুধু আল্লাহকে ডাকছি। আর নানান ভাবনার অথৈ সমুদ্রে বারবার হারিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ কী হয়ে গেলো? আজ সারাটা দিনই তো তিনি কর্মব্যস্ত ছিলেন। জোহরের নামাজের পর থেকে আসর পর্যন্ত দারুল ইফতায় সবক পড়িয়েছেন। আসরের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ওলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা সেরে প্রতিদিনের মতোই কামরার দরজা বন্ধ করে নির্জনে একান্ত হয়ে মুরাকাবায় বসেছেন। এটিই তার শেষজীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। এটিই তার ও আল্লাহর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় ও গভীর করার একান্ত সময় ছিলো। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে মাগরিবের আজানের পর দরজা খুলে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেছেন। নামাজের পর আমাদের কয়েকজনকে ডাকলেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন। প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশনা দিলেন। নসীহত করলেন। কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা নজরে পড়লো না। এমনকি স্কাইপি কেলেংকারিতে অভিযুক্ত একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের খবরে খুশি জাহির করলেন। ইসলামবিদ্বেষী হওয়ার কারণে আওয়ামীলীগকে তিনি কখনো পছন্দ করতেন না। তাদের বিরুদ্ধের যেকোনো খবরে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। তখনও তা হলো।
আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সেরে দারুল হাদীসে গেলেন দরস দিতে। এশার আগ পর্যন্ত সেখানে বুখারী শরীফের সবক পড়ালেন এবং তাকরীর করলেন। সবক থেকে ফিরে এসে আবার আমাকে ডাকলেন একা। প্রয়োজনীয় কিছু কথা বললেন। এশার পর তার প্রিয় এক ছাত্রের জানাযার ইমামতিও তিনি করলেন। প্রতিটি দৃশ্য এখনো চোখে ভাসছে। এত কর্মচঞ্চল ও প্রাণপ্রাচুর্যে সমুজ্জ্বল একজন মানুষের চোখের পলকে কী হয়ে গেলো!
ডাক্তারের ইশারায় সম্বিৎ পেয়ে দেখলাম, কয়েকজনকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ভেতরে গিয়ে যা দেখলাম, ডাক্তার যা বললেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না কিছুতেই। বাংলাদেশের মুসলমানদের সবচে’ প্রিয় মানুষটি আর নেই। মুসলমানদের আপদে-বিপদে বজ্র কণ্ঠটি আর শোনা যাবে না। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন স্থায়ী নিবাসে, না ফেরার দেশে। চলে গেছেন প্রিয়বন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে। সবাইকে এতিম করে, শোকের সাগরে ভাসিয়ে। চোখের সামনে সব তাকিয়ে দেখছি, কিন্তু ভেতরে কোনো বোধ কাজ করছিলো না, বিশ্বাস হচ্ছিলো না কিছুই। সব বাস্তবতাকে চিৎকার দিয়ে অস্বীকার করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। বাকরুদ্ধ, বোধশূন্য অবস্থায় ধীরে ধীরে তার শিয়রের পাশে গেলাম। দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। সেখানেই বসে পড়লাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। তখনও মনে হচ্ছিলো, এই মুদিত চোখ দুটো খুলে যাবে। তিনি স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি দিয়ে ডেকে উঠবেন। যা দেখছি, যা শুনছি, সবই অলীক। এখনই এই দুঃস্বপ্নের অবসান হবে। তিনি উঠে দাঁড়াবেন। আমাদের নিয়ে স্বপ্নের মঞ্জিলের দিকে হেঁটে যাবেন।
কে যেন কাঁধে হাত রেখে খুব আলতো করে বললো, ‘ভেঙে পড়লে তো চলবে না। শক্ত হোন, স্বাভাবিক হোন।’ ধীরে ধীরে বোধ ও চেতনা ফিরে পেতে শুরু করলাম। সত্য যতো কঠিন আর ভারিই হোক, তাকে তো মানতেই হবে। আল্লাহ তায়ালার ফায়সালার ওপর রাজি থাকাই তো ঈমানের অংশ। মেনে নিলাম। কিন্তু ২০১২ সালের ডিসেম্বর ১২ তারিখের (১২.১২.১২ইং) প্রথম প্রহরের এই বিয়োগান্ত ঘটনার কথা স্মরণ থাকবে আমৃত্যু। ঘড়ির কাঁটাও কি তখন ১২.১২ তে আটকে ছিলো? বর্ণাঢ্য জীবনের স্মরণীয় পরিসমাপ্তি।
উল্লেখ্য, রাত ১০টার দিকে কিল্লার মোড়স্থ নিজস্ব বাসভবনে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। আগে থেকেই তিনি ছিলেন ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত। ২০০৭ সনে তিনি ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতাল ও বাসায় শয্যাশায়ী ছিলেন। মুহূর্তে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো দেশে, বিদেশে, আন্তর্জাতিক পরিম-লে। শোকের ছায়া নেমে আসে সবার মাঝে। অবিশ্বাসের দোটানায় সকলের অনুভূতি যেন একই মোহনায় গিয়ে মিশে যাচ্ছিলো।
গোসল, জানাযা ও দাফন
আহলুল্লাহ ওয়াসেল সাহেব এরপর লেখেন- ‘আকস্মিক এই দুঃসংবাদের ধাক্কা সামলানো সকলের জন্যই কষ্টসাধ্য ছিলো। গভীর রাতেই আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ছুটতে থাকে, প্রথমে ধানম-ি ইবনে সিনা হাসপাতালে পরে লালবাগ জামেয়া অভিমুখে। প্রিয়মানুষকে হারানোর বেদনায় সকলেই শোকস্তব্ধ। কেউ চিৎকার করে বিলাপ করছেন, কেউ নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাচ্ছেন। একজন মানুষের জন্য লক্ষ কোটি মুসলমানের এই ভালোবাসার প্রকাশ, এই অশ্রুবিসর্জন, এই আক্ষেপ আহাজারির প্রকোপ তাকিয়ে দেখা যায়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
রাতেই গোসল দিয়ে তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানের প্রিয় স্থান দারুল হাদীসে রাখা হলো। সুদীর্ঘকাল এখানে বসেই তিনি ক্বালাল্লাহ ও ক্বালার রাসুলের দরস দিয়েছেন। এই ঘরেই তার প্রিয় উস্তায ও শায়খ হযরত সদর সাহেবের সুহবতে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, প্রহরের পর প্রহর। সারিবদ্ধভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে শেষ বারের মতো এক নজর দেখার জন্য দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়ালো। এমনিতেই তিনি ছিলেন সুপুরুষ। কিন্তু ইন্তেকালের পর তার হাস্যোজ্জ্বল অবয়ব থেকে এক অলৌকিক আভা ছড়াচ্ছিলো। এমন মোহনীয় সৌন্দর্যের দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা হয়, বারবার দেখেও তৃপ্তি আসে না। চোখ ফেরানো যায় না।
অভূতপূর্ব লোকসমাগম
পূর্বেই ঘোষণা ছিলো, জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে বেলা ৩টায় জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুপুরের আগেই ময়দান পূর্ণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হওয়ায় সেখানেই জোহরের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জোহরের নামাজের পর রাজধানী ঢাকার সব রাজপথ, অলিগলি এক সঙ্গে ছুটতে থাকে জাতীয় ঈদগাহের দিকে। সব স্রোতধারা এসে মিশে যায় একটি মোহনায়। বেলা ৩টা নাগাদ জাতীয় ঈদগাহ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আশপাশের রাস্তাঘাট, দক্ষিণে কার্জন হল ছাড়িয়ে রেলওয়ে হাসপাতাল, পূর্বদিকে জাতীয় প্রেসক্লাব ছাড়িয়ে পুরানা পল্টন মোড়, উত্তরে সুপ্রিম কোর্ট ছাড়িয়ে কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়। তখনও বিভিন্ন দিক থেকে খবর আসছে, আরিচায়, মাওয়া ফেরিঘাটে, কাঁচপুরে, টঙ্গীতে, মহাখালীতে, যাত্রাবাড়িতে, গাবতলীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ যানজটে আটকে আছেন।
এমন অভূতপূর্ব লোকসমাগম ইতোপূর্বে কবে কে কোথায় দেখেছেÑ উপস্থিত কেউ স্মরণ করতে পারলেন না। তিনি সারাজীবন যাদের জন্য লড়াই করেছেন, ভালোবাসা আর শোকের অশ্রুতে শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে তারা কার্পণ্য করেনি। এক সঙ্গে এতো মানুষের অশ্রু বর্ষণ ইতিহাস খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে।
বেলা সাড়ে ৩টায় লক্ষ লক্ষ আলেম-ওলামা আর ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয় ভাঙা বিলাপ আর অশ্রুবিসর্জনের মধ্য দিয়ে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। নামাজের ইমামতি করেন তার দীর্ঘদিনের সহপাঠী ও সহকর্মী, লালবাগ জামেয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও বর্তমান সদরুল মুদাররেসীন মাওলানা আবদুল হাই।
মুঘল ঐতিহ্যের ধারক লালবাগ কেল্লা সংলগ্ন লালবাগ শাহী মসজিদের সামনে সংরক্ষিত কবরস্থানে মাগরিব নামাজের আগ মুহূর্তে তাঁকে দাফন করা হয়। এখানেই তার পাশে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন শহীদ আল্লামা মোস্তফা আল মাদানী, মুফতি দীন মুহাম্মদ খান, মাওলানা আমিনুল ইসলামসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।’…
শেষের আগে
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মতো ব্যক্তিকে একটিমাত্র দিক বা এঙ্গেল থেকে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। ইলম-তাদরীস-দাওয়াহ-রূহানিয়্যাত-রাজনীতি-আন্দোলন ইত্যাদি সবদিকেই তার দখল, অর্জন ও অবদান অসামান্য। স্বল্পায়ূ জীবনে এতো বি¯তৃত ও বর্ণাঢ্য কার্যক্রম দেখে কেবল মুগ্ধ হওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। এই মানুষগুলোর মুখ শতাব্দীতে দু’একবারই দেখা যায়। একজন আমিনীর জন্য এ জাতিকে আরো কতো কাল অপেক্ষা করতে হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে এদেশের ইসলামী রাজনীতির তৈরি করা ক্ষেত্র যে অন্তত ৩০-৫০ বছর পিছিয়ে গেলো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমর বিল মারুফ আর নাহি অনিল মুনকারের বিবেচনায় আমাদের প্রতিবাদের ভাষাটি তৃতীয় স্তরে নেমে গেলো এই একটি মানুষের চলে যাওয়াতেই। তার ইন্তেকাল পরবর্তী বিগত চারটি বছর চোখে আঙুল দিয়ে এই বাস্তবতাই আমাদের দেখিয়ে যাচ্ছে। হায়, জাতীয় জীবনে আলেম সমাজ আজ কতোটা নিঃসঙ্গ এবং অসহায়! আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ অক্ষমতাকে ক্ষমা করুন। এই মহান মানুষটিকে জান্নাতে সুউচ্চ মাকাম দান করুন । আমিন!
পরিশিষ্ট- ১: সাক্ষাৎকার ও ঘরোয়া স্মৃতিচারণ
সামনে ঘোর বিপদ… -মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.)
শাকিল আদনান : আপনার ঢাকা আগমন পঞ্চাশের দশকে। সে তুলনায় আমিনী সাহেব ঢাকায় আসেন আরো অনেক পরে, ষাটের শুরুতে। কখন, কোথায় প্রথম তাকে দেখেন?
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.) : আমি আমিনী সাহেবকে প্রথম দেখি করাচীর নিউ টাউনে। একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। সেখানকার বাংলাদেশী ছাত্ররা আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিলো। ওখানেই আমি তাকে প্রথম দেখি। আর সে প্রথম দেখাতেই আমার মনে হয়েছিলো ছেলেটি মেধাবী এবং সচেতন।
শাকিল : কেনো এমন মনে হলো, কী আলাপ হয়েছিলো তখন?
মুহিউদ্দীন খান : না, সালাম আর কুশলবিনিময় ছাড়া তেমন কিছু আলাপ হয়নি। চেহারা দেখেই আমার এমন মনে হয়েছিলো। ওখানে বাংলাদেশী ছাত্রদের মধ্যে দুটো ছেলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। একজন মুফতি আমিনী। আর অন্যজন যাত্রাবাড়ীর মাওলানা মাহমূদুল হাসান। মুফতি আমিনী সাহেবের সাথে তেমন কথা না হলেও ময়মনসিংহের ছেলে হিসেবে মাহমূদুল হাসানের সাথে বেশ কথা হয়েছিলো।
শাকিল : তিনি বয়সে অনেক জুনিয়র হলেও আপনারা দীর্ঘদিন একত্রে রাজনীতি করেছেন। এই রাজনৈতিক পথচলার শুরু কখন, কীভাবে?
মুহিউদ্দীন খান : হাফেজ্জী হুজুর তার রাজনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু করলে আমি মাওলানা আমিনীকে বললাম, আপনি এ কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিচ্ছেন না কেন? তখনো তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তিনি বললেন, এটা তো হাফেজ্জী হুজুরও চান না। আমি আবার লালবাগের উস্তায। হাফেজ্জী হুজুর রাজনীতিতে নেমেছেন দেখে লালবাগ মাদ্রাসা-মসজিদ কমিটি এমনিতেই নারাজ। আমাদের উস্তাযদের প্রতিও তাদের সুধারণা নেই। আর আমি তো নবীন শিক্ষক। এখনই তাই ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আমি তখন বলেছিলাম, মিয়া কয় টাকা বেতন পান? আইসা পড়েন না চাকরি ছেড়ে…। যা হোক, পরে তিনি ইলেকশনের কাজে জড়ালেন। তার অল্প দিনের কাজ দেখেই আমরা তাকে কাছে টেনে নিলাম। ইলেকশন সামনে রেখে হাফেজ্জী হুজুর খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করলেন। তাতেও আমি আমিনী সাহেবকে জোড়ালোভাবে যুক্ত হওয়ার কথা বলেছি। হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর আমি যতোগুলো আন্দোলন করেছি, সবকটিতেই আমিনী সাহেবকে হাফেজ্জী হুজুরের কায়েম মাকাম মনে করেছি।
শাকিল : তখন তো খতিব উবায়দুল হক, শায়খুল হাদীস সাহেবসহ বড় বড় ওলামায়ে কেরাম ছিলেন। আমিনী সাহেবকে কেনো হাফেজ্জী হুজুরের কায়েম মাকাম মনে করলেন?
মুহিউদ্দীন খান : তার মধ্যে সে ধরনের যোগ্যতা ছিলো বলেই এমন মনে হতো। তার সাহস, গোছালো কথা-বার্তা, বডি লেঙ্গুয়েজ ইত্যাদি দেখে মনে হতো হাফেজ্জী হুজুরের কায়েম মাকাম হতে পারে একমাত্র সে-ই। এরপর তো খেলাফত আন্দোলন পড়ে গেলো ইরানীদের খপ্পড়ে। মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, মাওলানা আখতার ফারুক তাদের প্রভাবেই কিছুটা ইরানী প্রভাবে প্রভাবিত হলো।
শাকিল : এটা কোন সময়ের ঘটনা, হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পরে?
মুহিউদ্দীন খান : না, এটা হাফেজ্জী হুজুর থাকা অবস্থাতেই শুরু হয়েছিলো। তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে। আর আমি তখন ঘটনাচক্রে পড়ে গেলাম সৌদি বলয়ে। আসল কথা হলো, রাজনীতি বা আন্দোলন চালানোর ক্ষেত্রে আমি আমিনী সাহেবকে ছাড়ি নি। আরো পরে এসে তো তাঁকে নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটও করলাম।
শাকিল : ইসলামী ঐক্যজোট গঠনের প্রক্রিয়াটা কোন সালের দিকে?
মুহিউদ্দীন খান : এটা ‘৯৭ সালের দিকে। ইসলামী ঐক্যজোটে শায়খুল হাদীস সাহেব সদর ছিলেন। তবে শায়খুল হাদীস সাহেব সদর হলেও আমি আমিনী সাহেবকে একটু সাইট করতাম। একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিলো। শেষ পর্যন্ত শায়খুল হাদীস সাহেব আর মাওলানা আমিনীর মধ্যে মতবিরোধ হলো, আমি মাওলানা আমিনীকেই সাপোর্ট করলাম।
শাকিল : আপনি তো শুরু থেকেই ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তো নতুন জোটের চেয়ারম্যান তো আপনারই হওয়ার কথা?..
মুহিউদ্দীন খান : নিয়ম অনুযায়ী আজিজুল হক সাহেবের অনুপস্থিতে আমারই চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। কিন্তু আমি মাওলানা আমিনীকে ‘আগাইয়া’ দিলাম। বললাম, আমি না, মাওলানা আমিনী হোক। কারণ সে বড় আলেম। তাছাড়া হাফেজ্জী হুজুরের কাজ তার দ্বারা আদায় করতে হলে তাকেই এগিয়ে দিতে হবে। আমাদের টার্গেট ছিলো মাওলানা আমিনীকে হাফেজ্জী হুজুরের কায়েম মাকাম করা। এবং শেষ পর্যন্ত নিজের যোগ্যতা, সাহস ও ব্যাপক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তিনি হাফেজ্জী হুজুরের স্থলাভিষিক্ত হয়েই বিদায় নিলেন।
শাকিল : আপনি তো আগে থেকেই রাজনীতি করতেন। জমিয়তের সাথে যুক্ত ছিলেন। হাফেজ্জী হুজুরের সাথে কখন কীভাবে যুক্ত হওয়া?..
মুহিউদ্দীন খান : আমরা জমিয়ত করতাম। জমিয়ত তাদের নিজস্ব একটা প্রস্তাব অনুযায়ীই হাফেজ্জী হুজুরের সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জমিয়তে আমি তখন কার্যনির্বাহী সভাপতি ছিলাম। তবে আখতার ফারুক সাহেবরা আমাকে হাফেজ্জী হুজুরের কাছে ভিড়তে দিলেন না। তারা হাফেজ্জী হুজুরের দলের সদস্য ছিলেন। হুজুরের মুরীদ হলেন। হঠাৎ কোর্ট প্যান্ট ছেড়ে লম্বা কুর্তা ধরলেন। আমার পক্ষে তো আর বেশ বদলে নতুন রূপ ধারণ করা সম্ভব না। আমি এসব নিয়ে কখনো কম্পিটিশনে যেতাম না।
শাকিল : আপনারা তো হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর খেলাফত আন্দোলন ছাড়লেন..।
মুহিউদ্দীন খান : ইন্তেকালের পর খেলাফত আন্দোলন থেকে বের হয়েছি এমনটা ঠিক নয়। আমি তো আগে থেকেই সাইট কেটে থাকতাম। পরে মাওলানা আমিনী যখন কাজ করতে চাইলো, তাকে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। বিভিন্ন আন্দোলন এ সময় আমরা চালিয়ে গিয়েছি।
শাকিল : খেলাফত আন্দোলন থেকে বের হবার পর বাবরি মসজিদমুখী লংমার্চ আপনাদের স্বতন্ত্র বড় আন্দোলন। মাঝখানের ক’বছরের কার্যক্রম কী ছিলো?
মুহিউদ্দীন খান : বাবরি মসজিদমুখী লংমার্চের আগ পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন ইস্যুকেন্দ্রিক আন্দোলন করেছি। খতমে নবুওয়ত অন্দোলনও এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন নামে এসময় অনেকগুলো কমিটিও হয়েছে।
শাকিল : ‘আমরা’ বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন, আর খেলাফত আন্দোলন তখন কাদের কাছে?
মুহিউদ্দীন খান : আমরা বলতে আমি, শায়খুল হাদীস সাহেব এবং মাওলানা আমিনী। আমরা তখন একত্রেই ছিলাম। খতিব উবায়দুল হক সাহেবও ছিলেন। আর খেলাফত ছিলো আহমদুল্লাহ আশরাফের কাছে। বাবরি মসজিদ আন্দোলনে এবং তসলিমাবিরোধী আন্দোলনেও আমিনী সাহেবের ভূমিকা ও কার্যক্রম বেশি ছিলো। বয়সে তরুণ ছিলেন। শ্রম বেশি দিতেন। সাহসের পাশাপাশি গুছিয়ে কথা বলার অসাধারণ ক্ষমতা তার ছিলো।…আসলে অসুস্থতার কারণে হুবহু সব আজকাল মনে করতে পারি না।
শাকিল : রাজনীতি, আন্দোলন যাÑই বলি আমাদের কাছে আপনার মূল পরিচয় তো লেখক হিসেবে। সারাজীবন লেখালেখিতেই ব্যস্ত ছিলেন। আমিনী সাহেবকে কি কখনো বলেছেন লেখালেখির কথা?
মুহিউদ্দীন খান : আমি সবসময় তাকে উৎসাহ দিতাম। বলতাম- দেখেন, পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানে এমন কোনো বিখ্যাত আলেম নেই যাদের কিছু না কিছু লেখা আছে। কিন্তু বাংলাদেশী আলেমদের মধ্যে একমাত্র শামছুল হক ফরিদপুরী ছাড়া আর কারো কোনো খেদমত নেই। কতো বড় বড় আলেম ছিলেন, মাওলানা আতাহার আলী সাহেব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব, কুমিল্লা বরুড়ার একজন বড় আলেম নাম বোধ হয় মাওলানা ইয়াসীন হবেÑ তারা কোনো মিরাস রেখে যেতে পারেনি। তাদের মৃত্যুর পর তাদের কাছ থেকে আমাদের কিছু পাওয়ার নেই। তো আমি প্রায়ই তাকে বলতাম। পরে কিছু কিছু ঐ যে ফতোয়ার কিতাবসহ অন্যান্য কিছু কিছু লেখা শুরু করেন। বেশ কিছু কিতাব তো প্রকাশিতও হয়েছে ইতোমধ্যে।
শাকিল : ওলামায়ে কেরামের সংগ্রামের দীর্ঘ এ পথপরিক্রমার ফলাফল কি, আমরা কী পেয়েছি বলে মনে করেন?
মুহিউদ্দীন খান : আমাদের দীর্ঘ এ পথপরিক্রমায় তেমন কোনো সাফল্য নেই। যে সমস্ত ইস্যু সামনে এসেছে সেগুলোর সাথে সু-বিচার করে আমরা এগুতে পারিনি। পারিনি সাহসের পরিচয় দিতে। এর কারণ ছিলো দুটো। এক তো যোগ্যতার অভাব। দ্বিতীয় ছিলো নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব। আমিনী সাহেবের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে যে, তাঁর বয়স কম ছিলো। বড়রা তাকে কম বয়সি মনে করে শুরু থেকেই যথাযথ গুরুত্ব দিতে চান নি। তাছাড়া আজিজুল হক সাহেবের সাথে তাঁর দ্বন্দ্বের একটা প্রভাবও এক্ষেত্রে কাজ করেছে।
শাকিল : আমাদের ওলামায়ে কেরাম তো এমনিতেই রাজনীতি থেকে দূরে। এখন আবার আপনি যা বলছেন তা সত্য হলে তো সামনে মহাবিপদ…।
মুহিউদ্দীন খান : আমি তো বলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। শুধু বিপদ বলবো না। আল্লাহ পাক বিশেষভাবে হেফাজত করলে অন্য কথা। আমার কাছে খারাপ লাগে কি, নদভী হলে দেওবন্দীরা পছন্দ করে না। দেওবন্দী হলে আলিয়াওয়ালারা পছন্দ করে না। আলিয়াওয়ালা হলে আবার অন্যরা পছন্দ করে না। এগুলো তো আমরা পদে পদে ভোগ করে এসেছি। আমরা এগুলো মিরাস হিসেবে পেয়েছি। যেমন আমরা শামছুল হক ফরিদপুরীকে (রহ.) খুব গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু দেওবন্দীরা মাওলানা নূরুদ্দীন আজমীকে কোনো গুরুত্ব দেয় নি। অথচ তিনি আলেম হিসেবে অনেক বড় ছিলেন। লেখক হিসেবেও অনেক শক্তিশালী ছিলেন। আর একজন লেখক ছিলেন আব্দুল জলীল মাজাহেরী। আমাদের আবু তাহের মিসবাহ’র নানা। তিনিও খুব শক্তিমান লেখক ছিলেন। এমদাদিয়া লাইব্রেরির প্রাথমিক কিতাবগুলোতে ‘জনৈক অভিজ্ঞ আলেম দ্বারা অনূদিত’ লেখা আছে। সবগুলো তার দ্বারা লিখিত। নাম উল্লেখ নেই। এই যে একজন আরেকজনকে দেখতে না পারা, এটাই আমাদের বড় সমস্যা। আমি তো দেখেছি ক্লাসে পর্যন্ত উস্তাযরা ছাত্রদের সামনে সুযোগ পেলেই খোঁচা মারে…।
শাকিল : এক্ষেত্রে তো প্রায়ই ভারত-পাকিস্তানের উদাহরণ টানা হয়। তারা পারলেও কেবল আমরা পারছি না কেন?…
মুহিউদ্দীন খান : এগুলো রাজনীতি থেকে হয়েছে। বিশেষকরে ’৪৭ এ ভারত বিভাগের সময় দেওবন্দে দুটি দল হলো। মুফতি শফী ও শিব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.)সহ বড় একটি দল পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলো। আরেক দল দাঁড়ালো সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী ও তার অনুসারী দ্বারা। তো এভাবেই ওলামায়ে কেরামের মধ্যে দিল্লিকেন্দ্রিক বা নিজামুদ্দিনকেন্দ্রিক বিরোধ তৈরি হলো। সাধারণত একজন আরেকজনের কাছ থেকে ইস্তেফাদা নিয়েছে। কিন্তু সুযোগ পেলেই খোঁচা মারার স্বভাবটা সবসময় ছিলো। আমরা ঢাকা আলিয়ায় হাদীস পড়েছি যফর আহমদ উসমানীর কাছে…।
শাকিল : আপনাকে আলিয়ায় ভর্তি হওয়ার পরামর্শ তো সদর সাহেবই (রহ.) দিয়েছিলেন?..
মুহিউদ্দীন খান : হ্যাঁ, তখন আন্তরিকতা ছিলো। খোঁচা মারার বিষয়টি এতো ব্যাপক ছিলো না। পরে বেড়েছে।
শাকিল : এটাকে আপনি আলেম সমাজের সামগ্রিক অবস্থার প্রতিফলন বলবেন না সদর সাহেবের (রহ.) উদারতা?
মুহিউদ্দিন খান : সদর সাহেবের (রহ.) উদারতা।
শাকিল : তা হলে আমাদের আলেমদের এ বিরোধটাকে আমরা শিক্ষাধারা আর রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিরোধ বলতে পারি?
মুহিউদ্দীন খান : অনেকটা তাÑই।
শাকিল : আপনি বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনীতি ও আন্দোলনের শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন। ভবিষ্যতের ব্যাপারে কি বলবেন?
মুহিউদ্দীন খান : আমার অভিজ্ঞতার আলোকে যা মনে হয় তা বড়ই হতাশাজনক। বড়রাই যখন কিছু করে যেতে পারে নি, ছোটরা সেখানে কি করবে? তারা তো নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন।
শাকিল : এক্ষেত্রে অনেকেই বলেনÑ ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বা’দ। ভারত পাকিস্তান এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে বলেই তারা এক হতে পেরেছে। ভালো কিছু করতে পেরেছে। বাংলাদেশে এখনো তেমন কিছু হয়নি। হলে ঐক্য ঠিকই গড়ে উঠবে। ছোটখাটো উদাহরণ তো নিকট অতীতেও বিদ্যমান…
মুহিউদ্দীন খান : আল্লাহ পাক যদি ভবিষ্যতে কারো দ্বারা কাজ নিতে চান তা হলে তো তিনিই যোগ্য লোক তৈরি করে দিবেন। মানে হেফাজতে দীনের জন্য আল্লাহ পাক তো পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত ওলামায়ে কেরামকে রাখবেন। দারুল উলূম দেওবন্দও তো ১০০/১৫০ বছর আগে ছিলো না। তো যখন দরকার হবে আল্লাহ পাক পথ ধরে দিবেন।
শাকিল : মুফতি আমিনী সাহেব ছোট থেকেই বড় বড় আলেমেদীনের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছেন। এখনকার আলেমদের অবস্থা দেখে তেমন কারো গড়ে ওঠার লক্ষণ দেখেন কি?
মুহিউদ্দীন খান : মুফতি আমিনী সাহেবের কতোগুলো প্লাস পয়েন্ট ছিলো। তিনি আজীবন ওলামায়ে কেরাম দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। আবার প্রতিষ্ঠানগত দিকে দিয়ে লালবাগ-কাটারার মতো সেরা প্রতিষ্ঠান পেয়েছেন। এগুলো তার জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিলো। এসবের মধ্য দিয়েই সদর সাহেব-হাফেজ্জী হুজুরের উত্তরসূরি হওয়ার গৌরব যেমন অর্জন করেছেন, তেমনি কাজও করে গেছেন। অন্য কারো ক্ষেত্রে এমনকিছু তো এ মুহূর্তে দেখি না।
শাকিল : আর একটা বিষয়, আরবদের সাথে আমাদের দূরত্বটা কমলো না কেনো? বিশেষকরে ’৯৩ এর লংমার্চের সময় ব্যাপক সাড়া ওখানেও লক্ষ্য করা গেছে। আপনার এক লেখাতেও এটা ওঠে এসেছে। তারপরও আমরা পারলাম না কেন?
মুহিউদ্দীন খান : আরবের সাথে আমাদের দূরত্বটা মিরাস সূত্রে প্রাপ্ত। দেওবন্দের সঙ্গে আরবের সম্পর্ক কখনো ভালো ছিলো না। দেওবন্দের ইতিহাসে রাবেতার সদস্য হিসেবে এ বছরই (২০১২ ইং) প্রথম কেউ মনোনীত হয়েছেন। তবু বলতে হয়, এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরাই যোগাযোগ করি নি। এই সুযোগটা অন্যরা নিয়েছে।
শাকিল : আমিনী সাহেবের ইন্তেকালের পর এখন ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যত কেমন দেখছেন?
মুহিউদ্দীন খান : আমিনী নেই, এখন আমি কোনো আশা দেখি না। চারদিকে শুধু হতাশা। এমনটা আমার দীর্ঘ অসুস্থতাজনিত মানসিক অবসাদ থেকেও মনে হতে পারে। তবু, আশার কিছু তো দেখি না আমি।
শাকিল : আমিনী সাহেবের গৃহবন্দিত্ব এবং ইন্তেকাল নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত উপলব্ধির কথা জানতে চাই। কী মন্তব্য করবেন এক্ষেত্রে?
মুহিউদ্দীন খান : বাংলাদেশে তো বটেই সারাবিশ্বের ওলামায়ে কেরামের ক্ষেত্রে এটি একটি বিরল ঘটনা। শেষ দিকে তিনি আমার সাথে সাক্ষাতের প্রশ্নেও কিছুটা শঙ্কায় ভুগতেন। আমাকেও তো গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। জানো না?…
শাকিল : না তো!…
মুহিউদ্দীন খান : একই সময় থেকে। এখনো পুলিশ/এসপি এসে বসে থাকে। আমার মনে হয় মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। একটা মানুষকে মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ দিতে দিতে শেষ করে দেওয়া।
শাকিল : আমিনী সাহেবের সবচেয়ে বড় সাফল্য বা অর্জন কী বলে মনে করেন?
মুহিউদ্দীন খান : তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো মানুষের মনে স্থান করে নেওয়া। এর বাস্তব প্রমাণ হলো লালবাগ ও বড় কাটারার মতো ঐতিহ্যবাহী দুটো প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিচালনা। গৃহবন্দী থেকেও নির্বিবাদে দুটো মাদ্রাসা পরিচালনা করেছেন। আরেকটি হলো তাঁর জানাযায় অভূতপূর্ব জনসমাগম। আমার মনে হয় ঢাকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জানাযা।
শাকিল : আপনাকে অনেক শুকরিয়া। দুয়া করি আল্লাহপাক আপনাকে দ্রুত সুস্থ করুন। আমাদের মাঝে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুন। (আজ তিনিও আর আমাদের মাঝে নেই। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন)
মুহিউদ্দীন খান : তোমাদের জন্যও শুভকামনা। আসলে আজকাল উঠতে-বসতে পারি না। ধরে বসতে হয়। শেষ রাতের দিকে অবস্থা একটু খারাপ হয়। মনে হয়, আজকেই বুঝি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবো।.. তো তোমরা দুয়া করো। ভালো থেকো!
হুজুগে বাঙালির দেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন
-শফিউল আলম প্রধান
চেয়ারম্যান, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)
আমি এমন অন্যায় দাবি করতে পারি না- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে ইসলামকে ধর্ম হিসেবে দান করেছেন, এটা আত্মস্থ করার নূন্যতম যোগ্যতাও আমার আছে। কাজেই ইসলাম বোঝা আমার জন্য কঠিন। ইসলামের পরশে যারা নিজেকে মহিমান্বিত করেছেন, উদ্ভাসিত করেছেন; তাদের দেখে আমি ইসলামের শক্তি, শ্রেষ্ঠত্বের পাঠ নিই। আমিনী ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতের কথা মাথায় এলে সাথে সাথে একটি বিষয় আমার ভেতরে চলে আসে। আমরা যারা নিজেদেরকে সাধারণ মুসলিম বলে দাবি করি- তারা ইসলামের গভীরতা কতোটুকু বুঝি? ইসলামের স্পর্শে যখন আমরা খলিফা ওমরকে দেখি যে, সে ভুল পথ থেকে সরে এসে বিশ্ব মুসলিমকে জাগিয়ে তুলেছে, তখন আমরা খলিফা ওমরের মধ্যে ইসলামকে খুঁজে পাই। মুফতি মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর মধ্যেও আমি সেটা পেয়েছি। সে আমার ভাই। মানে, তার সাথে আমার হৃদ্যতা-সম্পর্ক এতোটাই গভীর ছিলো।
আমিনী ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় কোনো মাহফিলে হয়নি, কোনো হুজরাখানায় হয়নি, কোনো মিলাদ মাহফিলে বা আলোচনা সভায়ও হয়নি। ইসলামের যে মর্মবস্তু, যেটা আমি অন্তত বিশ্বাস করি, মনে করি সেটা হচ্ছে জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ। সেই জিহাদের ময়দানে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আর সেই পরিচয়টারও একটা ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে একজনকেই বন্ধু বলে গ্রহণ করেছেন এবং তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের এখানে এক নারী কবি, নাম তসলিমা নাসরিন। আমি তাকে অভিশাপ দেবো না। তাকে অভিশপ্তও বলবো না। কারণ, এই সমাজে এবং এই বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আজকে নাস্তিক্যবাদী শক্তি, ইসলামবিরোধী শক্তি, মুসলিমবিরোধী শক্তি এরা এদেশের মুসলিম নামধারী মানুষদেরকে কব্জায় নিয়ে আসে এবং তাদেরকে দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। তো সেই তসলিমা নাসরিন আমার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর এবং অশালীন মন্তব্য করে একটা কবিতা লেখে। এতে আমাদের মুসলিম জনসমষ্টির মধ্যে একটা বড় রকমের প্রতিবাদ আন্দোলন তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এগুলো বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন আন্দোলন ছিলো। এরপর আমার যতোটুকু স্মৃতিতে মনে পড়ে, এগুলোকে এক করার একটা চেষ্টা শুরু হলো। সেক্ষেত্রে বায়তুল মোকাররম মসজিদের তদানিন্তন ইমাম খতিব উবায়দুল হক সাহেব, উনি খুব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। আরেকজন ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব-এই দু’জন মানুষ একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অনেক কয়টা বৈঠক হলো। পরবর্তীতে যে বৈঠকটা হলো সেটা খুব সম্ভব মাওলানা এম এ মান্নান সাহেবের যে মসজিদ, গাউসুল আজম মসজিদে। সেখানে রাতে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পরে একটা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আলোচনা হলো। আরেকজন মানুষ এখানে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি হলেন মরহুম আনোয়ার জাহিদ। জাহিদ ভাইয়ের সাথেও মুফতি আমিনীর অনেক সখ্যতাÑঘনিষ্ঠতা ছিলো। এ পরিষদ গঠিত হওয়ার পরে আমরা যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়লাম। ওটাও একটা যুদ্ধ। শুধু তরবারী থাকলেই যুদ্ধ হয়, বন্দুক থাকলেই যুদ্ধ হয় এমন তো নয়। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামই হচ্ছে যুদ্ধ। এবং দেখা গেলো উপযুক্ত নেতৃত্ব পেলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ কীভাবে জেগে ওঠে। এখানে চরমোনাইর পীর সাহেব, তিনিও মরহুম মুফতি। নাম তার ফজলুল করীম। তিনিও ছিলেন ওই সংগ্রামে। কিন্তু সার্বক্ষণিক একজন যে সেনাপতি দরকার, এই আন্দোলনে এই দায়িত্বটা পালন করার মতো সার্বিক যোগ্যতা যেমন উদাহরণ স্বরূপ আমি কিংবা আনোয়ার জাহিদ ভাই; আমাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু ওই আন্দোলনের ধরণটা এমন ছিলো যে, সেখানে মানুষ একজন ধর্মীয় নেতাকে সামনে চাচ্ছে। সেখানে আমাদের মরহুম মুফতি আমিনী সাহেব তিনি একটা উদ্যোগী ভূমিকা নিলেন। তিনি সার্বক্ষণিক এই সংগ্রামে নেমে গেলেন। এবং আমরাও একজন ভালো কমান্ডার পেয়ে গেলাম। এটা অবিশ্বাস্য মনে হবে, যে হরতাল ডাকা হলো ওটার পক্ষ থেকে একটা গাড়ি পোড়েনি। একটা ইটের টুকরা মারতে হয়নি। একেবারে সুনসান হরতাল। একটা গাড়ি পথে নামেনি। একটা দোকান খোলেনি। এবং অগণিত মানুষ, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মানুষের ঢল নেমে গেলো। অভাবনীয় দৃশ্য। আমি বহু আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। ৬৯-এর সংগ্রাম, ৭০-এর আন্দোলন। কিন্তু এমন একটা শান্তিপূর্ণ অথচ সর্বাত্মক সফল আন্দোলন আমার চোখে খুব একটা পড়েনি। সত্যিই ব্যতিক্রমধর্মী।
আমরা একটা মহাসমাবেশ করেছিলাম তার নেতৃত্বে। শেরেবাংলা নগরের মানিক মিয়া এভিনিউয়ে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এতো বড় সমাবেশ আর কেউ করতে পারেনি। মানুষের এতো বিশাল সমাবেশ হয়েছিলো, বিশাল! আমার শুধু মনে পড়ে ঐখানেই তো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাযা হয়েছিলো। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাযায় যে ঢলটা নেমেছিলো মানুষের তার তুলনীয় হয়েছিলো ঐ সমাবেশ। এবং ইতিহাসের বৃহত্তম সমাবেশ আমার মতে। তবে ওটার প্রেক্ষাপট ছিলো ভিন্ন। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সমাবেশের মধ্যে আমাদের এটি ছিলো স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম সমাবেশ। এখানে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর যে কৃতিত্বের দিক, সাফল্যের দিক, তার অপূর্ব সাংগঠনিক ক্ষমতা, তার অসাধারণ বাগ্নিতাÑ তিনি আবার বক্তা হিসেবে পাবলিককে নাচাতে পারতেন। এটা ছিলো তার অসাধারণ গুণ। এবং আসলেও পৃথিবীর যতো বড় বড় পরিবর্তন, যেগুলোর সাথে জনগণ সম্পৃক্ত; সেগুলোতে বক্তৃতা হচ্ছে সবচে’ শক্তিশালী অস্ত্র। মানে মানুষকে অভিভূত করা, মানুষকে দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করাÑ এখানে বক্তার ভূমিকা খুব প্রবল। তো তিনি নিঃসন্দেহে একজন উঁচু মাপের বাগ্মী ছিলেন। জনগণকে তিনি সম্মোহিত করে ফেলতেন। উত্তেজিত করতে পারতেন, ঠা-া করতে পারতেন, কাঁদিয়ে দিতে পারতেন। এই অসাধারণ ক্ষমতা তার ছিলো।
আমাদের মুভমেন্ট পরে একটা জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিলো। আমরা যখন খুলনা গেলাম, লাখ লাখ জনতা। আমরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছি হাজার হাজার জনগণ। এবং একটা নারী কবির অশালীন কবিতাকে কেন্দ্র করে মূলত এটা আধিপত্যবাদী, মানে ভারতীয় আধিপত্যবাদÑইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে একটা অসাধারণ গণজাগরণ ছিলো। তখন আমাদের বিপক্ষে নেমে গেলো সমস্ত বাতিল শক্তি। স-ব। আওয়ামীলীগ থেকে শুরু করে সব একজোট হয়ে গেলো। বিএনপি ক্ষমতায়, কাজেই তার পক্ষপাত করার সুযোগ নেই। তার কোনো ভূমিকাও নেই। আবার এটাও বলবো না যে, তারা জুলুম করেছে। এই অলফোর্সেস একদিকে, আমরা অন্যদিকে। আবার এটা কোনো পলিটিক্যাল পার্টিও ছিলো না। এটা সমমনা অনেকগুলো শক্তির সমন্বিত দল। আমাদের এখানে ধর্মীয় নেতারা আসছে, রাজনৈতিক নেতারা আসছে, কবিÑসাহিত্যিকরা আসছে। এটা একটা ন্যাশনাল প্লাটফর্ম হয়ে গেছে। তো এটা নিয়ে অনেক রাতে আমার ওই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। বড় কাতর লাগে ওই দিনগুলো মনে পড়লে যে, আমরা প্রোগ্রাম করে রাতে বসছি। তাকে বলছিÑ এই যে জাগরণ একে যদি একটা কারেক্ট লাইনে নিয়ে যাওয়া যায় তা হলে এটাই এই সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের দিকে রিপ্লেস করতে পারে। এবং ভিনদেশীদের চক্রান্ত থেকে দেশ, জাতি, জনগণকে রক্ষা করতে পারে। তো যাই হোক, আন্দোলনটা যেহেতু ওই কবিতাকে কেন্দ্র করে ছিলো এবং যেহেতু মাল্টিফোর্সেসের সমাহার হয়েছিলো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুশক্তি মিলে ওটাকে ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে গেলো এবং তারা আতঙ্কিত হয়ে গেলো। এই যে এক অপূর্ব জাগরণ এটা ধর্মীয় বলেন, রাজনৈতিক বলেন সকল লোকদের ঐক্যবদ্ধ জাগরণের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। পরে অবশ্য আতঙ্কিত শক্তিগুলোর কারণে সেটা আর বেশিদূর এগোতে পারলো না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আন্দোলনটা শীতল হয়ে গেলো।
আন্দোলনের ধারাটা একসময় এতোই প্রবল হয়েছিলো যে, ওই মহিলার নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে গেলো। তাকে রাখবে কোথায়, গভর্নমেন্ট তাকে কোথায় রাখবে? জেলে রাখলে জেলের ইট ভেঙ্গে নিয়ে আসবে। আসলেও তাই। জেলে নিয়ে রাখলে পাবলিক গিয়ে তার ইট খুলে নিয়ে আসতো। হয়তো এক হাজার শহীদ হয়ে যেতো, এমন একটা অবস্থা তার নেতৃত্বে তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। বাস্তব কথা। পরে গভর্নমেন্ট সাহস পেলো না। তাকে না পারে জেলে রাখতে, না পারে গ্রেপ্তার করতে। কী করবে? যা-ই হোক, তারা একটা ফর্মুলা উদ্ভাবন করে তাকে গোপনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলো।
তসলিমা নাসরিন চলে গেলেন। মূল ইস্যু তো তসলিমাই ছিলেন। আমরা ইতোমধ্যে নিজেদেরকে তৈরি করতে পারলাম না অপরাপরদের অসহযোগিতার কারণে। আমি সেই নামগুলো উল্লেখ করতে চাই না। করা উচিতও না। যেহেতু আমরা সংগ্রাম পরিষদে ছিলাম, সবারই ভূমিকা ছিলো। সবাই পজিটিভ কাজ করেছে, এ কথা আমি বলবো না। কিন্তু ওই যে যেটা আমরা চাচ্ছিলাম, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমরা একটা দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক পরিকল্পনায় চলে যেতাম তা হলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। সেটা হলো না। তসলিমা নাসরিনকে বিদেশে প্রেরণের পরে এর আবেদনটা একটু কমতে শুরু করলো। আমরা বিকল্প কোনো কর্মসূচি দিলাম না। আস্তে আস্তে একসময় এটা স্তিমিত হয়ে গেলো। কিন্তু একজন সফল কমান্ডারের নেতৃত্বে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে, মুভমেন্টটার ভিত্তি পজিটিভ রাখা গেলে তা জনসম্পৃক্ত হয়, হতে বাধ্য। নেতারা যদি উপযুক্ত সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করে এবং যেকোনো কোরবানীর জন্য নিজেকে তৈরী রাখে তা হলে বাতিল শক্তি যে আমাদের সামনে কিছুই না সেটা ওই আন্দোলনেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। আমার সাথে তার পরিচয় কোনো হুজরাখানায় নয়, সমরক্ষেত্রেই আমরা একসাথ হয়েছি।
এরপরে দীর্ঘদিন আমরা বিভিন্ন আন্দোলনÑসংগ্রাম এবং সর্বশেষ এই ১৮ দলীয় জোট করলাম। এরপরে তো তাকে গৃহবন্দী করা হলো। তার ছেলেকে গুম করার চেষ্টা করা হলো এবং গুম করে রাখাও হয়েছিলো। কিন্তু কী রকম জিহাদী মানুষ তিনি, আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি বরং চিৎকার করে বলেছেন, আল্লাহ, আমার ছেলেকে যে গুম করেছে, তার ছেলেকে তুমি গুম করে দিয়ো। এই যে আওয়াজ তুললেন বলিষ্ঠ এবং দরাজ কণ্ঠের যে আওয়াজ, এরপরে তো ছেলেকে ফেরৎ দেওয়া হলো। আল্লাহ পাকের কী ইচ্ছা, তা তো তিনিই ভালো জানেন। কিন্তু বড় অসময়ে আমিনী ভাই চলে গেলেন। কারণ, সৎ নেতৃত্বের ভীষণ সংকট দেশে। দেশে জিহাদী আলেমÑওলামার খুব সংকট। এখানে মিলাদ পড়াবার লোক, ওয়াজ করার লোক প্রচুর আছে। কারণ ওসবে আপদ-বিপদ কম। বালা-মুসিবত নেই। দোযখ আর বেহেশতের ব্যাখ্যা দিলেই চলে যায়। কিন্তু সত্যিকার যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম করার জন্য যে যোগ্যতা-সাহস দরকার তার একটা অসহনীয় অভাব এ দেশে। তার মৃত্যুর পর এই অভাবটা আমি অনুভব করছি প্রবলভাবে। তারপরও আল্লাহর ফায়সালা আমাদের মেনে নিতে হবে। অকল্যাণের মধ্যেও কল্যাণ থাকে। এটা তো আমরা জানি না। আল্লাহ পাক তাকে বেহেশত নসীব করুন। আমরা সবসময় দুআ করি।
এই পরিচয়ের পূর্বে তার সম্পর্কে আমার জানাশোনা ছিলো না। আল্লাহ তাআলা আমার জন্য একটা সুযোগ করে দিয়েছিলেন। একটা অসাধারণ সুযোগ। ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি, ধর্মীয় রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের প্রতি আমি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। আলেম-ওলামার প্রতি শৈশব থেকেই আমার একটা অন্যরকম শ্রদ্ধা ও টান ছিলো। আছে এবং থাকবে। কিন্তু তাদের সাথে যে একটা সখ্যতা-সম্পর্ক, যোগাযোগ-আলাপ-আলোচনা এগুলোর খুব সুযোগ হয়নি। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গটা অন্যরকম। জামায়াত শুরু থেকেই আত্মপ্রকাশ করেছে একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে। কিন্তু বাকী যারা এসেছেন যেমন, চরমোনাই পীর সাহেব বলেন, ইভেন মুফতি আমিনী ভাই বলেন এরকম যারা আসলেন এঁরা কিন্তু ওই আন্দোলনের ফসল। আমার কাছে মনে হয়েছে, তারা রাজনীতির গুরুত্বটা অনুধাবন করতে পারছেন। যেমন আমি শুনতাম এবং এটা সঠিকও যে, মাদ্রাসাগুলোতে খবরের কাগজ পড়তে দেয়া হতো না। বিশেষ করে দেওবন্দ ঘরানার মাদ্রাসাগুলোতে। তাদেরকে সমাজ রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো। ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কিন্তু রাজনীতি, সমাজ সচেতনতার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এই আগ্রহটা সৃষ্টি হওয়ায় খুব ভালো হয়েছে। এর কারণে আমরা এখন অনেক নিরাপদ। নতুবা এই যে মওজুদ জনশক্তি, যারা আল্লাহর নামে, ইসলামের নামে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলছে; তাদের যদি সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা না থাকে, তারা যদি বিপদ আন্দাজ করতে না পারে তা হলে মোকাবেলা করবে কারা? এ আন্দোলনের পর তার মধ্যে একটা রাজনৈতিক মনস্কতা এসে গেলো। ক্রমান্বয়ে রাজনীতি, সমাজ, দেশের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে তার ভেতর আগ্রহ সৃষ্টি হতে শুরু হলো। আল্লাহর তরফ থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলো। আমি, জাহিদ ভাই এবং তিনি একসাথে বসে দেশ সমাজ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতাম। এরপরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলো। অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। ইসলামী ঐক্যজোটে তিনি কবে যোগ দেন সেটা আমার সঠিক জানা নেই। তখন আমরা যারা ধর্মীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না, তার চাহিদাটা আমরা প্রবলভাবে অনুভব করলাম। আমরা ভাবলাম তাকে সম্পৃক্ত করতে পারলে আন্দোলনটা খুব জোরদার হবে। জাহিদ ভাই ও আমরা এ নিয়ে খুব আলোচনা করতে লাগলাম। এরপরে তো তিনি চরদলীয় ঐক্যজোটে আসলেন। রাজনীতিতে অবদান রাখলেন বলিষ্ঠভাবেই।
একসময় তিনি কারারুদ্ধ হলেন। এবং খুব কষ্টে তাকে রাখা হয়েছিলো। রংপুর জেলে তাকে বহুভাবে জুলুম অত্যাচার করা হয়েছে। এরপর থেকে ইনফেক্ট আর আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা হয়নি। আমাদের মধ্যে লাগাতার একটা সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছিলো। তবে শুরুটা হয়েছিলো ওই আন্দোলন দিয়ে এবং তারপর আমৃত্যু তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো। সর্বশেষ আমার মনে পড়ে- গত বছর (২০১২ ইং), তারিখটা আমি সঠিক বলতে পারবো না। আমাদের একটা অনুষ্ঠান ছিলো লালবাগে। ইফতার মাহফিলের পর আমরা আসার পথে তার মাদ্রাসায় গেলাম। ওটাই ছিলো ওনার সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাত। সেখানে তিনি খুব খোলামেলাভাবেই বলছিলেন যে, গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্যে রাষ্ট্র। এবং অনেক মূল্য দিয়ে আমাদের বিজয় অর্জন করতে হবে। তিনি পরিষ্কার বলছিলেন, বিপদটা ধেয়ে আসছে। এই বিপদটা কোনো দলের বিপক্ষে না, কোনো নেতার বিপক্ষে না। এ বিপদ পুরো কওমের বিরুদ্ধে। এবং সকল ভারতীয় আধিপত্যবাদ, সম্রাজ্যবাদ এই রাষ্ট্রের বুনিয়াদকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এবং খুব সহজপন্থায় এখান থেকে বের হওয়া যাবে না, সহজে বিজয়ও অর্জন করা যাবে না। এমনকি তিনি এই আশঙ্কাও ব্যাক্ত করছিলেন যে, আপনারা যদি ভেবে থাকেন যে, একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। জনগণ ভোট দেবে এবং আপনারা গভর্নমেন্ট করবেন বা আমরা গভর্নমেন্ট করবো এটা ভুলে যাওয়া ভালো। এরপরেও একটা বিজয় অর্জন করতে হলে অনেক মূল্য দিয়ে অর্জন করতে হবে। এই আশঙ্কাটা তিনি করতেন। এবং এখন তো আমি দেখছি তা-ই হচ্ছে।
প্রচলিত অর্থের সম্পর্কটা আমাদের মাঝে গড়ে ওঠেনি। সুযোগই হয়নি। তাই ব্যক্তি আমিনী আর রাজনৈতিক আমিনীর মাঝে কোনো পার্থক্য করতে পারবো না। তার সাথে আমার সম্পর্কের শুরুটাই হয়েছে সমরে। এর বাইরে তাকে দেখিনি। এরপর যতোদিন ছিলাম সংগ্রামে, আমরা জিহাদের ময়দানে ছিলাম। এই জন্য তার পূর্ণ সত্তাটা আমার কাছে জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজন জিহাদী মানুষের যে উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি; এই চেহারাটাই বারবার ভাসে, উদ্ভাসিত হয়। আমার সামনে ওনার চেহারা আসলেই মনে হয় একজন সংগ্রামী মানুষ, যিনি জুলুমের বিরুদ্ধে যে কাফেলা সেই কাফেলাকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এবং এইজন্য সবচে’ বড় কোরবানী করতে তিনি প্রস্তুত। এরকম মনে হয় আমার কাছে বারবার। ওনার চেহারায় এর বাইরে কোনো দৃশ্য আমার মননে আসে না। কারণ আমাদের পটভূমিটা ছিলো একটু ভিন্ন। আর ব্যক্তিগত আলোচনা খুব কম হয়েছে। আমরা যখনই কথা বলছি, আমরা দেশ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে বারবার কথা বলেছি।
বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত কতোটা সম্ভব এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা কী করে হবেÑ এমন বিষয় নিয়ে আমিনী সাহেবের সাথে আমরা কথা বলেছি। কারণ, এখানে প্রচলিত একটা পদ্ধতি আছে। একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আল্লাহর জমিনে ইনসাফ এবং হক কায়েমের কথা যদি ভাবি, এরকম একটা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করি, তা হলে প্রচলিত পন্থায় কি এটা অর্জন করা সম্ভব? এক্ষেত্রে তিনি বলেছেন এবং খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। বলেছেন, দেখুন, এখানে ধাপে ধাপে যেতে হবে। মানে আমরা যেমন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মানি, এটা ওলামায়ে কেরাম নিন্দা করেন, সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এটা তারা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। কারণ, এই রাষ্ট্রটা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছে গেছে, যেখানে সরাসরি আমরা নিজ লক্ষ্যে যেতে পারবো না। চেষ্টা করলেও এটা হঠকারী হবে। হয়তো মানুষ বুঝবে এটা ঠিকই হচ্ছে কিন্তু ওটা ফেল করবে। ফেল করতে বাধ্য। আমাদের এই প্রচলিত ব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে হবে। এটা আমাদের দর্শন হিসেবে নিলে চলবে না। এটা কৌশলগত হিসেবে নিতে হবে। কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক ধারা দুটি ধারায় প্রবাহিত। একটা খালেদা জিয়ার বিএনপি। আরেকটি শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ। এটাকে বাইরে রেখে আলাদা একটা ধারা তৈরি, এটা চাইলেই আমরা পারবো না। বরং একসময় এটা দু’ পক্ষের চাপে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকবে। তো সেখানে আমাদের কৌশলগতভাবে এগুতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যারা ভাবছি, যেমন আমি মনে করি, এখানে ইসলামী হুকুমত কায়েম হতে হবে। এটা কায়েম না হওয়া পর্যন্ত সমাজে বৈষম্য থাকবে, জুলুম থাকবে, অনাচার থাকবে। কিন্তু এটা অর্জন করতে হলে আমাদেরকে এই ব্যবস্থার সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে হবে ওই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এবং সে কারণেই আমরা জোটে আছি। যতোদিন আছি আনুগত্য নিয়েই আছি। কিন্তু এটা মনে করি না যে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এ পথ পেরুতে হবে। তবে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করলে আমরা আমাদের লক্ষ্যের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতে পারবো। এটা আমিও বলি যে সঠিক। তাঁর এই চিন্তাটা প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতাসম্পন্ন চিন্তা।
আমাদের দল জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা। আমরা কী কী লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছি? উদাহরণ হিসেবে বলি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হলো। সেই সংগ্রামে আমরাও একজন ক্ষুদ্র সৈনিক ছিলাম। সেই রাষ্ট্রটি আমরা চেয়েছিলাম যে, একটা স্বাধীন সত্তা নিয়ে এখানকার অধ্যুষিত জনগণ, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে এবং যাদের সংগ্রামের কারণে পাকিস্তান হয়েছিলো; পাকিস্তান সেই আকাক্সক্ষাগুলো পূরণ করে নাই। এ কারণে আমরা স্বাধীনতা চাইলাম। এই স্বাধীনতা যেনো ভিনদেশী কোনো আধিপত্যবাদের শিকার না হয়। মানে, একটা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যদি রাষ্ট্রটি স্বাধীন রাখতে পারি তা হলে স্বাধীন দেশের গণতন্ত্রই প্রচলিত গণতন্ত্র। আর প্রচলিত গণতন্ত্র যদি ফাংশন করতে পারে প্রোপারলি, আর রাষ্ট্রটা যদি স্বাধীন থাকে, তা হলে এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসনকে অবহেলা করে কোনো শাসন এখানে দীর্ঘমেয়াদী হবে না। তো আমরা আমাদের এই লক্ষ্যমাত্রাটা নির্ধারণ করছি। এই লক্ষ্যটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় যদি অর্জন হয় তখন এই দেশের জনগণই ঠিক করবে তারা কী ধরনের ব্যবস্থা চায়। কী ধরনের হুকুমত চায়। কিন্তু একটা আধা স্বাধীন আধা পরাধীন দেশে এটা সম্ভব নয়। কাশ্মীরের মানুষ কী হুকুমত চায় এ প্রশ্ন তো অবান্তর। কারণ ওর স্বাধীনতাই নাই। তার ইচ্ছাতে হুকুমত প্রতিষ্ঠা তো দূরে থাকÑ তার ইচ্ছাটা প্রকাশ করার স্বাধীনতাটাও নাই। আজকে বাংলাদেশে ইনফ্যাক্ট একটা পতাকা আছে কিন্তু স্বাধীনতা নাই। ভূখ- আছে সার্বভৌমত্ব নাই। নদী আছে প্রবাহ নাই। শিল্প আছে উৎপাদন নেই। মাদ্রাসা আছে কিন্তু কার্যত দীনের যে স্বাধীন চর্চা সেটা নাই। আমার দেশের সম্পাদক অফিসবন্দী হয়ে আছে। আমার নেতারা ভিন্ন মত অবলম্বন করলে ধরে নিয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে টুপি-দাড়ি থাকলে তার দিকে তীর্যক চোখে তাকানো হয়। তার প্রতি জুলুম হয়, অত্যাচার হয়। মানে পুরো রাষ্ট্রটা একটা আধা স্বাধীন অবস্থায় চলে গেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, আমরা যেটা চাই, যে জন্য আমাদের সংগ্রাম ছিলো- একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। এবং এটা আমাদের বাধ্য করা হয়েছিলো। আমরাই তো পাকিস্তান বানিয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তান কিন্তু পাকিস্তান বানায়নি। এটা মনে রাখতে হবে। কারণ আমাদের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটেই পাকিস্তান হয়েছে। কারণ ওখানে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস, শুধু পাঞ্জাবে ইউ পি পার্টি। এক সিন্ধু আর বাংলাদেশ ছাড়া বাকিরা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়নি। কিন্তু আমাদের এই টোটাল ভোটে পাকিস্তান রাষ্ট্র হলো। পরে আমরা বাধ্য হলাম বাংলাদেশ করতে। এখন প্রথমে রাষ্ট্রটার স্বাধীন সত্তাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বাধীন সত্তা ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানে গণতন্ত্রও চলবে না। তারপরে স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো ফিরে আসে। যেমন মিসর, সেখানে যারা এলো, হ্যাঁ কারা আসছে এগুলো নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু এটা তো ঠিক যে ওই গণবিপ্লবের আবরণে যখন সাম্রাজ্যবাদের কবজা শিথিল হয়ে গেলো, সেই নির্বাচনে ধর্মীয় লোকেরাই এসেছে। তারা একে কার্যকর করতে পারবে কি না সেটা আরেকটা কথা, কিন্তু এসেছে তো। এখানে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার এলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা আকাক্সক্ষা এর প্রতিফলন তো হবেই। তো এই চিন্তার সাথে আমাদের জাগপার সাথে কোনো বিরোধ নেই। জাগপা আজকের যে কাজ সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আজকের কাজ হলো স্বাধীনতাকে নিরাপদ করো, নিরঙ্কুশ করো। তা হলে গণতন্ত্র চালু হবে। গণতন্ত্র চালু হওয়ার পরে আমাদের দেখার বিষয়, আমরা কী ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাই। তখন সেটা ভাববো।
একজন মুসলিম হিসেবে আমার এটা বিশ্বাস করতে হবে যে আমিনী সাহেবের মৃত্যুটা নির্দিষ্ট সময়ে হয়েছে। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, আমি তোমার মৃত্যুকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। না তুমি এক কদম আগে হাঁটতে পারবে, না তুমি এক কদম পিছু হটতে পারবে। এটা ধর্মীয় দিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু মানবিক তো একটা বিবেচনা আছে। আমি কিন্তু মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে নেবো না। বরং এই জালিম গভর্নমেন্ট তাকে অবরুদ্ধ করে তার পুত্রকে গুম করার প্রচেষ্টা চালিয়ে বিভিন্ন প্রকারের দৃশ্যমান-অদৃশ্য নির্যাতন চালিয়ে তাকে মৃত্যুর পথে ধাবিত করতে সাহায্য করেছে। সুতরাং তার মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এবং এই জন্য অভিশাপ দিই এই গভর্নমেন্টকে, একজন মশহুর আলেম, একজন জ্ঞানী মানুষ, একজন ধর্মীয় নেতার ওপরে নিদারুন মানসিক এবং অন্যান্য জুলুম অত্যাচার করে তাকে মৃত্যুর পথে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা আমাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবো যে, একজন উঁচুস্তরের আলেম, জ্ঞানী মানুষ, একজন ধর্মীয় নেতা, একজন রাজনৈতিক নেতা তাকে অবরুদ্ধ করে তার পুত্রকে অপহরণ এবং হত্যার চেষ্টা করা এবং নানাবিধ উপায়ে তার ওপর যে মানসিক এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক অত্যাচার চালানো হয়েছেÑ এটা তার মৃত্যুটাকে ত্বরান্বিত করেছে। এই জন্য গভর্নমেন্টও এর দায় অস্বীকার করতে পারে না। এক অর্থে এটা হত্যার শামিলও বটে।
আমরা যে আন্দোলন করেছি তা এ যুগে অনেকটা ঝুকিপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জের। ঝুকিপূর্ণ এই অর্থে যে, এই বিষয়টা সম্পর্কে আজকের বিশ্ব ভীত। এটা শুধু বাংলাদেশের কনসেপ্টে না। আজকে বিশ্বব্যাপী যে দুই সভ্যতার লড়াই, এখানে এই সভ্যতাটার বিকাশকে আজকে আতঙ্কিত করে রেখেছে এই দুনিয়ার আধিপত্যবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। আর বাংলাদেশ হচ্ছে এখন আধিপত্যবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদীদের লীলাভূমি। শাসকেরা হয়ে গেছে তাদের আজ্ঞাবহ। সুতরাং এই মুহূর্তে এটা একটা চ্যালেঞ্জিং ফ্যাক্টর। এটা একটা সংগ্রাম। কিন্তুআমি মনে করি এই সংগ্রামের ন্যায্যতা আছে এবং যেকোনো মূল্যে এই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া দরকার।
আমার স্মৃতিতে তার একটা সাহসিকতার ঘটনা আছে। আমরা একবার কিশোগঞ্জ ময়মনসিংহ গেলাম তার সাথে। সেখানে আমরা যাওয়ার সময় খবর পাচ্ছিলাম সভার ওপর হামলা চালানো হবে। ইত্যাদি। তো আমাদের অনেক নেতারাও ভাবতে থাকলো এ মুহূর্তে আমাদের সেখানে থাকা ঠিক হবে কি না। পথে পথে নানা খবর আসছে। তো আমরা এক জায়গায় দাঁড়ালাম। সবাই নেতারা। ওখানে অনেকেই মতামত দিচ্ছিলেন, এই ঝুঁকিটা এড়ানো দরকার। তো ওই সময় যখন একটা দ্বিধাগ্রস্থ ভাব। দেখলাম মুফতি আমিনী গর্জে উঠলেন। তিনি বললেন, এই ঈমান নিয়ে আপনারা লড়াই করতে চান তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে? এই দুর্বলতা নিয়ে? একজন মুসলিম হিসেবে আপনারা কি বিশ্বাস করেন যে, আপনার নিয়তি আপনার জায়গায় নিয়ে যাবে? সুতরাং পরিণতি যা-ই হোক, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন, জনগণের ওপর ভরসা রাখেন, আগে বাড়েন। আলহামদুলিল্লাহ, ধারে কাছে কেউ ভিড়তে পারে নাই। জনতার রুদ্ধশ্বাসের কারণে ধারে কাছেও কেউ ভিড়তে পারে নাই। এটা তার অসাধারণ এক সাহসিকতা।
মুফতি আমিনী একটা ব্যক্তিমাত্র না। তিনি একটা সত্তা। একদিকে তিনি ধর্মীয় নেতা আবার তার একটা রাজনৈতিক দলও ছিলো। আর আমাদের যে মিডিয়া জগত সেই জগতটাতো নিরপেক্ষ না। সেই জগতটারও একটা রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতিটার বিপরীত রাজনীতি হচ্ছে আমাদের মরহুম মুফতি আমিনী (রহ.)-এর রাজনীতি। তার যে সত্তা সেটা প্রচলিত যে মিডিয়া ব্যবস্থা তার অনুকূলে না। তাই তারা প্রচার করছে। কিন্তু প্রচারটাকে তারা সংকুচিত করেছে। যতোটুকু না দিলে মিডিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দেবে ততোটুকু তারা করেছে। এইজন্য আমাদের মিডিয়াকে অভিসম্পাত দেওয়ার কিছু নেই। কারণ, মিডিয়াগুলোর পেছনে যে পুঁজি খাটানো হচ্ছে, যে ক্যাপিটাল সেই ক্যাপিটাল এই রাজনীতিটাকে ভয় পায়। এবং আমিনী সাহেব যে রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করে সেই রাজনীতিটাকে তারা আতঙ্ক এবং ভীতির চোখে দেখে। সুতরাং তারা চায় না যে, এটা ব্যাপক হোক। ব্যাপকভাবে প্রচার হোক। কিন্তু মিডিয়ার দ্বারা এটা প্রভাবিত হয়নি। এটা গণমিডিয়া যেটা কাগজে লেখে না, ছবিতে দেখায় না, কিন্তু মানুষের কানে কানে মুখে মুখে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তা ছড়িয়ে যায়। সেই গণমিডিয়াতে কিন্তু আমিনী সাহেবের ইন্তেকালের বার্তা এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে, অল্প সময়ের মধ্যেই সীমাহীন মানুষের সমাগম ঘটেছে। কাজেই এক্ষেত্রে আমাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। ১৮৫৭ সালে যে সিপাহী বিপ্লব হয়েছিলো, তখন তো টেলিফোন ছিলো না। মোবাইল ছিলো না। মিডিয়া ছিলো না। কোথায় খায়বার আর কোথায় বাংলার ঢাকার লালবাগ দূর্গ, কিন্তু বিদ্রোহ হয়ে গেলো। কানে কানে চলে গেছে। একটা সময় আসবে যখন মিডিয়ার দ্বারা কিছু প্রভাবিত হবে না, গণমানুষ সিদ্ধান্ত নেবে এবং ওইটাই মিডিয়াতে আসতে হবে। সেই সময় আসবে অতিঅবশ্যই। মুফতি আমিনীরাও বেঁচে থাকবেন, এগিয়ে যাবেন স্বমহিমায়। এসবকে উপেক্ষা করেই।
অনুলিখন- আল আমিন আজাদ। সম্পাদনা- শাকিল আদনান।
আমরা সত্যিকার একজন ইসলামী লিডার হারিয়েছি- ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ
জাতীয় সংসদে প্রদত্ত দশ-বারো মিনিটের একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাপক আলোচনায় আসেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন আঠার দলীয় জোটের অন্যতম শরীক দল বিজেপির চেয়ারম্যান এবং ভোলা ১ আসনের সাবেক এমপি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। ইন্টারনেটের কল্যাণে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া অসাধারাণ সে ভাষণটি ‘বেস্ট স্পিচ অব বাংলাদেশের’ তালিকায় এখনো শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এরপর বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, পত্রিকা-ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকার এবং টকশোর নিয়মিত আলোচনায় উঠে আসা তার পজিটিভ রাজনীতিভাবনা, বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ আর গোছালো যুক্তি-তর্কের কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে দ্রুতই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন নবীন এই সংসদ সদস্য। সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব আর উচ্চশিক্ষা এক্ষেত্রে তাকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি, মধ্যপৌষের এক সন্ধ্যায় দেশবরেণ্য আলেমেদীন মুফতি ফজলুল হক আমিনীর অত্যন্ত স্নেহের মানুষ এই তরুণ রাজনীতিবিদের সাথে আলাপ হয় নতুন ডাক পরিবারের। কথা হয় ব্যক্তিগত সর্ম্পক, মুফতি আমিনীর ঈমানদীপ্ত জীবন ও সাহসী রাজনীতির নানা দিক নিয়ে। আলোচনায় উঠে আসে ইসলামী রাজনীতিসহ অন্যান্য প্রসঙ্গও। আলোচনার চুম্বকাংশ উপস্থাপিত হলো তারই জবানিতে।-শাকিল আদনান
মুফতি আমিনী সাহেবের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় দু’হাজার এক এর দিকে। চার দলীয় জোট গঠনের প্রেক্ষাপটে শায়খুল হাদীস সাহেব, মুফতি আমিনী সাহেব এবং আমার বাবা (বিজেপির সাবেক চেয়ারম্যান ও মন্ত্রী মরহুম নাজিউর রহমান মঞ্জু) কোনো এক মিটিংয়ে একত্রিত হয়েছিলেন। আমি বাবার সাথে ছিলাম এবং সেখানেই আমিনী সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়।… এর আগে আমিনী সাহেব সম্পর্কে আমি তেমন জানতাম না। তখন তো আমি বয়সে ছোট এবং পড়াশুনায় ব্যস্ত অন্য এক মানুষ। জোট গঠনের পর থেকেই মূলত তার সাথে পরিচয় এবং জানাশোনা শুরু।
প্রথম দিকের এ সাক্ষাৎগুলো ছিলো একান্তই ব্যক্তিগত। আমি তখনও রাজনীতি শুরু করিনি। বাবার সাথে গভীর সম্পর্কের কারণে প্রায়ই তিনি আমাদের বাসায় আসতেন। আমি চাচা চাচা করতাম, গল্প করতাম। আমার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া আরো পরে, দু’হাজার সাত সালে বাবা মারা যাওয়ার পর। আমিনী চাচা তখন আমাদের বাসায় আসেন এবং বাবার স্মরণে আয়োজিত প্রোগ্রামে মোনাজাত পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক যোগাযোগ-সম্পর্ক শুরু হয় এরপর থেকে।
আমিনী সাহেবের একটা বিষয় আমাকে সবসময় খুব মুগ্ধ করতো। কে কী চিন্তা করলো সেটার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করতেন না। ইসলামের বিরুদ্ধে কোনোদিন যদি কোনো কথা হয়েছে তিনি আর দ্বিতীয় চিন্তা করেননি। সে যেই হোক, যতো পাওয়ারফুল মানুষ হোক। কোনো রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনাও সামনে আনতেন না। এই ঈমানটা আমি চাচার মধ্যে দে