কর্পোরেট কালচার বনাম ইসলামের শ্রমনীতি- Islamic Perspectives on Organizational Culture

ইসলামের শ্রমনীতি, কর্পোরেট কালচার, অফিস কালচার, কর্মীর হক, মালিকপক্ষের হক, সহকর্মীর হক, লোক দেখানো কাজ, হিংসা,

Date

Author

Blog Duration

44 minutes

কিছু প্রশ্ন মাঝে-মধ্যে আমাদের ভাবনাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কে আমি? কোত্থেকে এলাম, যাবই-বা কোথায়? নির্জন রাতে বা একান্ত অবসরে এমন প্রশ্নে ভাবনারা যখন খেই হারায়, হৃদয়ের গহীন কোণ থেকে কেউ একজন হয়তো বলে ওঠে- তুমি মানুষ। মহান প্রভুর পরম আদর ও যত্নে গড়া অপূর্ব এক সৃষ্টি। শানের তোমার অন্ত নেই, বৈশিষ্ট্যে তুমি অনন্য। তুমি পেয়েছো আকৃতির শ্রেষ্ঠত্ব, চিন্তার সৌন্দর্য। তোমার আছে বিবেক, সাথে হৃদয় নামের অমূল্য এক সম্পদ। সৃষ্টিজগতে তোমার বিকল্প কিছু নেই, সমমানেরও কেউ নেই। তুমি তাই আশরাফুল মাখলুকাত

  1. শেকড়ের খোঁজ- Who we really are?
  2. কাজ যখন ইবাদাহ- Work is ibadah
    1. এতোকিছুর সমন্বয় কীভাবে করবো, আর আমাদের লাভই বা কি?
  3. অধিকার বনাম দায়িত্বশীলতা- Rights vs Responsibilities
    1. তাকওয়া
  4. জীবন ও জীবিকা বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশনা
  5. কাজ ও কাজের হক
    1. সামর্থ্য থাকলে তবেই কাজ নেয়া
    2. কাজের দায়িত্ব পেলে যথার্থভাবে তা আঞ্জাম দেয়া
    3. এবং যোগ্য ও আমানতদার লোক নিয়োগ করা
  6. কর্মী ও শ্রমিকের হক
    1. যথাসময়ে এবং দ্রুত পারিশ্রমিক প্রদান
    2. পারিশ্রমিক যোগ্যতামাফিক যথার্থ হওয়া
    3. এবং সক্ষমতা বিবেচনা করে কাজ দেয়া, অতিরিক্ত বোঝা না চাপানো
  7. কর্মীর দায়িত্ব (নিয়োগ দাতার হক)
    1. চুক্তি ও কথানুযায়ী কাজ সম্পন্ন করা
    2. কাজ সম্পর্কে সম্মক ধারণা ও সক্ষমতা থাকা, আমানতদার ও দায়িত্ব সচেতন হওয়া
    3. আমানতের ব্যাপারে খুবই সতর্ক হওয়া এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ আঞ্জাম দেয়া
    4. নির্ধারিত বেতন-ভাতার বাইরে সুবিধা না নেয়া
  8. ইখলাস: নিয়ত গুণে বরকত- Sincerity
    1. ইখলাস না থাকার পরিণতি
    2. ইখলাসের উপকারিতা
      1. ইখলাসের আলোচনার সারাংশ-
  9. রিয়া বা লৌকিকতা- Hypocrisy
    1. আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া
    2. রিয়ার আহকাম জানা এবং পরকালীন পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া
  10. অভিমান, ঈর্ষা-হিংসা বা লোভ: জরুরি সতর্কতা- Dealing with Ego, Jealousy, and Greed
  11. দ্বন্দ্ব ও বিবাদ: বেঁচে থাকার উপায় ও প্রয়োজনীয়তা
    1. দ্বন্দ্ব বা বিবাদ এড়াতে বা মানসিক কনফ্লিক্টের খারাবি থেকে বাঁচতে আরো দুয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা যেতে পারে।
    2. বেশি বেশি সদকা এবং সর্বোপরি দুআ অব্যাহত রাখা
  12. সহকর্মীদের সাথে আচরণ- Treatment of colleagues: Islamic Perspectives
    1. প্রতিবেশী ও মুসলিমদের পরষ্পরের কয়েকটি হক
  13. ব্যবসা বনাম মানুষের সেবা- Business and Entrepreneurship: Considering Khidmatul Khalq (خدمة الخلق)
    1. কুরআনে রিযিক তালাশের নির্দেশ
    2. হলাল উপার্জনেরেউপকারিতা

শেকড়ের খোঁজ- Who we really are?

মানুষ আমরা একই পিতা-মাতার সন্তান। দেশ, ভাষা বা বর্ণ ছাপিয়ে আমাদের বড় পরিচয়- বিশ্ববাসী সকলই আমরা একই পরিবারের সদস্য। আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মহান রবের দাসত্বের পরীক্ষা দেয়ার জন্য। জীবন তাই একার যেমন নয়, নয় উদ্দেশ্যবিহীনও। সহজ ও শাশ্বত এই বিষয় দুটো বিবেচনায় রাখা গেলে অনেক ইস্যুরই সুরাহা হয়ে যায়।

শেকড় ছাড়া যেমন গাছের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, নিজের মর্যাদা এবং বাকিদের গুরুত্ব না বুঝলে জীবনে ব্যালেন্সও আনা যায় না।

কুরআন বলছে-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

‘হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও নারী থেকে। আর আমি তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে সবচেয়ে বেশি সদাচারী।’ (আল কুরআন; সুরা হুজুরাত, আয়াত ১৩)

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ

‘যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করবো, তারা বলল আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যারা অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ৩০)

هُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ فَمَن كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُهُ…

‘তিনি দুনিয়ায় তোমাদেরকে বানিয়েছেন প্রতিনিধি। কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তার ওপরই তা বর্তাবে’…(সুরা ফাতির, আয়াত ৩৯)

وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلاَئِفَ الأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ

‘তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন এবং একে অন্যের উপর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন; পরীক্ষার জন্য যা তোমাদেরকে তিনি দিয়েছেন।’… [সুরা আনয়াম, আয়াত ১৬৫]

وَلَقَدْ أَهْلَكْنَا الْقُرُونَ مِن قَبْلِكُمْ لَمَّا ظَلَمُوا وَجَاءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ وَمَا كَانُوا لِيُؤْمِنُوا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِينَ . ثُمَّ جَعَلْنَاكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ مِن بَعْدِهِمْ لِنَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ

‘তোমাদের আগে বহু সম্প্রদায়কে আমি ধ্বংস করেছি তাদের জুলুমের কারণে…। আর তাদের পর তোমাদেরকে প্রতিনিধি বানিয়েছি, দেখি তোমরা কেমন করো।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ১৩-১৪)

পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে এভাবেই আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। এই ‘সৃষ্টির সেরা’ শব্দবন্ধটি আকারে যতো ছোট, ভাবে ততোই বিশদ ও মহিমাময়। সেরা হতে গুণ ও যোগ্যতা যেমন লাগে, মহান কারো স্বীকৃতিরও দরকার হয়। সেরাদের সুবিধে ও মর্যাদা যেমন থাকে, দায় ও জবাবদিহিতার চাপও সামলাতে হয়। বাহ্যিক সৌন্দর্য ও অন্তরের পবিত্রতা, মহান প্রভুর স্বীকৃতি ও দুনিয়ায় তার প্রতিনিধি হওয়ার দায়- সবমিলিয়েই মানুষ আমরা আশরাফুল মাখলুকাত।

পৃথিবীর দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আর সবকিছুই নিয়োজিত আমাদের সেবায়। না চাইতেই শ্রেষ্ঠত্বের এমন রাজকপাল নিয়ে জন্ম আমাদের

কুরআন বলছে-

أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً ۗ وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُّنِيرٍ.

‘তোমরা কি দেখ না, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তোমাদের ওপর তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন?’… (সুরা লুকমান, আয়াত ২০)

কেউ যখন নিজের মর্যাদা বুঝতে শুরু করে, তার মধ্যে তৈরি হয় বিশেষ এক দায়িত্ববোধ। তার বিবেক তাকে সহযোগিতা করে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে। সঠিক ও যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে। সহজে কেউ তাকে প্রতারিত বা প্ররোচিত করতে পারে না। ভুল ও ব্যর্থতার মাত্রা কমে গিয়ে জীবনে একরকম ব্যালেন্স তৈরি হয়।

এই ব্যালেন্সটাই জীবনে সফলতা অর্জনের সবচে বড় মাধ্যম, প্রধান হাতিয়ার। বিবেকের এই দায় ও ব্যক্তিত্বই মানুষের সেরা সম্পদ।

কাজ যখন ইবাদাহ- Work is ibadah

জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ব্যক্তিরা যখন নিজেদের সংগ্রামের গল্প করেন, শুনতে ভালোই লাগে। আমরা অভিভূত হই যখন একজন আর্টিস্ট বলেন- ডিজাইন বা শিল্প আমার পেশা নয়, অস্তিত্বের অংশ। আমি শিল্পে বাঁচি; খাই, ঘুমাই এমনকি স্বপ্নও দেখি!…

এসবক্ষেত্রে অনেক সময় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও সহজেই বুঝতে পারি- একেকটা সাফল্যের পেছনে কতোসব না বলা গল্প লুকিয়ে থাকে। জীবন যেমন ছকবাঁধা নিয়মে চলে না, শুধু নির্দিষ্ট একটা টাইমলাইন ফলো করে ক্যারিয়ারেও বড় কোনো মাইলফলক স্পর্শ করা যায় না। চিন্তা করতে হয় আরো বড় পরিসরে। প্রস্তুতি নিতে হয় দীর্ঘমেয়াদী। তারপর মেধা-যোগ্যতার পুরোটা ঢেলে দিয়ে, সময়-শখ-আহ্লাদ সব কুরবান করে দিয়ে কোনো একদিন হয়তো দেখা মিলে কাঙ্খিত সাফল্যের। প্রশ্ন হলো- এইসব বা এতোসব আমরা আসলে কেনো করি?

  • শুধু উপার্জন বা ভালো থাকার জন্য?
  • নাম-যশ-খ্যাতি বা সেলিব্রেটি হওয়ার জন্য?
  • চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাউকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাবার জন্য?

আপনার জবাব যদি ‘ইয়েস বা হাঁ’- এর দিকে যায় তাহলে আবার একটু পেছনে ফিরতে হবে! আমাদের জীবন, পৃথিবীতে আগমন ও দিনযাপন কিছুই যেহেতু শুধু আমাদের না; আমাদের কাজ ও পরিশ্রম তাহলে কেনো বা কীভাবে শুধু এসব উদ্দেশ্যে হতে পারে?

মহান আল্লাহ বলেন-

وَمَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَالۡاِنۡسَ اِلَّا لِيَعۡبُدُوۡنِ
জ্বিন ও মানুষকে আমি শুধু এজন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদাত করবে।
مَاۤ اُرِيۡدُ مِنۡهُمۡ مِّنۡ رِّزۡقٍ وَّمَاۤ اُرِيۡدُ اَنۡ يُّطۡعِمُوۡنِ
আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না। এও আশা করি না যে তারা আমাকে খাওয়াবে।
اِنَّ اللّٰهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُوۡ الۡقُوَّةِ الۡمَتِيۡنُ‏
নিশ্চয় আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং অত্যন্ত শক্তিধর ও পরাক্রমশালী।
(সুরা জারিয়াত, আয়াত- ৫৬-৫৭-৫৮)

বান্দা হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ স্রষ্টার ইবাদাহ ও তাঁকে সন্তুষ্ট রাখা। মানবজীবনে আলসেমি, কর্মহীনতা, কোনোরকম প্রতারণা কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে প্রশ্রয় পেতে পারে না। ইসলাম অনুমোদন দেয় না কেবল নিজের ভালো করা ও থাকার ভাবনাকেও। সুতরাং-

  • কাজ ও ক্যারিয়ার কেবল শখের কিছু নয়, ইবাদাহ
  • নিজের সাথে পরিবার ও আত্মীয়দের খেয়াল রাখা আমাদের কর্তব্য
  • সমাজ ও দেশের উন্নতিকল্পে অবদান রাখাও এর বিবেচনার বাইরে নয়

হাদীসে এসেছে- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

كُلُّكُم راعٍ وكُلُّكُم مسؤولٌ عن رعيتهِ
‘প্রত্যেকেরই নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে। এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্ক জিজ্ঞাসিত হতে হবে।’

নবীজী তার প্রিয় সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে উপদেশ দিয়ে বলেন-

يا بن مسعود، إذا عملت عملاً فاعمل بعلم وعقل ـ إذا أردت أن تقوم بأي عمل، فلا بد من أن يكون لديك ثقافة هذا العمل.
‘হে ইবনে মাসউদ, যখনই কোনো কাজ করো, প্রজ্ঞা ও বিবেক রেখে করবে। যখন কোনো কাজের দায়িত্ব নাও, সে কাজের যোগ্যতা থাকলে তবেই নেবে।’…

এতোকিছুর সমন্বয় কীভাবে করবো, আর আমাদের লাভই বা কি?

প্রথম কথা- কাজ যেহেতু ইবাদত, অন্যদিকে আলসেমি বা কর্মহীন থাকা নিন্দনীয়, সুতরাং লাভের বিবেচনা ছাড়াই কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। তবে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের কোনো কাজকেই ফায়দাহীন রাখেন নি।

হাদীসে এসেছে-

إن الله تعالى يحبّ إذا عَمِلَ أحدُكم عملاً أن يتقنه
‘তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করে এবং নিষ্ঠার সাথে তা আন্জাম দেয়, সে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে যায়।’

إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা সম্পদ দেখেন না, দেখেন তোমাদের হৃদয় ও কাজ।’

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ إِلَّا كَانَ لَهُ بِهِ صَدَقَةٌ
‘কোনো মুসলিম যখন একটা গাছ লাগায় বা ফসল ফলায় এবং তা থেকে পাখি, মানুষ বা পশু খায়; তার জন্য সেটা সদকা হয়ে যায়।’

তবে এসব ফজিলত পেতে অবশ্যই নিয়তটা যোগ করে নিতে হবে। আমি যা করি বা করছি আল্লাহর জন্যই করছি। উপার্জন ও ক্যারিয়ারে উন্নতির পাশাপাশি তখন সওয়াবও আমলনামায় যোগ হতে থাকবে।

নিয়তের সাথে এই কয়েকটা বিষয়ও খেয়াল রাখতে হবে-

  • ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হয় এমন কোনো কাজ না করা
  • কাজ করতে গিয়ে কারো ক্ষতি না করা
  • সহকর্মী সবার প্রতি সদয় থাকা
  • গীবত বা কাউকে লজ্জা দেয়াসহ অন্যায় সব কাজ থেকে বিরত থাকা
  • প্রতিষ্ঠান, পরিচালক ও দায়িত্বশীলদের প্রতি আস্থাশীল থাকা ইত্যাদি

আল্লাহর আনুগত্য এমন একটা বিষয়- একবার স্বীকার করে নেয়া গেলে সবই সহজ হয়ে যায়। আল্লাহই সহজ করে দেন। আর না চাইলে বা এড়িয়ে গেলে স্বাভাবিক অনেক ব্যাপারও দিনে দিনে কঠিন হয়ে ওঠে। কাজ, দায়িত্ব, জবাবদিহিতা সবই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আল্লাহর ওপর ভরসা করে একবার নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়া গেলে ইনশাআল্লাহ সবই ঠিক হয়ে যবে। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফিক দিন।

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُم بِإِيمَانِهِمْ ۖ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ
‘যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে, ঈমানের বদৌলতে তাদের প্রতিপালকই তাদের পথ প্রদর্শন করেন। আর নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে তাদের বাসস্থানের তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহর।’ (সুরা ইউনুস- আয়াত- ৯)

অধিকার বনাম দায়িত্বশীলতা- Rights vs Responsibilities

তিনজন লোক একবার কোথাও যাচ্ছিলো। পথে হঠাৎ বৃষ্টি আসায় দৌড়ে তারা পাশের এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলো। অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলের সাথে বড় এক পাথর এসে পড়লো গুহার মুখে। ফলে লোক তিনজন আটকে গেলো। পাথর সরানোর সামর্থ্য তাদের ছিলো না। তিনজনে পরামর্শ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলো- এই বিপদ থেকে মুক্তির একটাই উপায়। জীবনে করা সবচে খাঁটি কাজের কথা বলো এবং এর উসিলা করে আল্লাহর কাছে মুক্তি চাও- কেবল তিনিই এই বিপদ থেকে আমাদের বাঁচাতে পারেন

প্রথমজন বললো- আমার বাসায় বৃদ্ধ বাবা-মা থাকতেন। প্রতিদিন তাদেরকে আমি আমার একমাত্র ছাগলটির দুধ পান করাতাম এবং তাদের আগে পরিবারের কাউকে আমি পান করতে দিতাম না। একদিন ফিরতে দেরি হওয়ায় তারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এদিকে আমার বাচ্চারা ক্ষুধার্থ ছিলো। ঘুম ভাঙালে কষ্ট হবে তাই বাবা-মাকে ডাকিনি। সারারাত তাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে রইলাম। হে আল্লাহ, আপনি যদি মনে করেন আপনার নির্দেশের সম্মানেই আমি এমনটি করেছিলাম তাহলে আমাদেরকে এই বিপদ থেকে আপনি মুক্তি দিন। পাথর কিছুটা সরে গেলো।

অপর ব্যক্তি বললো– আমার এক চাচাতো বোন ছিলো। আমি তাকে খুব পছন্দ করতাম। একদিন বিপদে পড়ে সে আমার কাছে টাকা চাইতে এলো। আমি তাকে কুপ্রস্তাব দিলাম। সে রাজি হলো না। পরে কোনো উপায় না থাকায় আবার এলো এবং এবার রাজি হয়ে গেলো। আমি যখন মিলিত হবার জন্য তার কাছে গেলাম সে বলে উঠলো- আল্লাহকে ভয় করো। সাথে সাথে আমি সরে এলাম। হে আল্লাহ, আপনি যদি মনে করেন কেবল আপনার ভয়েই আমি সেদিন যিনা থেকে বিরত ছিলাম তাহলে এই বিপদ থেকে আমাদের রেহাই দিন। পাথর আরো কিছুটা সরে গেলো।

তৃতীয় সঙ্গী বললো- আমার কাছে এক শ্রমিকের বকেয়া মজুরি ছিলো, সামান্য পরিমাণ ধান। সে তার হক না নিয়েই চলে গিয়েছিলো। আমি সেই ধান চাষাবাদে লাগালাম। পরিমাণ বাড়ায় একসময় তা দিয়ে গরু কিনে ফেললাম। হঠাৎ একদিন শ্রমিক এসে তার পারিশ্রমিক চাইলো। আমি তাকে বললাম এই নাও এই গরু এবং সাথের দ্রব্যাদি তোমার পারিশ্রমিক। সে নিতে চাইলো না এই বলে যে- তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছো? আমি তোমার কাছে কেবল কিছু ধান পাই- এতো সম্পদ কী করে আমার হবে? ঘটনা খুলে বলায় সে খুশি হলো এবং তার হক নিয়ে চলে গেলো। হে আল্লাহ আপনি যদি মনে করেন এই কাজ আমি আপনার ভয়ে করেছি তাহলে আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। এরপর পাথর গুহামুখ থেকে পুরোপুরি সরে গেলো এবং তারা বেরিয়ে নিজেদের গন্তব্যে রওয়ানা হলো।

নবীজী সাহাবাদের এই গল্প শুনিয়েছেন। ইমাম বুখারি রহ.সহ অনেকেই হাদিসটি সূত্রসহ বর্ণনা করেছেন

তাকওয়া

এই হাদিসের শিক্ষা হলো তাকওয়া- সবকিছু করা শুধু আল্লাহর ভয়ে, সম্মানে বা তাঁর সামনে লজ্জিত হওয়ার আশংকায়। তো এই তাকওয়াই ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের ভিত্তি।

আর তাকওয়ার সহজ ও অনিবার্য ফলাফল হলো ইনসাফ। আমরা (পরিচালক-কর্মী, মালিক-শ্রমিক) যদি নিজেদের ওপর বর্তানো হকগুলো ঠিকভাবে আদায় করতে পারি তবেই সমাজে ইনসাফ কায়েম হবে। জীবনে তাকওয়ার প্রতিফলন ঘটবে। নবীজী সা. ইরশাদ করেন-

إن لنفسك عليك حقا، وإن لجسدك عليك حقا، وإن لزوجك عليك حقا
তোমার ওপর হক রয়েছে তোমার আত্মার, তোমার শরীরের এবং তোমার স্ত্রীর।

অধিকার বিষয়ক আলোচনার আগে তাকওয়া সম্পর্কে কুরআনের কিছু আয়াত দেখে নেয়া উচিত। কারণ, আমরা যতোটা অধিকার সচেতন ঠিক ততোটাই বেখবর আমাদের দায়িত্বের ব্যাপারে। অথচ দুটো এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে আলাদা করার সুযোগ নেই। যেখানে দায়িত্ব আছে সেখানে অধিকার আছে, যেখানে অধিকার থাকবে সেখানে দায়িত্ব কম-বেশ থাকতেই হবে।

সুতরাং দুটোর সমন্বয় ও ঠিকঠাক বাস্তবায়নে মূলত যা দরকার তা হলো তাকওয়া। আমার জবাবদিহিতা আল্লাহর কাছে। সুতরাং কাউকে পরোয়া করে কাজ করার যেমন দরকার নেই, কারো ভয়ে বা কোনোরকম লজ্জায় অধিকার প্রয়োগে বিরত থাকারও প্রয়োজন নেই। এই ভাবনাটুকু যে কোনো প্রতিষ্ঠান, অফিস বা প্রকল্পের পুরো দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে।

কুরআনে তাক্বওয়ার বিবরণ এসেছে এভাবে

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
হে মুমিন বান্দারা, আল্লাহকে পরিপূর্ণরূপে ভয় করো। আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৭২)

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا * يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَن يُطِعْ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا
হে মুমিন বান্দারা, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্য ও সঠিক কথা বলো। তিনি তোমাদের কাজকে শুধরে দেবেন, তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন। যারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের অনুসরণ করে তারাই প্রকৃত সফলকাম। (সুরা আহযাব, আয়াত ৭১-৭২)

আরো কিছু আয়াত ও হাদিসের সাথে আমরা ইতোমধ্যে পরিচিত হয়েছি। যেমন- ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই বেশি উত্তম যে বেশি মুত্তাকি বা খোদাভীরু’। হাদীস যেমন- ‘আল্লাহ তোমাদের সম্পদ বা চেহারা দেখেন না, দেখেন তোমাদের হৃদয় ও আমল’।

তাকওয়ার প্রাথমিক আলোকপাতের পর অধিকার ও দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে মোট ৪টি বিষয় আমাদের সামনে আসে যেগুলো জানা ও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।

  • জীবন ও জীবিকা বিষয়ে আমাদের ভাবনা বনাম আল্লাহর নির্দেশনা
  • কাজ ও কাজের হক বা দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি
  • কর্মী ও শ্রমিকের অধিকার
  • কর্মীর দায়িত্ব বা মালিকের হক

ধারাবাহিকভাবে সংক্ষেপে বিষয়গুলো আমরা এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।

জীবন ও জীবিকা বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশনা

বান্দা যখন মুত্তাকি হওয়ার গুণ অর্জন করে বা করতে সচেষ্ট হয়, তার সবকিছুই আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। সাধারণত আমরা সম্পদ অর্জন ও বন্টনের সে সূত্র দেখি বা যেভাবে ভাবি বাস্তবেও কি তা সেরকমই। দেখুন আল্লাহর ঘোষণা-

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
কোনো পুরুষ বা মহিলা যদি সৎকর্মশীল হয়, তাকে আমি পবিত্র জীবন দান করি। আর তাদের কাজের অতিউত্তম প্রতিদান তাদের আমি দেবো। (সুরা নাহল)

وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلاَئِفَ الأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ
তিনি পৃথিবীতে তোমাদেরকে বানিয়েছেন প্রতিনিধি। আর তোমাদের মধ্যকার কিছু লোককে কিছু লোকের ওপর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন সেসব বিষয়ে (ইলম, অর্থ, সম্মান), যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন। (সুরা আনআম, আয়াত ১৬৫)

نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُم بَعْضًا سُخْرِيًّا
দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে আমি বন্টন করে দিয়েছি তাদের জীবিকার উপকরণ এবং তাদের কতককে কতকের ওপর কিছু ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি যাতে তারা পরষ্পরকে আঁকড়ে থাকে। (সুরা যুখরুফ, আয়াত ৩২)

الذين يستحبون الحياة الدنيا على الآخرة ويصدون عن سبيل الله ويبغونها عوجا أولئك في ضلال بعيد
যারা দুনিয়ার জীবনকে পরকালের ওপর প্রাধান্য দেয়। আল্লাহর রাস্তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার বিকল্প খোঁজে। সেসব লোকেরা রয়েছে সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে। (সুরা ইবরাহীম, আয়াত ৩)

সাফল্য ও সম্পদ অবশ্যই বান্দার পরিশ্রমের ফসল, সাথে তাকদিরও। তাকদিরে না থাকলে কেউ হাজার চেষ্টা করেও সফল বা সম্পদশালী হতে পারে না। আবার চেষ্টা ছাড়া বৈধভাবে সম্পদের মালিক হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং আমাদের সাফল্য ও সম্পদ পরিশ্রম ও তাকদিরের সমন্বিত ফসল। তাই বলাই যায়- যে বা যারা সফল ও সম্পদশালী, তারা অবশ্যই আল্লাহর নেয়ামতের অধিকারী।

মালিকপক্ষকে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা হিসেবে শ্রদ্ধা করা কর্মী ও অধিনস্তদের দায়িত্ব। সাথে এও মনে রাখা দরকার যে, সৎকর্মশীল ও পরিশ্রমীদের আল্লাহ পাক পবিত্র ও সম্মানিত জীবন প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন।

সুতরাং আজ যে যে অবস্থানে আছে, পরিশ্রম ও দুআ তাকে আসছে দিনগুলোয় কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে সেটা আল্রাহ পাকই ভালো জানেন।

তাই পক্ষ হিসেবে যে যেখানেই থাকি আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ আল্লাহর শোকর গোজার হওয়া এবং এরপর নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বগুলো পালন করে যাওয়া। নিষ্ঠার সাথে, ভালোবাসার অঙ্গীকারে।

কাজ ও কাজের হক

কাজ বা দায়িত্ব শুধু পালন করে গেলে হবে না। দায়িত্ব নেয়ার সময় এবং তা পালনের ক্ষেত্রে অবশ্যই মৌলিক কিছু বিষয় বুঝে নিতে হবে এবং সে অনুপাতে জবাবদিহিতাও করতে হবে। কারণ, দুই বান্দা কোনো বিষয়ে একমত হয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা বা চুক্তির পর তা আর কেবল তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আল্লাহর হাওয়ালায় চলে যায়।

এক পক্ষ তাই যেমন অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে জুলুম করতে পারবে না তেমনি অন্যপক্ষও প্রকৃত কারণ ছাড়া কোনোরকম আলসেমি বা অবহেলা করে পার পেতে পারবে না। অবশ্যই তাকে হক আদায় করতে হবে এবং দুনিয়ায় না হলেও পরকালে জবাব দিতে হবে।

কিছু মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীস তুলে ধরা হলো।

সামর্থ্য থাকলে তবেই কাজ নেয়া

নবীজী তার প্রিয় সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে উপদেশ দিয়ে বলেন-

يا بن مسعود، إذا عملت عملاً فاعمل بعلم وعقل ـ إذا أردت أن تقوم بأي عمل، فلا بد من أن يكون لديك ثقافة هذا العمل.
‘হে ইবনে মাসউদ, যখনই কোনো কাজ করো, প্রজ্ঞা ও বিবেক রেখে করবে। যখন কোনো কাজের দায়িত্ব নাও, সে কাজের যোগ্যতা থাকলে তবেই নেবে।’…

কাজের দায়িত্ব পেলে যথার্থভাবে তা আঞ্জাম দেয়া

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের চুক্তিসমূহ পরিপূর্ণ করো। (সুরা মায়েদা, আয়াত-১)

إن الله تعالى يحبّ إذا عَمِلَ أحدُكم عملاً أن يتقنه
‘তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করে এবং নিষ্ঠার সাথে তা আন্জাম দেয়, সে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে যায়।’

এবং যোগ্য ও আমানতদার লোক নিয়োগ করা

قالت إحداهما يا أبت استأجره إن خير من استأجرت القوي الأمين
হযরত শোয়াইব আ. এর কন্যা হযরত মুসার (আ.) ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলেন এই বলে যে,
‘হে আমার পিতা, আপনি তাকে (হযরত মুসাকে বকরি চড়ানোর কাজে) নিয়োগ করুন। নিশ্চয় আপনি যাকে নিয়োগ দিচ্ছেন সে শক্তিশালী এবং আমানতদার।’ (সুরা ক্বাসাস)

কর্মী ও শ্রমিকের হক

নারী সমাজ

যথাসময়ে এবং দ্রুত পারিশ্রমিক প্রদান

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ
শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করো।

ثلاثة أنا خصمهم يوم القيامة: رجل أعطى بي ثم غدر، ورجل باع حرا فأكل ثمنه، ورجل استأجر أجيرا فاستوفى منه ولم يعطه أجره
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাক বলেন- কেয়ামতের দিন তিন ধরনের লোকের বিরুদ্ধে আমি নিজে বিবাদে জড়াবো।

  • এক, আমার নামের শপথ করে কাউকে যখন কোনো বিষয়ের জিম্মাদার বানানো হয় এবং এরপর সে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
  • দুই, কোনো মুসলিম গোলাম ভেবে অন্য এক মুসলিমকে খরিদ করে এরপর সত্য জেনেও আবার তাকে বিক্রি করে লাভের জন্য।
  • আর তিন, এমন লোক যে কোনো কাজের জন্য কিাউকে দায়িত্ব দেয় কিন্তু কাজ করার পর পারিশ্রমিক দেয় না।’ (বুখারী শরীফ)

পারিশ্রমিক যোগ্যতামাফিক যথার্থ হওয়া

مَنِ اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِينِهِ فَقَدْ أَوْجَبَ اللَّهُ لَهُ النَّارَ، وَحَرَّمَ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ فقال رجل: وإن كان شيئًا يسيرًا يا رسول الله؟ فقال: وَإِنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ
‘কেই যদি মুসলিম কারো হক স্বেচ্ছায় কেটে নেয়, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম আবশ্যক করে দেন এবং তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন- হে আল্লাহর রাসূল যদি সামান্য বিষয় হয়? তিনি বললেন- যদি গাছের সামান্য এক টুকরো ডালও হয়।’

এবং সক্ষমতা বিবেচনা করে কাজ দেয়া, অতিরিক্ত বোঝা না চাপানো

لا يكلف الله نفسا إلا وسعها
আল্লাহ তায়ালা কাউকে সক্ষমতার বেশি দায়িত্ব দেন না। (সুরা বাক্বারা, আয়াত ২৮৬)

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

ولا تكلفوهم ما لا يطيقون
তাদেরকে তোমরা এমন দায়িত্ব চাপিয়ো না যা তারা পারবে না (নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ)

কর্মীর দায়িত্ব (নিয়োগ দাতার হক)

আমাদের সমাজে মালিকপক্ষ বরাবরই জালেম হিসেবে হাজির হন। যদিও অনেক সময়ই দায় তাদের থাকে না বা নিজেদের অবস্থানে ঠিক থাকার পরও তাদেরকে সমালোচনা হজম করতে হয়।

বর্তমান পৃথিবী সুবিধার মোটামুটি সবকিছু মালিকপক্ষের জন্য সাজালেও অধিকারের শ্লোগানটা কেবল শ্রমিকের পক্ষে রেখেছে। অধিকার প্রশ্নে সব আলোচনা বা দলিল তাই শুধু শ্রমিকের পক্ষে আসে, যেনো মালিকের কোনো অধিকারই নেই।

আল্লাহ তায়ালা সবার প্রতি ইনসাফ করেছেন যার যার দায়িত্ব ও অধিকার বুঝিয়ে দিয়ে। শ্রমিক সম্মান, সুযোগ, পারিশ্রমিক ও আন্তরিকতা সবই পাবে তবে তা এইসব শর্তে-

চুক্তি ও কথানুযায়ী কাজ সম্পন্ন করা

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ

হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের চুক্তিসমূহ পরিপূর্ণ করো। (সুরা মায়েদা, আয়াত-১)

কাজ সম্পর্কে সম্মক ধারণা ও সক্ষমতা থাকা, আমানতদার ও দায়িত্ব সচেতন হওয়া

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَخُونُواْ اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُواْ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ وَاعْلَمُواْ أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلاَدُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ

‘হে মুমিন বান্দারা, তোমরা তো আল্লাহ এবং তার রাসূলের খেয়ানত করো না। তোমরা খেয়ানত করো নিজেদের ওপর বর্তানো আমানতের এবং তা জেনে শুনে।জেনে রেখো, তোমাদের সম্পদ এবং সন্তানাদি তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ, (যদি তোমরা সে পরীক্ষায় সফল হও) তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে বিরাট প্রতিদান।’

يِا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إَن تَتَّقُواْ اللَّهَ يَجْعَل لَّكُمْ فُرْقَاناً وَيُكَفِّرْ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ

‘হে মুমিন বান্দারা,যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তিনি তোমাদের দান করবেন ফুরক্বান (ভালো-মন্দ পার্থক্য করার অন্তর্চক্ষু), তোমাদের কৃত ভুলগুলো (মানুষের মন থেকে) দূরে সরিয়ে দেবেন। তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ বড়ই করুণাময়, মহান।’
(সুরা আনফাল, আয়াত ২৭-২৯)

আমানতের ব্যাপারে খুবই সতর্ক হওয়া এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ আঞ্জাম দেয়া

হাদীসে এসেছে-

أول ما تفتقدون من دينكم الأمانة
তোমরা তোমাদের দীন থেকে প্রথমে যা হারাবে তা হচ্ছে আমানত।

অন্য এক হাদীসে এসেছে-

أول ما يرفع من الناس الأمانة
মানুষদের কাছ থেকে (তাদের গুনাহের কারণে) প্রথমে ছিনিয়ে নেয়া হবে অমানত

কোনোরকম খেয়ানত বা প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া

হাদীসে এসেছে-

من غش فليس منا
যে বা যারা প্রতারণার আশ্রয় নেয় তারা আমাদের (মুসলিমদের) দলভুক্ত নয়।

খেয়ানত খুবই ভয়ংকর, সরাসরি মুনাফিকের আলামত। আর মুনাফিকদের ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা-

إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا

নিশ্চয় মুনাফিক্বদের ঠিকানা হবে জাহান্নামের তলদেশ। আর আপনি তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাবেন না।

কর্মদাতার প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা
মালিক পক্ষ কুরআনের আয়াতের আলোকে আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত হন, শরয়ি কোনো বিষয়ের বিরোধী না হলে তাদের আনুগত্য আবশ্যক।

نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُم بَعْضًا سُخْرِيًّا
দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে আমি বন্টন করে দিয়েছি তাদের জীবিকার উপকরণ এবং তাদের কতককে কতকের ওপর কিছু ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি যাতে তারা পরষ্পরকে আঁকড়ে থাকে।
(সুরা যুখরুফ, আয়াত ৩২)

নির্ধারিত বেতন-ভাতার বাইরে সুবিধা না নেয়া

হাদীসে এসেছে-

من استعملناه على عمل، فرزقناه رزقا فما أخذه بعد ذلك فهو غلول
কাউকে যদি আমরা কাজে নিয়োগ করি এবং তার নির্ধারিত সুবিধা (বেতন-ভাতা) প্রদান করি; এর বাইরে সে যা কিছুই নেবে বা গ্রহণ করবে তা হবে খেয়ানত তথা হারাম।

উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে পরিষ্কার যে, সবারই যেমন কম-বেশ অধিকার রয়েছে, রয়েছে দায়িত্বও। দুটোর সমন্বয় ঘটানোই মুমিন হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। এবং মুত্তাকি হওয়ার ও থাকার অবশ্য পালনীয় শর্ত।

ইখলাস: নিয়ত গুণে বরকত- Sincerity

কাজ করা এবং নিষ্ঠার সাথে করা দুটোর ব্যবধান প্রায় আকাশ-পাতাল। কাজ একই এবং অনেক সময় হয়তো দৃশ্যত ব্যবধান চোখে পড়ে না তবু একটাকে আমরা বলি দায়সারা কাজ আরেকটা গোছালো ও পরিপূর্ণ কাজ। একজন সৎ ও ব্যক্তিত্ববান কর্মী কখনো দায়সারা কাজ করতে পারে না, নিষ্ঠাহীন কাজ করে কেউ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যেমন পায় না; জীবনে উন্নতিও করতে পারে না।

আর ইসলামের বিবেচনায় বললে- নিষ্ঠা তথা ইখলাস ছাড়া কোনো আমল বা কাজ আল্লাহর দরবারে কবুলই হয় না। নিয়ত ও ইখলাস যে কোনো আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত।

হাদীসে এসেছে-

إنما الأعمالُ بالنيات، وإنما لكلِّ امرئٍ ما نوى
’নিশ্চয়ই সব কাজ নিয়দের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ তা-ই পায় যা সে নিয়ত করে।’

অন্য হাদীসে এসেছে-

إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা সম্পদ দেখেন না, দেখেন তোমাদের হৃদয় ও কাজ।’

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন-

قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
’হে নবী আপনি বলুন- নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবই জগতসমূহের মালিক আল্লাহর জন্য।’ (সুরা আনআম, আয়াত ১৬২)

الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
’তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কে উত্তম আমল করে। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক, আয়াত ২)

مَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ

’যে পরকালে লাভের আশা করে আমি তাকে বরকত দান করি (বা বাড়িয়ে দিই)। আর যে দুনিয়ার লাভের আশা করে আমি তাকে কিছু অংশ প্রদান করি, কিন্তু পরকালে সে কিছুই পানব না।’ (সুরা শূরা, ২)

উপরিউক্ত হাদীস ও আয়াতের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে বান্দার যে কোনো কাজে আল্লাহ ইখলাস চান। নয়তো সে কাজে সাময়িক উপকার হলেও আখিরাতে তার কোনো অংশ থাকবে না। মুফাস্সিরিন ও ফিক্বাহবিদগণ তাই মুসলিমদের প্রতিটি কাজে ইখলাস থাকাকে ওয়াজিব বলেছেন। কারণ যে কাজে ইখলাস নেই তা আর ইবাদাহ তথা আল্লাহর জন্য থাকে না, হয়ে যায় রিয়া ও নিফাক তথা লোকদেখানো ও মুনাফেকি- ইসলামে যা গ্রহণযোগ্য নয়।

না বুঝে অনেকে ভেবে বসে এসব তো আমলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আয়-উপার্জন বা দুনিয়ার কাজের বেলায় নয়। এমন চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ ইসলামে দুনিয়া বা আখিরাতের কাজকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। মুসলিম বান্দার প্রতিটি কাজই আমল– কোনোটা ফরজ, কোনোটা ওয়াজিব বা নফল কিন্তু সবই আমল ও ইবাদাহ। সবগুলোই তাই গুরুত্বপূর্ণ, সবকিছুতেই তাই নিয়ত ও ইখলাস থাকা জরুরি।

যেমন হাদীসে আমরা পড়েছি-

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ إِلَّا كَانَ لَهُ بِهِ صَدَقَةٌ
‘কোনো মুসলিম যখন একটা গাছ লাগায় বা ফসল ফলায় এবং তা থেকে পাখি, মানুষ বা পশু খায়; তার জন্য সেটা সদকা হয়ে যায়।’

বা যেমন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لست تنفق نفقة تبتغي بها وجه الله إلا أجرت بها حتى اللقمة تجعلها في في امرأتك
‘তুমি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা-ই খরচ করো তার প্রতিদান অবশ্যই পাবে, এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লুকমাটি তুলে দাও; তারও।’

দৃশ্যত যে কাজগুলোকে আমরা দুনিয়াবি বা দীনের সাথে সংশ্লিষ্টতাহীন মনে করি, সেগুলোকে ইবাদাহ হিসেবে গণ্য করি না এবং সেভাবে গুরুত্বও দিই না।

অথচ আমরা জানি, আমাদের প্রতিটি কাজ লিপিবদ্ধ হচ্ছে। আমাদের সময়ের হিসেব নেয়া হবে। আর যেখানে ইখলাস থাকবে না বা যে কাজে ইখলাস থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হবে না সে কাজে অবশ্যই কম-বেশ খেয়ানত হবে। খেয়ানত করে বা খেয়ানতের পরিবেশে থেকে একজন মুমিন কী করে খালেস ও পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারে? ইসলামী শরীয়ায় রাস্তায় পেশাব করা লোকের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না তার ‘আদল’ তথা পারসোনালিটি ইস্যু বিবেচনায়, সুতরাং কাজ ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ইখলাসকে গুরুত্ব না দিলেিএকজন মুমনের পারসোনালিটি কীভাবে পূর্ণতা পাবে?

তারচে বড় কথা- ইখলাসহীন কাজে রিয়া এমনকি শিরকেরও ব্যাপার চলে আসে যা সম্পূর্ণ হারাম।

সাহাবী হযরত ফুজাইল বিন আয়াযে রা. বলেন-

‘মানুষের কথা চিন্তা করে কোনো কাজ ছেড়ে দেয়া হলো রিয়া। আর মানুষের জন্য বা নামে কোনো কাজ করা হলো শিরক। একমাত্র ইখলাসই পারে এ দুটো থেকে তোমাকে বাঁচাতে।

হাদীসে এসেছে-

إن أخوف ما أخاف عليكم الشرك الأصغر قالوا: يا رسول الله وما الشرك الأصغر؟ قال: الرياء
’তোমাদের ব্যাপারে আমি সবচে বেশি ভয় করি ছোট শিরকের। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন- আল্রাহর রাসূল! ছোট শিরক কী? তিনি বললেন- রিয়া তথা লোকদেখানো মনোভাব।’

হযরত শাদ্দাদ বিন আওস রা. বলেন- রাসূলের যুগে আমরা রিয়াকে ছোট শিরক হিসেবে গণ্য করতাম।

আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন রিয়াকারীদের বলবেন- যাও সেসব লোকের কাছে যাদের দেখানোর জন্য তোমরা আমল করতে। দেখো গিয়ে আজ তাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান পাও কিনা।

হযরত জুনাইদ রাহ. বলেন- ইখলাস হলো বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার একান্ত গোপন বিষয়। ফেরেশতারা ইখলাসের খবর জানেন না যে লিখে রাখবেন। শয়তানও টের পায় না যে তা নষ্ট করবে। কুপ্রবৃত্তিও ইখলাসের ব্যাপারটি বুঝতে পারে না যে প্রভাবিত করবে। এজন্যই ইখলাসের এতো গুরুত্ব।

ইখলাস না থাকার পরিণতি

মুমিনের যে কোনো কাঝে ইখলাস থাকতেই হবে। ইখলাস না থাকার পরিণদি ভয়াবহ। কারণ যে লোকদেখানো বা খ্যাতির জন্য কোনো কাজ বা ইবাদাহ পালন করে পরকালে সে এসবের কোনো প্রতিদান পায় না।

কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاء مَّنثُوراً
‘কেয়ামতের দিন যখন তাদের কোনো আমল তালাশ করতে যাব, সেগুলোকে পাব উড়ন্ত ধুলোর ন্যায় (অকেজো)। (সুরা ফুরক্বান, ২৩)
ইখলাস ছাড়া শাফায়াত মিলবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

يَوْمَئِذٍ لَّا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلا
সেদিন কেবল তাদের জন্যই শাফায়াত উপকারে আসবে যাদের ক্ষেত্রে দয়ালু আল্লাহ অনুমতি দেবেন এবং যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন।’ (সুরা ত্বহা, ১০৯)

ইখলাসের উপকারিতা

কাজ ও ইবাদাতে ইখলাসের সবচে বড় উপকারিতা হলো- শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচা। শয়তান নিজেই বলেছে যা আল্লাহ পাক কুরআনে উল্লেখ করেছেন-

إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
‘আমি সব বান্দাকেই পথভ্রষ্ট করবো তবে তাদের ছাড়া যারা আপনার প্রতি একনিষ্ঠ বা মুখলিস।’

হযরত উমর রা. একবার আরেক সাহাবী হযরত আবু মুসা আশআরী রা.কে লিখলেন-

من خلصت نيته كفاه الله -تعالى- ما بينه وبين الناس
’যে ব্যক্তি তার নিয়তকে খালেস করে নেয়, আল্লাহ তায়ালা তার ও মানুষের সকল বিষয়ে জিম্মাদার হয়ে যান।’

ইখলাসের আলোচনার সারাংশ-

  • ইখলাস হলো বান্দার কাজ ও কথা কবুল হওয়ার ভিত্তি
  • ইখলাস দুআ কবুলেরও শর্ত
  • ইখলাসের মাধ্যমে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, দুনিয়া ও আখিরাতে
  • ইখলাসের মাধ্যমে মনের ময়লা ও সংশয় দূর হয়
  • ইখলাসের মাধ্যমে বান্দাহ শিরক থেকে মুক্ত থাকে
  • ইখলাসের মাধ্যমে সবার সাথে আন্তরিক সম্পর্ক ও ঐক্য তৈরি হয়
  • ইখলাসের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য নিশ্চিত হয়
  • ইখলাসের মাধ্যমে দুনিয়ার কঠোরতা থেকে মুক্তি মেলে
  • অন্তরে স্থায়ী প্রশান্তি তৈরি হয়
  • ঈমান বৃদ্ধি পায়, কাজে নিষ্ঠা ও একাগ্রতা তৈরি হয়
  • আমানত ও তাওয়াককুল প্রতিষ্ঠা পায়

রিয়া বা লৌকিকতা- Hypocrisy

ইতোমধ্যে রিয়া সম্পর্কে আমরা কিছু আলোচনা করে এসেছি। আরও একটি হাদীস প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। আল্লার রাসূল সা. বলেন-

إِنَّ الله لا يقبَلُ منَ العَملِ إلا ما كان خالِصًا له وما ابتُغِيَ به وجْهُه
’আল্লাহ তায়ালা কোনো আমল কবুল করেন না, যদি না সেটা হয় শুধুই তার জন্য এবং সে কাজে উদ্দেশ্য করা হয় কেবলই তার সন্তুষ্টি।’

সুতরাং একজন মুমনি হিসেবে যে কোনো কাজে সবসময় আল্রাহর সন্তুষ্টিই আমাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু এই রিয়া থেকে, যেটিকে নবীজী ছোট শিরকের সাথে তুলনা করেছেন- কীভাবে বাঁচা যেতে পারে?…কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা, যেমন-

সব কাজ আল্লাহর স্বরণে করতে সচেষ্ট হওয়া

أن تعبد الله كأنك تراه ، فإن لم تكن تراه ، فإنه يراك
’আল্লাহর ইবাদাত এভাবে করো যে তুমি তাকে দেখছো। যদি তুমি তাকে না দেখতে পাও. তাহলে অন্তত এটুকু মনে গেঁথে নাও যে তিনি তোমাকে দেখছেন।’ (মুসলিম শরীফ)

আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া

হাদীসে এসেছে-


أيها الناس اتقوا هذا الشرك فإنه أخفى من دبيب النمل فقال له من شاء الله أن يقول :وكيف نتقيه وهو أخفى من دبيب النمل يا رسول الله ؟ قال قولوا اللهم إنا نعوذ بك من أن نشرك بك شيئا نعلمه ونستغفرك لما لا نعلم

‘হে লোকসকল, তোমরা এই শিরক (রিয়া) থেকে বেঁচে থাকো। কারণ এটি পিপড়ার পদচিন্হ থেকেও সূক্ষ। কোনো একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন- হে আল্লাহর রাসূল, এমন সূক্ষ ও গোপনীয় শিরক থেকে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকবো? নবীজী জবাব দিলেন- তোমরা এই দুআ করবে যে, হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে পানাহ চাই এমন শিরক থেকে যা আমরা জানি। আর আপনার কাছে ক্ষমা চাই এমন শিরক থেকে যা আমরা জানি না।’ (আহমাদ ৪/৪০৩)

রিয়ার আহকাম জানা এবং পরকালীন পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া


أَنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ يَنْزِلُ إِلَى الْعِبَادِ لِيَقْضِيَ بَيْنَهُمْ وَكُلُّ أُمَّةٍ جَاثِيَةٌ فَأَوَّلُ مَنْ يَدْعُو بِهِ رَجُلٌ جَمَعَ الْقُرْآنَ وَرَجُلٌ يَقْتَتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَرَجُلٌ كَثِيرُ الْمَالِ فَيَقُولُ اللَّهُ لِلْقَارِئِ أَلَمْ أُعَلِّمْكَ مَا أَنْزَلْتُ عَلَى رَسُولِي قَالَ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَمَاذَا عَمِلْتَ فِيمَا عُلِّمْتَ قَالَ كُنْتُ أَقُومُ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ فَيَقُولُ اللَّهُ لَهُ كَذَبْتَ وَتَقُولُ لَهُ الْمَلائِكَةُ كَذَبْتَ وَيَقُولُ اللَّهُ بَلْ أَرَدْتَ أَنْ يُقَالَ إِنَّ فُلَانًا قَارِئٌ فَقَدْ قِيلَ ذَاكَ…رواه الترمذي ( 2382 )

‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা যখন বান্দাহর দিকে পা পাড়াবেন তাদের বিচার করার জন্য, সমস্ত মানবজাতি সেখানে উপস্থিত থাকবে আর তাদের মধ্য থেকে প্রথমে ডাকা হবে এমন (৩ জন) ব্যক্তিকে যে কুরআনের আলেম হয়েছে, যে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করেছে এবং সে ব্যক্তি যাকে প্রচুর সম্পদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আলেমকে বলবেন- আমি তোমাকে শিক্ষা দিইনি যা আমি আমার রাসূলের ওপর নাযিল করেছি? সে বলবে অবশ্যই, হে আমার প্রতিপালক। আল্লাহ পাক বলবেন- তুমি কী আমল করেছ যা আমি তামাকে শিখিয়েছি? সে বলবে আমি আপনার শেখানো ইলম অনুযায়ী আমলে রাত-দিন ব্যস্ত থেকেছি। আল্লাহ পাক তখন বলবেন- মিথ্যা বললে। ফেরেশতারাও তখন সাক্ষ্য দেবেন এই বলে য তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্রাহ পাক বলবেন- তুমি চেয়েছো তোমার আমলের কারণে মানুষ যেনো তোমাকে আলেম বলে এবং তা তো বলা হয়েছে।…(সুতরাং আজকে তোমার আমলনামায় আর কিছু অবশিষ্ট নেই। একই ব্যাপার হবে শহীদ ও সম্পদশালী লোকের ক্ষেত্রেও। সবাই বঞ্চিত হবে রিয়ার কারণে)।’ (তিরমিযি শরীফ, ২৩৮২)

এবং সবসময় গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ করা এবং জরুরত ছাড়া শো অফ না করা। কারণ বেশি দেখাবার মানসিকতা তারাই পোষণ করে যাদের কাজে খেয়ানতের ব্যাপা থাকে।

অভিমান, ঈর্ষা-হিংসা বা লোভ: জরুরি সতর্কতা- Dealing with Ego, Jealousy, and Greed

এই সময়ে আমাদের সবচে জটিল কয়েকটি সমস্যার একটি এই ইগো ও জেলাসি। লোভের ব্যাপারকে তো সহজে আলাদা করা যায় এবং স্পষ্টত বোঝাও যায়- সুতরাং তা ফেস করা এবং কাউকে তা থেকে বাঁচানো সহজ। মুশকিল হয় ইগো ও জেলাসির সাথে ডিল করাটা। অসম্ভব কি?

ক্রিয়েটিভ মানুষ মানেই ইমোশনাল, কারণ ক্রিয়েটিভ মানুষদের ইন্দ্রীয় শক্তি খুব পাওয়ারফুল হয়। লিডারশিপের গুণাবলিও তাদের মধ্যেই বেশি থাকে। আর একসাথে যখন কাছাকাছি যোগ্যতার অনেকগুলো মানুষ থাকেন, যারা একই সাথে ক্রিয়েটিভ এবং লিডার; ইগো ও জেলাসি সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক রোল প্লে করে। কারো সামান্য কথা, অচরণ এমনকি ইঙ্গিতেও আমাদের ভেতর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার খেলা শুরু হয়ে যায়। হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো- আমি এই আবেগ, ইগো বা জেলাসির কাছে হার মানবো কিনা?

ইগোর সহজ বাংলা করা যায় আমিত্ব বা নিজ কেন্দ্রিক ভাবনা। অন্যদিকে জেলাসিকে প্রথমত ঈর্ষা এবং পর্যায়ক্রমে হিংসার পর্যায়ে ফেলা যায়। এই সিমপ্লিফিকেশনের পর ব্যাপার বোঝা সহজ।

আমিত্ব, ঈর্ষা বা হিংসা কোনোটাই একজন ভালো, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বা আল্লাহর অনুগত বান্দার পছন্দনীয় কাজ হতে পারে না। হিংসা তো সরাসরি হারাম। আর আমিত্ব ও ঈর্ষা হলো হিংসার প্রাথমিক ধাপ, যেখান থেকে মুহূর্তের মধ্যে শয়তান আমাদেরকে হিংসার দিকে নিয়ে যায়।

ইগো ও জেলাসির ব্যাপারটা অফিসিয়াল কালচারের ক্ষেত্রে এভাবে বোঝা যেতে পারে যে, সহকর্মী কারো সাফল্য বা পদায়নে আমার মনে একরকম দ্যোতনা তৈরি হওয়া- কেনো সে? আমি কেনো নই বা ইস যদি আমি হতাম বা পেতাম! এইটুকুকে শরীয়ত বৈধতার সীমা দেয়। হিংসা হলো মনে মনে এমন কামনা যে সে এই যোগ্যতার অধিকারী না হোক বা তার থেকে এই মর্যাদা ছিনিয়ে নেয়া হোক- এটা হারাম। আর কেউ যখন সরাসরি আপত্তি, বিরোধিতা বা গোপনে-প্রকাশ্যে শত্রুতা শুরু করে; হারামেরও সীমা ছাড়িয়ে তা কোথায় পৌঁছে একমাত্র আল্লাহ মালুম। এমন একজন লোকই কোনো একটা অফিস বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করার জন্য যথেষ্ট। এমন লোকদের পরিণতি ভয়াবহ; দুনিয়াতেও, আখেরাতে তো অবশ্যই।

কুরআনে আল্রাহ তায়ালা বলছেন-

إِن تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِن تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُواْ بِهَا وَإِن تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ
لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئاً إِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ

‘যদি তোমরা কোনো কল্যাণের দেখা পাও, তাদের (অহংকারীদের) কষ্ট হয়। আর যদি তোমাদের কোনো কষ্ট বা বিপদ ঘটে, তারা প্রফুল্ল হয়। (হে মুমনিগণ) যদি তোমরা সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, তাদের ষড়যন্ত্র (হিংসা ও বদ দোয়া) তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ পাক তাদের কাজকে ঘিরে রাখেন (নিয়ন্ত্রণ করেন)।’ (আলে ইমরান)

হাদীসে নবীজী সতর্ক করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন-

انْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ، وَلَا تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ، فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لَا
تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ

‘তোমরা (দুনিয়াবি বিষয়ে) লক্ষ করো তোমাদের নিচের লোকদের। তোমাদের উপরে বা ভালো অবস্থানে থাকা লোকদের প্রতি তাকিয়ো না। এটা তোমাদের জন্য উত্তম ও সহায়ক হবে আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার ক্ষেত্রে।’


إِذَا كُنْتُمْ ثَلَاثَةً، فَلَا يَتَنَاجَى اثْنَانِ دُونَ الْآخَرِ، حَتَّى تَخْتَلِطُوا بِالنَّاسِ; مِنْ أَجْلِ أَنَّ
ذَلِكَ يُحْزِنُهُ

‘যদি তোমরা তিনজন একসাথে থাকো, তাহলে একজনকে বাদ দিয়ে কানে কানে কথা বলা শুরু করো না। এটা মানুষদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং কষ্টদায়ক হয়।’

لا تباغضوا ولا تحاسدوا ولا تدابروا وكونوا عباد الله إخوانا ولا يحل لمسلم أن يهجر أخاه فوق ثلاث

’তোমরা পরষ্পর রাগারাগি করো না। হিংসা করো না। কারো অনুসরণ করো না( দোষ খোঁজার জন্য)। কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে তিন দিনের বেশি কথা না বলা।’ (মুসলিম শরীফ)

হযরত আলী রা. বলেন- তিনটি জিনিষ মানুষকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। এক, অহংকার, যা ইবলিসের নৈকট্যের ফসল। দুই, লোভ, যা মানুষকে জান্নাত থেকে টেনে বের করে নেয়। এবং তিন, ঈর্ষা, যা মানুষকে হিংসা ও বরবাদির দিকে আহ্বান করে…

বিখ্যাত বুজুর্গ হাসান বসরী বলেন- দুটো জিনিস কখনো একত্র হতে পরে না- অল্পে তুষ্টি ও হিংসা। আর দুটো জিনিসকে কখনো পৃথক করা যায় না- হিংসা ও লোভ।

সুতরাং সহজেই বোঝা যায় ইমোশন, ইগো, জেলাসি বা হিংসা এসব শুধু ক্ষতিকর নয়, সরাসরি গুনাহের দিকে টেনে নিয়ে যায়। মানুষ হিসেবে মনে নানারকম ভাবনা উদয় ঘটবে বা শয়তান কুমন্ত্রণা দেবে এটা স্বাভাবিক। আমাদের উচিত সেসব নিয়ন্ত্রণ করা এবং এসন ভাবনা মনে ঢুকলে দ্রুত আউজুবিল্লাহ পড়তে থাকা এবং আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া। সাথে নিচের পয়েন্টগুলো স্বরণে রাখা যেতে পারে-

  • কারো সাথে তুলনায় না যাওয়া, বিশেষত উপরের পজিশনের কারো সাথে
  • কারো সাফল্যের ক্ষেত্রে তার পরিশ্রম ও কুরবানিগুলো বড় করে দেখা
  • আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরে বিশ্বাস করা
  • নিজের জানাশোনা ও অভিজ্ঞতা বাড়ানোয় মন দেয়া
  • নিজের যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকা
  • কারো প্রশংসায় ক্ষতি নেই, বরং লাভ- এটা মনে গেঁথে নেয়া
  • রাগ-ক্রোধ থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা
  • নিজের বাউণ্ডারি ও আওতায় থেকে দায়িত্ব পালন করা
  • নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া
  • টিম-মেটদের কাজ ও সাফল্যে খুশি হওয়া
  • নিজের সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করা
  • অল্পে তুষ্টির গুণ অর্জনে মনোযোগী হওয়া
  • অভিমান, ঈর্ষা, হিংসা ও লোভের ক্ষতি ও পরিণতি সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকা
  • সর্বোপরি সবসময় আল্লাহর আশ্রয় ও সাহায্য চাওয়া

দ্বন্দ্ব ও বিবাদ: বেঁচে থাকার উপায় ও প্রয়োজনীয়তা

অভিমান, ঈর্ষা ও হিংসার শুরুটা হয় আবেগের জায়গা থেকে, হৃদয়ে। কিন্তু এসবের প্রকাশ ঘটে কোনো না কোনোরকম দ্বন্দ্ব বা বিবাদের আকারে। কারো বাহ্যিক ত্রুটি বা অবহেলায় সৃষ্ট রাগ তো সহজে কমে যায় বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি বা শুরু হলে সহজে তা কমানো যায় না, যেহেতু দৃশ্যত নয় তাই অনেক সময় প্রয়োজনীয়ও মনে হয় না। কিন্তু এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। ছোট ছোট বিষয় মনে জমা হতে হতে একসময় এমন বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যে তখন সহজ সমাধান আর থাকে না।

অফিসিয়াল আবহে সাধারণত বাহ্যিক ভুল বা তেমন কারণে দ্বন্দ্ব কমই হয়, বা হলেও সহজে সমাধান হয়ে যায়। মুশকিল হয় পারসোনালিটি বা মানসিক লড়াইগুলোর ক্ষেত্রে। এবং ব্যাপার ঘুরেফিরে সেই একই- মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ বা ঈর্ষা-হিংসা ইত্যাদি।

আল্লাহ পাক এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে খুবই কঠিন কথা বলেছেন।

হাদীসে এসেছে-


لا يدخل الجنة من كان في قلبة ميثقال ذرة من كبر
যার অন্তরে সামান্য পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
أن الحسد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب
আগুন যেমন কাঠকে পোড়ায়, হিংসা তেমনই নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়।
لا يجتمع في جوف عبد الإيمان والحسد
একজন বান্দার পেটে একই সাথে ঈমাণ ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না।
لا يزال الناس بخير ما لم يتحاسدوا
মানুষ ততক্ষণই ভালো থাকে, যতোক্ষণ না তারা পরষ্পর হিংসা শুরু করে
شر الناس من يبغض الناس ويبغضونه
নিকৃষ্ট ব্যক্তি স যে মানুষদের অন্তরে রাগ তৈরি করে এবং যার প্রতি মানুষ রাগ করে

সুতরাং মান-অভিমান, রাগ-গোস্বা, হিংসা বা লোভ থেকে নিজেকে দূরে রাখা শুধু ব্যাক্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, পূর্ণ ঈমানদার হওয়া বা জান্নাতে যাওয়ার পূর্বশর্ত। উপেক্ষা করার কোনো উপায় কি আছে? অনেক সময় যেটা হয়, পরিবারে বা এলাকায় অনেকে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকলেও অফিসিয়াল আবহে বা প্রাতিষ্ঠানিক কালচারের বেলায় অবহেলা করে। এমন ভাবনার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, হুকুম সব জায়গায় সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।

আর এগুলো শুধু স্বতন্ত্র গোনাহ নয়, আরো অনেক গুনাহের দরজা খুলে দেয়। কারণ, এগুলোর কারণে ঐক্য ও ভ্রতৃত্ব নষ্ট হয়, যা বজায় রাখা ওয়াজিব। একই সাথে এগুলো পরষ্পরের হক এবং সহকর্মী ও প্রতিবেশীর হকও নষ্টের কারণ হয়। ব্যাপারগুলোকে খুব সহজ-স্বাভাবিক চোখে দেখা হলেও এগুলো খুবই জরুরি এবং গভীরতর।

হ্যাঁ, অনেক সময় হয় সহকর্মী বা পাশের কারো অবহেলা, দুর্বলতা বা দায়িত্বে অবহেলার কারণে মনে রাগ ও ক্ষোভ তৈরি হয়। অনেক সময় না চাইলেও মনে অপ্রয়োজনীয় ভাবনা বা ভুল আবেগ তৈরি হতে থাকে। এমন অবস্থায় দ্রুত সতর্ক হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া প্রয়োজন। অফিসিয়াল বিষয় অফিসিয়ালভাবে মেটানো যেতে পারে। তবে সবার আগে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিতে হবে। যাতে ভুল বা অনুচিত কোনো কথা বা আচরণ প্রকাশ না পেয়ে যায়।

কারণ, মিসজাজমেন্টের পরিণতি আরো ভয়াবহ। আল্লাহ পাক কেয়ামতের দিন সরাসরি মজলুমের পক্ষ নেবেন।

দ্বন্দ্ব বা বিবাদ এড়াতে বা মানসিক কনফ্লিক্টের খারাবি থেকে বাঁচতে আরো দুয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা যেতে পারে।

  • আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া
  • মনকে সবসময় ফ্রেশ ও পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করা
  • যার প্রতি বিরূপ ভাবনা বা ঈর্ষা তৈরি হয় তার সাথে কোমল আচরণ করা
  • সহকর্মীদের ভালো দিকগুলো ভাবা
  • বেশি বেশি ধারণা বা ভাবনা থেকে বেঁচে থাকা
  • হিংসার পরিণাম আর সদয় হওয়ার নেয়ামত স্বরণ করা
  • তাকওয়া ও সবর অবলম্বন করা
  • সব কাজে ও আচরণে ইখলাস অবলম্বন করা
  • সবাইকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা
  • বেশি বেশি সালাম দেয়া
  • নিজেকে সবসময় ছোট মনে করা, ভালো ও বেশি কাজ সত্ত্বেও

বেশি বেশি সদকা এবং সর্বোপরি দুআ অব্যাহত রাখা

মান-অভিমানের খেলা বা হিংসা ও ঈর্ষা এমন একটা চ্যাপ্টার বা মাঠ, একবার তা থেকে বেরুতে পারলে বা আউট অফ দ্য বক্স ব্যাপারগুলোকে উপলব্ধি করতে পারলে দ্বিতীয়বার আর কখনো সেদিকে নজর যাওয়ার বা বিভ্রান্ত হওয়ার চান্সই থাকে না। ফ্রেশ মনে থাকা ও বাঁচার তৃপ্তি ও নেয়ামত কাউকে বোঝানোর মতো নয়। সবই তখন শাশ্বত সুন্দর হয়ে যায়। মানুষের ব্যক্তিগত দিক নিয়ে আমি যতো কম ভাববো, ততোই ভালো। আল্লাহ পাক সবাইকে তাওফিক দিন।

নবীজীর হাদীস-


عَنِ ابنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنهُمَا، قَالَ : سَمِعتُ رَسُولَ اللهِ ﷺ، يَقُولُ: «كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتهِ : الإمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، والرَّجُلُ رَاعٍ في أهْلِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأةُ رَاعِيَةٌ في بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالخَادِمُ رَاعٍ في مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

’ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। দেশের শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জবাবদিহী করবে। পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, অতএব সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের দায়িত্বশীলা, কাজেই সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিতা হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। অতএব প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’
[বুখারি, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, আহমদ]

সহকর্মীদের সাথে আচরণ- Treatment of colleagues: Islamic Perspectives

পূর্ববর্তী আলোচনার প্রেক্ষিতে এই পার্ট তুলনামূলক ছোট ও সহজ। সহকর্মীদের প্রতি দু’রকম হক থাকে।

এক, ভ্রাতৃত্বের এবং দুই, প্রতিবেশীর।

সুতরাং ভাই এবং সহকর্মীর যে হকগুলো আমরা আদায় করি বা করতে সচেষ্ট হই এক্ষেত্রেও তাই প্রয়োজ্য হবে। তবে ব্যাপারটা আরেকটু গভীর কারণ, প্রতিবেশী বা ভাই সবসময় আমাদের সাথে থাকেন না বা তাদের হকগুলো জেনেরিক হয়। অন্যদিকে সহকর্মীরা সবসময় পাশে থাকেন, ব্যক্তিগত আরো নানান বিষয় এর মধ্যে জড়িয়ে যায়, সুতরাং সতর্কতাটাও কিছুটা বেশি অবলম্বন করাই উচিত।

কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখা যেতে পারে-

  1. সময় ও পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া
  2. সম্মিলিত কাজ ও দায়িত্বের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া
  3. আওয়াজ ও শব্দ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা
  4. কাজ, নেতৃত্ব ও মানসিকতায় সহমর্মিতা রাখা
  5. কানে কানে কথার মানসিকতা পরিহার করা
  6. অন্যের মতে প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া
  7. পুরো কথা পূর্ণ মনোযোগে শোনা
  8. সম্মতি নিয়ে কথা বলা
  9. কাজের বাইরের বিষয়ে কম কথা বলা
  10. ব্যক্তিগত সমালোচনা অবশ্যই পরিহার করা
  11. কাজের সমালোচনায় স্পেসিফিক হওয়া
  12. সদুপদেশ প্রদান ও সহযোগী হওয়া
  13. সদয় ও আমানত দার হওয়া

আল্লাহ পাক এবং রাসূলের কিছু নির্দেশনা ও উপদেশ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে-

فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنْ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا
তিনি তোমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের নেয়ামত দান করেছেন এবং তোমাদের রক্ষা করেছেন জাহান্নামের গহ্বর-মুখ থেকে।’ (আলে ইমরান)

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
‘মানুষ সম্পর্কে যখন বলো, ভালোটাই বলো।’ (বাক্বারাহ, ৮৩)

একবার কুরবানীর গোশত বন্টন করতে গিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরতা আয়েশাকে নির্দেশ দিলেন-

ابدؤى بجارنا اليهودى
’তুমি এই গোশত বন্টন শুরু করবে আমাদের প্রতিবেশী ইহুদিদের দিয়ে।’

مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ، وَأَبْغَضَ لِلَّهِ، وَأَعْطَى لِلَّهِ، وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإيمَانَ
’যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, রাগ করলে আল্লাহর জন্যই করে, আল্লাহর নামে দান করে, আল্লাহর হুকুম মেনে ফিরিয়ে দেয়; সে পরিপূর্ণ ঈমানদার।

المؤمن يألف ويؤلف ولا خير فيمن لا يألف ولا يؤلف
’মুমিন ভালোবাসে এবং ভালোবাসার পাত্র হয়। যে ভালোবাসে না এবং ভালোবাসর উপযোগীও হয় না তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই।’

أنا الرحمن وهذه الرحم شققتُ لها اسماً من اسمي فمَن وصلها وصلتُه ومَن قطعها بتتُّه
আমি দয়ালু, আর এটা আমার নামের একটা অংশ। যে তা (দয়া) রক্ষা করে, আমিও তারটা রক্ষা করবো। আর যে তা ছিন্ন করে আমিও তারটা ছিন্ন করবো। ( তিরমিযী, হাদীসে কুদসী)

مَن سرَّه أن يُنسأ له في أثره ويوسّع عليه في رزقه فليصِل رحِمه
যে ব্যক্তি চায় তার হায়াত দীর্ঘ হোক এবং তার আয়-উপার্জন বৃদ্ধি পাক যে যেনো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে। (বুখারী)

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنْ الْمُنكَرِ
মুমিনরা পরষ্পর বন্ধু ও কল্যাণকামী। পরষ্পরকে তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবয় মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সুরা তাওবা, ৭১)

الدِّينُ النَّصِيحَةُ قُلْنَا: لِمَنْ؟ قَالَ: لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلائِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ
দীন হলো উপদেশ ও কল্যাণকামিতার নাম। আমরা জিজ্ঞেস করলাম- কার জন্য হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন- আল্রাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, নেতৃস্থানীয় ও সাধারণ সব মুসলিমের জন্য।’

وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
’যদি তাদের সাথে বিবাদে জড়াতে হয়, জড়াও এমন পন্থায় যা সর্বোত্তম।’ (সুরা নাহল)

প্রতিবেশী ও মুসলিমদের পরষ্পরের কয়েকটি হক

হাদীসে এসেছে-

أن تسلِّم عليه إذا لقيتَهم ، وتجيبهم إذا دعوْك ، وتشمتهم إذا عطسوا ، وتعودهم إذا مرضوا ، وتنصح له إذا استنصحوك ، تحفظهم بظهر الغيب إذا غابوا عنك ، وتحب له ما تحب لنفسك وتكره له ما تكره لنفسك
’দেখা হলে সালাম দেয়া। ডাকলে সাড়া দেয়া। হাঁচির জবাব দেয়া। অসুস্থ হলে সেবা করা। পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দেয়া। অনুপস্থিত থাকলে তার আমানতের হেফাজত করা। নিজের জন্য যা পছন্দ তার জন্রও তােই পছন্দ করা এবং নিজের যা অপছন্দ তার জন্যও তাই অপছন্দ করা।’

কুরআনে এসেছে-

مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاّ لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
কেউ যখন কোনো কথা বলে অবশ্যই সেখানে একজন সতর্ক প্রহরী থাকেন।’ (সুরা কাফ)

أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللَّهِ أَنْفَعَهُمْ لِلنَّاسِ، وَأَحَبُّ الأعْمَالِ إِلَى اللَّهِ سُرُورٍ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ، أَوْ تَكْشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً، أَوْ تَقْضِي عَنْهُ دِينًا، أَوْ تُطْرَدُ عَنْهُ جُوعًا

’আল্লাহর কাছে সবচে প্রিয় ব্যক্তি সে যে মানুষের উপকারী। আর আল্লাহর সবচে প্রিয় কাজ হলো অন্য একজন মুসলিমকে খুশি করা বা তার কোনো কষ্ট দূর করা। তার পক্ষ থেকে করজ বা পাওনা আদায় করে দেয় বা কারো ক্ষুধা মেটানোর ব্যবস্থা করে।’

কুরআন-হাদীসের এই নির্দেশনাগুলো একই সাথে প্রতিবেশী, মুসলিম ভাই ও সহকর্মীদের হক, তাদের সাথে আচরণ ও চলাফেরার গুরুত্ব, ব্যাপকতা, লাভ ও পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। আমরা যা করি, কিছুই আসলে দীনের বাইরে নয়, আল্লাহর হুকুমের আওতা বহির্ভূত নয়। সুতরাং নিজের কাজের প্রতি যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি অন্যদের হক ও ভালো-মন্দের বিষয়েও আমাদের সজাগ থাকা জরুরি।

ব্যবসা বনাম মানুষের সেবা- Business and Entrepreneurship: Considering Khidmatul Khalq (خدمة الخلق)

এই সমাজে মুশকিল কিছু বিষয়ের একটি হলো হকদারকে প্রাপ্য সম্মান না দেয়া বা তার অধিকার স্বীকার না করা। ফলে সবাই নিজ গরজে নিজের কথা বলতে চায় এবং নিজের অধিকার ফলাতে যায়, কিন্তু রেজাল্ট হয় উল্টো। সমাজ তাকে জালেম ও খ্যাতিপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং মানবাধিকারবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। মালিকানা ও সম্পদশালী হওয়ার ক্ষেত্রে এখনকার সাধারণ বাস্তবতা এটাই যে তারা জালেম ও অন্যের শ্রম-ঘাম চুষে খাওয়া ব্যক্তি। অনেক প্রতিষ্ঠান বা মালিক পক্ষ যথাযথ হক আদায়ের পরও এমন জুলুমের শিকার হন বা মজলুম থেকে যান।

এই ব্যাপারটা শুধু বাইরে ঘটে এমন না, সবাই যখন মালিক পক্ষ বা ব্যবসায়ের কর্ণধারদের কম-বেশ অধিকারহরণকারী হিসেবে ট্রিট করতে শুরু করে, এর পএকটা প্রভাব কর্মীদের ওপরও পড়ে। তারাও অনেক ক্ষেত্রে অযথাই মালিকপক্ষ বা পরিচালকদের বেশি সুবিধাভোগী এবং নিজেদের বঞ্চিত ভাবতে শুরু করে। ফলে কাজে অমনোযোগিতা, খেয়ানত, ঘনঘন কাজ বদল এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ক্ষতি করার মতো ভয়াবহ ব্যাপারকেও তারা স্বাভাবিকভাবে বা নিজেদের একরকম অধিকার হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে।

এই পুরো প্রক্রিয়ার আড়ালে চাপা পড়ে মালিক পক্ষ বা ব্যবসায়ের পরিচালকদের যাবতীয় পরিশ্রম, কুরবানি, দৃশ্যমান-অদৃশ্য রিস্ক ও প্রতিকূলতা, তাদের উপকার ও দয়াদ্র মনোভাব এবং আর সব অবদান। সতর্কতা হিসেবে অনেক সময় না চাইলেও মালিকপক্ষকে নানান কঠোর নিয়ম ও সিস্টেম অনুসরণ করতে হয়। ফলে সহজ অনেক বিষয়ও দু পক্ষের টানাটানিতে জটিল হয়ে দাঁড়ায় এবং খর্ব হয় দু পক্ষেরই অধিকার ।

ইসলাম সবসময় ইনসাফের কথা বলে। কেই যখন কারো কোনো উপকার বিষেশত জীবিকার ক্ষেত্র তৈরি করে দেন ইসলাম এটাকে সাব্যস্ত করে খিদমাতুল খালক বা মানবসেবা হিসেবে। তাদের এই অবদান সদকা হিসেবেও পরিগণিত হতে পারে। তাই উচিত হলো- নিজেদের কাজ ও দায়িত্বে দু পক্ষেরই যত্নবান হওয়া, নিজেদের হক ও অধিকার নির্ধারণ করে নেয়া এবং সেভাবেই সবকিছু পরিচালনা করা। বোঝাপড়ার এই সমন্বয় তাদের মধ্যে যে বন্ধন তৈরি করবে সহজেই কেউ তা ভাঙতে পারবে না। কিছু মন্দ লোক তাই চাইলেও সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকবে না।

কুরআনে রিযিক তালাশের নির্দেশ

فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
’যখন নামাজ শেষ হয়ে যায়, তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাও এবং আল্লাহর রিযিক তালাশ করো। আল্লাহকে বেশি বেশি স্বরণ করো যাতে সফলকাম হতে পারো। (সুরা জুমআ, ১০)

হলাল উপার্জনেরেউপকারিতা

إن الله يحب أن يرى عبده تعبا في طلب الحلال
নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে হালাল রিযিকের তালাশে ব্যস্ত দেখতে ভালোবাসেন

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব
طلب الحلال فريضة بعد الفريضة

হালাল রিযিক তালাশ করা ফরজ ইবাদতের পর আরো একটি ফরজ

العافية عشرة أجزاء، تسعة في طلب المعيشة، وجزء في سائر الأشياء
ক্ষমার মোট নয়টি অংশ। এর তিনটিই হলো হালাল জীবিকা অন্বেষণে আর একটি অংশ বাকি সবকিছুতে

أيما رجل كسب مالا حلالا فأطعم نفسه أو كساها، فمن دونه من خلق الله فإنها له زكاة، وأيما رجل مسلم لم يكن له صدقة
কোনো ব্যক্তি যখন হালাল উপার্জন করে সে নিজে যেনো তা খায় বা পরিধান করে। আর নিজকে ছাড়া যদি সে কাউতে তা খাওয়ায় বা পরায় তা হবে সাদাকাহ

التاجر الصدوق تحت ظل العرش يوم القيامة
সত্যবাদী ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় থাকবেন

إذا فتح الله لأحدكم رزقا من باب فليلزمه
তোমাদের কারো জন্য যখন উপার্জনের কোনো পথ খুলে যায় তা আঁকড়ে ধরো

يا معشر التجار إياكم والكذب
হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, মিথ্যা থেকে দূরে থাকো

واللهُ في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه
আল্লাহ পাক ততক্ষণ বান্দার সহযোগিতায় থাকেন যতোক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের (সহকর্মী) সহযোগীতায় থাকে

إنّ لله عباداً في الأرض يسعون في حوائج الناس، هم الآمنون يوم القيامة
নিশ্চয় দুনিয়ায় আল্লাহর কিছু বান্দা আছেন যারা মানুষের প্রয়োজনে সহযোগিতা করে, কেয়ামতের দিন তারা আল্লাহর নিরাপত্তা পাবে।

من سعى في حاجة أخيه المسلم طلب وجه الله، كتب الله عزّ وجلّ له ألف ألف حسنة
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যখন কোনো মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সহযোগিতা করে আল্লাহ পাক তার জন্য হাজার হাজার নেকি লেখেন।

من مشى في عون أخيه ومنفعته، فله ثواب المجاهدين في سبيل الله
যে তার ভাইয়ের সাহায্য ও উপকারের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়, তার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সওয়াব লেখা হয়।

উপরিউক্ত হাদীস ও আয়াতসমূহ থেকে পরিষ্কার যে, ব্যবসা ও হালাল রিযিকের তালাশ করা ইবাদাহ। এবং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একজন আরেকজনের ওপর যেহেতু নির্ভরশীল তাই দু পক্ষেরই পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকা কর্তব্য। যারা মালিক বা পরিচালক হন তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ থাকে এবং তাদের অবদান ও সহযোগিতা তাদের জন্যই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের কারণ হবে।

অপরদিকে যারা কর্মী ও সহযোগী হবে তাদেরও শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার মানসিকতা রাখতে হবে। কারণ, সবার মুখ্য উদ্দেশ্য হালাল রিযিকের সন্ধান এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত ও সন্তুষ্টি অর্জন। সুতরাং একে অন্যের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পোষণ করা জরুরি। আমানত, অধিকার ও দায়ত্বশীল হওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলাম তাই সবক্ষেত্রে ইনসাফের কথা বলে, যার যার জায়গা থেকে সবাই যেনো ঠিক ঠিক অধিকার পায়। বান্দাহ যখন আল্লাহর হয়ে যায় বাকি সবকিছুই তার পক্ষের হয়ে যায়। সবক্ষেত্রে তাই আল্লাহর চাওয়া ও নির্দেশনা অনুসরণ করার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ পাক আমাদেরকে জানার, বোঝার এবং মানার তাওফিক দিন। আমিন।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *