আমার চারপাশের পৃথিবী পুরোই বদলে গেছে – লাইলা রাফিন

Sakil books

Date

Author

Blog Duration

14 minutes

আঁধার থেকে আলোর পথে

সত্যিই বুঝতে পারছি না কীভাবে শুরু করবো। আমার মাতৃভাষা ফ্রেঞ্চ তাছাড়া ইংলিশে লিখে আমি অভ্যস্ত নই। তবে এটা তো বাস্তব- ভাষা হিসেবে ইংলিশই এ মুহূর্তে সবার কাছে পৌঁছতে পারার সেরা উপায়। সুতরাং কিছু কষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গেই থাকুন। আশা করি- আঁধার থেকে আলোর পথে যাত্রায় আমার লড়াই, আপাত সৌম্য-সুন্দর এই সমাজ আর তার প্রকৃত বাস্তবতা আপনার ভেতরটাকেও নাড়িয়ে দেবে।

আমার-আপনার ভাবনার একটু পরিবর্তন যদি অন্যদের উপকারে আসে তবে সেটাই তো আদর্শ ব্যাপার হবে।

চলুন তবে সামনে এগোই।

Where I Come from

আমার জন্ম ফ্রান্সে। রাজধানী প্যারিসের পাশেই এক শহরতলীতে। মোটামুটি মধ্যবিত্ত এক পরিবারে জন্ম আমার। প্রাথমিক পড়াশোনাটা দাদা-দাদির কাছেই হয়েছে। প্রভুকে ধন্যবাদ, তিনি জীবনে সাফল্য পাবার মতো সব উপকরণই আমাকে দিয়েছেন। ১৭ বছর পর্যন্ত আমার জীবনটা বেশ নরমাল-স্বাভাবিকভাবেই কেটেছে।

আঁধার-থেকে-আলোর-পথে- French muslims
French Muslims

বই-পত্রে তো ‘নরমাল জীবন’ ব্যাপারটা শত-সহ¯্রবার পড়েছি, এখানে এই নরমালের প্রকৃত অর্থটা আসলে কি! এ সময়টাতে আমি পড়াশোনা এবং অশ্বারোহন নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। এই অশ্বারোহন বা ঘোড়দৌড় ঘিরেই সাজানো ছিলো আমার কৈশোরের প্রিয় জগৎ। খারাপ শোনালেও বলি- জীবন সম্পর্কে আমি মানুষের চেয়েও বেশি শিখেছি এসব নির্বাক প্রাণীর কাছ থেকে।

আমার দাদা-দাদি আমাকে ভালো শিক্ষাই দিয়েছেন। তাদের চিন্তাটাও ছিলো অন্য দশজন থেকে আলাদা। আমার পক্ষে সবচে উপকারী ছিলো সাধারণ স্কুলে না পাঠিয়ে আমাকে ধর্মীয় স্কুলে ভর্তি করা। সেটা ছিলো একটা ক্যাথলিক হাইস্কুল। তারা যদিও নিখাঁদ ধার্মিক ছিলেন না। অর্থাৎ প্রতি রবিবারই তারা চার্চে হাজির থাকতেন না, তবে ব্যাপারটা ধর্মের চেয়েও বেশি ছিলো ঐতিহ্যগত। আমার মা এবং আঙ্কেল ক্যাথলিক স্কুলের সাথে জড়িত ছিলেন, তাই আমাকেও সেখানটাতে যেতে হয়েছে। তারা অবশ্য আমাকে বাধ্য করেন নি, আমিই যেতে আগ্রহী ছিলাম।

আমার জন্য কাজটা কঠিনও ছিলো না, কারণ আমি জন্মেছিই ক্যাথলিক হিসেবে। বেড়ে উঠেছি ক্যাথলিক সংস্কৃতিতে। অন্য অনেক মানুষের মতো, নিজেকে আমি আমার ধর্ম সম্পর্কে খুব বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি করিনি।

বেশিরভাগ মানুষই নিজস্ব সংস্কৃতি থেকেই কোনো একটা ধর্মকে নিজের ধর্ম বলে গ্রহণ করে নেয়।

তারা খৃষ্টান হয় কারণ তারা খৃষ্টান সংস্কৃতি বা পারিবারিক আবহে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা ইহুদি হয় কারণ তারা ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা মুসলিম হয় কারণ তারা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। খুব কম মানুষই নিজেকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে- কেনো সে খৃষ্টান বা ইহুদি বা মুসলিম?

আর খুব কম হলেও যারা নিজেকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি করে তারাও গভীর ভাবনা বা গবেষণার পথে হাঁটে না। বরং চিন্তা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়েই তারা নিজ নিজ সংস্কৃতি বা ধর্মের কাছে ফিরে আসে। কারণ শৈশব থেকেই পরিচিত হওয়া পরিবেশ ও ঐতিহ্যকে পাশ কাটানো, এতোদিনের চেনা-জানা মানুষদের হঠাৎ দূরে ঠেলে দেয়ার সাহস সাধারণত তাদের হয়ে ওঠে না। ব্যাপারটা শুধু ধর্মের বেলায়ই তো নয়, বিজ্ঞান-শিক্ষা-সংঘ সব ব্যাপরেই সত্য এবং দৃশ্যত স্বাভাবিক।

আঁধার-থেকে-আলোর-পথে

আমার বয়স যখন আঠার, আমার দাদা মারা গেলেন। তার বয়ষ হয়েছিলো প্রায় ৬৮ বছর। ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটেছিলো এবং আমার জন্য সেটা মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর ছিলো। কারণ তাকে আমি বাবার মতোই জানতাম। তিনিই আমাকে বড় করেছিলেন। আমার দাদা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন তবে কখনো চার্চে যেতেন না। আমাদের বাসার সবচে কাছের চার্চের পরিচালকও তাকে মোটেই জানতেন না।

চার্চে তার মৃত্যুতে ধর্মীয় আচার পালনের সময় লাশকে ঘিরে অতিরিক্ত কপটতা আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিলো না। আমার কাছে সেসবকে খুবই বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিলো এবং এরপর থেকেই আমি জীবন থেকে ধর্মকে বর্জন করা শুরু করলাম। এবং বেশ অল্প সময়ই আমি পুরোপুরি ধর্মহীন এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হলাম।

ব্যাপার এতোটাই জটিল হয়ে উঠেছিলো যে আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়লাম। সব ধর্মকেই সেসময় আমি সম্মান করেছি কিন্তু কোনোটাকেই নিজের জন্য কামনা করি নি।

আমি তখন ভাবতাম কোনো মানুষ যদি নিজের জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তবে সেটা এজন্য যে নিজের প্রতি তার পুরো আস্থা নেই। নিজের প্রতি আস্থা রাখাটাই আমার কাছে পর্যাপ্ত মনে হতো, ধর্মের যেখানে কোনো প্রয়োজনই নেই। মৃত্যুর অবশ্যম্ভবি বাস্তবতা মানুষের মনে যে আতংক তৈরি করে, আমার মতে ধর্ম ছিলো সে আতংক তাড়াবার একটা উপায় মাত্র।

এমন অনেক কিছুই আমি তখন ভেবেছি যা এখন আমি ধর্মহীনভাবে মারা যাওয়া লোকেদের মধ্যে খুঁজে পাই। আমার মনে সারাক্ষণ তখন জবাবহীন কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো। আমরা কেনো আছি পৃথিবীতে? মৃত্যুর পরে কি সত্যিই কিছু আছে? এই বিপুলা পৃথিবীতে আমরা আসলে কি? মহাবিশ্বে আমরা তো অতি ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বহীন একপ্রকার জীব মাত্র…ধর্ম ছাড়া, আর কেউ কি আছে যে এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারে?

What Makes Me Search

আমার বয়স যখন ২২, পড়াশোনার জন্য আমি কানাডাকে পছন্দ করলাম। এক বছরের জন্য মনট্রীলে গেলাম যেখানে আমি বহু মানুষের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছি। জীবনে এই প্রথম আমি বাইরের কোনো দেশে বসবাস করতে গেলাম। এবং প্রথমবারের মতো আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম- ফ্রান্সের লোকেরা কেমন গভীর ধরনের জাতীয়তাবাদী, দেশ ও সংস্কৃতি নিয়ে কেমন গর্ব তারা অনুভব করে এবং কেনো তারা সব বিষয়ে অনমনীয়।

আঁধার-থেকে-আলোর-পথে

ভাবলাম- ফ্রান্সের নাগরিকদের দেখা উচিত অন্যান্য রাষ্ট্রে কী আছে- যাতে তারা আরো অনমনীয় হতে পারে, সবকিছু নিয়ে আরো খোলামেলা হতে পারে এবং নিজেদের রাষ্ট্রে যা আছে সেসব নিয়ে তাদের আরো যতœবান হওয়া উচিত। এটা শুধুমাত্র একটা উপলব্ধি- ধর্মের সাথে আদতে যার কোনো সম্পর্কই নেই। তবে অবান্তর হলেও আমার কাছে ব্যাপারটার গুরুত্ব অনেক।

যেহেতু আমি ফ্রেঞ্চ, মানুষ ভাবে আমি খোলামনের নই- বরং আমার অনেকরকম অবিবেচনামূলক সংস্কার আছে, বিশেষ করে ইসলামের ব্যাপারে, যেমনটা বেশিরভাগ অমুসলিমের থাকে।

আমি সবসময়ই এসব সংস্কার থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার প্রচেষ্টা করে এসেছি। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু সংস্কার থাকে, এমনকি সে না চাইলেও। এগুলো আমাদের সংস্কৃতি থেকেই অটোমেটিক্যালি চলে আসে বা চারপাশের ঘটনা অজান্তেই আমাদের মনে এসব সংস্কার ঢুকিয়ে দেয়। মিডিয়াও এক্ষেত্রে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমাদের উচিত সতর্কভাবে এসব সংস্কার থেকে বেঁচে থাকা, কেবল তাহলেই যে কোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে

আমি মনে করি বেশিরভাগ মানুষই এসব সংস্কার থেকে নিজেদেও মুক্ত রাখতে পারে না। ব্যাপরটা নিয়ে আরো কথা বলা যায় কিন্তু এখানে সেটা আমার বিষয় নয়। যদিও এটা খুবই আকর্ষণীয়, গুরুত্বপূর্ণও। এই যেমন আমিই যদি নিজের ভেতর এসব চিন্তাকে ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে না দিতাম তাহলে ইসলাম সম্পর্কে হয়তো কখনো আমার জানাই হতো না।

কারণ ফ্রান্সসহ অমুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের গড়ে তোলা ভাবমূর্তিটা খুবই বাজে ধরনের।

মিডিয়া বিশেষত টেলিভিশন আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক বা অন্যান্য রাষ্ট্রে তথাকথিত মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার খবর-চিত্র দেখিয়ে দেখিয়ে মানুষের মনে এসব ইমেজ গড়ে দেয়। যখন কোনো অমুসলিম ব্যক্তি এসব খবর পড়ে বা শুনে তখন এসবকে তারা ইসলামেরই সমার্থক হিসেবে ভেবে নেয়। তাদের কাছে ইসলামের অর্থই হয়ে যায় সংঘাত।

সত্য জানার ব্যাপারে এসব লাখো মানুষের কৌতূহল এবং ইচ্ছের অভাবকে আমরা তো কেবল দোষারুপই করতে পারি, তাতে কি লাভ কিছু হবে? আমাদের বরং তিরষ্কার করতে হবে মিডিয়ার উদ্দেশ্যপূর্ণ অপপ্রচার এবং সেসব মানুষদের যারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে নারী-শিশু এবং নিরপরাধ মানুষদের খুন করে বেড়ায়। এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

আঁধার থেকে আলোর পথে

এখন প্রশ্ন হলো- কী বা কে আমাকে ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুললো? খারাপ শোনালেও সত্য হলো- ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যেসব মুসলিমের সাথে আমার দেখা হয়েছে তারা নয় বরং যারা আমাকে ইসলমের বিষয়ে মন্দ ধারণা দিয়েছে তারাই আসলে আমার ভেতর আগ্রহটা তৈরি করে দেয়।বিশেষত মিডিয়া।

মনট্রীলে আমার বেশিরভাগ বন্ধু ছিলো আরবের বা আরব বংশোদ্ভূত এবং খৃষ্টান। একসাথে আমরা ছবি দেখতে বা রেষ্টুরেন্টে খেতে যেতাম, কখনো নাচতেও। সবই ছিলো ঈশ্বর এবং প্রকৃত ইসলাম থেকে শত ক্রোশ দূরের বিষয়। আমার বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলো তিউনিশিয়ান। অন্যদের থেকে খুব বেশি ধার্মিক নয় তবে সে ছিলো মুসলিম।

ইসলামের বিবেচনায় তার আচরণ যদিও সেরা মানের ছিলো না, তবে সে আমার সাথে আলাপ করেছে ইসলাম, আল্লাহ এবং নবীজী সা. সম্পর্কে।

ভালো মানের মুসলিম সে ছিলো না তবে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং নবীজীর সা. প্রতি তার পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো। ইসলাম সম্পর্কে খুব বেশি না বললেও সে আমাকে ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিলো। যেহেতু আমি অমুসলিম দেশের একজন নাগরিক, ইতোপূর্বে কখনো খুব বেশি মুসলিমের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি, তাই ইসলাম সম্পর্কে আমার জানাশোনাটা ছিলো কেবলই মিডিয়ানির্ভর।

যখন আমি নিজে নিজে ইসলাম সম্পর্কে খোঁজ নেয়া শুরু করলাম, আমি প্রথমেই দেখতে চাইলাম নারী বিষয়ে ইসলামের অবস্থানটা কী। কারণ এ বিষয়টা নিয়েই মিডিয়াতে বেশি সমালোচনা হতে দেখতাম এবং একজন নারী হিসেবেও এই প্রশ্নটাই আমাকে বেশি উদ্বিগ্ন করে রেখেছিলো। আমি জানতে চেষ্টা করলাম নারী বিষয়ে ইসলামের যে ভাবমূর্তি মিডিয়ায় আসে তা সত্য কিনা।

সেই ভাবমূর্তিটা ছিলো খুবই বাজে রকমের- যেখানে নারীকে সবক্ষেত্রে পুরুষের অধীনস্থ বলা হয়েছে, যেখানে নারীর কোনো অধিকার নেই, যেখানে নারী বোরকা পরায় বাধ্য এবং এমন অনেক কিছু। আশপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করে বিব্রত হওয়ার জড়ানোর রিস্ক নেয়ার চেয়ে আমি নিজেই পাঠ চালিয়ে যাবার এবং নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এতে লেখক দ্বারা হয়তো প্রভাবিত হবার আশংকা থাকে তবে সরাসরি আলাপ করার মতো নয়। কারণ, পড়ে- চিন্তা করার মতো পর্যাপ্ত সময় আপনি পাবেন। ইচ্ছেমতো সময় ও ব্যাপ্তি নিয়ে ভাবতে পারবেন। সরাসরি কথা বললে যেটার সুযোগ মেওে না। আমার পাঠের বেশিরভাগ সূত্রই আমি নেটে পেয়েছি এবং প্রভুকে ধন্যবাদ, সবক্ষেত্রে প্রকৃত সূত্রই আমি খুঁজে পেয়েছি। শুরুতে, আমি শুধু নারী বিষয়ে ইসলামের অবস্থান জানতে চেয়েছিলাম। সুতরাং এ বিষয়ে যা পাওয়া সম্ভব সবই আমি পড়তে শুরু করলাম।

যখন আমি জানলাম- ইসলামে প্রবেশ করতে থাকা এখনকার বেশিরভাগ সদস্যই নারী সম্প্রদায়ের, আমি এটাও জানতে শুরু করলাম কেনো, কেনো তারা ইসলামে প্রবেশ করছে? মিডিয়ার নেগেটিভ প্রচারণা সত্ত্বেও নারীরাই কেনো বেশি করে ইসলাম গ্রহণ করছে?

এরপর আমি শুধু ইসলামে নারীর অবস্থান জানার সাথে সাথে একেশ্বরবাদী তিনটি ধর্মেরই (ইহুদি, খৃষ্টান ও ইসলাম) অবস্থান জানতে শুরু করলাম। এক্ষেত্রে বর্তমানের ধর্মপালনের ধারণাকে আমি গুরুত্ব দিই নি, বরং ধর্মীয় গ্রন্থে কী আছে সেটাই বেশি দেখছিলাম। আমি চমৎকার কিছু প্রবন্ধ পেলাম যেগুলাতে তুলনামূলকভাবে তিনটি ধর্মেরই নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এসব পড়তে গিয়ে আমি আমার একসময়ের নিজের খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কেও প্রকৃত ধারণা পেলাম। আর এ সময়টাতেই আমি আবিষ্কার করলাম- ইসলামই খৃষ্টান বা ইহুদি ধর্ম থেকে বেশিরকম অধিকার ও স্বাধীনতা নারীদের দিয়েছে। ইসলাম নারীদের এমন কিছু অধিকার দিয়ে রেখেছে যেগুলো ফ্রান্সের নারীরা বিগত মাত্র ৫০ বছর আগে থেকে পেতে শুরু করেছে। আমি ফ্রেঞ্চ নারী বলে ফ্রান্সের কথা বললাম, প্রকৃত অর্থে সারা বিশ্বের নারীরাই বিগত কয়েক যুগ থেকে এসব অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেয়েছে।

বেশিরভাগ ইউরোপিয়ানের কাছে এটা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার হবে যদি তারা জানতে পারে- ইসলাম সম্পর্কে মিডিয়ার মাধ্যমে তারা যা শোনে, প্রকৃত অর্থে সেসব কতোটা ভ্রান্ত ও অপূর্ণ। সে মুহূর্ত থেকেই আমি আর পরোয়া করলাম না চারপাশের কে কী ভাবছে। বরং দিনের পর দিন ইসলাম সম্পর্কে আমার আগ্রহ বাড়তেই থাকলো।

আঁধার-থেকে-আলোর-পথে- Islam
Islam

আমি আমার পড়াশোনা চালিয়েই যেতে থাকলাম। কারণ যতো পড়ছিলাম কিছু কিছু ব্যাপার এমন দাঁড়াচ্ছিলো যেগুলো ঠিকভাবে বুঝতে পারছিলাম না। কিছু বিষয় এমন ছিলো যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অযৌক্তিক বা খাপছাড়া মনে হতো। তাই পড়াটা চালিয়েই যেতে হচ্ছিলো এবং সে বিষয়গুলোর প্রকৃত ব্যাখ্যা এবং জবাব আমি পেতে থাকলাম যখন সামগ্রিক ইসলামটা আমার সামনে স্পষ্ট হতে থাকলো।

ইসলামকে বুঝতে হলে, আপনাকে পুরো ইসলামকে সামনে আনতে হবে। কেবল বিশেষ কিছু দিক বা পছন্দের কিছু বিষয় সামনে অনলে হবে না।

কারণ ইসলাম এমন সামগ্রিক একটা ধর্ম যেখানে আমি সবকিছুকেই যৌক্তিক পেয়েছি। আমি বহু চেষ্টা করলাম অযৌক্তিক বা যুগের সাথে বেমানান কিছু পাওয়া যায় কিনা, পেলাম না। ইসলামে সবকিছুরই সুন্দর এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে, খৃষ্ট ধর্মের মতো অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্ন না করে কেবল বিশ্বাস করার কথা এখানে বলা হয় না।

আমি কখনোই মুসলিমদের দিকে বা তাদের আচরণের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি নি বরং পাঠের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যটা বের কলার চেষ্টা করেছি। একাকী, কারো দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হওয়া ছাড়াই। আর এসব খোঁজ বা গবেষণাও সামান্য সময়ের ব্যবধানে হয়ে গেলো। মাত্র তিন সপ্তাহে। এই সময়টাতে ইসলাম আমার জন্য একপ্রকার চুম্বক হয়ে উঠেছিলো এবং শেষ পর্যন্ত যা ঘোরের পর্যায়ে উপনীত হয়।

সারা দিন-রাত আমি কেবল ইসলাম নিয়েই ভাবতাম। একসময় অনুভব করলাম আমার এই ঘোর কাটতে পারে কেবল ইসলাম গ্রহণের মধ্যদিয়েই। বেশ কিছু রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি- ইসলাম নিয়ে ভেবে। ধর্ম পরিবর্তনের তাৎপর্য নিয়ে ভেবে। আমি ভাবলাম সকল ধরনের বাধা সম্পর্কে, বিশেষত রক্ষণশীল ফ্রেঞ্চ সোসাইটিতে যেগুলোর মুখোমুখি আমাকে হতে হবে। কিন্তু সেসব আর আমার কাছে তেমন কোনো ব্যাপার মনে হলো না, ইসলামই আমার সামনে হাজির হলো তার সকল গুরুত্ব নিয়ে। আমি তখনই ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম।

যখন ইসলাম গ্রহণ করলাম, পড়াশোনার কাজে তখনও আমি কানাডায়। কানাডায় আমি কোনো সমসার মুখোমুখি হই নি কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মতো কানাডার মানুষও কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তেমন ভাবে না। তাছাড়া খুব বেশি মানুষ সেখানে আমাকে জানতো না। সমস্যা শুরু হলো যখন আমি ফ্রান্সে ফিরে এলাম।

ফ্রান্সে ফিরেই আমাকে মুখোমুখি হতে হলো আমার পরিবারের, যারা অমুসলিম পরিবেশে থেকে মুসলিম বিশেষত আরবের মানুষ এবং তাদের জীবনধারাকে সহ্যই করতে পারতো না। যদিও আমি প্যারিসেই বসবাস করেছি, তবু প্যারিসে আমার কোনো মুসলিম বন্ধু ছিলো না। আমার মাথা ঢাকার আগেই আমি বহুরকম সমস্যার মুখোমুখি হতে শুরু করলাম। কারণ আমার চারপাশের মানুষজন কল্পনাই করতে পারেন নি কখানো আমি মুসলিম হয়ে যেতে পারি।

ফ্রান্সের সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষ সাক্ষাতের সময় শুধু হাত মেলায় না, বরং পরস্পরের গালে আলতো চুমু দেয়। সুতরাং আমি যখন চুমুর বদলে হ্যালো বলতাম বা হাত বাড়িয়ে দিতাম, তারা অপমানিত বোধ করতো।

তাদের কাছে ব্যাপারটা বড়ই বিচ্ছিরি ছিলো। এগুলোর বাস্তবতা আসলে এতোটাই জটিল, যেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। আমি তখনো মুসলিম নারী হিসেবে স্বীকৃত ছিলাম না, না অমুসলিমদের দ্বারা, না কোনো মুসলিম দ্বারা। তবে যতোটা আশংকা ছিলো , আমার পরিবার দ্বারা ততোটা সমস্যার মুখে আমাকে পড়তে হয়নি। কারণ ততোদিনে আমি অনেকাংশেই স্বনির্ভর হয়ে গিয়েছিলাম।

তারা জানতো যে তারা আমাকে আর প্রভাবিত করতে পারবে না। চাপ দেয়াও আর সম্ভব হবে না। তাই রাজি না থাকলেও তাদের জন্য একটাই পথ ছিলো আমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো। তবে আমার দাদি বরাবরই আলাদা রকমের খোলামনের মানুষ ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমি বলা চলে ভাগ্যবতিই ছিলাম। কারণ ফ্রান্সের এমন অনেক নারীর সাথেই আমার সাক্ষাত হয় বা হয়েছে যারা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে পরিবারের দ্বারা ব্যাপক হয়রানির শিকার হচ্ছে।

Islam in europe
Islam in Europe

What Islam Changes in My Life

ইসলাম আমার জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? জবাবটা সাধারণই। সবকিছুই বদলে গেছে। খাবার থেকে নিয়ে কাপড়-চোপড়, অন্যদের সাথে আমার সম্পর্ক ও চলাফেরা। সবই।

আমি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। রমজানে রোজা রাখি। যাকাত দিই। ১৯৯৮ সালে নানা কারণে আমি ফ্রান্স ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ এখানে স্বাধীনভাবে নিশ্চিন্ত মনে আমি ইসলামের অনুসরণ করতে পারছিলাম না। রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সের আইন যদিও ইসলাম পালনে বাধা দেয় না, তবে ফ্রান্সের মানুষ এবং তাদের ব্যবহার তো আর আইনের গতিতে চলে না।

একবার আমি একজন মুসলিমা হিসেবে মাথা ঢেকে মসজিদেও পথে রওয়ানা হলাম, রাস্তায় একলোক ভয়ে দু’ দু’বার বসার সিট বদলালো। সে বারবার বোঝাতে চাচ্ছিলো আমি তাকে বিরক্ত করছি।

এটা আমাকে খুব গভীরভাবে বুঝিয়ে দিলো- এখানে একজন মুসলিমাকে এমন অজ¯্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে প্রতিনিয়ত। যে রাষ্ট্রকে সারা বিশ্বে মানবাধিকারের রাষ্ট্র বলে পরিচয় দেয়া হয় সে রাষ্ট্রের মানুষ কেমন করে এতোটা অধৈর্য এবং প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারে? কোথায় এ রাষ্ট্রের নাগরিক স্বাধীনতা? সমাজের অংশ হতে হলে আপনাকে দেখতে কেনো অন্যসবার মতোই হতে হবে?

ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই দু:খজনক মনে হলো কারণ ফ্রান্স আমার দেশ, আমি কখনো চাই নি আমার দেশ ছেড়ে যেতে। যেহেতু আমি বাস্তবেই ইসলামের অনুসরণ করতে চাই- এটা কঠিন, ক্ষেত্রবিশেষ অসম্ভব যে সব ঠিক রেখে ফ্রান্সে আমি কাজ করতে পারবো।

ইসলামের দৃশ্যমান চিহ্ন (হেড স্কার্ফ) শরীরে ধারণ করার কারণে একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েও ফ্রান্সে আমি কোনো চাকরি পাই নি।

কাজের সূত্রে আমি এখন মরক্কোতে বসবাস করছি। এখানে বাস করে আমি আনন্দিত কারণ এখানে স্বাধীণভাবে আমার ধর্ম পালন করতে পারি। আমি মাথা ঢেকে এবং শরীরে লম্বা পোষাক জড়িয়েই এখানে কাজ করতে পারি। প্রতিদিন পাঁচবার আজান শোনাটা আমার অসম্ভব প্রিয় ব্যাপার। নামাজের সময় সহজেই ছাড় মেলে। আর রমজানে কোনো মুসলিম দেশে থাকার সুযোগ মেলা তো দারুণ এক ব্যাপার।

https://sakiladnan.com/%e0%a6%ac%e0%a7%88%e0%a6%b0%e0%a6%bf-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%93%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%a4%e0%a7%8b%e0%a7%9c%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%97%e0%a6%b2/

১৯৯৯ এর জুনে এক সপ্তাহের জন্য আমি ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। তবে আমার পরিবারের অবস্থা আমাকে একই সাথে ক্লান্ত এবং বিচলিত করে তুলেছে। আমার কিছু আত্মীয়ের আচরণ ছিলো চিন্তারও বাইরে। যখন আমার বাবা জানলো আমি হিজাব পড়া শুরু করেছি, তিনি সাথে সাথে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন।

আমার সাথে সাক্ষাত করতে অস্বীকৃতি জালালেন। এমনকি অন্যদের বলে দিলেন আমাকে যেনো অপমান করে তাড়িয় দেয়া হয়। এরপর থেকে আমি কখনো আর তার কথা শুনতে যাই নি। আমার মা-ও আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেন। যতোদিন আমি তাদের ইসলামের বাহ্যিক আলামত দেখাই নি, তারা আমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। হিজাব পরার পর থেকে আর সে ধারা বজায় থাকে নি। আজ, আমার সম্পর্ক আছে কেবল আমার ছোট ভাইদের সাথে এবং আমার দাদির সাথে।

পরিবারের অন্যদের আমি বর্জন করি নি। তবে- তারা না চাইলে আমি যেমন সেভাবে আমাক মেনে নিতে তো তাদের আমি বাধ্য করতে পারি না।

আমি এখনো বিয়ে করিনি, তবে ভাবছি। শীঘ্রই করবো ইনশাল্লাহ। আমার চারপাশের পৃথিবী পুরোই বদলে গেছে। প্রতিনিয়ত আমাকে নানারকম সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমার নিজের পরিচিত এবং আত্মীয়রাই আমার চলার পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।

এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে একজন সঙ্গী তো অন্তত দরকার। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সত্য দ্বীনের জন্য কবুল করে নিন এবং আমাদের চলার পথকে সহজ করে দিন। আমীন!


Why I became a Muslimah? by Leila Raffin. ইংলিশ থেকে অনুবাদ –শাকিল আদনান

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *