রক্তে লেখা ইতিহাস
[মূল আরবি থেকে নির্বাচিত ১০টি টুকরো গল্প]
Source: ফিলিস্তিনের জন্য ভালোবাসা by Sakil Adnan
কান্না
উজ্জ্বল সকাল। স্নিগ্ধ আলোয় চকচক করছে শিশির ভেজা সবুজ গাছপালা। পাখির কলতানে চারপাশ মুখরিত। ছোট্ট আমাল চোখ মেললো পৃথিবীর বুকে তার সবচেয়ে প্রিয় মুখটা দেখার জন্য। যেনো অপেক্ষা করছিলেন এমন ভঙ্গিতে তখনই মা অনেকটা ঝুঁকে পড়ে তার কপালে চুমু খেলেন। আমালের ঘুমজড়ানো চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়লো ভূবনজয়ী হাসি। আমাল জানে, এই হাসিটা দেখার জন্য বাসার অন্য সবাইকে মা বারণ করে দিয়েছেন তার ঘুম ভাঙাতে। আমালও তা-ই চায়। মায়ের সুন্দর মুখটা দেখে দিন শুরু হওয়াটা কী যে দারুণ লাগে তার, কাউকে সে বোঝাতে পারবে না। হঠাৎ আমালের মনে পড়লো আজ তার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। নাশতা খেয়ে সে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো। এরপর বাবার সাথে চললো শহরের পথে।
কদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলো আমাল। ডাক্তার দেখে বললেন, সেরে গেছে প্রায়, আর তেমন সমস্যা নেই। তার বাবা নানানভাবে ডাক্তারকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন- আর কোনো সমস্যা আছে কি না। মনে প্রশান্তি এলে তবেই আমালকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুলেন তিনি। চললেন বাজারের দিকে, কিছু কেনাকাটা করা প্রয়োজন। বাবার বাজার করার ফাঁকে একটা রুমালে আমালের চোখ আটকে গেলো। ছোট্ট রুমালটায় ফিলিস্তিনের পতাকা আঁকা। আমাল বাবাকে ডাকলো- বাবা, বাবা, এই রুমালটা আমায় কিনে দাও। আমি এটা মাকে উপহার দেবো। কেনা হলো রুমালটি।
টুকটাক কেনাকাটা শেষে বাবা-মেয়ে বাজার থেকে বেরুতে উদ্যোগী হলো। এসময় হঠাৎ দখলদার ইসরাইলি সেনারা গুলি ছুড়তে শুরু করলো। আমাল দেখলো দুজন যুবক মাটিতে পড়ে মুহূর্তেই নিথর হয়ে গেলো। ভয়ে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। আতংকে রীতিমতো কাঁপছিলো আমাল। বাবার দু’ বাহু শক্ত করে ধরে সে বলতে থাকলো- বাবা, আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো… আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো। আমি বাড়ি যেতে চাই।
আমালের বাবা তাকে কোলে নিয়ে দু’ বাহুর আড়ালে প্রায় ঢেকে ফেললেন। দ্রুত ছুটলেন গাড়ির স্ট্যান্ডের দিকে, যেখান থেকে গাড়িগুলো তাদের গ্রামের দিকে ছুটে যায়। তবে ওদিকে বর্বর ইসরাইলিরা তাদের আগেই গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলো। আমালদের বাড়িটা ছিলো গ্রামের একেবারে মুখেই। আমালের মাকে তারা মেরে ফেললো, তিনি যখন বাড়িটা এখান থেকে তুলে নেয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন।
আমাল তার বাবার কোলে করেই গ্রামে ফিরলো, ততক্ষণে গ্রামের শত শত মানুষ তাদের বাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন। আমাল বাবার কোল থেকে নেমেই দৌড়ে উঠোনের দিকে এগুলো। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে থাকলো- এখানে কী হয়েছে? সবাই এখানে জড়ো হয়েছেন কেনো? আমার আম্মু কোথায়? কেউ তাকে জবাব দিলো না। বাবার দিকে ফিরলো আমাল, তার দু’ চোখে অশ্রুর বন্যা। দৌড়ে সে ঘরে ঢুকলো, পেছন থেকে বাবার বারণ আর গ্রামবাসীর ডাকাডাকি কিছুই শুনলো না। আমালকে আটকে রাখতে ব্যর্থ হলো সবাই।
আমাল ভেতরে ঢুকলো। যতোটা তীব্র গতিতে ঘরে ঢুকেছিলো ঠিক ততোটাই শীতল হয়ে গেলো সে মুহূর্তেই। হায় কী ভয়ানক দৃশ্য! আমাল দেখলো তার মা এলোমেলোভাবে মাটিতে পড়ে আছেন, শরীর থেকে বের হওয়া রক্তে ভেসে গেছে পুরো মেঝে। আমাল ছুটে গেলো মায়ের কাছটায়। চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো। মায়ের নিথর দেহ থেকে কোনো সাড়া সে পেলো না। মাথাটা আলতো করে কোলে নিয়ে আবার সে ডাকতে শুরু করলো- মা, মা- জেগে ওঠো প্লিজ। এই তো আমি এখানে। আমার কারণে হলেও একটু জেগে ওঠো। প্লিজ মা প্লিজ…।
আমালদের বাড়িজুড়ে বিষণœতা ভর করলো। কারো মুখ থেকে টু শব্দটি বেরুলো না। আমালের চিৎকার তখন উচ্চ থেকে উচ্চ স্তরে পৌঁছতে লাগলো। ছোট্ট শিশুর বুকে যেনো পাহাড়ের বোঝা চেপে বসেছে। রাগ-ক্ষোভ-কান্না-হতাশায় আমালের বাবার চোখ-মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো, কীভাবে কী হয়ে গেলো তিনি বুঝতেই পারলেন না। যেমন পারে না কোনো ফিলিস্তিনি। একেকটা সকালে এভাবেই তাদের সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে আমালের দিকে এগুলেন তিনি। পকেট থেকে একটু আগে কেনা রুমলটা বের করলেন। মেয়েকে টেনে মায়ের কাছ থেকে সরালেন। এরপর ছোট্ট রুমাল দিয়ে আমালের মায়ের চেহারাটা ঢেকে দিলেন। বাবা-মেয়ে এরপর ভেঙে পড়লেন করুণ কান্নায়। এতোক্ষণে বাবার সাড়া পেয়ে ছোট্ট আমালের চিৎকার আরো বেড়ে গেলো। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে শান্ত-সুখের ছোট্ট নীড়টা ধুলোয় মিশে গেলো!
জলপাই-তেলের যুবকেরা
ফিলিস্তিনের অন্যান্য গ্রামের মতোই আমার গ্রামটি। এই গ্রামের মানুষগুলো খুব সহজ-সরল। ঘর-বাড়িগুলো ছিমছাম সাজানো-গোছানো। সবুজ বৃক্ষরাজি বড় মায়াজড়ানো। সেই ছোট্টটি থেকে আমি গ্রামটিকে অত্যন্ত ভালোবাসি। কোনোদিন এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে এমন কিছু আমি ভাবতেও পারি না। সকালে ঘুম থেকে জেগেই আমি গ্রাম দেখতে বেড়িয়ে পড়ি। প্রতিদিন। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় সবুজ প্রকৃতি সোনালি আভা ধারণ করে। মোরগের ডাক শুনি। এরপর মাদরাসায় যাই। সবমিলিয়ে আমি তৃপ্ত এবং প্রশান্ত এক ফিলিস্তিনি, আমার গ্রাম ও প্রকৃতি নিয়ে।
একদিন মাদরাসা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ নাকে বিষাক্ত গ্যাসের গন্ধ পেলাম। দখলদার বর্বর ইসরাইলের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় দৌড়ে বাসায় পৌঁছে বললাম পথে কী সব দেখে এসেছি। তখনই টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পেলাম সেই সন্ত্রাসবাদী ইসরাইলি নেতাটিকে, যার নাম কোনোভাবেই আমাকে আকর্ষণ করে না। তবু খুব মনোযোগী হয়ে খবরটায় চোখ রাখলাম। কারণ, এই খুনিটা বায়তুল মুকাদ্দাস পরিদর্শনে এসেছে। খবর পেয়েই ফিলিস্তিনের যুবকেরা আলআকসা পানে ছুট লাগালো, যেমন ছোটে দমকা হাওয়া। হাতে পাথরের টুকরো। এই সেই পাথর, যেগুলো না রোখা যায়, না ধ্বংস করা যায়। ইসরাইলি নরপিশাচগুলো তৎপর রইলো যে-কোনো সময় বিষাক্ত গ্যাস ও গুলি ছোড়ার কাজে।
আলআকসায় পৌঁছার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। ফিলিস্তিনিদের কাজে যেতেও বারণ করা হলো। এমনিতেই অর্থসংকটে ভুগতে থাকা ফিলিস্তিনিরা আরো একবার সংকটের মুখে পড়লেন। একদিন কাজ করতে না পারা মানে সেদিনের খোরাকি থেকে বঞ্চিত থাকা। ঘরে রুটি-ডাল না আসা। এমন এক অবস্থায় আমরা জীবন কাটাই, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সারাক্ষণ-সর্বত্র ভয় ও শংকা। কতোবার যে আমাদের মাদরাসা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো, কতোবার যে বিষাক্ত গ্যাস ছোড়া হলো- তার হিসেব কে রাখে? আমাদের বাবা-মায়েরা ঘরে প্রায় বন্দী থাকেন।
কখন দরজা খুলে বেরুনো যাবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমাদের ভাইদের ধরে ধরে ইসরাইলি কারাগারে আটকে রাখা হয়, বলা ভালো তাদের মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়া হয়। যা-ই হোক, আমি বসা থেকে উঠলাম, কী একটা প্রয়োজন সারতে। হঠাৎ বিকট আওয়াজ কানে এলো। গ্রামের বিভিন্ন দিক থেকে আওয়াজ আসতে শুরু করলো। ভাবলাম আতশবাজির আওয়াজ আসছে। প্রয়োজন সেরে দ্রুত বেরিয়ে পড়তে উদ্যত হলাম। এসময় হঠাৎ আওয়াজ আসতে শুরু করলো, চারদিক থেকে লাগাতার। মনে হলো বাসার খুব কাছেই আওয়াজ হচ্ছে। দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিলাম। টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় চারপাশ ছেয়ে যেতে দেখলাম। সাথে সাথে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর শত্রুদের ছুটোছুটি আরো বেড়ে যেতে দেখলাম। সাথে পাথর ছোড়াও তীব্রতর হলো। আমাদের গাঁয়ের ছেলেরা পাথর হাতে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে গেলো।
এভাবেই বেঁচে আছি, আমরা জলপাই-তেলের যুবকেরা। লেবুবাগানের সন্তানেরা। প্রতিনিয়ত আমরা এমন জুলুম-শোষণের মধ্য দিয়েই দিন গুজরান করছি। এসব ঘটনা এখন ফিলিস্তিনের সর্বত্র ঘটছে। প্রতিদিন। হৃদয়হীন ইসরাইলিদের জন্য এসব যেনো পানিভাতে পরিণত হয়েছে, আরো রূঢ় ও নৃশংসভাবে ফিলিস্তিনিদের উপর নিপীড়ন চালাবার জন্য এরা সদা তৎপর। যেমন ছোবলের জন্য মুখ হা করে রাখে সর্পরাজ।
এই আমার গল্প- হ্যাঁ গল্পই। হতাশা, বেদনা আর তীব্র কষ্টের; আমরা ফিলিস্তিনিরা যেসবের মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রান্ত করছি। দিন যায়। মাস পেরোয়। বছর শেষ হয়। একটি কথার পর দ্বিতীয় কথার পালা আসে। একজন শিশুর পর আরেকজন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। একজন বীরের পর আর একজন বীর শাহাদাত বরণ করে। এভাবেই, একটি গণঅভ্যুত্থান বা ইনতিফদার পর আরেকটি ইনতিফদা শুরু হয়ে যায়। আর আমরা অসহায় ফিলিস্তিনিরা এসবের পালাচক্রে আটকে দিনমান কেবল ছুটতে থাকি। ছুটতেই থাকি। মুক্তি যে নেই!
মানব কারাগার
সাবের দ্রুত বাড়ি ফিরতে চাইছিলো। দিনের দীর্ঘ সময় সে কেবল মায়ের কথাই উচ্চারণ করতো যে, মা বলেন- দ্রুত বাড়ি ফিরে এসো। কাজ সেরেই চলে আসবে, বিন্দ্রমাত্র দেরি করবে না। সাবের তাড়াহুড়ো করেই হাতের কাজ সাড়লো এবং মায়ের মুখ দর্শনের জন্য বাড়ির পথ ধরলো। মায়ের সাথে কথা শেষে যথারীতি ক্লান্ত শরীর বিছিয়ে দিলো নিজের প্রিয় খাটে। সাবের প্রতিবেলার খাবার মা-বাবার সাথেই খায়। বছর দুই আগে ইসরাইলি বর্বরতায় পঙ্গুত্ব-বরণ-করা তার বাবা প্রতিবেলায় ছেলেকে সামনে দেখতে চান। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজকাল তিনি বড় বেশি চিন্তিত। খাটের পাশে রাখা রেডিওতে সারাদিন খবর শোনেন, খারাপ কিছু কানে এলে সাথে সাথে ছেলেকে ঘরে ডেকে পাঠান। সাবের বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত চরম উদ্বিগ্নতায় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে যেতে থাকে তার চেহারার।
তবে সাবের, অল্প বয়সেই যার কাঁধে একদিকে বাবা-মায়ের দেখাশোনা আবার দিনান্তে তাদের জন্য দু’ লোকমা খাবার জোটানোর দায়িত্ব চেপেছে, বাবা-মায়ের সাথে সে প্রায়ই আলাপ করতো ইনতিফাদায় অংশ নেয়া যুবকদের বীরত্বের কথা। তাদের অসীম সাহসী কীর্তি-কলাপগুলো যদিও সে খুব ভালো করেই জানতো- মা-বাবা চান না সে ইনতিফাদায় জড়াক। তার মন বড় আনচান করতো ইনতিফাদায় অংশ নিতে। বর্বর ইসরাইলিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। সাবের ইনতিফাদায় অংশ-নেয়া-যুবকদের কথা বলতেই থাকতো। আর সুযোগ পেলেই ইসরাইল-বিরোধী কোনো-না-কোনো তৎপরতায় অংশ নিতো। ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে তার মন উত্তপ্ত হয়ে থাকতো ক্রোধ আর ক্ষোভে, যারা খুন-অপহরণ আর ধ্বংস ছাড়া কিছু জানে না।
সাবের ধীরে ধীরে বিলম্ব করে বাড়ি ফেরা শুরু করলো। একমাত্র সন্তান হিসেবে সাবেরের মায়ের মনে ভয়ও বেড়ে যেতে থাকলো। কারণ এমন সময় ছেলের চলাফেরা অদ্ভুত হতে শুরু করলো, যখন নাকি স্বপ্নটা কেবল বাস্তব হতে শুরু করেছে। সেই স্বপ্ন যা থাকে প্রতিটা বাবা-মায়ের। ছেলে বড় হয়ে পরিবারের হাল ধরবে। তাদের পরিবারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বেশি বাস্তব। সাবেরের মা বয়সের ভারে নুব্জ, বাবা পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন প্রায় দুই বছর।
একদিন ঠিকই সাবের সিদ্ধান্তটা পাকা করে ফেললো। খুনি ইসরাইলিরাই এখন তার একমাত্র টার্গেট। ইসরাইলিদের গোলাগুলি রুখে দেয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের যেগুলো বিন্দুমাত্র রেহাই দেয় না। এরপর যা হওয়ার তা-ই হলো। লড়াইয়ের কোনো এক উত্তাল দিনে সাবেরও ইসরাইলি নরপিশাচদের গুলিতে আক্রান্ত হলো। তীব্র ব্যথায় গুঙিয়ে-কঁকিয়ে উঠে মাটিতে পড়ে গেলো সে। সাবেরের পঙ্গু বাবার মাথায় রীতিমতো যেনো বাজ পড়লো। বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধ। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, আহত ছেলের সাথে সাথে তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা লাগলো।
কিছুটা সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলো সাবের। গায়ে বল ফিরে পেতেই আবার ইনতিফাদায় যোগ দিলো সাবের। এক রাতে শত্রুপক্ষের হাতে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত টানা চললো তার লড়াই। সাবেরের মায়ের আশংকা অল্প ক’দিনের মাথায় এসে বাস্তব হয়ে ধরা দিলো। ঘুম থেকে জেগে সে রাতে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আবিষ্কার করলেন- ইসরাইলি সেনারা তাদের ছেলেকে ধরতে চারপাশ থেকে বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।
ইসরাইলি আদালতে তিন বছরের জেল হলো সাবেরের। অসহায় বাবা-মা চেয়ে রইলেন একমাত্র সন্তানের ফিরে আসার পথে। ফিলিস্তিনের বুকে এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটে। সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকে রাতের আঁধার নেমে আসা পর্যন্ত চলে নিষ্ঠুর বর্বরতা। রাতেই কি রেহাই মেলে?… প্রতিটা মুহূর্তই যেনো ওরা ফিলিস্তিনিদের গিলে খেতে চায়।
দারুণ পৃথিবীর নিদারুণ মানব-কারাগার আমাদের এই দেশ। ফিলিস্তিন।
পবিত্র ভূমির শিশু
আমি পবিত্র ভূমির এক শিশু। আমি সুউচ্চ যাইতুন বৃক্ষের ডাল বহনকারী এক শিশু। আমি মহানবীর ইসরা ও মেরাজের স্মৃতিবিজড়িত ভূখ-ের শিশু। আমি সেই বরকতময় পাথর বহনকারী শিশু, যা দখলদার বর্বর রাষ্ট্রের সব প্রতিপত্তি রুখে দিতে সক্ষম।
এখনো চিনতে পারলেন না তো? শুনুন তবে আমার পরিচয়-
‘যাইতুনের ডাল আর জমিনের পাথরগুলোতে খোদাই করা আমার নাম।
আমার জন্ম এমন ভূখ-ে, হিং¯্র দানবেরা যাকে মমতায় আগলে রাখে
আমার জন্ম তো এমন দিনে, পবিত্র এই ভূমির নামে যেদিন ইনতিফাদা শুরু হয়েছিলো
আমার জীবন শুরু হলো, পরাধীন এই দেশ থেকে যেদিন গৃহহারা হতে থাকলো মানুষ…’।
বার চিনতে পারলেন- আমি কে? আপনাদের একটু কি মনে পড়লো আমি আর আমার মতো শিশু-কিশোরদের দুর্দশা? বুঝতে পারলেন ঠিক কোন্ দেশটি আমার?
আতংক
আম্মুর গলা শোনা গেলো। আমাকেই ডাকছেন। জান আমার, তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে নাও। তোমার ফুফাতো বোন সালওয়ার বাসায় যাবো। আম্মুর কথা শুনে আমি তো খুশিতে আত্মহারা। কতোদিন পর সালওয়া আপুর বাসায় যাবো! পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে ছোট বোন ও আম্মুর সাথে সালওয়া আপুর বাসার পথে রওয়ানা দিলাম।
খুব দূরে নয় আপুর বাসা, কিছুক্ষণেই পৌঁছে গেলাম। সামনে থাকায় আমিই দরজার কড়া নাড়লাম। দরজা খুলে আমাকে দেখে আপুরা তো অবাক! আহ্বানে-আনন্দে-মুগ্ধতায়-তৃপ্তিতে তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমাদেরও। সোফায় বসে হাসি-আনন্দ-গল্পে মেতে উঠলাম সবাই। সালওয়া আপুর পরীর মতো একটা মেয়ে হয়েছে। ওদিকে ফুফাতো ভাইয়েরও বিয়ে হতে যাচ্ছে। কতোসব পারিবারিক বিষয় এক এক করে উঠে আসতে লাগলো। এমন দারুণ মুহূর্তে হঠাৎ আমরা বোমা ফাটার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কাছেই কোথাও বোমা ছুড়েছে বর্বর ইসরাইলিরা। সাথে সাথে গোলাগুলিও শুরু হলো। আপুর চেহারার রঙ মুহূর্তেই বদলে যেতে দেখলাম। চারদিক থেকে সমানে নারী-পুরুষ-শিশুর চিৎকার ভেসে আসছিলো। আপুও হঠাৎ যেনো সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন- জলদি ভেতর ঘরে প্রবেশ করো। জলদি এসো। লুকাও। ওখান থেকে সরে এসো। জলদি! আমরা দৌড়ে ভেতর ঘরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু সুরাইয়া দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ মেঝেতে পড়ে গেলো। হায় খোদা, জানালা দিয়ে ছুটে আসা একটা বুলেট ওকে মাটিতে আছড়ে ফেললো।
সালওয়া আপু আবার চিৎকার করে ওঠলেন- সবাই এসো। মাটির নিচের বাংকারে ঢুকে পড়ো। জলদি যাও! জলদি যাও! দু’ মিনিটের মধ্যে নিজেদের সবাইকে আমরা মাটির নিচের সংকীর্ণ একটা কামরায় আবিষ্কার করলাম। কাঁচা মেঝে। নেই কোনো বিছানা বা আসবাব। ভয় ও আতংকে রীতিমতো বরফ হয়ে বাংকারটায় আমরা সিঁটিয়ে রইলাম। বোমা ও গোলাগুলির আওয়াজ সমানতালে শোনা যাচ্ছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সালওয়া আপুর একতলা বাড়িটি। আমার মনে তখন বারবার উঁকি দিয়ে যেতে থাকলো- হায় খোদা, আমাদের সাথে এই কি তুমি চাও? এও কি কোনো কথা যে বর্বর ইসরাইলিদের দ্বারা আল্লাহ আমাদের শাস্তি দেবেন? পরক্ষণেই মনে হলো- কী চরম বাজে চিন্তা আমি করছি। ভয় বা যে কারণেই হোক, একজন মুমিনের হৃদয়ে এসব চিন্তা কীভাবে আসতে পারে? সাথে সাথে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলাম। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের প্রতি রহম করুন। আমাদের প্রতি আপনি দয়াশীল হোন।
আতংকে সালওয়া আপুর বাচ্চাগুলোর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো ওরা। আপু প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে থাকলেন তাদের কান্না থামাতে। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা এভাবে কাঁদলো। আধা ঘণ্টা তো নয় যেনো অর্ধযুগ। আল্লাহর শোকর। গোলাগুলি অবশেষে বন্ধ হলো। এবার অন্তত এই অসহ্য গুহা থেকে বের হই। আতংকে এতোক্ষণ সেভাবে টের না পেলেও গোলাগুলি থেমে এলে আর এক মুহূর্তও সেখানে অবস্থার করা সম্ভব হয়ে উঠছিলো না।
আমরা উপরে উঠে এলাম। আপাতত গুলি-বোমার কোনো আওয়াজ শোনা না গেলেও কোনো নিশ্চয়তা নেই- আবার যে-কোনো সময় তা শুরু হবে। তাই এবার শোবার ঘরে আশ্রয় নিলাম। ভেতরের দিকে হওয়ায় এ ঘরটাই তুলনামূলক বেশি নিরাপদ। সবাই চেষ্টা করছিলো আতংক কাটিয়ে একটু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে। নইলে যে হার্টবিট বন্ধ হয়ে এমনিতেই মরতে হবে। সালওয়া আপুর ননদ সুরাইয়া আপু তখনো বসার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। আতংকে তার কথা ততক্ষণে আর মনেও রইলো না। একটু স্বাভাবিক হয়ে সবাই টুকটাক কথা বলতে শুরু করলো। তবে স্বাভাবিকভাবেই এবারের কথাগুলো আর আনন্দের রইলো না। পরিণত হলো শোক আর হতাশার। আতংক যেনো বুক ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। সুরাইয়া আপুর কথা মনে করে সালওয়া আপু কেঁদে ফেললেন। বাড়ির চারপাশে তখন কেবল একটাই গুঞ্জন- কতোজন শহীদ হলো। কতোজন পঙ্গুত্ব বরণ করলো। কে কে বন্দী হলো। ঘর-বাড়ি ধ্বংস হলো কতোজনের।
এসব আলোচনাই আমাদের মুখে ঘুরে ফিরছিলো আর আমি ভাবছিলাম- আয় আল্লাহ, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমাদের আলোচনা কেমন বেদনাময়-রুক্ষ-শুষ্ক আর হতাশার হয়ে গেলো! এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আমার ভাই এসে উপস্থিত হলো আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। আল্লাহর শোকর আদায় করলাম- আলহামদু লিল্লাহ।
বাসায় ফিরলাম। ফেরার পথের আলোচনাটাও স্বাভাবিক কারণেই যাওয়ার পথের মতো খুশির না হয়ে তিক্ততার হলো। বাসায় ফিরেই সোজা জায়নামাযে দাঁড়ালাম। রাব্বে কারিমের কাছে শোকরিয়া আদায় করলাম- আমরা এবং আমাদের ঘরবাড়ি এখনো নিরাপদ আছে বলে। অল্পতেই এবারকার বিপদ কেটে গেছে বলে। আল্লাহর দরবারে মুক্তি চাইলাম এই পরাধীনতা এবং জাহান্নামে পরিণত হওয়া প্রিয় মাতৃভূমির দুঃসহ দুরবস্থা থেকে।
আমাদের উপর বর্বর ইসরাইলিদের দখলদারির স্বরূপ হলো কুৎসিত চেহারার দৈত্যের মতো। এমন ভয়ানক দৈত্য- জীবন উৎসর্গকারীদের মাথার খুলি হলো এর দস্তরখান। শহীদের রক্ত এদের পানীয়। নির্যাতিত জনতার গায়ের চামড়া এদের পোশাক। এতিম-বিধবাদের কান্না এদের বিনোদন। মৃত মানুষ আর শহীদের লাশে ঢাকা নতুন নতুন আকাশ বানানো এর শখ ও তৃপ্তি।
আহলাম
আহলাম শান্ত-শিষ্ট ও ঠা-া মেজাজের একজন ছাত্রী। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে সে। শিক্ষিকা ও বান্ধবীদের কাছে আহলাম খুবই প্রিয়। মেধাবী ছাত্রী হওয়ার পাশাপাশি সে সবাইকে অত্যন্ত সম্মান করে। কয়েক মুহূর্তে যে-কাউকে আপন করে নেওয়ার দারুণ ক্ষমতা আছে আহলামের। ভবিষ্যতের জন্য হৃদয়ে সে দারুণ সব স্বপ্ন লালন করে। আসছে জীবনকে ঘিরে দেখা রঙিন ছবিগুলো তার চারপাশকে সারাক্ষণ সুরভিত করে রাখে।
একদিন ভোরে আহলাম স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। বই-পত্র ও ব্যাগ গুছিয়ে সে বাবার কাছে গেলো ভাড়া চাইতে। হায় কী দুঃসময়। মেয়ে স্কুলে যাওয়ার ভাড়া চাইছে অথচ বাবা তা দিতে পারছেন না। মেয়েকে বলার মতো কোনো কথাও তিনি খুঁজে পান না। কিছু একটা বলতে চান কিন্তু জিহ্বাটা মুখের ভেতর কে যেনো আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। আহলাম ব্যাপারটা বুঝলো এবং হাসিমুখেই সে মেনে নিলো। বাবাকে সে বললো- বাবা, চিন্তার কিছু নেই। গতকালের ভাড়া থেকে কিছু মনে হয় এখনো আমার ব্যাগে রয়ে গেছে, ওতেই আজ আমার চলে যাবে। আজ আর ভাড়া দিতে হবে না। আহলাম ব্যাগ কাঁধে স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে যায় অথচ তার কাছে ভাড়া কেনো একটা কানাকড়িও নেই। আর তার বাবা নির্বাক হয়ে বাসায় বসে থাকেন। মেয়ে যাই বলুক- তিনি তো জানেন গত দু সপ্তাহ ধরে মেয়েকে তিনি ভাড়া দিতে পারছেন না। এতোদূরের স্কুলে মেয়েটা হেঁটে হেঁটেই যায় উল্টো কিনা বাবাকে সান্ত¡না দেয়! কী অবলীলায় মেয়েটা বলে গেলো গতকালের ভাড়া থেকে বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে আজ চলে যাবে! তার মনে বারবার কথাটা বেজে উঠতে থাকে- ছোট্ট মেয়েটা কী অল্পতেই কতো বড় হয়ে গেলো। নিজের মন খারাপ অবস্থা নিয়েও বাবাকে সান্ত¡না দিতে আসে!
আহলাম স্কুলে পৌঁছলো। বান্ধবীদের সাথে গিয়ে বসলো, যারা ভয়ে রীতিমতো সিঁটিয়ে আছে। ম্যাডামের দেয়া গণিতের হোমওয়ার্ক আজও কেউ করতে পারে নি। মন খারাপের অবস্থায়ও বান্ধবীদের এই অর্থহীন অস্থিরতা দেখে আহলামের হাসি পেলো। ওদের এই ভয়টা যদি বাসায়ও থাকতো তা হলে তো হোমওয়ার্কটা ঠিকই করে নিয়ে আসতো। শাস্তিটাও পেতে হতো না। অবশ্য হোমওয়ার্ক মিস করা ছাত্রীর সংখ্যা অনেক হয়ে গেলে ম্যাডাম মাঝে মধ্যে ক্ষমাও করে দেন। বান্ধবীদের সে তাই আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দিলো। শিশুদের সকালের ক্লাসের পর্ব শেষ হওয়ার পর আহলাম ও তার বান্ধবীরা ক্লাসে প্রবেশ করলো। ম্যাডামের উপস্থিত হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলো তারা সবাই। ম্যাডাম একটু পরই ক্লাসে প্রবেশ করলেন। আহলাম দেখলো ভয়ে পাশে-বসা বান্ধবীদের মুখগুলো ফ্যাকাশে হয়ে আছে। ম্যাডাম অবশ্য আজ আর হোমওয়ার্কের কথা জিজ্ঞেস করলেন না। ছাত্রীদের চেহারা দেখে তিনি হয়তো ব্যাপারটা ঠিকই অনুমান করে নিয়েছেন।
ক্লাস শেষে আহলাম বাড়ি ফিরলো। পেটে প্রচ- ক্ষুধা তার। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছুই খাওয়া হয় নি। ব্যাগটা কাঁধ থেকে রেখেই সে মাকে জিজ্ঞেস করলো- আজ কী রান্না করলে মা? মলিন মুখে মা তাকে সাজিয়ে রাখা পাতিলগুলো দেখিয়ে বললেন- এগুলোতে গতকালের খাবার রয়ে গেছে। তুমি তোমার বাবা এবং ভাইদের সাথে ভাগ করে খেয়ে নাও।… আর তুমি? তুমি কী খাবে, মা? আহলাম ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে। মা তার বলেন- বাড়তি রুটি দিয়ে আমি নিজের ক্ষুধা মিটিয়ে নেবো। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না মা আমার। এখন যাও, তোমরা জলদি খেয়ে নাও।
আহলামদের পারিবারিক অবস্থা আজকাল এভাবেই অতিক্রান্ত হচ্ছে, যেদিন থেকে তার বাবা কাজে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন। তাদের বাড়িতে কখনো বাড়তি রুটি থাকতো না। আটার বস্তাও নয়। আর আটার বস্তা থাকলেই-বা কি? তিন সপ্তাহ থেকে গ্যাসের চুলা জ্বলছে না, পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে। কাঠ আর আগুন ছাড়া রান্না করা খাবার গরম করার কোনো উপায় নেই। দুই দিন এমনকি তিন দিন আগের খাবারও কোনোরকম একটু গরম করে তাদের খেতে হচ্ছে।
খাবার রেডি করতে গিয়ে আল্লাহর কথা মনে পড়ে অসহায় নিবেদন আর অভিমানে আহলামের কান্না চলে এলো। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে সে বললো- হায় খোদা, আপনি কি দেখছেন আমাদের দুরবস্থা!
দু’ দিন পর আহলাম স্কুল থেকে ফিরে দেখলো দরজার পাশে আটার বস্তা রাখা। তার চেহারা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মায়ের কাছে ঘটনার রহস্য জানতে চাইলো আহলাম- কোত্থেকে কীভাবে বস্তাটা এলো। তার মা জানালেন- একজন রহমদিল মানুষ এটা তাদের জন্য হাদিয়া পাঠিয়েছেন। আকাশের দিকে চেয়ে আহলাম অস্ফুট স্বরে বলে ফেললো- হায় আমার প্রভু, আমার বাবা যখন কাজে যেতে পারতেন, কারো কাছে আমাদের হাত পাততে হতো না। আমরা বরং অন্যদের দান করতাম। এখন তারাও খেতে পায় না আমরাও না। মৃত্যু এবং ক্ষুধার কাছে আমরা হেরে যাচ্ছি। এমন আটার বস্তাটা তো বড়জোর এক বা দু সপ্তাহ চলবে এরপর কী হবে? ফিলিস্তিনিরা কি তখন আবার কারো দানের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে? নাকি পাকস্থলি থেকে উঠে আসা ক্ষুধার অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাবার অপেক্ষা করবে? রহম করো খোদা, কবে শেষ হবে আমাদের দুর্দিন?
সাহস
নভেম্বর মাসের শীতের এক রাত, নীরবপ্রকৃতির আবেশে সবাই তখন ঘুমিয়ে আছে। আমি আমার খাটের উপর বসা। আজই শুরু-করা একটা বই পড়ছিলাম। রাত তখন বারোটা। মা আর আমার ভাইয়েরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তবে বাবা যথারীতি সজাগ ছিলেন। একজন ডাক্তার হিসেবে নিজের কাজের প্রশ্নে তিনি খুবই সিরিয়াস। যে-কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য সবসময় প্রস্তুত রাখতেন নিজেকে, খুব কমই তাকে ঘুমুতে দেখা যায়। আমি খুবই মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ছিলাম। এসময় একধরনের মৃদু আওয়াজ শুনলাম। মনে হলো বিশেষপ্রকৃতির হেলিকপ্টার বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে গেলো। ইতোপূর্বে এ ধরনের আওয়াজ শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তবে যেমন বলা হয়- মুমিনের হৃদয়ই তার দলিল; অনুভব করলাম, নতুন এই যান হয়তো নতুন কোনো বিপদেরই দুঃসংবাদবাহী।
দ্রুত আমি খাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম এবং জানালার দিকে ছুটে গেলাম। রাতের আকাশ অন্ধকারে ঢাকা থাকলেও উজ্জ্বল চাঁদের কারণে অনেক কিছুই দেখা যায়। তবে কোথাও আমি হেলিকপ্টারটির দেখা পেলাম না। আমার হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠলো। রাতের আঁধারে এভাবে কোনো হেলিকপ্টারের ঘুরাফেরা মানেই তো শহরে আক্রমণের প্রস্তুতি। কিন্তু, কেনো? এই মুহূর্তে হামলা করার কোনো কারণ তো দেখছি না। অবশ্য ইসরাইলি বর্বর পশুদের হামলে পড়ার জন্য সময় বা কোনো কারণের দরকার হয় না। আরো গভীরভাবে আমি দেখার চেষ্টা করলাম, পারলাম না অন্ধকারের প্রাবল্যে। খুঁজতে চেষ্টা করলাম- এই মুহূর্তে হামলার কী কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আফসোস, পরক্ষণেই দেখলাম প্রায় শব্দহীন সেই হেলিকপ্টারের পেট থেকে কালো একটা বস্তু বেরিয়েই নিচের শহরের দিকে ছুটে আসতে লাগলো।
হায় আল্লাহ, এসব হচ্ছেটা কী! পাগলের মতো আমি চিৎকার করতে শুরু করলাম- মা, সায়িদ, আহমাদ…সায়িদ, মা, আহমাদ, জলদি ওঠো। জলদি করো। ওঠো, ওরা আমাদের শহর আক্রমণ করেছে। ওঠো। চিৎকার করে মা ও ভাইদের জাগিয়ে দিলাম। সেই কয়েকটি মুহূর্ত আমি জীবনেও ভুলবো না। ভয়ে আমি কুঁকড়ে গিয়েছিলাম, ভীষণরকম ভয়। হ্যাঁ, ভীষণ ও মারাত্মক ভয়। এর পরপরই প্রথম বোমা বিস্ফোরণের তীব্র আওয়াজে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হলো। তৎক্ষণাৎ আমরা বেডরুম থেকে ছুটে পাতালকক্ষে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আমার ডাক্তার বাবা ছুটলেন আক্রান্ত এলাকার দিকে, নিজের দায়িত্ব পালন করতে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে এলো। এরপর তৃতীয়, এরপর… এরপর সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ হয়ে এলো। নিঝুম নীরবতা। কিন্তু সব নীরবতাই কি শান্তি ও স্বস্তির বার্তা বহন করে? অন্তত এই মুহূর্তে নীরবতা তো কিছুতেই সে অর্থ বহন করে না।
বর্বর ইসরাইলিদের আরো একটি নৃশংস আক্রমণ শেষ হলো। ড্রোন ও হেলিকপ্টারগুলোও আকাশ ছেড়ে গা ঢাকা দিলো। আর কোনো আওয়াজ আমরা শুনতে পেলাম না। বাবাকে দেখতে ছুটে গেলাম। ডাক্তার হলে কি, তিনিও তো আক্রান্ত হতে পারেন। বাবাকে নিরাপদ দেখে মন প্রশান্ত হলো। তবে আমাকে দেখে তিনি বললেন, রিনা, এখন চলে যাও। পরে দেখা হবে। এখানে খুবই ভয়াবহ অবস্থা।
বাবার মুখ থেকে যেমন শুনলাম অবস্থা তার চেয়ে ভালো ছিলো না কোনোভাবেই। বিদ্যুতের গতিতে সারা শহরে খবর ছড়িয়ে পড়লো- এখানে এক লোক মারাত্মক জখম হয়েছেন। দ্বিতীয় বোমাটা আহমাদ হাসান নামের আরেকজনের বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আমার মামার বন্ধু তিনি, কিছুদিন আমাদের বাসাতেও ছিলেন। আরেকজনের পুরো পা-ই বোমার আঘাতে উড়ে গেছে। এতোসব দুঃসংবাদ শুনে প্রথমদিকে আমরা ভড়কে গেলাম। এরপর, এরপর আশ্চর্য নীরবতায় ছেয়ে গেলো পুরো শহর। শোক-ক্ষোভ-বিস্ময়ের তীব্রতায় কারো মুখে কথা ফুটলো না। নীরবতাও কী ভয়ংকর হতে পার ভেবে শিউরে উঠলাম আমি। কেমন লাগবে ভাবুন তো- একটা শহরবাসীর উপর রাতের অন্ধকারে এমন ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এলো তারা যেটার কল্পনাও করতে পারছিলো না। হায় বিপদ! সমবয়েসী কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কেনো এতো দুঃখিত রিনা, তোমার কাছের কেউ তো মারা যায় নি বা জখমও হয় নি? অবাক ভাবটা চেপে রেখেই বললাম, ছোট্ট একটা শহরে আমরা তো একটা পরিবারের মতোই মিলেমিশে বাস করি। সবাই সবাইকে চেনে। কারো কারো মধ্যে বা কিছু মানুষের মতভিন্নতা বা বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু কারো বিপদে তো কেউ পিছনে বসে থাকে না। শহর আক্রান্ত হলে তো সবাই আবার হাতে হাত মিলিয়ে ছুটে আসে। এভাবেই তো আমরা একটা পরিবারে পরিণত হয়ে যাই। তোমার পরিবারের কেউ আহত হলে তুমি কষ্ট পাও না? এখানে একটা লোক পুরো পা হারিয়ে অসহায় পঙ্গুত্ব বরণ করলো তাতে কষ্ট পাওয়ায় অবাক হওয়ার তো কিছু দেখছি না। আসলে প্রতিমুহূর্তে আমাদের দেশে এতো বেশি নিষ্ঠুরতা চলে যে, মানুষ কান্নারও সুযোগ পায় না। কতো কাঁদবে, কজনের জন্য কাঁদবে?
আব্বু বাসায় ফিরলেন রাত আড়াইটারও পর। আমরা তাকে পা হারানো আংকেলের খবর জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, খুবই খারাপ অবস্থা। এমন ভয়াবহ কেসের সামনে জীবনে এই প্রথম পড়লাম আমি। তার জখম খুবই মারাত্মক… এরপর বাবাও আর কিছু বললেন না বা বলতে পারলেন না।
রাত চারটা সাড়ে চারটা নাগাদ শহরবাসী যার যার ঘরমুখো হলেন। আমি তখনও জেগে। কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। আমার ঘরের একমাত্র জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। পূর্বমুখী জানালাটায় দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম শেষ রাতের আঁধার ভেদ করে সূর্য ওঠছে। ধীরে ধীরে পূর্বাকাশ পুরোটা আলোকিত হতে থাকলো। আশ্চর্য উজ্জ্বল আলোয় ¯œাত হতে শুরু করলো পৃথিবী।
অবাক হয়ে ভাবছিলাম- আজকের সূর্য কি একটু বেশি উজ্জ্বল, একটু বেশি তেজসম্পন্ন? প্রতিদিন ভোরে সূর্য উঠবে, পৃথিবীকে আলোকিত করবে- সূর্যের কাছে মানুষের এইটুকুই তো সাধারণ আশাবাদ। তবে নতুন একটা দিনের সূচনা মানুষের মনোজগতে দারুণ আমেজ নিয়ে হাজির হয়। ফলে কাজ-বিষয়-ভাবনা খুব সহজ হয়ে যায়। গল্প-উপন্যাসসহ বিভিন্ন বইপত্রে আমি এমন পড়েছি। তবে আজকের সূর্যোদয়টা কেবল নতুন একটা দিনের সূচনা ছাড়া অমার কাছে কিছু মনে হলো না। যেই দিনটি মোড়ানো কষ্টে, মনোযাতনায়, নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসে। এমন দিন, যেটিতে নতুন করে আমার মনে ভয় জেগে উঠেছে, পুরনো সেই ভয়। একবার এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে যার শেষ হওয়ার কোনো খবর থাকে না। যেদিন বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যান, নিঃস্ব-অসহায় অবস্থায় সারাদিন আমাকে ঘরে পড়ে তড়পাতে হয়।
প্রতিটি মুহূর্ত তীব্র আতংক বোধ করি এই বুঝি খবর এলো বাবা আর ঘরে ফিরবেন না। কোথাও কোনো চিৎকার শোনা গেলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সকালে, স্কুলের ড্রেস পরে রওয়ানা হয়ে গেলাম। স্কুলে যাওয়ার পথেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত একটি ভবন দেখতে পেলাম। হায় আল্লাহ, কী ভয়ংকর দৃশ্য। জানালাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। দেয়ালগুলো মাটির সাথে মিশে গেছে প্রায়। দরজাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে অছে। হায়, চমৎকার বাড়িটির কী বীভৎস পরিণতি!
বিধ্বস্ত মন নিয়ে স্কুলের পথে এগিয়ে চললাম। চারপাশ থেকে কানে যা আওয়াজ এলো সবই বিগত রাতের সব ভয়াবহতা নিয়ে। বিধ্বস্ত বাড়ি, আক্রান্ত ও হতাহত মানুষজন। প্রথম ক্লাসটা কোনোরকমে শেষ হলো। এলো দ্বিতীয় ক্লাসের পালা। আরবিভাষার ক্লাস। তবে আরবি ক্লাসের শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা আজ আসেন নি। পা হারানো লোকটি তার স্বামীর খুব কাছের বন্ধু। আরো একবার আমাদের মনে বিষাদ ছেয়ে গেলো। দুদিন পর আমাদের প্রিয় ম্যাডাম ক্লাসে এলেন। মলিন মুখ, একটু কেমন অবিন্যস্ত ও অনভ্যস্ত চলাফেরা সহজেই চোখে পড়ে। বোঝাই যাচ্ছিলো কিছুতেই তিনি ঠিকমতো মনোনিবেশ করতে পারছেন না। আমরা পুরো ব্যাপারটা শুনতে চাইলাম। তিনি বললেন, হেলিকপ্টারের মৃদু আওয়াজ যখন কানে এলো, আমরা তখন ঘুমুবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না। কারণ এমন তো নয় যে, এই প্রথম সালফিতে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এর পরপরই বোমা ফাটার বিকট আওয়াজ হলো। প্রথমবারই ওরা ফিলিস্তিন স্বাধীনতা আন্দোলনের সালফিত অফিসে আক্রমণ করলো।
দ্বিতীয় আক্রমণ ছিলো আমার স্বামীর বন্ধুর বাড়িতে। আমরা তার স্ত্রীর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। সাথে সাথে আমরা তাদের বাড়িতে ছুটে গেলাম। আমাদের বাড়ির ঠিক পরের বাড়িটাই তাদের, মাঝে শুধু একটা সংযোগ সড়কের দূরত্ব। অনেক কষ্টে ঘরে ঢুকতে পারলাম। কারণ বোমার আঘাতে দরজা এতোটাই বেঁকে গিয়েছিলো যে, সহজে ঢোকার কোনো উপায় ছিলো না। অবশেষে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমি দ্রুত ভাবীর কাছে গেলাম এবং দুজনে মিলে ভয়ে কাঁদতে থাকা বাচ্চাদের সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। আর আমার স্বামী ভেতরে গেলেন বন্ধুকে উদ্ধার করতে। আমিও একটু পর তার সাথে যোগ দিলাম। আমার স্বামী ভেতরের রুমে গিয়ে অন্ধাকারেই বন্ধুর অবস্থা অনুধাবন করতে চাইলেন। সম্ভব হলো না। হাতের টর্চ জ্বেলে পরে আবিষ্কার করলেন তার বন্ধু খাটের উপর নেই। বিচ্ছিন্ন পা খাটের উপর পড়ে আছে। রক্তে ভেসে গেছে সাদা চাদর। ডানে-বায়ে টর্চ জ্বেলে দেখা গেলো খাট থেকে বেশ খানিকটা দূরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন মাহমুদ সাহেব।
আমাদের শিক্ষিকা বলে চললেন, ঘটনার ভয়াবহতায় আমরা দুজনেই এতোটাই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম যে, কান্না তো দূরের কথা এমনকি কথা বা চিৎকার করতেও ভুলে গেলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে কেবল দাঁড়িয়ে রইলাম। পরে কোনোরকমের তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আমরা আহত আংকেলের স্ত্রী ও মায়ের অবস্থা জানতে চাইলাম। শিক্ষিকা জানালেন, স্ত্রীর অবস্থা খুবই খারাপ। কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে অসময়ে গর্ভপাতে তার একটা বাচ্চাও নষ্ট হয়ে গেছে। তবে তার মা খুবই ধৈর্যশীল। তিনি এখনো শক্ত আছেন। হ্যাঁ, এই মা খুবই ধৈর্যশীল। দৃঢ় মানসিকতার। অবাক করা তার সহ্যশক্তি। ইতোপূর্বেও তিনি এক সন্তান হারিয়েছেন। আর এখন তার দ্বিতীয় ছেলে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে অথচ তিনি এর মধ্যেও নিজেকে সামলে রেখে ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিদের সান্ত¡না দিচ্ছেন। সবাই এটা পারে না। নিরেট আল্লাহ নিবেদিত বান্দী না হলে কোনো মায়ের পক্ষে এতোটা সবর করা সম্ভব না। মানুষ তাকে সালফিতের বীরাঙ্গনা বলে। সবদিক বিবেচনায় এটাই তার যোগ্য উপাধি।
এভাবেই ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোতে একেকটা বিয়োগান্ত ঘটনার জন্ম হয়। প্রায় দিন।
মাস কয়েক পরে আমি সেই চাচাকেই স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেলাম। ততোদিনে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। দুটো লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি হাঁটছিলেন। সাথে আমাদের ম্যাডামের স্বামী তার সেই বন্ধুসহ আরো কয়েকজন প্রতিবেশী। আমি এভাবে তাকে দেখে অবাক হয়ে ভাবছিলাম- কী আশ্চর্য সহনশীল লোক। কী অসীম তার মনোবল। কতো উঁচু পর্যায়ের বীর তিনি। আমার দৃষ্টিতে এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারাই বীরত্ব। বিদ্বেষের পরিবর্তে আশাবাদ এবং হতাশার বিপরীতে প্রত্যাশা লালন করতে পারাই প্রকৃত সাহসিকতা।
তেলাওয়াত
এই জীবনে সে দিনটির কথা কখনো ভুলবো না। সকাল থেকেই দিনটি বেদনাজর্জরিত ছিলো, কারণ আমার ছোট ভাইটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। আম্মু তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। বাড়ি ফিরতে অনেক সময় লেগে গেলো তার। এদিকে আবার প্রচ- মানসিক চাপ শুরু হলো। মাগরিবের আজানের মাত্র ঘণ্টা তিনেক বাকি, এখনো ইফতারের কোনো ব্যবস্থাই করা যায় নি। আমরা সবাই আম্মুকে ইফতার তৈরীর কাজে সহায়তা করতে লাগলাম। সবাই মিলে কাজ করায় খুব কম সময় থাকা সত্ত্বেও আজানের আগেই সব রেডি হয়ে গেলো। আমরা সবাই দস্তরখানের চারপাশে বসে মুয়াজ্জিনের আজানের অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবার আগে আজান শোনার অপেক্ষায় আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এসময় হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার তীব্র আওয়াজে ঘর-বাড়ি কেঁপে উঠতে লাগলো। আমি দেখলাম আগুনের কু-লি যেনো আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে এসময় গোলাগুলির আওয়াজ ছুটে আসতে লাগলো।
এমন সময় হঠাৎ আমাদের কান প্রায় স্তব্ধ হয়ে এলো। কারণ কাছেই কোথাও বিকট আওয়াজে বোমা বিস্ফোরিত হতে লাগলো। আব্বু বললেন, এটা বিশেষ শ্রেণির ইসরাইলি সেনাদের হামলা। আমরা সবাই দ্রুত শোবার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। কারণ সেটাই ছিলো অধিক নিরাপদ। এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগাতার গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেলো। আমার বড় ভাই আমাদের ভয় কমানোর জন্য মজার মজার জোকস্ বলতে শুরু করলেন, যা শুনিয়ে প্রায়ই তিনি আমাদের মন ভালো করে দিতেন। তিনি সুর করে গল্প বলতে শুরু করলেন, কল্পনায় যেনো বাস্তব কোনো ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা। ভাইয়া বলতে থাকলেন, ‘এই তো সৈনিকের হাত ট্রিগারে আটকে গেলো… আর সে গুলি ছুড়তে পারবে না!… বা ট্রিগারে হাত রেখে সৈনিকটি ঘুমিয়ে গেলো ইত্যাদি ইত্যাদি।… একটু পর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে গেলে আমরা শোনতে পেলাম, মৃদু কণ্ঠে মা কুরআন তেলাওয়াত করছেন।
আমাদের সান্ত¡না দিতে প্রতিবেশী খালামণি ছুটে এলেন। জানালেন, গোলাগুলি থেমে গেছে। ইসরাইলি পশুগুলি জেরিকোর উদ্বাস্তু শিবিরের পুলিশ ফাঁড়ি আর তাঁবুগুলোতে আক্রমণ করেছে। সেখানে খুব ভয়াবহ অবস্থা। সেই রাতে ভয়ে আমার আর ঘুম এলো না। বারবার মনে হচ্ছিলো একবার যেহেতু হামলা চালিয়েছে, জেরিকো শহরের প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে না দিয়ে বর্বর ইসরাইলিরা থামবে না।
তবে যে কারণেই হোক, ওরা সে রাতে আর হামলা করে নি। প্রায় দিনই ঘুরেফিরে ফিলিস্তিনের কোথাও না কোথাও এমন হামলা-জুলুম চলতেই থাকলো, যেমন আমার মায়ের মৃদু কণ্ঠের তেলাওয়াতটা প্রতিনিয়ত জারি থাকে। খারাপ কিছু ঘটা শুরু হলেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কুরআনের এই আয়াত- ‘হে নবী, আপনি বলে দিন, আমাদের ভাগ্যে মহান আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তার বাইরে কিছুই আমাদের স্পর্শ করে না।’ যে-কোনো বিপদে আম্মুর স্থিরচিত্ত আর প্রশান্ত চেহারা দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। আশ্চর্য মা আমার।
মা
আসরের আজান শুরু হলো, উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে লাগলো মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ। উম্মে মুহাম্মদ প্রতিবেশী নারীদের সাথে বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠোনে বসে উলের সুতা কাটছিলেন। কথা বলছিলেন, আকসার শহীদদের নিয়ে। ছেলে মুহাম্মদকে নিয়ে। ইসরাইলিদের বোমাবাজি, অবরোধ আর নিজেদের অসহায়ত্ব নিয়ে। স্বামীর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া, তার এক প্রিয়জনের সাক্ষাতে যেতে না পারার ব্যর্থতা, মাত্র মাইল কয়েক দূরের মায়ের বাসায় পর্যন্ত না যেতে পারা এবং দিনদিন বেড়ে চলা উদ্বেগসহ নানাকিছু নিয়ে তার কথা বলা চলতে লাগলো। এসব আলাপ করতে করতেই তারা স্মরণ করছিলেন মাস কয়েক আগের পরিস্থিতিগুলো নিয়ে। বিয়েশাদির আনন্দ, সৌভাগ্য ইত্যাদি নিয়ে কী দারুণ সময়ই না কাটছিলো তাদের। অথচ আজ কী বিচ্ছিরি অবস্থা চারপাশে…।
আমরা বাইরে পুরুষদের পায়ের আওয়াজ শুনছিলাম। তারা মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। পাশেই শিশুরা বল খেলছিলো, তাদের হাসি-চিৎকারের আনন্দধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো। উম্মে মুহাম্মদ এবার তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন নিজের সন্তানদের খোঁজ করতে। হুড়োহুড়ির মধ্যেই বাচ্চাদের খোঁজ করলেন। কয়েক পলক শিশুদের দেখে তিনি মুহাম্মদের অনুপস্থিতি টের পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মুহাম্মদ কোথায়? বাচ্চারা একটু ইতস্তত করলো। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করলো। একজন এরপর বললো, মুহাম্মদ সম্ভবত বড়দের সাথে বাজারের দিকে গেছে, যেদিকটায় ঝামেলা চলছে। ইসরাইলি হায়েনারা সেখানে সমানে গুলি ছুড়ছে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করছে, বোমা ফাটাচ্ছে আর আমাদের ছেলেরা পাথর হাতে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছে।
প্রতিবেশী এক মহিলা বলে উঠলেন, আল্লাহ তাদের হেফাজত করুন। এরপর কথাবার্তা থেমে গেলো। একটু পর হঠাৎ করেই হাসপাতালের দিকের রাস্তা থেকে চিৎকার ও হুল্লোড়ের আওয়াজ ছুটে এলো, উম্মে মুহাম্মদের অন্তর মোচড় দিয়ে উঠলো, ছেলে মুহাম্মদের আবার কিছু হলো না তো? ভয়ার্ত সাদা পায়রাগুলো মসজিদের উপরে চক্কর দিতে শুরু করলো। শিশুরা সব নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশী নারীদের হাতগুলো নিস্তেজ হয়ে এলো। এসময় মোবাইল বেজে ওঠায় উম্মে মুহাম্মদের হৃদয়টা ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো। ফোন রিসিভ করে তার মনে হলো দূর থেকে ব্যস্ত গলায় কেউ যেনো বলছে তারই ছেলে মুহাম্মদ আহত হয়েছে এবং পাশের হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়েছে।
বাড়িজুড়ে হঠাৎ বিষাদ ছেয়ে গেলো। উম্মে মুহাম্মদ চরমভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন, বুঝতে পারছিলেন না তার এখন কী করা উচিত বা কী বলা উচিত। প্রতিবেশী নারীরা নানান কিছু বলে তাকে সান্ত¡না দিতে লাগলেন।
তিনি হাসপাতালে পৌঁছলেন। কর্তৃপক্ষ সাথে সাথেই তাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। তিনি ছেলের কাছে প্রায় দৌড়ে গেলেন এবং জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। কেঁদে কেঁদেই তিনি বলতে লাগলেন, জানটা আমার, কোথায় তোর গুলি লাগলো? কেমন লাগছে তোর? পুরো শরীরটা জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতরে যেনো আড়াল করে ফেলতে চাইলেন। চুমোয় চুমোয় মুহাম্মদের শরীর ভরিয়ে দিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ তো কোনো জবাব দিচ্ছে না। একটাও কথা বলছে না। নড়ছে না পর্যন্ত। উম্মে মুহাম্মদ লক্ষ করলেন, শরীর তার বরফের মতো শীতল। উজ্জ্বল হাসিতে চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। উম্মে মুহাম্মদ চিৎকার করে উঠলেন, হায় আল্লাহ, আমার ছেলে!… আমার ছেলের কী হয়ে গেলো… কোথায় হারিয়ে গেলো আমার ছেলে…।
মুহাম্মদের বন্ধুরা চারপাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্ত¡না দিতে লাগলেন, আমরা আপনার ছেলে। মুহাম্মদ তো মারা যায় নি। মুহাম্মদ জীবিত।
কী ভয়াবহ সেই দুঃসহ মুহূর্তগুলো। পুরুষরা চারপাশে জড়ো হয়ে শান্ত-শীতল কণ্ঠে কোরাস ধরলেন, রক্ত এবং জীবনের বিনিময়ে, আমরা তোমাকে উৎসর্গ করলাম হে মুহাম্মদ! নারীরাও গুনগুনিয়ে তাতে কণ্ঠ মেলালেন। উম্মে মুহাম্মদকে সবরের প্রতি উৎসাহিত করলেন। শীতল পবিত্র কণ্ঠের কোরাসে হাসপাতালজুড়ে অন্যরকম এক আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না কেউ…।
প্রতিবেশী এক নারী এসময় কান্নাভেজা কণ্ঠে গান ধরলেন-
হে উম্মে মুহাম্মদের হৃদয়, তোমাকে সালাম। উম্মে মুহাম্মদের সৌভাগ্য, তোমার প্রতিও সালাম। হে ইতিহাস সৃষ্টিকারী মা, আমাদের চারপাশের এতোসব খুন-সন্ত্রাস-বোমাবাজির ত্রাস সত্ত্বেও দান ও কুরবানির ক্ষেত্রে তুমিই তো ফিলিস্তিনের আদর্শ। তুমি তোমার প্রিয় সন্তান হারিয়েছো, কিন্তু তুমিই তো তার আরশের পাশে জায়গা পাবে হে ভাগ্যবতী!
Leave a Reply