দয়া, শব্দবোধ
‘দয়া’ একটি কেজো বিশেষ্য, অকেজো নয়; তার দ্যোতনা নিছক ‘ভাব’-এ সীমায়িত করা তাই সঙ্গত হবে না – দয়াবিষয়ক এ প্রস্তাবটি দয়া করে গ্রহণ করুন, যাতে আমার দয়াগাঁথাটি স্বচ্ছন্দ হয়, কেননা ‘অপরের দুঃখ দূর করা’- এ আভিধানিক নির্ণয় শব্দটির অর্থের মনোগত সীমায়নের পক্ষে নয়। তাই ‘দয়া’ ধারণ করে যে মন দয়াময়, তাকে তার অন্তর্গত তাগিদ ছড়াতে হয় বিশ্বময়।
কাজেই বিবিধ অভিধায় প্রকাশ্য যে দয়া, কৃপা, করুণা, অনুগ্রহ, অনুকম্পা, সমবেদনা ও পরদুঃখকাতরতার আবেগ – জগৎ ও জীবনে ফলিত না হলে, সত্যের পটে মুদ্রিত না হলে – গভীর ইতিবাচকতা ধারণ করেও, তা চমৎকার ব্যর্থ সেই রঙধনু, যাতে আমাদের কোনো কাজ নেই।
আমরা দয়াশীলতার ফলন চাই। স্বীকারের অর্ঘ, যে-চাষী বীজ না বুনে ঘরে বসে আয়েশের হুঁকো টানেন তাঁর পটুতাকে নয়, বাস্তবতার জমিনে নিষ্ঠা ও শ্রমে দয়াশীলতার বীজ যিনি রোপন করেন তাঁর প্রেমকেই দেব।
আল্লাহর দয়া
দয়াময় স্রষ্টা তা-ই করেছেন। দয়া দিয়ে গড়েছেন সব। পৃথিবীর তাবৎ ধর্মগ্রন্থ তা-ই বলছে। কুরআনে ‘দয়াময়’ নামে একটা সূরা আছে, যাতে দয়াকে বলা হয়েছে সৃষ্টির কারণ। এ বিষয়টিকে যদি দর্শনের কার্যকারণ সূত্রের পরম্পরায় এনে ভাবি, কী দাঁড়াচ্ছে? পরমাণু থেকে আল্লাহ পর্যন্ত একটা মৌলরেখা। মানবীয়-অমানবীয় সকল আবেগ ছাড়িয়ে সেখানে উঠে এসেছে দয়া।
আল্লাহ তাই বলেছেন, তাঁর অপার দয়া ঘিরে আছে সবকিছু। এক আল্লাহ বহু নাম নিয়েছেন, তাতে তাঁর পরম একত্ব ক্ষুণ্ন হয় নি, সৃষ্টির চোখে মহিমান্বিত হয়ে ফুটেছে।
এ নামগুলোর তাৎপর্য নিয়ে ভাবলে দেখি, অসীম বিস্তার নিয়ে আছে দয়াবোধ। শক্তি ও জ্ঞান মৌলিক গুণ সত্ত্বেও, দয়াময়তাই কুরআনে বহূক্ত। তাই আল্লাহর প্রধান গুণবাচক পরিচয়, তিনি রাহমান বা দয়াময়।
দয়া ও মানবতা
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এত উচ্চমাত্রার বুদ্ধিমত্তা মহাজগতের কোথাও নেই। তাই কুরআনের কেন্দ্রীয় আলোচ্য মানুষ।
কেননা মানুষের জন্যেই ধর্ম, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়। আল্লাহই মানুষকে এ গুরুত্ব দিয়েছেন, এবং যতটা দিয়েছেন, মানুষ মানুষকে ততটা দেয় নি।
পৃথিবীর সমস্ত মতবাদকে ইসলামের পাশাপাশি রেখে নিরীক্ষণ করলে তা-ই দেখা যায়। কুরআন মানুষকে আল্লাহর রঙে রাঙাতে চায়, যে-রং সুন্দরতর। মানুষের মনন ও সৃজনশীলতার এত বড় স্বীকৃতি আর কোথাও নেই।
এভাবেই মানুষের মানবতাবোধের চেয়ে কুরআনের শেখানো মানবতাকে ঐশিক চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে আমরা একটি পূর্ণতর মাত্রায় উন্নীত হতে দেখি। আর সে ঐশিক চেতনার সমগ্রতা জুড়ে রয়েছে দয়া। সঙ্গত কারণেই আমরা প্রমাণ করতে সমর্থ হই যে, মানবতাবাদেরও শেকড় হলো দয়া। কাজেই দয়া ছাড়া ধর্ম হয় না। প্রেম ছাড়া মানুষও মানুষ হতে পারে না।
রিসালাত ও দয়া
মানুষের কাছে আল্লাহর আনুগত্যের আহ্বান নিয়ে যুগে যুগে যত নবী-রাসূল এসেছেন, সবাই ছিলেন মানুষ। রাসূল হিসেবে তাঁদের সৃষ্টি করা হয় নি, তাঁরা মানুষের ঘরে মানুষ হয়েই জন্মেছিলেন।
সময়ে আল্লাহ তাঁদের রাসূল মনোনীত করেন। এ মনোনয়নের ভেতরে লক্ষণীয় কারণ, তাঁরা ছিলেন খুবই দয়াশীল। বিভ্রান্ত মানুষকে উচ্ছেদ করেন নি, ভালোবাসা দিয়ে সত্যের পথে ডেকেছেন।
আল্লাহর কথা বলতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, তবু ক্ষুব্ধ হন নি। ক্ষমা করেছেন। দয়া দেখিয়েছেন। শৈশব থেকে দয়াশীলতার অব্যাহত অনুশীলনের ভেতর দিয়েই তাঁদেরকে রিসালাতের জন্যে পরিণত করে গড়ে তোলা হয়েছে।
মহানবী, দয়ার প্রতিরূপ
হযরত মুহাম্মাদ– তাঁর প্রতি সালাম- ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ছিলেন। পথহারা মানুষকে সুন্দর জীবনের আয়তনে টেনে তুলবার ব্রত নিয়ে যুগে যুগে বহু সাধকই আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে মহানবীর পার্থক্য, তিনি যেন নিজেই ছিলেন আলো। মানুষকে পথ দেখাবেন বলে এলেন, যেখানে আদতে কোনো পথই ছিল না; পাথর কেটে পথ তৈরি করতে হলো।
একটা অন্ধকার সময়ে, একটা দুর্গত অঞ্চলে তাঁর জন্ম, কিন্তু তিনি কোনো বিশেষ সময়ের, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্যে রাসূল নন; তিনি অনাগত সকল সময়ের, সকল দেশের, সব মানুষের। তিনি বিশ্বনবী। সারা বিশ্বের আদর্শ।
বিশ্বাসীদের ইমাম। এক আল্লাহর আনুগত্য ও সার্বভৌমত্বের বিশ্বায়নের আহ্বান নিয়ে তিনি যে-আন্দোলনের ডাক দেন, তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে দশদিগন্তে, বদলে যায় অর্ধ পৃথিবী। ইসলামের এ বিপ্লবই পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম বিপ্লব। খ্রিস্টবাদ গির্জাবন্দী হয়েছে, ইহুদি হয়েছে উদ্বাস্তু উৎপীড়ক, কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে মানবরচিত কত ধর্ম ও মতবাদ, সর্বশেষ সমাজতন্ত্রও মুখ থুবড়ে পড়ল, আর আজকের সর্বহারা মানুষ পুঁজিবাদের কবর খুঁড়ছে- কিন্তু ইসলামের জয়যাত্রা অপ্রতিরোধ্য। এ শক্তির উৎস আল্লাহর দয়া, মানুষের ভালোবাসা।
ইসলাম মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, আর ইসলামের নবী বিশ্বাসের সুতো দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন প্রাণের সঙ্গে প্রাণ। অন্ধকারে যারা মারামারি করছিল, তিনি তাদের বললেন:
শোনো! আমি প্রেমের বারতা নিয়ে এসেছি। আল্লাহ আমাকে বলে পাঠিয়েছেন, তোমরা যে মূর্তিপূজো করছ, রক্তপাত করছ, এ খুবই খারাপ। ফিরে এসো। দেখো, আমি আলো নিয়ে এসেছি। পাঠ করো প্রভুর নামে। আর মানুষকে ভালোবাসো। তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।
এই আহবায়কই হলেন মুহাম্মাদ। বিশ্বপ্রভুর রহমত। রহমত মানে দয়া। এ দয়ার কোনো চৌহদ্দি নেই।
এই রহমত অবারিত। মানুষ, গাছ, পশু-পাখি-পতঙ্গ, প্রকৃতি-পরিবেশ ও মহাজগৎ সবার জন্যেই রহমত। আল্লাহ নিজে সেই সাক্ষ্য দিয়েছেন, রাসূলও তা উচ্চারণ করেছেন। আমরাও তাহলে পাঠ করে নিই।
রাসূলকে উদ্দেশ করে সূরা আম্বিয়ার ১০৭ সংখ্যক আয়াতে আল্লাহ বলছেন: ‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’
কুরআনের বিশেষ বাগভঙ্গি অনুযায়ী এ আয়াতে রাসূলকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত হিসেবে প্রেরণ ছাড়া অন্য কোনো বিবেচনায় প্রেরণের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, রাসূল যে বিশ্বের জন্যে রহমত, এ বক্তব্য কী রকম জোর দিয়ে বলা হয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম, মানুষ-অমানুষ, প্রাণী-পদার্থ নির্বিশেষে সবার জন্যেই দয়া। দয়ার কী আশ্চর্য বিশ্বায়ন!
অতঃপর সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪ সংখ্যক আয়াতে এর বিশেষায়ণ হয়েছে:
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের নিজেদেরই মধ্য হতে রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পড়ে শোনায় ও তাদের পবিত্র করে। তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শেখায়। যদিও তারা ইতোপূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।’
মহানবীর দয়া
সময়ের প্রয়োজনে সাধারণভাবে সাময়িক সমাজবিপ্লব হতেই পারে, কিন্তু একটা জাতির সকল ব্যক্তিমানুষকে বিশ্বাস ও চরিত্রে আমূল বদলে দিয়ে ভেতর থেকে নতুন করে গড়ে তুলে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রবিপ্লব সাধন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার- রাসূল সা. সেটি সার্থকতার সঙ্গেই করেছেন, বিশ্ববিপ্লবের সূচনা করে গিয়েছেন।
আল্লাহর সাহায্যের পাশাপাশি মুখ্য যে অনুঘটক এর মূলে ক্রিয়মান ছিল, তা হলো রাসূলের বিনম্র স্বভাব, সৃষ্টির প্রতি দয়া ও মানুষের জন্যে মমতা।
সূরা আলে-ইমরানের ১৪৯ সংখ্যক আয়াতে স্পষ্টত বলা হয়েছে:
‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহেই তুমি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত; যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর হতে, তবে তারা তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যেত।’
সূরা তাওবার ১২৮ সংখ্যক আয়াতেও রাসূলের চরিত্র-মাধুর্য, সমবেদনা, শুভকামানা ও দয়াশীলতার উল্লেখ করে বলা হয়েছে:
‘তোমাদের মধ্যে এসেছে তোমাদেরই মধ্যকার এমন একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ যার কাছে দুঃসহ। তিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী, বিশ্বাসীদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’
রাসূলের দয়াদর্শন যথাযথ উপলব্ধির জন্যে তাঁর কথা ও কাজ দুটোই সামনে রাখতে হবে। আমরা তাই কিছু বিশুদ্ধ হাদীস উদ্ধৃত করছি:
জারীর ইবন আব্দুল্লাহ থেকে, রাসূল বলেছেন: আমি মুমিনদের খুবই ঘনিষ্ঠ, এমনকি তাদের নিজেদের চেয়েও। অতএব যে ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা যায় তার ঋণ শোধের দায়িত্ব আমার। আর যদি সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তা তার উত্তরাধীকারীদের। (সহীহ বুখারী-৬৭৩২, সহীহ মুসলিম-২৩১৯।)
জারীর ইবন আব্দুল্লাহ থেকে, রাসূল বলেছেন: যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না। (সহীহ মুসলিম-২৩১৯।)
সাহাবী আমর ইবন আব্দুল্লাহ থেকে, রাসূল বলেছেন: যারা অন্যের প্রতি দয়া করে, আল্লাহ তাদের দয়া করেন। যারা পৃথিবীতে আছে তোমরা তাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনিও তোমাদের দয়া করবেন। দয়া হলো আল্লাহর নৈকট্য, যে এতে পৌঁছুতে পারল সে আল্লাহর কাছে পৌঁছে গেল, আর যে তা কেটে ফেলল সে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল। (তিরমিযী-১৯২৪।)
বিশিষ্ট ইহুদি প-িত আব্দুল্লাহ ইবন সালামের প্রতি লক্ষ করুন। রাসূল মদীনায় এলে তিনি গিয়ে দেখা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথম যে কথাটি আমি তাঁর মুখ থেকে শুনলাম, তা হলো:
হে মানবম-লি! সালামের প্রচলন করো, (অভুক্ত) মানুষকে খাবার দাও, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখো। (তিরমিযী-২৫৮৫।)
আসলে সৃষ্টির প্রতি দয়া আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা ইসলামের মূল শক্তি। রাসূল দুর্গত মানুষের সাহায্যকে সবচেয়ে বড় ইবাদত বলেছেন। বলেছেন: যে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে তৃপ্তির সঙ্গে খায়, সে মুসলমান নয়।
তিনি আর্তজনের সেবা, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, বিপন্নকে উদ্ধার করা, ঋণগ্রস্তকে সাহায্য করা, অভাবী ও এতিমকে আশ্রয় দেওয়া, প্রতিকারের শক্তি থাকা সত্ত্বেও শত্রুকে ক্ষমা করা ইত্যাদি মানবিক চরিত্রের পূর্ণতা সাধন করে গিয়েছেন।
যে নবী মানুষের দুঃখ সইতে পারতেন না, আমরা তাঁরই অনুসারীরা আজ নির্দয় ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। মানুষের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা ছাড়া যে আল্লাহকে পাওয়া যায় না, এটি ভুলে যাচ্ছি।
মানবতার দৃষ্টান্ত দেখুন:
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ মসজিদে নববীতে ইতিকাফ করছিলেন। এক ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল। তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করে জানলেন, সে ঋণগ্রস্ত। তারিখ পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শোধ করতে পারছে না। আব্দুল্লাহ দাঁড়িয়ে গেলেন, জুতো পরে বেরিয়ে এলেন মসজিদ থেকে। আগন্তুক তখন বাধা দিয়ে বলছিলেন, এ কী! আপনি না ইতিকাফে আছেন। জবাবে তিনি আঙুল তুলে রাসূলের কবর দেখিয়ে বললেন, ওই ওখানে যিনি শুয়ে আছেন, আমি তাঁকে বলতে শুনেছি:
যে-কেউ তার ভাইয়ের সাহায্যের জন্যে পা বাড়ায়, তাঁকে দশ বছর ইতিকাফের সাওয়াব লিখে দেওয়া হয়।
এই হলো ইসলামের মানবপ্রেম। এমনই ছিল ইসলামের নবী আর তাঁর সাথীদের দয়াদর্শন।
এই ঘটনার আয়নার সামনে আমরা যদি নিজেদেরকে, এমনকি আজকের মাওলানা, পীর, তসবি-জপা ধার্মিকদের দাঁড় করিয়ে দেই, তাহলে কি লজ্জায় মাথা নুয়ে আসবে না?
অমুসলিমদের প্রতি দয়া
বিশ্বমানবতার শান্তির বারতা নিয়ে এসেছে ইসলাম, শুধু মুসলমানদের নয়; তেমনি ইসলামের নবীও শুধু মুসলমানের নবী নন, তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের। তাই তাঁর কর্মনীতি ও দয়াশীলতার বিস্তারও ছিল যথার্থই সর্বজনীন।
ভেবে দেখুন সেই মূর্তিপূজক বেদুইনের কাণ্ড, যে মসজিদে নববীর ভেতরে প্রশ্রাব করছিল। সবাই হতভম্ব। ওমর উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দয়ার আদর্শ নিয়ে যিনি এসেছিলেন, তিনি বললেন- থামো! ওকে প্রশ্রাব শেষ করতে দাও। অতঃপর রাসূল নিজে পানি ঢেলে মসজিদ ধুয়ে দিলেন। তিনি লোকটিকে বুঝিয়ে বললেন কেন তার এ কাজ ঠিক হয় নি; এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। বেদুইন তাতে খুশি হয়ে বলল:
হে আল্লাহ! আমাকে ও মুহাম্মাদকে অনুগ্রহ করুন, আমাদের ছাড়া অন্য কাউকে নয়। তার এ অম্ভুত দুয়া শুনেও রাসূল তাকে ভর্ৎসনা করলেন না, কটু কথা বললেন না। একজন স্নেহশীল অভিভাবক ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষকের মতো শুধু এটুকুই বললেন- ব্যাপক বিস্তৃত একটা বিষয়কে তুমি সংকীর্ণ করে দিলে। (সহীহ বুখারী-৬০১০।)
মহানবীর এ উদার জীবনদর্শনই মানুষকে ইসলামের দিকে আকর্ষণ করেছে, সত্যবোধ জাগিয়ে তুলেছে। সেই বেদুইনের কথাও হাদীসে এসেছে, যে খোলা তরবারি নিয়ে রাসূলের ওপর চড়াও হয় যখন তিনি গাছের ছায়ায় একাকী ঘুমুচ্ছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূলের হাতে সে কাবু হয়ে যায় এবং আত্মসমর্পন করে। তিনি তাকে হত্যা করতে পারতেন, বন্দি করে নিয়ে যেতে পারতেন, ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করতে পারতেন – কিন্তু দয়ার নবী সেসব কিছুই করলেন না। শুধুই দয়া করলেন। নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিলেন। পরে লোকটি স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়ে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করে এবং অনেক মানুষ তার হাতেই ইসলামের দীক্ষা নেন। (সহীহ বুখারী-২৯১০।)
একইভাবে ইহুদি পণ্ডিত যায়েদ ইবন সাইয়া, যে মহানবীকে যাচাই করবার ফন্দি নিয়ে এসেছিল। নবী তাকে শুধু ক্ষমাই করেন নি, ওমরকে বললেন: ওকে কিছু পুরস্কার দাও।
আবু হুরায়রা বলেন, রাসূলকে বলা হলো: হে রাসূল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে দুয়া করুন। জবাব দিলেন, আমাকে কারও অমঙ্গল কামনার জন্যে পাঠানো হয় নি। পাঠানো হয়েছে জগতের রহমত হিসেবে। (সহীহ মুসলিম-২৫৯৯।)
তায়েফের মর্মান্তিক ঘটনা সবাই জানি। তিনি তো সেখানে আল্লাহর কথা বলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত করে দেওয়া হলো। আল্লাহর আদেশে পাহাড়ের ফেরেশতা এসে বললেন- আদেশ করুন, দু পাহাড় এক করে এদের পিষে ফেলি। নবী বললেন: না, এদের পরপ্রজন্ম তো ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। (সহীহ বুখারী-৩২৩১।)
এই হলো ইসলামের প্রেম ও মানবদর্শন। আজ ইসলামকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা হচ্ছে, অথচ কুরআন-সুন্নাহর কোথাও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় নি, বারণ করা হয়েছে।
যে-নবী অমুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে গিয়েছেন, তাঁর উম্মত কী করে সাম্প্রদায়িক হতে পারে! ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, সর্বপ্রথম মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘুরা সমান রাষ্ট্রীয় সুযোগ ও মর্যাদা পেয়েছিল।
আজ তাঁর উত্তরসূরীরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপবাদ মাথায় নিয়ে বেড়াচ্ছে। এর কারণ, আমরা মহানবীর দয়াদর্শন থেকে ছিটকে পড়েছি। আমদানি করা অপসংস্কৃতির রং মেখে সঙ্ সেজেছি, ভুলে গেছি আমাদের আসল আত্মপরিচয়।
নারীর প্রতি গুরুত্ব ও দয়া
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত,
রাসূল বলেছেন: হে আল্লাহ! আমি দুই দুর্বলের অধিকারের ব্যাপারে ভয় করি- এতিমের অধিকার ও নারীর অধিকার। (আন-নিহায়াহ ফী গারীব আল-হাদীস-৩৬১/১।)
আমির ইবনুল আহওয়াস বলেন, তিনি রাসূলের সঙ্গে বিদায় হজ্বে অংশ নিয়েছিলেন। সেই ভাষণে রাসূল বলেছেন: আমি নারীদের সঙ্গে সুন্দর আচরণের জন্যে তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছি। তারা তোমাদের জীবনসঙ্গী। তোমরা এ (সাহচর্য) ছাড়া তাদের আর কিছুর মালিক নও। (ইবন মাজা ২৯৮/২।)
আনাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী কারীম মদীনায় নিজের স্ত্রীদের ও উম্মে সুলাইমের ঘর ছাড়া অন্য কোনো নারীর ঘরে প্রবেশ করতেন না। তাঁকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন- আমি তার প্রতি দয়া-মমতার কারণে তাকে (উম্মে সুলাইমকে) দেখতে যাই। কারণ তার ভাই আমার সঙ্গে থেকে নিহত হয়েছে। (সহীহ বুখারী-২৮৪৪।)
এতিম ও বিধবাদের প্রতি দয়া
একদিন এক ছোট্ট ছেলে নবীর কাছে নালিশ নিয়ে এল। শীর্ণকায়। গায়ে জীর্ণবস্ত্র। এমনিতেই রাসূল শিশুদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তার ওপর ছেলেটি এতিম। তিনি কাছে ডেকে তার কথা শুনলেন। সে বলল, আবূ জাহল তার পৈত্রিক সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। শুনে ক্রোধে রাসূলের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। ছেলেটির হাত ধরে ছুটলেন আবূ জাহলের বাড়ির দিকে।
একাকী নিরস্ত্র অবস্থায় তিনি যে তাঁর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রুর মুখোমুখি হচ্ছেন, নিজের নিরাপত্তার কথা একবার ভাবলেন না। গিয়ে মেঘগম্ভীর স্বরে আবূ জাহলকে বললেন- ‘এ ছেলেটির সম্পত্তি ঠিকঠাক বুঝিয়ে দাও।’ আবূ জাহল হকচকিয়ে গেল। রাসূলের দৃঢ়তায় প্রভাবিত হলো সে। ফিরিয়ে দিল এতিমের সম্পদ।
রহমতের নবী জীবনভর অসহায়দের সাহায্য করে গিয়েছেন। মানুষের কষ্ট তিনি সইতে পারতেন না। তাঁর অনুসারী সাহাবাদের সবসময়ই তিনি দুর্গত মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ করতেন।
আবু হুরাইরা বলেন, রাসূল সা. বলেছেন: বিধবা ও অভাবী মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্যে যে কিছু করতে চায়, তার মর্যাদা আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের মতো অথবা ওই ব্যক্তির ন্যায় যে সারারাত সালাতে কাটায় ও দিনে রোযা রাখে। (সহীহ বুখারী-৫৩৫৩, সহীহ মুসলিম-২৯৮২।)
আব্দুল্লাহ ইবন আবি আওফা বলেন: রাসূল সারাক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। অনর্থক বিষয় পরিহার করতেন। সালাত দীর্ঘ করতেন। খুতবা সংক্ষেপ করতেন এবং বিধবা ও অভাবী লোকদের প্রয়োজন পূরণে বের হতে দেরি করতেন না। (নাসাঈ-১৪১৫।)
উল্লিখিত হাদীসগুলো পাঠ করে আমরা দেখি রাসূল বিধবা ও অভাবী লোকদের কী আন্তরিকভাবে সাহায্য করতেন, তাদের প্রয়োজন পূরণে কতটা দয়ার্দ্র ও মমতাময় ছিলেন তিনি।
শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি দয়া ও মমতা
আনাস ইবন মালিক বলেন: এক বৃদ্ধ রাসূলের কাছে এলেন। উপবিষ্টরা তাঁকে জায়গা করে দিতে দেরি করল। তখন নবী কারীম সা. বললেন- যে শিশুদের ভালোবাসে না ও প্রবীণদের সম্মান করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (তিরমিযী-১৯১৯।)
আমর ইবন শুআইব তার পিতা থেকে, তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন: যে ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা দেখায় না, আর বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (তিরমিযী-১৯২০।)
আইশা বলেন, একবার রাসূলের কাছে একদল বেদুইন এল। তাদের একজন বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শিশুদের চুমু খান? আমরা তো তা করি না। রাসূল জবাবে বললেন- আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে দয়া-মায়া উঠিয়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে আমি কী করতে পারি?
একবার ঈদের দিন মহানবী কোথাও যাচ্ছিলেন। মাঠে শিশুরা খেলছিল। কিন্তু একটি বালক ওদের সঙ্গে না মিশে একাকী বিষণœমুখে মাঠের এক কোণে ছিল বসে। নবী ছেলেটির কাছে গেলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। জিজ্ঞেস করলেন: তোমার মন খারাপ কেন? সে বলল: আমার বাবা নেই। আর মা ফের বিয়ে করে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। আমার আর কেউ নেই। করুণার নবী গভীর মমতামাখা কন্ঠে বললেন-
তুমি কি খুশি হবে, যদি মুহাম্মাদ তোমার বাবা আর আয়িশা তোমার মা হন? শুনে ছেলেটি আনন্দে কেঁদে ফেলল। রাসূল তাকে কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
আমরা মনে করে দেখতে পারি সেই বৃদ্ধ মহিলার কথা, যে নবীকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে রোজ রোজ তাঁর পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। নবী সেই কাঁটা সরিয়ে পথ চলতেন। একদিন তিনি দেখলেন, পথে কাঁটা নেই। ভাবলেন, বোধহয় বুড়ি আজ ভুলে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় দিনও একই ব্যাপার, পথে কাঁটা নেই। এবার তাঁর সন্দেহ হলো, নিশ্চয়ই বুড়ি অসুস্থ। রাসূল তাঁকে দেখতে গেলেন। যা ভেবেছিলেন, তা-ই। বুড়ি অসুস্থ। তিনি তার সেবা-শুশ্রƒষা শুরু করলেন। তাকে সুস্থ করে তুললেন। বুড়ির ধারণা পালটে গেল। সে ভাবল, আমি যাকে কষ্ট দিতে চাই, তিনিই আমার কষ্ট দূর করতে লেগে গেলেন। ভালো মানুষ না হলে এ কি হয়! অতঃপর দয়ার আদর্শে মুগ্ধ হয়ে বুড়ি ইসলাম গ্রহণ করে।
ছাত্রদের প্রতি দয়া ও স্নেহ
আবু সায়ীদ খুদরী বলেন, রাসূল সা. বলেছেন: জ্ঞান অর্জনের জন্যে তোমাদের কাছে অনেক সম্প্রদায় আসবে। যখন তোমরা তাদের দেখবে, স্বাগত জানিয়ে বলবে- ‘আল্লাহর রাসূলের নির্দেশক্রমে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি।’ আর তাদের শিক্ষা দেবে। শিক্ষায় সাহায্য করবে। (তিরমিযী-২৬৫০, ইবন মাজা-২৪৭।)
মালিক ইবন হুয়াইরিস বলেন: আমরা সমবয়সী কয়েকজন যুবক নবী কারীম সা.-এর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে এলাম। বিশ দিন বিশ রাত কাটালাম। রাসূল ছিলেন আমাদের খুবই দয়ার্দ্র ও স্নেহপরায়ন শিক্ষক। যখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের কাছে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছি, তখন তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন আমরা বাড়িতে কাদের রেখে এসেছি। তিনি বললেন: ‘তোমরা তোমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাও। তাদের কাছে অবস্থান করো। তাদের শিক্ষা দাও।’ (সহীহ বুখারী-৬২৮,৬৩১।)
মুআবিয়া ইবনুল হাকামের বিষয়টি দেখুন। তাকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে রাসূল বেনজির ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
মুআবিয়া নিজেই বলেন: ‘আমার পিতা-মাতা তার জন্যে উৎসর্গিত হোন, আমি তাঁর মতো শিক্ষক কখনো দেখি নি। আল্লাহর কসম! (আমি অন্যায় করা সত্ত্বেও) তিনি আমাকে ধমক দিলেন না, প্রহার করলেন না, তিরস্কার করলেন না।’ (সহীহ মুসলিম ৫৩৭।)
দেখুন, জ্ঞান অর্জনে নিমগ্ন ছাত্রদের প্রতি রাসূল কত দয়ালু ও স্নেহপরায়ণ ছিলেন। বস্তুত, ইসলামের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য একটি আলোকিত অধ্যায়।
কয়েদিদের প্রতি দয়া
আবু মূসা আশআরী বলেছেন, রাসূল সা. বলেছেন: ‘বন্দিদের মুক্ত করে দাও। ক্ষুধার্তকে খেতে দাও। অসুস্থদের সেবা করো।’ (সহীহ বুখারী-৩০৪৬।)
বন্দীরা শত্রুশিবিরেরই হয়ে থাকে। তাদের প্রতিও রাসূলের এ উন্নত মানবিক আচরণ আধুনিক পৃথিবীকে কঠিন আত্মজিজ্ঞাসার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
রোগীদের প্রতি সহানুভূতি
আবূ হুরাইরা থেকে উদ্ধৃত, তিনি বলেন: আমি শুনেছি মহানবী বলেছেন-
মুসলমানের প্রতি মুসলমানের ছয়টি অধিকার রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো: হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী কী? তিনি বললেন: যখন দেখা হবে সালাম দেবে। যখন সে তোমাকে দাওয়াত দেবে, তুমি সাড়া দেবে। পরামর্শ চাইলে পরামর্শ দেবে। হাঁচির উত্তর দেবে। আর যখন সে অসুস্থ হবে তখন তার সেবা করবে এবং মারা গেলে দাফন-কাফনে অনুগামী হবে। (সহীহ বুখারী-১২৪০, ২১৬২।)
আলী বলেন, আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: কোনো মুসলমান অপর অসুস্থ মুসলমানের সেবা করতে এলে ফেরেশতারা তার জন্যে দুয়া করতে থাকে। আর জান্নাতে তার জন্যে একটি বাগান তৈরি করা হয়। (তিরমিযী-৯৬৯।)
এ সকল হাদীস দ্বারা আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, নবী কারীম রুগ্ন ব্যক্তিদের প্রতি কতটা দয়ালু ছিলেন। শুধু তাই নয়। তিনি উম্মতকে শিখিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন রোগাক্রান্ত মানুষকে সেবা করতে, তাদের প্রতি আন্তরিকতা দেখাতে।
বস্তুত, আর্তমানবতার সেবায় ইসলাম যে-ত্যাগের শিক্ষা উপস্থাপন করেছে, রাসূল যে-গভীর মমত্ববোধের আদর্শ ও কর্মনীতি রেখে গিয়েছেন, তা অনুসরণ করে আমরা আমাদের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার মৌলিক সংকটগুলি কাটিয়ে উঠতে পারি।
পশুপাখি ও উদ্ভিদের প্রতি দয়া
মানুষ যেমন আল্লাহর সৃষ্টি, তেমনি সমস্ত প্রাণীও। তাই মানুষের জীবন রক্ষা যেমন পুণ্যের কাজ, তেমনি পশুপাখি ও উদ্ভিদের প্রতিপালন ও পরিচর্যাও সাওয়াবের কাজ। এগুলি পরিবেশের ভারসাম্য ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ইসলাম তাই পশুপাখি ও উদ্ভিদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছে। বিপরীতপক্ষে অকারণে পশু হত্যা, পাখি শিকার ও গাছ কাটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
আবু হুরাইরা নবী কারীম থেকে বর্ণনা করেন: এক ব্যভিচারী নারী পিপাসায় মৃতপ্রায় একটি কুকুর দেখতে পেল। সে নিজের পায়ের মোজা খুলে তাতে ওড়না বেঁধে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে বাঁচাল। এ কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। (সহীহ বুখারী-৩৩২১।)
আব্দুল্লাহ ইবন উমার বলেন, রাসূল বলেছেন: জনৈক মহিলা একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। ফলে সে না খেয়ে মারা যায়। এ অপরাধে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করলেন। কেননা কেউ না দিক, বেঁধে না রাখলে তো বিড়ালটি খাবার কুড়িয়েও খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত। (সহীহ বুখারী-২৩৬৫; সহীহ মুসলিম-২২৪৩।)
আনাস থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন: যদি কোনো মুসলমান বৃক্ষরোপণ করে, শস্য চাষ করে, অতঃপর তা থেকে কোনো পশুপাখি খাবার খায়, তাহলে এটা তার জন্যে সাদকাহ হিসেবে আল্লাহর কাছে গচ্ছিত থাকবে। (সহীহ বুখারী-২৩২০; সহীহ মুসলিম-১৫৫২।)
ইবন উমার থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন: যে-কেউ যথাযথ কারণ ছাড়াই কোনো পাখি হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসেব নেবেন। (নাসাঈ-৪৪৪৫।)
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন: আমরা এক সফরে রাসূলের সঙ্গে ছিলাম। একসময় একটু প্রয়োজনে দূরে গেলাম। দেখলাম একটি লাল পাখি, সঙ্গে দুটো বাচ্চা। আমরা বাচ্চা দুটো ধরে নিয়ে এলাম। কিন্তু মা-পাখিটিও চলে এল। বাচ্চা দুটোর কাছে আসার জন্যে পাখিটি মাটির কাছে অবিরাম উড়ছিল। তখুনি রাসূল এসে পড়লেন। তিনি এটি দেখে বললেন- কে এ বাচ্চা ধরে এনে এদের মাকে কষ্ট দিচ্ছে? যাও, বাচ্চা দুটো মায়ের কাছে রেখে এসো। (আবু দাউদ ১৪৬/২।)
জাবির ইবন আব্দুল্লাহ বলেন: রাসূল সা. একটি গাধার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যার মুখম-লে লোহা পুড়িয়ে দাগ দেওয়া ছিল। তিনি বললেন- যে এটিকে লোহা দিয়ে দাগ দিয়েছে তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত!
সীরাতের আয়নায় আমাদের মুখ
কুরআন আল-হাকীম মানুষের প্রতি আল্লাহর দেওয়া পরিপূর্ণ ও শেষ জীবনবিধান, যার সব দিগদর্শনই রাসূল মুহাম্মাদ সা. তাঁর জীবনে বাস্তবায়ন করে এর প্রয়োগযোগ্যতা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ফলে তাঁর জীবনও তেমনি বিস্তার নিয়েছে।
তাঁর চরিত্রে প্রজ্ঞা, সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, পরোপকার, ধৈর্য, ত্যাগ, নেতৃত্ব, উদার জীবনবোধ প্রভৃতি মানবিক গুণাবলির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল। আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্যের পথরেখা তিনি একেবারে নিখুঁতভাবে এঁকে গিয়েছেন। মানবজীবনের সকল দিক ও প্রেক্ষিত তাঁর মহান আদর্শে আলোকিত হয়েছে।
আমরা রাসূল হিসেবে তাঁর ওপর ঈমান এনেছি, ফলে মনের ভেতর এক ধরণের অধিকারবোধ তৈরি হয়েছে। সেই অধিকারেই রাসূলের আলোকিত আদর্শের প্রশস্তি গাইছি। কিন্তু আলোটা নিচ্ছি না। মানবরচিত মতবাদের কুয়াশায় ঘুরপাক খাচ্ছি।
কেবলই নতুন নীতি তৈরি করছি, কিছুদিন পরে সময় সেই নীতিকে নাকচ করে দিচ্ছে, সেটি ছুঁড়ে ফেলে নতুন আরেকটি গড়ছি। আমরা থামছি না, শুধুই ভাঙছি আর গড়ছি। কিন্তু যিনি আমাদের গড়েছেন, তাঁর গড়া নিয়মে আস্থাশীল হতে না পারার মধ্যে যে হীনমন্যতা আছে, সেটি ভাঙছি না। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রিক সঙ্কট দেখা দেয় নি, ইসলাম যার সমাধান দিতে পারে না।
আজকের পৃথিবীতে মানবতাবাদী সংগঠনের অভাব নেই। সব দেশেই তা আছে। কিন্তু মানবতার বড়ই অভাব। অথচ রাসূল যেখানে তাঁর দয়াদর্শন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই সমাজে এ অভাব ছিল না। বরং রাসূলের গড়া মানবগোষ্ঠীই সর্বকালের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ সম্প্রদায়। মুসলমানদের অনুকরণীয় নবীই শিক্ষা, সুনীতি ও মানবতাবাদের জনক, কিন্তু আত্মভোলা মুসলমান আজ সভ্যতা শিখতে প্রবৃত্তিপূজারিদের দ্বারস্থ হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? কে দায়ী? এ কি ইসলামের নীতির দুর্বলতা, না নীতি মানতে-না-পারার ব্যর্থতা?
আজকে আমরা রাসূলের যে দয়াদর্শন আলোচনা করলাম, এরপর যখন গাড়িতে উঠে দেখব একজন বৃদ্ধ আসন না পেয়ে দুর্বল শরীরে কোনো রকমে হাতল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন কি সেই মহামানুষের কথা মনে পড়বে, যিনি প্রবীণদের সম্মান ও দয়া দেখাতে বলতেন?
খেতে বসে কি পাশের দরিদ্র লোকটির খবর নেবার তাগিদ বোধ করব? আমাদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান, আমরা কি ভাবতে পারি না কীভাবে এ সমাজের ভিক্ষুকদের স্বাভাবিক জীবনে টেনে আনা যায়? এ কি অসম্ভব? তাহলে রাসূল কীভাবে একটি কুঠার কিনে দিয়ে একটি জীবনকে বদলে দিয়েছিলেন?
আমরা সরকারকে কর দিই, তাই কি ভাবি রাস্তার কাগজ-কুড়োনো ছেলেটার প্রতি আমাদের কোনো দায় নেই, সরকারই এদের পুনর্বাসন করুক?
মহাজীবনের ডাক
এতক্ষণ মহানবীর মহাজীবনের শুধু একটি দিকের ওপর আমরা কিছুটা আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছি। আমরা পাঠ করেছি ইসলামের আলোকায়নের মহামন্ত্র। দেখেছি মহামানবের সুন্দর জীবনগঠনের কর্মসূত্র। আঁচ করেছি মানবাত্মার অজস্র-বিচিত্র অনুভবের ভেতর থেকে বেছে বের করে আনা এই একটিমাত্র আবেগের শক্তি কী করে বদলে দিতে পারে সারা পৃথিবী।
সেই আবেগ, সেই দুর্বার শক্তি আর কিছু নয়- দয়া।
দয়ার শক্তিতেই ইসলাম একটি শক্তিমান জীবনব্যবস্থা। এ শক্তিগুণেই সে তাগুতের ওপর জয়ী হয়েছে, পদানত করে নিয়েছে বহু সাম্রাজ্য। দয়ার শক্তিতেই নির্ভর করছে ইসলামের সমস্ত সম্ভাবনা। এ শক্তিতেই মহিমান্বিত আল্লাহর অস্তিত্ব।
দয়ার নীতিকে পাথেয় করেই মুহাম্মাদ সা. হয়েছেন বিশ্বনেতা। কাজেই আমরাও দয়াশীলতা আত্মগত করেই যথার্থ মানুষ হয়ে উঠতে পারি, হতে পারি বিশ্বনাগরিক।
লেখক: আবদুল হক
কবি ও প্রাবন্ধিক।
শিক্ষক: শাহবাগ জামিয়া মাদানিয়া, জকিগঞ্জ, সিলেট।
[নতুন ডাক, 2014]
Leave a Reply