মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন। আম-খাস দুই মহলেই তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তার ক্লাসে ছাত্ররা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, বয়ানে বসলে মুসল্লিদের ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। বই-কিতাব হাতে নিলে মাথা নুয়ে আসে শ্রদ্ধায়। কেনো, মাদরাসার স্বাভাবিক পরিবেশে থেকে, সব বাঁধা ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে কীভাবে সাধারণ এই মানুষটিই মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন হয়ে উঠলেন-এসব জানতে সম্প্রতি তার মুখোমুখি হয়েছিলো নতুন ডাক। আজকের ছাত্র ও তরুণ আলেমদের নিয়ে তার ভাবনা-প্রত্যাশা; সিলেবাস, পাঠদানপদ্ধতি ও বাঙালি আলেমদের ভবিষ্যত ভাবনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে আলোচনায়। আছে আরো কিছু মৌলিক আলোকপাত। তাঁতীবাজার ইসলামিয়া মাদরাসার অফিসে বরেণ্য এ আলেমের সাথে দীর্ঘ সময় কথা হয়। আলোচনার চুম্বকাংশ থাকলো আপনারই জন্য- শাকিল আদনান।
শাকিল আদনান : আপনার সফল কর্মজীবন নিয়ে বলুন। বেশ ক’টি দিক নিয়ে আপনি একসাথে কাজ করেছেন এবং আমাদের বিবেচনায় আপনি খুবরকম সফলও। সাফল্যের পথে এই যাত্রা কি সচেতন পরিকল্পনা থেকে, না কাজ করতে করতে একসময় দেখলেন হয়ে গেছে?
মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন : আমার জীবনের কাজের মধ্যে একটা ছিলো ইমামত। এখন নেই। ইমামত করার ব্যাপারে আমার কোনো পরিকল্পনা কখনো ছিল না। ঘটনাচক্রে একটি মসজিদের কর্তৃপক্ষ আমাকে অনুরোধ করলে ইমামতে এসে যাই। আর একটা কাজ হলো খেতাবাৎ। খেতাবাৎ বলতে জুমার বয়ান, ঈদের বয়ান ও অন্যান্য বয়ান-এগুলো আমি পরিকল্পনামতোই করেছি। ইসলাম যেরকম জামে’, আমি চেষ্টা করেছি ইসলামের এই ব্যাপকতা পরিপূর্ণভাবে মুসল্লিদের সামনে উপস্থাপন করতে। যাতে তারাও বুঝতে পারে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান আছে। তথাকথিত কিচ্ছা-কাহিনী বলে বয়ান শেষ করা বা প্রচলিত ওয়ায়েজরা যা করেন, আমি কখনো এটি করিনি। এগুলোই পরে ‘নির্বাচিত বয়ান ও খুৎবা’ নামে একটি বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এতে আমি প্রায় সবগুলো দিকের বয়ান সন্বিবেশিত করার চেষ্টা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ, হয়েছেও। সারাদেশের ইমাম সাহেবরাও এটা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষকতাও পরিকল্পনা করেই করেছি। করছি। আর লেখালেখিটা সবসময় যে পরিকল্পনা থেকে লিখেছি তা বলা যাবে না। দু’একটি লেখা বিচ্ছন্নভাবেও হয়েছে। তবে লেখালেখির সিংহভাগই আমি করেছি নির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা থেকে।
সমাজে যে বিষয়টির প্রয়োজন আছে কিন্তু কেউ লেখেনি, আমি সেটি নিয়েই লিখেছি। ভবিষ্যতেও যা লেখার পরিকল্পনা আছে তা এই চিন্তা থেকেই।
শাকিল আদনান : ইমামতে আপনার অনাগ্রহের কারণ কী ছিলো?…
মাওলানা হেমায়েত : ইমামতের ব্যাপারে আমি যেটা বুঝতাম যে, এক্ষেত্রে পরাধীনতা বড় বেশি। আর স্বভাবগতভাবে পরাধীনতা আমার কাছে অসহনীয়। তাই ইমামত নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। তবে মসজিদ কমিটি উদ্যোগী হয়ে প্রস্তাব করলে আমি কিছু শর্তারোপ করি এবং এর সবই তারা মেনে নেয়। ফলে ইমামতিও করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তো পরাধীনতা থাকে।
বিশেষ করে সময়ের পরাধীনতা। সময় মতো উপস্থিত থাকতে হয়। ইচ্ছেমতো কোনো প্রোগ্রামে যাওয়া যায় না। কাজে জড়ানো যায় না। আমি দীর্ঘদিন ইমামত করেছি, প্রায় তেইশ বছর এবং আলহামদুলিল্লাহ, অন্য অনেকের চেয়ে স্বাধীনভাবেই করেছি।
তবে দীর্ঘদিন হয় যাওয়ায় এই স্বাধীনতাটাকেও পরাধীনতা মনে হতে থাকায় শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছি।
শাকিল আদনান : আপনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে সেগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই বৈচিত্র্যময়। আপনি কোন্ অ্যাঙ্গেল থেকে বিষয় নির্বাচন করেন?
মাওলানা হেমায়েত : সমাজে যে বিষয়টির প্রয়োজন আছে আমি সে অ্যাঙ্গেল বা দৃষ্টিকোণ থেকেই লিখি। যেমন আমাদের এখানে দেশি-বিদেশি অনেক মতবাদ আছে। সবাই বলে এই মতবাদ খারাপ, ওরা ভ্রান্ত। কিন্তু কী কারণে, কেনো- এটা কেউ বলে না। এখান থেকে আমার অনুভবে এলো, এ সম্পর্কে এমন একটি বই হওয়া উচিত যাতে সব ভ্রান্তমতের বিস্তারিত পরিচিতি-বিবরণ থাকবে। পরে দলীলসহ লিখলাম-‘ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ’।
তাছাড়া ছাত্রজীবনে দু’টো বিষয় লক্ষ করেছি। পড়ানোর সময় বিভিন্ন নবী-রাসূলের আগমন-জন্মস্থান ইত্যাদি খোলাসা করা হয় না। উস্তাদদের কাছে প্রশ্ন করলে বলেন এটা আরব দেশের একটা জায়গার নাম। এর বেশি কিছু বলেন না। কিন্তু বিষয়টি তো স্পষ্ট হওয়া দরকার।
কোন্ নবী কোন্ গোত্রে এলেন, এর আগের ও বর্তমান নাম কী, অবস্থান অতীতে কোথায় ছিলো বর্তমানে কোথায় আছে তা চিহ্নিত করা দরকার। অস্পষ্ট থাকবে কেন? তাই এই পরিকল্পনা থেকেই ‘কুরআন ও ইসলামী ইতিহাসের মানচিত্র’ করলাম।
এমনিভাবে ছাত্রজীবনে অনেক কিতাবে নফসিয়্যাতি কথাবার্তা পেয়েছি। উস্তাদরা বলেছেন, তাফসীরের কিতাবাদিতেও বিভিন্ন নফসিয়্যাতি আলোচনা আছে।
নফসিয়্যাত মানে মনোবিজ্ঞান। এটা নফসিয়্যাতি উসূল, এটা নফসিয়্যাতি বিষয়, ইসলামী নফসিয়্যাত ইত্যাদি তাবীর প্রায়শই আলোচিত হয়। তখন আমার মনে জাগলো, ইসলামী নফসিয়্যাতের টুকরো টুকরো বিষয়গুলোকে যদি জুড়ে দেয়া যায় তাহলে তো এটা স্বতন্ত্র একটা শাস্ত্র হতে পারে।
জেনারেল সাইকোলজিতে ওরা অনেক অগ্রসর। তারা এটাকে স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে রূপ দিতে পারলে আমরা কেনো পারবো না। ছাত্রজীবন থেকেই এটার ওপর লেখা শুরু করেছি। শেষ করতে প্রায় দশ বছর লেগেছে। এর অর্থ এই না যে দশ বছর শুধু এটাই লিখেছি! সহযোগী কিতাবাদি না পাওয়ায় সময় বেশি লেগেছে।
এরপর ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এটাতো শাশ্বত বাস্তবতা। আমরাও নানা কথা প্রসঙ্গেই এটা বলে থাকি। কিন্তু এমন কোনো বই আমি পাইনি যাতে ইসলামের সবগুলো সাইট আছে। হযরত থানভী রহ. এক জায়গায় বলেছেন
ইসলামের বিধানগুলো পাঁচভাগে বিভক্ত। কিছু আকাইদ সম্পর্কিত, কিছু ইবাদত সম্পর্কিত, কিছু মুআমালাত সম্পর্কিত, কিছু মুআশারাত সম্পর্কিত এবং কিছু আখলাকিয়্যাত সম্পর্কিত- এ পাঁচ ধরনের।
তো আমি এমন কোনো বই পাইনি যাতে ইসলামের এ পাঁচ ধরনের আলোচনা আছে, যা পড়ে মানুষ বুঝতে পারে ইসলাম আসলেই পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তাই আমি ‘আহকামে যিন্দেগী’ লিখেছি।
শাকিল আদনান : এখন কী নিয়ে কাজ করছেন বা পরিকল্পনায় আর কী কী আছে?
মাওলানা হেমায়েত : এখন আমার পরিকল্পনায় আছে ইসলামী ইতিহাস ও ভূগোল। এখানেও আমি একটা শূণ্যতা অনুভব করি। যেমন,
ইসলামী ইতিহাস নামে যে বইগুলো আছে তার মধ্যে শুধু রাজা-বাদশাহদের ক্ষমতা দখলের লড়াই-শাসনব্যবস্থা ইত্যাদির আলোচনা আছে। অথচ ইসলামের তালীম-তারবিয়্যাত, তাহযীব-তামাদ্দুন, দাওয়াত ও তাবলীগ, তাযকিয়া এগুলো নেই। এগুলোও তো ইতিহাসের অংশ।
এগুলোরও আলোচনা হওয়া উচিত সমান গুরুত্ব দিয়ে। এই আঙ্গিকেই আমি কাজ শুরু করেছি। তেমনি ইসলামী ভূগোল। এর উপর তো কোনো বইই নেই। ইসলামী মনোবিজ্ঞানের মতো এটাও একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্র হতে পারে। আমি চেষ্টা করছি এটাকে স্বতন্ত্র শাস্ত্রে রুপ দিতে- যাতে ইসলামের দৃষ্টিতে সবকিছুর ভৌগলিক পর্যালোচনা সম্ভব হয়। এরপর ভূগোল বুঝতে যেসব তথ্য-উপাত্ত এবং প্রাথমিক ধারণা দরকার তাও যেনো চলে আসে।
এভাবে আমি আমার মৌলিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই অমার লেখালেখির কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ, যতোটুকু পেরেছি তা আল্লাহর অনুগ্রহ…।
শাকিল আদনান : আপনি লেখালেখি ও বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে দারুণ একটি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলেন। অন্য সবার মতো মাদরাসার স্বাভাবিক পরিবেশেই আপনি বড় হয়েছেন, তো আপনার মধ্যে এই সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গিটা কীভাবে তৈরি হলো?
মাওলানা হেমায়েত : আসলে লেখকের সচেতনতা বা লেখকের মনে ভাব উদিত হওয়া এটা মিনজানিবিল্লাহ হয়ে থাকে। আল্লাহর পক্ষ থেকে লেখার একেকটা বীজ এসে যায়। এই বীজটাকে রূপন করে, সংরক্ষণ করে, আস্তে আস্তে পরিচর্যা করে বড় করে তুলতে হয়।
লেখক তো অসলে জন্ম হয়, তৈরি করা যায় না। লেখকের মনোবৃত্তি বা লেখার একটা ভাব জাগ্রত হওয়া এটাও আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।
শাকিল আদনান : মাদরাসায় শিক্ষকতা এবং মসজিদ সামলেই আপনি এ কাজগুলো করেছেন, করছেন। সাধারণত আলেমরা বলে থাকেন, এ দুটো সামলে অন্য কিছু করার কোনো সুযোগ থাকে না। আপনি কী মনে করেন বা এক্ষেত্রে তাদের করণীয় কী হতে পারে?
মাওলানা হেমায়েত : দুটো কাজ করতে হবে। একটা হল সময় নষ্ট না করা। সময় নষ্ট না করলে সময়ের অনেক বরকত হয়। আমরা তো অনেক সময় নষ্ট করি। গল্প, আড্ডা, অহেতুক কাজে বসে থাকি। সময় নষ্ট না করলে বরকত পাওয়া যায়। আরেকটা বিষয় হল অর্থনৈতিক ধান্ধা। সার্বক্ষণিক টাকা আয়ের টেনশন। কীভাবে টাকা কামানো যায়।
ইমামরা ধান্ধায় থাকে কীভাবে মিলাদ, দোয়া করে টাকা বাড়ানো যায়। অর্থের পেছনে না পড়ে মৌলিক কাজে সময় ব্যয় করা উচিৎ। রিযিক তো আল্লাহর হাতে, তাকদিরে যা আছে তাই আসবে।
চেষ্টা অবশ্য করতে হবে। তবে জীবিকার পেছনে চেষ্টাটা সাধারণ রেখে পড়াশোনা ও গবেষণায় সময় বেশি ব্যয় করা উচিত।
শাকিল আদনান : সাধারণ শিক্ষায় দেখা যায় একটা পর্যায়ে গিয়ে ছাত্ররা কর্মজীবনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মাদরাসা শিক্ষায় এই ধাপ কোনটি বা কোন পর্যায় থেকে বিষয়টিকে সামনে আনা যায়?
মাওলানা হেমায়েত : আসলে ছাত্রজীবনে কর্মজীবনের কথা বেশি ভাবতে নেই। ছাত্রজীবনে গভীর মনোযোগের সাথে শুধু পড়াশোনা করবে। এটা করেই তো শেষ করা যায় না, কর্মজীবন-আয় ও উপার্জনের কথা ভাববে কখন? ফারেগ হওয়ার পর কর্মজীবন। ছাত্রজীবনের কাজ কেবল যোগ্যতা অর্জন করা।
আয়-উপার্জনের জন্য তো মাদরাসা শিক্ষা নয়। এটা এমন শিক্ষাও নয় যা দিয়ে সরকারী চাকুরী বা প্রশাসনিক দায়িত্ব পাওয়া যাবে। আর কর্মজীবনে গিয়ে কীভাবে ইলম প্রয়োগ করা যায় সে ফিকির করবে। ওয়াজের মাধ্যমে, দরস-তাদরীসের মাধ্যমে, লেখালেখির মাধ্যমে- যার যেরকম যোগ্যতা আছে। আমাদের মাদরাসাগুলোয় এজন্যই বক্তৃতা অনুষ্ঠান-দেয়ালিকা প্রকাশ এসব করানো হয়।
সুতরাং ছাত্রজীবনে কর্মজীবনের চিন্তা মাথায়ই আনা যাবে না। এতে ছাত্রের যোগ্যতা গঠনে প্রতিবন্ধকা সৃষ্টি হয়।
শাকিল আদনান : কর্মজীবন বলতে শুধু অর্থনৈতিক বিষয়ই তো নয়, ওয়ারিসে নবী হিসেবে যে কাজগুলো করতে হবে তার জন্য যোগ্যতা অর্জনের ব্যাপারও তো আছে।
মাওলানা হেমায়েত : হ্যাঁ, ওয়ারিসে নবী হিসেবে যেগুলো দরকার যেমন বক্তৃতা প্রশিক্ষণ-লেখালেখি প্রশিক্ষণ, মুরবিবদের মাধ্যমে তাযকিয়াহ-এগুলো তো সব জায়গায় হচ্ছে। এসব তো গুরুত্ব দিয়ে করতেই হবে।
একসময় মাদরাসাগুলোয় সংকির্ণতা ছিলো, এখন তো কোনো মাদরাসায় এমন হয় বলে মনে হয় না।
শাকিল আদনান : বাড়তি পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক মাদরাসা কঠোরতা আরোপ করে, বাইরের কিছু পড়ার সুযোগ দেওয়া হয় না।…
মাওলানা হেমায়েত : হ্যাঁ, অনেক মাদরাসায় বাধ্যবাধকতা আছে। কারণ, আউট পড়াশোনা বা জ্ঞানচর্চার জন্য অবাধে ছেড়ে দিলে ছাত্ররা আসল পড়াশোনা বাদ দিয়ে যে কোন বই পড়তে থাকে। তাই মাদরাসাগুলো একে আম করে না।
খারেজি পড়াশোনা করতে হবে দরসিয়্যাতকে মজবুত রেখে। তাহলে মাদরাসা বা উস্তাদরা বাঁধা দেবে না। আমি ছাত্রাবস্থায় হাজারের ওপর সাহিত্যের বই পড়েছি। আমাকে তো উস্তাদরা বাঁধা দিতেন না। কারণ তারা দেখেছেন ছেলেটি ক্লাসে নম্বরে আউয়াল। পড়াশোনা ঠিক রেখে পড়ছে। একটা ছাত্র যদি উস্তাদের গাইডে চলে তাহলে তো সমস্যা নেই।
ছাত্রাবস্থায় দুটো কাজ- পড়াশোনা করা এবং উস্তাদের দিকনির্দেশনা মোতাবেক চলা। উল্টাপাল্টা বই পড়লে চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে এবং মূল পড়া নষ্ট হয়। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মূল পড়া নষ্ট করে তো এক্সট্রা পড়ার অনুমতি দেওয়া যায় না। তাহলে ফরজ ছেড়ে নফল নিয়ে দৌঁড়াবে।
শাকিল আদনান : আপনার খারেজি মুতালার সূচনা কখন-কীভাবে? নিজেই শুরু করেন না কারো মাধ্যমে?
মাওলানা হেমায়েত : আমার খারেজি মুতালার সূচনা আমার বন্ধু ও বড় ভাই মাও. মাহমুদুল হাসানের মাধ্যমে, খুলনার। আমি যখন মীযান জামাতে পড়ি, তখন থেকেই এক্সট্রা পড়াশোনা-লেখালেখি শুরু।
শাকিল আদনান : আপনার ছাত্রজীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়ে বলুন…
মাওলানা হেমায়েত : ছাত্রজীবনে আমি কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি নি। তাই আলাদাভাবে সাফল্য ব্যর্থতা নির্ণয়ের সুযোগ হয়নি। সাফল্য-ব্যর্থতা সবারই থাকে। তবে আল্লাহর রহমতে যে কাজেই হাত দিয়েছি, সফল হয়েছি। আমার ছাত্রজীবনকেও আমি সফলই মনে করি।
শাকিল আদনান : হযরত, সময়টার বিষয়ে ক্লিয়ার হতে চাইছিলাম। ছাত্রজীবনের কোন্ সময়টায় এসে পড়াশোনার পাশাপাশি ভবিষ্যত কাজের জন্য একজন ছাত্র প্রস্তুতি শুরু করতে পারে?
মাওলানা হেমায়েত : ছাত্রজীবনে কর্ম নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগই নেই। একজন ছাত্র যদি পড়াশোনায় ভালো হয়, তাহলে তার চিন্তার কোনো কারণ নেই। ছাত্রের যোগ্যতাই তার ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে।
শাকিল আদনান : কাজ সম্পর্কে কোনো ধারণাই যদি না থাকে তাহলে তো অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হতে পারে…
মাওলানা হেমায়েত : মানুষ চলতে চলতে শিখবে। চলার পথে কিছু সমস্যা হতেই পারে। তাই চলতে চলতে শিখবে এবং যে লাইনে চলবে সে লাইনে আগে যারা চলেছে বা অভিজ্ঞ তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চলবে।
যে অঙ্গনে আমি চলিনি তার সম্পর্কে বুঝব কী করে? তাই চলতে চলতে শিখবে এবং এ অঙ্গনের যারা মুরব্বী তাদের থেকে মশওয়ারা নিয়ে চলবে।
আমি যখন ইমাম হলাম অনেক কিছুই জানতাম না। বড়দের পরামর্শ নিয়ে আস্তে আস্তে ঠেকে ঠেকে শিখেছি। সুতরাং ওটা নিয়ে ছাত্রাবস্থায় এতো ভাবার কিছু নেই।
শাকিল আদনান : আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনে দায়িত্বের চাপ ও ওয়ারাসাতের দায়বোধ কখনো মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে কি?
মাওলানা হেমায়েত : আমি মাদরাসায় পড়াচ্ছি এটাও তো ওরাসাতে নববীর কাজ।
নবুওয়াতের মূল দায়িত্ব হলো চারটি-তালীম-তাযকিয়া-তিলাওয়াত ও দাওয়াত। কুরআানের দুটো আয়াতে এটা বলা হয়েছে-‘য়ুআল্লিমুহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাতা ওয়া য়ুযাক্কিহিম’ এবং ইয়া আইয়ুহার রাসূলু বাল্লিগ মা উনযিলা ইলাইক’…। ওয়ারিসে নবীদেরকে এই চারটি কাজই করতে হবে।
এগুলোর মধ্যে আরো অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। যারা মাদরাসার দায়িত্বে আছে তারাও ওয়ারাসাতের কাজ করছে, যারা তাবলিগ করছে তারাও। যারা তাযকিয়ার লাইনে তারাও ওয়ারাসাতের কাজে লিপ্ত। তাই দায়িত্ব ও ওরাসাতের দায়বোধের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই।
তবে এটুকু বলা যায় যে, একজন একটা কাজে লিপ্ত হলে অন্যান্য কাজগুলো তাকে দিয়ে হয় না। এখানে তো ইনসান মুকাল্লাফ। কেউ একটা পারছে, কেউ অন্যটা- যার যার সামর্থ্যানুযায়ী।
শাকিল আদনান : অনেক সময় অভিযোগ করা হয় যে অন্যগুলোর প্রতি মোটেও খেয়াল করা হয় না।…
মাওলানা হেমায়েত : একটা হলো কাজ। আর একটা হলো সহযোগিতা।
আমি একা সব দায়িত্ব পালন করতে পারবো না। তবে যতোটা পারি অন্যদের সহযোগিতা করবো। আহলে হকদের প্রতিটি কাজে পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতা থাকতে হবে।
শাকিল আদনান : অনেকে তো সুযোগও নিয়ে থাকেন। বসে অলস সময় কাটান আর দাওাত-তাবলীগ বা অন্যান্য কাজের আহ্বান জানালে বলেন তিনি ইলমি কাজে ব্যস্ত কিংবা এজাতীয় বিভিন্ন অজুহাত…
মাওলানা হেমায়েত : আলেমদের সাচেতন হওয়া দরকার। অনেক আলেম দেখা যায় অনেক ব্যস্ত আবার অনেককে দেখা যায় অলস বসে আছে। এটা আলসেমি হতে পারে, হতে পার যোগ্যতার অভাব। তবে আলেম হিসেবে আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিৎ।
শাকিল আদনান : এমন মানসিকতার লোক আলেম সমাজে প্রচুর। দায়টা কি শুধু ব্যাক্তির না সামগ্রিকভাবে মোটামুটি সবার ওপর আসতে পারে, আপনার কি মত?
শাকিল আদনান : সামগ্রিকভাবে আলেম সমাজ কাজের প্রতি যত্নবান। আলসেমি বা যোগ্যতার অভাব এটা তো ব্যক্তিগত বিষয়, এর দায় সবার ওপর চাপানো ঠিক হবে না। আমি এক্ষেত্রে সবাইকে শুধু সচেতন হতে বলবো।
শাকিল আদনান: আবার ব্যক্তিগত বিষয়ে আসি। আপনি মৌলিক গবেষণার কাজ যেমন করেছেন, কিছু রম্য বা রস রচনার বইও আপনার আছে, এই সমন্বয়টা কী করে সম্ভব হলো?
মাওলানা হেমায়েত : আমার দুটো রম্য রচনার বই আছে। এগুলাতেও আসলে গবেষণার ছাপ আছে। এটাকে আমি রম্য আকারে পেশ করার চেষ্টা করেছি।
একসময় আমার ভেতরে একটা দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করতো। সব বিষয়কেই রস রচনা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। এমনকি ব্যাকরণের মতো বিষয়কেও।
এই বোধ থেকে তৎকালীন পাথেয় পত্রিকায় ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে লেখাও শুরু করেছিলাম। পত্রিকাটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর এগুনো হয়নি। তবে এই চিন্তাটা নিয়ে কাজ করা যায়। তরুণরা উদ্যোগী হলে ভালো করতে পারবে।
শাকিল আদনান: আপনার ‘চশমার আয়না যেমন’ বইয়ে প্রেম ও রোমান্টিসিজমের আলোচনা স্থান পেয়েছে। তো ইসলামী গল্প-উপন্যাস বা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় প্রেম ও রোমান্টিসিজমের উপস্থিতি ও উপস্থাপনা নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
মাওলানা হেমায়েত : আসলে প্রেম-রোমান্টিসিজমের দু’রকম ব্যাখ্যা আছে। সাধারণ অর্থে প্রেম বলতে শারিরীক বর্ণনা, সুড়সুড়িমূলক কথাবার্তা এসব বুঝানো হয়। এটা তো সবদিক থেকে ক্ষতিকারক। আলেমদের এসব নিয়ে না এগুনো উচিৎ।
তাছাড়া সাহিত্যের ধারা পুরো বদলে গেছে। পরিচিত শব্দ, সহজ ও ছোট বাক্যের গাঁথুনি এবং সাবলীল উপস্থাপনা না হলে আজকাল পাঠকরা গ্রহণ করে না।
এমনকি উপন্যাস সাহিত্যও এখন আর আগের মতো নায়ক-নায়িকা বা প্রেমনির্ভরতার ওপর থেমে নেই। সাহিত্যের ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত হয়েছে। জীবন-জগৎ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাষ্ট্র-সমাজ সব নিয়েই সাহিত্য হচ্ছে। সুতরাং শুধু প্রেমের ভাবনা নিয়ে আমি পড়ে থাকবো কেনো? তবে হ্যাঁ, আরেক অর্থে প্রেম-রোমান্টিসিজম হচ্ছে সাহিত্যের প্রাণ। আদর-সোহাগ, স্নেহ-প্রীতি, আবেগ-অনুভূতি, দু:খ-কষ্ট এসব ছাড়া তো সাহিত্য হয় না। সুতরাং আলেমদের রচনায় প্রেম থাকবে তবে তা পজিটিভ অর্থে।
তাছাড়া ইসলামী গল্প, ইসলামী উপন্যাস, ইসলামী সংগীত-এসবে ইসলামী শব্দ প্রয়োগের পক্ষপাতি আমি নই। এসবক্ষেত্রে ইসলামী শব্দ না লাগানো উচৎ। ক’দিন পর হয়তো ইসলামী নাটক, ইসলামী অভিনয় এগুলোও শুনতে হবে।
বিষয় ভালো হলে, উপস্থাপনার ধরনে বৈচিত্র্য এলে সবরকমের লেখাই ঠিক আছে। আমাদের আকাবিররাও তো গল্প লিখে গেছেন। এখন না হয় আমরা তা এই সময়ের ভাষায়, এই সময়ের ধারায় লিখলাম।
বিশেষ সাক্ষাৎকার, প্রথম পর্ব, নতুন ডাক, ২০১৩
Leave a Reply