চারপাশের অব্যাহত চাপে আমাদের অনুভূতিগুলো গ্যাসশূন্য বেলুনের মতো চুপসে গেছে। আনন্দ-বেদনা, বিস্ময়-হতাশা কিছুই আজকাল আর স্পর্শ করে না। রক্ত, লাশ, কান্না কাহাতক আর সহ্য করা যায়। জাতীয় জীবনে আমাদের এই দুঃসহ যাত্রা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে মনে করা কঠিন। আশংকার কথা, কবে কোথায় গিয়ে এই যাত্রা শেষ হবে কারো জানা নেই। সম্ভাবনার সামান্যতম আলোর দেখা নেই কোথাও।
দুঃসংবাদের অপেক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে থাকি, অজানা শংকায় সারাক্ষণ মন কাঁপে। জীবনের উল্টোগতিই যেনো আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নভেম্বরের [২০১৫] শেষদিকে এই যখন প্রিয় বাংলাদেশের বাস্তবতা, তখন হঠাৎই খবর এলো- এ্যাঙ্গোলায় ইসলাম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে। একইসাথে মসজিদগুলোও ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ছোট্ট খবর- মাত্র দুই লাইনের ব্যাপ্তি, কিন্তু তাতেই ঝড় ওঠলো বিশ্বজুড়ে। এই যুগেও এটা সম্ভব? বিস্ময়-উদ্বেগ-ক্ষোভ উথালপাথাল ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়লো কোটি মুমিনের অন্তরে। ভাসিয়ে দিয়ে গেলো বিশ্বাসের চরাচর। কোথায় এ্যাঙ্গোলা, ইসলাম আর মুসলিম ইস্যুটি তার কী এমন ক্ষতি করে ফেললো, মসজিদ কেনো ভেঙে ফেলতে হবে, কেমন আছে ওখানকার মুসলিমরা- এমন হাজারো প্রশ্নে ভরে উঠতে থাকলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কমেন্টবক্স। দেশে দেশে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো।
তবে, বড়ই পরিতাপের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম- মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পুরো ব্যাপারটাই আবার আড়ালে চলে গেলো। একদম উধাও, যেনো কিছুই হয়নি। খবরের সত্যাসত্য যাচাই, স্থানীয় মুসলিমদের খোঁজ, অভিযুক্ত ব্যক্তি-রাষ্ট্রের অবস্থান ও বক্তব্যসহ সার্বিক বিষয়ে বাস্তবমুখি কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা গেলো না; না কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, না প্রভাবশালী কোনো ইসলামি সংস্থার। কেনো?
এ্যঙ্গোলায় ইসলাম অবৈধ ও নিষিদ্ধ
এ্যঙ্গোলায় ইসলাম অবৈধ ও নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি প্রশাসনিকভাবেই প্রমাণিত। মসজিদ ভাঙা ও বন্ধ করে দেয়ার খবরও অসত্য নয়। গত ২২ নভেম্বর এ্যাঙ্গোলার সংস্কৃতি মন্ত্রী রোজা ক্রুসি এক বিবৃতিতে বলেন-
‘তার দেশের বিচার ও মানবাধিকার মন্ত্রণালয় ইসলামকে বৈধ ধর্ম বলে অনুমোদন দেয়নি। তাই পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত মসজিদগুলো বন্ধ থাকবে। তিনি আরো বলেন, ইসলাম ধর্ম অ্যাঙ্গোলার সাংস্কৃতিক প্রথাগুলোর সঙ্গে বৈপরিত্য রাখে বলে এই ধর্ম নিষিদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে’। এর ঠিক একদিন পর এ্যাঙ্গোলার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রতি জোসে এডোয়ার্ডো ডোস সান্তোস বলেন, এই পদক্ষেপ আমাদের দেশে ইসলামি প্রভাবের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি’।
তাদের এই বক্তব্যে এ্যাঙ্গোলায় ইসলাম নিষিদ্ধের ব্যাপারটি সাম্প্রতিক পদক্ষেপ মনে হলেও, বাস্তবে এটি স্থনীয় মুসলিমদের উপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা ধারাবাহিক নিপীড়নের একটা অংশ মাত্র।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এমন দুজন ব্যক্তির সরাসরি বক্তব্য এবং সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে শুধু রাজধানী লুয়ান্ডাতেই ২টি মসজিদ ভাঙা এবং অপর ৭টি মসজিদ বন্ধ করে দেয়ায় প্রথমবারের মতো বিষয়টি বিশ্বমিডিয়ার ব্যাপক কভারেজ লাভ করলো।
অন্যথায় মসজিদ ভাঙা ও বন্ধ করে দেয়ার কাজটি বহুদিন ধরেই সেখানে চলে আসছে।
কয়েক ডজন মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে
দুহাজার চার ও ছয় সালে রাজধানীতে ৪ টি মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১১ সালের নভেম্বরে সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা একটি মসজিদ মিনারসহ গুড়িয়ে দেয়া হয়। গত বছর মুসলিমরা নিজেদের কেনা জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণের আবেদন করেন। কয়েক মাস অপেক্ষা করেও সাড়া না পেয়ে তারা অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করলে কর্তৃপক্ষ এসে তা ভেঙে দেয়। ২০১২ সালেও একই অজুহাতে আরো একটি মসজিদ ভেঙে দেয়া হয়। জুটিও শহরের এমন অনেক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়, যেগুলোকে মুসলিমগণ অস্থায়ী মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করতেন। গত অক্টোবরেও লুয়ান্ডায় একটি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। সবমিলিয়ে গত কয়েক বছরে অনুমোদন না থাকার অজুহাতে এ্যাঙ্গোলায় কয়েক ডজন মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তালাবদ্ধ করা হয়েছে শত শত মসজিদ।
সম্প্রতি ইসলাম নিষিদ্ধকরণ ও মসজিদ ভাঙার খবর বেরুনোর প্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ায় এ্যাঙ্গোলান সরকার বিষয়টি অস্বীকার করে। এ্যাঙ্গোলায় ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি এবং দেশের সকল নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার সাংবিধানিকভাবেই প্রমাণিত- এমন বক্তব্যের পাশাপাশি কৌশলে তারা এও জানিয়ে দিয়েছে যে, কেবল ইসলাম নয় এমন আরো ১৯৪টি ধর্মমত সেদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়। অননুমোদিত ১০০০ ’রও বেশি ধর্মীয় স্থাপনার ব্যাপারে তাদের হাতে অভিযোগ আছে এবং পর্যায়ক্রমে তারা সেগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবেন’।…
সাময়িক চাপের মুখে তারা যাই বলুন, ব্যাপার আসলে একই। ধর্ম নিষিদ্ধ করা আর স্বীকৃতি না থাকার অজুহাতে যখন-তখন ধর্মেবিশ্বাসী নাগরিক ও ধর্মীয় স্থাপনার বিরুদ্ধে পদক্ষে নেয়ার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।
এ্যাঙ্গোলার সংবিধানে অন্যান্য আধুনিক রাষ্ট্রের মতোই জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের সংবিধানে বলা আছে-‘বিবেক, ধর্ম ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা অলংঘনীয় হবে। কাউকে তার ধর্মীয় বিশ্বাস, আদর্শিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করে বা উদাহরণ দিয়ে বিব্রত করা যাবে না। এমনকি রাষ্ট্রের তথ্যসংগ্রহের প্রয়োজন ছাড়া কাউকে তার ধর্মের বিষয়ে জিজ্ঞেসও করা যাবে না’।…
এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত থাকলেও কেনো সরকার ইসলাম নিষিদ্ধ করতে গেলো?…আলোচনাটা এই দৃষ্টিকোণ থেকে না করাই ভালো হবে। কারণ, ইসলাম সেখানে কখনো অনুমোদিত ছিলো না, সুতরাং নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটাই আসে না।
আজ পর্যন্ত এ্যাঙ্গোলান মুসলিমরা তাদের ধর্মের বৈধতার বিষয়ে সরকারের অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন- যার ভিত্তিতে তারা সেখানে মসজিদ ও অন্যান্য ইসলামি স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবেন, একটি বৈধ ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে সেখানে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করবেন কিংবা অন্যান্যদের মতো সকল ধর্মীয় অধিকার লাভ করবেন।
এ্যাঙ্গোলায় ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
এ্যাঙ্গোলা বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীর দেশ হলেও অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় অধিকার সেখানে অত্যন্ত সঙ্কুচিত। ১৯৯১ সাল থেকে স্থানীয় বিভিন্ন আদিবাসি ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ প্রায় ৯০০ ধর্মীয় গ্রুপ ও সংস্থা বৈধতার অনুমোদনোর জন্য আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছে। এক খবর অনুযায়ী, এ্যাঙ্গোলায় বর্তমানে ২০০০ ’রও বেশি ধর্মীয় গ্রুপ পরিচালিত হচ্ছে প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া। সর্বশেষ কোনো ধর্মীয় গ্রুপকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ২০০৪ সালে।
এ্যাঙ্গোলান সরকার প্রকাশ্যেই অনুমোদনের বিরোধিতা করে বা ধর্মীয় অধিকার লংঘিত করে ব্যাপারটি এমন নয়। পুরো অনুমোদন প্রক্রিয়াটি এমন একটা আইন ও সিস্টেমে পরিচালিত হয় যে, দু’চারটা ছাড়া অন্য কোনো ধর্মীয় গ্রুপ বা সংস্থার পক্ষে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করা প্রায় অসম্ভব।
আইন অনুযায়ী, একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পেতে হলে তার অধীনে কমপক্ষে এক লক্ষ প্রাপ্ত বয়ষ্ক সদস্য বা অনুসারী থাকতে হবে। এবং বাধ্যতামূলকভাবে এ্যাঙ্গোলার মোট ১৮টি প্রদেশের মধ্যে কমপক্ষে ১২টিতে তাদের বসবাস থাকতে হবে। প্রথমে তাদেরকে আইন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। প্রাথমিক তদন্তের পর আইন মন্ত্রণালয় থেকে তা যাবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। সেখানে ব্যাপক তদন্তের পর সরকার রাজি থাকলে তবেই মিলবে অনুমোদন।
এখানেও কথা আছে। অন্যান্য ধর্মের অধিবাসীর সংখ্যা ঠিকঠাক কাউন্ট করা হলেও উপেক্ষিত হয় মুসলিমদের জনসংখ্যার বিষয়টি। খৃষ্টানপ্রধান এ রাষ্ট্রে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছিলো ১৯৭০ সালে। এখন সব হিসেবে এবং সকল ইসলামি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মুসলিমদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক আগেই লাখ ছাড়িয়ে গেলেও সরকার দীর্ঘদিন ধরে এই হিসেবকে ৮০-৯০ হাজারের কোটায় ঝুলিয়ে রেখেছে।
ফলে বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় মুসলিমগণ তাদের বৈধ এ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ্যাঙ্গোলান মুসলিম কমিউনিটি ইসলামের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে সম্মিলিতভাবে ২০০৪ ও ২০০৬ সালে স্বতন্ত্র দুটি আবেদন জমা দিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাননি। এছাড়া স্থানীয়ভাবে মসজিদ ও ইসলামি স্থাপনা নির্মাণসহ অন্যান্য বিষয়ে বিভিন্ন সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পান নি কোনোরূপ সহযোগিতা ।
দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় অবস্থিত ছোট্ট একটি দেশ এ্যাঙ্গোলা। এর তিনদিকে আফ্রিকার তিন দেশ রুয়ান্ডা, নামিবিয়া ও জাম্বিয়া এবং অন্যদিকে পৃথিবীর বৃহত্তম মহাসাগর আটলান্টিক।
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এ্যাঙ্গোলা পর্তুগালের অধীনে ছিল এবং পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকা নামেও পরিচিত ছিল। ১৯৭৫ সালে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫ বছর যুদ্ধের পর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পরপরই বিরোধী এ্যাঙ্গোলান দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং তা ২০০২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে অব্যাহত থাকে।
বেশ ক’টি শান্তিচুক্তির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর ২০০২-এ. ইউএনআইটিএ নেতা জোনাস স্যাভিমবির মৃত্যুর পর গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। পাকাপাকিভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় এমপিএলএ নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোসে এডোয়ার্ডো সান্তোসের অধীনে।
ইউএনআইটিএ ও এমপিএলএ ’র মধ্যকার এ যুদ্ধে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ হতাহত হয়। বাস্তুচ্যুত হয় ৪ মিলিয়ন এ্যাঙ্গোলান। শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় আরো প্রায় অর্ধমিলিয়ন মানুষ। এ গৃহযুদ্ধে ইউএনআইটিএ’র সমর্থনে ছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকা আর এমপিএলএ’র সমর্থনে ছিলো সাবেক সোভিয়েত ও কিউবা।
বর্তমান এ্যাঙ্গোলার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর লুয়ান্ডা। এ্যাঙ্গোলার সরকারি ভাষা পর্তুগিজ, যদিও বেশিরভাগ পর্তুগিজ দেশটি ছেড়ে চলে গেছেন। পর্তুগিজ ছাড়াও অধিকাংশ এ্যাঙ্গোলান সাধারণত স্থানীয় বান্টু ভাষাগুলোর যে কোন একটিতে কথা বলেন।
এ্যাঙ্গোলার মোট জনসংখ্যা ১৯-২০ মিলিয়ন বা প্রায় দুই কোটি। এর ৮০-৮৫% লোক ক্যাথলিক খৃষ্টান। ১০% প্রোটেস্টেন্ট তথা গোরা বা মৌলবাদি খৃষ্টান। ৫% ব্রাজিলিয়ান সুসমাচারধর্মী (যিশুতে বিশ্বাসেই মুক্তি…) চার্চের অনুগত। কিছু ইহুদি ছাড়া অবশিষ্ট মুসলিমরা ওখনকার সংখ্যালঘু অধিবাসী।
আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে এ্যাঙ্গোলার সবচে ধনী দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দেশটিতে পেট্রোলিয়াম সম্পদ, জলবিদ্যুৎ নির্মাণের সুযোগ, উর্বর ক্ষেতখামার, হীরা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ- সবই ব্যাপকভাবে বিদ্যমান।
রাষ্ট্রের যাবতীয় বিষয়াদি থেকে দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো
এ্যাঙ্গোলার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোসে এডোয়ার্ডো সান্তোস প্রায় ৪২ বছর টানা যুদ্ধের (১৫ বছর স্বাধীনতা যুদ্ধ, ২৭ বছর গৃহযুদ্ধ) পর ২০০২ সালে দেশটির নিরঙ্কুশ শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। কিন্তু এমন একক ক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশটির উন্নয়নে তেমন কিছুই তিনি করতে পারেন নি। তার দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৮৩% আসে শুধু তেল রপ্তানি থেকে।
অথচ জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী উন্নয়নবিষয়ক একটি সূচকের আওতায় ১৮৩টি দেশের মধ্যে তার দেশের অবস্থান ১৪৭-এ। সান্তোসের প্রায় পুরো প্রশাসন (৭৫% এরও বেশি) ব্যাপকরকম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এসবে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি নিজের ক্ষমতাকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধন করে জনগণনির্ভর নির্বাচন পদ্ধতি বাদ দিয়ে প্রেসিডেন্সি সিস্টেমকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সিলেকশনে রূপাান্তরিত করেছেন। যদিও ইউএনআইটিএ সহ অন্যান্য বিরোধীদল শুরু থেকেই এসবের প্রতিবাদ করে আসছে।
এরপর ২০১২ সালে তিনি গোপন একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। জোর করে ৭২% ভোটপ্রাপ্তি দেখানো হয়। অথচ তাতে বিদেশি কোনো পর্যবেক্ষক ছিলো না। ব্যাপক নিপীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকে কোণঠাশা করে রাখা হয়েছিলো।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এসোসিয়েশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে- ব্যাপক গ্রেফতার, ভীতি প্রদর্শন ও নিপীড়নের মাধ্যমে প্রহসনের নির্বাচন করে তিনি ক্ষমতায় আসেন। এসময় সাংবাদিক ও স্থানীয় পর্যবেক্ষকেরাও গ্রেফতারির শিকার হন।
আলোচ্য বিষয়ের সাথে আপাত সঙ্গতিহীন এ্যাঙ্গোলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতো দীর্ঘ করে আলোচনায় আনলাম বিশেষ একটি কারণে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও তার দল মোটেই সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। দেশের অর্থনীতি নড়বড়ে, উন্নয়নসূচক তলানিতে, প্রশাসনের দুর্নীতি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে, নাগরিকদের মৌলিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থতার বেশ কিছু রিপোর্ট জাতিসংঘের কাছে জমা পড়েছে, হিউম্যান রাইট্স ওয়াচসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অবস্থানও অনুকূলে নয়, নতুন নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দলগুলোর সোচ্চার হওয়া এবং সর্বোপরি সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই। সুতরাং সবমিলিয়ে সান্তোস সরকারের এমনিতেই ঘুম হারাম হওয়ার কথা।
অনেকেই মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় হাত দেয়ার, বিশেষত ইসলাম নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠার একটাই অর্থ- রাষ্ট্রের যাবতীয় বিষয়াদি থেকে দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো এবং তুমুল প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ বর্তমান বিশ্ববাজারে নিজের মার্কেটভ্যালু বাড়িয়ে নিয়ে দেশের অর্থাবস্থার মন্দাভাব কাটানোর চেষ্টা।
মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা যে প্রতারণাপূর্ণ পদ্ধতির নাম দিয়ে থাকেন- ইকোনমিক বূম বা ক্রয়-বিক্রয়ের আকস্মিক ও অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি। কিছুটা ‘দূর কী বাত’ মনে হলেও ব্যাপারটি একদম ফেলে দেয়া যায় না।
নতুন উত্তেজনা সৃষ্টির একটা অপচেষ্টা
ইসলাম নিষিদ্ধকরণ ও মসজিদ বন্ধের ঘোষণাটি নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির একটা অপচেষ্টা হতে পারে। কারণ এই কাজটি বহু আগে থেকেই চলে আসছে। আশংকার ব্যাপার এই যে, উল্লেখিত আইন অনুযায়ী সরকার বৈধভাবেই পারে মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে। পারে স্বাধীনভাবে ধর্মপালন ও মসজিদের জায়গা পর্যন্ত কেড়ে নিতে। কিছুক্ষেত্রে খুব সীমিতভাবে সরকার অবশ্য ছাড় দিয়ে রেখেছে।
মুসলিম কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক আকারে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত পক্ষপাতদুষ্ট কিছু ভূমিকার কথা স্মরণ করা যতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার উন্নয়ন কাউন্সিলের রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা স্থানীয় মিডিয়ায় প্রায়ই মুসলিমদের কটাক্ষ করে মন্তব্য করেন।
সাবেক জাতীয় ধর্ম বিষয়ক পরিচালক সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট জমা দেন, যাতে চার্চের সংখ্যাবৃদ্ধির সুপারিশ এবং অন্যান্য ধর্মীয় দল-উপদলগুলোকে এ্যাঙ্গোলার জন্য একপ্রকার অসুস্থতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি বলেন- অসুস্থতার একটি রূপ হলো ইসলাম। রাজধানী লুয়ান্ডার গভর্ণর স্থানীয় এক রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেন- মৌলবাদি মুসলিমরা এদেশে স্থান পাবে না। সরকার তাদের মসজিদগুলোকে অনুমোদন দিতে প্রস্তুত নয়। ২০১২ সালে ওয়াশিংটন ভিত্তিক ধর্মীয় ও পাবলিক পলিসি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এ্যাঙ্গোলার সংস্কৃতিমন্ত্রী রোজা ক্রোসি সিলভা বলেছেন- সরকার বিশ্বাস করে, মুসলিম কমিউনিটি (যদি অনুমোদন দেয়া হয) এ্যাঙ্গোলান সমাজের গঠন ও কাঠামো ধ্বংস করে দেবে। অশংকার বিষয় হলো, এতোদিন বিষয়টি সরকারের কথায়-ভাবনায় থাকলেও বাস্তবায়নের কাজ এবছর থেকেই সম্ভবত শুরু হয়ে গেলো।
আফ্রিকায় ইসলামের শুরু
ইসলামের শুরু থেকেই আফ্রিকার মানুষ ইসলামের সংস্পর্শে অসার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বেলাল রা. ছিলেন আফ্রিকান। তিনি ছাড়াও আরো অনেক আফ্রিকানই নবীজীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
আফ্রিকার অধিকাংশ মানুষ কালো এবং কালো হওয়ায় যুগযুগ ধরে তারা সাদাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। ইসলাম যখন মানুষের মধ্যকার বর্ণ-অর্থবিত্ত-উচ্চতা ইত্যাদির ব্যবধান ঘুচিয়ে দিলো, আফ্রিকায় তখন ব্যাপকভাবে ইসলামের আদর্শ ছড়িয়ে পড়তে থাকলো।
অচিরেই আফ্রিকান মুসলিমরা সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলেন।
তবে তাদের এই আধিপত্য সপ্তম শতকের পর থেকে হ্রাস পেতে থাকে। ডাচ-পর্তুগিজসহ বিভিন্ন সা¤্রাজ্যের উপনিবেশে থেকে ব্যাপকরকম নিপীড়নের শিকার হওয়ায় আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হন। সময় ও শাসক বদলালেও তাদের ভাগ্য যেসব রাষ্ট্রে খুব একটা বদলায়নি, আজকের এ্যাঙ্গোলা তার অন্যতম।
এ্যাঙ্গোলার অধিকাংশ মুসলিমই অভিবাসী
এ্যাঙ্গোলার অধিকাংশ মুসলিম পশ্চিম আফ্রিকা, লেবানন ও ভারতবর্ষ থেকে হিজরত করে কিংবা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যাওয়া অভিবাসী। বর্তমানে তাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১-১.৫% মাত্র। তবে, সংখ্যায় কম হলেও এবং-
অব্যাহত বঞ্চনার শিকার হতে থাকলেও ইসলাম ও ইসলামি আদর্শকে তারা ভুলে যাননি। খুবই নিষ্ঠার সাথে তারা ইসলামের আদেশ-নিষেধ পালন করে যাচ্ছেন। আফ্রিকার প্রায় অখ্যাত দেশ এ্যাঙ্গোলায় ধর্মের বিষয়ে তাদের মজবুত অবস্থান অন্তত তাই বলে।
ইতিহাসের আদালত বড় নিষ্ঠুর, বড়ই ইনসাফের
এ্যাঙ্গোলায় ইসলাম নিষিদ্ধ ও মসজিদ ভাঙার খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আমরা ব্যাপক প্রতিবাদ ও বাস্তবমুখি-অর্থবহ কিছু পদক্ষেপ আশা করেছিলাম। আমাদের তারা আবারো হতাশ করলেন। দু’একটি উল্লেখযোগ্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে কারো পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি, যা সত্যিই দুঃখ্যজনক। ওআইসি শেষ পর্যন্ত একটি বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ এবং ব্যাপারটার ব্যাখ্যা চেয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এতোটুকুই যথেষ্ট বলে আমরা মনে করি না।
স্থানীয় মুসলিমরা অবশ্য আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছেন, শারীরিকভাবে বা সরাসরি অন্যকোনো পন্থায় তাদেরকে নিগৃহীত করা হচ্ছে না। তবে, ধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বীকৃতিহীনতা এবং মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনা কোনো অংশেই অগুরুত্বপূর্ণ নয়। খাদ্য-বাসস্থান-চিকিৎসার মতো স্বধীনভাবে ধর্ম পালনও মানুষের মৌলিক অধিকার। সুতরাং ধর্মের বিরুদ্ধে কারো অবস্থান, হোক তা ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রের- কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
আমাদের মুসলিম নেতৃবৃন্দ বরাবরই এক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধন্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন। হচ্ছেন। এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এ্যাঙ্গোলার মতো একটি রাষ্ট্রের এমন দুঃসাহসের পরও তারা যদি সজাগ না হন, সোচ্চার না হন; তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। মনে রাখা দরকার, ইতিহাসের আদালত বড় নিষ্ঠুর। বড়ই ইনসাফের।
সন্দেহ নেই, এমন পদক্ষেপে এ্যাঙ্গোলার বৈশ্বিক ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দীর্ঘমেয়াদে এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি পরিমাপ করা অসম্ভব। এই একটি সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্বের সোয়াশ’ কোটি মুসলিম, সঙ্গত কারণেই তাদের মিত্ররাও নিশ্চয় এ্যাঙ্গোলার বিরাগভাজনে পরিণত হবে। প্রশ্ন হলো, এ্যাঙ্গোলা কি তার আইনটি সংশোধন করে নিজের সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ধর্মীয় অধিকারের সাথে সামঞ্জস্যশীল করবে না ব্যাপক সমালোচনা ও বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এ পথেই হাঁটবে?
Leave a Reply