পরদিন ইতিহাস পরীক্ষা। রাজ-রাজাদের গল্প পড়ে রাতে তাই শাহী মেজাজে ঘুমুতে গেলাম। পরীক্ষার টানা ধকলে ঘুমও এলো চটজলদি। সেদিনই ছিলো আবার বহুল আলোচিত ত্রৈবারো’র (১২.১২.১২) সমাহার। ইতিহাসের এমন বর্ণিল পাতায় সমকালের সবচে’ কালো অধ্যায়টি যোগ হতে যাচ্ছে, কে কল্পনা করেছিলো?
সাইলেন্ট করা মোবাইল আমার সারারাত কাঁদলো। কাঁদলো শীতের আকাশ। হতচ্ছরা আমিই কেবল অচেতন ঘুমে। বজ্রপাত হলে কেমন বিভীষিকা তৈরি হয়, কিংবা একসাথে চারদিক থেকে পাথুরে আক্রমণের শিকার হলে?…জানি না। আমাদেরকে এসবের ভয়াবহতা বর্ণনার জন্য ওদের কেউ বেঁচে থাকে না। সকালবেলা আমার অবস্থাও হলো সেরকম। তবে, সব ছাপিয়ে ভেতরে জেগে ওঠলো দুটো অসমাপ্ত গল্পের থিম। নিরেট স্বার্থপরের মতো।
এককালে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে প্রবল বিতৃষ্ণ ছিলাম। বলেছি অনেক, লিখেছিও। সঙ্গত কারণেই এক্ষেত্রে হযরতের প্রতিও অভক্তি কাজ করেছে। ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। কিন্তু অভক্তির সে দায় শোধরাবার সুযোগ পেলাম কই? নতুন ডাকের কল্যাণে কাছে না হলেও কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে অনেকবার। দীর্ঘ একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি সেই কবে। পারলাম না তো। পরীক্ষার সকালে, হাতে বই ওঠলো না। স্মৃতি আওড়ালো না নাম-সনের হিসেব। শোকের দহনে, অপরাধবোধের ক্ষরণে মিইয়ে রইলাম পুরোটা সময়। মহাকাল বুঝি এভাবেই প্রতিশোধ নেয়?
মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. বিদায় নিলেন বড় অসময়ে। বিশ্বাস থেকে নয়, অসময়ের প্রসঙ্গ উঠছে কারণ আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। ক’মাস আগেই চলে গেছেন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। তার বিদায়ের মঞ্চ প্রস্তুত ছিলো। আমরা কেঁদেছি, ভেঙে পড়িনি। মুফতী আমিনী তো আমাদের কান্নারও সুযোগ দিলেন না।
তার ইন্তেকালের পর অনেককে বিভ্রান্ত হতে দেখেছি। এমনকি কাছের মানুষদেরও। তারা বলেছেন- ‘হুজুর নিজেও বুঝতে পারেননি, তিনি চলে যাবেন’। আসলে সাময়িক এই আবেগের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই, মূল্যও নেই। কারো সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ণয়ে এর কোনো গুরুত্ব নেই। হুজুগে মন তবু মানে না। খুঁজে বেড়ায় উপকরণ। ইন্তেকালের দিন দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নির্ধারণের বৈঠক, ডিসেম্বরের শেষে গৃহবন্দিত্ব থেকে বেরুনোর প্ল্যান কিংবা নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতিকল্পে বি.বাড়িয়ায় বাসাভাড়ার নির্দেশ আপাত সে ধারণাকেই জোরালো করে।
কিন্তু বিপরীত চিত্রও আছে। মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার আমল, বিশেষকরে মোনাজাতে কান্না উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এলাকার একটি বিষয় নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও আওয়ামীলীগের সাথে তার বিরোধ ছিলো। একসময় বাড়ি ও আত্মীয়রা আক্রান্তও হয়। তিনি মামাতো ভাই ও স্থানীয় সবকাজের প্রতিনিধি আনিসকে ডেকে পাঠান। তার বর্ণনা, ‘আমাকে প্রায়ই ঢাকায় তার কাছে যেতে হয়। জীবনে কখনো তাকে এমন ভেঙে পড়তে দেখিনি। শুধু খবর নয়, কী হয়েছে, কারা আহত হয়েছে সব জেনে নিলেন। তিন তিনবার আমায় খবর দিলেন, ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে; নিয়ে আয়। ওকে নিয়ে আয়। বুঝতে পেরেছিলেন, বি.বাড়িয়ায় তার আর যাওয়া হবে না’। ইন্তেকালের দিন তিনি রীতি ভেঙে জানাযা পড়ালেন। দুটো ক্লাস নিলেন একমাস পর। ক্লাসের আলোচনাগুলোও ছিলো যেনো ‘শেষ আর বিদায়ের’ আবহ সঙ্গীত। সুতরাং বুঝতে না পারার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। তবে?
ইন্তেকালের পর মুমিনের ইলম ও আমলের ধারা বন্ধ হয়ে যায়। মুফতী আমিনী সাহেবের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ছিলো নিশ্চয়। তাই তিনি আমল আর ইলমচর্চা বাড়িয়েছেন। শেষজীবনে বেশক’টি গুরুত্বপূর্ণ বইও লিখে গেছেন। এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত দিক বা নিজস্ব অর্জন। কিন্তু যে রাজনীতি ও আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন আজীবন, সেটা তার রাজনীতি বা তার আন্দোলন ছিলো না; ছিলো ইসলামের এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে কারো না কারো মাধ্যমে। তিনি চাননি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করে যেতে বা এমন কিছু বুঝাতে, যাতে তার ইন্তেকালের পর এ মহান আন্দোলন থমকে দাঁড়ায় বা গতি হারায় । হয়তো আল্লাহ পাকেরও তাতে সায় ছিলো। আমার উপলব্ধিতে তার শেষ জীবনের কার্যক্রম এ-ই মিন করে। এই সত্য তার কাছের মানুষেরা, আন্দোলনের সহকর্মীরা যতো দ্রুত বুঝবেন, ততোই মঙ্গল। নিশ্চয় এর মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকবেন মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ.। একজন নেতার সার্থকতাও এখানেই।
আমাদের ইসলামী অঙ্গনে জীবনী পর্যালোচনা ও মূল্যায়নধর্মী স্মরণসংখ্যা প্রকাশের চলমান ধারা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। আর্থিক সামর্থ্য, কাজের যোগ্যতা আর বরাবরই লেখক সংকটের কারণে আমরা এগুতে পারিনি। তবু কাজ হচ্ছে, নিয়মিত চর্চার পরিবেশ গড়ে উঠছে; এওতো অনেক কিছু। আমার প্রকাশক প্রত্যয়ী তরুণ সিদ্দিকুর রহমানকে আমি আন্তরিক মুবারকবাদ জানাই। স্বীকার করতে দোষ নেই, তার উৎসাহেই বিশাল এ কাজে হাত দেওয়া। এ পর্যন্ত যা করা গেলো তা আমাদের অগ্রসরমান প্রচেষ্টার একটা অংশের স্বীকৃতি পাবে নিশ্চয়ই।
স্মরণসংখ্যার কাজ শুরু করার সময়ই আমরা বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রচলিত ঢাউস সাইজের স্মারক করার সামর্থ্য আমাদের নেই, দরকারও নেই। অসংখ্য লেখকের একই ধরনের স্মৃতিচারণ দিয়ে পত্রিকা ভরে ফেলারও মানে হয় না। কাজ কম হোক, তবে মৌলিক হোক। মূল্যায়নধর্মী হোক। আমরা মাঠে নামলাম, কাজও শরু হলো। মরহুম মুফতী আমিনীর বরকত এবং ক’জন নবীনের একমাসের নির্ঘুম প্রচেষ্টার ফসল হয়ে ঘরে ওঠলো নতুন ডাক। আঙ্গিক আর বিন্যাসের বিশেষত্ব নিয়ে।
পরিকল্পনা নেওয়া মৌলিক কিছু কাজ শেষ পর্যন্ত আমরা করতে পারিনি। মুফতী আমিনীর সবচে বড় ও আলোচিত এবং সর্বশেষ আন্দোলন নিয়ে একটি পর্যালোচনার ইচ্ছে ছিলো। পারিনি। এটা ভালো করতে পারতেন তার কাছের কেউ। কিন্তু প্রিয় মানুষ হারানোর শোক আর বাড়তি দায়িত্বের হঠাৎ চাপে তারা এখনো এমন কাজ করার মতো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তবে সবক্ষেত্রে তারা আমাদের পাশে ছিলেন পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে। এজন্য নতুন ডাক পরিবার তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। শ্রদ্ধা রইলো সকল ওলামা হযরত আর লেখকদের প্রতি। আমাদের মতো তরুণদের ডাকে তারা অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন। নয়তো স্মরণসংখ্যার এ কাজ অধরাই থেকে যেতো। এ পর্যায়ে সম্পাদক হিসেবে আমি সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কারণ, বিষয়-বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি থেকে বাঁচতে এবং শিরোনামের বৈচিত্র্য রক্ষা করতে এই কলম কঠোর ছিলো মারাত্মকরকম। এই অপরাধ আশা করি সস্নেহে তারা ক্ষমা করবেন।
নতুন ডাক পরিবারের কর্মপদ্ধতি আর দায়িত্বে সমন্বয় সৃষ্টির প্রশংসা বরাবর করে এসেছি। এবার করতে হবে আরো বেশি। পুরো মাস ধরে সবাই প্রচন্ডরকম শ্রম দিয়েছে। নিয়মিত সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা সুহাইল আহমদ এবার সময় দিতে পারেনি। কর্মজীবনের প্রয়োজনে এখন সে ঢাকার বাইরে। তবে সহকর্মী আল-আমিন আজাদ তার অভাবটা বুঝতে দেয়নি। পুরোটা সময় সঙ্গ দিয়ে একাই সে দ্বিগুণ দায়িত্ব পালন করে গেছে। স্মরণ করছি সুহৃদ সায়ীদ উসমানকে, বারবার ফোন করে তাকে বিরক্ত করেছি। আর শেষ কৃতিত্বটা দিতে হবে অতিঅবশ্যই হা মীম কেফায়েতকে। প্রচ্ছদ ও মেকআপের দায়িত্ব নিয়ে বড়ো একটা দুশ্চিন্তা তিনি দূর করে দিয়েছেন। মুদ্রণসংক্রান্ত সব দায়িত্ব একাই সামলেছে নূরে আলম সিদ্দিকী। ধন্যবাদ তাকেও। নতুন ডাক পরিবারের সবাইকে আবারও শুকরিয়া।
পাঠকের দরবারে দরখাস্ত, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কেবল চেয়েছি একজন মুফতী আমিনীকে পাঠ করতে। তাতে যদি একটুও সাফল্য আসে, তবেই আমাদের পরিশ্রম সার্থকতা পাবে। ভালো থাকুন।
Editorial, Monthly Natun Dak Special Issue
Leave a Reply