এই তারুণ্যই লিখুক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নয়া ফরমান

বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা

Date

Author

Blog Duration

10 minutes

শ্বাসরুদ্ধকর এক সময় পার করছে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। মুক্তির আনন্দ, স্বজন হারানোর বেদনা, তরুণ প্রজন্মের সাহস ও স্পর্ধা অন্যদিকে ক্ষমতার মোহে অন্ধ একদল লোকের পৈশাচিকতা আমাদেরকে মুখোমুখি করেছে এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতার। ১৫ বছর পর আমরা প্রবল এক স্বৈরাচারীর কবল থেকে মুক্তি পেয়েছি। নিরাশ হতে থাকা তরুণ প্রজন্ম তাদের জাতটাই শুধু চেনায়নি, দূর করে দিয়েছে দেশবাসী আমাদের সবার সব ভয়, দ্বিধা ও উৎকণ্ঠা। এভাবেও জেগে উঠা যায়? এভাবেও সব বদলে দেয়া যায়?

জুলাইয়ের শেষ কটি সপ্তাহজুড়ে জেগে উঠা তারুণ্য একদিকে যেমন আশাবাদী করছিলো, অন্যদিকে নিজদেশের মানুষের উপর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ আর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে হাসিনা সরকার ও আজ্ঞাবহ বাহিনীগুলো আমাদের হৃদয়কে করছিলো ক্ষতবিক্ষত। দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রে তৈরি হওয়া দানব সহজে আমাদের পিছু ছাড়বে না জানতাম, হায়েনার মতো এভাবে হামলে পড়বে তা আমাদের কল্পনাতেও আসেনি। মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলো- এ কোন বাংলাদেশ? কাদের হাতে আমরা দিয়ে রেখেছি আমাদের নিরাপত্তা আর ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার স্বপ্ন?

এক মাস আগেও ভাবা যায়নি এমন এক অবিশ্বাস্য দৃশ্যপট অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে। মাত্র ক’মাস আগেই আরো একটি মিথ্যা নির্বাচন সাজিয়ে চতুর্থবারের মতো মসনদে বসেছে আওয়ামীলীগ। আমেরিকা-ইউরোপের ইশারায় বেশ হৈহুল্লোড় হলেও দেশবাসীকে রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করেছে সরকার। আলীগকে পেছন থেকে এককভাবে সাপোর্ট দিয়ে রাখা পাশের দেশ ইন্ডিয়াতেও মোদী সরকার টিকে গেছে। দম্ভে আলীগ নেতাদের পা আর মাটিতে পড়ে না, তাদের আর পায় কে।

নাগরিক হিসেবে আমাদের অসহায়ত্ব আর দ্রব্যমূল্যসহ বহুমুখী চাপে নাকাল জীবনে এমন সময়েই দৃশ্যপটে হাজির হলো বাংলার অপরাজেয় তারুণ্য। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো হঠাৎ তারা এলো জ্বলতে এবং জ্বালিয়ে দিতে। ভেসে উঠতে এবং ভাসিয়ে নিতে। কেনো কীভাবে ঘটলো এই বিস্ফোরণ?

কেনো কীভাবে ঘটলো এই বিস্ফোরণ?

history of Bangladesh

আওয়ামীলীগের একচ্ছত্র ‘রাজত্বকালে’ বেকারত্বের তীব্রতা থেকে ২০১৮ সালে প্রথম ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ শুরু হয়। একদিকে বেসরকারি চাকরির সুযোগ খুবই অপর্যাপ্ত, অন্যদিকে অল্প তৈরি হওয়া সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা বরাদ্দ থাকায় (অঘোষিত দলীয় নিয়োগ বা দুর্নীতি বিবেচনায় নিলে তা ৯০% এর কম হবে না) সাধারণ শিক্ষিত তরুণ সমাজ জীবন-জীবিকা নির্বাহের কোনো উপায় দেখছিলো না। কোটা সংস্কার আন্দোলন তাই দ্রুতই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামীলীগ সরকার যথারীতি রাস্তায় ফেলে পেটানো, চোখ উপরে ফেলা, এমনকি ক’জনকে গুম করে শক্তির সর্বোচ্চটা দেখাতে থাকে। ব্যাপক নির্যাতন ও জেল-জুলুম করেও আন্দোলন দমাতে না পেরে পুরো কোটা ব্যবস্থাই তুলে দেয়, তাও হাসিনার একক নির্দেশে। সাধারণ মানুষ তখন এর সাথে যুক্ত হয়নি, আন্দোলনও সেখানেই থেমে যায়।

আদালতে ফয়সালা না হওয়ায় ঝামেলা অবশ্য রয়েই গিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পক্ষের কজনের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে গত জুনে আদালত আবার কোটা বহালের রায় দিলে ছাত্ররা প্রতিবাদ শুরু করে। প্রথমে ভ্রূক্ষেপ না করলেও আন্দোলন বড় হতে থাকায় আওয়ামী সরকার পাল্টা আপিল করে। এদিকে রাজনৈতিকভাবে খোঁচানো এবং একপ্রকার উপেক্ষাও জারি রাখে। আগের অভিজ্ঞতায় ছাত্ররা এবার আর ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ না দিতে চূড়ান্ত আইনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। জুলাইয়ের প্রথম ১০-১২ দিনও এভাবে চলে যায়। প্রায় একমাস অতিবাহিত হতে থাকার পরও আন্দোলনের গতি না কমে বাড়তে থাকায় সরকার আস্তে আস্তে হার্ড লাইনে যাওয়া শুরু করে। চতুর্থবার ক্ষমতায় আসতে পারাসহ এমনিতেই নাক উঁচু লীগ সরকার ভয় দেখিয়ে ছাত্রদের ফেরাতে চেষ্টা করে।

অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের মাধ্যমে বিভিন্ন তর্ক ছড়িয়ে দেয়। উঠে আসে মেধাবী-কোটার সুবিধাভোগী বিরোধ, মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতি বনাম রাজাকার প্রজন্ম ইত্যাদি বিতর্ক। আল্লাহ পাকই উত্তম পরিকল্পনাকারী। নয়তো ১৫ বছর টানা সরকারে থাকা, এতো পোড়খাওয়া পরিণত দল আওয়ামীলীগ এই ছোট্ট ভুল কেনো করবে। চীন থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরা প্রধানমন্ত্রীর নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নে শেখ হাসিনা পুরো তরুণ প্রজন্মকে রাজাকার আখ্যায়িত করে বসেন। আগুনে ঘি ঢালা বলেন বা দুর্বল বাঁধে হালকা ধাক্কা দেয়া বলেন- এই এক কথাতে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা ছাত্র সমাজ আগ্নেয়গিরির রূপ ধারণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রথম স্লোগান উঠে, পরে হলের তালা ভেঙে এমনকি মেয়েরাও মাঝরাতে রাজপথে নেমে আসেন।

ফেরাউনে রূপ নিয়ে উদ্ধত সরকার তখনো নিজেদের সামলে না নিয়ে উল্টো দলীয় বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের উস্কে দেয়। শেখ হাসিনার ভুলকে তারা ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের তরফে আরো একবার পুরো তরুণ প্রজন্মকে অপমানিত করেন। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদেরসহ সিনিয়র নেতারা লেলিয়ে দেন ছাত্রলীগকে। লাঠিসোটা, রামদা ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ নিরীহ ছাত্রদের উপর হামলে পড়ে। মেয়েরা, এমনকি ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে যাওয়া আহত ছাত্রদের উপরও কয়েক দফা হামলা করে। সাধারণ ছাত্রদের রক্ত, বিশেষত মেয়েদের উপর আক্রমণের ভিডিও ভাইরাল হলে পরদিন আন্দোলন ছড়িয়ে পরে সারাদেশে। এদিন প্রকাশ্যে রংপুরে পুলিশ আবু সাঈদসহ ৬ জনকে হত্যা করলে ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন সাধারণ জনতাও। কোটাবিরোধী আন্দোলন রূপ নিতে থাকে গণআন্দোলনে।

কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে গণআন্দোলন

১৬ তারিখে সারাদেশে বেশ কয়েকজন নিহত ও অসংখ্য লোক আহত হবার প্রেক্ষিতে ছাত্রজনতা ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করেন। সরকার দলীয় ক্যাডার বাহিনী পাঠায়, পুলিশকে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়, নামানো হয় বিজিবি। আন্দোলনের গতি তাতে কমে না, খবর আসে শতাধিক মানুষ খুনের, হাজারো ছাত্রজনতার নির্মমভাবে আহত হবার। গণআন্দোলন তখন এগোয় গণঅভুত্থানের পথে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়, কারফিউ দিয়ে সেনা মোতায়েন করা হয়, দেশজুড়ে চলে গ্রেপ্তার অভিযান। কিন্তু ছাত্ররা দমে যায়নি। পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী পাণ্ডাদের হিংস্রতার ভিডিও সামনে আসতে থাকায় এতোদিন চুপ থাকা সব পক্ষ মুখ খুলতে শুরু করেন। বিদেশী মিডিয়া ও দেশের বাইরে থাকা প্রবাসী ও অন্যান্য বাংলাদেশপ্রিয় পক্ষগুলো ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটে থাকা আমাদের ভয়েস হয়ে প্রতিবাদ জারি রাখেন।

এক সপ্তাহের বেশি সময় পর যখন ইন্টারনেট ওপেন হলো, আমরা দেখলাম সরকার যথারীতি ভাঙা বা আগুনে পোড়া কিছু ভবন-স্থাপনা দেখিয়ে ব্লেম গেম শুরু করলো। বিনাকারণে নির্মমভাবে শহীদ হওয়া শত শত মানুষ, চোখ হারানো বা আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাতে থাকা হাজারো ছাত্র-জনতা সামান্য বিবেচনা পেলেন না। ভয় দেখিয়ে সরকার সব স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এই সময় সবচে পরিণত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন। শোক ও জুলুম সয়ে, জীবনের মায়া উপেক্ষা করে তারা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পদক্ষেপ নিতে যেমন ভুল করেননি, আন্দোলন ভণ্ডুল করে দেয়ার সব ষড়যন্ত্রও রুখে দিতে থাকেন। তাদের সাহস ও বুদ্ধিবৃত্তিক পথচলায এসময় দেশবাসীকে আশাবাদী করে তোলে। বিস্ময় নিয়ে আমরা দেখি- চারপাশের সব বিষয় উপেক্ষা করে মোবাইলে ডুবে থাকা প্রজন্ম কিভাবে আমাদের সব ধারণা বদলে দিচ্ছে। হাজারো বুদ্ধিজীবী, এজেন্সী ও ডিপ স্টেটের হর্তাকর্তাদের সব প্ল্যান-প্রস্তুতিকে নস্যাৎ করে দিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষ তখন আর ভয় পায়নি। মায়েরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন।

১৫-২০ বছরে হাসিনা রেজিমের দেশি-বিদেশী সকল পক্ষের সব পরিকল্পনা-প্রস্তুতি খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে থাকে। আমরা পরিচিত হয় জেন-জি নামের অবিশ্বাস্য এক প্রজন্মের সাথে, যাদের ইমাম মেনে পুরো জাতি যুক্ত হতে পারেন যে কোনো পরিবর্তনের যুদ্ধে।

palestine bangladesh friendship

প্রথমে ৯ দফা ঘোষণা করে ছাত্ররা শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি দিলেও ৩ আগস্ট ঘোষণা করেন এক দফা তথা হাসিনার পদত্যাগ। এর আগে ২ তারিখ শুক্রবার প্রতিটা মসজিদ থেকে বিপ্লবের ঘোষণা হয়, সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নামেন। কারফিউ ঘোষণা করে, ইন্টারনেট বন্ধ করে, সেনাবাহিনীর হাত ধরে শেখ হাসিনা শেষ রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু আল্লাহ পাক তো তাকদীরে লিখে রেখেছিলেন অন্যকিছু। আরো একবার শতাধিক মানুষ খুন করার নৃশংসতায় মেতে উঠে আওয়ামীলীগ। বাধ্য হয়ে ৬ তারিখের লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিকে ছাত্ররা ৫ তারিখে নিয়ে আসেন। ঘোষণা করেন হাসিনার বাসভবন গণভবন অবরোধ করার। হাসিনার রক্তক্ষুধা তবু যেনো মেটে না। বাহিনী প্রধানদের চাপ দিয়ে আরো রক্তপাতের বিনিময়েও তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেন। পাখির মতো গুলি করে মারার প্রকাশ্য হুমকি সত্ত্বেও ছাত্র-জনতা পরদিন ঢাকা লং মার্চ সফল করতে রাস্তায় নেমে পড়েন।

লাশের পর লাশ পড়তে থাকে কিন্তু তারা দমে যাননি। সেনাবাহিনী প্রধান অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে একপর্যায়ে হাসিনাকে মানাতে সক্ষম হন। কোনোরকমে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পতনঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচে বড় ও জুলুমবাজ স্বৈরাচারের।
খবরে প্রকাশ শেখ হাসিনা আরো রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষমতায় থেকে যেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। সেনাদের পুলিশের মতো ব্যবহার করতে না পেরে তিনবাহিনী প্রধানকে অপমান করতে থাকে। ৫ আগস্ট সকালে নিজের নিরাপত্তায় থাকা বাহিনীকে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালাতে নির্দেশ দেন। সেনাপ্রধান তখন শেষবারের মতো অফার দেন হয়তো আপনি ক্ষমতা ছাড়েন নয়তো আমি বাইরে গেলে আপনার বাহিনী আমাকে মারবে। আমি মারা গেলে সেনাবাহিনী এসে আপনাকেও মেরে ফেলবে। তাও হাসিনা মানতে চায়নি। পরে শেখ রেহানা ও বিদেশে থাকা পুত্র জয়কে দিয়ে হাসিনাকে রাজি করানো হয়। নয়তো এই মহিলা আরো হাজারো মায়ের বুক খালি করে পুরো দেশকে বহিঃশত্রুর হাতে তুলে দিতেও কার্পণ্য করতো বলে মনে হয় না।

হাসিনার পলায়ন

৫ আগস্ট দুপুরের দিকে ইন্টারনেট ফিরে এলে আমরা খবর পেতে শুরু করি। সামনে আসে হেলিকপ্টারে করে হাসিনার পালিয়ে যাবার ভিডিও। ক্যান্টনমেন্ট থেকে পরে বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। কোনো একদিন অত্যাচারী হাসিনার এই পরিণতি আমরা দেখবো বিশ্বাস ছিলো, এই সময়ে ২-৩ সপ্তাহের বিপ্লবে হয়ে যাবে আমরা অনেকেই তা ভাবতে পারিনি। বহু মানুষ এদিন রোজা রেখেছিলেন, পুরো দেশ উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়েছিলো আল্লাহ পাকের ফয়সালার দিকে। অবশেষে আমরা দেখলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পুরো দেশ ফেটে পড়লো উল্লাসে। সিজদায় মাথা অবনত হলো। রাস্তায় বেরুলো লাখো মানুষ। পনেরো বছরের দমবন্ধ অবস্থা থেকে দেশ আপাত মুক্ত হলো। হাসিনা আর দেশে নেই। আওয়ামীলীগ আর ক্ষমতায় নেই। ওদের দম্ভ আর দেখতে হবে না। একগুঁয়ে কথা ও আচরণ আর সইতে হবে না। প্রশাসন, দল ও সরকারের যোগসাজশে গড়ে উঠা মাফিয়া চক্রের দুঃশাসনে আর নিষ্পেষিত হতে হবে না। বর্তমান বাংলাদেশে এরচে সুখের, স্বস্তি ও শান্তির আর তো কিছু হতে পারে না। চোখের অশ্রুতে ভেসে গিয়ে আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারলাম।

মাফিয়া এই সরকারের পতন যতোটা সহজ মনে হচ্ছে আদতে তা ছিলো না। প্রথম দফায় কারফিউ জারির আগেই ওরা কমপক্ষে ২৬৭ জন মানুষকে খুন করে। ৮৮০ জন মানুষ পুরোপুরি বা আংশিক দৃষ্টিশক্তি হারান। ২ হাজারের বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। এই হিসেব নিশ্চিত হওয়া তথ্যের। হিসেবে আসেনি বা নিশ্চিত হওয়া যায়নি এমন সংখ্যা কয়েকগুণ বলা হচ্ছে। গণকবরের সন্ধান মিলেছে বেশ কয়েকটা। বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে এখনো বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে। কারফিউ ও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট চলাকালীনও প্রতিদিন হত্যার তথ্য এসেছে। ৪-৬ আগস্টে সারা দেশে নিহত হয়েছেন ৩৫০ এর বেশি মানুষ। নিজদেশের সরকারের হাতে এতো পরিমাণ খুন-হত্যা নিকট অতীতে শুধু সিরিয়া বা মিশরে কিছুটা দেখতে পাওয়া যায়। নিজের ক্ষমতার বলয় টিকিয়ে রাখতে শেখ হাসিনা নিজেকে জেনারেল সিসি ও আসাদের মতো নরপশুর কাতারে নামিয়েছেন। ভারতের সেবাদাস হয়ে সব প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো ধ্বংস করে যেভাবে তিনি নিজদেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন- আওয়ামীলীগ দল হিসেবে টিকে থাকুক বা না থাকুক তিনি যে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুন বাংলাদেশ ও জাগ্রত তারুণ্য তার শেষ দেখে ছাড়বে ইনশাআল্লাহ।

ভারতের ছত্রছায়ায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী রেজিমের কবল থেকে এই মুক্তিকে বাংলাদেশের ২য় স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম বলছে Bangladesh 2.0। ছাত্রদের তত্ত্বাবধানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বতী সরকার গঠিত হয়েছে। সব নিয়োগ ভালো এমন বলা না গেলেও তাদের সময় দিতে হবে। হাসিনা বা আওয়ামীলীগের জাতীয় নেতৃত্ব সব পলায়ন বা গা ঢাকা দিলেও তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। শেখ হাসিনার ছেলে জয় নানাভাবে লীগের তৃণমূল কর্মীদের দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছে। সবচে বেশি সমস্যা করবে ভারত। শেখ হাসিনার কাছ থেকে গত পনেরো বছরে ফ্রীতে অজস্র সেবা পাওয়ায় এখন তারা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করবে দেশকে অস্থিতিশীল করার। পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের নামে আগে-পরের, সত্য-মিথ্যা, এদেশের-ওদেশের সব মিলিয়ে অনলাইনে এবং তাদের জাতীয় মিডিয়ায় অনবরত মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দুদের রাজপথে নামানো হয়েছে, কিছু লোককে সীমান্তে ডেকে নিয়ে শোডাউন করানো হয়েছে। এসবের জেরে ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বেশ কিছু জায়গায় মুসলমানদের উপরও হামলা হয়েছে। এখন আবার ১৫ আগস্ট শোক দিবসের নামে দেশে আওয়ামীলীগকে জড়ো করে পরিস্হিতি উত্তপ্ত করার অপচেষ্টা চলছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বিচারিক একটা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র ছাত্র-জনতা ইতোমধ্যে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। সারা দেশে মন্দিরগুলোকে পাহারা দেয়া হচ্ছে যাতে কেউ হামলা করে সুযোগ তৈরি করতে না পারে।

সময়ের দাবি ও দাওয়াহর সুযোগ

দুই দশকের জঞ্জাল এতো দ্রুত তো দূর করা যাবে না। এতদিন যারা অবৈধভাবে সুবিধা নিয়েছে, জুলুম-শোষণ করে এসেছে; এরাও সহজে হার মানবে না। তবে আমাদের ঐক্য থাকলে ইনশাআল্লাহ সবই সম্ভব। আমাদের তরুণরা প্রমাণ করেছে তারা পারে, তারা পারবে। রাজনীতির মারপ্যাঁচ হোক বা ডিপ স্টেট ষড়যন্ত্র, সবই তারা সহজে ধরে ফেলতে পারে। সারা দেশে পরিবর্তনের যে জোয়ার তারা তৈরি করেছে; জঞ্জাল এবার সাফ হতেই হবে। এখন এগিয়ে আসতে হবে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষদের। বিশেষত আলেম সমাজের। সময় এখন দেশ গড়ার। সমাজে ভূমিকা রাখার।

আমাদের মসজিদগুলোকে আরো প্রাণবন্ত ও জাগরুক রাখতে হবে। সমাজ সেবা ও দাওয়াতের সুযোগ এখন বেশি করে কাজে লাগাতে হবে। তরুণরা কিছু করতে চায়, তাদের সামনে ইসলামের নির্দেশনা ও উপমাগুলো তুলে ধরতে হবে। আমাদের তরুণরা ভীত নয়। মূর্খ বা বোকা নয়। তারা বোঝে। আমলে নেয়ার চেষ্টা করে। তাদের কাছে টেনে একবার ইসলামী অনুশাসনের রাজপথে উঠিয়ে দিতে পারলে তারা নিজেরাই পথ দেখিয়ে নিতে পারবে। প্রতিটা মসজিদ ও মাদরাসা থেকে এলাকাভিত্তিক ‘হিলফুল ফুজুল’ গড়ে তুলতে হবে। ইমাম-খতিব ও আলেমরা উদ্যোগী হলে সহজেই এখন এগুলো করা সম্ভব।

আমরা কি শুনতে পাচ্ছি সময়ের ডাক? আলেমসমাজ ও তলাবারা এবার কি অন্তত এগিয়ে আসবেন?

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *