বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপট
৯ ডিসেম্বর ১৯০৫। ফ্রান্সে চার্চ থেকে রাষ্ট্রের বিভাজনের আইনটি পাস হয়। বিশেষ একটি ধর্মের অধীনতা বা প্রাধান্য থেকে ফ্রান্স প্রথমবারের মতো সেক্যুলার রাষ্ট্রের পরিচিতি লাভ করে। রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার নীতি, ধর্মপালনের স্বাধীনতা এবং চার্চের সাথে সম্পৃক্ত জনগণের অধিকার ছিলো এই আইনটির মৌল বিষয়।
ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বে প্রথম এবং প্রধানতম সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে এখনো ফ্রান্সের তথাকথিত যে গর্ব, এই আইনটিই হলো তার ভিত্তি।
তবে- কোনো আইন যখন একই সময়ে একপক্ষের অধিকারের নিশ্চয়তা দেয় এবং অন্যপক্ষের অধিকার হরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়- সে আইন নিয়ে রাষ্ট্রের গর্ব করাটা তো তথাকথিত হতে বাধ্য।
চার্চ থেকে বিভাজনের এই আইনের মাধ্যমে এখন থেকে রাষ্ট্র ফ্রান্স যেমন কোনো কাজেই চার্চের বক্তব্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, চার্চও তার স্বাভাবিক কাজ পরিচালনায় রাষ্ট্রের বাধাপ্রাপ্ত হবার আশংকায় পতিত হবে না। ফ্রন্সের ১৯৫৮ সালের সংবিধানে সরাসরি উল্লেখ আছে- ‘রাষ্ট্র ফ্রান্স কোনো ধর্মের স্বীকৃতি, বেতন-ভাতা বা কোনো প্রকার অনুদান প্রদান সংক্রান্ত কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে না।’ এর ঠিক বিপরীত অর্থ বা বাস্তবতাটা দাঁড়ায়- রাষ্ট্র কোনো চার্চ বা ধর্মের কাজে কখনো নাকও গলাবে না।
উল্লেখ্য, ১৯০৫ এর আগ পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিসিজম ছিলো ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। কয়েক শতাব্দী ধরেই নানা বিষয়ে রাষ্ট্র আর চার্চের বিপরীত বিবৃতি সমাজে জটিলতা সৃষ্টি করে আসছিলো। ফলে চার্চ থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করার জন্য সুদীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বতন্ত্র এই আইন পাস করতে হয়। তবে প্রায়োগিক অর্থে এখানে চার্চের অর্থ হবে ধর্ম। ফ্রান্সের সকল ধর্ম।
এই আইনের মাধ্যমে ধর্মসমূহের দায় থেকে রাষ্ট্র যেমন মুক্ত, ধর্মগুলোও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রশ্নে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আইন পাসের পরবর্তী প্রায় ৬-৭ দশক পর্যন্ত ছোটখাঁ নানা বিরোধ বা ঝামেলা সামনে এলেও রাষ্ট্রের আন্তরিকতা নিয়ে তেমন প্রশ্ন ওঠেনি।
৬০-৭০ দশকের মুসলিম অভিবাসনের পর থেকেই দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। বিশেষত আফ্রিকার আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে তখন বেশ বড় একদল মুসলিম কাজ ও বাসস্থানের খোঁজে ফ্রান্সে পাড়ি জমান। ধর্মপ্রাণ এসব মুসলিম ইসলামী বিধি-বিধান পালনের স্বাধীনতায় বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। ঠোকাঠুকির শুরু হয় তখন থেকেই।
নব্বইয়ের গোড়ার দিকে এসে যা শুধু ঠোকাঠুকিতে থেমে থাকেনি, বছরের পর বছর ধরে লুকিয়ে থাকা মস্ত ক্ষতটাকেই সামনে নিয়ে আসে।
ইসলাম ও মুসলিম ইস্যুতে শুধু চার্চ নয়- রাষ্ট্র ফ্রান্সই খোদ প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
বৈষম্যের সূচনা
ঘটনার সূত্রপাত অক্টোবর ১৯৮৯, দক্ষিণ প্যারিসে।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও তিনজন মুসলিম মেয়ে কলেজে (গ্যাব্রিয়েল হ্যাভেজ কলেজ) হাজির হলো, যথারীতি স্কার্ফে মাথা ঢেকে। তবে ক্লাসে ঢুকেই এদিন হেড মিস্ট্রেস তাদের স্কার্ফ খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। রাজি না হওয়ায় তৎক্ষণাৎ তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার ঘোষণা করা হলো। ফ্রান্সে মুসলিমদের মৌলিক অধিকার হরণ এবং ইসলামী জীবনধারা সংক্রান্ত বিতর্কের সেই প্রকাশ্য সূচনা।
এরপরের কয়েক সপ্তাহ কলেজ কমিটি এবং স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটির মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক ও আলোচনার প্রেক্ষিতেও কোনো সমাধান এলো না। মুসলিমরা জানিয়ে দিলেন- ধর্মীয় স্বাধীনতা যেখানে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, ধর্মীয় পরিচিতি বহন করা সেখানে অন্যায় হয় কী করে? অন্যদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনড় দাবি- প্রত্যক্ষ ধর্মীয় চিহ্ন বহন করাটা চার্চ থেকে রাষ্ট্রের বিভাজনের (লাইসিটি) আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সুরাহা না হওয়ায় স্টেট কাউন্সিলকে এগিয়ে আসতে হলো। এই কাউন্সিল একইসাথে ফ্রান্স সরকারের আইনি পরামর্শক এবং বিচার-আচারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের প্রাথমিক রায়ও মুসলিমদের পক্ষেই গেলো।
কাউন্সিল জানালো- ‘পাবলিক স্কুলে ধর্মীয় চিহ্ন শরীরে বহন করা ফ্রান্সের সেক্যুলার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।’ তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ বা গোঁড়া ফ্রেঞ্চ সোসাইটি তা মেনে নেয়নি। দেন-দরবার চলতেই থাকলো। পরের মাস ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভার এক মিটিংয়ে আলাপ-আলোচনার পর তারা দায়িত্বটা শিক্ষকদের ওপর ছেড়ে দিলেন। কেস বাই কেস বা ঘটনা ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে শিক্ষকরাই সিদ্ধান্ত নেবেন কোনটা রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় পড়বে আর কোনটা পড়বে না এবং সে প্রেক্ষিতেই তারা মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ট্রিট করবেন। এই সিদ্ধান্ত আপাত দৃষ্টিতে চমকপ্রদ মনে হলেও বাস্তব বিবেচনায় ছিলো রীতিমতো ভয়াবহ।
মন্ত্রিসভা বিষয়টির সুরাহা না করে এর সাথে বরং পলিটিক্স জুড়ে দিলো। ফ্রেঞ্চ সোসাইটিসহ পুরো শিক্ষক সমাজ যেখানে মুসলিমদের এই অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই ছিলো, মন্ত্রিপরিষদ তাদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে প্রকারান্তরে পুরো মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিলো। আশংকা যে অমূলক ছিলো না সেটার বাস্তবতা এর পরপরই সামনে আসতে শুরু করলো।
ঠিক একমাসের মধ্যেই পাশ্ববর্তী আরেকটি কলেজ তিনজন মুসলিম ছাত্রীকে বহিষ্কার ঘোষণা করলো। এর বাইরে নানাভাবে হয়রানি তো বাড়ছিলোই। অনন্যোপায় হয়ে মুসলিম অভিভাবকেরা এবার সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হলেন। আবারও এগিয়ে এলো মন্ত্রিপরিষদ এবং এবার তারা আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে উপদেশের মোড়কে বিতর্ক উসকে দিলো এই বলে- ‘স্কুল-কলেজগুলো যেনো রাষ্ট্রের লাইসিটি বা সেক্যুলার আইনের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল থাকে।’
এই শ্রদ্ধার নমুনা এরপর স্কুল-কলেজগুলোও দেখাতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে অসংখ্য মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী এ সময় পড়াশোনা বাদ দিতে বাধ্য হয়।
পড়াশোনার মতো মৌলিক অধিকার অর্জনের জন্য অনেক মুসলিম মেয়েকে নিরূপায় হয়ে স্কার্ফ-হিজাব বর্জন করতে হয়। পরিস্থিতি এতোটাই জটিল আকার ধারণ করে যে শুধু ’৯৪ তেই ১০০’র বেশি ছাত্রীকে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিলো।
মুসলিম মেয়েদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
ইহুদি-খৃষ্টান ছাত্র-ছাত্রীরাও স্কুলে তাদের ধর্মীয় সিম্বল বহন করে, মাথায় ছোট্ট টুপি ও গলায় ক্রুশ। সেটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি কখনো। মুসলিম মেয়েদের স্কার্ফ বা হিজাববিষয়ক এই তুমুল বিতর্কের সময়েও নয়। ‘৯৪ এর ব্যাপক উত্তেজনার একপর্যায়ে ফ্রান্সের বিজ্ঞ মন্ত্রিপরিষদ তৃতীয় এবং শেষবারের মতো এগিয়ে এলো। ধর্মীয় সিম্বলগুলোকে তারা দু’ ভাগে ভাগ করলো এবং ঘোষণা দিলো- ‘ধর্মীয় সিম্বলগুলোর মধ্যে কিছু আছে সাধারণ, ছোট প্রকৃতির বা অনাড়ম্বর- এগুলো ব্যবহারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাধা দিতে পারবে না। আর কিছু আছে খুবই আলাদা ধরনের এবং আড়ম্বরপূর্ণ- যেমন হিজাব বা স্কার্ফ- এগুলো এখন থেকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।’
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারা মুসলিম মেয়েদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং অধিকার হরণের ব্যাপারটির চূড়ান্ত রূপ দিলেন। একইসাথে আগ বাড়িয়ে ইহুদি-খৃষ্টান ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মীয় সিম্বল বহনের অধিকারের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থনও জানিয়ে দিলেন। কারণ, ইহুদিদের ইয়ারমুক আর খৃষ্টানদের ক্রুশ সাধরণত ছোট আকৃতিরই হয়ে থাকে। মুসলিম কমিউনিটি শেষ যে আশাটা ধরে রেখেছিলেন মন্ত্রিপরিষদের এই রায় তাতে পানি ঢেলে দিলো। প্রতিবাদে কিছু মুসলিম ছাত্রী পরদিন বোরকা ও স্কার্ফ পরেই স্কুলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। আবার নেমে এলো খড়গ। একদিনে শুধু লাইস সেন্ট এক্সিপিউরি স্কুল থেকেই ২৪ জন হিজাবপরিহিত মেয়েকে বহিষ্কার করা হলো।
এরপর তর্ক-বিতর্ক, সালিশ-মামলা বহুকিছুই হয়েছে, কাজের কাজটাই শুধু হয়নি। ২০০৩ এ এসে নতুন প্রেসিডেন্ট জ্যাক সিরাক (কারো কাছে- সাইরাস) স্কার্ফ ও হিজাবের সাথে সাথে ইহুদি ছাত্রদের ইয়ারমুক (মাথার তালুতে ব্যবহৃত ছোট্ট টুপিবিশেষ) এবং খৃষ্টানদের দৃশ্যমান ক্রুশ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রায়ে একপ্রকার সাম্য বা নিরপেক্ষতা আনার প্রয়াস পান। বঞ্চিত থেকে যায় কেবল মুসলিম ছেলে-মেয়েরা।
হিজাব নিষিদ্ধে ফ্রান্সই প্রথম!
এখানে ১৯৮৯-১৯৯৪ পর্যন্ত মোট ছ’ বছরের ঘটনাপ্রবাহ সংক্ষেপে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০৩ এ এসে প্রেসিডেন্ট জ্যাক সিরাক যার চূড়ান্ত রূপ দেন। বিশ্বে ফ্রান্সই প্রথম রাষ্ট্র যেটি প্রথমবারের মতো মুসলিম মেয়েদের ধর্মীয় এই অধিকার হরণ করে। এ ঘটনার তাৎপর্য ব্যাখ্যায় না গিয়েও শুধু বাস্তবতাুঁকু যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাহলেও মাথা ঘুরে যেতে বাধ্য।
পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রীয় কাঠামো তো আর আমাদের মতো নয়। পুরো দেশ একটা সিস্টেমে চলে। যেসকল মুসলিম মেয়েকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এমন নয় যে পাশের আরেকটা স্কুলে গিয়ে তারা ভর্তি হতে পারবে। আর ওখানে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে রাষ্ট্রের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া।
সুতরাং নব্বইয়ের পুরো দশকজুড়ে যেসব মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী স্কুল-কলেজ থেকে সরাসরি বহিষ্কৃত-বিতাড়িত বা নানা চাপে পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে তারা এক কথায় রাষ্ট্রের সবধরনের অধিকার থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বাচ্চাদের সাথে সম্পর্কিত এই আইনটির মাধ্যমে মূলত ফ্রান্সের প্রায় এক কোটি মুসলিমকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে।
সন্তান পড়াশোনার উপযুক্ত হলে এখন মুসলিম মা-বাবাদের আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়- ধর্মকে পাশে ঠেলে নিজেদের সন্তানদের তারা স্কুলে পাঠাবেন, না ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় সকল সুবিধা ও অধিকার থেকে প্রিয় সন্তানদের বঞ্চিত করবেন।
এই আইনটি একই সাথে হিজাব নিষিদ্ধের পটভূমি তৈরি করার পাশাপাশি পুরো বিশ্বে বিশেষত পাশ্চাত্যে ইসলামী জীবনধারার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি এবং মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার হরণের একটা নজির হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে বেলজিয়ামও হিজাব নিষিদ্ধ করে। বিশ্বে এই দুটি দেশই পাবলিক স্পেসে জাতীয়ভাবে হিজাব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
ফ্রান্সের দেখাদেখি স্পেন, রাশিয়া, ইটালি এবং সুইজারল্যান্ডের মতো প্রভাবশালী দেশও জাতীয়ভাবে না হোক লোকালভাবে অনেক প্রদেশে বা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করেছে।
আর এসবেরই সূত্রপাত ছিলো সেই নব্বইয়ের দশকে স্কুলে স্কার্ফ নিষিদ্ধকরণ। আফসোসের ব্যাপার এই- রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সের বেশ কয়েকটা পরিচিতির মধ্যে একটা হলো, ফ্রান্স মানবাধিকারের দেশ। একই সাথে পুরো ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সই মুসলিম জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে এগিয়ে। অথচ এই দেশটিই তার অন্যতম বৃহৎ নাগরিক সম্প্রদায়কে তাদের মৌলিক একটি অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বসলো।
শুধু বঞ্চিতই তো করেনি, বিশ্বে সবার আগে করলো এবং অত্যন্ত রূঢ় ও অমানবিকভাবেই করলো।
মানবাধিকার লংঘনের কালো অধ্যায়
ব্যাপার শুধু এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হতো। হয়নি। একান্ত ধর্মীয় এই বিষয়ের সাথে এরপর ভোটের রাজনীতি জড়িয়ে গেলো। আর দশজন নাগরিকের মতো একজন নাগরিকের পরিচয় হারিয়ে মুসলিমরা হঠাৎ পরিচিত হয়ে ওঠলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো- কে কীভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীর এই ভোটব্যাংকটি নিজের দখলে নেবেন। সকাল-সন্ধ্যায় দিনের দুই রূপের মতো মুসলিমদের কাছে এসে তারা একপ্রকার প্রতিশ্রুতি শোনান আবার ফ্রেঞ্চ সোসাইটিতে গিয়ে শোনান অন্যরকম কেচ্ছা। সাধারণ ফ্রেঞ্চ নাগরিকদের কাছে গেলে তারা হন খাঁটি জাতীয়তাবাদী আর মুসলিমসম্প্রদায়ের কাছে এলে হয়ে যান ত্রাতা।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ভোটব্যাংকের এই কার্ড চালাচালিতে একসময় বড় খিলাড়ি হিসেবে আবির্ভূত হন নিকোলাস সার্কোজি। শ্রেণিবৈষম্যের লোকাল এই চর্চাকে ২০০৭ এর প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে তিনি জাতীয়পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন। এবং এই প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের মুসলিমরা বুঝতে পারেন- পূর্বের বৈষম্যমূলক রায়গুলোর ক্ষেত্রেও দু’ দু’বার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রির দায়িত্ব পালন করা নতুন নির্বাচিত এই প্রেসিডেন্টের বিশাল ভূমিকা ছিলো। দু’বার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সার্কোজি ইতোপূর্বে অর্থমন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই ফ্রান্সের অর্থনৈতকি অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
২০০৮’র বৈশ্বিক মন্দা (সারাবিশ্বের- বিশেষত পাশ্চাত্যের শেয়ার বাজারসহ প্রায় সকল অর্থনৈতিক সেক্টরের অচিন্তনীয় ধস) মোকাবেলা করতে গিয়ে ফ্রান্সের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। সামলে উঠতে না পারায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন নিকোলাস সার্কোজি। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে- এসময় আবার তিনি পুরনো কার্ড খেলার সিদ্ধান্ত নেন।
স্কার্ফ দিয়ে শুরু হওয়া মুসলিম নারীদের পেশাক বিষয়ক বিতর্ক ততোদিনে হিজাব-বোরকা পর্যন্ত গড়িয়েছে- হঠাৎ তিনি এ নিয়ে বিতর্ক উসকে দেন। ‘ফ্রান্সে ইসলামী বোরকাকে স্বাগত জানানো হবে না’ মর্মে ঘোষণা দিয়ে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রয়াস পান। একইসাথে হিজাব-বোরকাকে তিনি বশ্যতামূলক পরিধেয় এবং পোশাকের আড়ালে জেলখানা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ফ্রান্সসহ সারা বিশ্বে এই ঘোষণা ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। তবে রাষ্ট্র ফ্রান্স এটাকে প্রায় দু’দশক ধরে গলায় আটকে থাকা কাঁটা অপসারণের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
৩২ সদস্যবিশিষ্ট শক্তিশালী একটি সংসদীয় কমিশন গঠন করা হয়, যাদের কাজ ছিলো বোরকা নিষিদ্ধের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দ্রুত সেটা বাস্তবায়ন করা। সার্কোজির ঘোষণা এবং সংসদীয় কমিশনের তদন্ত বিষয়ক বিতর্কের মধ্যেও দেশে-বিদেশে এই খবর চাউড় হয়ে যায়- ‘বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা আড়াল করতেই সার্কোজি এই রাজনৈতিক খেলা শুরু করেছেন।’
২৫ জানুয়ারি ২০১০, সংসদীয় কমিশন ‘স্টাডি’ শেষে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন- আজ থেকে ফ্রান্সের পাবলিক স্পেসগুলোতে ইসলামিক হিজাব বা বোরকা নিষিদ্ধ করা হলো।
হুকুম অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রায়ে একপ্রকার সাম্য আনয়ন বা বিতর্ক এড়ানোর দুর্বল প্রয়াস হিসেবে মাস্কসহ যে কোনো ফেস কভারিং পরিধেয়কেও নিষিদ্ধ করা হয়। …
আধুনিক বিশ্বে প্রথমবারের মতো একটি রাষ্ট্র পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অধিকার হরণমূলক এই আইনটি পাস করলো। সৃষ্টি হলো মানবাধিকার লংঘনের কালো অধ্যায়।
Leave a Reply