কোন পথে ইউরোপের ইসলাম

Islam in france

Date

Author

Blog Duration

6 minutes

পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দম ফেলার আগেই পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। প্রযুক্তিজগতে নিত্যনতুন বিপ্লব ঘটিয়ে মানুষ একদিকে জীবনকে গতিময় করছে, সেই মানুষই আবার যখন-তখন রাজনৈতিক খেলার অসহায় পুতুল হচ্ছে। চারপাশে একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে এবং কী ঘটলো কেনো ঘটলো ঠিকভাবে বুঝতে পারার আগেই নতুন ঘটনার খবর চলে আসছে।

প্রতিটি ঘটনা এতোটা আকস্মিক ও লোমহর্ষক, পেছনের কারণগুলো নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। কখনো আসা গেলেও সেটা বহাল থাকছে না। রাতে একরকম ভাবনা নিয়ে ঘুমুতে গেলে সকালের নতুন কোনো খবরে পুরো ভাবনার মোড় ঘুরে যাচেছ। ‘ঘটনার ঘনঘটা’ শব্দবন্ধ দিয়েও ব্যাপারটার ঠিকঠাক ব্যাখ্যা বোধ হয় সম্ভব নয়। মানসিক এই অস্থিরতা আজকাল সবখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক দিনযাপনটাই হয়ে ওঠছে অসম্ভব।

বড় আশংকার ব্যাপার- নিয়ন্ত্রণের লাগামটা কারো হাতে থাকছে না। না ব্যক্তি, না রাষ্ট্র- কারো কাছে কোনো সমাধান নেই। অনুমানটুকুও নেই- কী ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে আসছে দিনগুলোতে। সবাই আমরা শান্তি চাই, স্বস্তি চাই- কিন্তু ব্যক্তি ও সমাজভেদে চাওয়ার মাত্রা আর ধরনগুলো এতো ব্যতিক্রম, পাওয়ার তীব্রতা এতো জিঘাংসামূলক যে, শেষ পর্যন্ত মানুষ আমাদের জীবনেরই কোনো মূল্য থাকছে না। লোভ আর ক্ষমতার রাজনীতি বিশ্বকে আজ আস্ত একটা অগ্নিকু- বানিয়ে ছেড়েছে।

আমাদের চারপাশে অস্বাভাবিক যা ঘটে, সবকিছুর পেছনে সাধারণত মানুষেরই হাত থাকে। এই অপরাধী হয়তো আমার পরিচিত, হয়তো নয়। হয়তো সে আমার দেশের, হয়তো অন্যদেশের। হতে পারে সে আমার ধর্মের কিংবা অন্য কোনো ধর্মের। যে হোক, যেখানের হোক বা যে ধর্মেরই হোক- আল্টিমেটলি একজন মানুষই তো।

খুন-গুম-ব্যভিচারের মতো জঘন্যতম অপরাধ যা পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত ঘটছে, ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের সাধ্য নেই সেগুলো বন্ধ করার বা থামিয়ে দেওয়ার। সরাসরি এগুলো হয়তো আমাদের দায়িত্বও নয়- কিন্তু চাইলেই কি এসবের প্রভাব আমরা এড়াতে পারি? মহান আল্লাহ যে জীবন আমাদের দিয়েছেন- ঠিক পথে সে জীবনকে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে নেওয়াই আমাদের কাজ। এই ‘ঠিক পথে’ কথাটা মূল দায়িত্বের সাথে আরো অনেকগুলো দায়িত্বের ভাবনা সামনে নিয়ে আসে।

আমাদেরকে তাই শুধু নিজের কথা ভাবলে চলে না, প্রতিবেশীদেরও ভাবনায় শামিল করতে হয়। মুসলিম ভাইবোনদের স্বার্থচিন্তা মাথায় রাখতে হয়। একজন মানুষ তখনই ঠিকঠাকভাবে এসব করে এবং পারে- জীবন আর চারপাশের জগৎ নিয়ে তার জানাশোনাটা যখন ব্যালেন্সড হয়।

প্রচুর না হলেও পর্যাপ্ত হয়। পরিস্থিতি বিচারে যখন তার সত্যিকার একটা দেমাগ তৈরি হয়। পৃথিবীজুড়ে গবেষণা, লেখালেখি বা বলাবলির এই যে চর্চা, উদ্দেশ্য তো এই একটিই। ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা একটার পর একটা ঘটতে থাকবে, মিডিয়ার কাঁধে চড়ে খবরের ধারাও অব্যাহত থাকবে; সেগুলোকে নির্দিষ্ট কিছু ছাঁচে ফেলো। সহজ করে ভাবো, সমাধান খোঁজো এবং ঠিক করো নিজের কর্মপদ্ধতি।

তাহলেই দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হবে। স্বস্তিদায়ক হবে জীবনচলার পথ।

বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহর আজকের যে দুর্দশাগ্রস্ত ও জর্জরিত হাল, আশাবাদী হওয়ার প্রত্যক্ষ বা দৃশ্যমান কোনো কারণ তো নেই। বড় স্বস্তির বিষয়- গন্তব্যটা আমরা জানি। আমাদের শাশ্বত পথনির্দেশক কুরআন এবং হাদীসে উম্মাহর জয়-পরাজয় আর উত্থান-পতন নিয়ে সবিস্তার বিবরণ বিদ্যমান।

আজকের পরাজিত ও অধঃপতিত হালতের পর সময় তো কেবল উত্থানের। কখন, কোত্থেকে বা কীভাবে সেটা শুরু হবে- এইটুকু শুধু জানা নেই।

আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসার পাশাপাশি প্রচেষ্টাটা তাই আরো ব্যাপক এবং চিন্তার ক্ষেত্রটা আরো প্রসারিত করা দরকার। আরবের পবিত্র ভূমি না পশ্চিমের দিকভ্রান্ত সমাজ- কোত্থেকে উম্মাহর এ জয়যাত্রা শুরু হবে বা ইতোমধ্যে হয়েও গেছে কিনা কে বলতে পারে! উপেক্ষা বা একপেশে ভাবনার পরিবর্তে এখন তাই সচেতনতা এবং ভালোবাসার বিস্তার ঘটানো দরকার।

আবেগের জায়গা থেকে বেরিয়ে নির্মোহ মূল্যায়নে যাওয়া দরকার। এসব ভাবনা থেকেই এই মুহূর্তের পাশ্চাত্যকে একটু বিশদভাবে জানার প্রচেষ্টাটি শুরু করেছিলাম। হতাশ হয়ে লক্ষ করলাম- এ নিয়ে তেমন কাজই হয়নি আমাদের। টুকটাক যা-ও হয় বা হচ্ছে- আবেগ, মিথ আর একপ্রকার ঘৃণার মিশেলে সেগুলো এতোটাই গোলমেলে- সিদ্ধান্তে যাবার কোনো সুযোগই নেই।

আজকের এই জটাজটিল বিশ্বে এককথায় সমাধান করা বা সিদ্ধান্তে যাওয়ার মানসিকতা তো রীতিমতো আত্মঘাতি।

পড়ার টেবিল ছাপিয়ে একসময় লেখার কাজ শুরু হলো, বন্ধুবর ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলিলের সৌজন্যে এসময় এগিয়ে এলো জামেয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকার গবেষণাধর্মী ম্যাগাজিন নেয়ামত। ধারাবাহিকভাবে বেশকিছু লেখা মাসিক নেয়ামতে প্রকাশিত হলো। এরপরের কৃতিত্ব পাঠকবর্গের। তাদের চাওয়া এবং অব্যাহত প্রেরণাতেই প্রচেষ্টাটি এখনো চালু রয়েছে। ইনশাআল্লাহ থাকবে।

Islam in europe

শার্লি এবদোয় হামলার প্রেক্ষাপটে লেখাটা শুরু হওয়ায় প্রথমে ফ্রান্স নিয়ে আলোচনা এসেছে। সাত পর্বের সে আলোচনা পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। বই করার তাগাদাটাও তখন থেকেই শুরু। বছর না পেরুতেই এরপর প্যারিসের রহস্যময় সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে ত্বরান্বিত হয় বই প্রকাশের দাবি।

অধমও তাই দেরি না করে মোটামুটি একটা ফরম্যাট দাঁড় করিয়ে আপনাদের করকমলে পেশ করার প্রয়াস পেলাম। বাহুল্য ও দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে এই আলোচনায় কেবল মৌলিক বিষয়গুলো তুলে আনার চেষ্টা করেছি। তবু শুধু ফ্রান্সের প্রেক্ষাপটে করা আলোচনা দিয়েই আস্ত এই বই দাঁড়িয়ে গেছে।

শিরোনামের ইউরোপ বলতে এখানে বিশেষভাবে ফ্রান্সকে বিবেচনায় রেখে বইটি পাঠের আহ্বান থাকলো। ফ্রান্সের মুসলিম সমাজ, ফ্রান্সে ইসলামের প্রায় তেরশ’ বছরের ঐতিহাসিক অভিযাত্রা এবং আজকের বাস্তবতার পাশাপাশি শার্লি এবদো ও সাম্প্রতিক প্যারিস হামলা নিয়ে সবিস্তার আলোচনা এই বইয়ে স্থান পেয়েছে। শেষদিকে প্রখ্যাত কুরআন গবেষক ডা. মরিস বুকাইলির দুর্লভ একটি সাক্ষাৎকারসহ ফ্রান্সেরই ক’জন নওমুসলিমের আত্মকাহিনী যুক্ত হয়েছে।

লেখালেখি আদতে সহজ না কঠিন, এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কারো বেলায় লেখালেখিকে যেমন খুব সাধারণ একটা ব্যাপার মনে হয়, কারো বেলায় আবার ভাবাই যায় না। চাইলেই কি আর কিছু লিখে ফেলা যায়! তবে তর্ক-বিতর্কের প্রসঙ্গ এড়িয়ে এটুকু অন্তত বলাই যায়-

কল্পনার রাজ্য ছেড়ে লেখা যতোটা বাস্তবভিত্তিক হয়, চারপাশের প্রকৃতি বা তাত্ত্বিক বিষয়াদির বাইরে লেখা যতোটা জীবনঘনিষ্ঠ হয় কিংবা মহান আল্লাহর অবাক সৃষ্টি মানুষই যখন উপজীব্য হয়ে ওঠে; লেখালেখিটা তখন সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ভিন্ন দেশ, অচেনা পরিবেশ, অনভ্যস্ত সংস্কৃতির মানুষ আর তাদের জীবনধারা নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বেশি সত্যি। ‘কোন পথে ইউরোপের ইসলাম’- শিরোনামের বক্ষমান বইটির কাজ করতে গিয়ে বরাবর আমাকে এই জটিল বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

ইউরোপ- শুধু ইউরোপ কেনো পুরো পশ্চিমা বিশ্ব নিয়েই আমাদের সমাজে মিথের দারুণ ছড়াছড়ি, বিশেষত ইসলাম বা মুসলিম সমাজকেন্দ্রিক ভাবাভাবি তো পুরোই আবেগনির্ভর।

এমন বৈরী বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ইন্টারনেটের মতো বিভ্রান্তিকর তথ্যজালের চ্যালেঞ্জ ডিঙিয়ে প্রকৃত সত্য তুলে আনার কাজটা তো জটিলই হবার কথা। নিজের যৎ সামান্য জ্ঞান, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা; অজ¯্র ওয়েবসাইট এবং সবশেষে ইউরোপেরই ক’জন নওমুসলিম ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে যাওয়া অভিবাসীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কাজটা চালিয়ে যেতে হয়েছে। এ পর্যন্ত যেটুকু করা গেলো, আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানি ছাড়া কিছুতেই তা সম্ভবপর ছিলো না। প্রশংসা সব মহান সে মালিকের।

মাসিক ম্যাগাজিন ‘নতুন ডাক’ -’র মতো আমার প্রায় সব কাজই তরুণদের উদ্দেশ্যে করা। এদেশের ঘুমন্ত তারুণ্যের প্রতিই আমার সকল নিবেদন। এই বইয়ের কাজ করতে গিয়েও বিবেচনাটা হয়তো এড়াতে পারি নি। বইটিকে তাই চূড়ান্ত কোনো গবেষণাকর্ম হিসেবে গ্রহণ না করে বরং পাশ্চাত্য বিষয়ক আপনার নিজস্ব জানাশোনা এবং ভাবাভাবির সহযোগী একটি গ্রন্থণা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ থাকলো।

কাজের শুরুতেই দুটো বিষয়কে একপ্রকার মূলনীতি হিসেবে স্থির করে নিয়েছিলাম- আবেগের জায়গা থেকে বেরিয়ে ও যথাসাধ্য বিভ্রান্তি এড়িয়ে প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরা এবং নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থেকে বিরত থাকা। সচেতনভাবেই নীতিটা মেনে চলার চেষ্টা করেছি- কোথাও ব্যত্যয় ঘটলে নিঃসন্দেহে তা আমারই ব্যর্থতা।

আবেগের জায়গা থেকে বেরুতে না পারলে কোনো কাজেই প্রত্যাশিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়।

দৃশ্যমান লড়াইয়ের বাইরেও ভেতরগত যে লড়াইটা পাশ্চাত্যে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনেরা করে যাচ্ছেন, সেটা তো বিশেষ কোনো এলাকা বা সময়ে সীমবদ্ধ নয়। লড়াই সবখানের। প্রতিমুহূর্তের। তাদের মধ্যে প্রবহমান ¯্রােতে গা ভাসানোর নজির যেমন আছে, সবধরনের নোংরামি আর বৈরিতা ঠেলে সামনে এগিয়ে চলার লোকেরও অভাব নেই।

অবজ্ঞায় চোখ ফেরানো বা সহমর্মিতায় গলে পড়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের সংগ্রামের ভাষাটা পড়তে পারা। প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে এখানে আমি তাই নির্মোহ বাস্তবতাটাই তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, বৈরী মত ও পথের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরতেও কার্পণ্য করি নি শুধু এই ভাবনায়।

আরোপিত সিদ্ধান্ত সব সম্ভাবনাকে শুরুতেই দাফন করে দিতে পারে, অগ্রসর ভাবনা এবং রুচিবোধের এই জায়গাটার প্রতিও যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে চেয়েছি। কতোটুকু পারলাম, সেই বিবেচনা এখন আপনাদের হাতে।

বই প্রকাশের এই মুহূর্তে স্মরণ করছি আমার সব বন্ধু-সুহৃদদের, প্রতিনিয়ত যাদের সাথে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। ভেতরের একটা তাড়না থেকেই দিনমান এসব ভাবনায় আমরা মেতে থাকি। প্রত্যাশায় দোষ কী- কোনো একদিন সত্যিই হয়তো কাঙ্খিত পথের দিশা পেয়ে যাবো।

স্বপ্নময় সে যাত্রার অপেক্ষায় একটা জীবন তো কাটিয়েই দেয়া যায়- প্রত্যয়ীদের হারাবার যে কিছু নেই!

নয়ানগর, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
২৬/১২/১৫ইং

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *