গত জানুয়ারিতে শার্লি এবদোয় হামলার প্রেক্ষাপটে মূলত জার্মানিতেই ‘প্যাগিডা’র আহ্বানে ইসলামবিদ্বেষী আন্দোলন গড়ে ওঠেছিলো, পরে যা পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি আয়নাল কুর্দির মৃত্যু পরবর্তী মানবতার আবেগী আহ্বানে এই জার্মানিই সবচে আগে এবং ব্যাপকভাবে এগিয়ে এসে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। চলতি বছর ৮ লাখ অভিবাসীকে গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়ায় জার্মানিতে মুসলিম ইস্যুটি নিয়ে ইতোমধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। কিছুদিন নীরব থাকার পর এই সুযোগে র‌্যাসিস্ট সংগঠন প্যাগিডাও আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। জার্মানিতে ইসলাম ও মুসলিম বিষয়ক এ আলোচনার শুরুতে এ পর্বে আমরা ড. ইসরা ওজিউরেক ’র সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোকপাত তুলে ধরছি। উল্লেখ্য- ড. ইসরা তুর্কি বংশোদ্ভুত প্রখ্যাত একজন পশ্চিমা গবেষক। সম্প্রতি ‘বিয়ীং জার্মান, বিকামিং মুসলিম’ শিরোনামে একটি গবেষণা গ্রন্থ লিখে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। আমরা তার সব চিন্তা ও কাজকে পুরোপুরি সমর্থন করি না, তবে ভালো কাজ হলে তো গ্রহণ করতেও বাধা নেই। এই ভাবনা থেকেই তার আলোচনাটা এখানে আনছি এবং সামনে আরো কয়েকবার তাঁর প্রসঙ্গ আসবে। আপনাকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা- শাকিল আদনান

জার্মানিতে ইসলাম: চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

পশ্চিম ইউরোপে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিকাশ ও ক্রমবর্ধমান উন্নতির ধারা বিষয়ক গবেষণাগুলো বেশিরভাগ সময় অভিবাসন আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেই পরিচালিত হয়। কিন্ত বাস্তবতা হলো এই দেশগুলোতে প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যাক স্থানীয় ও স্থায়ী নাগরিকগণও ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আমি এখানে পশ্চিম ইউরোপের প্রধানতম দেশ জার্মানির নওমুসলিমদের যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে সেসব নিয়ে সামান্য আলোচনা করবো। জার্মানির মুসলিম কমিউনিটিগুলো কীভাবে নওমুসলিমদের ট্রিট করছেন সেটাও একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করবো।

এটা অনুমিত যে জার্মানিতে কমবেশ এক লক্ষ নওমুসলিম আছেন। এ সংখ্যাটি পাশ্ববর্তী দুই দেশ ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের সাথেও সামাঞ্জস্যশীল। একইভাবে এটাও সত্য যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিম ইউরোপের এই দেশগুলোতেও প্রতিনিয়ত ইসলাম গ্রহণকারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আর বলার প্রয়োজন নেই, সাম্প্রতিক কালে এ রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামভীতি এবং মুসলিমদের ঘৃণার সংস্কৃতিও বেশ গতি পাচ্ছে। এমন বৈরি পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও দিন দিন ইসলাম গ্রহণের ধারা বৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিমদের আরো খুলে বললে নওমুসলিমদের প্রতি চিন্তকদের কৌতূহলও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ নওমুসলিমদের এখানে প্রতিনিয়ত নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ একটা সম্প্রদায় হিসেবে চিন্হিত হবার পাশাপাশি তাদেরকে জাতিগত বিদ্বেষেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। একইসাথে এই জার্মান মুসলিমদের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে জার্মানির মূল ¯্রােত বা জাতীয় পরিচিতির সাথে নিজেদের মেলাবার জন্য এবং অন্যদিকে আবার মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত হবার জন্যও। অন্যভাবে বললে- ইসলামে কনভার্ট হবার বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত ব্যাপার মনে হলেও এটা একটা সামাজিক বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবে বিষয়টির সাথে বিশেষ উদ্দেশ্য জড়িয়ে যাচ্ছে, জার্মান সোসাইটি এমনকি স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়েও। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল।

এখানে কিছু প্রশ্ন চলে আসে- যেসব জার্মান নাগরিক ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছেন, ইসলাম বিষয়ক ব্যাপক ভীতি ও ঘৃণা সমাজে ছড়িয়ে থাকার পরও তাদের মনে কী করে ইসলামের প্রতি মুগ্ধতা কাজ করছে? কেনো এবং কীভাবে জার্মানির কেউ একজন ইসলামকে ভালোবাসতে পারে- যেখানে অভিবাসী মুসলিম এবং তাদের ধর্মচর্চাকে প্রতিনিয়ত নানারকম বাধার মুেেখ পড়তে হচ্ছে? একজন ‘সাদা’ মুসলিম হওয়াটা কী অর্থ বহন করে যেখানে ইসলামকে বিশেষভাবে একটা জাতির সাথে জুড়ে দেবার অপচেষ্টা চলে? কনভার্ট বা ধর্মান্তরিত হবার পর এসব জার্মান মুসলিম কী করে স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটিগুলোর সাথে নিজেদের যুক্ত করে? পূর্বের একজন খৃষ্টান বা নাস্তিক জার্মান মুসলিম হবার পর নিজের সমাজ, ধর্ম এবং জার্মান জাতীয়তাবাদ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কীভাবে বা কোন দৃষ্টিকোণ নিয়ে কথা বলে?

এই প্রশ্নগুলো আমার সাম্প্রতিক সাড়াজাগানো গ্রন্থ- ‘বিয়ীং জার্মান, বিকামিং মুসলিম’ বইয়ের আলোকে তোলা। এই বইটি সেসব অভিজ্ঞতার নিয়ে লেখা যেগুলো গত দশ বছরে জার্মান নওমুসলিম সোসাইটির সাথে সময় ব্যয়ের মাধ্যমে আমার অর্জিত হয়েছে। এতে আমি তথাকথিত ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতির মতো কুসংস্কার এবং বর্জনীয় মানসিকতার জটিল রূপটিও বুঝে ওঠার চেষ্টা করেছি। মূলধারার জার্মান এবং জন্মগত বা ধর্মান্তরিত মুসলিমদের পারস্পরিক আচরণ, আরও পরে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যকার বোঝাপরা এবং তাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের বিষয়েও আলোকপাত করার প্রয়াস পেয়েছি।

মুসলিম পরিচিতিটা জার্মানিতে এমন এক বিষয় যেটা অভিবাসী মুসলিমদের গায়ে রীতিমতো সেঁটে দেয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু ইসলাম তো সাধারণ ইউরোপীয় দ্বারাও গৃহীত হতে পারে এবং হচ্ছে। এই ন্যাটিভ ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রেও কি আমরা সেভাবে সমালোচনা করতো পারবো বা বলতে পারবো যে তাদের ট্র্যাডিশনও ইসলামোফোবিয়া? আমরা এমন কোনো সূত্র দেখাতে পারবো কি- এই ধর্মান্তরিত নওমুসলিমেরা মূলধারার ইউরোপীয় সমাজে ঠিক কী ধরনের ঘৃণা সৃষ্টি করছে? অথবা অন্যভাবে বললে- তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা পছন্দ ইউরোপের কোন ক্ষেত্র বা অংশে ক্ষত সৃষ্টি করছে?

এই বিষয়গুলো জার্মান সোসাইটির মজবুত অবয়বে সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে গেছে। সাথে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে ধর্ম পরিবর্তনের বিশেষ করে ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে কেমন গুরুত্ব পায় বা পাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে- যুদ্ধবিদ্ধস্ত জার্মানির পুনর্গঠনে লাখ লাখ মুসলিম শ্রমিকের জার্মানিতে আগমন ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচে বড় উন্নয়ন কর্মকা- এবং ইতিবাচক ব্যাপারগুলোর একটি। তাদের এই অভিবাসন গ্রহণই মূলত নতুন জার্মানি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। এই শ্রমিকশ্রেণী এবং তাদের পরিবারগুলো অচিন্তনীয় এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছিলো এতোদিনের একঘেয়ে ও পোস্ট হলোকাস্টের (ব্যাপকাকারে মানবহত্যা) অভিযোগাক্রান্ত জার্মান সমাজে। এবং নিশ্চল এক অবস্থা থেকে জার্মান সোসাইটিকে তারা পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়ার সাথে সাথে অগ্রগতির দিকে নিয়ে গেছে।

এই অগ্রগতির একটি ফলাফল ছিলো জার্মান ও তুর্কি জাতি এবং মুসলিম-খৃষ্টান ও সাধারণ ইউরোপীয়দের মধ্যে সম্পর্ক ও আস্থার পুননির্মাণ। এর আরেকটি উজ্জ্বল দিক ছিলো সাংস্কৃতিক দূরত্ব কমানো এবং বিভাজনের দেয়াল ভেঙে দিয়ে দুই জার্মানির একত্রিত হয়ে যাওয়া। ২০০০ সালে জার্মান নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তিত হবার পর তাই হাজার হাজার মুসলিম অভিবাসী এবং তাদের সন্তানেরা নির্দ্বিধায় জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। এ সময় খুব বড় না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় সাবেক খৃষ্টান এবং নাস্তিক জার্মান নাগরিকের ইসলামের ছায়াতলে আসার বিষয়টি সবার দৃষ্টিতে আসে। জার্মান এবং মুসলিম ইস্যুর সুরাহার প্রশ্নে দুই জার্মানির একত্রিত হবার ঘটনারও ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

গোড়া ও মূলধারার জার্মান সমাজ তাদের নওমুসলিমদের বিশেষভাবে শ্রেণীভুক্ত করে এবং প্রশ্ন তুলে থাকে তাদের জার্মান বা ইএরাপীয়ান জাতীয়তাবাদ নিয়ে। তাদের অযৌক্তিক জিজ্ঞাসা- একজন মানুষ একইসাথে একজন মুসলিম এবং একজন ইউরোপীয়ান বা জার্মান কী করে হতে বা থাকতে পারে? তাদের বিবেচনায় অভিবাসী মুসলিমেরা তো বটেই, ধর্মান্তরিত নওমুসলিমেরাও জার্মানির জন্য একপ্রকার অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সন্ত্রাসী। এসব কারণে জার্মানির নওমুসলিমেরাও নিজেদের অন্যান্য অভিবাসী মুসলিম সোসাইটি থেকে একপ্রকার দূরে রাখতে সচেষ্ট হয়। প্রথমেই তারা জাতিগত পরিচয়ের সংকটে পড়তে চায় না বা অপবাদ মুক্ত থাকার প্রয়াস পায়। বিপরীত পরিস্থিতি এড়াতে কিছু কিছু নওমুসলিম তো এমন ধারণার প্রচারেও প্রয়াসী হন যে জার্মান মূল্যবোধ এবং জীবনধারার সাথে আসলে ইসলামের তেমন কোনো বিরোধ নেই। জার্মানির পুরনো জীবনধারার সমালোচনা করলেও বার্লিন দেয়াল ভেঙে দুই জার্মানির একত্র হবার পরবর্তী সম্মিলিত জার্মানকে তারা যথেষ্টই উদার এবং ইসলামের সাথে সামঞ্জশ্যসীল মানতে চান।

জন্মগত মুসলিম যারা জার্মানির আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠেছেন তারা চারপাশের আলোচনা-সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে সাংস্কৃতিক বৈষম্য ঘোচানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিশ্বাস করেন- ইসলামী মূল্যবোধ ও জীবনধারার সাথে আপস না করেই জার্মানির মূলধারায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর একীভূত হওয়া সম্ভব। জার্মাানির ধর্মান্তরিত মুসলিমেরা জাতীয় ঐতিহ্য এবং পরিচিতির সাথে সংঘর্ষ না রেখেই পরিপূর্ণ ইসলামের অনুসরণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার এবং সবধরনের বিবেচনাতেই বেশ যুক্তিযুক্ত।

অস্থির বিশ্ব মাড়িয়ে ইতিহাসের পথে যাত্রা

ইউরোপের হালচাল নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার এবারের পর্বটি যখন লিখতে বসছি, দেশীয় এবং বৈশ্বিক দুই দিকের হাওয়াই তখন যথেষ্ট সরগরম। এক মাসের ব্যবধানে বিদেশী নাগরিকদের ওপর তিন-চারটা জীবনঘাতী হামলা হলো, দিনে-দুপুরে দেশের নিরাপদতম দুটো স্থানে একই সময়ে লেখক-প্রকাশকদের কুপানো হলো, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে একজন পুলিশ সদস্যকেও মেরে ফেলা হলো। সাথে নব্য ক্রেজ ইসলামিক স্টেটের উড়ো বার্তার আতংক তো আছেই। কয়েক বছর ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থার সাথে নিরাপত্তার হঠাৎ এমন ‘ব্ল্যাকহোল’সম ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় দেশবাসী মারাত্মক অস্বস্তিতে পড়লেন। ১৯-২০ তারিখে আচমকা ইন্টারনেটের প্রধান প্রধান যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ এবং বিএনপির সাকা চৌধুরী ও জামায়াতের মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রাখার ঘোষণা দিয়ে সরকার তাতে চূড়ান্ত মাত্রা যুক্ত করলো। দমবন্ধ অবস্থা আর কাকে বলে?…

সব পক্ষই সময়মত নিজেদের কাজ ঠিকঠাকভাবেই করে যাচ্ছে, আমজনতা আমরাই কেবল বুঝে উঠতে পারছি না আমাদের এখন কী করণীয়! দেশের হাল যখন এই, বিশ্ব পরিস্থিতি তখন আরো উত্তাল। ১৩-২০ নভেম্বর এই এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিশ্ববাসী সাম্প্রতিক কালের ভয়াবহতম ক’টি সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়লো। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় লেবাননের বৈরুতে পৃথক দুটো বোমা হামলায় কমপক্ষে ৪৩ জন নিহত এবং বহু মানুষ জখম হলেন। ২৭ ঘন্টার ব্যবধানে পরদিন ফ্রান্সের প্যারিসে ছ’টি স্থানে একই সময়ের হামলায় নিহত হলেন ১৩২ ইউরোপীয়। তিন দিনের ব্যবধানে ফের দু:সংবাদ এলো। ক্ষেত্র এবার নাইজেরিয়া। এখানেও পৃথক দুটো হামলায় ৪৪ জন মানুষ নৃশংসতার শিকার হয়ে জীবন হারালেন। দু’দিন পর আবার- এবার মালীতে নিহত হলেন আরো প্রায় ত্রিশ জন। বিক্ষিপ্ত অন্যান্য ছোটখাট হামলা বা দুর্ঘটনা তো ছিলোই। মাত্র এক সপ্তাহে আড়াইশ’র বেশি মানুষ অস্বাভাবিক মৃত্যুর মুখে পড়লেন, পঙ্গুত্ব বরণ করলেন আরো অসংখ্য নারী-পুরুষ। প্রিয়জন হারানো মানুষগুলোর কষ্ট আর অসহায়ত্ব তো কোনো এঙ্গেল থেকেই হিসেবে আনা সম্ভব নয়। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়- আমরা এখন কোন পৃথিবীতে বাস করছি?

প্রতিটি মৃত্যুই কষ্টের। সেই মৃত্যুকে যদি অস্বাভাবিক বা নৃশংস শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয়, কষ্টের মাত্রাটা এমনিতেই বেড়ে যায়। কতোটা বাড়ে?…সেটা পরিমাপ করার ক্ষমতা মানুষ আমাদের নেই।

কিন্তু মৃত্যুর মতো বেদনাময় এবং আপাত নিরীহ এই ব্যাপারটার সাথেই আপনি যখন আঞ্চলিক রাজনীতি, ধর্মের লেবাস কিংবা গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান জুড়ে দিতে চাইবেন, কষ্ট ছাপিয়ে মনে তখন নানারকম প্রশ্ন জাগবে।

প্যারিসের ঘটনা এবং পরবর্তী তৎপরতা আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহের মিডিয়া কভারেজ হিসেব করেই বলা হচ্ছে- ৯/১১ ’র টুইন টাওয়ার হামলার পর প্যারিস হামলার ঘটনাই বিশ্বের সবচে’ আলোচিত ঘটনা। এই আলোচনা আর সব বিষয় ছাড়াও বৈরুতের ৪৪, নাইজেরিয়ার ৪৩ এবং মালীর অপর ৩০ জনের মৃত্যুর খবরকে প্রায় মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে। সপ্তাহ পেরিয়েও বিশ্ব মিডিয়ার এমন দাপুটে কভারেজ ধরে রাখার বিষয়টিই বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। জীবন তো জীবনই, সব মৃত্যুতেই তো একইরকম প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। প্যারিসের জন্য আপনার মন ব্যথিত হলে মালী-নাইজেরিয়ার জন্য কেনো নয়? ইউরোপবাসীর মৃত্যুতে আপনার চোখে পানি এলে বৈরুতের জন্য কেনো নয়? সিরিয়া, ইরাক, আফগানের কথা আর নাইবা ওঠালাম। প্যারিসের জন্য তো আমরাও কেঁদেছি। কিন্তু চোখের পানি শুকাবার আগেই দায়টা যখন আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো, ক’জন ব্যক্তির দায়ে ইসলামকেই যখন কাঠগড়ায় ওঠাবার পাঁয়তারা শুরু হলো- কষ্ট ছাপিয়ে আমাদের মনেও তখন প্রশ্ন জাগলো।

কেনো এই হামলা? কারা এই হামলা করলো? কঠোর নজরদারির আওতায় থাকা প্যারিসের ছ’টি নিরাপদতম স্থানে একই সময়ে এমন হামলা পরিচালনা কীভাবে সম্ভব? শার্লি এবদোয় হামলার বছর না ঘুরতেই আবারও কেনো ফ্রান্সই আক্রান্ত? এই হামলার পর সিরিয়ার নিরীহ শরণার্থী শিবির কেনো আক্রান্ত হলো? শোক আর সন্ত্রাসবাদের প্রশ্ন এড়িয়ে কেনো হঠাৎ শরণার্থী গ্রহণের প্রশ্নে অস্বীকৃতি এলো? ইসলাম পশ্চিমের জন্য হুমকি- প্রায় মরে যাওয়া এই প্রশ্ন আবার কেনো সামনে নিয়ে আসার অপচেষ্টা শুরু হয়ে গেলো?…হ্যাঁ, এই প্রশ্নগুলো সামনে এনে ভাবুন। হিসেব মিলতে শুরু করবে।

আইএস বা জঙ্গিগোষ্ঠীর শক্তি-সামর্থ্য, নিরপরাধ মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ কিংবা আল্লাহর সঠিক বিচারের ব্যাখ্যা দূর কি বাত, এখানে বরং সব সত্যের ওপরের সত্য হলো- মোসাদ কিংবা পশ্চিমের বিশেষ কোনো দেশ-সংস্থার অজ্ঞাতে, অসহযোগিতায় ইউরোপ-আমেরিকায় এমনতর হামলা চালানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেই। শান্তি আর স্থিতিশীলতা নিয়ে যতো বাণীই আমরা ছড়াই না কেনো, যুদ্ধই পৃথিবীর অনিবার্য বাস্তবতা। বড় শক্তিগুলো নিজেদের প্রয়োজনে কোথাও নিজেরা আর কোথাও স্থানীয় চাটুকার দিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখে। রাখবেই, নইলে তাদের টিকে থাকা সম্ভব না। সিরিয়া, ইরাক, আফগানে নিজেদের প্রয়োজনে ওরা যেভাবে নৃশংসতা চালায়, এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই আইএস বা আলকায়েদার কোনো নিবেদিত প্রাণ কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়ে আবার নতুন হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। প্যারিসের হামলার বেলায়ও এ আশংকাকে আপনি ছুড়ে পারবেন না। আশি-নব্বইয়ের তথাকথিত ‘কোল্ড ওয়ার’ শেষ হবার পর থেকে গত দুই দশক ধরে এ-ই তো চলে আসছে।

এখানে আইএস বা ইসলামের নামে অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপের কাজকে সমর্থন বা তাদের নির্দোশ প্রমাণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় এমন ভয়াবহ হামলা চালাবার মতো শক্তিশালী পক্ষ হিসেবেও ওদেরকে মেনে নিতে আমরা রাজি নই। যদি তা সত্যও হয়- এর দায় কেনো ইসলাম বা মুসলিম উম্মাহর ওপর আসবে? এসব হামলা বিচারের প্রধানতম প্রতিপাদ্য- দিন শেষে বেশি লাভটা কার?…আরব বসন্ত থেকে নিয়ে বর্তমান সিরিয়া পর্যন্ত যা হয়েছে তাতে যে পশ্চিমাদেরই বড় হাত ছিলো, আমরা জানতাম। রাশিয়া এই ক’দিন আগে সিরিয়ায় হামলা চালালে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে। ক্ষমতায় আরোহনের প্রায় এক যুগ পর এই প্রথম জাতিসংঘের সাধারণ সভায় উপস্থিত হয়ে ভøাদিমির পুতিন ‘সব ফাঁস’ করার হুমকি দিলে সেটা মোটামুাট প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এরপর দু’ সপ্তাহ পশ্চিমের মুখে কোনো রাও ছিলো না। আশংকাময় অপেক্ষাটা তখন থেকেই ছিলো- প্রতি বা পাল্টা আক্রমণটা কোন দিক থেকে আসে। সেটা এলো এবং ভয়াবহভাবেই এলো। মুখ লুকোতে প্রথমদিকে রাশিয়ার সুরে তাল মেলালেও নিজেদের আধিপত্য পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য প্যারিস হামলার ঘটনা পশ্চিমের জন্য মহা সুযোগ নিয়ে হাজির হলো। মহাসমারোহে এখন আবার সিরিয়ায় হামলা চালানো যাবে।

ফ্রান্স ইতোমধ্যে শুরুও করে দিয়েছে। তোড়জোড় চলছে জাতিসংঘে বিশেষ প্রস্তাব পাসের। শরণার্থীদের যে ¯্রােত পশ্চিমমুখী হয়েছিলো সেটাও বন্ধ করা যাবে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই নতুন তো নয়ই, আগের ভাগ হওয়া কোটা পরিমাণ শরণার্থী গ্রহণেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিল পাস হয়েছে। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার নামে পুরো ইউরোপে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। ফ্রান্সে চলছে নজিরবিহীন বিশেষ অভিযান। সন্দেহ নেই- শার্লি এবদোর ধকল কাটিয়ে না উঠতেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য আরো ভয়াবহ অনিরাপদ জীবনযাত্রার মুখোমুখি করে দেয়া হলো পশ্চিমের মুসলিমদের।

আর হামলার জন্য ফ্রান্সই কেনো বারবার জঙ্গিদের প্রথম পছন্দ? আপনার হিসেব মেলাবার আগে এই পয়েন্টগুলোও সামনে আনুন- ফ্রান্স ইউরোপের একমাত্র দেশ যেখানে গিয়ে এক হাজার বছর আগে ইসলামের জয়যাত্রা থেমে গিয়েছিলো। ফ্রান্সই ইউরোপের একমাত্র দেশ- নিরাপত্তা এবং সমাজ কাঠামোয় সবচে’ জটিল হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম জনসংখ্যা এবং নওমুসলিম বৃদ্ধির ধারায় অন্য সব দেশ থেকে এগিয়ে।

এতোটাই এগিয়ে যে মুসলিমরাই দাবি করছেন- আগামী ৪-৫ দশকের মধ্যে ফ্রান্স মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হবে। অর্থাৎ এক হাজার বছরের ব্যবধানে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আবার এই ফ্রান্স থেকেই ইসলামের বিজয়-যাত্রা শুরু হবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সুতরাং মুসলিমদের অপ্রতিরোধ্য গতি থামাতে এমন কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা ফ্রান্সের খুব দরকার। আফসোস শুধু এই- রাজনীতির এসব নোংরা খেলায় আল্লাহর নিরীহ কিছু বান্দাকে সবসময় বলি বানানো হয় এবং আরো অসংখ্য মাসুম বান্দা তাতে বিব্রত অবস্থায় পড়ে। অসচেতন মুসলিমরা অন্যদের ভুলকে নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন। ইসলামকে ভুল বোঝেন। দূরে সরে যান শাশ্বত দীনের রাজপথ থেকে।

আমাদের আলোচনা চলছিলো জার্মানি নিয়ে। প্রাসঙ্গিক হলেও সূচি বহির্ভূত আলোচনায় আমরা বহুদূর চলে এসেছি। রাষ্ট্র জার্মানি এবং এর ইতিহাস নিয়ে কিছু তথ্য দিই। একটু দীর্ঘ করেই। আশংকার সব হিসেব বিবেচনায় রেখেও জার্মানি নিয়ে কেনো জানি আমার আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে। কারণ, মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত শক্তির সর্বশেষ উদাহরণ ছিলো উসমানী খেলাফত। বিশ্বমঞ্চে তৎকালীন প্রুসিয়া-জার্মানির সাথে উসমানী খেলাফতের গাঢ় বন্ধন ছিলো। দেড় শতাব্দীর লম্বা সময় ধরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও তারা জার্মানির সাথেই সন্ধিবদ্ধ ছিলো। এরপরের ইতিহাস তো মশহুর। আজকের প্রেক্ষাপটেও ইউরোপে একমাত্র জার্মানিই দৃঢ়তার সাথে মুসলিম বান্ধব হিসেবে নিজেদের পরিচয় করাচ্ছে।

অভিবাসীরা তো আছেনই, মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকার মুসলিমরাও জার্মানিকে নিরাপদ আবাস মনে করছেন। প্যারিস হামলার পর যখন ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্র এবং দূরের যুক্তরাষ্ট্র থেকেও মুসলিম শরণার্থী বিরোধী রব ওঠলো, জার্মানি সেখানে স্পষ্ট বলে দিয়েছে- প্যারিস হামলা আর শরণার্থী দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ইস্যু। শরণার্থী প্রশ্নে কেউ যেনো সন্ত্রাসবাদের ইস্যু যুক্ত করার চেষ্টা না করে। আরো কিছু হিসেব আছে, ইনশাল্লাহ সামনের আলোচনাতেই আসবে। তাই কিছুটা দীর্ঘ করেই জার্মানিকে জানার প্রয়াস চালালাম।

সংযুক্ত প্রজাতন্ত্রী জার্মানি

জার্মানি- সরকারিভাবে সংযুক্ত প্রজাতন্ত্রী জার্মানি ইউরোপের অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। জার্মানি ১৬টি রাজ্য নিয়ে গঠিত একটি সংযুক্ত ইউনিয়ন। এর উত্তর সীমান্তে উত্তর সাগর, ডেনমার্ক ও বাল্টিক সাগর, পূর্বে পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণে অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড এবং পশ্চিম সীমান্তে ফ্রান্স, লুক্সেমবুর্গ, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস অবস্থিত। জার্মানির ইতিহাস বেশ জটিল, সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। ১৮৭১ সালের আগে এটি কোন একক রাষ্ট্র ছিল না। ১৮১৫ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত জার্মানি একটি কনফেডারেসি এবং ১৮০৬ সালের আগে অনেকগুলো স্বতন্ত্র ও আলাদা রাজ্যের সমষ্টি ছিলো।

আয়তনের দিক থেকে জার্মানি ইউরোপের ৭ম বৃহত্তম রাষ্ট্র। উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগরের উপকূলীয় নিম্নভূমি থেকে মধ্যভাগের ঢেউ খেলানো পাহাড় ও নদী উপত্যকা এবং তারও দক্ষিণে ঘন অরণ্যাবৃত পর্বত ও বরফাবৃত আল্পস পর্বতমালা দেশটির ভূ-প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় করেছে। দেশটির মধ্য দিয়ে ইউরোপের অনেকগুলি প্রধান প্রধান নদী যেমন রাইন, দানিউব, এলবে প্রবাহিত হয়েছে এবং দেশটিকে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে সাহায্য করেছে। বার্লিন দেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। তবে প্রাক্তন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন শহরে এখনও বেশ কিছু সরকারি অফিস রয়েছে। জার্মান ভাষা এখানকার প্রধান ভাষা। ধর্ম পরিচয়ে দুই-তৃতীয়াংশ লোকই রোমান ক্যাথলিক বা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান। জার্মানি বিশ্বের একটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। এর অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পরে বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম। জার্মানি লোহা, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম এবং মোটরগাড়ি রপ্তানি করে। জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি।

১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিপক্ষ হিসেবে জার্মানিকে পরাজিত করে। মিত্র দেশগুলি আজকের জার্মানিকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে নেয়। ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন ও সোভিয়েত সেনারা একেকটি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা শক্তিগুলির মধ্যকার মিত্রতা ১৯৪০ দশকের শেষে ভেঙে গেলে সোভিয়েত অঞ্চলটি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তথা পূর্ব জার্মানিতে পরিণত হয়। পশ্চিম-নিয়ন্ত্রিত বাকী তিন অঞ্চল একত্রিত হয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করে। যদিও জার্মানির ঐতিহাসিক রাজধানী বার্লিন পূর্ব জার্মানির অনেক ভেতরে অবস্থিত ছিল, তা সত্ত্বেও এটিকেও দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে লক্ষ লক্ষ পূর্ব জার্মান নাগরিক অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানিতে অভিবাসী হওয়া শুরু করলে ১৯৬১ সালে পূর্ব জার্মানি সরকার বার্লিনে একটি প্রাচীর তুলে দেয় এবং দেশের সীমান্ত-নিরাপত্তা জোরদার করে।
পুন:মিলনের তীব্র আকাঙ্খার দাবি থেকে ১৯৮৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের বাসিন্দারা বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলে। এই ঘটনাটিকে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পতন ও জার্মানির পুনঃএকত্রীকরণের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৩রা অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রিত হয়ে জার্মান ফেডারেল প্রজাতন্ত্র গঠন করে।

প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীসমূহ

ধারণা করা হয়- সুপ্রাচীন নর্ডীয় ব্রোঞ্জ যুগ অথবা প্রাক-রোমান লৌহ যুগে জার্মানিতে আদি জাতিগোষ্ঠীগুলোর বসবাস শুরু হয়েছিলো। দক্ষিণ স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং উত্তর জার্মানি থেকে এই গোষ্ঠীগুলো দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বসতি স্থাপন শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে। এই সম্প্রসারণের ফলে তারা গলের কেল্টীয় গোষ্ঠী এবং পূর্ব ইউরোপের ইরানীয়, বাল্টিক ও স্লাভিক গোষ্ঠীগুলোর সান্নিধ্যে আসে। জার্মানির সেই প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে খুব অল্পই জানা গেছে। এখন পর্যন্ত মানুষ যা জানতে পেরেছে তা ঐ জাতিগুলোর সাথে রোমান সা¤্রাজ্যের কিছু লিখিত যোগাযোগের দলিল-প্রমাণাদির মাধ্যমে। প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণাতেই এই তথ্যগুলোর অনেকাংশ উদ্ঘাটিত হয়েছে।

অগাস্টাসের রাজত্বকালে রোমান জেনারেল পুবলিয়াস কুইঙ্কটিলিয়াস ভ্যারাস জার্মানিয়াতে (রোমানরা মাঝে-মধ্যে এ নামে অভিহিত করতো) আগ্রাসন চালানো শুরু করে। এই আগ্রাসন চলাকালেই জার্মানির গোষ্ঠীগুলো রোমানদের যুদ্ধকৌশল সম্বন্ধে জানতে পারে। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই রোমান যুদ্ধ কৌশলের অনেকাংশ তারা রপ্ত করতে সক্ষম হয়। ৯ খ্রিস্টাব্দে টেউটোবুর্গ বনের যুদ্ধে জার্মানির চেরুস্কান নেতা আরমিনিউস, রোমান জেনারেল ভ্যারাসের নেতৃত্বে পরিচালিত নয় লেজিয়নের এক সৈন্যদলকে পরাজিত করে। এর ফলে আধুনিক জার্মানি তথা রোমান সা¤্রাজ্যের বাইরেই থেকে যায়। বর্তমান জার্মানি অঞ্চলটি ৮৪৩ অব্দে ক্যারোলিঙ্গিয়ান সা¤্রাজ্যের বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়। ফ্রান্সও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর বহু শতাব্দী যাবৎ জার্মানি ছিল দুর্বলভাবে একত্রিত জমিদারিভিত্তিক কতগুলি দেশের সমষ্টি। ১৬শ শতকের পর থেকে জার্মান রাষ্ট্রগুলি ইউরোপের যুদ্ধ ও ধর্মীয় সংঘাতে ক্রমশ বেশি করে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯শ শতকের শুরুতে ফ্রান্স জার্মান রাষ্ট্রগুলি দখল করলে জাতিগতভাবে একত্রিত এক জার্মানির জন্য জনমত প্রবল হয় এবং ১৮১৫ সালে প্রুসিয়ার নেতৃত্বে জার্মান রাষ্ট্রগুলি একটি কনফেডারেশন গঠন করে, যা ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

বিশ্বযুদ্ধ

১৮৭১ সালে অটো ফন বিসমার্কের অধীনে একত্রিত হবার পর জার্মানিতে দ্রুত শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মানি ইউরোপে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ১৯১৮ সালে জার্মানির পরাজয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থা থেকেই উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়ার ফলে নাৎসি পার্টির আবির্ভাব ঘটে। ত্বরান্বিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি তৈরির যাত্রা। নাৎসি পার্টি ১৯৩০- দশকে এডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। এরপরের ইতিহাস তো বিখ্যাতই। ১৯৩৯ সালে জার্মানির সর্বগ্রাসী আচরণের ফল হিসেবে দ্বিতীয় বারের মত বিশ্বযুদ্ধের হুমকির মুখে পড়ে বিশ্ববাসী। সংঘটিত হয় মানবেতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধটি। যার ধকল আজও বিশ্ববাসীকে পোহাতে হচ্ছে।

রাজনীতি

জার্মানি ফেডারেল, সংসদীয় এবং প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৯৪৯ সালের প্রণীত সংবিধানের কাঠামো অনুযায়ী জার্মানির রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। জার্মানির সংবিধান মূলত ফেডারেল জার্মানির মূল আইন বা গ্রুন্ডগেজেটস নামে পরিচিত। সংবিধান প্রণেতারা তখনই তাদের এই ইচ্ছা প্রকাশ করে রাখেন- যখন দুই জার্মানি আবার একটি রাষ্ট্র হিসেবে একত্রিত হবে তখন এই সংবিধান একটি উপযুক্ত সংবিধান দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। সংবিধানের সংস্কারের জন্য সংসদের উভয় সভার দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দরকার হয়। সংবিধানের মৌলিক নীতি গুলোর মধ্যে জনগণের আত্মমর্যাদার নিশ্চয়তা, ক্ষমতার বিভাজন, ফেডারেল অবকাঠামো এবং আইনের চিরস্থায়ী ধারাসমুহ বিদ্যমান।

জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি যিনি বুনডেসটাগ ও প্রত্যেক রাষ্ট্রের সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত সম্মিলিত সভার দ্বারা নির্বাচিত হন। জার্মানির সরকার ব্যবস্থায় সরকারের প্রধান হলেন চ্যান্সেলর, বর্তমানে অ্যাঞ্জেলা মারকেল এই দায়িত্ব পালন করছেন। চ্যান্সেলর সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর মত বিশেষ ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। ১৯৪৯ সাল থেকে জার্মানির প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হলো খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মানি। তাছাড়াও মুক্ত গণতান্ত্রিক দলসহ বিভিন্ন নামে ছোট কিছু রাজনৈতিক দল রয়েছে।

ভূগোল

জার্মানির মোট আয়তন ৩,৫৭,০২১ বর্গকিমি যার মধ্যে ৩,৪৯,২২৩ বর্গকিমি ভূমি এবং ৭,৭৯৮বর্গকিমি জলভাগ। আয়তনের বিচারে জার্মানি ইউরোপের মধ্যে সপ্তম এবং বিশ্বের মধ্যে ৬৩তম। জার্মানি মধ্য ইউরোপের একটি বড় রাষ্ট্র। সামুদ্রিক জলসীমার অন্তর্গত এলাকা গণনায় ধরে জার্মানির আয়তন ৩,৫৭,০২১ বর্গকিলোমিটার। আল্পস পর্বতমালাতে অবস্থিত ২,৯৬২ মিটার উঁচু জার্মানির সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। জার্মানির মধ্যভাগে আছে অরণ্যাবৃত উচ্চভূমি এবং উত্তরে আছে নিম্ন সমতলভূমি। এই নিম্নভূমি দিয়ে ইউরোপের কিছু প্রধান নদী বয়ে গেছে, যাদের মধ্যে আছে রাইন, দানিউব, এবং এলবে নদী।

অর্থনীতি

জার্মানিতে যোগ্যতাসম্পন্ন শ্রমিক, উন্নত অবকাঠামো, মূলধনের বৃহৎ মজুদ, দুর্নীতির নিম্নহার ও উচ্চ উদ্ভাবনী ক্ষমতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সোশ্যাল মার্কেট ইকোনমি বিদ্যমান। জার্মানীর আছে ইউরোপের বৃহত্তম ও বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি, যা ২০০৯ সালে জিডিপিতে পঞ্চম স্থানের অধিকারি। জুলাই ২০১০ এ দেশের গড় বেকারত্বের হার ছিল ৭.৫ শতাংশ। শিল্পায়নের শুরু থেকেই জার্মানি বৈশ্বিক অর্থনীতির চালক, উদ্ভাবক এবং সুবিধাভোগী। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, জি৮, জি২০ ’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য জার্মানি ২০০৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিশ্বের রপ্তানীকারক দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে ছিল। ২০০৯ সালে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানীকারক দেশ এবং তৃতীয় শীর্ষ আমদানিকারক দেশ। বিশ্বে বায়ুমিল ও সৌরশক্তি প্রযুক্তির শীর্ষস্থানীয় উৎপাদক দেশ জার্মানি। হ্যানোভার, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং বার্লিনের মতো বড় শহরগুলোতে বৃহত্তম বাণিজ্যমেলা ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ইউরোপীয়ান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংহতির প্রবক্তা জার্মানি। ইইউভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে লিখিত বাণিজ্যিকচুক্তি ও ইইউ একক বাজার আইনের আওতায় জার্মানির বাণিজ্য নীতি পরিচালিত হয়। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে জার্মানিই ইউরোপের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো চালু করে। ফ্রাঙ্কফুর্টের ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক কর্তৃক এর আর্থিকনীতি নির্ধারিত হয়। ২০০৯ সালে এঙ্গেলা মার্কেলের নেতৃত্বাধীন জার্মান সরকার ৫০ বিলিয়ন ইউরোর (৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) একটি অর্থনীতি চাঙ্গাকরণ পরিকল্পনা অনুমোদন দেয় যার উদ্দেশ্য ছিল কিছু ক্ষেত্রকে নিম্নগামিতার হাত থেকে রক্ষা করা ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার রোধ করা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানি সবসময় নেতৃত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফ্রান্সের সাথে কঠিন সন্ধি বজায় রেখেছে। জার্মানি ইউরোপের সেসব দেশের মধ্যে অন্যতম যারা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অধিকতর রাজনৈতিক ঐক্য, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা জোরদার করতে চায়। নিকট ভবিষ্যতের ইতিহাস এবং বৈদেশিক শক্তির আগ্রাসনের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফেডারেল জার্মান প্রজাতন্ত্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কমই অংশগ্রহণ করেছে।

সামরিক বাহিনী

জার্মানির সামরিক বাহিনী সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী ও কেন্দ্রীয় চিকিৎসা সেবা নিয়ে গঠিত। ১৮ বছরের পুরুষদের জন্য সামরিক বাহিনীর সেবা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং তারা বছরে অন্তত নয় মাস দায়িত্ব পালন করে। সামরিক খাতে ২০০৩ সালে দেশটির জিডিপির ১.৫% খরচ হয়। যুদ্ধ ব্যতীত অন্য সময় সামরিক বাহিনীর সেনাপতি থাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। জার্মানির সংবিধান শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধের অনুমতি দেয় যার সেনাপতি হবে দেশটির চ্যান্সেলর। ২০০১ সাল থেকে সামরিক বাহিনীর সকল কাজে মেয়েদের অবাধ অংশগ্রহণ চালু রয়েছে তারপরও তাদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক নয়। বর্তমানে ১৪,৫০০ জন মহিলা সেনা কর্মরত আছে। এ পর্যন্ত দুই জন মহিলা চিকিৎসা কর্মকর্তাকে জেনারেল পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে।

জনসংখ্যা ও সংস্কৃতি

জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। সারা পৃথিবীতে জার্মানি ১৫তম জনবহুল দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২২৯.৪ জন অধিবাসী বাস করে। জার্মান ভাষা জার্মানির সরকারী ভাষা। এছাড়া অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরও অনেকগুলি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে আরবি, গ্রিক, ইতালীয়, কুর্দি এবং তুর্কি ভাষা উল্লেখযোগ্য। জার্মান ভাষায় জার্মানিকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে ‘ডাস লা- ড্যার ডিখটার উন্ড ডেনকার’, যার অর্থ হচ্ছে ‘কবি ও চিন্তাবীদদের দেশ’। একটি জাতির দেশ হিসেবে জার্মানির উত্থানের অনেক আগে থেকেই জার্মান সংস্কৃতির আবির্ভাব এবং এর বিস্তৃতি ছিল গোটা জার্মানভাষী এলাকা জুড়ে। গোড়া থেকেই জার্মান সংস্কৃতি ইউরোপের তৎকালীন সব হালচালে প্রভাবিত হয়ে এসেছে এবং এই প্রভাবে ধর্ম ও ধর্ম নিরপেক্ষতা দুটোই ছিল। এই জন্যে জার্মান সংস্কৃতিকে ইউরোপের উচ্চ সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে- ইতিহাসের কিছু জাঁদরেল মনীষী যেমন ভোলফগাংক আমাডেয়ুস মোৎসার্ট, ফ্রানৎস কাফকা, কার্ল মার্ক্স, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এবং পাউল কেলান যদিও আধুনিক অর্থে জার্মান নাগরিক ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের ঐতিহাসিক অবস্থান, কাজ ও সামাজিক গুরুত্ব বুঝতে হলে অবশ্যই তাঁদের দেখতে হবে জার্মান সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে।

বার্লিন প্রাচীর

বার্লিন প্রাচীর ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছে পশ্চিম বার্লিন ও পূর্ব বার্লিন-এর সীমানা প্রাচীর হিসেবে, যেটি পশ্চিম জার্মানি ও পূর্ব জার্মানির একটি সীমানা ছিল। ১৩ আগস্ট, ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৮ বছর এটি পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিন এবং পূর্ব জার্মানির অন্যান্য অংশকে পৃথক করে রেখেছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ সময়কালে প্রাচীর টপকে পশ্চিম বার্লিন যাবার চেষ্টাকালে ১২৫ জন প্রাণ হারান। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় ২০০। সদ্য প্রকাশিত দলিলে দেখা যায়- কমিউনিস্ট সরকার পক্ষত্যাগকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলো।
কয়েক সপ্তাহের টানা জনঅসন্তোষের পর ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ পূর্ব জার্মান সরকার পশ্চিম বার্লিনে যাবার অনুমতি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। হাজার হাজার উৎসুক জনতা প্রাচীর টপকে পশ্চিম পাশে যেতে থাকে। পশ্চিম প্রান্তে উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের স্বাগত জানানো হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে স্যুভেনির সংগ্রাহকরা প্রাচীরটির কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো প্রাচীর সরিয়ে নেয়া হয়। বার্লিন প্রাচীর খুলে দেয়ার ঘটনা দুই জার্মানির পুনঃএকত্রিকরণের পথ প্রশস্থ করে দেয়, যার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর।

পরবর্তী প্রভাব ও সাংস্কৃতিক বিভেদ

প্রাচীরটির সামান্য অংশই বর্তমানে অবশিষ্ট আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটির প্রথমটি “পোটসডামা প্লাটসের” কাছে। ওবাবার্মবুকার নিকট স্প্রি নদীর তীরবর্তী অংশটি ইস্ট সাইড গ্যালারি নামে ডাকা হয়। তৃতীয় অংশটি আছে উত্তর দিকে বেনায়ার স্ত্রাসের কাছে। ১৯৯৯ সালে এটিকে বার্লিন প্রাচীরের স্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রাচীর পতনের পর দেড়যুগ পেরিয়ে গেলেও বার্লিনের দু’অংশের লোকজনের মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য এখনও ধরা পড়ে। আরও বলা হয়ে থাকে, মানসিক প্রাচীর এখনও রয়ে গেছে। ২০০৪ সালের সেপ্টম্বর মাসে এক জরিপে দেখা যায় শতকরা ২৫ ভাগ পশ্চিম বার্লিনবাসী এবং ১২ ভাগ পূর্ব জার্মানবাসী প্রাচীরের অস্তিত্ব কামনা করেন। এ সংখ্যাটি সত্যি আশংকাজনক।

জার্মানিতে ইসলাম : শেকড়ের খোঁজ

জার্মানিতে ইসলামের সূচনা কিংবা মুসলমানদের আগমনের ইতিহাস দিন-তারিখ উল্লেখ করে বলা মুশকিল। শুধু মুশকিল নয়, একপ্রকার অসম্ভব।

ঐতিহাসিক সূত্রগুলোর দাবি- জার্মানিতে ইসলামের সূচনা তাবলিগ বা সুফিবাদের মাধ্যমে নয়, রাজনৈতিকভাবে হয়েছিলো। আরো খুলে বললে- তৎকালীন প্রুসিয়া-জার্মানির সাথে তুরস্কের উসমানি খেলাফতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। এই হিসেবে জার্মানিতে ইসলামের সন্দেহমুক্ত সূচনা আঠার শতকের মধ্যভাগে।

১৭৯০ খৃষ্টাব্দে প্রুসিয়ার সাথে উসমানি খেলাফতের বিশেষ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়, জার্মানিতে প্রথম মসজিদ- লাল মসজিদের নির্মাণের ঘটনাও সমসাময়িক। ১৭৮৯-১৭৯১। একটি খৃষ্টান রাষ্ট্রের সাথে খেলাফতরাষ্ট্রের সহযোগিতামূলক চুক্তি কিংবা সেখানে মসজিদ নির্মাণের ঘটনা সে মুহূর্তের বিশ্ববাস্তবতায় খুব সাধারণ ব্যাপার ছিলো না। হওয়ার কথাও নয়। শাসনতন্ত্র বা শাসক যেমনই হোন- সবকিছুতে তখনো ধর্মবিশ্বাসেরই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিলো। এই চুক্তি ও মসজিদ নির্মাণের সূত্রে তাই আরো অন্তত দুই-তিন দশক পূর্বে সেখানে ইসলাম ও মুসলমানদের উপস্থিতি আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে। অন্য কয়েকটি সূত্রমতে- এই দুই দেশ বা জাতিগোষ্ঠীর সম্পর্ক অবশ্য আরো পুরনো। আঠার শতকের শুরুর দিকেই দুই দেশের মধ্যে সেনা, শ্রমিক ও প্রকৌশলী বিনিময় হয়েছিলো। ১৭২০ সালে প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের রাজত্বকালে ২০ জন মুসলিম সেনা প্রুসিয়ার সেনাবাহিনীর অধীনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে জানা যায়।

১৭৪৫ সালে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের সময় স্বতন্ত্র একটি মুসলিম সেনা ইউনিট ছিলো প্রুসিয়ায়। সুতরাং দাওয়াহ কিংবা সুফিবাদের সূত্র বাদ দিলেও অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না- আঠার শতকের শুরু বা সতের শতকেই ইসলামের বাণী ইউরোপের প্রধানতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র এই জার্মানিতে পৌঁছে গিয়েছিলো।

জার্মানিতে ইসলামের উপস্থিতি ও এর তাৎপর্য বুঝতে হলে আঠার শতকের বিশ্ববাস্তবতার বিশেষ কিছু দিক এবং খেলাফতের মর্যাদা হারানো আজকের তুরস্ক ও ফেডারেল জার্মানির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটটাও একটু জানা দরকার।

আঠার শতকের বিশ্ব পরিস্থিতি

আঠার শতকের শুরুতেই ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপে ফরাসি সা¤্রাজ্যের গোড়াপত্তন, শেষদিকে শিল্প বিপ্লবের কল্যাণে গ্রেট বৃটেনের অভাবিত উত্থান এবং মধ্যভাগে রাশিয়ার সাথে লড়াইয়ে উসমানি খেলাফত বা অটোমান সা¤্রাজ্যের পরাজয়ের ঘটনা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সাথে গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। কয়েক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞান আর দর্শন নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে চলা পাশ্চাত্যে পরিবর্তনের হাওয়াটা এই আঠার শতকেই প্রবলভাবে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলো। এই হাওয়াই যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অভিজাতশ্রেণী এবং পাদরীবর্গকে হটিয়ে ফ্রান্সের জনগণকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রথমবারের মতো নয়া ফরাসি সা¤্রাজ্যের ভিত গড়তে সক্ষম হন।

বিজ্ঞানের এই সাধনার বদৌলতে এই শতকেরই শেষভাগে গ্রেট বৃটেনে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। নিত্যনতুন উদ্ভাবন আর প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারে ইউরোপজুড়ে কল-কারখানা, শহুরে সমাজ এবং নতুনরকমের শ্রমিকশ্রেণী গড়ে ওঠে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানারকম সংস্কার সাধিত হয়। এর বাইরে, আঠার শতকের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিলো ১৭৬৮-১৭৭৪ পর্যন্ত ছয় বছরের টানা লড়াইয়ে রাশিয়ার কাছে ইসলামি খেলাফতের কেন্দ্র তুরস্কের পরাজয়।

অর্ধযুগব্যাপী এই যুদ্ধে হেরে তুর্কি খেলাফতের পতন ঘটেনি ঠিক, ভিতটা নড়বড়ে হয়ে যায়। স্পেন থেকে মুসলিমদের হটিয়ে খৃষ্টান পাশ্চাত্যের যে উত্থান; বিজ্ঞান, দর্শন, প্রযুক্তিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে এরপর কেবল তারা শক্তিমান হয়েছে। সামরিক ও বিজ্ঞানের যৌথ শক্তিতে বলিয়ান খৃষ্টান পাশ্চাত্যের বিপরীতে মুসলিম বিশ্ব সেসময় কেবল নিঃস্ব হওয়ার পথে এগিয়েছে। ভেতরে ভেতরে ধুকতে থাকা তুর্কি খেলাফতের প্রকৃত হাল রাশিয়ার সাথে এই যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উত্থানের পর এই প্রথম তুর্কি খেলাফত বড়রকম অসহায়ত্বের মুখে পড়ে। বিশাল খেলাফতের আসন্ন ভাঙনের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় বড় শক্তিগুলোও নানাভাবে সুযোগ নিতে মড়িয়া হয়ে ওঠে। তুর্কি খেলাফতের তখন একজন শক্তিশালী বন্ধুর খুবরকম প্রয়োজন দেখা দেয়। সামরিক শক্তিতে আঠার-উনিশ শতকজুড়ে ইউরোপের সবচে’ আগুয়ান রাষ্ট্র প্রুসিয়া (পরিচিতি সামনেই আসছে) এসময় তুরস্কের ডাকে এগিয়ে আসে। প্রায় এক শতাব্দীর বন্ধুত্বের সূত্রে এই দুই রাষ্ট্র ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে বিশেষ সহযোগিতামূলক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

বিশাল খেলাফতের ঝা-াবাহী তুরস্ককে বন্ধু হিসেবে পাওয়া শিল্পে ও সামরিক শক্তিতে অগ্রসর প্রুসিয়া-জার্মানির জন্যও বেশ লোভনীয় ছিলো নিঃসন্দেহে। দুই রকমের প্রয়োজন দুটো রাষ্ট্রকে কাছে নিয়ে আসে, বন্ধুত্বের সুবাদে যৌথ কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করে সামরিক খাত থেকে নিয়ে শিল্প এবং অন্যান্য খাতেও। জন্মগত দাঈ মুসলমানদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় প্রুসিয়া-জার্মানিতেও ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

তুরস্ক এবং জার্মানির সম্পর্ক

আধুনিক সভ্যতা

১৭৯০ খৃষ্টাব্দে প্রুসিয়ার সাথে শান্তি ও বন্ধুত্বের বিশেষ চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে উসমানি খেলাফত বা অটোমান সা¤্রাজ্য জার্মানির সাথে সামরিক সম্পর্ক আরো জোরদার করে তোলে, বিশেষ করে সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামীদের শাসনামলে। উসমানি সা¤্রাজ্য আর জার্মানির সম্পর্ক কেবল বিশ্বযুদ্ধে জোট গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, এই দুই রাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আরো নানারকম বিনিয়োগমুখী প্রজেক্টেও যুক্ত ছিলো, বাগদাদ রেলওয়ে নির্মাণ ছিলো সেরকমই একটি প্রজেক্ট। সুতরাং চুক্তির বিবেচনায় ব্যাপারটা যতো সীমিত, কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ততোটাই বিস্তৃত।

এখানে প্রুসিয়ার একটু পরিচিতি দিয়ে নেয়া দরকার। জার্মাানি বরাবরই ফেডারেল তথা কমবেশ স্বাধীন রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংযুক্ত গণপ্রজাতন্ত্রী ছিলো। জার্মানির এই রাজ্যগুলো ঐতিহ্য, আইন ও মানসিকতায় স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর ছিলো। প্রুসিয়াও ছিলো এমনই একটি স্বাধীন রাজ্য, আজকের সংযুক্ত জার্মানির রাজধানী বার্লিন একসময় এই প্রুসিয়ার রাজধানী ছিলো। এসব অবশ্য উনিশ শতকের শেষ দিককার কথা। সংক্ষেপে বললে- প্রুসিয়া মূলত অধুনালুপ্ত একটি সা¤্রাজ্য। ব্রান্ডেন্টবার্গ অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠেছিলো এই রাষ্ট্র, ইউরোপ বিশেষত জার্মান ইতিহাসে প্রুসিয়ার ছিলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। একসময় এটি টিউটোনিক নাইটদের অধিকারে আসে এবং পরে জার্মানকরণের মধ্য দিয়ে আধুনিক জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। সামরিক শক্তি ও বিদ্যায় প্রুসিয়ার ব্যাপক খ্যাতি ছিলো। অষ্টাদশ এবং উনিশ শতকে তাই এটি ইউরোপের বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। উনিশ শতকে এসে চ্যান্সেলর অটোফন বিসমার্ক জার্মান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে একত্র করার উদ্যোগ নেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই উনিশ শতকের শেষ এবং আরও পরে বিশ শতকের শুরুর দিকে এসে প্রুসিয়া স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে নিজের পরিচয় হারায়। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থানের পর তো এই নামটি চিরতরে ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। প্রুসিয়ানরা বরাবরই সামরিকতন্ত্রের সমর্থক ছিলো। এমনকি সামাজিক জীবনেও তারা সামরিক রীতি-নীতির প্রয়োগ ঘটাতে অভ্যস্ত ছিলো। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাগরিকমাত্রই হবেন সৈনিক এবং যোদ্ধা। সাধারণ প্রুসিয়ানদের বিশেষ বৈশিষ্ট ছিলো- ন্যায়, আনুগত্য, সংযম এবং আত্মত্যাগ। প্রুসিয়ান গুণ নামে আজ এটি শুধুমাত্র জার্মান সংস্কৃতির একটা অংশ হিসেবে টিকে আছে। আমাদের আলোচনায় তৎকালীন প্রুসিয়াকে একটু সামনে টেনে এনে আমরা জার্মানি হিসেবেই উল্লেখ করেছি।

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের পর তুরস্ক বহুসংখ্যক জার্মান বংশোদ্ভুত ইহুদি শিক্ষাবিদ ও প্রকৌশলীদের আশ্রয় প্রদান করে, যাদের মধ্যে বামপন্থী এবং উদার দু’রকমের লোকই ছিলো এবং মূলত জীবন বাঁচাতে এরা জার্মানি ছেড়ে পালিয়েছিলো। এই মেধাবী ও প্রফেশনাল ইহুদিরা পরে তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প কারখানা পুনর্গঠন-পুনর্বিন্যাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। উসমানি সা¤্রাজ্য থেকে সাধারণ রাষ্ট্রে পরিণতা হওয়া তুরস্ক ও জার্মানির মধ্যকার বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শীতল যুদ্ধের যুগে আরও গভীর ও সুদৃঢ় হয়ে ওঠেছিলো। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ১৯৬০-এ তুরস্ক ও জার্মানির মধ্যকার শ্রমিক বিনিময় চুক্তির সময় বহু তুর্কি নাগরিক জার্মানিতে অভিবাসী হয়েছিলো এবং সাদরে বরিতও হয়েছিলো। প্রায় তিন মিলিয়ন বা ত্রিশ লাখ তুর্কি নাগরিক এখন জার্মানিতে বাস করেন। তুর্কি বংশোদ্ভুত এই জার্মান নাগরিকদের বাণিজ্যিক ভলিউম বছরে কমপক্ষে ২৫ বিলিয়ন ইউরো। তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়ার এটাও একটা বড় কারণ, প্রতিবছর অন্তত চল্লিশ লাখ জার্মান নাগরিক তুরস্কে বেড়াতে আসেন। জার্মান এবং তুর্কি জোটের দীর্ঘকালীন সুদৃঢ় সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখায় এই পর্যটনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে। তাৎক্ষণিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক যৌথ সম্পর্কের পাশাপাশি জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের তাৎপর্যপূর্ণ পার্টনার। ন্যাটো, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল এবং ইউরোপিয়ান নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার (ঙৎমধহরুধঃরড়হ ভড়ৎ ঝবপঁৎরঃু ধহফ ঈড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ রহ ঊঁৎড়ঢ়ব) মতো প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তির কল্যাণে এ দুই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোও বেশ সুদৃঢ় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ।

তুরস্ক এবং জার্মানির মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ-যাতায়াত এরদোগান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জার্মানির প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান উলফ ১৮ অক্টোবর ২০১০ তুরস্ক ভ্রমণ করেন। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট জোহান্স রাউয়ের ১০ বছর পর কোনো জার্মান প্রেসিডেন্ট এই প্রথম তুরস্কে এলেন। ঠিক এক বছরের মাথায় ১৮ সেপ্টেম্বর তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল জার্মানিতে সফর করেন। এরও আগে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের আমন্ত্রণে জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল ২৯-৩০ মার্চ ২০১০- এ তুরস্ক সফর করেন। ফিরতি সফরে সে বছরই তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ৮-ই অক্টোবর জার্মানি ঘুরে আসেন। পরপর এই কয়েকটা উচ্চস্তরের দ্বিপাক্ষিক সফরের মধ্য দিয়ে তুরস্ক এবং জার্মানির তিন শতাব্দীর সম্পর্ক নতুন এক স্তরে উন্নীত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং যোগাযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিষয়ে দু দেশের মধ্যে প্রকাশ্য বিতর্ক ও বিরোধ দেখা গেলেও বিশ্লেষকেরা এগুলোকে দু দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও জোরালো কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করছেন না ।
ইসলামের সূচনা ও মুসলিম জনসংখ্যা

জার্মানিতে ইসলামের সূচনাবিষয়ক কিছু তথ্য ইতোমধ্যেই আমরা দিয়েছি। জার্মানির মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে এই মুহূর্তে সঠিক তথ্য দেওয়া প্রায় অসম্ভব। একটা কারণ তো এই- পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলোতে জনগণের ধর্মীয় পরিচয়ের কোনো পরিসংখ্যান সাধারণত থাকে না। রাষ্ট্রেরও অধিকার নেই জনগণের ধর্মীয় তথ্য সংরক্ষণের । আর বড় কারণ- আরব বসন্ত বিশেষ করে সিরিয়া ইস্যুতে লাখ লাখ মুসলিম আরববিশ্ব থেকে জার্মানিতে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। গত কয়েক বছরে এই সংখ্যা পনের লাখ পেরিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অনুমান। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছে। এই প্রক্রিয়া কতোদিন চলবে অনুমান করা মুশকিল। এর বাইরে এশিয়া বিশেষত বাংলাদেশসহ বেশ ক’টি মুসলিম দেশ থেকেও কাজ ও উন্নত ভবিষ্যতের খোঁজে মুসলিম তরুণেরা বৈধ-অবৈধভাবে সমানে জার্মানিতে পাড়ি জমাচ্ছেন। শরণার্থী ও অভিবাসন ইস্যুতে নতুন-পুরাতন জোরালো বিতর্ক চালু থাকায় শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে সবার ঠাঁয় হবে কিনা সেটাও বিবেচ্য। শরণার্থী সংকটের নানাদিক ও জার্মানির ভেতর-বাইরের বিতর্ক নিয়ে পরের কোনো পর্বে আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ। আপাতত বিতর্ক এড়িয়ে ২০০৩-২০০৭ ও ২০১১ সালের কয়েকটি জরিপের তথ্য এবং একটি প্রাইভেট পরিসংখ্যান তুলে ধরলাম। এরপরে সমন্বয়ে যাবো ইনশাল্লাহ।

ইসলাম এবং মুসলিম ইস্যুতে জার্মানির অবস্থান নিয়ে বরাবরই আমি বিশেষ আশাবাদী। আশংকার সবরকম হিসেব বিবেচনায় রেখেও জার্মানি নিয়ে কেনো জানি আমার এমন আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে। মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত শক্তির সর্বশেষ উদাহরণ ছিলো উসমানী খেলাফত। বিশ্বমঞ্চে তৎকালীন প্রুসিয়া-জার্মানির সাথে উসমানী খেলাফতের গাঢ় বন্ধন ছিলো। এক দু বছর বা যুগ নয়, দেড় শতাব্দীর লম্বা সময় ধরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও তারা জার্মানির সাথেই সন্ধিবদ্ধ ছিলো। এরপরের ইতিহাস তো মশহুর। আজকের প্রেক্ষাপটেও ইউরোপে একমাত্র জার্মানিই দৃঢ়তার সাথে মুসলিম বান্ধব হিসেবে নিজেদের পরিচয় করাচ্ছে। অভিবাসীরা তো আছেনই, মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকার মুসলিমরাও জার্মানিকে শুরু থেকেই নিরাপদ আবাস মনে করছেন। বছর দুই আগে প্যারিস হামলার পর যখন ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্র এবং দূরের যুক্তরাষ্ট্র থেকেও মুসলিম শরণার্থী বিরোধী রব ওঠলো, জার্মানি সেখানে স্পষ্ট বলে দিয়েছে- প্যারিস হামলা আর শরণার্থী দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ইস্যু। শরণার্থী প্রশ্নে কেউ যেনো সন্ত্রাসবাদের ইস্যু যুক্ত করার চেষ্টা না করে। আরো কিছু হিসেব আছে, ইনশাল্লাহ সামনে আসবে। আলোচনা তাই একটু লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আশা করি শেষ পর্যন্ত সাথেই থাকবেন।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে শ্রমিক অভিবাসন এবং সত্তুর-আশির দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতায় শরণার্থী সংকটের কারণে জার্মানিতে ইসলাম একটি দৃশ্যমান ধর্মে পরিণত হয়। ২০১১ সালের একটি আদমশুমারি অনুযায়ী- জার্মানির প্রায় দুই ভাগ লোক নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচয় প্রদান করেন। এ হিসেবে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দেড় মিলিয়ন। যাই হোক- এটা তো প্রকৃত সংখ্যাকে উপেক্ষা করার মতোই একটা ব্যাপার। কারণ, স্পষ্টতই জার্মান নাগরিকেরা তাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশে অনীহার অধিকারটা এক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। ২০০৯ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী- জার্মানিতে কমপক্ষে সাড়ে চার মিলিয়ন বা ৪৫ লাখ মুসলিম রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় দু’ মিলিয়নই জার্মান নাগরিক। ২০০৬ এর এক হিসেব অনুযায়ী- প্রায় ১৫০০ হাজার হলেন ধর্মান্তরিত মুসলিম। জার্মান পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসেবে- ২০০৫ সালে জার্মানির প্রায় দশ ভাগ জন্ম নেয়া শিশুর পিতা-মাতা ছিলেন মুসলিম।

ইসলাম হলো জার্মানির সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় এবং বর্ধিঞ্চু গ্রুপ। প্রটেস্ট্যান্ট এবং রোমান ক্যাথলিক মিলিয়ে খৃষ্টান ধর্মই জার্মানির সংখ্যাগুরু ধর্মীয় গ্রুপ। জার্মানির মুসলিমদের বড় অংশটি তুরস্কের। পাকিস্তান, সাবেক যুগোশ্লোভিয়া, আফগানিস্তান, ইরান এবং আরব রাষ্ট্রগুলোরও কিছু কিছু মুসলিম সেখানে রয়েছেন। মুসলিমদের বড় অংশই রাজধানী বার্লিনে বসবাস করেন। ৭৫% মুসলিম হলেন সুন্নি। শিয়া এবং কিছু কাদিয়ানীও সেখানে আছেন।

জার্মান এবং উসমানী খিলাফতের মধ্যকার কূটনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের সূত্র ধরেই মুসলিমরা প্রথমে জার্মানিতে আসেন। আঠার শতকের শুরুরদিকে ২০ জন মুসলিম সেনা প্রুসিয়ার প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের অধীনে কাজ করেন। ১৭৪৫ সালে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক ক্ষমতায় বসে মুসলিম রাইডারস নামে প্রুসিয়ান সেনাবাহিনীতে মুসলিম সেনাদের একটি স্বতন্ত্র ইউনিট গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। এই সেনা ইউনিটে বিশেষ করে বসনিয়া, আলবেনিয়া এবং তাতার সেনারা অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৭৬০ সালে শুধু বসনিয়ান মুসলিম সেনাদের নিয়ে স্বতন্ত্র একটি ইউনিট গঠন করা হয়, যাতে ১০০০ সেনা অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

১৭৯৮ সালে বার্লিনে একটি মুসলিম কবরস্থান নির্মিত হয়। এই কবরস্থানটি ১৮৬৬ সালে একবার শহরের বাইরের দিকে স্থানান্তরিত হয় এবং এখনো এটি বিদ্যমান। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক ইসলামিক কংগ্রেসের জার্মান শাখা এবং জার্মান মুসলিম শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষালয়। তখন সেখানে ৩০০০ মুসলিম সদস্য ছিলেন, যাদের ৩০০ জনই ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভুত। জার্মানিতে নাৎসিবাদের জন্ম মুসলিম সম্প্রদায়কে কখনো টার্গেট বানায় নি। এডলফ হিটলার ইসলাম এবং মুসলিম জাতি সম্পর্কে যথেষ্ট সুধারণা পোষণ করতেন। তিনি মাঝে-মধ্যে বলতেনও- ‘বিন¤্র এবং নিস্তেজ খৃষ্টবাদের চেয়ে ইসলামই ‘জার্মান রেস’ (গতিশীল জার্মান জাতীয়তাবাদ) এর সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল।’ নরম্যান ক্যামেরন অনূদিত ১৯৪১-১৯৪৪ সালে হিটলারের ঘরোয়া আলোচনার একটি সংকলনে উল্লেখ আছে- হিটলার স্বভাবসুলভ গর্বভরে একদিন উচ্চারণ করেছিলেন- ‘চার্লস মার্টেল যদি পয়টিতে (পশ্চিম ফ্রান্সে অবস্থিত সীমান্তবর্তী একটি শহর) বিজয়ী না হতো, তাহলে খুবরকম সম্ভাবনা ছিলো আমরা সবাই এতোদিনে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে যেতাম। সেই ইসলাম যা যুগ যুগ ধরে সাহসী যোদ্ধাদের বীরত্বকে মহিমান্বিত করেছে এবং তাদের জন্য খুলে দিয়েছে সপ্ত বেহেশতের দরজা। আর তারপর জার্মান জাতি পুরো বিশ্বকে পদানত করে ফেলতো।’

এডলফ হিটলারের এক বন্ধু হিটলারের এমন একটি বক্তব্যও উদ্ধৃত করেছেন- ‘মুহাম্মাদের ধর্ম ইসলামই খৃষ্টধর্মের চেয়ে আমাদের সাথে বেশি সামঞ্জস্যশীল, নিস্তেজ আর বিন¤্রতার দায়ে জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও জার্মানি কেনো খৃষ্টবাদের সাথে সম্পর্কে জড়ালো?’…বোঝা যায়- ইসলামের তাৎপর্যটা হিটলার ভালোই অনুভব করতে পেরেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ২০ হাজার জার্মান মুসলিম বিভিন্ন শহরে জার্মান বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। জেরুজালেমের গ্রান্ড মুফতি আমিন আল হোসাইনি সুদস্টাফে প্রচুর সংখ্যক মুসলিম সেনা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সুদস্টাফে ছিলো নাৎসি বাহিনীর এলিট ফোর্স। এর বাইরে তিনি অন্যান্য জার্মান বাহিনীতেও মুসলিমদের পাঠিয়েছিলেন। নাৎসিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ইউনিট (ডধভভধহ ঝঝ) ভ্যাফন এস এসসহ আরো নানা সেনা ও ভলেন্টারি ইউনিট গঠনেও তার বিশেষ ভূমিকা ছিলো।

পশ্চিম জার্মান সরকার ১৯৬১ সালে গাস্টআরবাইটার বা অতিথি শ্রমিক হিসেবে বিদেশি শ্রমিক আহ্বান করলে অভিবাসীদের সংখ্যায় ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে। দুই দশকে মিলিয়ে যার বর্তমান ফিগার ৪.৩ বা প্রায় ৪৫ লাখে উন্নীত হয়েছে। এই অভিবাসীদের বড় অংশটিই দক্ষিণ তুরস্কের আনাতোলিয়া রাজ্যের নাগরিক ছিলো। তাদেরকে এখন জাতিগত জার্মানদের সমান্তরালেই বিশেষ একটা সমাজ হিসেবে চিন্হিত করা হয়

জার্মান ওপেন সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের একটি পরিসংখ্যান : ২০০৭

জার্মানির পরিসংখ্যান সংস্থাগুলো প্রাইভেসি সংক্রান্ত কারণে জনসাধারণের ধর্মীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। কেবল নাগরিকত্ব বিষয়ক তথ্যই পাওয়া যায়। এই সূত্রে জার্মানিতে মুসলিম জনসংখ্যা ৩ থেকে ৩.২ মিলিয়ন বা ৩২ লাখের মতো, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩.৬ থেকে ৩.৯ বা প্রায় চার পার্সেন্ট। মোট জনসংখ্যা আট কোটির কিছু বেশি। আর এই হিসেবে বিদেশ থেকে আগত মুসলিমেরা মোট অভিবাসীর এক তৃতীয়াংশ প্রায়। জার্মানির বেশিরভাগ মুসলিম তুর্কি বংশোদ্ভুত এবং তাদের প্রায় সবাই নাগরিক সনদপ্রাপ্ত। দ্বিতীয় সর্বাচ্চ জার্মান মুসলিম বসনিয়া-হার্জেগোভিনা বংশোদ্ভুত। এই তালিকায় এরপর আছে ইরান, মরক্কো এবং আফগানিস্তান। লেবানন, পাকিস্তান, সিরিয়া, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ারও অনেক মুসলিম আছেন।
২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে নাগরিকতা প্রদানের আইনটি যথেষ্ট শিথিল করা হয়েছে, বিদেশী বাবা-মায়ের জার্মানিতে জন্ম নেওয়া সন্তানেরাও এ আইনের মাধ্যমে নাগরিকতা আবেদনের সুযোগ পান। শ্রমিক অভিবাসী হিসেবে মুসলিমদলের প্রথম তরঙ্গটি জার্মানিতে পৌঁছে ১৯৬০-১৯৭০ দশকের মধ্যে প্রধানত তুরস্ক থেকে। উত্তর আফ্রিকা এবং যুগোস্লোভিয়া থেকেও। এরপর আশির দশকে আবারও বড় একদল মুসলিম জার্মানিতে পাড়ি জমান, তবে রাজনৈতিক গোলযোগ বা সংঘাতের কারণে এবার তারা আসেন মূলত উদ্বাস্তু ও শরণার্থী হিসেবে। অভ্যুত্থানের কারণে এবারও তুরস্ক থেকেই প্রচুর লোক জার্মানিতে পাড়ি জমান। যেহেতু আশ্রয় ও কাজের খোঁজেই তারা এ দেশে এসেছিলেন, তাদেও ঠাঁয়ও হয়েছে কেবল সেসব শহরে- বার্লিন, হামবুর্গ, ডুসবার্গ, ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা মিউনিখের মতো যেগুলো শিল্পের জন্য বিখ্যাত।
জার্মানিতে এখন প্রথম থেকে নিয়ে চতুর্থ প্রজন্মের মুসলমানদের সময় চলছে। শুরুতে অনেক শ্রমিক অবসর হলে তুরস্কে বা নিজের দেশে ফিরে যেতেন, সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারটা কমে এসেছে। জার্মানিতে জন্ম নেয়া এবং সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠা দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ প্রজন্মের মুসলিমরা আর পূর্বপুরুষদের দেশে ফিরে যাবার চিন্তা করেন না। জার্মানিকেই তারা স্থায়ী আবাস বানিয়ে নিয়েছেন। বছরে বছরে অবশ্য নিয়ম করেই তারা নিজেদের পূর্বপুরুষের দেশে বেড়াতে যান। প্রতিবছর জার্মানি থেকে চল্লিশ লাখ লোক কেবল তুরস্কেই বেড়াতে আসেন। অবশ্য মুসলিম সংস্থাগুলোরও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নতুন দেশে নিজেদের পরিচিতি, নিরাপদ আবাস, নাগরিক অধিকার এবং ইসলাম চর্চায় যে-কোনোরকম ছেদ ঠেকাতে বরাবরই তারা সোচ্চার ছিলেন। জার্মান অভিবাসী মুসলিমেরা তাই পশ্চিমের যে-কোনো দেশের তুলনায় অধিক নিরাপদ।

উদার জার্মানি এবং ঘরের শত্রু প্যাগিডা

ইউরোপে ইসলাম ও মুসলমান

প্যারিস হামলায় সৃষ্ট উত্তাপ অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। এতোটাই যে, সংবাদসংস্থাগুলোর ফলোআপ রিপোর্টিংয়েও ঠাঁই মিলছে না ইস্যুটির। পত্রিকার পাতা কিংবা নিউজ পোর্টালের নির্দিষ্ট বিভাগগুলোতে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও এ নিয়ে তেমন কিছুই পাবেন না। যে ইস্যুটিতে তিন-চার সপ্তাহজুড়ে বিশ্ববাসী বুঁদ হয়ে থাকলো বা থাকতে বাধ্য হলো, এখন হঠাৎ সেটা হাওয়া হয়ে যায় কীভাবে? কোনো ঘটনা সংবাদের সাধারণ সীমা ছাড়িয়ে বিশেষ এজেন্ডায় পরিণত হলে এমনই হয়। ‘সংবাদমূল্যে’র ফালতু ব্যাখ্যার আড়ালে মিডিয়া আগ্রাসনের এ এক নির্লজ্জ নমুনা। প্যারিসের ঘটনায় যার যা চাওয়া ছিলো, বেশ ভালোভাবেই তারা সেগুলো পেতে সক্ষম হয়েছে। এখন আর অযথা সময়-শ্রম নষ্ট করার কোনো দরকার নেই তাদের। সিরিয়ানরা এতোদিন গৃহযুদ্ধের ফাঁদে হাঁস-ফাঁস করে মরেছে। একসময় এসে রাশিয়াও তাদের মারতে শুরু করলো। এখন জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় মারছে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি। নাটের গুরু যুক্তরাষ্ট্র তো বরাবরের মতোই পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডজুড়ে নিজের প্রবল উপস্থিতি বজায় রেখেছে। আমরা ভুলে গেলেও প্যারিস হামলার মাজেজা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছেন অগ্নিকু- সিরিয়ার অসহায় মানুষজন। ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সীমান্তে আটকা পড়া শরণার্থী কিংবা সংখ্যালঘু মুসলিমরাই এখন ভালো বলতে পারবেন- এই ঘটনা তাদের জন্য কেমন বিভীষিকা নিয়ে হাজির হয়েছে পশ্চিমের দেশে দেশে। আর এসবই তো এখন ফলোআপ রিপোর্টিংয়ের সহজ-স্বাভাবিক উপাদান হবার কথা, হচ্ছে বিপরীতগুলো। হঠাৎ সতর্কতা জারি, বোমাতঙ্কে বিমানের জরুরি অবতরণ কিংবা নিরাপত্তা সংকটে প্রদেশজুড়ে স্কুল বন্ধের ঘোষণা ইত্যাদি ইত্যাদি- এগুলোই হচ্ছে এখনকার ব্রেকিং এবং টপ নিউজ। সান বার্নাদিনোর ঘটনার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের টর্নেডো তো চলছেই।

প্যারিসে হামলার ঘটনা প্রাথমিক যে শংকা সামনে নিয়ে এসেছিলো, সেটা বাস্তবায়নেই এখন উঠেপড়ে লেগেছে তাবৎ পাশ্চাত্য। আতঙ্কে নিজেদের গোহাবাসী করার পাশাপাশি দফায় দফায় প্রশাসনের সাথে বৈঠক, শান্তি সমাবেশ, অনলাইন ক্যাম্পেইন এমন কি বিশাল খরচের বিলবোর্ড ভাড়া করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে মুসলিমদের। কেমন লাগে বলুন, এই যুগেও শহর-নগরের বিলবোর্ডগুলো ভাড়া করে যখন প্রচার করতে হয়- ‘মুহাম্মাদ (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) বিশ্বাস করেন- শান্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নারী অধিকারে’। মুসলিম মালিকানাধীন ওয়েব সাইট এবং পত্রিকাগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে এখন শুধুই শান্তি আর মানবাধিকার সমর্থিত আর্টিকেলের একেকটা আধারে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে। এখানে এসেও খুঁচিয়ে যাচ্ছে উগ্র কোনো খৃস্টান বা ইহুদি মানব-মানবী। এক লমহায় ১৫ বছর পিছিয়ে পাশ্চাত্যের বাস্তবতা এখন যেনো ৯/১১ পরবর্তী বাস্তবতায় গিয়ে ঠেকেছে। মুসলিম এক তরুণ সেদিন লিখলেন- চারপাশে আজকাল মুসলিমদের করুণা করার লোকের অভাব নেই। এমন পাশ্চাত্য আমরা চেয়েছিলাম? কেনো, কীভাবে হয়ে গেলো এসব?…

মুসলিম ইস্যুতে ইউরোপসহ পুরো পাশ্চাত্যে এই মুহূর্তের সবচে’ উদার দেশ জার্মানি। প্যারিসের ঘটনা জার্মানির শরণার্থী নীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, যদিও ইউরোপে অভিবাসন এবং মুসলিম বিদ্বেষী ‘প্যাগিডা’র আন্দোলন এই জার্মানিতেই জন্ম ও বিস্তার লাভ করেছে। জার্মানিতে তারা সবচে’ বেশি সক্রিয়ও। জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মার্কেল এবং প্রেসিডেন্ট জোয়াকিম গাউক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন- প্যারিস হামলা জার্মান শরণার্থী ইস্যুতে কোনো পরিবর্তন আনবে না। বিরোধী শিবির এবং বেশ কয়েকটি ইউরোপীয়ান দেশের সমালোচনা উপেক্ষা করে আইএস এবং শরণার্থী ইস্যুকে এক না করার জন্য তারা সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন। শুধু এক্ষেত্রেই নয় বরাবরই জার্মানি যথেষ্ট উদার মানসিকতা দেখিয়েছে মুসলিম ইস্যুতে। বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং দুই জার্মানির একত্রিত হবার ২০তম বার্ষিকীতে এ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছিলেন- ‘জার্মানির মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হতে খুব বেশি দেরি নেই। কিছুদিনের মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগা জার্মানিতে অধিক পরিমাণ মসজিদের উপস্থিতি মেনে নেয়ার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মার্কেল বলেন, ৪০ থেকে ৫০ লাখ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ জার্মানিতে মসজিদ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হতে চলেছে। তার আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান উলফ বলেছিলেন, খ্রিস্টান ও ইহুদী সভ্যতার পাশাপাশি মুসলিম সভ্যতাও সমানভাবে জার্মান সমাজে অন্তর্ভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে। শুধু জার্মান সরকার নয়, সাধারণ নাগরিকেরাও মুসলিম অধিকার ইস্যুতে বরাবর সজাগ। প্যাগিডার উদ্ভব যেমন এখানে ঘটেছে, প্যাগিডার যাবতীয় কার্যক্রমকে তারা রুখেও দিয়েছে। প্যাগিডা দশজনের জমায়েত করলে তারা ত্রিশজনের জমায়েত করে প্রতিবাদ জানায়। ফিলিস্তিন ইস্যুতেও পশ্চিমের সব দেশের চেয়ে জার্মানদের ভূমিকাই সবচে’ স্পষ্ট এবং অগ্রগণ্য।

জার্মানির শরণার্থী গ্রহণের ঐতিহাসিক ও বাস্তবভিত্তিক অনেক কারণ রয়েছে। ইতিহাস বলে- অভিবাসী বা শরণার্থী ইস্যুতে জার্মানি বরাবরই সহানুভুতিশীল। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রায় ১২ লাখ জাতিগতভাবে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া নাগরিককে গ্রহণ করেছিলো, যারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছিলো। সেই মূলত শুরু। এরপর ষাটের দশকে যখন জার্মানি অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কর্মীর- যারা আবাসন খাতে এবং শিল্প কারখানায় কাজ করবে। ষাটের দশকে জার্মানি তাই তুরস্ক, ভিয়েতনাম, সাবেক যুগোস্লাভিয়া ও পোল্যান্ড থেকে প্রচুর ‘গাস্ট আরবাইটার’ বা অতিথি শ্রমিক গ্রহণ করে। সিরিয়ার নাগরিক কম থাকলেও তিউনেশিয়া, ইরান ও ইরাকের নাগরিক যথেষ্ট পরিমাণে সেখানে ছিলেন। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে জার্মানির একটা যোগাযোগ ছিলো। ব্রিটেন, ফ্রান্স ছাড়া অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা জনগোষ্ঠীর খুব একটা অভিবাসন ঘটেছে- এটা বলা যাবে না। তাই সিরিয়ান শরণার্থীরা তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় জার্মানিকেই রেখেছিলো। জার্মানির অভিবাসন প্রক্রিয়াও অনেক সহজ। ২০০৫ সালে জার্মানিতে নতুন একটি অভিবাসন আইন চালু হয়। এতে বলা হয় জার্মানি হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ। আগে এই আইন ছিলো না।

pagoda in paris

নাগরিকত্ব অর্জনের মতো আশির দশকে অভিবাসন আইনটিও বেশ জটিল ছিলো। পরবর্তীতে ২০১২ সালে জার্মানি ঊঁৎড়ঢ়বধহ ইষঁব ঈধৎফ খবমরংষধঃরড়হং আইনটি পাস করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা ছাত্ররাও তাঁদের কাজের অনুমুতিপত্র ও থাকার অনুমতি লাভ করে। এসব কারণে সিরীয় শরণার্থীদের জার্মানির ব্যাপারে আগ্রহ থাকাটাই ছিলো স্বাভাবিক। তাছাড়া ইউরোপের কোনো কোনো দেশে অর্থনীতির শ্লথগতি ও বেকার সমস্যার মুখে পড়লেও, জার্মানি এক্ষেত্রে বরাবরই ছিলো ব্যতিক্রম। জার্মানি ৩ দশমিক ৪১৩ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ, যা বিশ্বের চতুর্থ বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয় বছরে ৪১ হাজার ৯৫৩ ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যেখানে বেকার সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ, জার্মানিতে এই সংখ্যা মাত্র পাঁচ ভাগ। ফলে অনেকের কাছেই এই দেশের ব্যাপারে বিশেষ একটা আকর্ষণ রয়েছে। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে জার্মানির কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দরকার। পরিসংখ্যান বলছে শতকরা ৩৮ জন মানুষ জার্মানিতে এখন একা থাকেন। বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাচ্ছে।

অনেক পরিবার সন্তান নিতে চাচ্ছে না। পেশার উন্নয়নের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে তারা সন্তান পালনের ঝুঁকি নিতে চায় না। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে কর্মী দরকার। ফলে ‘গাস্ট আরবাইটার’ জার্মানির খুব দরকার। এর বাইরে জার্মানিতে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী। একজন কর্মী বিদেশি হলেও তাঁর যদি কাজ করার অনুমতিপত্র থাকে এবং তিনি যদি বেকার থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেবে, বাসাভাড়া দেবে, সন্তানদের জন্য আলাদা ভাতা দেবে এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাবার ভাতাও দেওয়া হবে। সবমিলিয়ে কাজ না করেও একজন তাঁর পরিবারপ্রতি মাসে প্রায় তিন হাজার ইউরো পাবেন। যেকোনো বিবেচনায় শরণার্থীদের জন্য এটা বড় পাওয়া। জার্মান সরকারের এসব শরণার্থীর ব্যাপারে আগ্রহের বড় একটা কারণ- এসব শরণার্থীর প্রায় সবার বয়স ৩৫-এর নিচে এবং তাদের সাথে সন্তান আছে। নিশ্চয় তারা দক্ষ কর্মী হয়ে যাবে এবং জার্মান অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবে, যেমনটি রেখেছিলো ইতোপূর্বে জার্মানিরই কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা। তবে সব সত্যের ওপরের সত্য হলো- জার্মান সরকার যে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে, অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই মানবিকতা এতটুকুও স্থান পায়নি। হাঙ্গেরি কিংবা চেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বরং পুরোই উসকানিমূলক ছিলো। তাঁরা ধর্মীয় প্রশ্ন তুলেও তাঁদের উগ্র মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। জার্মানি এক্ষেত্রে পুরোই ব্যতিক্রম। হিটলার এবং নাৎসি বাহিনী নিয়ে জার্মানির একটি কালো ইতিহাস আছে। এর পেছনে সেই গ্লানিবোধেরও একটা প্রভাব আছে হয়তো। তাছাড়া ইতিহাসও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান মুসলিমদের সাথে জার্মানির পুরনো সখ্যতার পক্ষেই কথা বলে।

ইসলামী খেলাফতের বড় অংশজুড়েই জার্মানির সাথে মুসলিম বিশ্বের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এসবকিছুরই সম্মিলিত ফলাফল- চলমান দু:সময়েও মুসলিম ইস্যুতে আজকের উদার জার্মানি। সিরিয়ানদের বিপদে অন্যদের মতো মুখ না ফিরিয়ে অনেক জার্মান নাগরিককেই দেখা গেছে স্বপ্রণোদিত হয়ে শরণার্থী ফান্ডে নিজেদের বেতনের ১ ভাগ তারা সরকারকে দেওয়ার প্রস্তাব করছেন। জার্মান সরকার তাদের কালো ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে শরণার্থীদের গ্রহণ করে বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। বেড়েছে তাদের মর্যাদাও। যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে জার্মানিই এখন বিশ্বের সবচে’ বড় এবং শীর্ষ অভিবাসী গ্রহণকারী দেশ। সবচে’ নিরাপদ এবং প্রিয়ও। এসবের মধ্য দিয়ে জার্মানি আবারও প্রমাণ করলো- তারা শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত।

দুবাইয়ে জার্মান নারীর ইসলাম গ্রহণ

আমি কিছু একটা খুঁজছিলাম। তবে বছরের পর বছর অপেক্ষার পরও সেটা পাই নি।

আমি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। আমি নিজেকে বন্ধুদের সাথে মেলাতে পারতাম না। কারণ আমার বন্ধুদের ব্যাপার ছিলো অনেকটা এমন- ওহ, আজ তো ছুটি। আজ জম্পেশ একটা পার্টি দেয়া দরকার। চলো বিয়ারের প্রথম বোতলটা ছিপিমুক্ত করি। চলো কাজের পোষাক বদলে পার্টি পোষাক পরে নিই। উদযাপন সর্বস্ব উদ্দাম এক জীবন। হ্যাঁ, আমার জন্য এটা কঠিন সময়ই ছিলো বলতে হবে।
এরপর হঠাৎ করেই কী একটা ঘটে গেলো। আমার পৃথিবীটা পুরোই বদলে গেলো।

দুবাইয়ে চাকরির প্রস্তাব

আমি ভ্রমণে ব্যাপক অভ্যস্ত ছিলাম। বয়সে যখন আমি ত্রিশে পৌঁছে গেলাম, মনে হলো- এবার তো আর বসে থাকা যায় না। কোথাও সেটেল হতে হবে। আমি বাড়ী ফিরলাম এবং একটা চাকরি খুঁজতে লাগলাম। তবে পাচ্ছিলাম না। অপেক্ষায় না থেকে ভাবলাম- এভাবে বসে না থেকে বরং কোথাও একটু বেড়িয়ে আসা যাক। এরপর খুব না ভেবে আমি আমি আরব রাষ্ট্র দুবাইয়ে বেড়াতে চলে গেলাম। আমি দুবাই এলাম এবং দু’ সপ্তাহের ব্যবধানে একটা চাকরির প্রস্তাবও পেলাম। আমার বাবা-মা বিষয়টা নিয়ে খুবই ভীত হয়ে পড়লেন। এক সময়ের আমার মতোই- আমার বাবা-মাও এ ব্যাপারে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলেন যে পশ্চিমা কোনো মেয়ে আরবে যাবে এবং সেখানে চাকরি করবে! অবশ্যই আমরা সবাই এমনই ছিলাম কারণ যেসব ঘটনা প্রতিনিয়ত আমরা শুনতে পেতাম এবং সময়টাও ছিলো ২০০১ এর শেষের দিকে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন ৯/১১’র ঘটনা নিয়ে তখন কেমন তোলপাড় চলছিলো। চারপাশে যা ঘটছিলো, খারাপ কিছুর আশংকায় আমরা সবাই তখন তটস্থ থাকতাম।

আমি এরপর একসময় মুসলিমদের সাথেও সময় কাটিয়েছি। এটা শুরু হয়েছে যখন আমার ভাই ইসলাম গ্রহণ করলেন। আমাদের বিবেচনায় তার মুসলিম হবার মূল কারণ ছিলো তিনি একজন তুর্কি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। সুতরাং তার বোন হওয়ায় এবং তার সিদ্ধান্তে তাকে অটল রাখার কামনা থেকে আমরা ইসলামিক সেন্টারগুলোতে গিয়েছি। নি:সন্দেহে সব রকম কুসংস্কার পেছনে ফেলে আমি এটা করেছি।

আমি ভাইয়ের সাথে ইসলামিক সেন্টারগুলোতে গিয়েছি। কিছু আলোচনায় অংশ নিয়েছি। তার সাথে কিছু বইও পড়েছি। তবে সেটা কখনো আমার জন্য এমন উৎসাহমূলক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় নি যে আমি ভাববো- এবার আমাকে ইসলাম গ্রহণ করতেই হবে। জানতে-পড়তে ভালো লাগতো, ব্যাস- এতোটুকুই। এরপর আমি একটি ইসলামী দেশে এলাম। এই প্রথম আমি মুসলিমদের সঙ্গ উপভোগ করলাম সম্পূর্ণ নতুনভাবে। হঠাৎ করে আমার মনে হতে শুরু করলো- তারা সত্যিই অসাধারণ। মুসলিমরা সত্যিই আপনাকে খুব শ্রদ্ধার সাথে সঙ্গ দেবে। আমি এতে খুব স্বস্তি বোধ কররাম। ইতোপূর্বে আমি মিশেছি কেবল ইউরোপীয়ান বা এমন জাতির মানুষদের সাথে যাদের সাথে আমি স্বাচ্ছন্দে মিলতে পারি। আমি সবসময় একটা নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ খুঁজতাম। মাঝে এমন একটা সময় গেলো যে আমি আর সে স্বস্তিদায়ক ক্ষেত্রটা খুঁজে পেতাম না। এখন এসে দুবাইয়ে যেটা পেলাম।

ছ’ মাস পূর্বে আমি কালিমা পাঠ করেছি। বোরকা পরা শুরু করেছি। আমি প্রথম থেকেই বোরকা পরার ব্যাপারটাকে ভালোবাসতাম। তবে এড়িয়ে গেছি কারণ, ভাবতাম ইসলাম গ্রহণ না করেই এটা পরা শুরু করলে আরবরা আবার এটাকে নিজেদের জন্য অবমাননাকর মনে করে কিনা! আমি একজন সাদা পশ্চিমা মেয়ে হয়ে বোরকা পরে ঘুরবো এটা সবাই ভালোভাবে নাও তে নিতে পারে।
আমার সাবেক স্বামীর ব্যাপারটাও তখন একটা ফ্যাক্ট ছিলো। তিনি তখনও আমার স্বামী। তবে আমার কাছ থেকে একপ্রকার ফেরার ছিলেন কারণ আমাদের বিয়ে যেভাবেই হোক একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাই ধীরে ধীরে আমিই তার থেকে একটা দূরত্ব তৈরি করি। আমরা বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপার নিয়ে আলাপ করতাম। আমি সবসময় তাকে নিজ দায়িত্বে সরে যেতে অনুরোধ করতাম এবং সে তা অস্বীকার করে বলতো- ‘না, তুমিই আমার স্ত্রী। আমি তোমার সাথে আরব দেশেই থাকতে প্রস্তুত। আমি তখনই সরে যাবো যখন আমার সিদ্ধান্ত নিতে ইচ্ছে করবে। আমি তো পুরুষ, সুতরাং সিদ্ধান্তটা আমারই।’ আমার ইসলাম বিষয়ক পড়াশোনাও তখন যথেষ্ঠ গতি পেয়েছিলো। এসব ঘটনার মধ্যেই একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে আমি ভাবলাম এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম- আজই আমি মুসলিমা হয়ে যাবো। সে মোতাবেক আমি গোসল করলাম। ভালো কাপড় পরলাম। কাজে গেলাম। কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না। সিদ্ধান্তটা কেউ জানলোই না। কাজ শেষ করে আমি আমার মতোই একজন জার্মান নারীর কাছে গেলাম যে ৭ বছর পূর্বেই ইসলাম গ্রহল করেছে। আমি কালিমা পাঠ করলাম।

কালিমা পাঠ শেষে আমি যখন বাসায় ফিরলাম, আমার কাছে তখন এর অর্থ ছিলো এমন- আমি বাসায় ফিরেছি এবং আমার একান্ত কাছের মানুষ আমার হাজবেন্ডও তখনো জানে না আমি ইসলামে দীক্ষিত হয়ে গেছি। আমি তাকে জানাই নি কারণ বিগত ছ’ মাস ধরে টানা তাকে আমি জিজ্ঞেস করে আসছিলাম কখন তুমি আমার থেকে পৃথক হবে? আমি ভাবলাম আজ তাকে আবারো বলবো- সুতরাং কখন তুমি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে? তবে ঘটনা তখনই ঘটলো। সুবহানাল্লাহ, সেদিন জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে সে বললো- ঠিক আছে, আমি আজই তোমাকে ছেড়ে যাবো। আমি ইতোমধ্যেই কাপড় গুছিয়েও রেখেছি। এটা নি:সন্দেহে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আমার জন্য একটা বিশেষ পুরষ্কার ছিলো। আমি আরো নিশ্চিত হলাম- আমার সিদ্ধান্ত সর্বোতভাব সঠিক।

ইসলাম আমায় সাহসী ও সুদৃঢ় করেছে

আমি ২০০৯ এর ২৫ এ জুন শাহাদাহ পাঠ করি। কেবল সেদিনটি ছাড়া পুরো বছরটা আমার জীবনের সবচে বাজে একটা সময় ছিলো। আমার পূর্ব জীবনে ঘটে যাওয়া বিশ্রী ও ঘৃণ্য সব কাজ প্রতিনিয়ত আমায় কুড়ে কুড়ে খেতো। আমি সেসব ভাবনা পাশ কাটাবার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যেতাম এবং ভাবতাম একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে কখনো এমনটা মনে হয় নি যে আমি আমার বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছি। আলহামদুলিল্লাহ, এখনো পর্যন্ত এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন নিজের মনে প্রশ্ন জেগেছে- কেনো আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম? এটা কখনো আমার কাছে কোনো অপশন ছিলো না।

আমার সাথে তখন যা ঘটেছে সবই ছিলো প্রতিকূল ও বিপরীতমুখি। এটা আমাকে আরো সাহসী ও সুদৃঢ় করেছে। এবং এসময় আমি অরো বেশি করে ইসলামকে জানা শুরু করলাম। সবাই ভাবে, কেউ যখন ধর্মান্তরিত হয় তখন কেবল শাহাদাহ পাঠ করে। আপনি সামান্য কুরআন পড়লেন, সে মুগ্ধতা থেকেই শাহাদাহ পাঠ কররেন এবং তাতেই সীমাবদ্ধ থাকলেন সেটা কোনো ভালো খবর হতে পারে না। আমার ব্যাপার ছিলো- যতো বেশি বাধা ও প্রতিবন্ধকতা আমার সামনে এসে দাঁড়াতো আমি ততো বেশি করে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতাম এবং বেশি বেশি নলেজ অর্জন করতাম। এটা আমার জন্য সত্যিই বেশ কঠিন একটা বছর ছিলো। এসময়, আমার বন্ধুরা হঠাৎ করে আমার শত্রুতে পরিণত হয়। আমার জীবন দ্রুত খাদে আটকে যেতে শুরু করে। তখন আমার একটা মাত্র বন্ধু আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার নাম কেটি এবং সত্যিই সে আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। আমার ব্যাপক পরিচিত মহলের মধ্যে কেবল সেই আমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। অন্য সবাই তখন আমার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিলো এবং তারা আমার সিদ্ধান্তে বিমূঢ় ও বাজেরকমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো। আমি জানতাম একমাত্র কেটিই তখন আমার পাশে আছে এবং প্রয়োজনে মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে হলেও তার সাথে আমি কথা বলতাম। আমি আল্লাহর কাছে বরাবরই শুকরিয়া জানিয়েছি আমাকে এমন একজন বন্ধু উপহার দেয়ার জন্য। পশ্চিমা বিশ্বের বাস্তবতায় নতুন ধর্মে দীক্ষা নেয়ার পরবর্তী অবস্থাটা অন্য কারো পক্ষে আন্দাজ করাও মুশকিল।

কেটি সব বিষয়ে আমাকে ব্যাপক সাহায্য করলেও সে নিজে তখন মুসলিম ছিলো না। সে দ্বিধান্বিত ছিলো। আমার মনে পড়ে- একবার আমার সাবেক স্বামীসহ কেটির সাথে আমি লাঞ্চ করতে যচ্ছিলাম। ব্যাপরটা যদিও এখন কাঁটার মতো হৃদয়কে বিদ্ধ করে তবু এটা ঘটেছিলো। আমরা গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম এবং সেটা ছিলো জুমাবার। আমরা দুবাইয়ের আলখাউর এরিয়া দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম বহু ছাদ খোলা গাড়ি যাচ্ছে। ত্রিশ জনের মতো করে মানুষ ঠাসাঠাসি করে একটা গাড়িয়ে দাঁড়িয়ে জুমা পড়তে যাচ্ছে। কনভয়ের মতো দেখতে হওয়ায় ব্যাপারটা নিয়ে আমরা প্রচুর হাসাহাসি করছিলাম। আমরা খুব হাসছিলাম আর ভাবছিলাম এভাবে বিপজ্জনকভাবে দাড়িয়ে জুমা পড়তে যাওয়াটা কতোটুকু যৌক্তিক? তারা কেনো এমনটা করছে? শুধুমাত্র নামাজের জন্য কেনো তারা নিজের নিরাপত্তা ও জীবনকে বিপদের মুখে ফেলছে?

ঘটনাক্রমে গাড়িই পুরো আলোচনাই তখন ধর্ম নিয়ে হচ্ছিলো। আমার এখনো মনে পড়ে- কেটি বলেছিলো, আমি ধার্মিক নই তবে যদি আমি কোনো ধর্মকে নিজের জন্য বাছাই করতাম সেটা নিশ্চিতভাবে হতো ইসলাম। শুনে গাড়ির সবাই হেসে দিলো। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কেনো তুমি ইসলাম গ্রহণ করতে? দেখো না এরা কেমন কপট ও ভ- চরিত্রের হয়? সেদিন এসব নিয়ে ব্যাপক কথা হয়েছিলো। তবে সেদিনের সে ঘটনার পর থেকেই বিস্ময়করভাবে আমি ও কেটি অরো বেশি বেশি করে ধর্ম বিষয়ক পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। সুতরাং সন্দেহ নেই সেদিনের সে আলোচনা একদিকে যেমন কষ্টের, তেমনি আনন্দেরও। বৈরি অবস্থা থেকেই আমরা ইসলাম সম্পর্কে জেনেছি। বুঝতে চেষ্টা করেছি। এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহে সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে সক্ষম হয়েছি। ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র সঠিক ও সত্য ধর্ম। স্বস্তি, শান্তি, স্বাধীনতা ও মুক্তি কেবল ইসলামেই সম্ভব। নারীবান্ধব পৃথিবীর একমাত্র ধর্মও ইসলাম। আল্লাহ পাক আমাদের ইসলামের প্রতি অটল থাকার তৌফিক দান করুন।