সময় এখন মিডিয়ার। গোপন থাকে না কিছুই। ঘরে বসেই জানা যায় পুরো পৃথিবী। মিডিয়ার কল্যাণে আজকের পৃথিবী প্রচারের গোলাম। প্রচারণার বাহারি উপস্থাপনে মিথ্যার কাছে সত্য এখন নিরুপায়! বর্তমান সময়ে তথ্যবোমের প্রভাবে সত্যের উপাসক ক্রমশঃ দৃশ্যের আড়ালে। নিয়ত তথ্যের নির্যাতনে অসহায় একদল ঐতিহ্যপ্রেমিক মত্ত থাকে ভাইয়ের জীবন অতিষ্ঠ করার অকাজে। প্রতিদিন কমতে থাকে ব্যক্তিত্ব। নষ্ট হতে থাকে জীবনের লক্ষ্য। তুচ্ছ কুতর্কের মগ্নতায় হারিয়ে ফেলি নিজের আবাস
বর্তমান বিশ্বের এমন একটি মুসলিম দেশ কি আছে যেখানে মুসলমানগণ নিরাপদে জীবন-যাপন করছেন? এমন একটি জনপদ কি আছে যেখানে একজন মুসলিম সত্য প্রচারে সম্পূর্ণ নিরাপদ? একজন মুসলিম সত্যিকারের মুসলিম হয়ে, সত্যিকারের ইসলামী আদর্শ নিয়ে কোথাও কি আছেন শঙ্কামুক্ত? পৃথিবীর বিপর্যস্ত আর যুদ্ধবিদ্ধস্ত জনপদ মানেই মুসলমানের আবাসভূমি!
অপরদিকে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই নেমে আসে হতাশার চালচিত্র। জাতিগত পরিচয় আর নামের পরিচয় ছাড়া ইসলামকে বাস্তব জীবনে পালনীয় মনে করে; এমন মুসলমানদের জন্য এক একটা কারাগার হয়ে ওঠছে মুসলিম প্রধান দেশগুলো। কারাগার হয়ে আছে আমাদের স্বদেশ। বাংলাদেশের যেসব মসজিদে শুক্রবারে খতিবগণ বয়ান করেন, সেইসব মসজিদের অনেক খতিবদের বক্তব্য হলো, “মুসল্লিরা এখন বয়ান শুনে ইমাম সাহেব তার রাজনৈতিক আদর্শের বিপক্ষে কিছু বললো কিনা তা যাচাই করার জন্য। ইমাম সাহেব মসজিদে বসে রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে পর দিনই চাকরি শেষ!” নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনে হেফাজতে ইসলামের যেসব নিবেদিত কর্মী মসজিদে নাস্তিকদের বিপক্ষে কথা বলেছে তাদের অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। অনেকেই বাধ্য হয়েছেন চাকরি ছেড়ে দিতে। অথচ আমরা একটি মুসলিম প্রধান দেশে বাস করি!
আমাদের মসজিদের সভাপতি, সেক্রেটারি অবশ্যই মুসলামান। তারা যখন একজন আলেম, একজন খতিব ও একজন মাদরাসা ছাত্রকে ধর্মান্ধ, মৌলবাদি, ধর্মব্যবসায়ী বলে গালি দেয় তখন খুব উচ্চস্বরে বলে- ‘আমিও একজন মুসলমান’! সেই মুসলামান দাবিকারী লোকগুলোই একজন খতিবকে মসজিদ থেকে অপমান করে বের করে দিচ্ছে। অপরাধ, ইসলামের পক্ষে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা নিয়ে কথা বলা।
তারা নাস্তিকতাকে বাকস্বাধীনতার আড়ালে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এই নাস্তিকতা বেঁচে থাকলে এই দেশের মুসলমানদেরকে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপনটা তাদের জন্য সহজ হয়। সহজ হয় ইমাম, খতিব, আলেম আর মাদরাসার ছাত্রদেরকে গালি দিতে। বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম জনপদের মত বাংলাদেশও একজন মুসলমান, একজন ঈমানদারের জন্য প্রায়কারাগার হয়ে ওঠছে।
এই যখন সামগ্রিক মুসলমানদের অবস্থা; তখন আমরা মুসলিম যুবকরা কী করছি? আমরা কতটুকু আমাদের দায়িত্ব পালন করছি! উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যের জন্য আমাদের কোনো প্রচেষ্টা কি আছে? আছে কি অনাগত বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার কোন প্রস্তুতি! আপাতত দৃশ্যমান কোন এক্টিভিটিস দেখা যাচ্ছে না। যদি কারো কারো থেকেও থাকে, তা একেবারেই নিজস্ব গণ্ডিতে। নিজস্ব বলয়ে। উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই আমাদের উপলব্ধি, বর্তমানে বিভাজনের খেলার কাছে এই প্রচেষ্টাগুলো একেবারেই অপ্রতুল।
পুরো পৃথিবীজুড়েই আছে মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন। সুন্নি-শিয়া দুটি ভাগ তো স্বীকৃতই। এই নিবন্ধে বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটা আলোচনা উপস্থাপনের চেষ্টা করবো। দেখতে চেষ্টা করবো বাংলাদেশের মুসলমানদের বর্তমান অবস্থান কোথায়? ইসলামী রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা কতটুকু? চলমান নানা দল-উপদলের ক্রমাগত প্রচারণা আমাদের মুসলামদের জন্য কতটুকু অনুকূল হয়েছে! কতটুকু হয়েছে প্রতিকূল! আগামীতে আমারা আমাদের অবস্থান কতটুকু উদ্ধার করতে পারবো?
বাংলাদেশে ইসলাম আসে সূফী-দরবেশগণের হাত ধরে। এদেশের মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশ মুসলামানের মূল হচ্ছে হিন্দু পরিবার। ইসলাম আগমনের পর হিন্দুদের বৈষ্ণব দর্শন আর বৌদ্ধদের নির্বাণের প্রভাবে প্রভাবিত হন কোন কোন সূফী। একসময় ইসলামের সূফীবাদ, হিন্দুদের সন্নাস, বৌদ্ধদের নির্বাণ একাকার হয়ে যায়। এই পথে যারা হাঁটেন তাদের অধিকাংশই নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে মূলধারার আলেমগণকে বাতিল করে দেয়।
অপরদিকে মূলধারার আলেমগণ তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে ফতোয়া দেন।
সেই পথের পথিকদের মধ্যে আছে বাউল সম্প্রদায়; যাদেরকে আবার বাউল ধর্মে দীক্ষিত হতে হয়! আছে লালনের ভক্ত সম্প্রদায়। যারা সিদ্ধির পথে জাত-পাত-বর্ণের দেয়াল ভাঙ্গার মত একটা সুন্দর স্লোগানের সাথে সাথে ধর্মেরও অবসান চান! শরীয়ত-মারেফতের আলাদা আলাদা চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে একদল ছিন্ন করেছে ধর্মের সকল বিধিবিধানের শিকল। নারী-পুরুষের সকল ভেদাভেদ ভেঙ্গে মাজার ও উরশের গেঁজেল আড্ডায় কেউ কেউ করছে পরম সত্তার সন্ধান!
কেউ আছে আলিশান দরবারে নিয়ত উপঢৌকনে ডুবে থেকে, মানুষের সকল পাপের দায়ভার নিয়ে জান্নাতের সনদ বিলানোয়! এভাবেই চলছে নানা পথে আর মতে মুসলমানদের জীবন-যাপন।
এইভাবে যখন নানা দলে-উপদলে বিভাজিত হচ্ছিল মুসলমানগণ, তখনই এই উপমহাদেশে আসে ইংরেজ শাসন। ইংরেজরা এসে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের খেলাটাকে একটি শিল্পের (?) পর্যায়ে নিয়ে যায়! তাদের ছায়ায় মুসলমানদের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে একরে পর এক মতবাদ। সেইসব মতবাদের মধ্যে কাদিয়ানি ও রেজভিয়া মতবাদ এখনো সরবেই বেঁচে আছে। এদের মধ্যে রেজভিয়ারা দেওবন্দি আলেমদেরকে কাফের বলতে আরাম পায়! আর কাদিয়ানিরা আছে সবখানে কিন্তু কোনখানেই তাদেরকে দৃশ্যপটে পাওয়া যাবে না।
আমরা আমাদের জীবনে উম্মাহর ঐক্যের আলোচনায় সবসয় শুনে এসছি, ‘আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ’। মানে মুসলমানের বিপক্ষে কুফর সবসময় এক হয়ে যায়। বর্তমানে দেখছি একদল নামধারি মুসলমানও ইসলাম ও মুসলমানের বিপক্ষে কুফরের সঙ্গে এক হয়ে মুসলিম নিধনে কাজ করে। অথচ যে মুসলিমদেরকে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘ওয়া’তাসিমু বিহাবলিল্লাহি জামিআ’ সেই মুসলমানগণ নিজেদের মধ্যে ঐক্যের কোন সুযোগই রাখে নি বিশ্বায়নের এই সময়ে। বরং বিভাজনের নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে মাঠে নামছে মুসলিমগণ!
এতক্ষণ মুসলিমদের মধ্যে গোমরাহ হয়ে যাওয়া কিছু দলের কথা বলছিলাম। এখন আমারা যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারি দাবি করি, তাদের মধ্যে দৃশ্যমান দল-উপদল নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি। অন্তর্জালিক জগতে ও বাস্তব জগতে যেসব দল-উপদলের কথা শুনা যায় তাদের কয়েকটি হলো:
বর্তমানে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি একটিভ দলটি হলো আহলে হাদিস, কেউ কেউ এদের লা মাজহাবীও বলে। কোথাও কোথাও সালাফী নামেও পরিচিত। অবশ্য তারা নিজেদেরকে কখনো কখনো এর কোনটাই বলতে রাজি নন! এদের পরই আছে আহলে কুরআন। তারা হাদিসের অথিনটিসিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে! কুরআনকেই নিজেদের একমাত্র অবলম্বন বলে দাবী করবে। এদের পরেই অনলাইনে সবচেয়ে বড় দলটি জামাতের এবং ছাত্র শিবিরের। অবশ্য এক্টিভিস্ট হিসেবে জামাত-শিবির বড় দল হলেও ধর্মীয় ইখতেলাফের ক্ষেত্রে তাদের কমজনই আসেন।
তাসাউফপন্থীদের মধ্যেও আছে নানা দল- উপদল। কাদরিয়া, নকশবন্দীয়া, চিশতিয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া। এই চার দলের মধ্যেও আছে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল। দেওবন্দীদের মধ্যে আছে থানবী, মাদানী।
বর্তমানে আমাদের মধ্যে আছে রাজনৈতিক বিভাজন। কেউ আছেন কোন বড় রাজনৈতিক দলের সাথে জোট করে টিকে থাকার পক্ষে। কেউ আবার একলা চলো নীতিতে অটল। স্যাকুলারদের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েও কেউ দ্বীনের কাজ করার চেষ্টা করছেন। নির্দিষ্ট ইস্যূ ছাড়া এদেশের আলেমগণ একটি বৃহত্তর প্লাটফর্মের জন্ম দিতে পারে নি। পারেন নি একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষেত্র তৈরি করতে। এসব সমস্যার পেছনে আলেমগণের সদিচ্ছার চেয়ে বিতর্কপ্রিয় ভক্তবৃন্দ এবং তাদের কূপমুন্ডুতা অনেক বেশি দায়ী। দেশে যখন ইসলামপন্থীদের দুর্দিন তখনো আমরা পারি নি একটা বৃহত্তর ঐক্যের পথে হাটতে। যতটুকো পেরেছি তাও ধরে রাখতে পারি নি।
দল-উপদল থাকলে সমস্যা কোথায় প্রশ্ন করেন অনেকেই। কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করেন ‘ইখতেলাফুল উলামা-ই রাহমাতুন’ আলেমগণের মতানৈক্য রহমত স্বরূপ। কিন্তু সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যখন নির্যাতিত শব্দটির অর্থ হয়ে যাচ্ছে মুসলমান। তখন কি আমাদের অভ্যন্তরিণ ইলমী ও ফিকহি বিতর্কগুলো চাঁপা দিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা উচিত নয়?
প্রতিটি দলের মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক একটা প্রবণতা হলো, তারা নিজেকে ছাড়া কাউকেই হক বলতে রাজি নয়। কাজের ধরণ আর কৌশলের কারণে মানুষের পথ ও পন্থা ভিন্ন হতে পারে এটা আমরা কোনভাবেই মানতে রাজি নই। একদল তাবলীগকে ভ্রান্ত বলে তো আরেক দল পীর-মাশায়েখের মুরীদীকে ভ্রান্ত বলে। কেউ আবার জিহাদের কাজকে ভ্রান্ত বলে তো অন্যজন প্রচলিত ওয়াজ মাহফিলকে বিদাত বলে। একজন হঠাৎ করে বলে ওঠে আকিদায় আমাদের আছে প্রচ- ভ্রান্তি। আমরা নিয়মিত আছি শিরক আর বিদাতের মধ্যে। পরক্ষণেই আরেকজন আবার তাকেই কুফরীর কাছেই নিয়ে যাচ্ছে।
কদিন আগে এক বড় ভাই আমাকে এসে বললেন উপমহাদেশের আলেমগণ সহীহ ইসলাম থেকে বহু দূরে। তাদের সব কাজই বিদাত। তাদের আকীদা নতুন করে সহীহ করতে হবে। অথচ সেই ভাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইউরোপে গিয়েছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু দশ বছরের ব্যাবধানে তিনি এখন আলেমগণের আকীদা সহীহ করার ডিলারি নিতে চাচ্ছেন।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমরা কেউই উম্মাহর অনাগত দুর্দিনের কথা ভাবছি না। সবাই আছি নিজের বলয় গড়া আর নিজের উপলব্ধির প্রচারে। একদল আরবে থেকে প্রচার করে যাচ্ছে এদেশে ইসলামের নামে যা আছে তাতে কেবল বিদাত। কিন্তু সেই ভাইটিই সৌদি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেন না।
উম্মাহর এই দুর্দিনে আমাদের যখন দরকার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাতিলের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার, তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিনিয়ত বাতিল করে দিচ্ছি। প্রতিদিন একজন মুসলমানকে কাফের বা মুশরিক বানানোর সোল এজেন্ট নিয়ে পাইকারি করছি।
সমগ্র পৃথিবীর সব কুফরী শক্তি যখন একযোগে মুসলিম নিধনে নেমেছে। তখন মুসলমানগণও একজন আরেকজনের ঈমান নিধনে নেমেছি। দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর কুৎসিত কসরত করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। আফগান, কাশ্মির, আরাকান, ফিলিস্তিন, উইঘুর প্রভৃতি দেশে যখন চলছে মুসলিম নিধনের কুফরি উল্লাস, ধেয়ে আসছে আমাদের স্বদেশের পানে; তখনও আমরা আমাদের আত্মপ্রচারের মায়াবী ইখতেলাফে আকণ্ঠ ডুবে আছি।
হে আল্লাহ আপনি আমাদের অন্তরে উম্মাহর দরদ ঢেলে দিন। আমরা যেন একটি পরিবার হয়ে দ্বীন ও ঈমানের পথে চলতে পারি। সমগ্র বিশ্বজুড়ে মুসলিম জনতার দুর্দিন শেষ করে একটি ইনসাফের রাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
ডিসক্লেইমার: এই লেখাটি একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। মনের ভেতরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের যন্ত্রণা লাঘবের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। বন্ধুদের কাছে নিবেদন এই বিষয়ে আরো যা তথ্য আছে আপনাদের কাছে; তা নিয়ে আপনারাও লিখুন। আসুন সবাই একটি বৃহত্তের ঐক্যের পথে এগিয়ে যাই।
সাইফ সিরাজ
২৮/০২/২০১৪, দলপা
Source: Natun Dak, March 2014
Leave a Reply