গেলো ৭-ই অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে অতর্কিত এক সামরিক হামলা চালায়। মাত্র ৬ ঘন্টার অভিযানে এক হাজারের বেশি ইসরায়েলি নাগরিক হতাহত হয় এবং দুই শতাধিক লোককে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয় হামাস। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ একটা জনপদে থেকে হামাস কীভাবে এমন হামলা পরিচালনা করতে পারলো সেটা এক বিস্ময়। ইসরায়েল অবশ্য পাল্টা আঘাত শুরু করতে সময় নেয়নি। মিনিটে মিনিটে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকা প্রায় উজাড় করে ফেলেছে। ২০ দিনে ১২ হাজার টনের বেশি বোমা নিক্ষেপ করেছে, হত্যা করেছে ৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে। ওদের বর্বরতার ধরণ মনে করিয়ে দিচ্ছে হাজার বছর আগের ক্রুসেডের সময়কালকে। ওদের বর্বরতার ধরণ মনে করিয়ে দিচ্ছে হাজার বছর আগের ক্রুসেডের সময়কালকে। মসজিদ, চার্চ, হাসপাতাল কিছুই বাদ রাখছে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ, ডাক্তার-সাংবাদিক থেকে মানবাধিকার কর্মী, মুসলিম কিংবা খৃস্টান কাউকেই তারা হিসেবে ধরছে না।
ইসরায়েলের এই হামলা যতোটা না প্রতিশোধের, তারচে ঢের বেশি নিজেদের তৈরী করা গ্লোবাল ইমেজ ধসে পড়ার অপমানে এবং হামাস সদস্যদের নাগাল না পাবার ক্ষোভে। বিশ্বসেরা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা নজরদারি যন্ত্র সবই যেন জাস্ট ভেসে গেলো ‘তুফানুল আকসা’ নামে হামাসের মাত্র ৬ ঘন্টার এক অভিযানে!
হামাসের এই হামলা নানাভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর এটাই ফিলিস্তিনের তরফে সবচে বড় আক্রমণ। গত এক দশকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এমন একটা আক্রমণ অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। হামাস সেটা করতে পেরেছে, যেভাবে করেছে সব ঠিক ছিলো কিনা (ইসরায়েলি যে বয়ান আমরা শুনছি, কারণ হামাস সংখ্যা বলেনি। মাহাথির মুহাম্মাদের মতো অনেকে ইসরায়েলের তথ্য মানতে নারাজ) সেই প্রশ্ন রেখেই অবশ্য এই দাবিটা করতে হবে।
ফিলিস্তিনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিটা কী আসলে?
গত দুই দশকে বিশ্বমোড়ল আমেরিকার একমাত্র বারাক ওবামা প্রশাসন ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুই রাষ্ট্রের ভিত্তিতে সমাধানের পক্ষে তুলনামূলক সরব ছিলো। ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৪ সালে ফিলিস্তিন বড় কয়েকটি আক্রমণের মুখে পড়লেও জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ভালো কিছু সিন্ধান্ত এসেছে বারাক ওবামার দুই আমল মিলিয়েই। কিন্তু ডোনাল্ট ট্রাম্প এসে পুরো চিত্র পাল্টে দিয়েছেন।
ট্রাম্প প্রথমেই ফিলিস্তিন বিষয়ে আন্তর্জাতিক কভারেজ কমিয়েছেন। গত দশ বছরে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা মানবাধিকার তো দূরে, ফিলিস্তিন নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনাই কার্যত নেই। ট্রাম্প আরব রাষ্ট্রগুলোসহ সকল মুসলিম রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ এড়িয়েই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। পূর্ব-পশ্চিম জেরুসালেমের পুরোটাকে ইসরায়েলের একক রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। নিজের এই সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করতে আমেরিকার দূতাবাস তেলআবিব থেকে সরিয়ে এনে জেরুসালেমে স্থাপন করেছেন। ফিলিস্তিনের জন্য আমেরিকার তরফে চলে আসা রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কমিয়েছেন। গাজা স্ট্রিপকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করার ব্যবস্থা এমন জায়গায় নিয়েছেন যে ইসরায়েল বিভিন্ন বন্ধু দেশের ত্রাণ বহরে পর্যন্ত আক্রমণ চালানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে।
এই প্রত্যেকটা সিদ্ধান্তই এমন যে ভবিষ্যতে কখনো আন্তর্জাতিক মহল চাইলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আর কোনো উপায় থাকবে না। বাস্তবায়িত হবে জায়োনিস্ট ইসরায়েলের কয়েক শতাব্দীর স্বপ্ন। ডোনাল্ড ট্রামকে আমেরিকার মানুষ ক্ষমতা থেকে সরালেও জো বাইডেন নামের যে লোককে চেয়ারে নিয়ে এসেছে তিনি আরো কট্টর ইস্রায়েলপন্থী। তিনি ট্রাম্পের অনেক নীতি বদলালেও ইসরায়েল নীতিকে বরং আরো বেগবান করেছেন। (গত ৩ সপ্তাহ ধরে চলা ইসরায়েলি গণহত্যার পক্ষে তার অবস্থান সবচে’ নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ।) নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নেই হামাসকে তাই এমন অলআউট আক্রমণে যেতে হয়েছে। প্রতিদিন একটু একটু করে নীরবে শেষ হয়ে যাবার চেয়ে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের প্রাপ্য দাবিকে আরো একবার তুলে ধরতে চেয়েছে হামাস। এবং তারা সফল।
সাড়া বিশ্ব উদ্বিগ্ন হলেও ইতোমধ্যে ৬ হাজারের বেশি জীবন হারানো ফিলিস্তিনিরা ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলছেন আল্লাহু আকবার- এমন বীরের জীবনই তো আমরা চাই। পরিবারের প্রায় সকল সদস্য হারিয়ে ফিলিস্তিনি বাবারা মিষ্টি বিতরণ করছেন। এই ঈমানের মানুষদের হারায় এমন স্পর্ধা কার?
ফিলিস্তিনজুড়ে বিশেষত গাজা স্ট্রিপে ইসরায়েলের বর্বর নৃশংসতা- জাতিসংঘ কোথায়?
ফিলিস্তিন এখন জ্বলছে। গাজা স্ট্রিপ ধ্বংস প্রায়। খাদ্য, পানীয়, বিদ্যুৎ, ফুয়েল এমনকি মেডিসিনের প্রবেশও বন্ধ করে দিয়ে গাজা স্ট্রিপকে নরকে পরিণত করা হয়েছে। সাথে চলছে নিষ্ঠুর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও বোম্বিং। পশ্চিম তীর ও বায়তুল মুকাদ্দাসও ছাড় পাচ্ছে না। পার্শবর্তী দেশ লেবানন ও সিরিয়াতে দফায় দফায় বোম্বিং করা হচ্ছে যাতে হিজবুল্লাহ বা সিরিয়ান সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতে না পারে। আমেরিকা তাদের বিমানবাহী জাহাজ দিয়ে সমুদ্রপথ ব্লক করেছে। পৃথিবীজুড়ে গণহত্যার আশংকা এবং সে সূত্রে প্রতিবাদ বাড়লেও ইসরায়েল তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সাথে নিয়ে এবার হামাসসহ গোটা গাজা উপত্যকাকেই ধ্বংস করার মরিয়া অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই সময়ে এসে বড় প্রশ্ন হলো- জাতিসংঘ কোথায়? তাদের কাজ আসলে কী আর তারা করছেটা-ই বা কী? অনুমেয় উত্তরই দেয়া লাগবে আসলে।
নিয়মিত কিছু বিবৃতি দেয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি জাতিসংঘ।
২০০১ এ আফগানিস্তান, ২০০৩ এ ইরাক কিংবা ২০১৩ পরবর্তী আরব বসন্তের প্রেক্ষিতে লিবিয়া ও সিয়িয়ায় যেমন জাতিসংঘ আমরা দেখে এসেছি, ফিলিস্তিনেও একই ব্যাপার দেখতে হচ্ছে আমাদের।
রাশিয়া এবং সহযোগী কিছু দেশ মিলে যুদ্ধ বন্ধ বা অন্তত ত্রাণ পাঠাবার যে প্রস্তাব সামনে এনেছিল তাও ভেস্তে গিয়েছে আমেরিকার ভেটোতে। ইসরায়েলের আক্রমণের ঠিক ১৫ দিন পর জাতিসংঘ মহাসচিব আজকে (২১ অক্টোবর) মিশরে গিয়েছেন, ইসরায়েলের বাইরে গাজাবাসীর একমাত্র বহির্গমন পথ রাফা ক্রসিং পয়েন্ট পর্যবেক্ষণে। ত্রাণের প্রথম চালান হিসেবে মাত্র ২০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে যেখানে দরকার শত শত ট্রাক। জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস এই সংখ্যা বাড়ার আশাবাদটুকু শুধু ব্যক্ত করতে পেরেছেন।
ব্যাক্তিগতভাবে বর্তমান জাতিসংঘ মহাসচিব ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন এবং তিনি তার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এটুকু স্বীকার করতে হবে। গত ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস সরাসরি নাম না নিয়ে ইসরায়েলের সমালোচনা করে বলেছেন- “গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের যে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন দেখতে পাচ্ছেন, তা নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। একটি সংঘাতে কোনো পক্ষই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি আরও বলেন- ইসরায়েলের ওপর হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা ‘শূন্য থেকে হয়নি’।ফিলিস্তিনি জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। তারা তাদের ভূখণ্ড বসতিতে পরিণত হতে এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছে। তাদের অর্থনীতি থমকে গেছে। এই মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশাও ধুলোয় মিশে গেছে।”
জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই প্রথম এমন স্পষ্ট একটা বক্তব্য এলো। এই ৩ সপ্তাহে জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিল মোট চারটি সভা আহ্বান করেছে। রাশিয়া ও ব্রাজিলের তরফে ২ দফা ইসরায়েলি হামলা বন্ধের প্রস্তাব তোলা হয়েছে কিন্তু কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি মূলত আমেরিকার বাধায় এবং যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের অনাগ্রহে।
ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সদস্যদের মধ্যে ২৯ জন এই ক’দিনে নিহতও হয়েছেন- এ নিয়েও প্রতিষ্ঠানটি যথেষ্ট সোচ্চার।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানসহ অনেক দেশই গুতেরেসের ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য ও পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল ক্ষিপ্ত হয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবকে পদত্যাগ করতে আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত একটি বৈঠকও বাতিল করেছেন। ইসরায়েল জাতিসঘের প্রতিনিধিদের ভিসাও বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।
তবু প্রশ্ন থেকেই যায়- জাতিসংঘ কি আসলেই কিছু করতে পারবে না? বা ফিলিস্তিন বিষয়ে জাতিসংঘের কী কী করার আছে আসলে?
জাতিসংঘ কি আসলেই কিছু করতে পারবে না? বা ফিলিস্তিন বিষয়ে জাতিসংঘের কী কী করার আছে আসলে? এখানে দুটো বিষয় আলোচনা করতে হবে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের আইনি উপস্থিতি এবং ফিলিস্তিনকে ঘিরে জাতিসংঘের ত্রাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম।
সাত দশকে রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের অর্জন ও স্বীকৃতি
পর্যবেক্ষক সত্তা
১৯৯৮ সালে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক সত্তা (অবজার্ভার এনটিটি) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ফলে দেশটি এখন অভ্যন্তরীণ ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যৌথ কিংবা এককভাবে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। তবে ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার অধিকার রাখে না।
পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র (অবজারভার স্টেট)
জাতিসংঘে একমাত্র অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র আছে ভ্যাটিকান সিটি। ২০০৪ সালের এক প্রস্তাবে এ মর্যাদার ক্ষমতা ব্যাখ্যা করা হয়, যা বর্তমানে ফিলিস্তিন যে মর্যাদা ভোগ করছে তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু ফিলিস্তিনের সঙ্গে ভ্যাটিকানের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে- জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে ভ্যাটিকানের কোনো সভা বা কর্মকা-ের প্রস্তাব বা বিবরণী সরাসরি অন্য সদস্যরাষ্ট্রের কাছে সরকারি নথি হিসেবে পাঠাতে পারে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সুযোগ নেই।
ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি
‘২৯ নভেম্বর ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বীকৃতি মেলে। ১৯৩ সদস্য বিশিষ্ট এই বিশ্ব সংস্থার ১৩৮টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পক্ষে ভোট দেয়। নয়টি রাষ্ট্র বিপক্ষে ভোট দেয় এবং ৪১টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। ফল ঘোষণার পরপরই সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের পেছনে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো হয়। এ সময় তারা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলেন। জাতিসংঘের নন-মেম্বার স্টেট এর মর্যাদা পাবে ফিলিস্তিন। এটা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি পৃথিবীর বৃহত্তম সংস্থা জাতিসংঘের পরোক্ষ স্বীকৃতি। পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গাজা উপত্যকা নিয়ে গঠিত ফিলিস্তিন এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হতে পারবে।’ সূত্র : আল জাজিরা ও এপি।
এই মর্যাদা অনুযায়ী ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র নয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আঞ্চলিক সংস্থা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে। ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সভায় বা বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। তবে কোনো প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে না।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির তাৎপর্য কী?
Palestine-actual-territory প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও জাতিসংঘে শুভবোধের জয় হয়েছে। সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনকে বাধ্যতামূলকভাবে বিভক্ত করার ঠিক ৬৫ বছরের মাথায় (২০১২ সালে) এ ঘটনা ঘটলো। এতোদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিন জাতিসংঘে ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক সত্তা’র মর্যাদা ভোগ করতো, এবার তা ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’-এর মর্যাদায় উন্নীত হলো।
এই স্বীকৃতির আসলে গুরুত্ব আছে। জাতিসংঘে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিশাল গুরুত্ব আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের নামের সঙ্গে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি যুক্ত করেছে। আর এর ফলে সাধারণ পরিষদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার না পেলেও ফিলিস্তিন এখন থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিতে পারবে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টও অন্তর্ভুক্ত। ধরে নেওয়া যায়, এটাই ইসরাইল ও ইসরাইলের বন্ধুদের চিন্তার বিষয়। উল্লেখ্য, একবার আইসিসির সদস্য হয়ে গেলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা যায় কি না তা তদন্তের জন্য সংস্থাটির প্রতি অনুরোধ জানাতে পারবে ফিলিস্তিন।
সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের আরেকটি গুরুত্ব আছে। আরো একবার প্রমাণিত হলো, আজকাল আর বিশ্বের অধিকাংশ দেশ প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদামাফিক যেকোনো ইস্যুতেই ‘জি হুজুর’ নীতি অনুসরণ করছে না। এটি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বরাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী।
অবশ্য এই সবকিছুতেই পানি ঢেলে দিয়েছেন ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেডিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ইসরায়েলের আসল বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প। বারাক ওবামার ৮ বছরের সময়কালে দুই রাষ্ট্রের ভিত্তিতে সমাধানের প্রশ্ন যতোটা এগিয়েছিলো, ট্রাম্প আর তার মেয়ের ইহুদি জামাতা (যিনি আবার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টাও ছিলেন) মিলে সেটা উড়িয়ে দিয়েছেন।
ইসরায়েলের চাওয়াই এখন আমেরিকা-ইউরোপের চাওয়া। ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখন প্রকাশ্যেই সমগ্র ফিলিস্তিন দখলের কথা বলেন। ফিলিস্তিন থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের বিতাড়িত হবার জন্য আরব মুসলিমদের দায়ী করেন। এমনকি হিটলারের হাতে হওয়া কথিত ইহুদি হলোকাস্টের জন্যও দায়ী করেন মুসলিমদের। পুরো ইসরায়েল এখন এক পায়ে খাড়া ফিলিস্তিনিদের মেরে বা তাড়িয়ে দিয়ে পুরো ভূখণ্ডের দখল নিতে। শান্তি আলোচনা এখন সুদূর পরাহত।
ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের নানাবিধ তৎপরতা ও সেবামূলক কার্যক্রম
জাতিসংঘকে ফিলিস্তিন বিষয়ে বরাবরই আন্তরিক মনে হলেও তাদের করার কিছু নেই তেমন। জাতিসংঘের শক্তি বিশ্বের সকল দেশের মিলিত শক্তি। পুরো পশ্চিমা বিশ্ব যেহেতো একতরফাভাবে ইসরায়েলের পক্ষে, জাতিসংঘ বা অন্যদের চাওয়ার গুরুত্ব এখানে এমনিতেই কম। আবার এটাও সত্য যে এখন পর্যন্ত ভালো যা বা যেটুকু হয়েছে তা জাতিসংঘের মাধ্যমেই হয়েছে। বিশেষ করে শরণার্থী হওয়া লাখো ফিলিস্তিনিদের খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে জাতিসংঘের ভূমিকা সত্যি প্রশংসনীয়।
জাতিসংঘের মোট ৬টি বিভাগ ফিলিস্তিনে তাদের বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে।
সেক্রেটারি জেনারেল ও তার টিম: জাতিসংঘ মহাসচিব ব্যক্তিগতভাবে বা তার দূতদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রতিরোধমূলক কূটনীতি, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কাজ করেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সাধারণ পরিষদ: জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত সাধারণ পরিষদ 1947 সাল থেকে ফিলিস্তিনের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রচেষ্টায় জড়িত।
নিরাপত্তা পরিষদ: আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রাথমিক দায়িত্ব রয়েছে। কাউন্সিল মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এবং ফিলিস্তিন প্রশ্নে বহুবার আলোচনা করেছে ও করে।
UNRWA: ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নেয়ার ইস্ট (ইউএনআরডব্লিউএ) মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় কার্যক্রম। জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ার আশ্রয়ে থাকা 5 মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ত্রাণ এবং সামাজিক পরিষেবা প্রদান করে।
মানবাধিকার কাউন্সিল: মানবাধিকার কাউন্সিল তার নিয়মিত ও বিশেষ অধিবেশনে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছে। এটি 1967 সাল থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
UNSCO: ইউনেস্কো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জাতিসংঘের মানবিক কর্মসূচি ও উন্নয়নমূলক কাজের সমন্বয় করে।
শেষের আগে
যে মুহূর্তে আমরা এখন আমাদের প্রাত্যহিক কাজ আঞ্জাম দিচ্ছি এবং দিনশেষে ঘুমুতে যাচ্ছি, সেই প্রতিটি মুহূর্তে ইসরায়েলি বোমায় কেঁপে কেঁপে উঠছে ফিলিস্তিন। কারো না কারো বাড়ি-ঘর ধ্বংস হচ্ছে, কেউ না কেউ প্রিয়জন হারাচ্ছেন। খাবার নেই, সুপেয় পানি নেই, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, জরুরি কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো জ্বালানিও নেই। শুধু মুসলিম ও ফিলিস্তিনি হবার খেসারত দিতে গিয়ে তারা জীবন্ত কবরস্থ হবার পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। কষ্টের ব্যাপার হলো- শুধু আত্মরক্ষার অজুহাতে প্রায় পুরো কুফুরী বিশ্ব এক হয়ে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াতে পারলেও এতগুলো মুসলিম রাষ্ট্র মিলে একটাবার বলতে পারছে না যে, অনেক হয়েছে জাস্ট স্টপ।
ইসরায়েল ও আমেরিকার এবারের প্রস্তুতি ভয়াবহ।৩ সপ্তাহে সাড়ে ছয় হাজার ফিলিস্তিনীর জীবন এবং হাজারো ঘর-বাড়ি, হাসপাতাল-স্কুল ও ইবাদাতগাহ নিশ্চিহ্ন হলেও ইসরায়েলি বর্বরতা থামার বা কমার নাম নেই। জরুরি ত্রাণ বা ওষুধপত্রও এখনো দেয়া হচ্ছে না। ইসরায়েল যখন আধুনিক ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বের সকল নেতা ও মিডিয়া তাদের হয়ে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলো সত্য খবর প্রচার বাধাগ্রস্ত করছে।
পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। আমাদের কাজ হওয়া উচিত যার যার জায়গা থেকে যেটুকু সম্ভব ফিলিস্তিনিদের সহায়তায় দাঁড়ানো। যারা এই বর্বরতা বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারে তাদের উপর চাপ তৈরী করা।
এই সময়ে আমাদের বড় কিছু অর্জনের একটি হলে পৃথিবীর আসল রুপকে নিজেদের দর্পনে দেখতে পারা। ধর্মের প্রশ্নে পৃথিবীর অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে। গাইরত হারানো মুসলিম জাতি এখন সহজে বুঝতে পারবে মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা বা এমন আরো যত স্লোগান শোনা যায় সবই মেকি। আসল প্রশ্ন ইসলাম ও কুফরের। আলো ও অন্ধকারের। পাশ কাটানো বা এড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগ কোথাও নেই। পরিবর্তন আনতে হলে আগে তো নিজেদের সচেতন হতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে বোঝার তাওফিক দিন। ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের জীবন সুন্দর ও সম্মানজনক করুন। আমিন।
Leave a Reply