মুসলিম মাত্রই যেহেতু কম-বেশ সীরাত জানেন, প্রচলিত আয়োজনে দেখি কেমন একটা অবহেলা। জানা সীরাতকেই তাই একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে আনার প্রয়াস। বিস্তৃত নবীজীবনের কয়েক ছোপ লাল শিরোনামে ১-১০ পয়েন্টে নবীজীবনের দশটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।…
আভাস-আগমন
মাথাটা উঁচু করে শরীরের সবটুকু শক্তি তুলে আনলো বুক বরাবর। বিশালদেহী হাতির গায়ে লেগে রইলো শুধু দু’ হাঁটুর চাপা স্পর্শ। একই পজিশনে সাড়িবদ্ধভাবে এগিয়ে চললো ওদ্ধত আবরাহার সুবিশাল হস্তিবাহিনী। লক্ষ্য- দৃশ্যত জীর্ণশীর্ণ একটা ঘর- কাবাকে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়া। মেটানো অপমানের জ্বালা।
দূর থেকে ওদের প্রতিটি দাম্ভিক পদক্ষেপ-পদচালনা নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছে হতাশ কতোগুলো চোখ, কাবা যাদের আত্মার আত্মীয়। অসহায়ত্বের যন্ত্রণা আর ব্যর্থতার ক্ষোভ ওদের নির্বাক করে দিয়েছে। ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে গড়গড় শব্দে। অবশেষে, অগ্রগামী হাতিটা পৌঁছে গেলো যখন কাবার একেবারে সন্নিকটে, হৃদপি-ের অবশিষ্ট স্পন্দনটুকুও গেলো থেমে। উঠে এলো না হৃদয়জ শেষ আকুতিটুকুও। কিন্তু এসে গেলো আসমানি ফয়সালা এবং সে মুহূর্তেই- ‘ওয়া আরসালা আলাইহিম তায়রান আবাবিল’। আর সামান্য সময়ের ব্যবধানে ধ্বংস হলো ওদ্ধত আবরাহার বিশাল হস্তিবাহিনী।
#
ক’দিন হলো আকাশের রূপে পরিবর্তন এসেছে। বিক্ষিপ্ত তারাগুলো জড়ো হয়েছে একটা জায়গায়। ব্যাপারটা হেজাযবাসীর দৃষ্টি এড়ালো না। সাধারণ মানুষের চোখে এটা বড়জোর কৌতূহল আর কিছুটা বিস্ময়ের সীমায় পৌঁছে থেমে গেলেও বিশেষ কিছু হয়ে ধরা দিলো জ্যোতিষীদের চোখে। দীর্ঘ সাধনায় অর্জিত বিদ্যা তাদের জানিয়ে দিলো পরিবর্তন আসছে দুনিয়াতেও। বিরাট একটা কিছু অচিরেই ঘটবে মাটির এই পৃথিবীতে।
#
চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সবার চেহারায়। মাথাগুলো সামান্য ঝোঁকানো। সমাধান পাওয়ার প্রত্যাশা আবার হতাশ হবার আশংকা দুইয়ে মিলে অস্থির হয়ে ওঠা সম্রাট কিসরার চেহারাটা ধীরে ধীরে ঘুরছে চারপাশের লোকগুলোর ওপর। কোনো শহর বা গ্রাম নয়, কারো ঘর বা হুজরা নয় কেবল তার রাজপ্রাসাদটা হঠাৎ দুলে ওঠলো, খসে পড়লো ডজন খানেক ইট- কেনো? ‘সাওয়া’ নদটাই-বা হঠাৎ পানিশূন্য হয়ে পড়লো কীভাবে?… সভাসদদের জরুরি তলব করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন কিসরা।
কিন্তু কেউ কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। সবার মনে তোলপাড় চলছে- এও কি সম্ভব? কীভাবে সম্ভব? ঠিক তখন দরবারের এক কোণে এসে দাঁড়ালো কিসরার খাস নওকর। বাদশাহর মলিন চেহারাটা আরো মলিন, আমলাদের নুয়ে থাকা মাথাটাকে আরো নুইয়ে দিতে সে ঘোষণা করলো- শহরের প্রান্তে আমাদের প্রধান গীর্জার কাছে হাজার বছর ধরে যে অগ্নিটা প্রজ্জ্বলিত হয়ে আসছে, আজ ভোরে হঠাতই সেটা নিভে গেছে।
…এবং এর পরপরই আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো একটি খবর। মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকলো একটাই রব- যার অপেক্ষায় তামাম পৃথিবী, তিনি আগমন করেছেন। আরববিশ্বকে চমকে দিয়ে আব্দুল মুত্তালিব যার নাম রাখলেন- ‘মুহাম্মাদ’। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
বঞ্চনা
বাবাকে দেখা হয়নি। কোলে ফেরার পরপরই মা-ও চলে গেলেন। মা-বাবার মমতা জড়ানো চিরায়ত শান্তির পরশটা আর পাওয়া হলো না। মায়ের আদুরে চুমুর, বাবার মধুভরা ডাকের কী যে মহিমা সেটা অনুভব করা না হলেও তাদের বিচ্ছেদ-বেদনা, একাকিত্বের নিঃসীম যন্ত্রণায় তাকে দগ্ধ হতে হয়নি। সারাটা সময় পাশে থেকে, সবকিছু শেয়ার করে মায়ের ঝাপসা চেহারা কিংবা না দেখা বাবার সম্ভাব্য চিত্র খুঁজে ফেরার মতো অবসর তাকে দেননি আব্দুল মুত্তালিব। তাই বলে কি নিয়তিকে খণ্ডানো যায়? …
হলোও তাই। আটের ঘরে পা রাখার পর চারপাশের পরিবেশটাকে খোলা চোখে দেখার, নিজের ভাবনায় রাঙাবার সময় যখন এলো- আব্দুল মুত্তালিবেরও ইন্তেকাল হয়ে গেলো। ফেলে আসা কষ্টগুলো তার আবারো জেগে ওঠলো, এক সাথে।
এক্সিডেন্টে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা কারো দেহে জ্ঞান ফেরার মতো।
বন্ধন
টুপ করে দু’ ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দু’ চোখ থেকে। বাঁ হাতে মুছে উঠে দাঁড়ালেন মাঝবয়সী তাহিরা। আগাম সুখ-ভাবনার শিহরণ ও লজ্জা, মহা সৌভাগ্যের হাতছানি আবার চির বঞ্চিত হবার শংকা- সব মিলে দেহে সৃষ্টি হয়েছে আশ্চর্য এক কম্পন। থেমে থেমে পা থেকে মাথায় উঠতে থাকলো শীতল একটা প্রবাহ। জানালা দিয়ে কাবা পানে চেয়ে থাকা তাহিরার হৃদয়ের খুব গভীর থেকে উঠে এলো একটামাত্র আবদার- আল্লাহ, তাঁর শানে এই অভাগীকে তুমি কবুল করবে?…
খ্যাতি তার তাহিরা। অর্থ-সম্পদও প্রচুর। সমানে সব প্রস্তাব আসছে বিত্তশালী ও সম্ভ্রান্ত সব পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু নাহ, গ্রহণ তিনি করলেন না। দু’ দু’বার যে বন্ধন থেকে তাকে ছিটকে পড়তে হলো এবং কাছাকাছি সময়ে, ফের সে বন্ধনে জড়াতে তিনি একদম নারাজ। কিন্তু তার এই পাথুরে সিদ্ধান্ত মোম হয়ে গলে গেলো অল্প কিছুদিনের মাথায়।
দুটানায় পড়ে গেলেন অভিমানী খাদিজা। সিদ্ধান্তহীনতার আগুনে দগ্ধ হতে থাকলো তার অবলা হৃদয়। ‘অচিরেই তোমাদের শহরে আসছে আখেরি নবী। যে হতে চাও তার সঙ্গিনী, হয়ে নাও এখনি।’ কুরাইশী নারী আড্ডায় অদৃশ্য লোক থেকে ভেসে আসা এই ঘোষণাই ছিলো তার এই দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতার একমাত্র কারণ।
ঘটনাগুলো একে একে বলে গেলো গোলাম মায়সারাহ। অলৌকিক সব ব্যাপার! পাদ্রীর ভবিষ্যৎবাণী, বিভিন্ন জনের উক্তি, ব্যবসায়ের বরকত, মেঘখন্ডেরর ছায়া দান কোনোটাই বাদ গেলো না। তাহিরাখ্যাত খাদিজার অস্থির মন শান্ত হলো। ধারণা গভীর বিশ্বাসে রূপায়িত হলো। প্রবীণ আলেম ওরাকার সমর্থন সে বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করলো। আর তাই, এক হলো আলোকিত হলো দুটো হৃদয়। একজন খাদিজা অন্যজন আল আমিন। আত্যায়্যিবাতু লিত্যায়্যিবিন!
খোঁজ
দু’ চোখে তার কেবলই বিস্ময়। স্বপ্নে স্বপ্নে রাতটা কেটে যাওয়ার পর বিস্ময়ের চাদরে মোড়ানো চোখের পাতা দুটো যখন মেলেন, তাঁর সামনে খুলে যায় রহস্যের আরেক জগৎ। ঘুমের কোলে শুয়ে সারাটা রাত দেখা ব্যাপারগুলোকে সকালে এক এক করে ঘটতে দেখেন। হুবহু, কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়া। এবং এর পরপরই তিনি বদলে যান। অভ্যেসের চেনা পথটাকে আরো নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেন। বাড়িয়ে দেন গতি।
ভাবনা তার সঙ্গী হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই। সবকিছুতেই তার গভীর দৃষ্টি, সবক্ষেত্রেই তার অবিরাম ভাবনা। একাকিত্বের একঘেয়ে অবসর নয়, শৈশবের সবকিছু চেনার অদম্য কৌতূহল নয়, নিরেট সৌন্দর্য উপভোগ কিংবা নতুন কিছু পাওয়ার উদগ্র বাসনাও নয়; তার ভাবনার প্রেক্ষাপট অন্যরকম। বিষয়ও ভিন্ন। কারো সাথেই যার কোনো মিল নেই। একেবারেই নেই।
চারপাশে কবরের নিস্তব্ধতা। অন্ধকারটা তারচে’ গাঢ়। ভেতরে আলো প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। পোকামাকড়ের বিচ্ছিন্ন শব্দ ছাড়া হঠাৎ কারো আওয়াজ ভেসে আসারও কোনো সম্ভাবনা নেই। লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে, ভূমি থেকে যথেষ্ট ওপরে হেরার সরু গুহাটায় বসে বসে তিনি ভাবেন।
আত্মার সবটুকু আলোক শক্তি মেলে ধরে খুঁজে ফেরেন অদৃশ্য সে সত্তা, যিনি সৃষ্টি করলেন মানবজাতি। সুন্দর করে সাজালেন পৃথিবী।
ক্ষণে ক্ষণে একটামাত্র জিজ্ঞাসা তার গোটা দেহ কাঁপিয়ে দিয়ে যায়- কে তিনি? কোথায় তিনি?…
প্রত্যয়
এদের কালো হৃদয়টা অচেনা নয় আবু তালিবের। বয়স তো আর কম হয়নি। বিছানায় পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুণে যাওয়াই কাজ এখন। এই সমাজে, এই পরিবেশেই তার বসবাস। মায়াবী চোখের আড়ালে এদের পুষ্ট দেহে কী পরিমাণ নোংরামি আর হিংস্রতা লুকিয়ে আছে, তাও তার ভালো করেই জানা। দ্বিতীয় দফায় দিয়ে যাওয়া হুমকিটা তাই পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না তার পক্ষে। শারীরিক দুর্বলতা তাকে অসহায় বানিয়ে ফেলেছে। বিপরীত দিকটাও তাই কিছুতেই ভাবতে পারলেন না। ওদের একেকটা কথা ধারালো পাথর হয়ে তার হৃদয়ের কোশগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে তুললো। বাবার ওসিয়্যত, শেষ আবদারটা ছুঁচালো লোহা হয়ে তার হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে চললো।
যা জানার ইতোমধ্যেই তিনি জেনে ফেলেছেন, কিছুই আর গোপন নেই। তারপরও আবু তালিব ডেকে পাঠানোর খবর যখন পৌঁছলো, ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠলো। ধীর পদক্ষেপে গিয়ে দাঁড়ালেন চাচার একেবারে মাথার কাছটায়। আবু তালিব নির্বিকার শুয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেনও না। গম্ভীর আহত স্বরে কথাগুলো বললেন। ওদের হুমকির কথা। নিজের অক্ষমতার কথা।
ঠাঁই দাঁড়িয়ে তিনি শুনে গেলেন। ভেতরে দুর্দমনীয় ঝড়। চোখ ফেটে বেরুতে চাইছে কষ্টের জলধারা। বুকের বাঁ পাশটায় যেনো আগুন লেগেছে। কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। একই ভঙ্গিতে। কিছু বললেন না। নীরবে চলেও এলেন না। বরং কী একটা যেনো তার ভেতরটাকে হঠাৎ কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। বিদ্যুৎ চমকের মতো। এবং ভেতরের সব তছনছ করা ঝড়, অসহ্য যন্ত্রণা, সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে তার অনিচ্ছাতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটা বাক্য। অগ্নিঝড়া প্রত্যয়।
‘না চাচাজী, না। সত্য দ্বীনের দাওয়াত আমি ছেড়ে দিতে পারি না। আমার এক হাতে সূর্য, অন্যটায় চাঁদও যদি ওরা এনে দেয়, তবুও না। কিছুতেই না।
রক্তক্ষরণ
এক আহ্বান
প্রশ্নটার জবাব তিনি পেয়েছেন। দীর্ঘ চল্লিশটি বছর কঠোর সাধনা করে, অবিশ্বাস্য সব ত্যাগ স্বীকার করে যে মুহূর্তটির জন্য তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুললেন, হেরাগুহায় সে মুহূর্তটি তার জীবনে এসেছে। এবং এর পরপরই তিনি সত্যের মশাল হাতে তাকালেন আঁধার দুনিয়ার দিকে। হেদায়াতের বার্তা নিয়ে ছুটে গেলেন পথভোলা জাতির কাছে। ঘরে-বাইরে, মাঠে-ময়দানে- সবখানে শুরু হলো, চলতে থাকলো তার তাবলিগ।
কিন্তু ওরা নেতৃত্ব হারাতে প্রস্তুত ছিলো না। খেয়ালী জীবন ছেড়ে আসতে রাজি হলো না। বরং শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। দাওয়াতে বাধা দিলো।
তাকে মিথ্যুক বললো। পাগল বললো। পথে কাঁটা বিছালো। ঘরে ময়লা ছুঁড়লো। গায়ে কাঁদা ফিকে দিলো। মুখে থুথু ছিটালো। মাথায় উটের পঁচা ভূড়ি চাপিয়ে দিলো। পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে গোটা দেহ রক্তাক্ত করলো। গলায় ফাঁস আটকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। তার চোখের সামনে নওমুসলিমদের নির্যাতন করলো। নির্মমভাবে খুন করলো। করতেই থাকলো।
আর তিনি?…
সারাটা রাত পড়ে পড়ে আল্লাহর দরবারে কাঁদলেন। আর দিনের বেলায়- ‘শিরক করো না, বলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- এই এক আহ্বান নিয়ে ব্যাকুল, ব্যথাতুর হৃদয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলেন মানুষের দ্বারে দ্বারে।
শোয়াবে আবি তালিব
শিশুগুলো অনবরত চিৎকার করে। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে, বাবার গলা জড়িয়ে করুণ সুরে কাঁদে। একটুকরো রুটির জন্য। একটু ছাতুর জন্য। এবং এভাবে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ওরা ঘুমিয়ে যায়। বেশিক্ষণ ঘুমুতেও পারে না। ক্ষুধায় তড়পাতে থাকে। একসময় কাঁদার শক্তিটুকুও যায় শেষ হয়ে। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে পলকহীন চেয়ে থাকে মা-বাবার দিকে। তবুও কিছুই জোটে না তাদের ভাগ্যে। একটু সান্তনাও না।
সাথে আনা খাবারগুলো শেষ হয়ে গেছে বেশ ক’দিন হলো। এতোটুকু খাবার নেই কারো কাছে। হঠাৎ চলে আসারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তিন দিক পাহাড়ে ঘেরা, অন্যদিকে আবু জাহেলের কঠোর পাহাড়া। ছোট্ট এ স্থানটার এখানে-ওখানে, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে একটু কিছু পাওয়ার আশায় ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর মানুষগুলো ছোটোছুটি করে। শিশুগুলোর মুখেও যদি কিছু একটা তুলে দেয়া যায়।
কিন্তু না, কোথাও কিছু পাওয়া যায় না। বুক ফেটে কান্না আসে। কাঁদাও যায় না। শরীর কাঁপে থরথর করে।হৃদপি-টায় থেকে থেকে চিরচিরিয়ে ব্যথা ওঠে।কয়েক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা বেধে দেয়া হয়েছে যেনো ওটার পাশে।মাথাটা লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে অসহ্য যন্ত্রণায়। কিন্তু উদরটাকে শীতল করার মতো খাবার, মনকে প্রবোধ দেয়ার মতো কথা, কলজের টুকরো সন্তানকে সান্তনা দেবার মতো ভাষা তারা খুঁজে পায় না।
শোয়াবে আবি তালিব খ্যাত ছোট্ট উপত্যকায় আত্মীয়-স্বজন ও নওমুসলিমদের নিয়ে তাঁকে তিন তিনটি বছর কাটাতে হলো অন্তহীন মনোকষ্ট ও ক্ষুধার নির্মম যাতনা সয়ে। ভাবনা যেখানে থমকে দাঁড়ায়। বিবেক যেখানে অকেজো হয়ে যায়। একটু রক্তক্ষরণও কি হয় না?…
আত্মদান
ছোট্ট একটা ভুল হয়ে গেলো। বিজয় নিশ্চিত ভেবে পেছন দিকের পাহাড়ে নিয়োজিত সেনারা ময়দানে নেমে এলেন। অন্য অনেকের মতো মালে গনিমত কুড়ানোয় লেগে গেলেন। কিন্তু উহুদ প্রান্তের ছোট্ট এ ভুলটার পরিণতি দাঁড়ালো বড় ভয়াবহ। জয়ের আনন্দটা মুহূর্তেই মানুষের আর্তচিৎকার আর ঘোড়ার হ্রেসাধ্বনির নিচে দাফন হলো। বিজয়ী বীরদের পরশধন্য ভূমি রক্তে প্লাবিত হলো। শান্ত-স্থির পরিবেশটা হয়ে দাঁড়ালো বিভীষিকাময়। গোটা প্রান্তরজুড়ে অনেক্ষণ ধরে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চললো। একসময় শত্রুরা নবীজীর অবস্থান জেনে গেলো। রক্তনেশায় পাগল হয়ে উঠা মুশরিকরা চারদিক থেকে হায়েনার মতো তাঁর ওপর হামলে পড়লো।
সাহাবারাও ছুটে এসে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। একক বা সম্মিলিত প্রতিটি আক্রমণকে প্রতিবারই রুখে দিলেন। কুরবান করে দিলেন নিজেদের জীবন। ওরা পাথর ছুড়লো। তীর নিক্ষেপ করলো। তরবারি ও বল্লম হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকলো। নবীজীর চারপাশে সাহাবারা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সব পাথর এসে লাগলো তাদের গায়ে। সব তীর এসে বিঁধলো তাদের চোখে-মুখে। তরবারি-বল্লমের উপর্যুপরি আঘাতে ঝাঝরা হতে থাকলো তাদের শরীর।
সাধ্যের সবটুকু দিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন, জীবন কুরবান করে রক্ষা করে গেলেন প্রাণের মানুষ নবীজীকে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
ছোঁয়া
উহুদের যুদ্ধ শেষ হলো। কবরের স্তব্ধতা নেমে এলো মুসলিম শিবিরে। কয়েক মুহূর্তের ঘটে যাওয়া তাণ্ডব তাদেরকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। নবীজী এক এক করে সবার খোঁজ নেয়া শুরু করলেন। এসময় তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন হযরত কাতাদাহ রা.। সারা দেহ রক্তে রঞ্জিত। থেমে থেমে চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফেঁটা ফোঁটা রক্ত। ডান হাতটা নবীজীর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। তাতে একটা চোখ। বললেন- শেষ তীরটা এসে সোজা চোখে লাগায় পাতা-রগ ছিঁড়ে চোখটা কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে।
কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন মানবতার মুক্তিদূত। দু’চোখে তাঁর অশ্রুর বান। একটু পর তাঁর কাঁপা কাঁপা ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো- আল্লাহ, তোমার হাবিবের চেহারা হেফাজতের জন্য এই সাহাবী যেমন নিজের চোখ কুরবান করে দিলো, তুমিও তার চেহারাটা ঠিক সেভাবেই হেফাজত করো। এরপর চোখটা হাতে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত কোটরে বসিয়ে দিলেন।
উপস্থিত সাহাবারা অবাক-বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন- কাতাদাহর চোখ সাথে সাথে সুস্থ হয়ে আগের চেয়েও বহুগুণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
শিরোনামহীন
হুজরার পর্দাটা সরিয়ে তিনি মসজিদে তাকালেন। আবু বকরের ইমামতিতে সাহাবারা তখন ফজর পড়ছেন। তাঁর চেহারা মুবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সারাটা জীবন ধরে এমন একটি কাফেলাই তো তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন। পর্দাটা ছেড়ে দিয়ে এরপর ভেতরে চলে এলেন। নামাজ শেষে আবু বকর হুজরায় ঢুকলেন। নবীজীর শারীরিক হালত অন্য দিনের চেয়ে ভালো ছিলো। তাঁকে প্রফুল্ল দেখাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ অবস্থান করে তিনি বেরিয়ে এলেন। খবর কিছুটা ভালো শুনে সাহাবারাও নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন।
সূর্য ততক্ষণে মাথার উপরে। তাঁর অসুস্থতা হঠাৎ বেড়ে গেলো। মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হলো। হযরত আয়েশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলেন। মেসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজলেন।
পাশেই পানির পেয়ালা রাখা ছিলো, একটু পরপর ভেজা হাতে চেহারা মুছে দিতে দিতে বলতে থাকলেন- আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। নিশ্চয় মৃত্যু বড় যন্ত্রণাদায়ক। এসময় একবার উপরের দিকে তাকালেন এবং দু’ হাত উঁচু করে বললেন- হে আল্লাহ, নবী-রাসূলদের জন্য তুমি যে স্থান প্রস্তুত রেখেছো, আমি সেখানেই যেতে চাই।
কথাটা বলা শেষ হলো, মুদে এলো তাঁর চোখ। চিরদিনের জন্য। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আমাদেরকে নবুয়ত ও রেসালাতের বরকত থেকে, সরাসরি ফয়েজে রব্বানি লাভের সুযোগ থেকে চির বঞ্চিত করে দেওয়া হৃদয় বিদারক এই ঘটনাটি ঘটলো বারই রবিউল আউয়াল, ৬৩৩ হিজরি।
২০০৮। শরহে বেকায়া। প্রথম সম্পাদনা- নয়াজাহান।
Leave a Reply