রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদ
প্রতিটি মৃত্যুই কষ্টের। সেই মৃত্যুকে যদি অস্বাভাবিক বা নৃশংস শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয়, কষ্টের মাত্রাটা এমনিতেই বেড়ে যায়। কতোটা বাড়ে?…সেটা পরিমাপ করার ক্ষমতা মানুষ আমাদের নেই।
কিন্তু মৃত্যুর মতো বেদনাময় এবং আপাতনিরীহ এই ব্যাপারটার সাথেই আপনি যখন আঞ্চলিক রাজনীতি, ধর্মের লেবাস কিংবা গোষ্ঠীগত কৌলিন্যের বয়ান জুড়ে দিতে চাইবেন, কষ্ট ছাপিয়ে মনে তখন নানারকম প্রশ্ন জাগবে।
প্যারিসের ঘটনা এবং পরবর্তী তৎপরতা আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহের মিডিয়া কভারেজ হিসেব করেই বলা হচ্ছে- ৯/১১ ’র টুইন টাওয়ার হামলার পর প্যারিস হামলার ঘটনাই বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। কেউ কেউ তো বলছেন- প্যারিস হামলাই ফ্রান্সের ৯/১১! এই আলোচনা আর সব বিষয় ছাড়াও বৈরুতের ৪৪ জন, নাইজেরিয়ার ৪৩ জন, মালীর ৩০ জন এবং প্রতিদিন নির্মম পরিণতির অসহায় শিকার হতে থাকা ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর খবর প্রায় মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে।
কাঠগড়ায় ইসলাম
সপ্তাহ পেরিয়েও বিশ্ব মিডিয়ার এমন দাপুটে কভারেজ ধরে বা ধরিয়ে রাখার বিষয়টিই বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। জীবন তো জীবনই, সব মানুষই সমান। সব মৃত্যুতে তাই একইরকম প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। প্যারিসের জন্য আপনার মন ব্যথিত হলে মালী-নাইজেরিয়ার জন্য কেনো নয়? ইউরোপবাসীর মৃত্যুতে আপনার চোখে পানি এলে বৈরুত-ফিলিস্তিনের জন্য কেনো নয়? সিরিয়া, ইরাক, আফগান বা মিয়ানমারের কথা আর নাইবা ওঠালাম। প্যারিসের জন্য তো আমরাও কেঁদেছি। কিন্তু চোখের পানি শুকাবার আগেই দায়টা যখন আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো, ক’জন ব্যক্তির দায়ে খোদ ইসলামকেই যখন কাঠগড়ায় ওঠাবার পাঁয়তারা শুরু হলো- কষ্ট ছাপিয়ে আমাদের মনেও তখন প্রশ্ন জাগলো।
কেনো এই হামলা? কারা এই হামলা করলো? কঠোর নজরদারির আওতায় থাকা প্যারিসের ছ’টি নিরাপদতম স্থানে একই সময়ে এমন হামলা চালানো কীভাবে সম্ভব? শার্লি এবদোয় হামলার বছর না ঘুরতেই আবারও কেনো ফ্রান্সই আক্রান্ত হলো? এই হামলার পর সিরিয়ার নিরীহ শরণার্থী শিবির কেনো আক্রান্ত হলো? শোক আর সন্ত্রাসবাদের প্রশ্ন এড়িয়ে হঠাৎ কেনো শরণার্থী গ্রহণের প্রশ্নে অস্বীকৃতি এলো? ইসলাম পশ্চিমের জন্য হুমকি- প্রায় মরে যাওয়া এই প্রশ্ন আবার কেনো সামনে নিয়ে আসার অপচেষ্টা শুরু হয়ে গেলো?…
হ্যাঁ, আপনার ভাবনার সাথে এই প্রশ্নগুলোও যুক্ত করুন, হিসেব মিলতে শুরু করবে।
যুদ্ধই পৃথিবীর অনিবার্য বাস্তবতা
আইএস বা জঙ্গিগোষ্ঠীর শক্তি-সামর্থ্য, নিরপরাধ মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ কিংবা আল্লাহর সঠিক বিচারের ব্যাখ্যা দূর কি বাত, এক্ষেত্রে বরং সব সত্যের উপরের সত্য হলো- মোসাদ বা পশ্চিমের বিশেষ কোনো দেশ-সংস্থার অজ্ঞাতে কিংবা অসহযোগিতায় ইউরোপ-আমেরিকায় এমনতর হামলা চালানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেই। শান্তি আর স্থিতিশীলতা নিয়ে যতো বাণীই আমরা ছড়াই না কেনো, আজকের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধই পৃথিবীর অনিবার্য বাস্তবতা।
বড় শক্তিগুলো নিজেদের প্রয়োজনে কোথাও নিজেরা আর কোথাও স্থানীয় চাটুকার দিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখে। রাখবেই, নইলে তাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। সিরিয়া, ইরাক, আফগানে নিজেদের প্রয়োজনে ওরা যেভাবে নৃশংসতা চালায়, এই ক্ষোভ কাজে লাগিয়েই আইএস বা আলকায়েদার কোনো নিবেদিত প্রাণ কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়ে আবার নতুন হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। প্যারিসের হামলার বেলায়ও এ আশংকাকে আপনি ছুড়ে ফেলতে পারবেন না।
আশি-নব্বইয়ের তথাকথিত ‘কোল্ড ওয়ার’ বা শীতল যুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে গত দুই দশক ধরে এ-ই তো চলে আসছে।
দায় কেনো ইসলাম বা মুসলিম উম্মাহর ওপর
এখানে আইএস বা ইসলামের নামে অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপের কাজকে সমর্থন বা তাদের নির্দোষ প্রমাণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় এমন ভয়াবহ হামলা চালাবার মতো শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে ওদের মেনে নিতেও আমরা রাজি নই। যদি তা সত্যও হয়- এর দায় কেনো ইসলাম বা মুসলিম উম্মাহর ওপর আসবে? দিনশেষে কার-কেমন লাভ- এসব হামলা বিচারের প্রধানতম প্রতিপাদ্য এটিই।
আরব বসন্ত থেকে নিয়ে বর্তমান সিরিয়া পর্যন্ত যা হয়েছে তাতে যে পশ্চিমাদেরই বড় হাত ছিলো, সচেতন মানুষমাত্রই জানতেন।
রাশিয়া এই ক’দিন আগে সিরিয়ায় হামলা শুরু করলে বিষয়টি প্রথমবারের মতো ব্যাপক আলোচনায় আসে। ক্ষমতায় আরোহণের প্রায় এক দশক পর এই প্রথম জাতিসংঘের সাধারণ সভায় উপস্থিত হয়ে ভ্লাদিমির পুতিন ‘সব ফাঁস’ করার হুমকি দিলে আমজনতার মনেও সেটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এরপর দু’ সপ্তাহ পশ্চিমের মুখে কোনো ‘রাও’ ছিলো না।
পাল্টা আক্রমণ
আশংকাময় অপেক্ষাটা তখন থেকেই ছিলো- প্রতি বা পাল্টা আক্রমণ ঠিক কোন দিক থেকে আসে। কীভাবে আসে। দ্রুতই পাল্টা আক্রমণটা এলো, ভয়াবহভাবেই এলো। মুখ লুকোতে প্রথমদিকে রাশিয়ার সুরে তাল মেলালেও নিজেদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্যারিস হামলার ঘটনা পশ্চিমের জন্য মহা সুযোগ নিয়ে হাজির হলো।
মহাসমারোহে এখন আবার সিরিয়ায় হামলা চালানো যাবে। ফ্রান্স ইতোমধ্যে শুরুও করে দিয়েছে। আইএস ধ্বংসে তড়িঘড়ি করে জাতিসংঘে বিশেষ প্রস্তাব পাস করানো হলো। শরণার্থীদের যে ¯্রােত পশ্চিমমুখী হয়েছিলো সেটা বন্ধ করারও অপচেষ্টা চলছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই নতুন তো নয়ই, আগের ভাগ হওয়া কোটা পরিমাণ শরণার্থী গ্রহণেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও আইএস এবং অভিবাসন বিরোধী বিশেষ বিল পাস হয়েছে। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার নামে পুরো ইউরোপে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ফ্রান্সে চলছে নজিরবিহীন বিশেষ অভিযান।
সন্দেহ নেই- শার্লি এবদোর ধকল কাটিয়ে না উঠতেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য আরো ভয়াবহ অনিরাপদ জীবনযাত্রার মুখোমুখি করে দেয়া হলো পশ্চিমের লাখো মুসলিমকে। বঞ্চনার অভিযোগ এড়িয়ে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীকে এভাবে কোণঠাসা করে রাখার চেয়ে বড় সুখবর পশ্চিমাদের জন্য আর কী হতে পারে? একবার ভাবুন তো- দিনশেষে কার লাভের পাল্লাটা ভারি হতে যাচ্ছে?
পুতিন এবং নতুন রাশিয়া
ভ্লাদিমির পুতিন। রাষ্ট্রের প্রশ্ন ছাপিয়েও এই মুহূর্তে তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সাবেক এই কেজিবি অফিসারকে ঘিরে রহস্যের শেষ নেই। মানুষ হিসেবে তিনি পর্দার অন্তরালের বা নীরব প্রকৃতির হলেও দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চের সেরা আসনটি ফিরিয়ে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রথম টার্মে ভেতরে ভেতরে কাজ চালালেও দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ধারা পরিবর্তন করেন। সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই নতুন রাশিয়া এখন প্রকাশ্য ভূমিকা পালন করছে।
বিগত ক’বছরে আমেরিকা-ইউরোপের সম্মিলিত পশ্চিমা জোটের একচেটিয়া নাক গলানোকে রাশিয়া কেবল প্রশ্নবিদ্ধই করেনি, প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার বিবেচনা এমনকি পরামর্শ ছাড়া পশ্চিমা বিশ্ব আজকাল কোথাও নতুন করে পা ফেলছে না বা সাহস করছে না, যার সর্বশেষ নজির আইএস এবং সিরিয়া।
বছর দুয়েক আগে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে এবং নিরাপত্তা বাড়ানোর অজুহাতে সীমান্তে সেনা সমাবেশের ব্যবস্থা করে পুতিনের উদ্ধত রাশিয়াকে পশ্চিমা জোট যখন প্রায় ঘিরে ধরতে চাইলো, পুতিন অদৃশ্য সে বৃত্তকে শুধু ভাঙলেনই না- রাশিয়ার সীমান্ত লাগোয়া ইউক্রেনের পূর্বাংশ ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার মানচিত্রে ঢুকিয়ে নিয়ে রুশ ভল্লুকের হুমকি ছুড়লেন।
এরপর অবরোধ, বয়কটসহ আরো বহু কাহিনী সামনে এনে পশ্চিম বরাবরই চেষ্টা চালিয়ে গেছে পুতিনের নতুন রাশিয়ার রাশ টেনে ধরতে। মিডিয়ার গলায় ঝুলে রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখায় নিজেদের সফল প্রমাণের লাগাতার প্রচেষ্টা পশ্চিম চালিয়ে গেলেও, গত সেপ্টেম্বরে পুতিন চূড়ান্ত আঘাতটা হানলেন।
মিত্র হিসেবে ইরান এবং বাশার আল আসাদের আহ্বানে সিরিয়ায় আইএস বিরোধী হামলা শুরুর পাশাপাশি সিরিয়ার আকাশকেও নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করলেন। ইউক্রেনের পর দ্বিতীয়বার সিরিয়ায় নাক কাটা পড়লো পশ্চিমের। এই একটা পদক্ষেপে পশ্চিমা গোষ্ঠীর সব জারিজুরি বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তাবৎ পশ্চিম মিলে সবরকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই ক’বছরে যে রাশিয়ার কিছুই করতে পারে নি, এটা প্রমাণে এরচে’ বড় সুযোগ সে মুহূর্তে আর হতে পারতো না।
বিশ্ববাসীর সামনে ঝুলে থাকা কোণঠাসা হালতের মিথ্যে পর্দা সরানো, পশ্চিমা শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের সামর্থ্য প্রমাণ, পরমাণু চুক্তির অস্বস্তিকর হালত থেকে সদ্যমুক্ত ইরানকে গুরুত্ব দিয়ে পুরনো জোটের রূপরেখা পরিবেশন এবং আইএস দিয়ে আরব বিশ্বে পশ্চিমের একক খেলা বন্ধের মতো বহু লক্ষ্য এই একটা তীর দিয়েই তিনি ভেদ করলেন।
ফলে আমেরিকা-ইউরোপ-তুর্কি এবং সৌদি জোটের মধ্যপ্রাচ্য ভাগাভাগির ধারাতেই কেবল ছেদ পড়েনি, রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া এবং চীনের মৈত্রি জোটের সাথে চলমান প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধটাও সরাসরি হয়ে ওঠেছে। বিশ্ববাসীর বিশেষত মুসলিম উম্মাহর এখন শত্রু-মিত্র যাচাই করতেও সুবিধে হবে।
রাষ্ট্র সৌদি-তুরস্ক বা ইরান-সিরিয়ার চেয়ে সামগ্রিক মুসলিম উম্মাহর স্বার্থটাই বেশি গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার
সময়টাই এখন এমন যে সব হিসেব মিলিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। ভালো-মন্দের সাথে মন্দের ভালোটাও গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে ভাবনায় রাখতে হয়। এখানে রাষ্ট্র সৌদি-তুরস্ক বা ইরান-সিরিয়ার চেয়ে সামগ্রিক মুসলিম উম্মাহর স্বার্থটাই বেশি গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যে কোনো হিসেবে যেতে হলে দখলদার ইসরাইল এবং বায়তুল মুকাদ্দাস ও মজলুম ফিলিস্তিনিদের কথাও আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার।
চোখ বন্ধ করে কোনো একপক্ষকে মেনে নেওয়ার সুযোগ যেমন নেই, গোয়ার্তুমি করে উপযুক্ত মিত্র হারাবার ঝুঁকিও নেওয়া যাবে না।
রাশিয়ার হামলা এবং অন্যান্য বাস্তবতা
সিরিয়ায় রাশিয়ার এ হামলা এবং অন্যান্য বাস্তবতা নিয়ে সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফের এই বিশ্লেষণটি দেখা যেতে পারে।
‘সিরিয়ায় রাশিয়ার উদ্দেশ্য কেবল বাশার আল-আসাদকে বাঁচানো না। আইএসকে দিয়ে বৈরী সরকার ও স্বাধীন সীমান্ত ধ্বংস করে পশ্চিমারা যে নতুন মধ্যপ্রাচ্য বানাতে চায়, তাতে রাশিয়া, চীন ও ইরানের ঘোরতর বিপদ। বিশ্বের তেলভান্ডার পশ্চিমা তেলকুবের কোম্পানিদের হাতে চলে গেলে রুশ অর্থনীতি ও চীনের উত্থান থামানো যেতে পারে।
একদিকে ন্যাটো দিয়ে ঘেরাও হওয়া অবস্থা, অন্যদিকে রুশবিরোধী নতুন মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়াকে থমকে দেবে। তাই ইউক্রেনের পর দ্বিতীয়বারের পশ্চিমাদের নাক কাটতেই হলো তাদের।
তুরস্ক চায় রাষ্ট্রহীন উত্তর সিরিয়াকে নয়া তুর্কি সালতানাতের অংশ করতে। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে ভেবে লাখো সিরীয় উদ্বাস্তু আশ্রয় দিয়ে রেখেছে তারা। পাশাপাশি দক্ষিণ তুরস্কে মার্কিন ঘাঁটি আরও বড় হয়েছে, ন্যাটোর মদদ তো আছেই।
এমন সময়ে এরদোগানের বাড়া ভাতে ছাই দিলো রুশ বোমারু বিমান। পরপর তিনবার তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বুঝিয়ে দিলো, সিরিয়ার দিকে নজর দিলে খবর আছে। যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে তুরস্ককে।
সিরিয়ার ওপর মার্কিন-তুর্কি নেতৃত্বে নো ফ্লাই জোন করার চিন্তাও বরবাদ। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে তুরস্কের কুর্দি ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সিরীয় শাখা। ইতিমধ্যে তারা সিরিয়ার ভেতরে মুক্তাঞ্চল গড়ে নিয়েছে। তুরস্কে অভিযান হলে এখন তারা সিরিয়া থেকে লড়তে পারবে।
মুখ পুড়ল ইসরায়েলেরও। সিরিয়ার পূর্ণ পতনের পরে লেবাননের প্রতিরোধ গুঁড়ানোর ইচ্ছা ছিলো তাদের। আইএস নামক ফেউকে সামনে রেখে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে চাইছিলো তারা। আর সৌদিরা তো ইয়েমেনকে তছনছ করে ইরানের ডানা ছাঁটছিলোই।
মোদ্দাকথা, মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করার পরিস্থিতি তৈরিই ছিলো ইসলামিক স্টেট বা আইএস লেলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য। আসল যুদ্ধে নামার আগে পুতিনকে তাই যুক্তির যুদ্ধেও নামতে হলো। বিশ্বদরবারে তিনি বললেন,
‘প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রায়ই আইসিসের হুমকির কথা বলেন। ভালো, কিন্তু কে তাদের সশস্ত্র করলো? কে এই বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো? কে ওই এলাকায় অস্ত্র জোগালো? সিরিয়ায় কারা যুদ্ধ করছে, তা আপনারা সত্যিই জানেন না? তাদের বেশির ভাগই ভাড়াটে যোদ্ধা। টাকার বিনিময়ে তারা লড়ে। যে বেশি দেবে, তারা তাদের হয়েই কাজ করবে। আমরা জানি- কত টাকা তাদের দেওয়া হয়েছে…
যুক্তরাষ্ট্র বলে, ‘সিরিয়ার গণতান্ত্রিক সভ্য বিরোধী পক্ষকে আমাদের সাহায্য করা উচিত।’ আর তারা সাহায্য করলো, অস্ত্র দিলো এবং যোগ দিল আইসিসে। এর থেকে এক ধাপ এগিয়ে ভাবা কি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব?
আমরা এ ধরনের কার্যকলাপ সমর্থন করি না। আমরা মনে করি, এগুলো ভুল।’
ইতিহাস এ মুহূর্তে পুতিনের পক্ষে।
একদিকে মার্কিন-ইসরায়েলি-সৌদি-তুর্কি জোট, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন-ইরান-সিরিয়া-হিজবুল্লাাহ জোট। ইরান ও হিজবুল্লাহর যোদ্ধারাও যোগ দিয়েছে আসাদের সেনাদের সঙ্গে। আসাদ বটেই দুঃশাসক, কিন্তু আসাদহীন সিরিয়ার অবস্থা হবে লিবিয়ার মতো, সেটা কারও চাওয়া হতে পারে?
গাদ্দাফি হুঁশিয়ারি করেছিলেন- তাঁকে হত্যা করা হলে লিবিয়া দোজখ হবে। হয়েছেও তাই।
‘সভ্যতার যুদ্ধ’ বনাম ‘গণতন্ত্রের যুদ্ধ’
ক্লিনটন ও বুশ মধ্যপ্রাচ্যে ‘সভ্যতার যুদ্ধ’ আর পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলে ‘গণতন্ত্রের যুদ্ধ’ উসকে দিয়েছিলেন। ফলাফল যুদ্ধ ও জাতিগত গণহত্যায় লাখো প্রাণের অপচয়। এই দায় পশ্চিমারা এড়াতে পারে না। ইউক্রেনে এলিট বিপ্লব ঘটিয়ে রাশিয়াকে অপদস্থ করতে গেলে পুতিন রুশ ভালুকের থাবা চালালেন। ইউক্রেন থেকে কেটে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গীভূত করলেন। সিরিয়ায়ও তারা দেখালো, তারা যা করে- ভেবেচিন্তে করে।
নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে দেখে সাবেক মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জবিগনিউ ব্রেজেনিস্কি সামাল সামাল আওয়াজ তুলছেন। বৈশ্বিক মার্কিন আধিপত্য কায়েমে ইসলামি মৌলবাদীদের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের বুদ্ধিটা তাঁরই। এ জন্য তাঁকে বলা হয় জঙ্গিবাদের গডফাদার।
পলিটিকো ম্যাগাজিনে তিনি লিখেছেন যে সিরিয়ায় মার্কিন ‘অ্যাসেটে’ রুশ হামলা চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র যেনো রাশিয়াকে প্রতিশোধের হুমকি দেয়। গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা পরিভাষায় ‘অ্যাসেট’ বলা হয় অন্য দেশে সক্রিয় এজেন্টদের। এ এক দারুণ লুকোচুরি খেলা।’…
সৌদি-তুরস্ক বা ইরান সম্পৃক্ত থাকলেও নাটের গুরু নয়
এই লেখকের রাশিয়াপ্রীতি সুবিদিত, সে প্রসঙ্গ এড়িয়েও বেশ কিছু সত্য উদ্ধৃত অংশ থেকে আমরা পেতে পারি। সৌদি-তুরস্ক বা ইরান এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকলেও কেউ যে তারা নাটের গুরু নয় সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। শংকার ব্যাপারও সেটাই।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নাম ব্যবহার করে, ক্ষেত্রবিশেষ সহযোগিতা নিয়ে আরেকটা মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংস করা হচ্ছে, ভালো ফল কী করে আশা করা যেতে পারে।
এই ষড়যন্ত্র ঠেকাতে না পারলেও অন্তত এড়ানোর সাহস ও সক্ষমতা অর্জন না করলে আজকের মধ্যপ্রাচ্য যে আরেকটা কামালীয় তুরস্কের পথে এগুবে না- সেরকম নিশ্চয়তা কে দিতে পারে?
প্যারিস হামলায় ইউরোপ-আমেরিকার লাভ-ক্ষতি
সময় বদলেছে। কিছুই আর আগের মতো নেই। সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে জটিল রাজনীতিও জটিলতর হয়েছে। রাজনীতির খেলায় আগে প্রতিপক্ষ মরতো, এখন স্বপক্ষের লোকেরাও মরে। সবকিছুতেই এখন সবার কেবল জয় দরকার। কে মরলো, কতোজন মরলো সে হিসেবের কারো সময় নেই।
দেশের সীমানায় সে জয়ের নাম ক্ষমতা হলে, আন্তর্জাতিক পরিম-লে অবশ্যই তা আধিপত্য। সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলার প্রেক্ষাপটে পশ্চিমের সব পরিকল্পনা যখন মাঠে মারা যেতে বসলো, এতোদিনের সাজানো মঞ্চ, মিথ্যে অভিনয়, মানবতা-গণতন্ত্রের মায়াবি বয়ান সব যখন নিজের জনগণের কাছেই মার খেতে শুরু করলো, প্যারিস হামলা পশ্চিমের জন্য যেনো মহা আশির্বাদ হয়ে এলো।
মাঝের এক-দেড় মাসের স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে মহা সমারোহে পশ্চিম আবার সিরিয়া নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে। পুতিনের অভিযোগ, আইএস ঘিরে সৃষ্টি হওয়া কোণঠাসা পরিস্থিতি মোটামুটি মাটিচাপা দেয়া গেছে। অতিরিক্ত সুবিধে হিসেবে পশ্চিমমুখি শরণার্থীদের মিছিল থামানো এবং নির্দ্বিধায় স্থানীয় মুসলিমদের গতিময় অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার প্রয়াসও নেয়া যাচ্ছে।
পশ্চিমের মানুষ মানেই এলিট শ্রেণীর সদস্য, সাদা চামড়ার মতো তাদের রক্তের মূল্যও আর সবার চাইতে বেশি- মিডিয়ার গলায় চড়ে প্যারিস হামলা নিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া এই শোক আর আহাজারির রেশ তো বহুকাল পশ্চিমের এই কৌলিন্যের ঢোল বাজিয়ে যাবেই।
আর ক’টার হিসেব দরকার বলুন! লাভের এই বৃহৎ ফিরিস্তির সামনে মাত্র কয়েক ডজন নাগরিক হারানোর ক্ষতিটুকু কী-ই-বা এমন গুরুত্ব রাখে?…
ফ্রান্সই কেনো জঙ্গিদের প্রথম পছন্দ?
হামলার জন্য ফ্রান্সই কেনো বারবার জঙ্গিদের প্রথম পছন্দ?
পছন্দ কারণ ফ্রান্স ইউরোপের একমাত্র দেশ যেখানে গিয়ে এক হাজার বছর আগে ইসলামের জয়যাত্রা থেমে গিয়েছিলো। ফ্রান্সই ইউরোপের একমাত্র দেশ- নিরাপত্তা এবং সমাজ কাঠামোয় সবচেয়ে জটিল হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম জনসংখ্যা এবং নওমুসলিম বৃদ্ধির ধারায় অন্য সব দেশ থেকে এগিয়ে। এতোটাই এগিয়ে যে মুসলিমরাই দাবি করছেন- আগামী ৪-৫ দশকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ফ্রান্স মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।
অর্থাৎ এক হাজার বছরের ব্যবধানে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আবার এই ফ্রান্স থেকেই ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সুতরাং মুসলিমদের অপ্রতিরোধ্য গতি থামাতে এমন কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা ফ্রান্সের আজ খুব দরকার। আফসোস শুধু এই- রাজনীতির এসব নোংরা খেলায় আল্লাহর নিরীহ কিছু বান্দাকে সবসময় বলি বানানো হয় এবং আরো অসংখ্য মাসুম বান্দা তাতে বিব্রত অবস্থায় পড়েন।
অসচেতন মুসলিমরা অন্যদের ভুলকে নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। ইসলামকে ভুল বোঝেন। দূরে সরে যান শাশ্বত দীনের রাজপথ থেকে।
কোন পথে ফ্রান্সের ইসলাম?
বৈষম্য, বঞ্চনা আর নির্যাতনের আলোচনা করতে গিয়ে কেবল হতাশার কথাই বলে যাচ্ছি। আশার আলো কি সত্যিই কোথাও নেই?
আছে এবং জোড়ালোভাবেই আছে। আমার বিবেচনায় চলমান শতাব্দীটি নিপীড়নের শিকার হবার মধ্য দিয়েই ইসলামের শক্তি অর্জনের সময়।
মানুষ টিপ্পনি কাটছে, আমার পরোয়া নেই। গালি দিচ্ছে, আমার পরোয়া নেই। মারতে আসছে, আমার পরোয়া নেই। নিজের কাজ নিয়ে আমি বিভোর। নিজের পথে একনিষ্ঠ মনে আমি আগুয়ান। মানুষ, পরিবেশ কোনোটাই সেখানে বিবেচ্য নয়, নয় বাধাও।
ফ্রান্সের মুসলিমরাও এখন এমন অবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। বৈষম্য, প্রতিকূলতা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম এবং নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে তারা বিন্দুমাত্র নমনীয় নন।
হিজাব পরিহিত একজন নারীকে যখন হিজাব খুলে চলতে হয় কিংবা একজন দাড়িওয়ালা মুসলিমকে প্রতিনিয়ত বক্রদৃষ্টির মুখে পড়তে হয়- এই কষ্ট অন্য কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু ফ্রান্সের নারী মুসলিমরা হার না মেনে লড়াই করে যাচ্ছেন। পহেলা ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবস নামে দারুণ এক আন্দোলনও গড়ে উঠেছে। প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ই-কমার্সসহ নানাভাবে তারা নিজেদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের বিকল্প ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন।
দলে দলে মূলধারার ফ্রেঞ্চ নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করছেন। সবমিলিয়ে উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্সের মুসলমান। ফ্রান্সের ইসলাম।
ভবিষ্যদ্বাণী না বিতর্ক উসকে দেয়া?
মিশেল হুয়েলবেক। ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। সম্প্রতি সুমিশন- ইংরেজিতে সাবমিশন নামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। এই বইয়ে ২০২২ সালে একজন মুসলিম প্রেসিডেন্টের অধীনে তিনি নতুন এক ফ্রান্সের কল্পিত চিত্র এঁকেছেন।
বলা বাহুল্য- স্পষ্টভাবে বারবার তিনি অস্বীকার করলেও এই বইয়ের বিরুদ্ধে সাহিত্যের নামে সূক্ষ্মভাবে ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা চালানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। কারণ, বইটিতে তিনি এমন এক ফ্রান্স দেখাতে চেয়েছেন, যেখানে নারীদের চাকরি করার সুযোগ নেই। ফলে পুরুষদের বেকারত্ব কমে গেছে। নারীরা রাস্তাঘাটে হিজাব পরে ঘুরছেন। সন্ত্রাসও কমে গেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
বইয়ের তথ্য যে কোনো দিক থেকেই ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। আমাদের কথা সেটা নয়। কথা হলো- দেশের সবচে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক কখন, কোন পরিস্থিতিতে ঠিক দশ বছরের মাথায় একজন মুসলিম প্রেসিডেন্টের কল্পনা করতে পারেন? জনপ্রিয়তা-ব্যবসায় কিংবা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছাড়াও অন্য কোনো কারণই কি সেখানে বিবেচ্য হতে পারে না?
পারে, তবে যেটা পারে সেটা ফ্রান্সসহ পশ্চিমের কেউ উচ্চারণ করতে চায় না। সাহস পায় না। পশ্চিমের এই ভণ্ডামির প্রেক্ষাপটে আমরা কি ধরে নেবো- ফ্রান্স সরকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা এবং নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকা ফ্রেঞ্চ নাগরিকদের তথ্য নিয়ে যে লুকোচুরি খেলছে তা মিথ্যে?
তবে কি ধরে নেবো- সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলার রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েও যেভাবে মুসলিমদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে তাতে খোদ ফ্রান্সের নাগরিকদেরই সায় নেই? তবে কি ধরে নেবো- যে হারে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরি এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতার প্রশ্নে মুসলিমদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তাতে অতিষ্ঠ হয়ে বেশিরভাগ ফ্রেঞ্চ নাগরিকই ইসলামের প্রশ্নে এবং মুসলিম ইস্যুতে সরকারের বিরোধী হয়ে ওঠছেন?
এসব উপলব্ধির কোনো একটাও যদি সত্য হয় তাহলে মানতেই হবে- ফ্রান্সের বদলে যাওয়ার খুব দেরি নেই। সত্যিকার অর্থেই সেখানে মুসলিম প্রেসিডেন্ট দেখতে পাওয়াটাও খুব অস্বাভাবিক হবে না। স্থানীয় মুসলিম স্কলারগণও বলে ফেলছেন-
আশ্চর্য কি, আগামী ৪০ বছরের মধ্যে ফ্রান্স সত্যিই একটি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে!
নতুন ভোরের পথ চেয়ে…
শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হলেও ফ্রান্সের রাষ্ট্র কাঠামোটা যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের আর পাঁচটা দেশের মতো নয়। যথেষ্ট রক্ষণশীল। বলা ভালো গোঁড়া প্রকৃতির।
তাই ফ্রান্সের মুসলিমরাও শুরু থেকেই ধর্মীয় পরিচয় ছাপিয়ে রাষ্ট্রের একজন হয় ওঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফ্রান্স কখনো তা মেনে নেয়নি।
দশকের পর দশক ধরে তারা শরণার্থী বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবেই মুসলিমদের ট্রিট করে এসেছে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের বিশ্বাস করতে না পারে তাহলে তো ভুগতেই হয়। ভবিষ্যতই বলে দেবে কী ভোগান্তি ফ্রান্সের কপালে লেখা আছে।
আমরা শুধু বলতে পারি- মানুষ মাত্রেরই কিছু চাহিদা আছে। প্রতিজন নাগরিকই রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান সুযোগ পাবার অধিকার রাখেন। সেক্যুলার আর মানবাধিকার রাষ্ট্রের তকমাধারী ফ্রান্স যদি এসবের পরোয়া না করে তাহলে ভোগান্তির খুব দেরি নেই। কারণ সব কষ্ট স্বীকার করেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে ফ্রান্সের মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। সুতরাং তাদের আর হারাবার কিছু নেই।
এখন তারা শক্তি অর্জন করছেন। ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। তাদের দাবি ধীরে ধীরে গণদাবিতে পরিণত হচ্ছে। শার্লি এবদো এবং সাম্প্রতিক প্যারিস হামলার পরও মূল সমাজ থেকে তাদের বিন্দুমাত্র বিচ্ছিন্ন করা যায়নি, সম্পর্ক বরং আরো মজবুত হচ্ছে।
জনগণও খেলাটা ধরে ফেলছেন। সুতরাং এখন চাইলেই আর রাজনীতির দাবা চালা যাবে না। ফ্রান্স সরকারের উচিত হবে বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে সমঝোতায় আসা। সবাইকে নিয়ে নিজেদের নতুন চলার পথ ঠিক করা।
এককালের অভিবাসী মুসলিমেরাই যে আধুনিক ও উন্নত ফ্রান্স গড়ে তোলার মূল কারিগর সেটা ভুলে গেলে চলবে কেনো।
এককালের পরাশক্তি ফ্রান্স যদি এইটুকুও না পারে তো কে নিশ্চয়তা দিতে পারে- হাওয়ার বাঘ একসময় সত্যি জাদুকরকেই খেয়ে ফেলবে না!
Leave a Reply