আল্লাহ পৃথিবীটা এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, তাতে সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষযোগ্য। জীবন-মৃত্যুর বাগডোরে মানুষ বন্দী। একই সাথে প্রত্যেক মানুষই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কেউ অপরিহার্য নয়। প্রতিটি মানুষ চরিত্র ও অবস্থানগত কারণেই আলাদা পরিচিতি ও গুরুত্ব পায়, প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র ফেতরৎ নিয়েই জন্ম নেয়।
পার্থক্যটা গুণগত বৈশিষ্ট্যের কারণে। এর মাধ্যমে কোনো মানুষের মর্যাদা ছোট করা হয়নি। বরং জবাবদিহিতার গণ্ডি নির্ধারণ করে দিয়ে আল্লাহ মরণশীল মানুষকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এমন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তারাই যারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে চলেন।
আলেম-ওলামা ও জ্ঞানী লোকেরা পথ চলেন জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য অনুধাবন করে। তাছাড়া পরকালীন ভাবনা তাদের জীবন যাপনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এ জন্যই বলা হয়, অনুগত বান্দা কালেমা পড়ে প্রথমে আসল স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়।
এর মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া সকল শক্তির কর্তৃত্ব অস্বীকার করা হয়। পরক্ষণেই একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব মেনে নেয়। এই ঘোষণা মেনে নেয়াই মোমেন জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। এ কারণেই তারা প্রতিপক্ষের জন্য ভীতির কারণ হন, আর মোমেনদের জন্য হন রহমদিল ও বিনয়ের উপমা। মুফতী ফজলুল হক আমিনী সাহেবকে সেই মানদণ্ডে রেখেই বিচার করা উচিত। আমার জানা মতে মরহুম ছিলেন এই সময়ের অন্যতম সাহসী পুরুষ। একই সাথে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুজাহিদ। তার এই রাজনৈতিক পরিচিতি গতানুগতিক ধারণার বাইরের কিছু।
কারবালার ওপর তার একটি লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছিলো, তিনি শুধু হোসেনি হৃদয়-মন-মানসসম্পন্নই নন, একই সাথে সকল প্রকার এজিদির বিরুদ্ধেও সতত সোচ্চার ছিলেন। যতোবার তাকে দেখেছি ততোবারই তার ভেতর একজন আলেমেদ্বীনের প্রতিকৃতি প্রত্যক্ষ করেছি। সেই সাথে দেশ ও জাতির প্রতি মমত্ববোধ সম্পন্ন একজন সময়সচেতন মানুষকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি।
অসংখ্যবার দেখাশোনা ও বহুবার কথাবার্তা, একসাথে বার দুয়েক সফরের পর আমার ধারণা হয়েছে তিনি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন আধুনিক মানুষও বটে। মুফতী ফজলুল হক আমিনী সাহেবের নাম জানতাম অনেক আগে থেকেই। প্রথম পরিচয় কেল্লার মোড়ে হজরত হাফেজ্জী হুজুরের দরবারে।
তারপর অনেক আসরে-মঞ্চে তাকে কাছ থেকে দেখেছি। কথা হয়েছে। আলোচনায় যুক্তিতর্ক নিয়ে বাহাসও হয়েছে, তবে কোনো বিতর্ক নয়। একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য আলোচনা-সমালোচনার বৈঠকে যা হয় তাই, এর বেশি কিছু নয়।
একদিনের কথা বিশেষভাবে স্মরণে পড়ে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশের দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী এবং ওলামা-মাশায়েখের একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। লক্ষ্য ছিলো, দেশে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের একটা আওয়াজ তোলা।
সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ইসলামবিরোধী তৎপরতা বন্ধের একটা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সর্বজনাব শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, মাওলানা আবদুর রহীম, মাওলানা আমিনী, অধ্যাপক আখতার ফারুক, মাওলানা হামিদুল্লাহ, মাওলানা যশোহরী, মেজর (অব:) আবদুল জলিল, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দিন, প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাশেম, অধ্যাপক শাহেদ আলী, অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের, মাওলানা আবুল কালামসহ আরো ক’জন। যাদের সবার নাম আজ আর স্মরণে পড়ছে না। সেই উদ্যোগের উদ্যোক্তা পুরুষ ও সভাপতিত্ব করছিলেন হজরত হাফেজ্জী হুজুর। সেই বৈঠকে আমাদের সবাইকে নিয়ে হাফেজ্জী হুজুর একটি ছায়া মন্ত্রিসভাও গঠন করেছিলেন। এটা ছিল অনেকটা বিরোধী দলীয় ধারণার কাছাকাছি।
আমরা একমত হয়েছিলাম, হাফেজ্জী হুজুর যে তওবার রাজনীতি শুরু করেছেন এবং খেলাফতে প্রত্যাবর্তনের ডাক দিয়েছেন সেটাকে এগিয়ে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে মানিক মিয়া এভিনিউতে একটা বিশাল সমাবেশেরও আয়োজন করা হয়েছিলো। আমাদের এ সভাটি জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিলো। যদিও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা তখন আর সম্ভব হয়নি।
ঘরোয়া বৈঠকে এবং মঞ্চসভায় মাওলানা আমিনী সাহেব প্রায়ই সরব থাকতেন। কথা বলতেন অকপটে। যা বুঝতেন তাই প্রকাশ করতেন। তার এই বৈশিষ্ট্যটি কারো কারো মনঃপূত হতো না। আমি এর ভেতরেও দুটো মানবিক গুণ দেখতে পেয়েছিলাম। প্রথমত, এটা ছিলো আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের সৎসাহসের প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, এর নেপথ্যে একটি ঈমানী দৃঢ়তা সক্রিয় ছিলো। সমাজকে যারা কিছু দিতে পারে তাদের এই গুণটি থাকতে হয়।
আমার জানা মতে যুগ যুগ ধরে যেসব আলেম-ওলামা সমাজ সংস্কারে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছেন, তারা সবাই ছিলেন সাহসী এবং দৃঢ়চেতা। সময়ের প্রতিকূলে দাঁড়িয়েও তারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে নতশির হননি।
এই সাহস ও দৃঢ়তাই উপমহাদেশের অনেক আলেমকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবি থেকে এ সময়ের আলোচিত সকল আলেমই যুগের চাহিদা পূরণে যথাসাধ্য ভূমিকা পালন করেছেন। যারা ভূমিকা পালন করেননি ইতিহাসে তারা ঠাঁইও পাননি। তাদেরকে কেউ স্মরণও করেন না।
ফতোয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার, রাজনীতিতে নৈতিক শক্তির উত্থান ঘটানো ও জালেমের বিরুদ্ধে হককথা বলার দৃষ্টান্ত স্থাপনের ক্ষেত্রে মাওলানা আমিনী যুগ যুগ ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। যে সময়টিতে আলেম-ওলামারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে আড়ষ্ট। কেউ কেউ বোবা শয়তান সেজে বসে আছেন কিংবা দরবারি হয়ে বিবেক বিক্রি করে দিয়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন, শাসকশ্রেণীর রক্তচক্ষু দেখে অনেকেই কাতর হয়ে ম্রিয়মাণ থেকেছেন, অথবা সময়ের দাবি পূরণে অক্ষমতা প্রদর্শন করাকে ভালো ভেবেছেন, সেই সময়টিতে মাওলানা আমিনী প্রায়ই গর্জে উঠেছেন।
সত্য উচ্চারণে দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন। গৃহে অন্তরীণ হয়েও কীভাবে সাহসের সাথে লড়তে হয়, সন্তান হারানোর ভীতি নিয়েও যে মুজাহিদ আরশের প্রভুর কাছে ফরিয়াদের ভাষাকে জিহাদের স্তরে উন্নীত করতে পারেন, তারই উপমা হতে পারেন মুফতী ফজলুল হক আমিনী।
দ্বীনি শিক্ষার প্রসারে তার অবদান একটি লাগাতার শিক্ষা আন্দোলনের মর্যাদা পেয়েছে। আমার দৃষ্টিতে জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে বিমুখ আলেমদের সামনে রাজনীতির একটি রাজপথ তৈরি করে দেয়ার জন্য মাওলানা আমিনীর ভূমিকা একটি প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
চার দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ এবং দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীরা একটি বিড়ম্বনা ও প্রতিকূলতার মাঝে অবস্থান করছেন। সেটাকে চ্যালেঞ্জ করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন খতিবে আজম, মাওলানা আব্দুর রহীম, খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক, শায়খুল হাদীস, হাফেজ্জী হুজুরসহ আরো ক’জন বরেণ্য আলেম। ইসলামের রাজনৈতিক রূপটিকে এড়িয়ে যারা দ্বীন চর্চার একটি খণ্ডিত ধারা সৃষ্টি করে তুষ্টি পান, তারা সত্যকে আড়াল করে চলেন, সময়ের চ্যালেঞ্জ নিতে সাহসী হন না। তারা যার যার অবস্থানে হয়তো কীর্তিমান কিন্তু খণ্ডিতভাবে অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারেন, পূর্ণাঙ্গভাবে নয়।
এসব বিবেচনায় মুফতী ফজলুল হক আমিনীকে সামনের কাতারে রাখার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। একজন মানুষ সবার কাছে সমানভাবে নন্দিত হন না। সবাই তার মিত্র হয় না। মাওলানা আমিনীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে তার রাজনীতি, সমাজ ভাবনা, দৈনন্দিন জীবনাচার, জ্ঞান সাধনা সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এ সময়ের একজন সাহসী ও লড়াকু মানুষ। যা তাকে অনেকের কাছ থেকে আলাদা করেছে।
তার জানাজায় ব্যথাতুর ও শোককাতর মানুষের ঢল প্রমাণ করেছে তিনি লক্ষ প্রাণে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
এ সত্য আড়াল করা সম্ভব নয় যে, বাংলাদেশের অনেক আলেম-ওলামা দরবারি হতে পছন্দ করেন। অনুদারতাই কারো কারো কাছে দ্বীনদারি। ঐক্যের বিপরীতে দূরত্ব বাড়ানোই তাদের কাজ। সামান্য সুযোগের বিনিময়ে তারা বিবেক বিক্রি করেন। হোসেনি ধারার ওয়াজ করেন কিন্তু এজেদি ধারায় ডুবে থাকতে ভালোবাসেন।
মুফতী আমিনীর ভেতর কিছু ভিন্নমত নিয়েও ঐক্যপ্রয়াসী হওয়ার একধরনের সাহসী চেতনা ভর করেছিলো, যা তাকে সতত লড়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাতো। সময়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সাহসী করে তুলতো।
অন্য ভাষায় যাকে ঈমানী শক্তির বহিঃপ্রকাশ ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে।
জাতীয় দৈনিকে লেখা একটি কলামে প্রাসঙ্গিকভাবে মরহুমের জানাজার প্রসঙ্গটা টেনেছিলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সামাজিক শক্তি হিসেবে আলেম সমাজ টিকে থাকার সুযোগ না পেলে এ সমাজ টিকবে না। ধর্মভীরু কিংবা ধর্মপ্রাণ মানুষের এই জনপদে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন ও সহিষ্ণুতার বিকাশ ঘটাতে আলেমদের ভূমিকাই মুখ্য। এ বিবেচনায়ও আলেম সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি ও সম্মান বাড়ানোর জন্য যারা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাদের মধ্যে আমিনী সাহেব অন্যতম।
আমরা যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জ্ঞান-গরিমার দাবি করি, তারা বুঝতে পারি না আমাদের জ্ঞানের পরিধি সীমিত। আধুনিক শিক্ষার দোহাই দিলেও জ্ঞানের পরিসর গণ্ডিবদ্ধ। কারণ ঐশী জ্ঞানভাণ্ডারের ভেতরে না হাতিয়ে প্রকৃত জ্ঞানী হওয়া সম্ভব নয়। সনদ ও ডিগ্রিই সব শিক্ষা নয়। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষাজীবনের যে ব্যাপ্তি, সেটা আত্মস্থ করার সুযোগ না নিলে সনদ ও ডিগ্রি নিয়েও মূর্খ থাকতে হয়। তাই বলে যুগ-জিজ্ঞাসা ও প্রযুক্তি জ্ঞানকে অবহেলা নয়।
আমার জানা মতে মুফতী সাহেব যুগ-যন্ত্রণা যেমন বুঝতেন, তেমনি যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার মতো যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন। অনেক আলেম যা অবজ্ঞা ও অস্বীকার করেন আমিনী সাহেব তা শুধু স্বীকার করতেন না, আলেম-ওলামাদের যুগোপযোগী হওয়ার প্রেরণাও জোগাতেন।
নতুন প্রজন্ম তার এই দুর্লভ গুণটি অনুধাবন করলেই একটা দিশা পাবেন।
লেখক- উপ সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত
মুফতী আমিনী রহ.-কে নিবেদিত মাসিক নতুন ডাক বিশেষ স্মরণ সংখ্যার সৌজন্যে
Leave a Reply