ষড়যন্ত্র যুগে যুগে
১৯৬১’র জুনে ফ্রান্সের একটি দ্রুতগামী ট্রেন প্যারিসের কাছাকাছি বোমা হামলার মুখে পড়ে। ২৮ জনের মৃত্যু এবং একশ’র বেশি মানুষ তাতে আহত হয়।
ফ্রান্সের অধীনে থাকা আলজেরিয়া ১৯৫৪ সাল থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে আসছিলো। ঘটনাক্রমে আক্রান্ত ট্রেনটি ছিলো ফ্রান্সের এমন একটি সংস্থার মালিকানায়, যারা আলজেরিয়ার স্বাধীনতার কট্টর বিরোধী।
ব্যস, দুইয়ে দুইয়ে চার এর সূত্র অনুসরণ করে এ হামলার দায় চাপিয়ে দেয়া হলো আলজেরিয়ান মুসলিম সন্ত্রাসীদের ওপর। অন্যার্থে- মুসলিমদের ওপর।
নিরাপত্তা-খাদ্য-বাসস্থানের খোঁজে আলজেরিয়াসহ আফ্রিকার বেশকিছু দেশ থেকে মুসলিমরা তখন ফ্রান্সসহ বিভিন্ন ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রে ঢোকা শুরু করেছে। এই হামলার দায় চাপানোর মাধ্যমে ফ্রান্স সরকার তার দেশে প্রথমবারের মতো মুসলিম কমিউনিটিকে কালো তালিকাভুক্ত করার প্রয়াস পায়। পরের বছর ১৯৫২ তে আলজেরিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে।
তবে ষাট-সত্তুরের দশকেই ইউরোপে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অভিবাসনের ঘটনাটি ঘটে, মুসলিম ইস্যুটিও তখন নতুন করে ইউরোপের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উদার দাবিদার ইউরোপের রক্ষণশীল, বলা ভালো গোঁড়া মানসিকতাও তখন প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এক্ষেত্রে ফ্রান্সই এগিয়ে ছিলো সবচেয়ে বেশি।
বাসস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এসব মৌলিক মানবাধিকার সূচকের প্রত্যেকটিতেই মুসলিম সম্প্রদায় ব্যাপকরকম বঞ্চনার শিকার হন।
সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় ফ্রান্সের মুসলিম নাগরিকদের বেকারত্ব ও ভালো চাকরির দুষ্প্রাপ্যতা বিষয়ক ভয়াবহ এক চিত্র উঠে এসেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমদের এসব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার পর ফ্রান্স শুরু করে দ্বিতীয় পর্যায়ের আরো ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। স্কার্ফ-হিজাব বিতর্ক উসকে দিয়ে মুসলিম মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধে উদ্যোগী হয়। রুদ্ধ করে মুসলিম নারীদের কাজের সুযোগ।
ফলে ফ্রান্সের নাগরিক হয়েও নিজেদের দেশে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির অসহায় শরণার্থীতে পরিণত হন।
ফ্রান্সে ইসলামের নীরব বিপ্লব
পাশ্চাত্যের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কল্যাণে তথ্যের সহজলভ্যতা যেমন সুবিদিত, সমন্বয়ের কাজটাও তেমনি মুশকিল। রসুনের একমুখিতার মতো ইসলাম আর মুসলিম বিষয়ক ওদের সব আলোচনা- হোক সেটা খবর-জরিপ-কলাম বা বক্তৃতা, শেষমেশ গিয়ে সন্ত্রাসবাদে ঠেকে।
বিভিন্ন পক্ষ বা সূত্রের দাবিগুলোর মধ্যকার ব্যবধানও এতো বেশি থাকে যে, সত্যটা নির্ণয় করে ওঠা মারাত্মক কঠিন হয়ে পড়ে। ৯/১১ পরবর্তী পুরো পাশ্চাত্যের ইসলাম বিষয়ক নীতি ও অবস্থান (পক্ষের বা সহমর্মিতার নয় নিশ্চয়ই…) এক হলেও নানান কারণে ফ্রান্সে বরাবরই একটু ব্যতিক্রম অবস্থা ছিলো। সেক্যুলার রাষ্ট্রের তকমা গায়ে সাঁটানো থাকায় নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার নিয়ে ফ্রান্স না পারছিলো প্রতিবেশী বা মিত্রদের গৃহীত ভূমিকা থেকে বেরিয়ে উদার হতে, না পারছিলো উপেক্ষা করতে।
আগে থেকেই তুলনামূলকভাবে অধিক সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস, ভৌগোলিক দিক থেকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছাকাছি অবস্থান, হিজাব নিষিদ্ধকরণ ও মুসলিম শিশুদের ধর্মশিক্ষার দাবি বিষয়ক দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা মামলা এবং অভ্যন্তরীণ আরো বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান থাকায় পরিবেশও বর্তমান বাস্তবতার অনুকূলেই ছিলো।
সংবিধান এবং সরকারের সাংঘর্ষিক অবস্থান, ২০০৫ এর চাপিয়ে দেওয়া রায়ট এবং সর্বশেষ শার্লি এবদো ম্যাগাজিনের অনাধিকার চর্চার ঘটনা জ্বলন্ত আগুনে কেবল ঘি-ই ঢেলেছে।
সবমিলিয়ে ফ্রান্সে তাই ইসলামের নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। ফ্রান্সের সাবেক ইন্টেলিজেন্স অফিসার মি. গোডার্ডসহ অনেকেই আজকাল বলতে শুরু করেছেন- ফ্রান্স হলো ধর্ম পরিবর্তনের (হবে ইসলাম গ্রহণের!) উর্বর ভূমি।
Leave a Reply