বুদ্ধিজীবী বনাম চাটুকার
আমাদের গ্রামাঞ্চলে কথাপ্রিয় কিছু নারী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। মজলিস খালি হোক বা ভরপুর, প্রসঙ্গ কাছের হোক বা দূরের- কথা তারা বলবেই। মজার ঘটনা এমন রসিয়ে রসিয়ে বলতে পারে যে শ্রোতামাত্রই নিজেকে মূল চরিত্র কল্পনা করে ওঠেন, মুহূর্তেই পুরো মজলিসে হাসি-ঠাট্টার রোল পড়ে যায়। আবার কারো নিন্দার বেলায় এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একেকটা দোষ বের করে আনতে থাকে যে চারপাশে হায় হায় রব শুরু হয়ে যায়। পুরুষ সমাজেও এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
শহরে বা শিক্ষিতসমাজে এই চর্চার উন্নতি বলতে কিছুটা পরোক্ষ হয়ে যাওয়া। প্রথম কথাতেই না বলে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে পারাটাই শহরের ট্র্যাডিশন। প্রশংসার ক্ষেত্রে আগে কিছু মন্দ বলে নাও, সমালোচনার ক্ষেত্রে কিছু ভালো দিক তুলে ধরে তারপর শুরু করো। কথার তখন কী যে ধার!
আমাদের একজন শিক্ষক বুদ্ধিজীবী আছেন। নানা জায়গায় নিজেকে তিনি একচোখা হরিণ হিসেবে পরিচয় দেন। লেখা-জোখায় শহুরে এই ধারাটা রীতিমতো তার ট্রেডমার্ক। প্রিয় বিষয়-পছন্দের ব্যক্তির ক্ষেত্রে জরুরি হলেও নেতিবাচক বিষয়গুলো তিনি নিয়ম করেই এড়িয়ে যান। আর বিপরীত হলে হাসতে হাসতেই এমন পচানো শুরু করেন যে বেচারার গায়ের কাপড় তো বটেই চামড়া অব্দি ক্ষতবিক্ষত হবার উপক্রম হয়।
আশপাশে লক্ষ্য করলে এমন অনেককেই পাওয়া যাবে, একজনের নাম এখানে আলাদা করে আর নাইবা বললাম!
নওমুসলিমদের নীরব বিপ্লব
কাঁটি করায় বাঙালির খ্যাতি প্রবাদতুল্য হলেও এর চর্চাটা অবশ্য বিশ্বজুড়েই আছে। পাশ্চাত্যে ইদানীং এই নিন্দা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের শহুরে স্টাইলটারই ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে। একটু বিশেষ অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে- নিজেদের কাজ আর শখের বাইরে এ মুহূর্তে ইসলাম ও মুসলিম ইস্যুটিই তো ওদের বা ওখানকার প্রধানতম নেতিবাচক আর ভয়জড়ানো বিষয়।
আপনি পশ্চিমা বিশ্বের আজকের কোনো সাধারণ নাগরিককে জিজ্ঞেস করুন, কোনো নেতার বক্তব্য শুনুন, কোনো লেখক-বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি বা কলাম পড়ুন-
দেখবেন ইসলাম আর মুসলিম ইস্যুতে তাদের কথার ধরন-উপস্থাপনা কেমন বদলে যায়। বাস্তবতা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এখন শুরু থেকেই সরাসরি নিন্দা তো আর করা যায় না, তাই প্রথমে ভালো কিছু বলে নিয়ে তারপরই পুরনো পথে পা বাড়ায়। অথচ বছর কয়েক আগেও এটা চিন্তা করা যেতো না।
ইসলামকে টার্গেট করে গণহারে সমালোচনা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর জবাব যখন তাদের নিজেদের লোকেরাই দলে দলে ইসলামগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে দেওয়া শুরু করলেন, পাশ্চাত্য তখন বাধ্য হলো কথার ধারা পাল্টাতে। অযৌক্তিক-মিথ্যে সমালোচনার ব্যাপারটা তো আর থামে নি, ভাখাাঁই কেবল বদলেছে। চলুক, চলতে থাকুক; ভুক্তভোগী মুসলিমরাও এখন আর পরোয়া করছেন না। ঠিক সময়ে আসমানের অবধারিত ফয়সালা তো আসবেই।
৯/১১ পরবর্তী পাশ্চাত্যে ইসলামী জাগরণে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। পশ্চিমের দেশে দেশে এখন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লম্বা হচ্ছে নওমুসলিমদের মিছিল।
তবে- ইউরোপের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ফ্রান্সেই পরিবর্তনের হাওয়াটা সবচেয়ে গতিশীল এবং দৃশ্যমান। আমাদের আলোচনাও ফ্রান্স নিয়েই চলছিলো।
ফ্রান্সের মুসলিম জনসংখ্যা
সেক্যুলার রাষ্ট্র হওয়ায় ফ্রান্সে নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচয় জিজ্ঞেস করা বা স্বতন্ত্র তালিকায়ন করার আইনগত অধিকার কারো নেই। ফ্রান্সে তাই মুসলিম জনগোষ্ঠীর সরকার স্বীকৃত কোনো পরিসংখ্যানও নেই। বেসরকারি সংস্থাগুলো নানাসময় যে জরিপ চালিয়েছে তার ভিত্তিতেই মোটামুটি একটা অনুমান করে নেওয়া হয়। এসব জরিপের তথ্যগুলো আবার কেবল নওমুসলিমদের আইনী ঘোষণা এবং বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র থেকে আগত অভিবাসীদের সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ খুবই সীমিত। তাই বর্তমানে ফ্রান্সে ঠিক কতোজন বা কী পরিমাণ মুসলিম বসবাস করছেন এর সন্দেহাতীত তথ্য বা পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই।
ফ্রান্সের আইএনইডি (ওঘঊউ) বা আইএনএসইই (ওঘঝঊঊ)’র মতো পাবলিক প্রতিষ্ঠান, যেগুলো রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা বা বিভিন্ন সামাজিক ধারাসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের সাথে যুক্ত- ২০১০ সালের অক্টোবরে প্রদত্ত তাদের এক রিপোর্ট বলছে ফ্রান্সে প্রায় আড়াই মিলিয়ন বা পঁচিশ লাখ ‘ঘোষিত’ মুসলিম রয়েছেন, যাদের বয়স ১৮-৫০ এর মধ্যে। এই আড়াই মিলিয়নের মধ্যে মাত্র ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার হলেন ফ্রান্সের ন্যাটিভ বা জন্মগত নাগরিক যারা অন্য ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসে ইসলামকে নিজেদের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
কেবল প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক বা ভোটার সম্পর্কিত জরিপ হওয়ায় স্পষ্টতই এই হিসেব থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী মুসলিম শিশু-কিশোররা বাদ পড়েছে, ব্যতিক্রম হলেও একইভাবে বাদ পড়েছেন বা বিবেচনার বাইরে রয়ে গেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব মুসলিমেরাও। ২০১০ সালে মুসলিমদের বাস্তব সংখ্যা তাই আরো বেশিই ছিলো।
মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র থেকে যেসব লোক নিজেরা বা যাদের বাবা-মায়েরা ফ্রান্সে অভিবাসন গ্রহণ করেছেন তাদের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ফ্রান্স সরকার অবশ্য ২০১০ সালেই তাদের আনুমানিক মুসলিম জনসংখ্যা ৫-৬ মিলিয়ন বলে উল্লেখ করেছে।
এই হিসেবে সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি এসেছে। তবে সমন্বয়টা তারা এই বলে করে নিয়েছে যে, ৫-৬ মিলিয়নের মধ্যে মাত্র ২ মিলিয়ন মুসলিম নিজেদের ‘প্র্যাকটিসিং’ মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন- আমরা যাদের বলি ‘দীনদার’ মুসলিম, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ প্রতিনিয়ত ইসলামের সকল বিধিবিধানই যারা মেনে চলার প্রয়াস পান। সুতরাং ফ্রান্সের সরকারি সূত্রেও ২০১০ সালের ‘ঘোষিত’ বা ‘প্র্যাকটিসিং’ মুসলিম জনসংখ্যা দুই থেকে আড়াই মিলিয়নই, মোট ছিলো ৫-৬ মিলিয়ন। ২০০৭ সালের দুটো বেসরকারি জরিপ ফ্রান্সের মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩% বললেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপ অবশ্য সরাসরিই ১০% বলে উল্লেখ করেছিলো।
‘দ্য সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক’ জরিপে ফ্রেঞ্চ মুসলিমদের মোট সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৫-১০%। ‘পিউ ফোরাম’ এর অন্য এক গবেষণা বলছে ২০১০ সালে ফ্রান্সে ৪.৭ মিলিয়ন বা প্রায় সাতচল্লিশ লাখ মুসলিম ছিলেন। এই স-ব হিসেব বা জরিপই ২০১০ সাল বা তারও পূর্বের। এরপর লাস্ট আপডেটেড বা সর্বশেষ হিসেব পাওয়া যায় ২০১৩ সালের।
২০১৪ সালের বেশ ক’টি বেসরকারি জরিপ ও গবেষণা দাবি করছে ২০১৩ সালে ফ্রান্সের মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ৬.৫ মিলিয়ন বা ৬৫ লাখের মতো। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা ৬৬ মিলিয়ন (সাড়ে ছয় কোটির বেশি) হওয়ায় এই হিসেবেও মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১০% এর মতো।
অবশ্য ‘জান-পওল গার্ভিচ’ এর এক হিসেবমতে ২০১১ সালে ৭.৭ মিলিয়ন বা মোট জনসংখ্যার প্রয় ১১% মুসলিম থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মুসলিম জনসংখ্যায় প্রকৃত বাস্তবতা
ফ্রান্সের মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে এতো দীর্ঘ বক্তব্যে যাওয়ার ব্যাখ্যা পরে দিচ্ছি। ওপরের প্যারায় লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো- এখানকারর কোনো জরিপ বা কারো দেওয়া তথ্যই পুরোপুরি নিশ্চিত বা একশ ভাগ সত্য নয়। সবকটিতেই কিছু সহজ সূত্র বা আনুমানিক হওয়ার ব্যাপারটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
আর অনুমাননির্ভর ব্যাপারে আমরা একটু বেশি বেশি করে হিসেব ধরলেও ইউরোপ বা পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি এর ঠিক বিপরীত। এ্যাক্সেক্ট, হান্ড্রেড পার্সেন্ট তথা শতভাগ সত্যতা নিশ্চিত করতে বা এর কাছাকাছি থাকতে তারা বরং সংখ্যা কিছু কমিয়ে হিসেব করে। সুতরাং জরিপে উল্লেখিত সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা তো থেকেই যায়। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো- মুসলিম জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানোটাই যে তাদের একান্ত চাওয়া হবে তাতে আর সন্দেহ কি! শুধু এই আনুমানিক হিসেব দিয়েই তো ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ টি রাষ্ট্রের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যায় ১ নম্বর হিসেবে উঠে এসেছে- বলা ভালো কালো তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে!
জরিপগুলোকে আনুমানিক বলার কারণ পরিষ্কার- সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকায় এ নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো জরিপ কখনো হয়নি। সবাই তাই ধার-করজ করেই কাজ চালিয়েছে। আর সহজ সূত্র বলতে বুঝিয়েছি- ১৮ বছরের কম বয়স্ক- তাদের ভাষায় ‘শিশুদের’ হিসেবের বাইরে রাখা, পঞ্চাশোর্ধ্বদের গুরুত্ব না দেয়া এবং ‘ঘোষিত’ বা ‘প্র্যাকটিসিং’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে সংখ্যা কম দেখানোর প্রয়াস নেওয়া। তারা যাই বলুক- কারো শিশু থাকা, ঘোষণা দেওয়া কিংবা দীনদার হওয়ার ওপরই তো আর মুসলিম হওয়া না হওয়াটা নির্ভরশীল নয়।
সুতরাং উপরে বর্ণিত সবগুলো তথ্যই যে বেশরকম অসত্য এবং বহুলাংশে কম করে দেখানো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সংখ্যা কমানোর এতোসব প্রচেষ্টার পরও, আরো বড় লুকোচুরি খেলা হয়েছে নওমুসলিমদের তথ্য এবং রাষ্ট্রের সীমানা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে। প্রদত্ত প্রায় সবগুলো জরিপের সূত্রই বলছে- মুসলিম জনসংখ্যার এই হিসেব মূলত মেট্রোপলিটান ফ্রান্সের। পুরো ফ্রান্সের নয়।
মূল ভূখন্ড, কোরসিকা এবং আরো কিছু ছোট দ্বীপ-উপদ্বীপ নিয়ে মেট্রোপলিটান ফ্রান্স গঠিত, এর বাইরেও রিপাবলিক বা সামগ্রিক ফ্রান্সের বিশাল অংশ রয়ে গেছে। সেখানেও নিশ্চয় আরো অনেক মুসলিম আছেন যারা আপাতত এসব জরিপের আওতায় পড়েন নি। আর নওমুসলিম বিষয়ে সকল সূত্রের খবর- ফ্রান্সে ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণকারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। কী পরিমাণে?…
শব্দের খেলায় চতুর কলামিস্ট বা কূটনীতিকরা অস্পষ্ট ইংলিশ ‘থাউযেন্টস’ (হাজার হাজার বা হাজারো) শব্দটি বলে পরিমাণ ব্যাখ্যা করতে চাইছেন। কিপ্টে সূত্রগুলো বলছে বছরে ৭-১০ হাজার। আর উচ্ছ্বসিত মুসলিমরা দাবি করছেন প্রতিবছর ৬০-৭০ হাজার ফ্রেঞ্চ নাগরিক মুসলমান হচ্ছেন। আসল সত্যটা কি? বিতর্কে এড়িয়ে সমন্বয়ের প্রাথমিক হিসেব মেলাতে গেলেও তো বাৎসরিক গড় সংখ্যাটা ২৫-৩০ হাজারের কম হয় না কোনোভাবেই।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসলাম গ্রহণের সংখ্যাবৃদ্ধিতে স্থানীয় মুসলিম লিডারগণও বিস্মিত হয়ে যাচেছন।
সুতরাং এতোক্ষণের আলোচনার সবগুলো বিবেচনা মাথায় নিলে নিঃসন্দেহে বলে ফেলা যায়- ফ্রান্সের মুসলিম জনসংখ্যা ৯-১০ মিলিয়ন বা কোটির কাছাকাছি হবেই, মোট জনসংখ্যার বিবেচনায় যা ১৫% কেও ছাড়িয়ে যায়! প্রকৃত সংখ্যা যাচাই ও উল্লেখ করা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা থাকাটা তাহলে অস্বাভাবিক নয় মোটেও।
ফ্রান্সের সেরা ঔপন্যাসিক তো আর এমনি এমনিই তার উপন্যাসে শীঘ্রই একজন মুসলিম প্রেসিডেন্ট দেখার কল্পনা করে ওঠেন না। একজন মুসলিম স্কলার (মারওয়ান মুহাম্মদ) একরকম চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছেন- কে বলতে পারে যে আগামী ৩০-৪০ বছরের মধ্যে ফ্রান্স একটি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হবে না!
ফ্রেঞ্চ পার্লামেন্টে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব
ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ মুসলিম হলেও ফ্রেঞ্চ পার্লামেন্টে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে আজুজ বেকাকসহ কেউ কেউ কোনো মন্ত্রণালয় বা সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করলেও সেটা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ছিলো না। মেয়াদও ছিলো খ-কালীন।
জনগণের প্রতিনিধির চেয়ে তাদেরকে বরং প্রেসিডেন্ট বা দলীয় প্রধানের বিশেষ প্রতিনিধি বলাই শ্রেয়তর। বোরকা নিষিদ্ধসহ ফ্রান্সে মুসলিম ইস্যুতে রাজনীতি করার বড় রেকর্ড গত টার্মের (২০০৭-২০১২) প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির। ব্যক্তিগতভাবে তিনি তিনজন মুসলিম বংশোদ্ভূত সদস্যকে তার কেবিনেট ও গুরত্বপূর্ণ দপ্তরে নিয়োগ দিয়েছিলেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য তারাও কিছু করেন নি বা পারেন নি, দীর্ঘদিন ধরে দলের হয়ে কাজ করা কিংবা নির্বাচনকালীন প্রচারণায় বিশেষ ভূমিকা পালনের পুরস্কার হিসেবে সারকোজি তাদেরকে সম্মানিত করেছিলেনমাত্র।
তারচেয়ে বড় কথা- মরক্কো কিংবা আফ্রিকান পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নেওয়া এই শ্রেণীটি মুসলিম পরিচয় ধারণ করলেও লালন কতোটুকু করেন তা নিয়ে মুসলিম সোসাইটিতেই প্রশ্ন আছে। অথচ তাদেরকেও যুগের পর যুগ ‘বিশ্বস্ততার’ প্রমাণ দিয়ে এটুকু অর্জন করতে হয় বা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন মুসলিম কমিউনিটির প্রধান বা ইমামেরা ফ্রান্স সরকারে বা প্রশাসনের কোথাও প্রাথমিক আস্থার জায়গাটুকুই এখনো খুঁজে পান নি।
সেক্যুলার রাষ্ট্রের তকমাধারী ফ্রান্সের গোঁড়া সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও মুসলিম পরিচয়ে বা মুসলিম জনসংখ্যার পক্ষ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো প্রতিনিধিত্ব তৈরীর সুযোগ মুসলিমেরা কখনো পান নি। বর্তমান বাস্তবতা তো আরো জটিল।
ফ্রান্সে মসজিদ ও ইসলামী সংস্থা
ফ্রান্সে মসজিদ ও বিভিন্ন মুসলিম কমিউনিটির প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ইসলামী সংস্থা প্রায় ১৫০০টি। বিভিন্ন কমিউনিটি বলতে- যুগ যুগ ধরে আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইরান-পাকিস্তানের যেসব অভিবাসী ফ্রান্সে পারি দিয়েছেন তাদের স্থানীয় প্লাটফর্মকে বোঝানো হয়েছে। আছে তাবলীগ, সালাফিজম, শিয়া ও নগণ্য সংখ্যক কাদিয়ানী মতবাদের অনুসারীও।
জাতীয়ভাবে সবাই মুসলিম পরিচয়েই ফ্রান্সে বাস করেন। বিভিন্ন সময়ের জরিপে তাই সম্মিলিত তথ্যই উঠে এসেছে। ফ্রান্সে অবশ্য ধর্মীয় পরিচয় যাচাই বা হিসেব করার সরকারি কোনো নিয়ম বা বৈধতা নেই, অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্যের সূত্র ধরেই এই জরিপগুলো করা হয়। আশির দশকের পর থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা সেন্টার বা মাদরাসাও সংখ্যায় যুক্ত হয়েছে।
সব মসজিদ, বিশেষত মাদরাসাগুলো যদিও ফ্রান্স সরকার কর্তৃক স্বীকৃত নয়, স্থানীয় মুসলিমেরা চেষ্টা করছেন মোটামুটি একটা সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে। তাতে ঝামেলাও বাঁধছে। প্রায়ই কোনো মাদরাসা বা অনুমোদনহীন মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি প্যারিস হামলার প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স সরকার ১৬০ টি ‘অনুমোদনহীন’ মসজিদ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দুঃখজনক হলেও তাদের সিস্টেমটা বেশ মজার- রাষ্ট্র নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকারের স্বীকৃতি দিচ্ছে, ধর্ম পালনের সুযোগ দিচ্ছে না।
মসজিদের জন্য অনুমতি চাইতে যাবেন, মিলবে না। পরিত্যক্ত কোনো গ্যারেজ বা বাড়িতে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে নামাজ পড়া শুরু করলেন, সরকার বলবে সেটা বেআইনি।
কথা, যুক্তি, বিকল্প সবই আছে এর, সমাধানটাই শুধু নেই।
Leave a Reply