আমার নিজস্ব মন্তব্য বা পারিপার্শ্বিক ব্যাখ্যার চেয়ে এক্ষেত্রে বরং একজন ফ্রেঞ্চ সাংবাদিকের রিপোর্ট হুবহু তুলে দিচ্ছি, নিজেদের কনক্লুশনে যাওয়ার আগে তাই ওদের উপলব্ধিটুকুও জেনে নিন। ২০১০ এ হিজাব নিষিদ্ধ হওয়ার এক বছরের মাথায় ২০১১ সালে এলিসন হার্ড এই রিপোর্টটি করেছিলেন।
‘ফ্রান্সের পাবলিক স্পেসে মুখাবৃত বোরকা নিষিদ্ধের এক বছর পূর্তি হলো। সরকারের ভাষায় আইনটি পাস হয়েছিলো- রাষ্ট্রের সেক্যুলার মূল্যবোধ এবং নারী অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে। বিপরীত বক্তব্য বা অভিযোগ ছিলো- ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি এবং মুসলিমদের ঘিরে তৈরি হওয়া অসত্য ধারণা ও উপলব্ধিকে আরো পোক্ত করার প্রেক্ষিতেই এই আইনটি পাস করা হয়েছে- যা মুসলিমদের জন্য কোনোভাবে সুখকর তো নয়ই, বরং আরো বেশি বিব্রতকর।
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলছে- এই এক বছরে পুলিশ কমপক্ষে ৩৫৪ জন মুসলিম নারীকে যাত্রাপথে আটকে দিয়েছে এবং চেকিং করেছে। এর মধ্যে ২৯৯ টি অভিযোগ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০ জনকে ১৫০ ইউরো বা প্রায় সাড়ে বার হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যদিও বলছে- খুবই সতর্কতার সাথে তারা আইনটি প্রয়োগের পথে হেঁটেছেন, কিন্তু যারা প্রয়োগের শিকার হয়েছেন, বিশেষত মুসলিম নারীরা- তারা বলছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
নিষিদ্ধ বোরকা
‘নিষিদ্ধ বোরকা’ শিরোনামের ডকুমেন্টারিতে একজন মুসলিম যুবতী বলেছেন- ‘এই আইন পাসের পর আমার দু:স্বপ্নগুলো যেনো বাস্তবে রূপান্তরিত হয়ে সামনে এসে গেছে। আপনি যখন বাইরে যাবেন, আপনার পাকস্থলি ভেতরে দলা পাকাতে শুরু করবে। আপনি কেবল খুঁজতে থাকবেন- আশপাশে কোথাও পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কি না। বাইরে থাকার পুরোটা সময় আপনাকে অপমানিত হওয়ার আতংকে ভুগতে হবে। আগের মতো এখনো আমি বাইরে যাই- তবে এই আইন ভয়টা বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাপকমাত্রায়। ভয় দীর্ঘক্ষণের বিরক্তিকর পরিচিতি নির্ণয়ের, ভয় অপমানের, ভয় জোরপূর্বক পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার, ভয় অনির্দিষ্ট সময়ের বিরক্তিকর প্রশ্নবানের…।’
প্যারিসের এমন প্রায় ২০০০জন নারী, জীবনের তাগিদে যারা প্রতিদিন পুরো মুখঢাকা বোরকা পরে বের হন এই আইন তাদের জীবনকে সত্যিই বিভীষিকাময় করে তুলেছে। ফ্রান্সের সমাজবাদী এবং ডকুমেন্টারি ফিল্ম পরিচালক এক নারী (অমহঁং ফবর ঋল্কড়) এই মুসলিম মেয়েদের নিয়ে সম্প্রতি একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন।
তিনি মোট ১০০ জন মুসলিম নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, বোরকা নিষিদ্ধের আইন পাস হওয়ার পর থেকে কেমন জটিল আকার ধারণ করেছে তাদের জীবন- সেসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা নিয়ে। ডকুমেন্টারির পরিচালক ডি ফিঁউ বলেন-
‘আমি এমন অনেক মেয়ের সাথে মিলিত হয়েছি- পুলিশ বিষয়ক কোনো সমস্যা যাাদের নেই। তারা অনায়াসে পুলিশের সামনে দিয়ে চলে যেতে পারেন। কখনো তারা গ্রেফতারের শিকার হননি। বলা ভালো হতে হয় না। আবার এই দেশেই আপনি এমন নারীদেরও পাবেন- যারা একেকজন চারবার করেও গ্রেফতারের মুখে পড়েছেন এবং এর মধ্যে দুই থেকে তিনবারই জরিমানার শিকার হয়েছেন।’
জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি তথ্য দিয়েছেন- আইন পাস করার পর থেকে অন্তত অর্ধেক সংখ্যক মুসলিম নারী তাদের মুখ ঢাকা বোরকা পরা ছেড়েছেন। কিন্তু ডকুমেন্টরির পরিচালক ডি ফিউঁ বলতে চান- নিষিদ্ধের ফলাফল বরং উল্টোটা হয়েছে।
তার ভাষায়-‘প্রচুর নারী নিকাব পরা শুরু করেছেন অইনটি পাস হওয়ার পর থেকেই এবং তারা বেশ আক্রমণাত্মক। এসব নিপীড়নমূলক আইনের কারণে কখনো কখনো তো তারা খোদ রাষ্ট্রেরও বিরোধিতা করতে চান। মুসলিম নারীরা মনে করেন- এসবের মধ্য দিয়ে তারা মূলত প্রতিরোধ করছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এটা একপ্রকার লড়াই। তারা আরো বলছেন- যতোবেশি করে আমরা অপমানিত হবো ততোবেশি করেই সত্য তথা আমাদের দীনকে আঁকরে ধরবো।’
এই আইনটি নিকাবের পক্ষের আওয়াজকে আরো জোরালো করে তুলেছে।
অন্তত ৩৫০ জন মুসলিম নারী এখন নারী স্বাধীনতা সংঘের (অসধুড়হং ড়ভ ভৎববফড়স) সদস্য, এটি একটি গ্রুপ যা দুর্ভোগের শিকার নারীদের নৈতিক এবং আইনী সহযোগিতা দিয়ে থাকে এবং বোরকা নিষিদ্ধের আইনটি প্রতিস্থাপন বা সংশোধনের জন্যও প্রচারনা চালায়। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা লাইলা সিতার বলেন-
আইনটি এক আকস্মিক দুর্বিপাক। শত শত নারীকে এখন আতংক নিয়ে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। তারা তাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে রীতিমতো হতাশ। প্রতিনিয়ত পুলিশের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন অপরাধীদের মতো। মৌখিক এবং শারীরিক লাঞ্চনার ঘটনা তো এর মধ্যেই সীমা ছাড়িয়েছে। মৌখিক অপমান এবং হয়রানিগুলোকে তো এখন আমরা গণনাতেই ধরছি না। এটা এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পর্যবসিত হয়েছে।’
পাবলিক স্পেসে নিকাব পরে বের হওয়াটাকে আজকাল গাড়ি চালাবার সময় ফোনে কথা বলার মতো অন্যায় হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। এক্ষেত্রেও আপনাকে কখনো শুধু সতর্ক করা হয় কিংবা কোনো সামাজিক কাজের পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় কিন্তু মুসলিম নারীরা বলছেন- পুলিশ তাদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে।
ডি ফিউঁ বলেন- পুলিশকে যদিও কেবল পরিচিতি নিশ্চিতকরণের অধিকার দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা প্রায়শই অধিকারের বেড়া ডিঙিয়ে মুসলিম নারীদের অহেতুক দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করছে। তিনি বলেন- নারীদের কখনো চার ঘণ্টা পর্যন্তও আটকে রাখা হয়েছে এবং অনেক পুলিশ সদস্যকে দেখা গেছে যে তারা জানেই না- আইনটি কেবল পরিচয় নিশ্চিতকরণ পর্যন্তই সীমিত। আবার কখনো এমনও হয়েছে- তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেদের পুরো পরিচিতি তুলে ধরার পরও তাদেরকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মুসলিম নারীরা বাধ্য হয়ে হিজাব নেন?
আইন পাসের সময় বলা হয়েছিলো- বেশিরভাগ কিশোরী-নারীকে জোরপূর্বক এমন মুখঢাকা পুরো শরীরের বোরকা পরানো হয়েছে। কিন্তু নারী সংঘ এবং ডি ফিউঁ দুজনই বলছেন- মুসলিম এই নারীদের বড় একটা অংশই হয়তো অবিবাহিত বা নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণের কারণে ডিভোর্সড। সুতরাং জোর করে বোরকা পরানোর ব্যাপারটি পুরোই বানোয়াট।
জোরপূর্বক বোরকা পরাবার অভিযোগ পেলে আইনী ব্যবস্থার মুখোমুখি করার রাষ্ট্রীয় হুঁশিয়ারী দেওয়া থাকলেও বিগত এক বছরে কোনো মুসলিম নারী একটাও অভিযোগ করেন নি।
Leave a Reply