দোররাকাহিনী এবং একটি রায়

Date

Author

Blog Duration

2 minutes

আর দশটি দিনের মতোই সকালটি শুরু হয়েছিলো। ঘুম থেকে জেগে অন্তত তাই মনে হলো। পরিচ্ছন্ন আকাশ, লাল-হলুদ সূর্যের মিষ্টি রোদ- এই তো চেনা বাংলার ভোর।

ব্রাশ হাতে উঠোন পেরুবার পর আমার ধারণা পাল্টাতে হলো। কিসের জটলা মাঠে? আমাদের বাড়ির সীমানা ঘেসেই প্রাইমারি স্কুল। গ্রামের বড় সালিশগুলো এখানেই হতো। আরেকটি সালিশের সাক্ষী হতে দিলাম ছুট।

মাঠে গিয়ে অবশ্য হতাশই হতে হলো। আমার মতো ছোটদের কাছে যেতে দেয়া হচ্ছে না। বড়রা কথা বলছেন ফিসফিস করে। কী হচ্ছে এখানে?…

বেশ কিছুক্ষণ পর জটলার ভেতর বিধ্বস্ত এক নারীকে আবিষ্কার করলাম। মোটা লাঠি দিয়ে সবার সামনে তাকে পেটানো হলো। এরপর এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো বিশ্রীভাবে।

আমাদের ক’ বাড়ি পর থাকতেন এক চাচা, অন্য এলাকা থেকে এসে ছোট্ট একটা ঘর করে এখানে থাকছিলেন, সম্ভবত তার খালার বাড়িতে। শাস্তির পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাকে গ্রাম ছাড়ার নোটিশ দিয়ে সালিশ সমাপ্ত হলো।

পরে জেনেছিলাম- এই মুসাফির লোকটি ঢাকায় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীটিকে নিয়ে এসেছিলেন। এলাকার বখাটে যুবকেরা সারারাত পালাক্রমে ওকে ‘ধর্ষণ’ করেছে। সকালে এলাকায় রটে যাওয়ার পর সালিশটি বসেছিলো।

এই ঘটনা দীর্ঘ দিন আমার বালক মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। আজ যখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব ঘটনাকে নারীনেত্রীদের যবানে মিডিয়ায় প্রচার হতে দেখি, শুনি দোররা আর ফতোয়াবাজির আজগুবি বয়ান; চোখের সামনে ভাসে সেই সকাল, স্কুলের জনাকীর্ণ মাঠের দৃশ্য এবং একবারের জন্যও মাথা না ওঠানো নারীটির বিধ্বস্ত অবয়ব।

এই কি ইসলামী দোররার স্বরূপ?…কিংবা পবিত্র ফতোয়ার?

হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া বিষয়ক ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘ এক যুগ ধরে চলে আসা বিতর্কটির অবসান শুধু নয়, ইসলামী শরীয়ার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিও উচ্চকিত হয়েছে।

ফতোয়ার বৈধতা এবং ফতোয়া প্রদানের অধিকার শুধু বিজ্ঞ আলেমদের- এই সাহসী ও সময়োচিত রায়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালত দেশের সর্বস্তরের মুসলিম জনতার প্রাণের দাবি বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছেন। আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই।

শুরু থেকেই এই কথাটি আলেম সমাজ বহুভাবে বলে আসছেন। কিন্তু গ্রাম্য সালিশের রায় ও দোররা, ধনী কৃষকের মাতব্বরি ও ফতোয়া যে এক নয়- এই সত্যকে বরাবর আমরা উপেক্ষিত হতে দেখেছি।

অবশেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা, শীর্ষ আইনজীবীদের বক্তব্য এবং বিজ্ঞ পাঁচ আলেমের মতামত শুনে আদালত এই রায় দিলেন। এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক যেনো না হয় আমরা সেটাই চাইবো। শাসকশ্রেণী আন্তরিক হলে অনেক আগেই সমাধানটা হতে পারতো। সবকিছু নিয়ে রাজনীতি করার অশুভ চর্চাটা এ দেশে কবে বন্ধ হবে কে জানে!

বাঙালির কাঁধে ‘হুজুগের’ অপবাদ বহুদিনের। শিক্ষার হার বাড়ছে। বাড়ছে সচেতনতা। কিন্তু হুজুগেপনাটা রয়ে গেছে আগের মতোই। যুক্তির বলে দিনদিন আমরা একে বরং প্রতিষ্ঠিতই করছি। ফলে বাড়ছে বৈরিতা ও বিভক্তি। দলে দলে। পরিবারে পরিবারে। এই অনুদার মানসিকতা জাতি হিসেবে আমাদের কোথায় ঠেলে দেবে জানা নেই।

দলের যা সিদ্ধান্ত, নিজের যা সমঝ এ নিয়েই আমরা অহর্নিশ মেতে থাকি। বাজে মনোভাবটাও পিছু ছাড়ে না। বিবেকের চাটুকারিতায় সত্যিকার জাগরণটা তাই খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। শত বছর আগে যে আক্ষেপের কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ- বাঙালি আমরা সেটা বয়ে বেড়াবো আর কতোকাল?…

[ সম্পাদকীয়, নতুন ডাক, জুন ২০১১ ]


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *