তিনি খুবরকম পরিচিত। পরিচিত তার প্রতিষ্ঠানও। এবং এই পরিচিতির ব্যাপ্তি শুধু দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে। বলছি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা। টানা দুই যুগ ধরে তিনি হটলাইনে। জনক-প্রবক্তা-মহাজন ইত্যাদি আলোচনা-সমালোচনায় আবর্তিত হয়েছেন বরাবর।
আমরা অবশ্য শুরু থেকেই তার অবস্থান ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে একপ্রকার অবচেতনই ছিলাম। প্রথম বোমাটি ফাটালো নোবেল কমিটি। বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলতে গিয়েও নোবেল প্রাইজের পাশে বাংলাদেশের নাম দেখে আমরা গর্বিতই হলাম। আবারো ফিরে গেলাম তন্দ্রায়। কিন্তু নাটকের শেষ কিস্তিটি মনে হয় তখনো বাকি ছিলো।
একটি ডকুমেন্টারি করে নরওয়ের একজন গবেষক-সাংবাদিক অবশেষে সেটারই মঞ্চায়ন করলেন। শুরু হলো তোলপাড়। আলোচনা-সমালোচনা, হুমকি-ধমকি এবং আইন-আদালত সব মিলে সৃষ্টি হলো আশ্চর্য এক জট। কে করবে সমাধান?
গ্রামীণ ব্যাংকের সূচনাটা দারুণ। বাগ্মী ড. ইউনূসের জবানিতে শুনতে কবিতার মতো।
জোবরা গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে মাথায় প্ল্যান এলো। মাত্র ৫০ টাকায় যাত্রাও শুরু হয়ে গেলো। চমৎকার টেকনিকে মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নিলেন মোড়ল সংস্কৃতির প্রধান দুই হাতিয়ার- খৃষ্টবাদের নারী এবং ইহুদিবাদের সুদ। এরপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি, বন্ধু-শুভাকাকাঙ্খীদেরও অভাব হয়নি কখনো।
এই নারী ও সুদ এবং কিছু মানুষ ও কিছু জল্লাদের কল্যাণে ভিত গড়ে উঠলো এবং একক হিসেবে প্রতিষ্ঠাও পেলো গ্রামীণ ব্যাংক।
ঋণ, সুদ, ব্যবসা এবং রাবেয়া-সুফিয়াদের বুকচেরা আর্তনাদ সব মিলেমিশে সেখানে একাকার। বহু ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে অবশেষে নোবেল জয়। ক্ষুদ্রঋণ নামে গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণা ছড়িয়ে পড়লো ব্যাপকভাবে এবং ধীরে ধীরে ফাঁক-ফোকরগুলোও বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। তবে দু’ একবার মুখ খুললেও সাহস করে কেউ ঘুরে দাঁড়ায়নি। অকারণে কেঁচো খুড়তে এদেশেও তেমন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ’ শিরোনামে নরওয়ের টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ডকুমেন্টারি এক্ষেত্রে বড় ব্যতিক্রম। সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হলো ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে।
একসময় তা অবশ্য তুলেও নেয়া হলো। কিন্তু ততোদিনে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারও ভালোই প্রতিক্রিয়া দেখালো কথা-কাজে। পদ হারালেন ড. ইউনূস। নতুন নায়ে পা দিতে বাধ্য হলো গ্রামীণ ব্যাংক। তবে যে প্রক্রিয়ায় এগুলো হলো, পরবর্তীতে সরকার এবং ড. ইউনূসের নিজের নেয়া পদক্ষেপগুলোও যেরকম; তাতে পুরো দেশবাসী বিব্রত। বিরোধী দল আর মিডিয়ার ভূমিকা এক্ষেত্রে আরো বিতর্কিত। আবারো কেন এমন হলো?
দেশ-জাতির ইমেজের সাথে জড়িত ব্যাপারগুলোর সুন্দর সুরাহা এখনো কেনো করতে পারি না আমরা?
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যক্রম-সাফল্য সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। মুসলিম প্রধান এই দেশে তিনি সুদ আর নারীর মতো আগুন নিয়ে খেলেছেন। তাই দেশবাসীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তিনি কখনো পাননি, নোবেল জয়ের পরও না। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তার নামের সাথে দেশের ইমেজের প্রশ্ন জড়িত।
তাই সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত আইনানুগ হলেও আমরা তা চাইনি। অন্তত এভাবে না। ড. ইউনূস সাহেবও সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে দেশকে প্রতিপক্ষ বানালেন কী করে? ব্যক্তিগত স্বার্থ-প্রতিহিংসার এ খেলায় তারা দেশের যে ক্ষতি করলেন জাতি কি তা ক্ষমা করবে?
এই প্রেক্ষাপটে বিরোধী দল ও মিডিয়ার ওপর বড় একটা দায়িত্ব বর্তেছিলো। তারা ব্যর্থ হলেন। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার মতো অপরিণত কাজ তারা এক্ষেত্রেও করলেন এবং কোনো কিছু না ভেবেই। অতীতের অবস্থান ছেড়ে এসে কেউ মাথায় তুললেন, কেউ উদ্যত হলেন নর্দমায় ছুড়ে ফেলতে। ফলে পানি আরো ঘোলা হলো।
ক্ষতি যা হবার হলো দেশের। ইমেজ যা নষ্ট হবার হলো জাতির। কী আশ্চর্য, দেশ-জাতি-ভবিষ্যৎ সব ভুলে আমরা মেতে উঠলাম কাদা ছোঁড়ার অর্থহীন মিছিলে!
সম্পাদকীয়, নতুন ডাক। মে-২০১১ইং
Leave a Reply