বিশ্বজুড়ে আল্লামা ইকবাল এক পরিচিত নাম। মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠতম কবি তিনি।
পাঞ্জাবের সেয়ালকোট শহরে ১৮৭৭ সালের ৯ই নভেম্বর জন্ম নেয়া এই কবি ২২ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৮৯৫ সালে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে চলে আসেন লাহোরে। ততোদিনে কাব্য রচনায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠা ইকবাল লাহোরের বিভিন্ন কবি সম্মেলন ও সাহিত্য সভায় যোগ দিয়ে কবিতা পাঠ করতে থাকেন। ক্রমেই তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তখন তার ‘নালায়ে ইয়াতিম- অনাথের বিলাপ’ কাব্য সমঝদারদেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো। হতাশাগ্রস্ত জাতি, অস্থির পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান অধ:পতন, মুসলিম বিশ্বের শোচনীয় পরিস্থিতি ইকবালকে মুসলিম জাগরণের কাব্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
ঘুণেধরা মুসলিম মানসে ঈমানী ঐক্যের চেতনা জাগাতে তিনি লিখেছেন-
‘আরব আমার চীনও আমার, পর নহে সেও হিন্দুস্তান
মুসলিম আমি বিশ্বপ্রেমিক ওয়াতান আমার সারাজাহান।
-গোলাম মোস্তফা’র অনুবাদ থেকে।
এভাবেই কবি ইকবাল মুসলিম বিশ্বকে ঈমানী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ এক জাতি হিসেবে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন আজীবন।
ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি বুলালে দেখা যায়, ইকবালের সময়ে তুর্কি সা¤্রাজ্য নামমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ছিলো। ইউরোপ থেকে ইসলাম ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছিলো। রাশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে গ্রাস করে নিচ্ছিলো রুশ স¤্রাট। চীনের মুসলিমরা নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা হারিয়ে হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলো। ব্রিটিশরা দখল করে রেখেছিলো মুসলিম অধ্যুষিত মিসরকে। ইরান ইরাকের ঐতিহ্য মুছে যাচ্ছিলো। স্পেন থেকে মুসলিম শাসনের রূপ-রস-গন্ধ মন্দ ছন্দে ঢেকে যাচ্ছিলো দিনদিন।
এ বিষয়গুলো সত্যিকারের একজন মুসলমানের মতো ইকবালকেও মর্মাহত করে তুলেছিলো। তাই সে সময়ে যেসব তরুণ মুসলিম মুক্তি আন্দোলনের অগ্রসেনানির ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মহাকবি ইকবাল। ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন মুসলিম জাতিকে কাব্যের চাবুক মেরে বারবার জাগিয়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। কবি গোলাম মোস্তফা অনূদিত “তারানায়ে মিল্লি’ কবিতায় আমরা তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই-
‘আমার সিনায় লুকানো রয়েছে পাক আমানত তৌহিদের
হিম্মত কার দুনিয়া হইতে মিটায় আমার নাম নিশান।’
কিংবা
‘সেদিনের কথা মনে আছে কিগো আন্দালুসের হে গুলবাগ,
যেদিন তোমার শাখায় শাখায় বাসা বেঁধে মোরা গাহিনু গান।’
বালাদ ই ইসলাম কবিতায় আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তার দিল জগানো গানগুলো-
‘দিল্লী- সে আমাদের ব্যথা মসজিদ
এখানে ঘুমায় কত আশা উম্মিদ
এ পাক যমিন কেন পাবে নাকো মান
এখানে রয়েছে কত মহিমার দান’
কিংবা-
‘দিল্লীই শুধু নহে বাগদাদও ভাই
মুসলিম গৌরব মহমার ঠাঁই’
কিংবা-
‘কর্ডোভা আমাদের ছিলো আঁখিনূর
মাগরীবি যুলমাতে যেন কোহেতুর’।
আজি আর নাই তার শিখা সে জ্যোতির
মরীচিকা ছেয়ে আছে নব প্রগতির।
ইউরোপে দিল আলো দীপ শিখা যার
সে দীপ নিভিয়া গেছে নেমেছেআঁধার।
এভাবে হারানো মুসলিম ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া মরণপ্রায় জাতির ঈমান জাগানিয়া শতশত কবিতায় সমৃদ্ধ হয়ে আছে ইকবালের কাব্যভা-ার। ইকবাল শুধু একজন কবি এবং দার্শনিকই ছিলেন না, তিনি দূরদর্শী একজন রাজনীতিকও ছিলেন।
নর-নারীর প্রেম-বিরহ, ফুলপাখি, নদী; জীবনের সুখ-দু:খের মত মামুলি বিষয়বস্তু ছেড়ে কাব্যে দার্শনিকতার এক নতুন ফটক উন্মোচন করেছেন ইকবাল। তিনি কাব্যকে করেছেন জাতি গঠনের হাতিয়ার। তিনি উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় জাতিকে যে কাব্যভা-ার উপহার দিয়ে গেছেন, তা সম্পূর্ণ কুরআন-হাদীস ও ইসলামি ইতিহাস ঐতিহ্যের সারমর্ম। ইকবালের রচনা জুড়ে আছে ইসলাম। ফারুক মাহমুদ অনূদিত ‘যরবে কলীম’সহ বহু কবিতা এর স্বাক্ষ বহন করে।
‘ইসলামের রুহ হলো অগ্নি আর আলোক খুদীর
আর সে খুদীর অগ্নি অস্তিত্ব ও আলো জিন্দেগীর।’
আব্দুল মান্নান তালিব অনূদিত ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, কবিতায় চিত্রিত হয়েছে একই দৃশ্য-
‘খুদীর গোপন রহস্য লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
খুদী তরবারি শানপ্রস্তর তার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
এ যুগ সন্ধানে ফেরে তার ইবরাহিমের
সারাটা দুনিয়া হলো বুতখানা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’
আল্লামা ইকবাল মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের মঞ্চে একত্রিত করতে মৃত্যু পর্যন্ত কলমযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। তার আশা ছিল, অচিরেই ইসলামের হারানো গৌরব ফিরে আসবে। আবার বুক-মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে ইসলাম।
এ আশাই বিবৃত হয়েছে সোলায়মান নদভীকে লেখা তার এক চিঠিতে। তিনি লিখেছেন-
‘সে সুপ্রসন্ন সময় অতি নিকটে যখন এ অঞ্চলে মুলিমরা শত শত বছরের গোলামির জিঞ্জির ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। নিরাশার অন্ধকার ফুঁড়ে হেসে উঠবে আশার আলো। পৃথিবীর সব শক্তির উপর শক্তিমান হয়ে উঠবে ইসলাম। মানবরচিত সব আদর্শকে পরাজিত করে বিশ্বব্যাপী বিজয়ী হবে ইসলামী আদর্শ।’
ইকবালের কবিতা আমাদের এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য করে যে, কবিতাও হতে পারে দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম।
حکمت از قطع و برید جامہ نیست مانع علم و ہنر عمامہ نیست
‘জ্ঞানচর্চা জামা-কাপড় কেটে ছোট করায় নিহিত নয়,
পাগড়িও নয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথের কাঁটা।’
কুরআন ও হাদীসকে উপজীব্য করে লেখা তার কবিতা কখনো মুয়াজ্জিনের ভূমিকা নিয়েছে, আবার কখনো দরদী মুবাল্লিগের ভূমিকা নিয়ে ঘুমন্ত জাতিকে জাগানোর চেষ্টা চালিয়েছে।
রুহুল আমীন খান অনূদিত ‘ তুলূয়ে ইসলাম’ কবিতায় আমরা এমনটাই দেখতে পেয়েছি-
‘তুমি খোদার হস্ত বাণী খোদায়ী তেজে শক্তিমান
সকল দ্বিধা দূর করে ফের দাঁড়াও উঠে মুসলমান
তোমার বুকের রাঙা খুনে বিশ্ববাসী রঞ্জিত
মুসলমানের আজানধ্বনি করলো জগৎ সজ্জিত’।
ইকবালের কবিতা দার্শনিক চিন্তাধারা ও আদর্শিক মতবাদে পরিপুষ্ট হলেও তা মানবীয় সকল উপদানে সমৃদ্ধ। তাই তার কাব্যে গোটা বিশ্বের, সকল ধর্ম-বর্ণের কাব্য সমালোচক ও বোদ্ধা পাঠকেরাও কাব্যখোরাক খুঁজে পেয়েছেন, এ কথা র্নিদ্ধিধায় বলা যায়।
মুসলিম জাগরণের অমর যোদ্ধা এ মহান কবি ১৯৩৮ সালের ২৫ শে অেেক্টাবর মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ এপ্রিল আল্লাহর সান্নিধ্যে পারি জমান। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তার জবানে উচ্চারিত হয় “আল্লাহ’ এবং মুচকি হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার ঠোঁটজোড়ায়।
আল্লহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, আমীন!
Author: সায়ীদ উসমান
Source: Natun Dak
Leave a Reply