আঁধার থেকে আলোর পথে
আমি কিছু একটা খুঁজছিলাম। তবে বছরের পর বছর অপেক্ষার পরও সেটা পাই নি। সব কেমন শূন্য শূন্য মনে হতো আমার কাছে।
আমি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। নিজেকে আমি বন্ধুদের সাথে মেলাতে পারতাম না। কারণ আমার বন্ধুদের ব্যাপার ছিলো অনেকটা এমন- ওহ, আজ তো ছুটি। আজ জম্পেশ একটা পার্টি দেয়া দরকার। চলো বিয়ারের প্রথম বোতলটা ছিপিমুক্ত করি। চলো কাজের পোশাক বদলে পার্টি পোশাক পরে নিই। উদযাপন সর্বস্ব উদ্দাম এক জীবন। হ্যাঁ, আমার জন্য এটা কঠিন সময়ই ছিলো বলতে হবে।
এরপর হঠাৎ করেই কী একটা ঘটে গেলো। আমার পৃথিবীটা পুরোই বদলে গেলো।
দুবাইয়ে চাকরির প্রস্তাব
আমি ভ্রমণে ব্যাপক অভ্যস্ত ছিলাম। বয়সে যখন আমি ত্রিশে পৌঁছে গেলাম, মনে হলো- এবার তো আর বসে থাকা যায় না। কোথাও সেটেল হতে হবে। আমি বাড়ী ফিরলাম এবং একটা চাকরি খুঁজতে লাগলাম। তবে পাচ্ছিলাম না। অপেক্ষায় না থেকে ভাবলাম- এভাবে বসে না থেকে বরং কোথাও একটু বেড়িয়ে আসা যাক। এরপর খুব না ভেবে আমি আমি আরব রাষ্ট্র দুবাইয়ে বেড়াতে চলে গেলাম।
আমি দুবাই এলাম এবং দু’ সপ্তাহের ব্যবধানে একটা চাকরির প্রস্তাবও পেলাম। আমার বাবা-মা বিষয়টা নিয়ে খুবই ভীত হয়ে পড়লেন। এক সময়ের আমার মতোই- আমার বাবা-মাও এ ব্যাপারে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলেন যে পশ্চিমা কোনো মেয়ে আরবে যাবে এবং সেখানে চাকরি করবে! অবশ্যই আমরা সবাই এমনই ছিলাম কারণ যেসব ঘটনা প্রতিনিয়ত আমরা শুনতে পেতাম
এবং সময়টাও ছিলো ২০০১ এর শেষের দিকে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন ৯/১১’র ঘটনা নিয়ে তখন কেমন তোলপাড় চলছিলো। চারপাশে যা ঘটছিলো, খারাপ কিছুর আশংকায় আমরা সবাই তখন তটস্থ থাকতাম।
আমি এরপর একসময় মুসলিমদের সাথেও সময় কাটিয়েছি। এটা শুরু হয়েছে যখন আমার ভাই ইসলাম গ্রহণ করলেন। আমাদের বিবেচনায় তার মুসলিম হবার মূল কারণ ছিলো তিনি একজন তুর্কি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। সুতরাং তার বোন হওয়ায় এবং তার সিদ্ধান্তে তাকে অটল রাখার কামনা থেকে আমরা ইসলামিক সেন্টারগুলোতে গিয়েছি। নিঃসন্দেহে সব রকম কুসংস্কার পেছনে ফেলে আমি এটা করেছি।
ভাইয়ের সাথে ইসলামিক সেন্টারে
আমি ভাইয়ের সাথে ইসলামিক সেন্টারগুলোতে গিয়েছি। কিছু আলোচনায় অংশ নিয়েছি। তার সাথে কিছু বইও পড়েছি। তবে সেটা কখনো আমার জন্য এমন উৎসাহমূলক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় নি যে আমি ভাববো- এবার আমাকে ইসলাম গ্রহণ করতেই হবে। জানতে-পড়তে ভালো লাগতো, ব্যস- এতোুঁকুই। এরপর আমি একটি ইসলামী দেশে এলাম।
এই প্রথম আমি মুসলিমদের সঙ্গ উপভোগ করলাম সম্পূর্ণ নতুনভাবে। হঠাৎ করে আমার মনে হতে শুরু করলো- তারা সত্যিই অসাধারণ।
মুসলিমরা সত্যিই আপনাকে খুব শ্রদ্ধার সাথে সঙ্গ দেবে। আমি এতে খুব স্বস্তি বোধ করলাম। ইতোপূর্বে আমি মিশেছি কেবল ইউরোপিয়ান বা এমন জাতির মানুষদের সাথে যাদের সাথে আমি স্বাচ্ছন্দ্যে মিলতে পারি। আমি সবসময় একটা নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ খুঁজতাম। মাঝে এমন একটা সময় গেলো যে আমি আর সে স্বস্তিদায়ক ক্ষেত্রটা খুঁজে পেতাম না। এখন এসে দুবাইয়ে যেটা পেলাম।
ইসলাম গ্রহণ
ছ’ মাস পূর্বে আমি কালিমা পাঠ করেছি। বোরকা পরা শুরু করেছি। আমি প্রথম থেকেই বোরকা পরার ব্যাপারটাকে ভালোবাসতাম। তবে এড়িয়ে গেছি কারণ, ভাবতাম ইসলাম গ্রহণ না করেই এটা পরা শুরু করলে আরবরা আবার এটাকে নিজেদের জন্য অবমাননাকর মনে করে কিনা! আমি একজন সাদা পশ্চিমা মেয়ে হয়ে বোরকা পরে ঘুরবো এটা সবাই ভালোভাবে নাও তো নিতে পারে।
আমার সাবেক স্বামীর ব্যাপারটাও তখন একটা ফ্যাক্ট ছিলো। তিনি তখনও আমার স্বামী।
তবে আমার কাছ থেকে একপ্রকার ফেরার ছিলেন কারণ আমাদের বিয়ে যেভাবেই হোক একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাই ধীরে ধীরে আমিই তার থেকে একটা দূরত্ব তৈরি করি। আমরা বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপার নিয়ে আলাপ করতাম। আমি সবসময় তাকে নিজ দায়িত্বে সরে যেতে অনুরোধ করতাম এবং সে তা অস্বীকার করে বলতো- ‘না, তুমিই আমার স্ত্রী। আমি তোমার সাথে আরব দেশেই থাকতে প্রস্তুত। আমি তখনই সরে যাবো যখন আমার সিদ্ধান্ত নিতে ইচ্ছে করবে। আমি তো পুরুষ, সুতরাং সিদ্ধান্তটা আমারই।’
আমার ইসলাম বিষয়ক পড়াশোনাও তখন যথেষ্ট গতি পেয়েছিলো। এসব ঘটনার মধ্যেই একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে আমি ভাবলাম এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম- আজই আমি মুসলিমা হয়ে যাবো। সে মোতাবেক আমি গোসল করলাম। ভালো কাপড় পরলাম। কাজে গেলাম। কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না। সিদ্ধান্তটা কেউ জানলোই না। কাজ শেষ করে আমি আমার মতোই একজন জার্মান নারীর কাছে গেলাম যে ৭ বছর পূর্বেই ইসলাম গ্রহল করেছে। আমি কালিমা পাঠ করলাম।
কালিমা পাঠ শেষে আমি যখন বাসায় ফিরলাম, আমার কাছে তখন এর অর্থ ছিলো এমন- আমি বাসায় ফিরেছি এবং আমার একান্ত কাছের মানুষ আমার হাজবেন্ডও তখনো জানে না আমি ইসলামে দীক্ষিত হয়ে গেছি।
আমি তাকে জানাই নি কারণ বিগত ছ’ মাস ধরে টানা তাকে আমি জিজ্ঞেস করে আসছিলাম কখন তুমি আমার থেকে পৃথক হবে? আমি ভাবলাম আজ তাকে আবারো বলবো- সুতরাং কখন তুমি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে? তবে ঘটনা তখনই ঘটলো।
সুবহানাল্লাহ, সেদিন জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে সে বললো- ঠিক আছে, আমি আজই তোমাকে ছেড়ে যাবো।
আমি ইতোমধ্যেই কাপড় গুছিয়েও রেখেছি। এটা নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আমার জন্য একটা বিশেষ পুরষ্কার ছিলো। আমি আরো নিশ্চিত হলাম- আমার সিদ্ধান্ত সর্বোতভাবে সঠিক।
ইসলাম আমায় সাহসী ও সুদৃঢ় করেছে
আমি ২০০৯ এর ২৫ জুন শাহাদাহ পাঠ করি। কেবল সেদিনটি ছাড়া পুরো বছরটা আমার জীবনের সবচে বাজে একটা সময় ছিলো। আমার পূর্ব জীবনে ঘটে যাওয়া বিশ্রী ও ঘৃণ্য সব কাজ প্রতিনিয়ত আমায় কুড়ে কুড়ে খেতো। আমি সেসব ভাবনা পাশ কাটাবার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যেতাম এবং ভাবতাম একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।
তবে কখনো এমনটা মনে হয় নি যে আমি আমার বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছি। আলহামদুলিল্লাহ, এখনো পর্যন্ত এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন নিজের মনে প্রশ্ন জেগেছে- কেনো আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম? এটা কখনো আমার কাছে কোনো অপশন ছিলো না।
আমার সাথে তখন যা ঘটেছে সবই ছিলো প্রতিকূল ও বিপরীতমুখী। এটা আমাকে আরো সাহসী ও সুদৃঢ় করেছে। এবং এসময় আমি আরো বেশি করে ইসলামকে জানা শুরু করলাম।
সবাই ভাবে, কেউ যখন ধর্মান্তরিত হয় তখন কেবল শাহাদাহ পাঠ করে। আপনি সামান্য কুরআন পড়লেন, সে মুগ্ধতা থেকেই শাহাদাহ পাঠ কররেন এবং তাতেই সীমাবদ্ধ থাকলেন সেটা কোনো ভালো খবর হতে পারে না।
আমার ব্যাপার ছিলো- যতো বেশি বাধা ও প্রতিবন্ধকতা আমার সামনে এসে দাঁড়াতো আমি ততো বেশি করে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতাম এবং বেশি বেশি নলেজ অর্জন করতাম। এটা আমার জন্য সত্যিই বেশ কঠিন একটা বছর ছিলো।
এসময়, আমার বন্ধুরা হঠাৎ করে আমার শত্রুতে পরিণত হয়। আমার জীবন দ্রুত খাদে আটকে যেতে শুরু করে।
তখন আমার একটা মাত্র বন্ধু আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার নাম কেটি এবং সত্যিই সে আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। আমার ব্যাপক পরিচিত মহলের মধ্যে কেবল সেই আমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। অন্য সবাই তখন আমার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিলো এবং তারা আমার সিদ্ধান্তে বিমূঢ় ও বাজেরকমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো।
আমি জানতাম একমাত্র কেটিই তখন আমার পাশে আছে এবং প্রয়োজনে মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে হলেও তার সাথে আমি কথা বলতাম। আমি আল্লাহর কাছে বরাবরই শুকরিয়া জানিয়েছি আমাকে এমন একজন বন্ধু উপহার দেয়ার জন্য।
পশ্চিমা বিশ্বের বাস্তবতায় নতুন ধর্মে দীক্ষা নেয়ার পরবর্তী অবস্থাটা অন্য কারো পক্ষে আন্দাজ করাও মুশকিল।
কেটি সব বিষয়ে আমাকে ব্যাপক সাহায্য করলেও সে নিজে তখন মুসলিম ছিলো না। সে দ্বিধান্বিত ছিলো। আমার মনে পড়ে- একবার আমার সাবেক স্বামীসহ কেটির সাথে আমি লাঞ্চ করতে যাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা যদিও এখন কাঁটার মতো হৃদয়কে বিদ্ধ করে তবু এটা ঘটেছিলো।
আমরা গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম এবং সেটা ছিলো জুমাবার। আমরা দুবাইয়ের আলখাউর এরিয়া অতিক্রম করছিলাম তখন দেখলাম বহু ছাদ খোলা গাড়ি যাচ্ছে। ত্রিশ জনের মতো করে মানুষ ঠাসাঠাসি করে একটা গাড়িয়ে দাঁড়িয়ে জুমা পড়তে যাচ্ছে। কনভয়ের মতো দেখতে হওয়ায় ব্যাপারটা নিয়ে আমরা প্রচুর হাসাহাসি করছিলাম। আমরা খুব হাসছিলাম আর ভাবছিলাম এভাবে বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে জুমা পড়তে যাওয়াটা কতোুঁকু যৌক্তিক?
তারা কেনো এমনটা করছে? শুধুমাত্র নামাজের জন্য কেনো তারা নিজের নিরাপত্তা ও জীবনকে বিপদের মুখে ফেলছে?
ঘটনাক্রমে গাড়িই পুরো আলোচনাই তখন ধর্ম নিয়ে হচ্ছিলো। আমার এখনো মনে পড়ে- কেটি বলেছিলো, আমি ধার্মিক নই তবে যদি আমি কোনো ধর্মকে নিজের জন্য বাছাই করতাম সেটা নিশ্চিতভাবে হতো ইসলাম। শুনে গাড়ির সবাই হেসে দিলো। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কেনো তুমি ইসলাম গ্রহণ করতে? দেখো না এরা কেমন কপট ও ভ- চরিত্রের হয়?
সেদিন এসব নিয়ে ব্যাপক কথা হয়েছিলো। তবে সেদিনের সে ঘটনার পর থেকেই বিস্ময়করভাবে আমি ও কেটি আরো বেশি বেশি করে ধর্ম বিষয়ক পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। সুতরাং সন্দেহ নেই সেদিনের সে আলোচনা একদিকে যেমন কষ্টের, তেমনি আনন্দেরও।
বৈরী অবস্থা থেকেই আমরা ইসলাম সম্পর্কে জেনেছি
বৈরী অবস্থা থেকেই আমরা ইসলাম সম্পর্কে জেনেছি। বুঝতে চেষ্টা করেছি। এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহে সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে সক্ষম হয়েছি। ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র সঠিক ও সত্য ধর্ম। স্বস্তি, শান্তি, স্বাধীনতা ও মুক্তি কেবল ইসলামেই সম্ভব।
নারীবান্ধব পৃথিবীর একমাত্র ধর্মও ইসলাম।
আল্লাহ পাক আমাদের ইসলামের প্রতি অটল থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন!
Leave a Reply