বিস্ময়কর বাস্তবতা
একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার। বাকস্বাধীনতা, সমানাধিকার, অস্ত্রমুক্ত শান্তিময় বিশ্ব ইত্যাদি আরো যেসব শ্লোগান পশ্চিমা মিডিয়া, বিভিন্ন সংস্থা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিত্য ব্যবহার করে, সেগুলো বিশ্ববাসীকে মুলো দেখানো ব্যাপার ছাড়া কিছু নয়। ভাবতে অবাক লাগে-
১৯৯৯ সালেই প্রতি ৩৪ মিনিটে একটি খুন, প্রতি ৬ মিনিটে একটি ‘বলপূর্বক’ ধর্ষণ, প্রতি ৩৩ মিনিটে একটি শারীরিক নিগ্রহ এবং প্রতি ২২ মিনিটে একেকটি সহিংস অপরাধ সংঘটনের মতো ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় দুরাবস্থার পরিসংখ্যান মাথায় নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব দেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস দেখিয়েছে।
এখন পর্যন্ত তারা খুবরকম সফলও। আর এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রধান এবং এখন পর্যন্ত বিকল্পহীন সহযোগী আজকের ইউরোপ।
ঔদ্ধত্য না মূর্খতা?
চল্লিশ ফুট চওড়া রাস্তাটি সরলরেখার মতো সোজা সামনে এগিয়েছে। পেছনে ডান-বাম দিক থেকে আরো দুটো রাস্তা এসে এই চত্বরেই মিলিত হয়েছে। স্বচ্ছ স্ফটিকের মৎস্যকন্যাসদৃশ বিশাল এক নারীমূর্তি চত্বরটিকে এনে দিয়েছে বিশেষ মহিমা। শহরের ব্যস্ততম এ চত্বর মাড়াতে প্যারিসবাসীকে প্রায়দিনই বেশ ক’মিনিট সময় খরচ করতে হয়।
আজ অবশ্য রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। পূর্বদিকের বড় রাস্তাটি তো পুরোই ফাকা। গাড়ির বদলে এখানে আজ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছেন। চত্বরকে পেছনে রেখে বিশাল এক মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় কোনো দিবস বা উৎসব হলে এখানে মাঝে-মধ্যে মঞ্চ তৈরি করা হয়। এলাকাবাসী একত্র হয়ে আনন্দ-উল্লাস করেন, নেচে-গেয়ে উদযাপন করেন বিশেষ সে দিবস বা উৎসব।
আজকের দিনটি অবশ্য কোনো জাতীয় দিবস নয়, উৎসবের বিশেষ কোনো উপলক্ষও নেই। তবু এখানে মঞ্চ স্থাপন, শ’ তিনেক মানুষের জটলা এবং মিডিয়ার বাড়াবাড়ি উপস্থিতি সাধারণ পথচারীদের কৌতূহলী করে তোলে। উচ্চ ভলিউমে তুমুল উত্তেজনা ছড়ানো বক্তৃতা শোনার জন্য তারাও একপাশে জড়ো হন। বিশাল মঞ্চের ডান পাশে মাইক্রোফোন হাতে বক্তব্য দিচ্ছেন মধ্যবয়সী এক লোক। মঞ্চের পেছনেই সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে শোকের কালো বর্ণে ছাপা বিশাল এক ব্যানার।
তাতে অস্বাভাবিক বড় বোল্ড অক্ষরে লেখা- ‘স্টপ ইসলাম’। স্টপ ইসলাম- ইসলামকে থামিয়ে দাও! ব্যানারের দু’ পাশে ও নিচে ছোট অক্ষরে আরো কী সব লেখা, দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না।
আশপাশে তাকিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের প্রায় সবার গায়ে একইরকম টি-শার্ট দেখা গেলো। সাদা টি-শার্টের সামনে পেছনে লাল রঙে ক্রস চিহ্নিত মসজিদের ছবি। বক্তার কথাগুলোও এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কণ্ঠে সমান উত্তেজনা ধরে রেখে ক্ষোভ আর ঘৃণাভরে তিনি বলে যাচ্ছেন- …
‘আমাদের শান্তিময় সমাজে যাবতীয় বিশৃঙ্খলা, অশান্তি আর সন্ত্রাসের জন্য এই ইসলামই দায়ী। সুতরাং আজ এ মুহূর্ত থেকেই ইসলামের গতিকে চূড়ান্তভাবে থামিয়ে দিতে হবে। আর কোনো মসজিদ নির্মাণ চলবে না। কার্যক্রম সীমিত করে বড়জোড় ঐতিহ্য হিসেবে কয়েকটা মসজিদ রেখে বাকিসব ধ্বংস করে দিতে হবে। সন্ত্রাসের আখড়া ধ্বংস করে সে স্থানে নির্মাণ করা হবে শান্তির প্রতীক প্রভু যিশুখৃষ্টের ক্রুশচিহ্নিত চার্চ। আমাদের সমাজ ও কালচারের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে যারা বসবাস করতে পারবে কেবল সেরকম মডারেট মুসলিমদেরই আমরা এদেশে থাকার অনুমতি দেবো। আর কোনো সন্ত্রাসী যেনো এই জনপদে আশ্রয় না পায় বা জন্ম না নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করাই হবে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য’।…
কিছু পথচারী অবাক হন। অমন অবাক তারা আর কখনো হন নি। ক’মিনিটের দেখা এবং শোনা বিষয়গুলো তাদের বিমূঢ় করে দেয়। ভয়ে বুক কাঁপে।
কী আশ্চর্য- আল্লাহর যমিনে দাঁড়িয়ে, আল্লাহর রিযিকে বেড়ে উঠে, আল্লাহর দেয়া আলো-হাওয়ায় বেঁচে থেকে মানুষ নামের এই দুর্বল জীবগুলো কিনা আল্লাহর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করছে!…
খবর- পেগিডা নামে পরিচিতি পাওয়া একটি সংগঠন শার্লি এবদোয় হামলার ঘটনার আগে-পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমন অজ¯্র সমাবেশ-মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। অনলাইনে তৎপরতার পাশাপাশি এখনো সুযোগ পেলেই পথসভা আয়োজনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
ফ্রান্স, বিশেষত জার্মানিতেই তাদের দৌরাত্ম তুলনামূলক বেশি।
ইতিহাসের পথে…
৭১১ খৃষ্টাব্দ। বিজিত হলো স্বপ্ন আর গৌরবের দেশ- স্পেন। আফ্রিকা হয়ে ইউরোপের এই পূর্ব অংশে ইসলামের ঝা-া ওড়াতে মুসলিম বীরদের লড়াই চালিয়ে যেতে হলো চার যুগেরও বেশি সময়। কালিমার পতাকাবাহী মুজাহিদদের জন্য মরক্কোর ‘জিব্রাল্টার’ প্রণালী যেমন স্পেনের পথ সুগম করেছিলো, স্পেন খুলে দিলো পুরো ইউরোপের দরজা। এই বিজয়ের প্রধান সিপাহসালার মুসা বিন নুসাইর (তারেক বিন যিয়াদ ছিলেন তার অধীনস্থ কমান্ডার) এবার ফ্রান্সের দিকে দৃষ্টি দিলেন। সামনে আপাতত একটাই বাধা- স্পেন-ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী পির্যানিস পর্বতমালা।
তবে- ইতিহাস স্পেনবিজয়ী এই বীর মুজাহিদের নামের পাশে আর কোনো সাফল্য লিখে রাখার সুযোগ পায় নি। অপর কালজয়ী মুসলিম সেনানী তারেক বিন যিয়াদের বীরত্বপূর্ণ সহযোগিতায় স্পেনবিজয়টাই তার জীবনের সেরা এবং শেষ সাফল্য হয়ে রইলো। অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অচেনা সংস্কৃতির নতুন একটা দেশকে গুছিয়ে তোলার গুরুদায়িত্ব সামলে গভর্নর থাকার বছর দুয়েকের মধ্যে নতুনভাবে বিশেষ কিছু করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
৭২১ সালে স্পেনের নতুন গভর্নর হয়ে এলেন আরবের আরেক বীর- আবদুর রহমান আল গাফিকি। দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই ফ্রান্স হয়ে সেন্ট্রাল ইউরোপে কালিমার দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়াকে তিনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিলেন। এক বছরের মাথায় ৭২২ খৃষ্টবর্ষেই তিনি পির্যানিস পর্বতমালা মাড়িয়ে ফ্রান্সে ঢুকে পড়লেন। অল্প সময়ে ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চল দখল করে নিলেন। তবে উমাইয়া খিলাফাতের ঘন ঘন গভর্নর বদলানোর ধারায় দু’বছরের মধ্যে তিনিও এখানকার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেন।
সময় যেতে থাকলো, বছরে বছরে নতুন গভর্নরেরা এসে অভিযান অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যের সম্মিলিত বাহিনীর পাশাপাশি এসময় তাদেরকে কঠিনতম মোকাবেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছিলো ফ্র্যাঙ্কস বা ফিরিঙ্গি বাহিনীর।
যুদ্ধেরই অংশ হিসেবে জয়-পরাজয়, সামনে-পেছনে করে দশ বছরের মাথায় ৩২২ সালের অক্টোবরে দুই পক্ষ মুখোমুখি হলো চূড়ান্ত লড়াইয়ের। ঘটনাক্রমে তখন আব্দুর রহমান আল ঘাফিকিই ছিলেন পুনর্বার নিয়োগ পাওয়া গভর্নর ও সিপাহসালার। টানা আট দিনের লড়াইয়ে এক অসম যুদ্ধে চার্লস মার্টেলের নেতৃত্বে ফিরিঙ্গি বাহিনীর কাছে পরাজিত হলো আবদুর রহমানের মুসলিম বাহিনী। প্রায় চার লাখ সৈন্য নিয়ে নিজেদের পরিবেশে, পাহাড়ি অঞ্চলের আড়ালসহ অন্যসকল সামরিক সুবিধা নিয়ে ফিরিঙ্গিরা লড়াই চালিয়ে গেলো মাত্র ৫০ হাজারের (কিছু সূত্রে ত্রিশ হাজার বা তারও কম) সংখ্যার, রসদ ও পেছনের সাহায্য না পাওয়া কেবল ঈমানের বলে বলীয়ান মুসলিম বাহিনীর সাথে এবং এড়াতে পারলো পরাজয়। ইউরোপকে ফেলে রেখে শহীদ আবদুর রহমানের লাশ কাঁধে পিছু হটতে বাধ্য হলো ছোট্ট সংখ্যার মুসলিম মুজাহিদীন।
এর আগে-পরে নানাসময় ফ্রান্সে বহু অভিযান পরিচালিত হয়েছে, তবে ওয়্যার অব টুওয়ারস বা মা’রেকাতু বিলাতিশ শুহাদা খ্যাত এই অভিযানটাই ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম ও শেষ উল্লেখযোগ্য অভিযান। ব্যতিক্রম ছাড়া এরপরের পাঁচ-সাত শ’ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়- স্পেন-পর্তুগালসহ আশপাশের বিজিত অঞ্চলগুলোর অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন আর সাজ-সজ্জা বৃদ্ধির প্রতি সৌখিন-শিল্পপ্রিয় মুসলিমদের যতো মনোযোগ, ততোটাই অনীহা ফ্রান্স হয়ে সেন্ট্রাল ইউরোপে ইসলামের বিজয় অভিযান পরিচালনায়। ফিরিঙ্গি বাহিনি, সম্মিলিত কুফরি শক্তি, নিজেদের দুর্বলতা কিংবা একান্তই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা- কারণ যাই হোক,
স্পেন-ফ্রান্সের সীমান্তঘেষা পির্যানিস পর্বতমালা ইসলামের ইতিহাসে আজও অলঙ্ঘনীয় একটা দেয়াল হয়েই রয়ে গেলো।
Leave a Reply