ইউরোপের ইসলামী যুগ
তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনের রচয়িতা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ. তার ইলমি জাওয়াহেরে বিশেষ এক প্রসঙ্গে ইউরোপের তৎকালীন বাস্তবতা তুলে ধরে লিখেন-
বিজয়ী বেশে ইসলাম যখন পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ করলো এবং আন্দুলুস ও পর্তুগাল তাদের শাসনাধীনে চলে এলো, তো অর্ধ শতাব্দী পেরোবার আগেই এখান থেকে প্রচলিত বারবারি ভাষা উঠে গেলো এবং এই অঞ্চল একটা সাধারণ আরব রাষ্ট্রেরই অংশ বনে গেলো।
শুধু ভাষাই নয় তারা ইসলামী সংস্কৃতির অনুসারী এবং ইসলামী সভ্যতার ধারক হতে পারা নিয়ে গর্ব করে ফিরতো। আর শুধু এ দুটো রাষ্ট্রই তো নয় বরং ফ্রান্সসহ আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতেও ভালো করেই এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিলো।
মিশরের মাজমায়ে ইলমির প্রধান শায়খ মুহাম্মদ কারদ আলী মিসরি আন্দুলুস এবং পর্তুগালে ভ্রমণকালে আশ্চর্য সব ঘটনার মুখোমুখি হন। তিনি সেখানকার অতীত ও বর্তমান হালাত নিয়ে তার সফরনামায় বলেন-
‘ইসলামের অধীনে চলে আসা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোই শুধু নয়, চারপাশের রাষ্ট্রগুলোও ইসলামের ভাষা এবং সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলো। লাতিন, জালালাকা এবং নারফারিউনের বোদ্ধা লোকেরাও আরবী ভাষা শিখেছিলো। মুসলিমদের সংস্কৃতি এবং জীবনধারার প্রতি তারা এতোটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলো যে নিজেদের ধর্মীয় রীতিনীতিকে ছেড়ে দিয়ে ইসলামের বিধিবিধান, অভ্যেস এমনকি তাদের নারীদেরও ইসলামী পর্দায় রাখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছিলো। ’
পূর্বপুরুষদের অযোগ্য সন্তান
আফসোস, আমরা কী থেকে কী হয়ে গেলাম। কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় এসে পৌঁছেছি। পূর্বপুরুষদের অযোগ্য সন্তানেরা কীভাবেই না মান-সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। অন্যদের গোলামির জিঞ্জির মাথায় বেধে নিয়েছে। তাদের স্থাপিত ভিত্তির এক একটি ইট খুলে ফেলেছে। আফসোস, যারা এককালে আমাদের অনুসরণ করাকে নিজেদের জন্য গৌরবের বিষয় বলে ভাবতো আজ আমরা তাদের অনুসরণে মত্ত হয়ে পড়েছি। তাদের পছন্দ-অপছন্দ, তাদের ভাষা এখন আমাদের মুখে মুখে।
অপ্রয়োজনেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে পারাটাকে আমরা এখন গর্বের বিষয় মনে করি। শুদ্ধ উচ্চারণ করতে না পারলেও অশুদ্ধতেই কাজ চালিয়ে যেতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করি না। আর সাহেব বাহাদুরের সাদৃশ্য ধারণ করতে পারাটা তো বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার।
মেয়েদেরকে পর্দা থেকে বের করেছি। পুরুষদের বেশ-ভূষা পাল্টে দিয়েছি।
প্রথমে আমরা কেবল ভাষা এবং বেশ পরিবর্তন করেছি আর মনে মনে ভেবেছি যে, ঈমানের সম্পর্ক তো ক্বলবের সাথে। বাহ্যিক পরিবর্তনে ঈমানের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে যে, এটাই একটা বিদ্যুতের চমক ছিলো যেটা ক্বলব এবং মগজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ইংরেজি জীবনধারা এবং খৃষ্টীয় মতবাদ আমাদের মনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে ছেড়েছে।
এক ব্যক্তি ইংলিশদের জুতো পরিধান শুরু করলো আর ভাবলো যে এই জুতো পরার কারণে আমি তো আরবদের মতো হয়ে যাই নি। পরে দেখা গেলো জুতোর সাথে সাথে সে প্যান্টও পরা শুরু করেছে। এভাবে ইসলামী পোশাক একটা একটা কমে একটা একটা করে ওদের পোশাক গায়ে ওঠতে লাগলো।
একসময় দেখা গেলো যে বাহ্যিক পরিবর্তনের পর তার ভেতরেও পরিবর্তন শুরু হয়ে গেলো এবং শরীর থেকে নিয়ে তার ঘরবাড়ি এবং চারপাশেও পরিবর্তন আসা শুরু হলো।
ঘরের পর্দা তার ভালো লাগে না, সুতরাং সেগুলো সরিয়ে ফেলা হলো। বসে খেতে পারে না সুতরাং দস্তরখান উঠে গেলো। নামাজের জন্য বারবার অজু করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো, সুতরাং নামাজও বাদ পড়তে থাকলো। মোটকথা- তার শরীর-মন এবং ঘর থেকে ইসলাম পুরোপুরি ওঠে গেলো।
এভাবেই সব বদলায়, যার সূচনাটা সামান্য পোশাক বা ভাষার মাধ্যমেই ঘটে।
ইসলামী সংস্কৃতি ধ্বংসের নিষ্ঠুর খেলা…
মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ. তার ইলমি জাওয়াহেরে আরো বলেন-
বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক প্রচারণা, চাপ প্রয়োগ এবং জুলুমের চূড়ান্ত করেও মুসলিম জনগণ তো বটেই, অন্যধর্মের সাধারণ মানুষদের থেকেও ইসলামী জীবনধারা বা সংস্কৃতির প্রভাব দূর করতে ব্যর্থ হয়ে খৃষ্টান রাজারা মিটিংয়ে বসলো করণীয় ঠিক করতে। আলোচনায় সমাধানের কোনো পথ স্থির করতে না পেরে বিশেষ একটি কমিশন গঠন করে দেয়া হলো।
মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা যাচাই করে কমিশন রিপোর্ট পেশ করলো-
‘মুসলিম শাসকদের তাড়াতে পারলেও আমরা তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কুতুবখানা, ইসলামী ভাষা- এসব তো সমাজ থেকে মিটিয়ে দিতে পারি নি। শত বছরের চর্চায় এগুলো তাদের হৃদয়ের গভীরে শেকড় গেড়ে বসেছে। তাই বাস্তব কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।…
কমিশনের রিপোর্টকে সিরিয়াসভাবে নিয়ে যে ভয়ংকর খেলায় ইউরোপীয় খৃষ্টানরা এরপর মেতে ওঠলো, ইতিহাসে তার নজির পাওয়া খুবই কঠিন। ইসলামী ভাষা তথা আরবীর যে কোনোরকম ব্যবহার তারা নিষিদ্ধ করলো, নিজেদের সংস্কৃতি ছাড়তে রাজি হবে না এমন খাঁটি মুসলিমদের সম্পূর্ণ খালি হাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য করলো, ইসলামী পোশাক বা বাহ্যিক যে-কোনো ইসলামী বেশও নিষিদ্ধ হলো।
শুধু তাই নয়- ইসলামী কুতুবখানায় সংরক্ষিত যাবতীয় পুস্তক একটি মাঠে জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। সেগুলো শুধু ইসলামী বই ছিলো না, শত শত বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের হাজারো কিতাব
যেগুলোর সাথে ইসলাম বা মুসলিম জাতির আপাত দৃষ্টিতে কোনো সম্পর্কই হয়তো ছিলো না। শুধু মুসলিমদের সংরক্ষণে থাকার অপরাধে এমন পরিণতি বরণ করতে হয়েছিলো নিরীহ এসব পুস্তকেরও।
আফসোসের ব্যাপার- এসব কাজে তখন নেতৃত্ব দিচ্ছিলো সদ্যই মুসলিমদের অধীনতা হারানো উন্নততর ইউরোপীয় রাষ্ট্র স্পেন।
Leave a Reply