‘ফিলিস্তিন কেবল একটি দেশ নয়। আল-আক্বসা কেবল একটি মসজিদ নয়। আমাদের শেকড়। আমাদের আশ্রয়। ফিলিস্তিন-আল আক্বসার ভাগ্য এবং মুসলিম জাতির মুক্তি অভিন্ন সুতোয় গাঁথা।’
-সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ.
Table of Contents
লেখকের নিবেদন
কেমন আছে ফিলিস্তিন? কেমন ছিলো যুগে যুগে? কোন পথে এগুচ্ছে আজকের ফিলিস্তিন?…আপনার মতোই, আমার মনের আকাশেও এমনসব প্রশ্ন হরহামেশা ঘুরে বেড়ায়। যেটুকু খবর, তারচেয়েও গভীর করে জানার জন্য অস্থির হয়ে থাকে। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে তোলে, তবুও ক্লান্ত হয় না। ক্ষান্তি দেয় না। কেনো বলুন তো?
পৃথিবীর দুই শতাধিক দেশের একটি ফিলিস্তিন, আল আক্বসাও পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর অসংখ্য ঘরগুলোরই একটি; তারপরও ফিলিস্তিন-আল আক্বসার জন্য আমাদের এতো কিসের টান? কেনো উতলা হই ফিলিস্তিন-আল আক্বসার খবর সংগ্রহের জন্য? ফিলিস্তিন-আল আক্বসার কথা মনে পড়লেই- প্রেমের বিভোরতা কিংবা শোকের দহন, গৌরবের মহিমা কিংবা পরাজয়ের গ্লানি, স্বপ্নের ঐশ্বর্য কিংবা অক্ষমতার বিভীষিকা- এমনসব সাংঘর্ষিক ভাবনা কেনো আমাদের ক্ষতবিক্ষত করে চলে?…
ইতিহাসের চরম বাস্তবতা আর গল্পের স্বপ্নীল আবেশে এসব প্রশ্নেরই জবাব খোঁজার মোটামুটি একটা প্রয়াস এই বই। শুকরিয়া সব মহান আল্লাহ তায়ালার।
ইতিহাস আর সময় পাশাপাশি চলে। হাতে হাত রেখে তারা সামনে এগোয়। কাল যা ঘটলো আজ তা ইতিহাস। এই মুহূর্তে যা ঘটছে, কিছুক্ষণ পর তাও তো ইতিহাসই। সময় যেমন ইতিহাস সৃষ্টি করে, ইতিহাসের মহিমায় সময়ও কখনো কখনো তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। সৃষ্টির শুরু থেকে এভাবেই গলাগলি করে তাদের নিরন্তর পথচলা। আর সংরক্ষণের মতোই, ইতিহাসের প্রয়োজনীয় অংশটুকু বেছে বের করাও বড় কঠিন কাজ। নিজের অযোগ্যতার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও জটিল সে কাজটি আঞ্জাম দেওয়ার এই চেষ্টাটুকু করলাম কারণ, ইতিহাসের আমিও এক তৃষাতুর পাঠক। ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলা বা কাজে লেগে থাকায় কোনো সাফল্য বা তৃপ্তি দেখি না। অপূর্ণতা বা ভুলভাল থেকে যাওয়ার আশংকা সত্ত্বেও এ ধরনের কাজকে তাই জরুরি মনে করি।
আল আক্বসা বা বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতি যে প্রেম আমাদের আবেগে ভাসায়, একই প্রেম তো মুক্তির আর্তনাদও করে যাচ্ছে প্রায় একশ বছর ধরে। পুরোটা না জানলে একজন উমর বা সালাহুদ্দীন আইয়ূবী কেনো তৈরি হবে? কীভাবে হবে? ফিলিস্তিনিদের লড়াইটাকেও সরাসরি ইসলামের বা আল আক্বসার মুক্তির লড়াই হিসেবে মেনে নিলে বাস্তবতাকে খুব বেশি উপেক্ষা করা হয়ে যায় না?
আপনার মত এমনই হোক বা বিপরীত, ইতিহাসের তাতে কোনো পরোয়া নেই। সহজ সিদ্ধান্তে যাবার আগে একবার চলুন সে ইতিহাসের আকাশে কিছুক্ষণ ডানা ঝাপটে আসি!
খৃস্টপূর্ব দুই হাজার অব্দ থেকে শুরু করে এই সেদিন পাওয়া জাতিসংঘের স্বীকৃতি, হযরত আদম আলাইহিস সালামের পবিত্র হাতের সূচনা থেকে নিয়ে আজকের জর্ডানের তত্ত্বাবধান পর্যন্ত ফিলিস্তিন আর আল আক্বসার ইতিহাস খুব সংক্ষেপে, খুবই সরল ভাষায় এই বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সমজাতীয় বা অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো উপেক্ষার পাশাপাশি গুরুত্ববহ বিষয়গুলো জায়গা পেয়েছে যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারেই। মনোযোগে চিড় ধরার আগেই ইতিহাসের শুষ্ক মরুদ্যান পেরিয়ে গল্পের সবুজ প্রান্তরে আপনার পদার্পন ঘটবে, ইতিহাস আর গল্পের এবারের এই মিলিত উপস্থাপনায় আপনাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।
শেষ করার আগে একটু বলি। যেহেতু ইতিহাস, এই বই তাই লেখকের সৃষ্টি নয় সংকলন। ভাষা আর উপস্থাপনার বিচার আপনার হাতেই থাকলো। বইয়ের ভাবনা না থাকলেও পছন্দের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের অভ্যেস আমার বেশ পুরনো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সূত্র বা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা উচিত থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে তা দেওয়া গেলো না বলে অগ্রিম দু:খ প্রকাশ করছি। বিশেষ করে বই শেষ করার আগ মুহূর্তে ২০০২-৩ সালে ফিলিস্তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি গল্প সংকলন আমার হস্তগত হয়।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার প্রেক্ষাপটে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণী থেকে শুরু করে দশম শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদের ডায়রি সংগ্রহ করে একটি সংকলন তারা প্রকাশ করেছিলো। নিজের কিছু গল্প বাদ দিয়ে সেখান থেকে নয়টি ডায়রির সরাসরি অনুবাদ বইয়ে যুক্ত করেছি। সবশেষে বিখ্যাত একজন ফিলিস্তিনি লেখকের গল্পও থাকছে। সন্দেহ নেই, আমাদের কাল্পনিক গল্পের মায়ার চেয়ে তাদের নিজস্ব বর্ণনার বাস্তবতা আপনাকে আরো বেশি করে নাড়া দেবে। ভাবাবে। শেখাবে।
বই প্রকাশে কিছুটা দীর্ঘসূত্রিতা আর আমার আলসেমিতে মূল্যবান সে সংকলনটার কপিও আজ আর হাতের কাছে পেলাম না। তাদের নামগুলোও তাই দেওয়া যাচ্ছে না। বই বা বিষয়ের গুরুত্বে তাতে কোনো প্রভাব পড়বে না ঠিক, তবুও এ তো আমারই দায়। আরো একবার তাই দু:খ প্রকাশ করছি। পরবর্তী সংস্করণে এই অপূর্ণতা এবং আপনার দেওয়া অন্যান্য পরামর্শও আমরা ঠিকঠাক করে নেবো ইনশাআল্লাহ। ভালো থাকুন। সুন্দর থাকুন। ধন্যবাদ।
–শাকিল আদনান
মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
১৩/১০/২০১৬ ইং
যুগে যুগে ফিলিস্তিন (অবস্থান, আয়তন ও ইতিহাস)
ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ও জনগণের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং সহজতার কারণে এখানে আমরা ঈসায়ি বা ইংরেজি সনকেই কালের পরিচায়ক হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছি। জানেন অবশ্যই- হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের বছরটিই বিশ্বে আধুনিক সন-তারিখ গণনার সর্বাধিক প্রচলিত সূত্র হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পৃথিবীতে আগমনের পূর্বের সময়কে বলা হয় খৃস্টপূর্ব এবং পরের সময়কে খৃস্টাব্দ। প্রাচীন ফিলিস্তিন এবং আজকের ফিলিস্তিন বিষয়ে খুবই সংক্ষেপে কেবল বিশেষ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহকে এই বইয়ে তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। কাল গণনার সাধারণ হিসেব এবং ইসলামের আগমন-পরবর্তী হিজরি সন দু’ভাবেই আমরা ফিলিস্তিনের ইতিহাস তুলে আনতে চেয়েছি। আশাকরি এই সমন্বয় ফিলিস্তিন এবং যুগ যুগ ধরে সেখানে বাস করে আসা আরব জনগোষ্ঠীকে জানা-বোঝা এবং তাদের নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে আরো সহজতা তৈরি করবে। ধন্যবাদ।
অবস্থান ও আয়তন
ফিলিস্তিন। পৃথিবীর প্রাচীনতম এক জনপদের নাম। ইতিহাস পরম্পরায় ভূমধ্যসাগর, মৃতসাগর এবং জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী এলাকার জন্য সুদীর্ঘকাল থেকে নামটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আরো ভেঙে বললে- ভূমি হিসেবে ফিলিস্তিনের অবস্থান এশিয়া মহাদেশের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে। উত্তরে লেবানন ও সিরিয়া, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে আকাবা উপসাগর ও মিসরীয় উপদ্বীপ এবং পূর্বে আধুনিক আরবরাষ্ট্র জর্ডান দ্বারা বেষ্টিত এই দেশ। আবহাওয়া শীতকালে নাতিশীতোষ্ণ এবং গ্রীষ্মকালে শুষ্ক গরম। ওয়েস্ট ব্যাংক তথা পশ্চিমতীরে গ্রীষ্মকালের গড় তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও শীতকালে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গাজা সিটিতেও কাছাকাছি, গ্রীষ্মে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ফিলিস্তিনের পুরনো নাম কানআন বা কেনান। ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত, এখানে বাসস্থান গড়ে তুলেছিলো প্রাচীন কানআনি সম্প্রদায়। আমাদের পবিত্র কুরআনেও এ তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়। খৃস্টপূর্ব তিন হাজার সহস্রাব্দর সূচনাতে এই সম্প্রদায়ের লোকজন আরব উপদ্বীপ থেকে এখানে আগমন করেছিলো। ফিলিস্তিন নামটি সমুদ্র উপকূলীয় এক সম্প্রদায়ের নাম থেকে নেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীনকালে কেনান নামে পরিচিত ফিলিস্তিন ভূখ-েণ্ডর আয়তন ছিলো ২৫০০ বর্গ কিলোমিটার।
ফিলিস্তিন নবীদের পুণ্যভূমি। এই ভূমিতে জন্মগ্রহণ ও জীবনযাপন করেছেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম, হযরত লুত আলাইহিস সালাম, হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম, হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম, হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম, হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম, হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামসহ বহু নবী-রাসূল; সরাসরি কুরআনেই যাদের বিবরণ পাওয়া যায়।
ফিলিস্তিন খুবই উর্বর ও ভারসাম্যপূর্ণ আবহাওয়াপ্রধান একটি দেশ। কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক বিচারেও এর অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর বাইরে ফিলিস্তিন বহুসংখ্যক সভ্যতারও জন্মস্থান। বর্তমান বিশ্বের বৃহৎ তিনটি ধর্মেরও গভীরতম সম্পর্ক ফিলিস্তিনের সাথে। সবমিলিয়ে ফিলিস্তিন বিস্ময়ের আধার। এই দেশ নিয়ে যতো ভাবি, বিস্ময় কেবলই বেড়ে যায়। পৃথিবীর মানচিত্রে আপাত-ছোট্ট একটা দেশকে মহান আল্লাহ তায়ালা কী অসামান্য মর্যাদাই-না দিলেন! ছোট্ট ফিলিস্তিন তাই কেবলই স্থানীয় অধিবাসীদের না থেকে সবার হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের চাওয়া-পাওয়াও তাই আর কেবল তাদের চাওয়া-পাওয়ায় সীমিত থাকে নি, হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসীর।
জনসংখ্যা
ফিলিস্তিনের প্রায় সকল নাগরিকই মুসলিম। আছে স্বল্পসংখক খৃস্টান, ইহুদি ও দ্রুজ সম্প্রদায়ের লোকও। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সকল ফিলিস্তিনির চলমান লড়াইও নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, কখনো ছিলো না। তাদের লড়াই অবৈধ দখলদার কট্টর ইহুদিবাদীদের বিরুদ্ধে, পশ্চিমা মিডিয়া ও নেতারা নানাভাবে যেটাকে বিশেষ একটা ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে এসেছে একদম শুরু থেকেই। ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ২০০৩ জানুয়ারির এক হিসেব অনুযায়ী ৯.৩ মিলিয়ন বা প্রায় এক কোটি। এই হিসেব অবশ্য বিভিন্ন দেশে অভিবাসী বা উদ্বাস্তু-হওয়া-ফিলিস্তিনিদেরও সম্মিলিত রূপ। এই এক কোটির মধ্যে ৩.৬ মিলিয়ন ওয়েস্ট ব্যাংক তথা পশ্চিমতীর, গাজা স্ট্রিপ ও পূর্ব জেরুসালেমে বসবাস করেন। পশ্চিম তীরে ২.৩ মিলিয়ন, গাজা স্ট্রিপে ১.৩ মিলিয়ন। জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও মিসরে আছেন ৪.৬ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি। অন্যান্য আরব দেশে ৫,৭৮,০০০; যুক্তরাষ্ট্রে ২,২৩,০০০ এবং বাকি বিশ্বে ২,৯৫,০০০। এর বাইরে জবরদখলকৃত ইসরাইলি অবৈধ ভূখ-ে আছেন আরো ১ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি, যারা জাতিতে ফিলিস্তিনি হলেও বর্তমান ইসরাইলি অংশে জীবনযাপন করছেন। ধারণা করা হয়, আগামী ২ দশকে ফিলিস্তিনিদের এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে এবং উন্নীত হবে কমপক্ষে দুই কোটিতে।
ফিলিস্তিনে বর্তমানে তিন প্রকারের মুদ্রার প্রচলন আছে। জর্ডানের দিনার, যুক্তরাষ্ট্রের ডলার ও ইসরাইলি শেকেল। ফিলিস্তিনের সরকারি ভাষা অনুমিতভাবেই আরবি। তবে অনেকে ইংরেজিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বেশকিছু হিব্রুভাষী ও যৎসামান্য ফরাসি এমনকি ল্যাটিনভাষীও আছেন ফিলিস্তিনে। ঐতিহাসিকক্রমে এদেশের জনগণকে ফিলিস্তিনি হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। যদিও ধর্মের বিচারে এখানে সবযুগেই বিভিন্ন ধর্ম প্রচলিত ছিলো এবং আজও আছে। ফিলিস্তিনিরা যথেষ্ট বন্ধুবৎসল। সাধারণভাবে সবাই প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচার বজায় রেখে চলেন।
ফিলিস্তিনের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে পর্যটনের সম্ভাবনা আর সব দেশের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম। যদিও ধর্মীয় কারণে এর অপরিসীম গুরুত্ব আছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫,২০,০০০ পর্যটক ফিলিস্তিনে যাতায়াত করে থাকেন। এর মধ্যে গাজা শহরে ৪১০০০ ও খানইউনিসে ১৮০০০ আর তুলনামূলক নিরাপদ পশ্চিমতীর ও মসজিদে আকসায় অবশিষ্ট বড় অংশটি ভ্রমণ করেন।
ইসলামপূর্ব ফিলিস্তিনের ইতিহাস
প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও গবেষণার সূত্র অনুযায়ী- লেক টিবেরিউস (হ্রদ) খননকার্যে পাওয়া মানুষের মরদেহের অবশিষ্টাংশের বয়স আন্দাজ করা হয় খৃস্টপূর্ব ছয় লাখ বছর। ফিলিস্তিনে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন যে জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে তা হলো জেরিকো শহর, যাতে কমপক্ষে কয়েক শ’ পরিবারের বসবাসের তথ্য পাওয়া যায়। আর জেরিকোর সাংস্কৃতিক নাম ছিলো নাতুফিয়ান। এ ছাড়া প্রাচীন ফিলিস্তিন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা নেই আজকের আধুনিক বিশ্বের। তাই কুরআনে বর্ণিত এবং ‘কেনান’ হিসেবে পরিচিত সম্প্রদায়ের ইতিবৃত্ত দিয়েই ফিলিস্তিনের ইতিহাসের যাত্রা শুরু করা যথার্থ হবে।
খৃস্টপূর্ব যুগ এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন
খৃস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ
ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ছিলেন কেনানের অধিবাসীগণ। তারা নগরায়িত হয়ে গিয়েছিলেন এবং নগর-রাষ্ট্রে বসবাস করতেন, যার অন্যতম নগর ছিলো জেরিকো। তারা একটা ভাষাও উদ্ভাবন করেছিলো। রাজপথগুলোর মধ্যস্থলে অবস্থিত ফিলিস্তিন তিন মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতো। ফিলিস্তিনকে মিসর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া [প্রাচীন গ্রিক- Μεσοποταμία – দুটি নদীর মধ্যবর্তী ভূমি, আরবি- الرافدين بلاد । বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস তথা দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো। অধুনা ইরাক, সিরিয়ার উত্তরাংশ, তুরস্কের উত্তরাংশ এবং ইরানের খুযেস্তান প্রদেশের অঞ্চলগুলোই প্রাচীনকালে মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত ছিলো বলে মনে করা হয়] এবং এশিয়া মাইনর থেকে আগত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। ঘটনাক্রমে ফিলিস্তিন ঐ অঞ্চলের প্রধান শক্তিগুলোর স্বাভাবিক যুদ্ধক্ষেত্র পরিণত হয়েছিলো। সে সূত্রেই আশপাশের সা¤্রাজ্যগুলোর আধিপত্য বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিলো ফিলিস্তিন। আর এসবেরই সূচনা হয়েছিলো খৃস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে মিসরের হাত ধরে।
খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ
এই সহস্রাব্দের পুরোটাজুড়েই মিসরীয় আধিপত্যবাদ ও কেনানি স্বায়ত্তশাসন অ্যামরাইট, হিট্টাইট এবং হুরিয়ান বহিরাগত হানাদার গোষ্ঠীর হুমকির মাঝে বিরাজ করছিলো। তবে এসব হানাদারকে মিসরীয়রা পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছিলো এবং কেনানিদের দ্বারাই ফিলিস্তিন ভূখ-ের আত্মীকরণ করা হয়েছিলো। এদের সংখ্যা সেসময় দুই লাখের মতো ছিলো।
খৃস্টপূর্ব চৌদ্দ শতকের দিকে মিসরীয় শক্তি দুর্বল হতে শুরু করলো। ঠিক সেসময়ই নতুন হানাদার গোষ্ঠী- হিব্রুদের আগমন। এরা ছিলো মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত একটা উপজাতি এবং গোত্রীয় নাম ছিলো ফিলিস্তিন, যাদের নামে পরে দেশটির নামকরণ করা হয়েছিলো।
খৃস্টপূর্ব ১২৩০ সালে ইউশা ফিলিস্তিনের কিছু কিছু অংশ বিজয় করেছিলেন। তারা পাহাড়ি এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলো। কিন্তু শত চেষ্টায়ও এরা সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন অধিকার করতে সমর্থ হয় নি।
খৃস্টপূর্ব ১১২৫ -এ এসে অবশেষে ইসরাইলিগণ (কতগুলো হিব্রু উপজাতির সম্মিলিত শক্তি) কেনানিদের পরাজিত করতে সমর্থ হলো। তবে অতীতের যে-কোনো সময়ের তুলনায় আরও কঠিনভাবে তাদেরকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধসংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। ফিলিস্তিনিরা মূল শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম সমুদ্রের তীরে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলো, যার দ্বারা কেনানিদের শহর জেরুসালেম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হতো। খৃস্টপূর্ব ১০৫০ এর দিকে ফিলিস্তিনিরা তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও লৌহনির্মিত অস্ত্র ব্যবহার করে ইসরাইলিদের পরাজিত করেছিলো।
খৃস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের শেষ এক হাজার বছর। আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম এসময় ইসরাইলিদের রাজাধিরাজ ছিলেন। তার সময়ে এসেই ইসরাইলিরা অবশেষে ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের পরাজিত করেছিলো এবং পর্যায়ক্রমে কেনানিদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো। ইসরাইলিদের ঐক্য ও আশপাশের সা¤্রাজ্যগুলোর দুর্বলতা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে পারঙ্গম করেছিলো জেরুসালেমকে রাজধানী করে একটি বৃহৎ স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে।
খৃস্টপূর্ব ৯২২ সাল পর্যন্ত হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের পুত্র হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের অধীনে ইসরাইলি জনগোষ্ঠীতে শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিলো। তবে তার মৃত্যুতে খৃস্টপূর্ব ৯২২ সালে এ রাজ্য উত্তরে ইসরাইলি ও দক্ষিণে জুডা নামে দু’ভাগে বিভাজিত হয়ে গিয়েছিলো।
খৃস্টপূর্ব ৭২১-৭২২ সালের মধ্যে যখন আশপাশের রাষ্ট্রগুলো সীমানা বর্ধনে মনোযোগ দিল তখন বিভাজিত ইসরাইলিরা তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে পারলো না। অ্যাসিরিয়ার কাছে ইসরাইলিদের মাথা অবনত হলো।
খৃস্টপূর্ব ৫৮৬ সাল। ব্যাবিলনিয়দের দ্বারা জুডা বিজিত হলো। ওরা জেরুসালেম ধ্বংস করেছিলো এবং জীবিত ইহুদিদের নির্বাসিত করেছিলো। বখতে নসর জেরুসালেমে প্রবেশ করে মন্দির ইত্যাদি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলো। রাজকীয় প্রাসাদ ও বাকি রাজন্যবর্গের ঘরবাড়ি ভেঙেচুড়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলো। অবশিষ্ট সাধারণ জনগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।
খৃস্টপূর্ব ৫৩৯ সাল। পারস্যের রাজা মহান সিরাম ব্যাবিলনিয়া বিজয় করেছিলেন। তিনি ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনের একটি জেলায় ফেরৎ যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। পারস্যপ্রশাসনের অধীনে ইহুদিদের যথেষ্ট পরিমাণে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দান করা হয়েছিলো। ওরা জেরুসালেমের দেয়ালগুলো পুনঃনির্মাণ করেছিলো এবং হযরত মুসা আলাইহিস সালামের শরীয়ার প্রচলন করেছিলো, যা ওদের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির মানদণ্ড হিসেবে আজও মোটামুটিভাবে অনুসৃত হয়। মুসলিমদের মতো ইহুদিরাও এক প্রভুতে বিশ্বাসী ছিলো, তবে ইসলামের আগমনের পরও নতুন শরীয়ার অধীনে তারা নিজেদের সংশোধন করে নিতে ব্যর্থ হলো।
খৃস্টপূর্ব ৩৩৩ সাল। ফিলিস্তিনের এই পারস্য-আধিপত্য গ্রিসের প্রশাসনের স্থলাভিষিক্ত হলো যখন ম্যাসিডোনিয়ার রাজা আল-ইস্কান্দর এই এলাকা বিজয় করলেন। আল-ইস্কান্দারের বংশ, মিসরের টলেমীয়রা ও সিরিয়ার সেলুসিডেরা ক্রমপরম্পরায় এদেশে শাসন চালিয়ে যাচ্ছিলো। সেলুসিডেরা হেলেনীয় তথা গ্রিসের সংস্কৃতি ও ধর্মও ফিলিস্তিনের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিলো।
খৃস্টপূর্ব ১৪১-১৬৩ সাল। মাক্কাবীদের অধীনে ইহুদিরা বিদ্রোহ করেছিলো এবং আবারো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো।
খৃস্টপূর্ব ১৩২-১৩৫ সাল। ইহুদিরা বিদ্রোহ করেছিলো; অনেক ইহুদিকে এই অপরাধে মেরেও ফেলা হয়েছিলো। অনেককে দাস হিসেবে বিক্রয় করে দেয়া হয়েছিলো এবং বাকিদের জেরুসালেম ফিরে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিলো। জুডিয়ার নতুন নামকরণ করে সিরিয়াকে ফিলিস্তিনের অধীনে রাখা হয়েছিলো।
খৃস্টপূর্ব ৬৩ সাল। রোমানরা জেরুসালেম দখল করে নেয়। হীরডকে রাজা নিযুক্ত করা হয়। সে হ্যাসমোনীয়দের শেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো এবং দ্বিতীয় মন্দির পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ও সম্প্রসারণের জন্য মুক্তহস্তে খরচের বিধি জারি করেছিলো। এরপর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়, যাতে দেখা যায় সীমাহীন রাজকীয় গোলযোগ, শান্তিকামী ও উগ্রপন্থীদের মাঝে বাক-বিত-া, মারামারি, খুনোখুনি এবং রোমীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা।
খৃস্টপূর্ব ৩৭-৪ সাল এবং হযরত ঈসার আলাইহিস সালাম আগমন
রাজা হীরডের রাজত্বকালে নাজারতে ঈসা আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন। পৃথিবীতে আগমনের কয়েক বছর পর তিনি নিজের ওপর নাযিলকৃত ধর্মবাণী প্রচারের কাজ শুরু করেন। জনগণকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও মুসা আলাইহিস সালামের বিশুদ্ধ শিক্ষার দিকে তাঁর আহ্বানের প্রচেষ্টাকে তদানীন্তন সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করেছিলো। তার বিচার করা হয়েছিলো এবং তাকে মৃত্যুদ-ে দ-িতও করা হয়েছিলো। দ- কার্যকরও করা হয় তবে কুরআন-হাদিসের বিশুদ্ধ সূত্রমতে তারা তাকে ‘বধ’ করতে সমর্থ হয় নি বরং তারই সদৃশ অন্য একজনকে তখন বধ করা হয়েছিলো। মুসলিম জাতির চিরকালীন বিশ্বাসও এমন এবং এটাই সত্য। মহান আল্লাহর নির্দেশে সময়মতো আবার তিনি পৃথিবীতে আগমন করবেন এবং শেষ নবীর উম্মত হয়ে ইসলামের প্রতি মানুষদের আহ্বান জানাবেন।
১-৯৯৯ খৃস্টাব্দ এবং ইসলামি যুগের সূচনা
খৃস্টাব্দ ৭০। রোমের টিটাস জেরুসালেম অবরোধ করলেন এবং প্রচ- প্রতিরোধ সত্ত্বেও অবশেষে মন্দির ভূপাতিত করতে সমর্থ হলেন। সাথে সম্পূর্ণ নগরীও তার হাতেই বিজিত হলো। পরিপূর্ণ ও স্থায়ী জয়ে টিটাস হীরডীয় মন্দিরের পুরোটা ধ্বংসের নির্দেশ জারি করেছিলো। এই রোমানদের দ্বারা জেরুসালেমে ধ্বংসাবশেষের উপর আইলা নামক এক নতুন নগরীর গোড়াপত্তন করা হয়েছিলো। জুপিটার নামে উৎসর্গকৃত নতুন একটি মন্দিরও গড়ে তোলা হয়েছিলো।
খৃস্টাব্দ ৩১৩। যখন রোমান স¤্রাট কনস্টান্টিন খৃস্টধর্মকে আইনসম্মত বৈধতা দান করলেন, ফিলিস্তিন তখন বিশেষ মনোযোগ ও যতœ পেতে শুরু করেছিলো। তার মাতা হেলেনা জেরুসালেম ও ফিলিস্তিন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। কারণ তখন এ পবিত্রভূমি খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানসমূহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলো। এরপর সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও সংস্কৃতির এক স্বর্ণযুগের অবতারণা ঘটেছিলো ফিলিস্তিনে। জনগণের বেশিরভাগ হেলেনীয় (গ্রিস) ও খৃস্টীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েছিলো। এসময় তেমন কোনো রক্তপাত ঘটেনি। কোনো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলে নি। যারা নিজ এলাকায় ফিরে যেতে চাচ্ছিলো তাদেরও স্বাধীনভাবে যেতে দেয়া হয়েছিলো। এমনকি তাদের সমস্ত সহায়-সম্বলসহকারে। যারা থেকে যেতে চাইলো, তাদের জীবন, মান, সম্পদ ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তার জামানত দেওয়া হয়েছিলো।
খৃস্টাব্দ ৩২৪। বাইজানটিয়ানের কনস্টান্টিন [তৎকালীন রোমীয় শাসক] এসময় আইলা দখল করে নিয়েছিলো। সে নগরীর দেয়ালগুলো পুনর্নির্মাণ করেছিলো। নগরীকে খৃস্টানদের তীর্থস্থান হিসেবে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো।
একনজরে খৃস্টাব্দ ২৯-৬১৪
এক সংক্ষিপ্ত পারস্য দখলদারিত্বের দ্বারা বাইজানটাইন শাসন মাঝপথে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলো। আর তারও সম্যক পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো যখন মুসলিম আরববাহিনী ফিলিস্তিন আক্রমণ করেছিলো এবং জেরুসালেম দখল করে নিয়েছিলো ৬৩৮ খৃস্টাব্দে।
খৃস্টাব্দ ৬৩৮। আরবদের বিজয়ের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে এসময় শুরু হয়ে গেলো ১৩০০ বছরের মুসলিম উপস্থিতি। তখন থেকেই ফিলিস্তিন নামটি এ অঞ্চলের জন্য পুরোমাত্রায় নির্ধারিত হলো এবং ব্যবহৃতও হতে থাকলো ব্যাপকভাবে। রোমীয় প্রভুদের সরদারি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিরা দারুণরকম উৎসুক ছিলো।
নবী ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশধর হিসেবে আরবদের সঙ্গে একই আদিম পরিবারভুক্তির ব্যাপারে সচেতনতা আর বিজয়কালে মুসলিমদের দয়া, অনুকম্পা ও উদারতার সুনাম সম্বন্ধে অবগত থাকায় স্বল্পকালের অবরোধের পর জেরুসালেমের জনগণ নিজেদের নগরী সমর্পণ করে দিয়েছিলো দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের হাতে। শর্ত শুধু একটাই ছিলো, আত্মসমর্পণের শর্তাবলি খলিফা হযরত উমরের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত এবং চূড়ান্ত করা হবে। সুতরাং তাই করা হয়েছিলো।
মুসলমানদের হাতে বায়তুল মুকাদ্দাস
জেরুসালেম বাইজেন্টাইন প্রদেশ প্যালেস্টিনা প্রিমার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিলো। মুসলিম জাতির বিজয়ের ২৩ বছর পূর্বে ৬১৪ সালে শেষ বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের সময় সাসানীয় সেনাবাহিনী শাহ্রবারাজের নেতৃত্বে এখানে আক্রমণ করে। পারসিকরা শহরে লুটপাট চালায়। এসময় তারা শহরের ৯০,০০০ খৃস্টান অধিবাসীকে হত্যা করে। লুটপাটের অংশ হিসেবে চার্চ অব দ্য হলি সেপালাচার ধ্বংস করা হয়, এর ক্রুশ খুলে তিসফুনে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐতিহাসিকদের ধারণাÑ ইহুদিরা পারসিকদের গোপনে সহযোগিতা করেছিলো।
৬৩২ সালে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতেকালের পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম জাতির নেতৃত্ব লাভ করেন ও খলিফা হন। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় এরপর তাকে রিদ্দার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। সমগ্র আরবে ইসলামের ঐশী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই তিনি পূর্ব দিকের ইরাকে ইসলামের বিজয় অভিযান পরিচালনা করেন। এই অঞ্চলটি তৎকালীন সাসানীয় সা¤্রাজ্যের একটি প্রদেশ ছিলো। অপরদিকে পশ্চিমে কালিমার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করায় মুসলিমবাহিনী বাইজেন্টাইন সা¤্রাজ্য আক্রমণ করে।
৬৩৪ সালে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইনতেকাল করেন এবং উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর উত্তরসূরি মনোনীত হন। তিনি হযরত আবু বকরের শুরু করা এই বিজয় অভিযান আরো বেগবান করেন। ৬৩৬ সালে সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বড় অভিযান পরিচালনা করেন। ৬৩৬ সালের আগস্টে ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিমবাহিনী পরাজিত হলেও পিছনে হটার মতো কোনো সিদ্ধান্তে যায় নি। অক্টোবরের প্রথম দিকে সিরিয়ার মুসলিমবাহিনীর আমির বা কমান্ডার-ইন-চিফ আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু ভবিষ্যৎপরিকল্পনা বিষয়ে একটি সভা আহ্বান করেন।
উপকূলীয় শহর কায়সারিয়া ও জেরুসালেমের বিষয়ে বিভিন্ন মত উঠে আসে। আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু এই দুটি শহরের গুরুত্ব অনুধাবন করছিলেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পেরে তিনি খলিফা উমরের কাছে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি লেখেন। উত্তরে খলিফা দ্বিতীয় শহর জেরুসালেমে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। এরপর আবু উবায়দা জাবিয়া থেকে জেরুসালেমের দিকে অগ্রসর হন। তার সাথে খালিদ বিন ওয়ালিদ ও তার অধীনস্থ বাহিনীও ছিলো। নভেম্বরের প্রথমদিকে মুসলিমরা জেরুসালেমে পৌঁছেন। বাইজেন্টাইনবাহিনী সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে নগরপ্রাচীরের ভেতরে অবস্থান নেয়।
অবরোধ
পারসিকদের কাছ থেকে জেরুসালেম পুনরুদ্ধারের পর হেরাক্লিয়াস ঐতিহাসিক এই শহররে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মজবুত করেন। ইয়ারমুকে বাইজেন্টাইনদের পরাজয়ের পর জেরুসালেমের পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পুনরায় সংস্কার করেন। মুসলিমরা শহর অবরোধ করতে চায় নি। তবে ৬৩৪ সালে মুসলিমরা শহরের সকল প্রবেশপথের উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যান। মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী দুর্গ পেল্লা ও বসরা দখল করে নেয়ার পর জেরুসালেম একরকম অবরোধের মুখে পড়ে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর শহরটি সিরিয়ার বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সম্ভবত অবরোধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।
মুসলিমবাহিনী জেরিকো পৌঁছলে সফ্রোনিয়াস শহরের সকল পবিত্র চিহ্ন ও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সংগ্রহ করে ও কনস্টান্টিনোপলে পাঠানোর জন্য উপকূলে পাঠিয়ে দেয় এই ভয়ে যে, মুসলিমরা সেসব ধ্বংস করে দেবে। তবে বাস্তবতা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। মুসলিমরা ৬৩৬ এর নভেম্বরে শহর অবরোধ করে। শহরের উপর ক্রমাগত আক্রমণের বদলে তারা বাইজেন্টাইনদের রসদ কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন যাতে রক্তপাতহীন আত্মসমর্পণ সম্ভব করা যায়। বেঁচে যায় নিরীহ মানুষের জীবন এবং ধন-সম্পদ।
অবরোধের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য কোথাও লেখা নেই। তবে এটি রক্তপাতহীন ছিলো বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, রক্তপাত বা ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপার ঘটলে তা অবশ্যই বিস্তারিত বিবরণে পাওয়া যেতো।
ইসলামি ইতিহাসসহ অন্যসব বর্ণনায় বরং বিপরীতটাই দেখতে পাওয়া যায়। ইসলামের শিক্ষাও সে কথাই বলে, ইসলামের প্রথমযুগের সকল সামরিক অভিযানই যার সুস্পষ্ট সাক্ষী। যাই হোক, বাইজেন্টাইনরা হেরাক্লিয়াসের কাছ থেকে সাহায্যের ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিয়েছিলো। চার মাস অবরোধের পর সফ্রোনিয়াস জিজিয়া প্রদান ও আত্মসমর্পণে সম্মত হন। তবে তিনি শর্ত দেন স্বয়ং খলিফা উমরকে এসে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। বলা হয়, সফ্রোনিয়াসের শর্তগুলো মুসলিমদের কাছে পৌঁছালে মুসলিম-সেনাপতি শুরাহবিল ইবনে হাসানা প্রস্তাব করেন- মদিনা থেকে খলিফার আগমনের অপেক্ষা না করে খালিদ বিন ওয়ালিদকে খলিফা হিসেবে পাঠানো হোক, কারণ তিনি দেখতে অনেকটা উমরের মতো ছিলেন। কিন্তু এই কৌশল কাজ করে নি।
সম্ভবত খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ায় খুব পরিচিত ছিলেন অথবা শহরের খৃস্টান আরবদের কেউ কেউ মদিনায় গিয়ে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয়কেই দেখেছে, ফলে এই দুজনের শারিরীক পার্থক্যগুলোও তাদের জানা ছিলো। সফ্রোনিয়াস আলোচনায় অসম্মতি জানান। যখন খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মিশনের ব্যর্থতা সম্পর্কে রিপোর্ট করেন, আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু খলিফা উমরের কাছে চিঠি লিখে পরিস্থিতি অবহিত করেন ও আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতার জন্য তাকে জেরুসালেমে আমন্ত্রণ জানান।
খৃস্টানদের আত্মসমর্পণ
পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস চার্চ অব দ্য হলি সেপালচারে খলিফা হযরত উমরকে নামায পড়ার আমন্ত্রণ জানান। ৬৩৭ সালের এপ্রিলের প্রথমদিকে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ফিলিস্তিনে পৌঁছান। প্রথমে তিনি জাবিয়ায় আসেন। আবু উবায়দা, খালিদ ও ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাকে সেখানে অভ্যর্থনা জানান। তারা খলিফাকে গ্রহণ করার জন্য এখানে আসেন। আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু অবরোধকারী মুসলিমবাহিনীর নেতৃত্বের জন্য থেকে যান।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জেরুসালেম আসেন ও ‘উমরের চুক্তি’ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত চুক্তিটি সম্পাদন করেন। এর ফলে জেরুসালেমবাসীরা মুসলিমদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং জিজিয়ার বিনিময়ে অমুসলিমদের নাগরিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। মুসলিমদের পক্ষে খলিফা উমর এতে স্বাক্ষর করেন এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস, আবদুর রহমান বিন আউফ ও মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমপক্ষে চুক্তির স্বাক্ষী হন। ৬৩৭ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে জেরুসালেম পরিপূর্ণভাবে খলিফার কাছে সমর্পিত হয়। ৫০০ বছরের নিপীড়নমূলক রোমান শাসনের পর এই প্রথম ইহুদিরা বিশেষ কোনো শর্ত ছাড়াই জেরুসালেমে বসবাস ও উপাসনা করার অনুমতি পায়।
বিভিন্ন লিখিত মুসলিম দলিল মোতাবেক- যোহরের নামাযের সময় সফ্রোনিয়াস উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চার্চ অব হলি সেপালচারে [খৃস্টান উপাসনালয়, বর্তমান ইসরাইলে] নামায পড়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু এটা করলে ভবিষ্যতে খৃস্টান চার্চের গুরুত্ব কমে যেতে পারে এবং মুসলিমরা আবেগের বশবর্তী হয়ে এটিকে মসজিদে পরিণত করতে পারে এই আশংকায় উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাতে রাজি হন নি। জেরুসালেমে দশদিন অবস্থান করার পর খলিফা উমর মদিনার পথে রওয়ানা হন।
পরবর্তী ঘটনা
৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় ডোম অব দ্য রক। এটি কুব্বাতুস সাখরা নামেও পরিচিত। বায়তুল মুকাদ্দাসের একটা অংশ হলেও এটা মূল বায়তুল মুকাদ্দাস নয়। তবে সৌন্দর্য ও শিল্পগুণের কারণে এটাই এখন মসজিদে আকসা হিসেবে অধিক খ্যাত। সোনালি গম্বুজের মসজিদটির কথাই এখানে বলা হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ আজকাল যেটাকে মসজিদে আকসা মনে করেন। খলিফার নির্দেশ অনুযায়ী ইয়াজিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কায়সারিয়ায় যাত্রা করেন ও পুনরায় বন্দরনগরীর অবরোধে নেতৃত্ব দেন। আমর ও শুরাহবিল ফিলিস্তিন বিজয় সম্পন্ন করার কাজে যাত্রা করেন। সে বছরই এই কাজ সমাপ্ত হয়।
তবে ৬৪০ সাল নাগাদ কায়সারিয়া দখল করা সম্ভব হয়নি। এসময় প্রথমে মুয়াবিয়া রাযিআল্লাহু আনহু সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন। তার কাছে এই শহরবাসী আত্মসমর্পণ করে। ১৭,০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে আবু উবায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু ও খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তর সিরিয়া জয় করতে অগ্রসর হন। ৬৩৭ সালে এন্টিওক জয়ের পর এই অভিযান সমাপ্ত হয়। ৬৩৯ সালে মুসলিমরা মিসরে অভিযান পরিচালনা করেন ও জয়লাভ করেন।
জেরুসালেমে অবস্থানের সময় সফ্রোনিয়াস হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বেশ কিছু পবিত্র স্থান দেখাতে নিয়ে যান। টেম্পল মাউন্টও এর মধ্যে ছিলো। টেম্পলটির দুরাবস্থা দেখে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এখানকার জঞ্জাল ও ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে একটি কাঠের তৈরী মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন। গলের বিশপ আরকালফ ৬৭৯ থেকে ৬৮২ এর মধ্যে জেরুসালেম ভ্রমণ করেন। তিনি এসময় তার দেখা মসজিদের বিবরণ দেন। তার বর্ণনায় এটির বীমগুলো কাঠের তৈরী ও এটি পুরানো ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মাণ করা হয়েছিলো এবং এতে মোট ৩,০০০ লোক একসাথে নামায আদায় করতে পারতো।
জেরুসালেম বিজয়ের ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর ৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ডোম অব দ্য রক নির্মাণের কাজে হাত দেন। দশম শতাব্দীর ইতিহাসবিদ আল-মুকাদ্দাসির লেখা অনুযায়ী আবদুল মালিক শহরের খৃস্টান গির্জার চাকচিক্যের সাথে তুলনীয় কিছু গড়ার জন্য এই নির্মাণে হাত দেন। তবে তার উদ্দেশ্য যাই থাক, এর জাঁকজমক ও আকার তৎকালীন মুসলিমদের সাথে জেরুসালেমের সংযোগ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক ছিলো।
পরবর্তী ৪০০ বছর ধরে ঐ অঞ্চলে মুসলিমদের কর্তৃত্ব বজায় ছিলো। প্রথম ক্রুসেডের সময় ইউরোপীয়রা জেরুসালেম দখল করে নেয়ার আগ পর্যন্ত এটি মুসলিমদেরই অধীনে ছিলো।
ফিলিস্তিন মুসলিমদের কাছে পবিত্র এ জন্য যে, এই ফিলিস্তিনের আল মাসজিদুল আকসাকে মুসলমানদের সর্বপ্রথম কিবলা হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিলো। এই দেশটিতে ইসলামের অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরিত হয়েছেন। আরও এ জন্য যে, মহান আল্লাহ তায়ালা এই পুরোনো জেরুসালেম নগরীর আজকের আলআকসা মসজিদ থেকে তার প্রেরিত মহামানব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসরা তথা নিশীথ ভ্রমণ ও আকাশপথে মিরাজ সম্পন্ন করেছিলেন। জেরুসালেম বা আলকুদস ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম নগরী হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। মুসলিম প্রশাসকেরা তাদের ধর্ম চাপাতে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর কোনো জোর বা জবরদস্তি করেন নি। এক শতাব্দীরও কিছু বেশি অতিক্রান্ত হওয়ার মধ্যেই ফিলিস্তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী ইসলাম গ্রহণ করে।
বাকি খৃস্টান ও ইহুদিদের আহলে কিতাবের সম্মান দেয়া হয়েছিলো। তাদের সম্প্রদায়গুলোকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়েছিলো। নিরাপত্তার জামানত ও উপাসনার স্বাধীনতা দান করা হয়েছিলো। এ ধরনের সহনশীলতা ধর্মের ইতিহাসে বিরল। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে তো আরো বেশি বিস্ময়কর। বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি আরবি ও ইসলামি সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলো। ফিলিস্তিন বিভিন্ন সা¤্রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে জাগতিক উন্নতিতে ব্যাপক উপকৃত হয়েছিলো। প্রথম মুসলিম রাজবংশ দামেশকের উমাইয়াগণ ফিলিস্তিনের ধর্মীয় তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলো এবং শাসনক্ষেত্রেও একে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলো।
খৃস্টাব্দ ৭৫০
আব্বাসি খেলাফতআমলে রাষ্ট্রশক্তি বাগদাদে স্থানান্তর শুরু হলো। উপেক্ষিত হলো ফিলিস্তিন। ফলে আবার অশান্তি শুরু হয় ফিলিস্তিনে। এরপর তো সেলযুক, ফাতেমি ও ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের ধারাবাহিক আধিপত্যের বিস্তার ঘটেছিলো এবং একের পর এক সা¤্রাজ্যের হাতে নিস্পেষিত হতে হয়েছিলো ফিলিস্তিনকে। তবে মুসলিমবিশ্ব যখন বিজ্ঞান, কলাবিদ্যা, দর্শন ও সাহিত্যের এক স্বর্ণ যুগে ভাস্বর ছিলো, ফিলিস্তিন মুসলিমবিশ্বের অধীনে থাকার সুবাদে এর বড় একটা অংশ উপভোগ করেছিলো এবং নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পেরেছিলো। মুসলিমরা গ্রিকদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংরক্ষণ করেছিলো এবং অনেকক্ষেত্রেই নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা উদ্ভাবন করেছিলো, যা কিনা পরে ইউরোপীয় সভ্যতার পুনর্জন্মে প্রভূত সহায়তা দান করেছিলো। তবে অবশিষ্ট সা¤্রাজ্যের অংশের মতো, ফিলিস্তিন মামলুকদের অধীনে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলো এবং একপ্রকার পতনের আবহে পড়ে গিয়েছিলো। সে এক বেদনাদায়ক ইতিহাস।
১০০০-১৮৯৯ খৃস্টাব্দ : ক্রুসেডের চ্যালেঞ্জ এবং মুসলিম শাসন
ক্রুসেডের সূচনার পেছনে ধর্মীয় কারণটা মুখ্য হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণও এর সাথে যুক্ত ছিলো। অন্য কারণগুলোই বরং ধর্মের নামে ক্রুসেডকে অনিবার্য করে তুলেছিলো। কারণ মুসলমান ছাড়া কোনো জাতি যে মূলত ধর্মের জন্য লড়ে না, ইতিহাসই এর বড় সাক্ষী। ১০৯৫ থেকে নিয়ে ১২৯১- প্রায় দুই শতাব্দীজুড়ে এই ধ্বংসাত্মক ক্রুসেডের সূচনা ঘটেছিলো পোপ দ্বিতীয় আরবানের একটি বিভ্রান্তিমূলক ঘোষণার মাধ্যমে। ফ্রান্সের পিটার যখন বায়তুল মুকাদ্দাস জিয়ারতে গেলেন, তার দৃষ্টিতে ‘ঈশ্বরের ঘরে’র ওপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব তার ভালো লাগলো না। ইউরোপে ফিরে গিয়ে তিনি লাগাতার সফর করে ফিলিস্তিনি খৃস্টানদের দুরাবস্থার মিথ্যে কাহিনী ছড়িয়ে পুরো ইউরোপকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইলেন। অনেকটা সক্ষমও হলেন।
পিটারের এ সফর পাশ্চাত্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করলো। চতুর এই ধর্মযাজক খৃস্টান ধর্মের অনুসারী দুষ্কৃতকারীদের শাস্তির ব্যাপারটা বড় করে তুললেও বায়তুল মুকাদ্দাস দর্শন করতে-আসা-পশ্চিমা খৃস্টানদের দুষ্কর্মগুলো একদম চেপে গেলেন। বায়তুল মুকাদ্দাস দর্শনে এসে নানারকম অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া খৃস্টানদের শাস্তি দেয়া হয়েছিলো। পোপ যেহেতু গীর্জাসমূহের আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন, তিনি বিভিন্ন উপগোষ্ঠীর একটি সম্মেলন ডাকলেন এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন। ঘোষণার শেষ দিকে তিনি বললেন, এ যুদ্ধে মারা গেলে খৃস্টান যে কারো সবধরনের পাপ মোচন হয়ে যাবে। চরম পাপীও স্বর্গ লাভে ধন্য হবে। খৃস্টানরা এরপর সেন্ট পিটারের নেতৃত্বে দলে দলে ফিলিস্তিনে হামলার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। শুরু হয় মানবেতিহাসের দীর্ঘতম ও ধ্বংসাত্মক ধর্মযুদ্ধ- ক্রুসেড।
প্রথম ক্রুসেড
১০৬০ এর দশকে সালজুক (মুসলিম) তুর্কীদের হাতে জেরুসালেমের কর্তৃত্ব চলে এলে পশ্চিমাবিশ্বে একপ্রকার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যে-কোনো পটপরিবর্তনেই কিছু অনিশ্চয়তা ও সন্দেহের অবকাশ দেখা দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমাদের কাছে এই পরিবর্তন সাধারণ ছিলো না, এটা ক্রমশ শক্তিশালী-হতে-থাকা-ইউরোপিয়ানদের সামনে যুদ্ধের একটি অজুহাত দাঁড় করিয়ে দেয়। ধাপে ধাপে পরে যেটি ক্রুসেডে রূপায়িত হয়।
১০৯৫-১১৪৫ খৃস্টাব্দ। পোপের ঘোষণার পর একে একে চারটি বিশাল বাহিনী বায়তুল মুকাদ্দাস জয়ের সঙ্কল্প নিয়ে যাত্রা করলো। পাদরি পিটারের অধীনে তের লাখ খৃস্টানের এক বিশাল বাহিনী কনস্টান্টিনোপলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এরা এতোটাই বর্বর ছিলো যে পথে পথে নিজেদের ধর্মের লোকদের উপরই হত্যা, রাহাজানি ও লুটপাটের ত্রাস কায়েম করে। বুলগেরিয়া হয়ে এরা যখন কনস্টান্টিনোপল পৌঁছে, এখানকার রোমান স¤্রাট উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দায়ে এদের গতি এশিয়া মাইনরের দিকে ঘুরিয়ে দিতে বাধ্য হন। এরা যখন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করে, সালজুকি শাসক কালাজ আরসালান এ বাহিনীটি নাস্তানাবুদ করে দেন।
খৃস্টানবাহিনীর প্রচুর সৈন্য নিহত হয়। ক্রুসেডারদের প্রথম এ অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ক্রুসেডারদের দ্বিতীয় বাহিনী জার্মান পাদরি গাউসফেলের নেতৃত্বে আবার অগ্রসর হয়। তারা যখন হাঙ্গেরী অতিক্রম করে, লাগামহীন অনাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হাঙ্গেরীর লোকেরা তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। নিজেদের অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করার মধ্য দিয়েই দ্বিতীয়বারের মতো ব্যর্থ হয় খৃস্টান পাশ্চাত্য।
ক্রুসেডারদের তৃতীয় বাহিনীতে ইংল্যান্ড, ফ্র্রান্স ও ফিনল্যান্ডের স্বেচ্ছাসেবকেরাও যুক্ত ছিলো। এ বাহিনী যখন কথিত পবিত্র যুদ্ধের জন্য যাত্রা করে, ধর্মের লেবাসে উন্মত্তপ্রায় এসব স্বেচ্ছাসেবকের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শিকার হয় রাইন নদীর তীরবর্তী মোসেলসহ বেশ কয়েকটি শহরের ইহুদি বাসিন্দারা। এরা যখন হাঙ্গেরী অতিক্রম করতে থাকে, হাঙ্গেরীর বাসিন্দারা রীতিমতো কচুকাটা করে হাঙ্গেরীর মাটিকে এদের কবরস্থান বানায়।
ক্রুসেডারদের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল ও বিশাল বাহিনী ছিলো মোট দশ লাখ সৈন্যের। ১০৯৭-এ এরা রওয়ানা হয়। এ বাহিনীতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও সিসিলির রাজপুত্ররাও শামিল ছিলেন। ইতিহাসে এরাই নাইট ট্যাম্পলার হিসেবে খ্যাত। এই সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ড ছিলো ফ্রান্সের বুউয়েঁর গডফ্রির (এড়ফভৎবু ড়ভ ইড়ঁরষষড়হ) হাতে। এই বিশাল বাহিনী এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হয় এবং প্রসিদ্ধ কুনিয়া শহর অবরোধ করে। কালাজ আরসালান এবার পরাজিত হন। বিজয়ী খৃস্টানরা অগ্রসর হতে হতে এন্তাকিয়া পৌঁছে যায়। নয় মাস পরে এন্তাকিয়াও তাদের দখলে চলে যায়। সেখানকার সমস্ত মুসলমানকে তারা হত্যা করে। মুসলমানদের উপর ক্রুসেডারদের নির্যাতন ছিলো বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায়গুলোর একটি। সেখানে তারা রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়।
এটা ইউরোপিয়ানদের নিজস্ব বিবরণীতেই উল্লেখ আছে। শহরে কী নারী, কী পুরুষ, কী শিশু, কী বৃদ্ধ- যাকে যেখানে যে অবস্থাতেই পাওয়া গেছে, নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রবহমান রক্তে সেদিন নাকি ঘোড়ার ক্ষুরগুলো পর্যন্ত পিছলে পিছলে যাচ্ছিলো। এমনই ছিলো বর্বর খৃস্টানদের নৃশংসতার নমুনা। প্রায় এক লাখ মুসলমান নিহত হন। এন্তাকিয়ার পর বিজয়ী খৃস্টান বাহিনী সিরিয়ার কয়েকটি শহর দখল করতে করতে হিমস পৌঁছে।
বায়তুল মুকাদ্দাসের পতন
হিমস দখল করার পর ক্রুসেডাররা বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে। ফাতেমি বংশের শাসকেরা বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষার সন্তোষজনক ব্যবস্থা নেয় নি বা নিতে পারে নি। খৃস্টান এই ধর্মীয় উন্মাদরা ১৫ জুন ১০৯৯ সালে সহজেই বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়। ‘ঈশ্বরের পবিত্র শহর’ রক্ষা এবং পবিত্র ধর্মযুদ্ধের বুলি আওড়িয়ে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ শুরু করলেও বায়তুল মুকাদ্দাস শহরের পবিত্রতার দিকে কোনো খেয়ালই করা হয় নি। মুসলমানদের উপর এ শহরেও নৃশংস গণহত্যা চালানো হয় এবং তাদের ধনসম্পদ লুটে নেয়া হয়। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরাও এই লজ্জাজনক অত্যাচারের কাহিনী অস্বীকার করতে পারেন নি। তারাই বরং একে ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
অথচ মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন জেরুসালেমের কর্তৃত্ব বুঝে নেন, স্থানীয় খৃস্টানদের সাথে তাঁর ও মুসলিমবাহিনীর আচরণ ছিলো সম্পূর্ণ উল্টো। এক ফোঁটা রক্ত ঝরে নি। একটা তলোয়ারও খাপমুক্ত হয় নি। বিজয় ধরে রাখা, পরবর্তী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে গডফ্রি জেরুসালেমের স¤্রাট পদে সমাসীন হয়। বিজিত এলাকাগুলো খৃস্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। এসব এলাকার মধ্যে ছিলো ত্রিপোলি, এন্তাকিয়া ও সিরিয়ার বিভিন্ন অংশ। এসময় মুসলমানদের পরাজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো অনৈক্য ও গোত্রীয় বিচ্ছিন্নতা।
সালজুকীদের বিচ্ছিন্নতার মাঝখানে এ পর্যায়ে ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হন সুলতান ইমাদুদ্দীন জঙ্গী রহ.। তিনি জঙ্গীশাসনের গোড়াপত্তন করেন এবং মুসলমানদের নব জীবনে ফিরিয়ে আনেন। তিনি হারবান, হালাব ইত্যাদি এলাকা জয় করে নিজের রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করেন। যে সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে ক্রুসেডারদের তিনি প্রতিহত ও পরাজিত করেন, ইসলামের ইতিহাসে তা গৌরবময় অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ইমাদুদ্দীন ইথারব দুর্গ ও মিসরের সীমান্ত এলাকা থেকে খৃস্টানদের বিতাড়িত করে নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করেন। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রুসেডারদের করুণ পরাজয় বরণ করতে হয় এবং ইমাদুদ্দীন সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেন। এই মহান সিপাহসালারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ শহর বা’লাবাক্কাতে পুনর্বার ইসলামি পতাকা উড্ডীন করা।
নাইট টেম্পলারদের উত্থান ও নৃশংসতা
১১১৮ সালে (মতান্তরে ১১১৯ সালে) সম্রাট ২য় বল্ডউইনের সময় একদল সন্ন্যাসীর মধ্য থেকে স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরীর প্রস্তাব আসে, যাদের কাজই হবে কেবল আলআকসার তীর্থযাত্রীদের প্রতিরক্ষা ও জেরুসালেম সংরক্ষণ। এই বাহিনী তৈরীর মূলে ছিলেন হিউ ডি প্যান- একজন ফরাসি নোবেলম্যান। (হড়নষব সধহ- রাজকীয় প্রথায় একজন সম্মানিত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি)। এই বাহিনীর মাধ্যমে ইউরোপ থেকে বিশেষত আরব-আফ্রিকায় ধর্মীয় বা ব্যবসায়িক যাত্রার নিরাপত্তাবিধানের একধরনের বাড়তি দায়িত্ব নেওয়া হয়। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ এই উদ্দেশ্যের ব্যাপারে দ্বিমত করেন।
তাদের ধারণা- এই বাহিনী তৈরীর ‘মতলব’ অন্যকিছু ছিলো। ঘটনা যাই হোক, এর নাম দেয়া হয় ঞযব ঙৎফবৎ ড়ভ ঃযব চড়ড়ৎ কহরমযঃং ড়ভ ঃযব ঞবসঢ়ষব ড়ভ করহম ঝড়ষড়সড়হ সংক্ষেপে ঞযব কহরমযঃ ঞবসঢ়ষধৎং। এক দিকে এরা সন্ন্যাসী অপর দিকে নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা। তাদের ভাষায়- ঈশ্বরের যোদ্ধা, যাদের ইহলৌকিক কোনো পিছুটান থাকবে না।
সম্রাট বল্ডউইন ক্রুসেড যোদ্ধাদের বায়তুল মুকাদ্দাসের কর্তৃত্ব দান করেছিলেন। এসময় তারা মসজিদের মাটি খুড়ে বিপুল গুপ্তধন লাভ করে। গুপ্তধনের আকার-প্রকার-পরিমাণ নিয়ে নানান কথা প্রচলিত থাকলেও তা যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলো তাতে সন্দেহ নেই। সম্পদপ্রাপ্তির পাশাপাশি এটা মূলত তাদের কাছে চূড়ান্ত মুক্তিসনদ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। টেম্পলারদের প্রধান এরপর ফ্রান্সে আসেন। চার্চপ্রধান, এমনকি সম্রাটও অবশেষে পোপের সাথে দেখা করেন এবং তার কাছ থেকে একটি অনাক্রম্যতা (রসসঁহরঃ) সনদ লাভ করেন। এর অর্থ ছিলো- কোনো দেশের আইন তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। কোনো রাষ্ট্রের নিয়মনীতি মানতে হবে না, খাজনা বা কোনোপ্রকার ট্যাক্সও দিতে হবে না [প্রাগুক্ত নোট ২]।
ঠিক কিসের বিনিময় বা ক্ষমতাবলে তারা এমন সনদ নিতে পারলো সেটা পরিষ্কার না হলেও গুপ্তধনপ্রাপ্তির সৌজন্যে তখন তারা অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যায় এবং ইউরোপজুড়ে তাদের ক্ষমতার বিস্তার ঘটে। তাদের হাত ধরে একটি ব্যাংকিং সিস্টেমও গড়ে ওঠে। তীর্থযাত্রীরা নিরাপত্তার জন্য নিজেদের অর্থ (সোনা-রুপা) ওদের দফতরে জমা দিতো এবং এর বিপরীতে সেই মূল্যের কাগজের রিসিট নিয়ে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতো। নির্দিষ্ট শহরাদিতে রিসিট দেখিয়ে প্রচলিত মুদ্রা তুলতে পারতো। এই সার্ভিসের জন্য ১০% চার্জ করা হতো। ক্রুসেডের সাথে নাইট-টেম্পলারদের যোগসূত্র ছিলো অত্যন্ত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ।
দ্বিতীয় ক্রুসেড
১১৪৪-১১৮৭ খৃস্টাব্দ। ইমাদুদ্দীনের ইনতেকালের পর ১১৪৪ খৃস্টাব্দে তার সুযোগ্যপুত্র নূরুদ্দীন জঙ্গী পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ক্রুসেডারদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে তিনি পিতার চেয়ে কোনো অংশে কম তৎপর ছিলেন না। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি মুসলমানদের মধ্যে জিহাদের নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চার করেন এবং খৃস্টানদের কাছ থেকে প্রচুর এলাকা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হন। প্রত্যেকটি যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি ক্রুসেডারদের পরাজিত করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় রওহা শহরটি আবার মুসলমানদের দখলে চলে আসে।
ক্রুসেডারদের পরাজয়ের খবর সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লে আবার পোপ তৃতীয় কনরাড এবং ফ্রান্সের শাসক সপ্তম লুইয়ের নেতৃত্বে নয় লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইউরোপ থেকে রওয়ানা হয়। এই বাহিনীতে নারীরাও ছিলো। প্রথম ক্রুসেডের মতো এ বাহিনীর সৈন্যরাও অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল ছিলো। সপ্তম লুইয়ের বাহিনীর একটি বড় অংশ সালজুকীদের হাতে ধ্বংস হয়। তারা যখন এন্তাকিয়ায় পৌঁছে, ততোদিনে তাদের তিন চতুর্থাংশ সেনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। অবশিষ্ট সৈন্যরা অগ্রসর হয়ে দামেশক অবরোধ করে। কিন্তু সাইফুদ্দীন জঙ্গী ও নূরুদ্দীন জঙ্গীর সম্মিলিত বাহিনীর প্রচেষ্টায় ক্রুসেডারদের পরিকল্পনা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। পিছু ধাওয়া করে সপ্তম লুই ও কনরাডকে আবার ইউরোপের সীমান্তের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় ক্রুসেড এভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায়।
দৃশ্যপটে বীর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ.
পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে এবং ইসলামের ইতিহাসে তখন এমন এক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে, যার কৃতিত্ব ও অবদান বহু বহু যুগ পরে এসেও এতোটুকু ম্লান হয় নি। তিনি ইউসুফ বিন আইয়ূব, ইতিহাসে যার খ্যাতি- গাজী সালাহুদ্দীন আইয়ূবী নামে। মুসলিম ইতিহাসের মহান সিপাহসালার, আধুনিক যুগের খালিদ বিন ওয়ালিদ। মিসরের ফাতেমি খলিফা ফায়েজ বিল্লাহর সক্ষমতা ছিলো না খৃস্টানদের ¯্রােত প্রতিহত করার। তার মন্ত্রী শাদের সাদী ক্রুসেডারদের বিপদ অনুভব করে নূরুদ্দীন জঙ্গীকে মিসরে হামলার আহ্বান জানালেন। নূরুদ্দীন জঙ্গী নিজ ভাই আসাদুদ্দীন শিরকোহকে এ অভিযানে নিযুক্ত করলেন। আসাদুদ্দীন মিসরে প্রবেশ করে খৃস্টানদের নাস্তানাবুদ করে দিলেন। কিন্তু ফাতেমি মন্ত্রী সাদী বিশ্বাসঘাতকতা করলেন।
শিরকোহের বিরুদ্ধে খৃস্টানদের সাথে তিনি আঁতাত করলেন। ১১২৭ খৃস্টাব্দে শিরকোহ আবার মিসরে হামলা চালালেন এবং আলেকজান্দ্রিয়া দখলের পর মিসরের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নিলেন। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী এসব অভিযানে শিরকোহের সহযোগী ছিলেন। শাদের সাদীকে বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের দায়ে প্রাণদ- দেয়া হয়। শিরকোহ হন খলিফার মন্ত্রী। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী তখন শিরকোহের স্থলাভিষিক্ত হন। খলিফা তাকে আল মালিকুন নাসির উপাধী দেন। খলিফার ইনতেকালের পর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী মিসরে আব্বাসীদের নামে খুতবা চালু করেন। মিসরের স্বাধীন খলিফা হওয়ার পর সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। বদলে যেতে শুরু করে ইতিহাসের ধারা।
হিত্তিন যুদ্ধ
সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ১১৮২ খৃস্টাব্দের মধ্যে সিরিয়া, মোসেল, আলেপ্পো ইত্যাদি প্রাচীন ও বিখ্যাত নগর জয় করে ইসলামি খিলাফার অন্তর্ভুক্ত করেন। এ পর্যায়ে ক্রুসেডারদের নেতা রেনোল্ড তার সাথে চার বছরের শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। শর্ত অনুযায়ী স্থিতিশীলতা বজায় ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার কথা থাকলেও ক্রুসেডারদের আচরণে চুক্তিটি মূলত কাগজ-কলমেই সীমিত থেকে যায়। ক্রুসেডাররা যথারীতি বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা সৃষ্টিতে লিপ্ত থাকে এবং মুসলমানদের কাফেলার ওপর হামলাও অব্যাহত রাখে।
১১৮৬ সালে খৃস্টান অধিপতি রেনোল্ড আরো কয়েকজন খৃস্টান নেতাকে সাথে নিয়ে মদিনা মুনাওয়ারায় হামলার উদ্দেশ্যে হেজাজে অভিযান চালানোর ধৃষ্টতা দেখায়। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী তার অপতৎপরতা রুখে দেয়ার পদক্ষেপ নেন এবং অবিলম্বে রোনাল্ডকে ধাওয়া করে করে হিত্তিন গিয়ে ধরে ফেলেন। সুলতান রোনাল্ডবাহিনীর উপর এমন এক আগ্নেয় উপাদান নিক্ষেপ করেন যাতে মাটিতে আগুন জ্বলে ওঠে। শত্রুবাহিনী আক্রমণ তো দূরের কথা, পালাবারও উপায় খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো। সাল তখন ১১৮৭। হিত্তিনে সংঘটিত হলো ইতিহাসের ভয়াবহতম এক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তিরিশ হাজার খৃস্টান সেনা নিহত হয়। বন্দী হয় প্রায় সমপরিমাণ। রেনোল্ডও বন্দী হয়। ওয়াদার বরখেলাফ এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে সুলতান নিজ হাতে দেহ থেকে তার মাথা ছিন্ন করেন। মুসলিমবাহিনী এরপর খৃস্টান অধ্যুষিত এলাকাগুলো ছেয়ে ফেলতে শুরু করে।
বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়
হিত্তিনে জয় লাভের পর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী জেরুসালেম ও বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মনোযোগ দেন। এক সপ্তাহ ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর খৃস্টানরা অস্ত্র ফেলে দেয় এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করে। ঠিক ৯১ বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাস আবার মুসলমানদের অধীনে চলে আসে। বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় ছিলো সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তবে প্রতিশোধের আগুনে জ্বললেও তিনি ক্রুসেডারদের পথে হাঁটলেন না। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের অনুসরণ করে নৃশংসতা থেকে সম্পূর্ণ বিরত রইলেন। খৃস্টানদের উপর সাধারণ সেনা দ্বারাও কোনো প্রকার অত্যাচার-নির্যাতন হতে দিলেন না। চল্লিশ দিনের মধ্যে শহর ছেড়ে যেতে অনুমতি দিলেন। দয়ালু সুলতান মুক্তিপণ হিসেবেও নির্ধারণ করলেন মামুলি অর্থ।
তা-ও যারা পরিশোধ করতে অপারগ হলো, তাদের এমনিতেই মুক্তি দিলেন। কারো কারো মুক্তিপণ তিনি নিজের পক্ষ থেকে দিয়ে দিলেন। তখন থেকে প্রায় ৭৬১ বছর পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদেরই আয়ত্তে ছিলো। আর আজ? পশ্চিমাদের মদদে ১৯৪৮ এর একটি ষড়যন্ত্র এবং ১৯৬৭ এর চাপিয়ে দেয়া আরেকটি যুদ্ধ বদলে দেয় বাস্তবতা। পরাধীন হয় ফিলিস্তিন। হাতছাড়া হয় আলআকসা। ইহুদিদের কব্জায় থাকা জেরুসালেম-বায়তুল মুকাদ্দাসের কান্না কি আমরা শুনতে পাই?… কবে আসবেন আরেকজন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী?…
তৃতীয় ক্রুসেড
বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়া ক্রুসেডারদের জন্য মৃত্যুর পয়গামের চেয়ে কম ছিলো না। পোপ ৩য় আরবান হার্ট এটাকে মারা যান। সালাহুদ্দীনের বিজয় ইউরোপে তুমুল ক্ষোভ ও কম্পন সৃষ্টি করে। শুরু হয়ে যায় তৃতীয় ক্রুসেডের আয়োজন। পাদরি ও ধর্মযাজকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে খৃস্টানদের উত্তেজিত করে তোলেন। পুরো ইউরোপ এতে যোগ দেয়। জার্মান স¤্রাট ফ্রেডরিক বারোসা, ফ্রান্সের স¤্রাট ২য় ফিলিপস অগাস্টাস সশরীরে এ যুদ্ধে অংশ নেন। পথে কোনো এক
নদীতে ফ্রেডরিক ডুবে মরেন। কুলক্ষণ ভেবে বা নিরাশ হয়ে খৃস্টান বাহিনী যাত্রা ভঙ্গ করেন।
১১৮৯ সালে ইংল্যান্ডের স¤্রাট তৃতীয় রিচার্ড সেকালের সবচেয়ে ভারী অস্ত্র ও কামানসহ বিশাল এক বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। গন্তব্যস্থলে পৌঁছলে তার সাথে এতোদিন সাধারণ সিভিলিয়ান সেজে থাকা ও পলাতক ক্রুসেডাররাও শরিক হয়। তা ছাড়া সেই অঞ্চলের খৃস্টান সৈন্যরা, যারা আগে বল্ডউন ও রোনাল্ডের অধীনে ছিলো তারাও সংঘবদ্ধ হয়। সবমিলিয়ে খৃস্টান বাহিনী বিপুল আকার ধারণ করে। অপরদিকে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সৈন্যসংখ্যা দিন দিন কমে আসছিলো। প্রশিক্ষিতদের পাশাপাশি সাধারণ মুসলিমদের নিয়ে গঠিত একই বাহিনীর পক্ষে বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তো অসম্ভবই। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য মুসলিম নেতার আশানুরূপ সাড়া না পাওয়াও এর একটা বড় কারণ ছিলো।
রিচার্ড বিপুল শক্তি নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী আক্কা বন্দর রক্ষার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। কিন্তু ক্রুসেডারদের কাছে ইউরোপ থেকে লাগাতার সাহায্য আসতে থাকে। এক যুদ্ধে দশ হাজার খৃস্টান সৈন্য নিহত হয়। তারপরও ক্রুসেডাররা অবরোধ বহাল রাখে। যেহেতু অন্যকোনো ইসলামি রাষ্ট্র থেকে সুলতানের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো হলো না, এজন্য ক্রুসেডারদের অবরোধে শহরবাসীর সাথে সুলতানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে শহরবাসীরা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেয়ে শহরটি খৃস্টানদের হাতে ন্যস্ত করতে রাজি হয়। দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। মুসলমানরা দু’লাখ স্বর্ণমুদ্রা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিশোধে সম্মত হয় এবং খৃস্টানদের মহাক্রস ও পাঁচশ খৃস্টান বন্দীকে ফেরত দেয়ার শর্ত মেনে নিয়ে অস্ত্র ত্যাগ করে। মুসলমানদের সবকিছু সাথে নিয়ে শহর থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু খৃস্টান রাজা রিচার্ডও বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং অবরুদ্ধ সব মুসলিমকেই হত্যা করেন।
আক্কার পর ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিনের আসকালান বন্দরের দিকে অগ্রসর হয়। আসকালানের পথে সুলতানের বাহিনীর সাথে খৃস্টানদের মোট এগার-বারটি লড়াই হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আরসুভের লড়াই। সুলতান বীরত্ব ও সাহসিকতার উজ্জ্বল নমুনা পেশ করেন। কিন্তু কোনো মুসলিমরাষ্ট্র বিশেষ করে বাগদাদের খলিফার পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য না আসায় বাধ্য হয়ে সুলতানকে পিছু হটতে হলো। ফিরে আসার সময় সুলতান নিজেই আসকালান শহর ধ্বংস করে দিলেন। ক্রুসেডাররা যখন সেখানে পৌঁছলো, ইট-বালির স্তূপ ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না। এদিকে সুলতান বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষার সব আয়োজন সম্পন্ন করলেন। কারণ ক্রুসেডারদের এবারকার মূল টার্গেট ছিলো বায়তুল মুকাদ্দাস।
সুলতান তার ছোট্ট একটি বাহিনী নিয়ে দারুণভাবে খৃস্টানদের বিশাল বাহিনী প্রতিহত করতে লগলেন। ফুরিয়ে আসতে থাকা রসদ এবং দুর্বল হতে থাকা বাহিনী নিয়ে বিজয়ের কোনো আশা দেখতে না পেয়ে ক্রুসেডাররা সন্ধির আবেদন জানায়। দু’পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হয়। সন্ধির মধ্য দিয়েই তৃতীয় ক্রুসেড শেষ হয়।
চুক্তির শর্তাবলি-
- বায়তুল মুকাদ্দাস যথারীতি মুসলমানদের অধীনেই থাকবে।
- পশ্চিমা তীর্থযাত্রীদের জেরুসালেমে আসা-যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে।
- ধ্বংসপ্রাপ্ত আসকালান স্বাধীন এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
- দুই পক্ষের পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করা হবে।
ঊ্যাপাক প্রস্তুতি সত্ত্বেও এই ক্রুসেডে খৃস্টানরা আক্কা বন্দর ছাড়া কিছুই লাভ করতে পারেনি। পুরোপুরি বিফল হয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যায়। প্রাণঘাতি রোগে সুলতানের সেবা ও সহমর্মিতা পেয়ে খোদ রিচার্ড তো সুলতানের বদন্যতা, উদারতা ও বীরত্বে ব্যাপক মুগ্ধ হন। জার্মান রাজা ইতোপূর্বে পালানোর সময় নদীতে ডুবে মারা যায়। এসব যুদ্ধে প্রায় ছয় লাখ খৃস্টান সেনাকে প্রাণ হারাতে হয়।
অন্যান্য ক্রুসেড
রিচার্ডের ইচ্ছা ছিলো তিনি আরেক দফা অভিযান চালাবেন। কিন্তু জেরুসালেমে আহত হওয়ার পর তার সে ক্ষতস্থান আর পুরোপুরি ভালো হয় নি বরং সেই ক্ষত থেকেই তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে ক্রুসেড থেমে যায়নি। এই যুদ্ধ তার পরের আরো একশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কিন্তু ক্রুসেডাররা কখনো জেরুসালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করতে সমর্থ হয়নি। তৃতীয় ক্রুসেডের পর ১১৯৫, ১২০২-৪, ১২১২-২১, ১২২৭, ১২২৮-২৯, ১২৪৯-৫৪, ১২৭০-৭২ এবং ১২৯১ সালগুলোয় একের পর এক ছোট-বড় যুদ্ধ চলতেই থাকে। প্রতিবারই খৃস্টানরা বিপুল রক্তপাত আর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে।
তবে এই তেরতম শতাব্দীর পর ক্রুসেডারদের মধ্যে আর যুদ্ধের সাহস রইলো না। মুসলমানরাও নিজেদের এলাকা রক্ষায় সচেতনতা অবলম্বন করতে গিয়ে নতুন যুদ্ধের পথে আর অগ্রসর হয় নি। খৃস্টানদের দীর্ঘ যুদ্ধের ধারা শেষ হয় এবং ধ্বংস ও পরাজয় ছাড়া কিছু অর্জন করতে না পারায় তাদের যুদ্ধোন্মাদনা পুরোপুরি থিতিয়ে যায়। আপাতত অবসান ঘটে দুই শতাব্দীব্যাপী ধ্বংসাত্মক ক্রুসেডের।
বিশেষ ক্রুসেড
এখানে যে ক্রুসেডগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো, এর বাইরেও কয়েকটি ক্রুসেড সংঘটিত হয়। সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন ১২১২ খৃস্টাব্দে বালকদের ক্রুসেড নামে এক বিশেষ ক্রুসেডের আয়োজন করা হয়। খৃস্টান পাদরিদের মতে বয়স্ক মানুষেরা পাপী হয়ে থাকে। পাপীরা থাকার কারণে ক্রুসেডবাহিনী জয় লাভ করতে পারছে না। বালকেরা যেহেতু নিষ্পাপ, অতএব তাদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করা গেলে বিজয় আসতে পারে। ৩৭ হাজার বালকের এক বিশাল বাহিনী গঠন করা হয়। ফ্রান্স থেকে ৩০ হাজার বালকের বাহিনী রওয়ানা হয় সেনাপতি স্টিফেনের নেতৃত্বে আর জার্মানি থেকে নিকোলাসের নেতৃত্বে রওয়ানা হয় আরো ৭ হাজার বালক।
কিন্তু এসব বালকের কেউই বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। পথে পথে ফ্রান্সের উপকূলীয় এলাকা ও ইতালিতে তাদের ধীরে ধীরে বিভিন্ন নেতা-গোত্রপতিদের গোলামে পরিণত করা হয় কিংবা যৌন নিপীড়ন শেষে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। নিজেদের মধ্যে লড়াই করেও অনেকে জীবন হারায়। কট্টর খৃস্টান ঐতিহাসিকেরাও স্বীকার করেন- খুব কম সংখ্যক বালকই নিজ দেশে ফিরতে পেরেছিলো। নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে এমন ভয়ানক, ঘৃণ্য এবং লজ্জাজনক খেলার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও পাওয়া যায় না। বালকদের এ ক্রুসেড হয় পঞ্চম ক্রুসেডের আগে।
ইউরোপে উসমানি খেলাফতের সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা যেসব যুদ্ধ করে, সেগুলোকেও তারা ক্রুসেড হিসেবে আখ্যায়িত করে। সেই অর্থে পশ্চিমের একপক্ষীয় ক্রুসেড এখনো চলমান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস ঘিরে নেওয়া ওদের পদক্ষেপগুলোও সেটাই প্রমাণ করে। ৯/১১ ’র পর থেকে যা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
নাইট টেম্পলারদের শেষ পরিণতি
১২৯২ সালে জয়-করা একমাত্র শহর আক্কা ব্যতীত কোনো এলাকা নাইট-টেম্পলারদের অধিকারে থাকে নি এবং ১২৯২ সালের যুদ্ধে, মতান্তরে ১২৯১ সালে পরাজিত হয়ে তারা তাদের শেষ লর্ড (এৎধহফ গধংঃবৎ ড়ভ ঃযব কহরমযঃং ঞবসঢ়ষধৎ) জ্যাক ডি মলোয়সহ সাগর পাড়ি দিয়ে সাইপ্রাসে আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকে ফ্রান্সের স¤্রাটের কাছে মিলিটারি সাহায্যের আহ্বান পাঠায়। কিন্তু কোনো সাহায্য আসে নি। ফ্রান্সের সম্রাট ফিলিপ দ্য ফেয়ার (চযরষষরঢ় ঃযব ঋধরৎ) তখন নাইট-টেম্পলারদের কাছ থেকে নেয়া ধারের ভারে ডুবুডুবু অবস্থায়। তা ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না।
ইংল্যান্ডের সাথেও তখন তার যুদ্ধ চলছিলো। লক্ষণীয় যে, টেম্পলাররা তাদের টাকা সুদে ধার দিয়ে বাদশাহি চালাচ্ছিলো, কিন্তু যুদ্ধের খরচের জন্য নিজেদের টাকা ব্যয় না করে সম্রাটকেই সে খরচ বহন করতে আবেদন করছিলো যাতে সম্রাট পরিশেষে সেই টাকা ট্যাক্সের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে তুলে নেয়। সেই যুগের এমন কারসাজি আর আজকের কারসাজির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বড় বড় কর্পোরেশনের চাপে ইউরোপিয়ান সরকারগুলো যুদ্ধে যায় এবং ট্যাক্স পেয়ারের টাকায় সে যুদ্ধ চালায়। কর্পোরেশনগুলো এই সুযোগে যুদ্ধোত্তর ফায়দা হাসিল করে।
ডি মলোয় নিরাশ হয়ে ১৩০৭ সালে ফ্রান্সে আসেন কিন্তু ইত্যবসরে অনেক ষড়যন্ত্র হয়ে যায়। পোপের সম্মতি নিয়ে সম্রাট ফিলিপ জ্যাক ডি মলোয় ও তার অনুচরদের গ্রেফতার করেন এবং মৃতু্যুদ- দেন। আর তাদের হত্যার মাধ্যমে ফিলিপ কর্জমুক্ত হন। এসব কাজ পশ্চিমা দেশগুলো এখনো আরবদেশের লিডারদের সাথেও করে যাচ্ছে, তাদের নির্মূল করে তাদের গচ্ছিত টাকা আত্মসাৎ করে, ইরাক-লিবিয়াসহ সাম্প্রতিক আগ্রাসনের শিকার আরব দেশগুলোর ভাগ্যেও একই ব্যাপার ঘটছে।। ডি মলোয় ও তার অনুচররা ১৩১৪ সালের ১৩ মার্চ শুক্রবার দ-প্রাপ্ত হয় এবং তারপর থেকে ঋৎরফধু ঃযব ১৩ঃয ইউরোপিয়ানদের কাছে একটি কালো দিন হিসেবে আখ্যায়িত হতে শুরু করে।
কিন্তু অবশিষ্ট সাধারণ টেম্পলারদের কী হলো? তাদের বিরাট সম্পত্তির কী হলো? তারা কোথায় গিয়ে আত্মগোপন করলো? এসবের কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। অনেকের ধারণা, এই নাইট-টেম্পলাররা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গোপন সোসাইটি গড়ে তোলে এবং সেসবের আড়ালে থেকেই মিশন অব্যাহত রাখে।
ষোল-উনিশ শতক : উসমানি খিলাফাহ
১৫১৭ খৃস্টাব্দ। এশিয়া মাইনরের উসমানীয় তুর্কীরা মামলুকদের পরাজিত করলো। সামান্য কিছু প্রতিবন্ধকতা ব্যতীত উসমানীয়রা ১৯১৭-১৮ পর্যন্ত ফিলিস্তিন শাসন করে। দেশটাকে কয়েকটা জেলায় ভাগ করা হয়েছিলো, যেগুলোকে মাঞ্জাক বলা হতো। জেরুসালেম বা আশপাশের জেলাগুলোর প্রশাসন আরব ফিলিস্তিনিদের অধীনে দেয়া হয়েছিলো। যারা ছিলো কেনানিদের বংশধর। তবে খৃস্টীয় ও ইহুদি সম্প্রদায়গুলোকে বেশ ভালো মাপের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছিলো। ষোড়শ শতাব্দীতে উসমানীয় সা¤্রাজ্যের গৌরবের সময়ে ফিলিস্তিন তার অংশীদার হয়েছিলো। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে উসমানি সা¤্রাজ্যের পতন দেখা দেওয়ায় ফিলিস্তিনের অবস্থাও আর ভালো থাকে নি।
১৮৩১-১৮৪০ খৃস্টাব্দ। মিসরের আধুনিকায়নের রাজপ্রতিনিধি মুহাম্মদ আলী তার প্রশাসনকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন। তার শাসনপদ্ধতি জমিজমা সংক্রান্ত আইন, কৃষিপণ্য ও শিক্ষায় যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছিলো।
১৮৪০ খৃস্টাব্দ। উসমানি সা¤্রাজ্য নিজেদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো। বেশ কিছু সংস্কারও সাধন করলো। আর ফিলিস্তিনে এসময় ইহুদিদের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১,২০০, পরের পাঁচ দশকে- ১৯১৪ সালে এসে যা ৮৫,০০০-এ উন্নীত হয়। আজকের যে ফিলিস্তিনকে ইহুদিময় করার অপচেষ্টা চলছে তখন সেখানে তাদের উপস্থিতি বলতে গেলে ছিলোই না। আরব মুসলিম এবং কিছু আহলে কিতাব বা খৃস্টান ধর্মের মানুষই ফিলিস্তিনে বসত গেড়েছিলেন।
১৮৯৭ খৃস্টাব্দ
সর্বপ্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেস সুইজারল্যান্ডের বাসল শহরে অনুষ্ঠিত হলো। ওরা ফিলিস্তিনকে উপনিবেশীকরণের ‘বাসল-কর্মসূচি’ ঘোষণা করে। আর এই ঘোষণার মাধ্যমেই শুরু হয় শতাব্দীব্যাপী জুলুম-শোষণের রক্তাক্ত ইতিহাস, এখনো যা সমানভাবে চলমান, নৃশংসতার মাত্রা তো দিনে দিনে বরং বেড়েই চলেছে।
১৯০০ -১৯৪৬ : পতন আর ঘর হারানোর দুঃসহ কাল
১৯০৪ খৃস্টাব্দ। চতুর্থ জায়োনিস্ট কংগ্রেস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো আর্জেন্টিনায় ইহুদিদের জন্য তারা একটা জাতীয় স্বদেশ প্রতিষ্ঠা করবে। ইতোপূর্বে আফ্রিকার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯০৬ সালে জায়োনিস্ট কংগ্রেস মত বদলে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, তাদের স্বদেশ হবে ফিলিস্তিন।
১৯১৪ খৃস্টাব্দ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটলো। বৃটিশ সরকার উসমানীয় প্রশাসনের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনসহ আরবদেশগুলোকে স্বাধীনতা প্রদানের অঙ্গীকার করলো এই শর্তে যে, তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে তারা বৃটেনকে সহযোগিতা করবে। কারণ তুর্কীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের সঙ্গে জোট গঠন করে বৃটেনের বিপক্ষশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো। বাস্তবে যা ছিলো পূর্বপরিকল্পিত একটা ষড়যন্ত্র।
১৯১৬ খৃস্টাব্দ। বিজয়ীপক্ষের বৃহৎ অংশীদার বৃটেন ও ফ্রান্স সাইকেস-পিটক চুক্তি সই করলো। নিজেদের সুবিধামতো সমগ্র আরবভূমিকে এই চুক্তিতে তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করলো। লেবানন ও সিরিয়া ফ্রান্সকে দেয়া হলো। জর্ডান ও ইরাক বৃটেনকে। ওয়াদা ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনের ভাগ্য ঝুলিয়ে দিয়ে এর আন্তর্জাতিকায়ন করা হলো। মানে ফিলিস্তিন সরাসরি কারো অধীনে থাকবে না। পরবর্তীকালে যা সুদূরপ্রসারী ঘৃণ্য এক ষড়যন্ত্র হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে আসে।
১৯১৭-১৯১৮ খৃস্টাব্দ। ১৯১৭ ’র ২ নভেম্বর বৃটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা করে। ঘোষণাটি ছিলো বৃটিশ ফরেন সেক্রেটারি লর্ড আর্থার জে বেলফোরের পক্ষ থেকে, তাই এটি বেলফোর ঘোষণা হিসেবে খ্যাত। ঘোষণায় তিনি যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন। যেহেতু আরবরা ছিলো ইহুদিদের তুলনায় অনেকগুণ বেশি, ঘোষণাটি সবার কাছে তাই আরবদের অনুকূল হিসেবেই অনুমিত হয়।
কিন্তু এর মাঝে যে মহা ধোঁকা লুকিয়ে ছিলো, তা শুধু তারা কেনো, কেউ বুঝতে পারে নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরীর উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। আনন্দিত বৃটিশপ্রধানমন্ত্রী তার কাছে তখন জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান। উত্তর ছিলো- অর্থ নয়, আমার জাতির জন্য চাই এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন। সুতরাং তা-ই হলো। বৃটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীনে রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরবশূন্য করার জন্য কাজে লাগায় ইহুদিবলয় প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি।
এদিকে, ১৯১৮ সালে আরবদের সহায়তায় বৃটিশসরকার উসমানীয় তুর্কীদের কাছ থেকে ফিলিস্তিন দখল করে নিলো। আরবরা তুর্কীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো। কারণ, বৃটিশরা মক্কার শরীফ হুসাইনকে কথা দিয়েছিলো যুদ্ধের পর আরবদেশসমূহকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। বৃটেন এর মধ্যে গোপনে আরো দুটি সংঘাতময় প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসলো। ১৯১৬ সালে সাইকেস-পিকট চুক্তিতে বিজিত এলাকাগুলো বিভাজিত করে শাসন পরিচালনা করার ব্যাপারে ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সঙ্গে গোপন আঁতাত করলো। আরবদের অন্ধকারে রেখেই ফিলিস্তিনে জাতীয় বাসস্থান গড়তে দেয়া হবে বলে তৃতীয় আরও একটা চুক্তি তারা ইহুদিদের সঙ্গে করলো। প্রতারণা আর ষড়যন্ত্রের মচ্ছব চললো পুরো আরব এবং মুসলিমবিশ্বের বিরুদ্ধে। যারা ভুক্তভোগী হলো তারাই কেবল কিছু জানলো না।
১৯১৯-১৯২২ খৃস্টাব্দ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯১৮ থেকেই ইহুদিরা ইউরোপসহ সারা বিশ্ব থেকে ব্যাপক আকারে ফিলিস্তিনে আবাস গড়তে শুরু করলো। ১৯১৯ সালে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের সর্বপ্রথম জাতীয় সম্মেলন ডাকলো এবং এতে তারা বেলফোর ডিক্লারেশনকে পরিষ্কার ভাষায় প্রত্যাখ্যান করলো। এক বছর পর ১৯২০ -এ সান রিমো সম্মেলনে ফিলিস্তিনের উপর বৃটেনকে ম্যান্ডেট প্রদান করা হলো তাদের মতামত ও ভাবনা পাশে ঠেলে দিয়েই। এর ঠিক দু’ বছর পর লীগ অব নেশন্সের কাউন্সিল ফিলিস্তিন ম্যান্ডেট ঘোষণা করলো। ফিলিস্তিনে জারি হলো তিন দশকব্যাপী বৃটিশ-শাসন।
স্যার হারবার্ট স্যামুয়েল নামের এক চিহ্নিত ও স্বঘোষিত কট্টর ইহুদিকে ফিলিস্তিনে বৃটেনের সর্বপ্রথম হাইকমিশনার হিসেবে প্রেরণ করা হলো। তার প্রধানতম দায়িত্বই ছিলো ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন সুনিশ্চিত এবং ত্বরান্বিত করা। বৃটিশদের ম্যান্ডেটকালীন এই তিন দশকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বাড়ি-ঘরসহ বহু কৃষি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলো। অতি নগণ্য সংখ্যার ইহুদি জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫% -এ পৌঁছে গেলো। আরবদের ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হাতে তুলে দেওয়ার ইউরোপীয় ষড়যন্ত্র ততোদিনে প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছে।
১৯২৯ খৃস্টাব্দ। জেরুসালেমের ইহুদিদের বিরুদ্ধে আরবদের বেশ বড় আকারের বিদ্রোহ দেখা দিলো। ফিলিস্তিনিরা ১৩৩ জন ইহুদি নিধন করতে সক্ষম হয়েছিলো, বিনিময়ে নিজেদের ১১৬ জনকে হারিয়েছিলো। এ দাঙ্গা ঘটেছিলো দু’পক্ষের দু’রকমের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। আলআকসা মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বের দেয়ালের ব্যবহার নিয়ে ছিলো মূল বিতর্ক। মুসলিমদের পবিত্র এ স্থানকে ইহুদিরা নিজেদের পুরোনো মন্দিরের অংশ বলে দাবি করে। সব সমীক্ষাতেই পরিষ্কারভাবে দেখা যায়, এটা পবিত্র মসজিদের অংশ এবং ইসলামি যুগেই নির্মিত। প্রশাসনের সমর্থন পেয়ে ইহুদিরা গোয়ার্তুমি বজায় রাখে। তবে এর বাইরেও বির্তকের আরো বড় কারণ ছিলো আরবদের শংকা। ততোদিনে তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো- ইহুদিরা বৃটিশ-শাসিত ফিলিস্তিনকে নিজেদের এক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা দ্রুততর করছে।
১৯৩৬- ১৯৩৭ খৃস্টাব্দ। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের জমি বাজেয়াপ্তকরণ ও ইহুদি অভিবাসনের বিরুদ্ধে ছয় মাসব্যাপী এক সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরু করলো। ১৯৩৭ সালে পিল কমিশন, যার শীর্ষপদে ছিলেন লর্ড রবার্ট পিল, তিনি একখানা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। তাতে মূলত কমিশন এই উপসংহারে উপনীত হয়েছিলো যে, প্যালেস্টাইনের ম্যান্ডেট অকার্যকর। এখানে আরব ও ইহুদিদের মাঝে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মতো ভরসা তারা করতে পারছে না। অবশেষে এই কমিশন ফিলিস্তিনকে তিনভাগ করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র, একটি আরব রাষ্ট্র এবং আরও একটি নিরপেক্ষ ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে, যা বৃটেন শাসন করবে।
১৯৩৯ খৃস্টাব্দ। বৃটিশসরকার একটি হোয়াইট পেপার প্রকাশ করে যাতে তারা ইহুদি ইমিগ্রেশন সীমাবদ্ধ করার ঘোষণা এবং একইসাথে ফিলিস্তিনকে দশ বছরের ভেতর স্বাধীনতা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করে। জায়োনিস্ট তথা কট্টর ইহুদিরা এটি প্রত্যাখ্যান করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর তারা একটি সন্ত্রাসী দল গঠন চূড়ান্ত করে এবং বৃটিশ ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এক রক্তাক্ত সংগ্রামের সূত্রপাত করে, কয়েক বছরের ব্যবধানে পরবর্তী সময়ে যা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে রূপ পরিগ্রহ করে।
১৯৪৮ : ফিলিস্তিনের কফিনে শেষ পেরেক
ফিলিস্তিনে ইহুদি উপনিবেশের ইতিহাসের শুরুটা ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে। এ সময়ই ইউরোপে এন্টি-সেমিটিজম তথা ইহুদি-বিদ্বেষ দানা বাঁধতে শুরু করে। নিজেদের দেশে ইহুদিদের উপস্থিতি রীতিমতো অসহ্য হয়ে উঠতে থাকে পশ্চিমা খৃস্টানদের কাছে। তখন থেকেই ইহুদিরা নিজেদের একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করে। তাদের মতে, তাওরাতের প্রতিজ্ঞা মতে ফিলিস্তিনেই সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে তাওরাতে কোথাও বলা নেই, ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ইহুদিদের জন্য আবশ্যক।
প্রায় হাজার বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদিরা বিতাড়িত ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্যাতিত হলেও ইতিহাসের সত্য হলো, এন্টি-সেমিটিজমের উত্থানের যুগে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের কোনো অধিকারই ছিলো না। আমেরিকার সব মানুষই তো ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালসহ ইউরোপ-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। তাই বলে এখন তো তারা এসব দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি করতে পারে না। ১৮৭৮ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ফিলিস্তিন মোটামুটি সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে বিরাজ করছিলো এবং সেখানে মুসলিম ও খৃস্টানরা বেশ শান্তিতে বাস করছিলো। সামান্য ইহুদিও সেখানে ছিলো। ১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনে জনসংখ্যার
পরিসংখ্যান এরকম-
- মোট জনসংখ্যা- ৪,৬২,৪৬৫।
- আরবমুসলিম এবং খৃস্টান- ৯৬.৮%।
- আর ইহুদি মাত্র- ৩.২%।
কিন্তু নেপোলিয়নীয় নীতির অনুসারী বৃটিশদের সহায়তায় ইহুদিরা বেশ দ্রুত ফিলিস্তিনে উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। জাহাজে করে একেকবারে হাজার হাজার ইহুদিকে ফিলিস্তিনে আনা হয়, ঘরবাড়ি করে থাকার জন্য তাদের বিপুল অর্থ দেয়া হয়। বৃটিশরা একদিকে ইহুদিদের জন্য খুলে দেয় ফিলিস্তিনের দরজা, অন্যদিকে বৃটিশবাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেকগুলো প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিলো, পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য ইহুদিদের গুপ্ত সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় আত্মহননপন্থা। ১৯৪০ সালে এসএস প্যাট্রিয়া নামের একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে। ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজ উড়িয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করে। হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করলো। পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকলো দ্রুত গতিতে। ফলে ৩% থেকে বেড়ে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫ লাখ ৪০ হাজার বা ২৫% এরও বেশি। চার দশকে কয়েক হাজারের ক্ষুদ্র গোষ্ঠী থেকে তারা ছয় লাখের বিশাল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলো।
এ পর্যায়ে জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ঐতিহাসিক ‘দুই জাতি সমাধান’ প্রস্তাব করে। তারা প্রাচীন ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করে দুটি দেশ বানানোর কথা বলে- একটি ইসরাইল আরেকটি ফিলিস্তিন। এ সনদে বলা হয় জেরুসালেম শাসিত হবে সরাসরি জাতিসংঘের দ্বারা। ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসে। ফিলিস্তিনের অবস্থা তদন্ত করে ওই বছরই সেপ্টেম্বর নাগাদ জাতিসংঘের নিকট রিপোর্ট পেশ করার জন্য সেই অধিবেশনে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্য ছিলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চেকশ্লোভাকিয়া, গুয়েতেমালা, ভারত, ইরান, নেদারল্যান্ড, পেরু, সুইডেন, উরুগুয়ে ও যুগোশ্লোভিয়া। ইহুদি সম্প্রদায় ওই সময় চিৎকার করে বলতে থাকে- জাতিসংঘ যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক, ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যতীত অন্যকোনো প্রস্তাবেই তারা সম্মত হবে না।
যথাসময়ে কমিটি রিপোর্ট প্রদান করে। রিপোর্টে কমিটির সদস্যগণ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দু’ধরনের সুপারিশ করেন। কানাডা, চেকশ্লোভাকিয়া, পেরু, গুয়েতেমালা, নেদারল্যান্ড ও উরুগুয়ে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে দুটি পৃথক রাষ্ট্র করার প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে ভারত, যুগোশ্লোভিয়া ও ইরান একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের সুপারিশ করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ উভয় প্রস্তাব একটি এডহক কমিটির নিকট পাঠিয়ে দেয়। এ কমিটিতেও গুয়েতেমালা ও উরুগুয়ে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার জন্য জোরদার ওকালতি শুরু করে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন।
তুমুল বিতর্কের পর ভোট গ্রহণ করা হয় এবং ২৯-১৩ ভোটে ফিলিস্তিন বিভক্তির প্রস্তাব পাস হয়ে যায়। বৃহৎ দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও আমেরিকা উভয়ই বিভাজনের পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে প্রস্তাবটি পাস না হলে তা কার্যকরী হয় না বিধায় ১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর তারিখে সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবটি আবার বিবেচনা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই তারিখ পর্যন্ত পরিস্থিতি ইহুদিদের অনুকূলে ছিলো না। তাই বৃহৎ শক্তিগুলো নানান প্রকার টালবাহানা করে ভোটগ্রহণে বিলম্ব করতে থাকে।
অন্যদিকে ইহুদি নেতৃবৃন্দ পৃথক পৃথকভাবে জাতিসংঘ সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য প্রবল চেষ্টা শুরু করে দেয়। আমেরিকাও সেসময় ইহুদিদের পক্ষে ভোটদানের জন্য সদস্য দেশগুলোর উপর চাপ দিতে থাকে। ২৯ নভেম্বর পরিস্থিতি ইহুদিদের অনকূলে এসে যায় এবং সেই দিনই ৩৩-১৩ ভোটে ফিলিস্তিন বিভাগের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১০টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে এবং একটি দেশ পরিষদে অনুপস্থিত থাকে। প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার একচতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেলো ভূমির ৫৭% আর ফিলিস্তিনিরা পেলো ৪৩%। এ সিদ্ধান্তের পর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অত্যাচারের মাত্রা সবরকম সীমা ছাড়িয়ে যায়। ইহুদি জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী দলগুলো জোরজবরদস্তি করে মুসলমানদের বাড়ি-ঘর ও ধন-সম্পত্তি দখল করে নিতে থাকে।
জাতিসংঘ এ প্রস্তাব গ্রহণের পর মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ১৭ হাজার মুসলমান শহীদ হন। ১৪ মে রাত বারোটায় ফিলিস্তিনে বৃটেনের অছিগিরি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। তাই সে তারিখের মধ্যেই একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এদিকে ইহুদি নেতা ওয়াইজম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিস্টার ট্রুম্যানের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে একটা নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। নির্দিষ্ট সময়ে ফিলিস্তিনে বৃটেনের অছিগিরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এক মিনিট পরই ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করলো ইহুদি নেতা বেন-গুরিয়ান। এর মাত্র দশ মিনিট পর ওয়াশিংটন সময় সকাল ৬টা ১১ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বৃটেন।
ঠিক ওই সময় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মার্কিন প্রতিনিধি কর্তৃক ফিলিস্তিনকে সাময়িকভাবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আনার প্রস্তাবটি সম্পর্কে আলোচনা চলছিলো। কিন্তু কিসের কি, আলোচনা চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ রেখে বাইরে যা করার নিজেরাই করে ফেললো পশ্চিমাবিশ্ব।
এদিকে পাশের আরবরাষ্ট্রের অনিয়মিত বাহিনী ও ফিলিস্তিনে বসবাসরত আরবগণ ঘোষণার পরপরই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল আক্রমণ করেন। নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এবং প্রধানত অনিয়মিত বাহিনী দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করার কারণে ইহুদিরা আরবদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে এবং ফিলিস্তিনের বৃহদাংশ থেকে তাদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতির পর দেখা যায়- ইহুদিরা কেবল মিসরের আওতাধীন গাজা উপত্যকা (৩৬০ বর্গ কি.মি.) এবং জর্দানের শাসনাধীন পশ্চিম তীর (৫৮৬০ বর্গ কি.মি.) ও পূর্ব জেরুসালেম ছাড়া ফিলিস্তিনের ৮০% ভাগ দখল করে নিয়েছে। ফলে, নিজ বাসভূমিতে সাড়ে সাত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে যায়।
পশ্চিমা মিত্রদের সহযোগিতা ও আশকারায় দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইসরাইল। ষাটের দশকে পারমাণবিক বোমার মালিকও বনে যায় তারা। দখলদারি ও বর্বরতার ব্যারোমিটার বাড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলের একগুঁয়েমি ও নৃশংসতায় ফিলিস্তিনে রক্তগঙ্গা বইতে থাকে। আরব-ইসরাইলের মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনটি যুদ্ধ হয়। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেম ও পশ্চিম তীর জর্দানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, গাজা ও সিনাই উপত্যকা থেকে মিসরকে হটিয়ে দেয় এবং সিরিয়া থেকে গোলান মালভূমি নিজের দখলে আনে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দাবি অবজ্ঞা করে ইসরাইল এসব এলাকা তার দখলে রাখে এবং ১০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে নিজ বাসভূমিতে উদ্বাস্তুতে পর্যবসিত করে। পরে ১৯৭৯ সালে মিসরের সঙ্গে শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় ইসরাইল সিনাই থেকে এবং ২০০৫ সালে গাজা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে আসে। এসব অন্যায় যুদ্ধে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া কিছুই জোটে নি। জীবন-বাসস্থান আর ভূমির কুরবানিই কেবল দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। এখনো যা চলমান…
দেশ ও জাতির মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন) বা ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান। তিনি ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল ফাতাহরও নেতা ছিলেন।
ইটের জবাবে পাটকেল তথা সরাসরি লড়াইয়ের মাধ্যমে ইসরাইলি দখলদারির হাত থেকে ফিলিস্তিন স্বাধীন করতে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় হামাস। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। সংগঠনটি ইসরাইলের অস্তিত্বের কোনোরকম স্বীকৃতি দেয় না।
আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপরিচালনার নিজস্বতা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে ফিলিস্তিনের দুই অংশ পশ্চিম তীর ও গাজা ২০০৭ সালের আগস্টে চলে যায় এ দুটি দলের নিয়ন্ত্রণে। সেই থেকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ‘ফাতাহ’ পশ্চিম তীরে ও খালেদ মিশালের নেতৃত্বে ‘হামাস’ গাজা শাসন করছে। বছর দুই আগে দুই দলের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী নতুন করে নির্বাচনের পর একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা। কিন্তু হামাস-ফাতাহর চুক্তিকে ভালোভাবে নেয় নি ইসরাইল। তাদের মতে হামাস একটি জঙ্গি সংগঠন। হামাস-ফাতাহ জাতীয় ঐক্যের সরকার হলে সেই সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যাবে না বলে ঘোষণা দেয় ইসরাইল। আরো একবার ব্যর্থ হয় দুই দেশের শান্তিপ্রক্রিয়া।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ পর্যন্ত নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, দখলদার ইসরাইলের গোয়ার্তুমির কারণে শেষ পর্যন্ত কোনোটি সফল হয় নি। বরং দশকের পর দশক ধরে সেখানে নতুন মাত্রায় সংঘাত জন্ম নিয়েছে, ইসরাইলই যার জন্মদাতা, ইসরাইলই যার নিয়ন্ত্রক।
ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) এবং ইয়াসির আরাফাত
১৯৬৪ সালে আরব লিগের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন বা পিএলও) প্রতিষ্ঠিত হয়। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পিএলও গেরিলা হামলার মাধ্যমে ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও আরবভূমিতে বসতি স্থাপন প্রতিরোধ করতে থাকে। লেবানন কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার কারণে এই মুক্তি সংস্থা আগ বেড়ে ১৯৮০ সালে দক্ষিণ লেবানন প্রায় দখল করে নেয়। পরে ইসরাইল যুদ্ধের মাধ্যমে এই এলাকার কর্তৃত্ব দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৭৩ এর ২ মার্চ পিএলও সুদানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করে বলে অভিযোগ করা হয়। ১৯৭৪-এর ১৩ নভেম্বর আরাফাত নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে শান্তির প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।
জাতিসংঘ পিএলওকে ফিলিস্তিন জনতার একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ইয়াসির আরাফাত এক হাতে মেশিনগান ও অন্য হাতে শান্তির প্রতীক যায়তুনের শাখা নিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে উপস্থিত হন। তৃতীয় বিশ্বের ও প্রগতিশীল দেশসমূহের প্রতিনিধিরা তাকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের আওতায় আরাফাত জাতিসংঘে এসে নিরাপত্তা কাউন্সিলের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরাইলকে স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্থাপনের শর্ত হিসেবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সকল সহিংস তৎপরতা বন্ধ করার ঘোষণা দেন।
এ ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৪৯ সালের যুদ্ধ বিরতি রেখা-মধ্যবর্তী এলাকায় ইসরাইলি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে পশ্চিম তীর ও গাজাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনা দেয়া হয়। এর পরে মাদ্রিদ ও অসলোতে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পিএলওয়ের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের সম্মত নীতিমালার ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণায় বলা হয়, ইসরাইল ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূমি ফেরত দেবে আর পিএলও আজকের দিন থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিহার করবে।
এই ঘোষণায় বিবৃত ও দু’পক্ষের গৃহীত সূত্রসমূহ অসলো চুক্তি নামে খ্যাতি লাভ করে। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির আশায় ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেরেসকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। এইভাবে গৃহীত নীতি অনুযায়ী পিএলওর বিকল্প ও উত্তরাধিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯৪ এর ১ জুলাই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজা ও পশ্চিম তীরের (প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের) নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
এই পটভূমিকায় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন জুলাই ২০০০-এ ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাককে শান্তি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। জানা যায়, তার মধ্যস্থতা অনুযায়ী ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে সরে এসে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে রাজি হবে এবং এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনিরা আলআকসা মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের ধর্মীয়ভাবে ইহুদিদের কাছে তাৎপর্যমূলক অংশের উপর ইসরাইলি সার্বভৌমত্ব মেনে নেবে এবং জর্দান উপত্যকা থেকে তিনটি প্রতিরক্ষামূলক সেনা চৌকি থেকে ক্রমান্বয়ে সরে আসবে বলে দু’পক্ষ সম্মত হয়।
পরে আরাফাত এই সমঝোতা মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরুর ঘোষণা দেন এবং তা অব্যাহতও রাখেন। এই সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইল আবার আরাফাতকে ইসরাইলের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন গাজা ও পশ্চিম তীর প্রধানত জাতিসংঘ ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সহায়তায় অর্থায়িত ও পরিচালিত হয়ে আসছে। এই প্রশাসন নিয়ে আরাফাতের বিরুদ্ধে ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও বিরোধিতার সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নিরিখ অনুযায়ী প্রাপ্ত সহায়তা থেকে আরাফাত ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তার ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণাধীন বিশেষ তহবিলে স্থানান্তর করেন বলেও খবর বের হয়। সবমিলিয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে গঠিত হওয়া এই মুক্তি আন্দোলন।
বারবার মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে এবং পরবতী সময়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে আবেদনহীন এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় পিএলও বা ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা। সেই অর্থে অনেক ফিলিস্তিনির মত অনুযায়ী ব্যক্তি আরাফাতের অর্জনও শূন্য। পিএলও এবং ইয়াসির আরাফাত আজ যেনো শুধুই ইতিহাস।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার মূর্তপ্রতীক হামাস
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা বা পিএলও যে স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা পূরণ করতে না পারায় স্বভাবতই ১৯৮৭ সালে হামাস নামে নতুন একটি দলের উদ্ভব হয়। হামাস মূলত ইহুদিবাদী আগ্রাসী ইসরাইলের বিরুদ্ধে মজলুম ফিলিস্তিনিদের দুর্বার এক প্রতিরোধ আন্দোলনের নাম। সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পিএলও ছিলো দুর্দান্ত এক মিলিট্যান্ট সংগঠন। কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাবে আরাফাত তথা পিএলও অস্ত্র পরিত্যাগ করে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসায় পিএলও গুরুত্ব হারায়। ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় পিএলওর রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ফাতাহ। বিনিময়ে আরাফাত পান নোবেল পুরস্কার।
পিএলও অস্ত্র পরিত্যাগ করে শান্তি আলোচনায় মনোযোগী হয়ে পশ্চিমা নেতাদের বাহবা কুড়ালেও উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন দেখাতে না পারায় তখন থেকেই ক্ষয় শুরু হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই শূন্যস্থান পূরণে উত্থান ঘটে আরো সাহসী ও দুর্দান্ত যোদ্ধাদের সংগঠন হামাসের।
হামাস শব্দের অর্থ ‘উদ্দীপনা’। এটি মূলত হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া তথা ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের আদ্যক্ষরগুলোর মিলিত রূপ। ফিলিস্তিনে এই প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রকাশ্য সূচনা ঘটে ১৯৮৭ সালে, প্রথম ইনতিফাদার শুরুর দিকে। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ফিলিস্তিনি ধর্মীয় নেতা শায়েখ আহমাদ ইয়াসিন। আহমাদ ইয়াসিন ছিলেন একজন পঙ্গু এবং অন্ধপ্রায় মানুষ। তিনি চলাফেরা করতেন হুইলচেয়ারে করে। তার বয়স যখন ১২ বছর, একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনি প্রতিবন্ধী হন। যুবক বয়স থেকেই তিনি ছিলেন গাজা সিটির নেতা। ১৯৭৮ সালে ৪৯ বছর বয়সী শায়েখ আহমাদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের জন্য আল মুজাম্মা আল ইসলামি নামে একটি ইসলামি সংগঠন গড়ে তোলার জন্য অধিকৃত ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। ইসরাইল তা মনযুর করে।
কারণ, ইসরাইলের লক্ষ্য ছিলো গাজায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার [পিএলও] গুরুত্ব হ্রাস করা। কিন্তু ইসরাইলের সেই প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায়। খুব সহসাই তারা বুঝতে পারে শায়েখ আহমাদ ইয়াসিন একজন সত্যিকারের স্বাধীনতাকামী মুসলমান। ১৯৮৮ সালে গৃহীত হয় হামাস চার্টার বা হামাসের প্রথম সংবিধান, যাতে সংগঠনটির লক্ষ্য হিসেবে সরাসরি উল্লেখ করা হয়- ‘অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো।’
সংগঠন হিসেবে হামাস
সংগঠন হিসেবে হামাস মূলত তিনটি শাখার সমষ্টি- রাজনৈতিক শাখা, সমাজকল্যাণ শাখা এবং সামরিক শাখা। মজলিসে শূরা হামাসের প্রতিনিধিদের শীর্ষ বোর্ড। এই শূরার মাধ্যমেই হামাস সমগ্র ফিলিস্তিনে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে হামাসের নীতিনির্ধারণী পরিষদ হলো পনেরো সদস্যের পলিটিক্যাল ব্যুরো। বর্তমানে হামাসের প্রধান হলেন খালেদ মিশাল আর গাজা অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন ড. ইসমাইল হানিয়া।
সমাজসেবার মধ্য দিয়েই হামাসের গড়ে ওঠা
হামাসের চিরশত্রু ইসরাইলি বিশেষজ্ঞদের গবেষণাতেই উঠে এসেছে, হামাসের কার্যক্রমের ৯০% হলো সামাজিক। শিক্ষা বিস্তার, সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক কাজ এবং এই সামাজিক কাজের মধ্যে দাতব্য চিকিৎসা, মসজিদ স্থাপন, স্কুল ও শিশুশিক্ষায় অর্থায়ন, খেলাধুলার জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। শত অবরোধের মধ্যেও বার্ষিক ৭০-৯০ মিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট দিতে সক্ষম হয় হামাস, যার প্রায় ৮৫% অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে। প্রতিরক্ষা এবং সামরিক খাতে বরাদ্দ যায় মাত্র ১৫%।
সবসময় ঘর ভাঙ্গা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় হামাস। ইসরাইলি বিমান হামলায় কোনো ঘর বিধ্বস্ত হলে ১৫ মিনিটের মধ্যেই হামাসের সেবাদানকারী সদস্যরা চলে আসেন তাদের সাহায্যে। এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনে শহীদ-হওয়া-ফিলিস্তিনি পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য এককালীন ও নিয়মিত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে হামাস। যদিও হামাস মূলত একটি ইসলামি আন্দোলন হিসেবে কাজ করে কিন্তু জোরপূর্বক কাউকে ইসলামি অনুশাসনে বাধ্য করার কোনো নজির এই সংগঠনের নেই। হামাস সরকারের দাওয়াহ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ফাদিলা’ নামে কিছু নাগরিক কমিটি আছে, যারা বিভিন্নভাবে জনসাধারণকে ইসলামি অনুশাসন মেনে চলতে আহ্বান জানায়।
টানা আট বছর অবরোধ এবং নানান ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও গাজা উপত্যকায় শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে হামাস। ২০১২ সালের এক হিসেব মতে, গাজা উপত্যকায় শিক্ষার হার প্রায় ৯৯%। সেখানে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় চার লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর জন্য ৬৮৩টি স্কুল রয়েছে, যার মধ্যে ৩৮৩টি স্কুল সরকারিভাবে অর্থাৎ হামাস নিজেই সরাসরি পরিচালনা করে। এর বাইরে শিশুদের জন্য অসংখ্য নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন স্কুল বা মকতব প্রতিষ্ঠা করেছে হামাস, যেগুলোতে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের এক বেলা খাবারও সরবরাহ করা হয়।
স্বাস্থ্যসেবায় হামাস নিজেকে উন্নীত করেছে এক অনন্য অবস্থানে। অব্যাহত অবরোধে থাকার কারণে খাদ্যের মান কমে যাওয়ায় গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শৈশবকালীন অপুষ্টির হার তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ইসরাইলি আগ্রাসনে আহত মানুষজনের চিকিৎসার প্রয়োজন তো রয়েছেই। হামাসপরিচালিত হাসপাতালে কম খরচে বা বিনাখরচে সুচিকিৎসা দেয়া হয়। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা বা দাতাদেশ থেকে আসা সাহায্য ও আর্থিক অনুদান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দক্ষতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছে হামাস। অপরপক্ষে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহর বিরুদ্ধে এই দিক থেকে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সবের পাশাপাশি শরণার্থী শিবির থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের সংগঠন ব্যক্তিগত দান ও চাঁদার উপর নির্ভর করে একটার পর একটা সফল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে থাকে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ফিলিস্তিনিরা এবার তাদের খুচরা দান পাঠাতে থাকে হামাসের ঠিকানায়। হামাস প্রতিটা পয়সার হিসাব রাখে সর্বাধিক স্বচ্ছতা আর দক্ষতার সঙ্গে। শক্ত সামাজিক সংগঠন হওয়ায় আর ধর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতি রেখে কাজ করায় নৈতিকতার একটা নতুন মান তারা রচনা করে। হামাসের এই সামাজিক কার্যক্রমের জনপ্রিয়তা শুধু অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাতেই নয়, বরং ফাতাহ শাসিত পশ্চিম তীর এমনকি আশপাশের অন্যান্য মুসলিমদেশেও বেশ প্রশংসিত।
অবরুদ্ধ আর যুদ্ধবিধ্বস্ত এক টুকরো জনপদে সস্তায় বিনোদনের সুযোগ তৈরীর জন্য হামাসের তৈরী পার্ক, বাগান, খেলার মাঠ, ফুটবল মাঠ, চিড়িয়াখানা, রেস্তোরাঁ বিনোদনের পাশাপাশি অনেক মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। প্রয়োজনে সবসময় কাছে পাওয়া যায়, ভরসা করা যায়, এমনই এক অনন্য সংগঠনে পরিণত হয় হামাস। হামাস মানেই সমস্যার সমাধান। কোনো চাঁদাবাজি নেই, প্রোটেকশন মানির দাবি নেই। সবমিলিয়ে সমগ্র ফিলিস্তিনবাসীর প্রাণের সংগঠন হিসেবে নিজের ভিত গড়তে সক্ষম হয় হামাস।
হামাসের সামরিক শাখা
হামাসের সামরিক শাখা গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। দুই দুইটি ইনতিফাদার মধ্য দিয়ে যা পূর্ণতার পথে এগিয়েছে। এই সামরিক শাখার নামের সাথে প্রত্যক্ষ ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৩৫ সালে বৃটিশ সৈন্যদের গুলিতে নিহত সিরিয়ান মুক্তি আন্দোলনের নেতা শহীদ ইজ্জদ্দীন আলকাসসাম-এর নাম অনুসারে এ সামরিক শাখার নাম দেয়া হয় ‘আল কাসসাম’ বিগ্রেড। আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতারা এই মুক্তি আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৯২ সাল থেকে এই বিগ্রেড অপারেশন শুরু করে। শুধু গাজাতেই হামাসের অন্তত ১০ হাজারের বেশি যোদ্ধা রয়েছে। প্রথাগত সেনাবাহিনীর মতো কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন ও বিগ্রেডে বিভক্ত হামাসের এই সামরিক শাখা।
নর্থ গাজা বিগ্রেড, গাজা বিগ্রেড, সেন্ট্রাল গাজা বিগ্রেড এবং সাউথ গাজা বিগ্রেড নামে আল-কাসসামের চারটি বিগ্রেড আছে। আল কাসসাম বিগ্রেড ২০০১ সালের ২৬ অক্টোবর স্থানীয়ভাবে তৈরী রকেট দিয়ে ইসরাইলের স্থাপনায় হামলা চালায়। এই রকেটের নাম ছিলো ‘কাসসাম-১’। এই রকেট তৈরীর পর টাইম ম্যাগাজিনের শিরোনাম ছিলো- ‘একটি পুরনো রকেট, যা মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দিতে পারে।’ সত্যিই হামাসের এই রকেট এখন ইসরাইলের মাথাব্যথার বড় কারণ। এই রকেটের মাধ্যমে হামাস ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে নতুন রূপ দিতে সক্ষম হয়। অল্প দিনের মধ্যেই এই রকেটের নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়। ‘কাসসাম-২’ উদ্ভাবিত হয়, যেটি ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যবহার করা হয়।
কাসসাম বিগ্রেড এখন ৮০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম রকেট তৈরি করেছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে গাজার সাথে যুদ্ধে এম-৭৫ ব্যবহার করে কাসসাম। এই যুদ্ধেই তারা ইসরাইলের হাইফা শহরকে লক্ষ্য করে আর-১৬৯ রকেটও ব্যবহার করেছে। বিস্ময়করভাবে আল কাসসাম সে বছরেরই ১৪ জুলাই ইসরাইলের ভেতরে বিশেষ অপারেশনে অংশ নিতে সক্ষম এরকম তিনটি ড্রোন নির্মাণের ঘোষণা দেয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনীর মতো আলকাসসাম বিগ্রেডের ইঞ্জিনিয়ারিং, এরিয়াল, আর্টিলারি এবং আত্মঘাতী স্কোয়াড রয়েছে।
২০১২ ’র যুদ্ধে তাদের নৌসেনাদের একটি দল ইসরাইলের আস্কেলন শহরে অবস্থিত সুরতি জাকিম সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করে প্রথম অপারেশনের ঘোষণা দিয়েছে। ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের মোকাবেলার জন্য আলকাসসাম বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন করেছে। মিলিটারি শাখা ‘আলবাত্তার’, ‘আলইয়াসিন’ নামে কামান বিধ্বংসী গোলা তৈরি করেছে, যেটি ইসরাইলের প্রবাদতুল্য মেরকাভা কামান ধ্বংস করতে সক্ষম। কাসসাম বিগ্রেড শূন্য দশকে ইসরাইলের কিছু সেনাকে আটক করতে সক্ষম হয়। যার মধ্যে একজন ছিলো গিলাত শালিত। ২০০৫ সালে তাকে আটক করে। ২০১১ সালে এক হাজার ৫০ বন্দী ফিলিস্তিনির বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ইসরাইলি সেনা আটকের তাৎপর্য নানান কারণেই অনেক বেশি।
অপরাপর রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে হামাসের যথেষ্ট পার্থক্য আছে। হামাসের নেতারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী দলের আধ্যাত্মিক নেতা শায়েখ আহমাদ ইয়াসিনকে হত্যা করেছে। আবদুল আজিজ রানতিসির মতো দক্ষ সংগঠক ও প্রভাবশালী নেতা নিহত হয়েছেন। বর্তমান নেতা খালেদ মিশাল একাধিকবার ইসরাইলি গুপ্ত হামলার শিকার হয়েছেন। হামাসের প্রতিজন কর্মী জানেন, তার এই লড়াই কোনো সাধারণ স্বার্থ অর্জনের জন্য নয়। এই লড়াই মাতৃভূমি রক্ষার লড়াই। ফলে এই লড়াইয়ের যেমন শেষ নেই, নেই পরাজয়ও।
ইসরাইলি কঠোর নজরদারির মধ্যে হামাস যোদ্ধারা কোথায় কীভাবে থাকে আর কীভাবেই-বা চলাফেরা করে- সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। জবাব খুব সহজ। পৃথিবীর তাবৎ মুক্তিসংগ্রমীদের মতো ফিলিস্তিনি যোদ্ধারাও সাধারণ মানুষের মাঝে অবস্থান করে। মানবসেবায় হামাসের ভিত এতোটাই শক্ত অবস্থানে উন্নীত হয়েছে যে, ফিলিস্তিনের প্রতিটি নাগরিক হামাসের রীতিমতো সক্রিয় যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ইসরাইলের যাবতীয় ষড়যন্ত্রের নকশা আর জাল তাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ইসরাইলের অভিযোগ গাজায় টানেলের মধ্যে হামাস যোদ্ধারা অবস্থান করে। কিন্তু ইসরাইলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা হলো, এই টানেলের কোনো কূল-কিনারা তারা করতে পারছে না। হামাস যোদ্ধারা গাজায় এতোটাই জনপ্রিয় যে, গাজায় ইসরাইলের যাবতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। গাজায় ২০১২ সনে ইসরাইলের হামলার পর হামাস ব্যাপক রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে।
২০০৪ সালে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর হামাস ও ফাতাহ’র সম্পর্কের অবনতি হয় এবং সেটা চরম আকার ধারণ করে ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হামাস প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেই বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে এবং দুই মাসের মাথায় মন্ত্রিসভা গঠন করে ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে। প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন ফাতাহ’র সাথে হামাসের মতবিরোধ এর মধ্যে চরমে ওঠে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমাবিশ্ব হামাস সরকারকে অস্বীকৃতি জানায়।
নিজেরা পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে নির্বাচন করালো, ফলটা মনমতো না হওয়ায় বৈধসরকারকে অস্বীকার করে বসলো। হায় গণতন্ত্র! যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমাবিশ্ব একযোগে ঘোষণা করলো, হামাস যতোদিন সরকার হিসেবে থাকবে, তারা ফিলিস্তিনিদের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করবে না। বরং ইসরাইলকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে যাবে। মাহমুদ আব্বাসও সুযোগ খুঁজছিলেন হামাসকে কীভাবে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়। অনেক টানাপোড়নের পর পশ্চিমাদের মদদ ও সমর্থনে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাহমুদ আব্বাস হামাস সরকারকে বরখাস্ত করেন ও তার নিজ দল ফাতাহ দ্বারাই সরকার গঠন করেন। নির্বাচনে বিজয়ী হামাস স্বভাবতই তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। দু’পক্ষের অনিবার্য সংঘর্ষের ফলস্বরূপ ফিলিস্তিন বিভক্ত হয়ে পড়ে।
সেই থেকে পশ্চিম তীর শাসিত হচ্ছে মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ দ্বারা আর গাজা শাসন করছে হামাস। অন্যদিকে, হামাস ক্ষমতায় আসার তিন মাসের মাথায় ইসরাইল গাজা ভূখ-কে শত্রু এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। শুরু হয়ে যায় ইসরাইল ও হামাসের আরো একটি সংঘাত, বলা উচিত বা বলতে হবে গাজায় ইসরাইলের আরো একটি নৃশংস আগ্রাসন। তবে ফাতাহ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীকে পরাজিত করে গাজার দখল নিয়ে নেওয়ার পর থেকে হামাসই গাজা শাসন করছে।
শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই নয়। হামাসের ব্যাপারে পাশ্ববর্তী আরবদেশগুলোরও নানান সীমাবদ্ধতা আছে। হামাসকে ইতোমধ্যেই সিরিয়া থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। হামাসের অধিকাংশ শীর্ষ নেতা এখন আশ্রিত হয়েছেন কাতারে।
সশস্ত্র আন্দোলন হওয়ায় কেউ কেউ তো হামাসকে ধ্বংস করে ফাতাহ’র মাধ্যমে গাজায় পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। তবে তা কখনোই হওয়ার নয়। শিকড় থেকে উঠে আসা কোনো গণসংগঠনকে দমন-পীড়ন আর ষড়যন্ত্র করে শেষ করে দেয়া যায় না। হামাস এখন ফিলিস্তিনেরই প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে।
মুক্তিসংগ্রামে সীমাহীন আত্মত্যাগ, সততা, দক্ষতা ও নিপীড়িত মানুষের মাঝে থেকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি দেশের জন্য আমরণ লড়াইয়ের অদম্য মানসিকতাই হামাসকে উন্নীত করেছে এক অনন্য অবস্থানে। শুধু ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ে নয় বরং সারা বিশ্বের মজলুম সংগ্রামী মানুষের মধ্যেও হামাস এখন উজ্জ্বলতম উপমা। সাম্প্রতিক একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, দুই ভাগ মিলিয়ে ৫২% ফিলিস্তিনি মানুষ সমর্থন জানিয়েছে হামাসের পক্ষে, অপরদিকে ফাতাহ’র জনসমর্থন মাত্র ১৩%। ইসরাইল তার আসল আধিপত্যবাদী অস্তিত্বের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মনে করে আদর্শনিষ্ঠ ও অকুতোভয় হামাসকে। তাই হামাস গাজার শাসনভার কাঁধে তুলে নেয়ার পর থেকেই ইসরাইল অবরোধের মাধ্যমে এ ক্ষুদ্র জনপদের ১৫ লাখ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
অসহায় গাজাবাসী বিনাদোষে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। গাজায় যাতে কোনো পণ্যসামগ্রী ঢুকতে না পারে ইসরাইল সেজন্য কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর এ কাজে সহযোগিতা করে আসছে মুরসি-পরবর্তী মিসর। মিসর-লাগোয়া একমাত্র রাফাহ পয়েন্ট ছাড়া বিশ্ববাসীর সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় যে নেই গাজাবাসীদের! একপাশে সাগর, বাকি দিক ইসরাইলঘেরা।
২০১২ ’র সর্বশেষ বড়সড় ইসরাইলি আগ্রাসনের পরপর কাতারে হামাস নেতা খালেদ মিশালের সাথে বৈঠক করেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ অব্বাস। দুই নেতা আগেই ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে মাহমুদ আব্বাস যখন হামাসকে বাদ দিয়ে ইসরাইলের সাথে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন, ইসরাইল বলেছে আপনি তো হামাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। আলোচনাই তো ফলপ্রসূ হবে না। আবার যখন তিনি হামাসকে সাথে নিয়ে আলোচনায় গিয়েছেন, ইসরাইল বলছে হামাসকে সাথে রাখলে কোনো আলোচনা হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন জাতীয় ঐক্য ছাড়া ইসরাইলের জবরদখল থেকে তারা মুক্তি পাবেন না। এমনকি ইসরাইলও আলোচনায় বসবে না। ফলে গাজার মানুষের রক্তের উপর দিয়ে ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন এক সংগ্রামের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এমন প্রচেষ্টায় ইসরাইল আরো বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছে। হলেই-বা কি, বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা কখনোই দমন করতে পারে না। ইসরাইলও পারবে না। ফিলিস্তিন একদিন মুক্ত হবেই। ভয় কিসের- এই বিজয় তো আকাশেই লেখা হয়ে আছে!
ফিলিস্তিনের ইনতিফাদা
১৯৮৭ সালের এপ্রিলে জর্ডানের আম্মানে আরবদেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন বসলো এবং এ সম্মেলন ফিলিস্তিনের দখলদার জায়নবাদী সরকারের বিরুদ্ধে কোনোরকম নীতি-অবস্থান গ্রহণ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত রইলো। ফিলিস্তিনি জাতি গভীর আশা নিয়ে বসে ছিলো- তাদের বহু বছরের অপেক্ষার পালা এবার একটা সমাপ্তিতে পৌঁছবে। আরবজাহান তাদের বাস্তুহারা অবস্থান থেকে নাজাত দিতে এবার অন্তত বিশেষ কোনো ভূমিকা নেবে। বিশেষত ইসরাইলের অধিকৃত ফিলিস্তিনে বন্দী জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া ফিলিস্তিনি জনসাধারণ বড় আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো আরবসরকারগুলোর দিকে। এই মজলুম জাতি আরো একবার আরবসরকারগুলোর প্রকাশ্য উদাসীনতা ও অবহেলা প্রত্যক্ষ করে জাতীয়তাবাদী দর্শনের কার্যকারিতা এবং সরকারগুলোর পৃষ্ঠাপোষকতা ও সমর্থন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে।
এই অসহায়ত্ব, কান্না, ভেতরে জমে থাকা বহু যুগের ক্ষোভ ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর বিকেলে অন্যায়ভাবে ক’জন ফিলিস্তিনি লাশ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিপুল বিস্ফোরণ ঘটায় বৃহত্তম শরণার্থী শিবির জাবালিয়ায়। পরদিনের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আবারও ইসরাইলি সেনাদের নৃশংসতা আগুন ধরিয়ে দেয় এ শিবিরসহ সমগ্র ফিলিস্তিনে। ইসরাইল-পশ্চিমাবিশ্বের সমস্ত গোয়েন্দা তথ্য-অনুমান এবং আরবনেতাদের ভয়-সতর্কতার যাবতীয় হিসেবনিকেশকে ছুড়ে ফেলে ইট-পাথর হাতে রাস্তায় নামে আপামর ফিলিস্তিনি জনতা। ৮৭ ’র সর্বাত্মক এই গণঅভ্যুত্থানই ফিলিস্তিনের প্রথম ইনতিফাদা হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।
ইনতিফাদা অর্থ নাড়া দেয়া, ঝাঁকুনি দেয়া। অনেকটা পাখিদের গোসল সেরে ভেজা শরীররটা হালকা করা এবং আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি হিসেবে ডানা ঝাঁপটানোর মতো ব্যাপার। ইনতিফাদা ভেজালকে দূরে ঠেলে খাঁটি হওয়ার গণআন্দোলন, যাতে বিজয়ের আকাশপানে জনগণ অনায়াসেই পাখা মেলতে পারে। ইনতিফাদার আগ পর্যন্ত সকল আন্দোলন ও অভ্যুত্থানই ছিলো বিশেষ কোনো দল বা গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এবার এই ইনতিফাদার আগে বা পরে কোনো বিশেষণ যুক্ত করা যায় নি। এই ইনতিফাদা ছিলো ফিলিস্তিনি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণপ্রতিবাদ।
কেমন ছিলো ইনতিফাদার ধরন- সেটা বুঝতে এই রিপোর্টটা দেখা যাক। ‘১৯৮৭ ’র ৯ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে জানানো হয়, ৮ ডিসেম্বর খুন ও জখমের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাবালিয়া শিবিরে বিক্ষোভ চলছে এবং ইসরাইলি সৈন্যদের উপর পেট্রোল বোমা ছোঁড়ার পর ১৭ বছর বয়সী এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীকালে সে ইনতিফাদার প্রথম শহীদ হিসেবে পরিচিতি পায়। বিক্ষোভ দ্রুত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেমে ছড়িয়ে পড়ে। যুবকেরা প্রতিবেশীদের নিয়ন্ত্রণ নেয়, ময়লা-আবর্জনা, পাথর এবং টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে ক্যাম্প বন্ধ করে দেয় এবং যেসকল সৈন্য পেট্রোল বোমার সাহায্যে জোরপূর্বক প্রবেশের চেষ্টা করছিলো তাদের মুখোমুখি হয়। ফিলিস্তিনি দোকানদাররা তাদের ব্যবসায় বন্ধ করে দেয় এবং শ্রমিকেরা ইসরাইলে কাজ চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
এই সকল কার্যক্রমকে ইসরাইল ‘দাঙ্গা’ বলে অভিহিত করে এবং ‘আইনশৃঙ্খলা’ পুনরুদ্ধারের স্বার্থে নিষ্ঠুর দমন প্রক্রিয়াকে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় এবং ন্যায়সঙ্গত হিসেবে ঘোষণা করে। কয়েকদিনের মধ্যে অধিকৃত অঞ্চলগুলো অভূতপূর্ব মাত্রায় বিক্ষোভ মিছিল ও বাণিজ্যিক ধর্মঘটে আন্দোলিত হতে থাকে। আক্রমণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা হয়, যেমন, সামরিক যানবাহন, ইসরাইলি বাস এবং ইসরাইলি ব্যাংক। এই গণপ্রতিরোধের প্রথমদিকে কোনো ইসরাইলি বসতিতে আক্রমণ করা হয় নি, কোনো ইসরাইলি গাড়িতে পাথর নিক্ষেপ করা হয় নি। দেশজুড়ে সমান শান্তিপূর্ণভাবে চলা এই বিক্ষোভে অভূতপূর্ব ছিলো সাধারণ জনতার অংশগ্রহণের মাত্রা; নারী, শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক জনগণ এতে শামিল হয়।
ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য লাঠি, কাঁদানেগ্যাস, জলকামান, রাবার বুলেট, এবং গোলাবারুদ নিয়ে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু বিক্ষোভ আরও বেগবান হয়। শীঘ্রই পুরো অঞ্চলজুড়ে পাথর নিক্ষেপ এবং টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার মাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সহিংসতায় ছয়জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। পরের দিন বিক্ষোভকারীরা পূর্ব জেরুসালেমের মার্কিন দূতাবাসে একটি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে, যদিও এতে কেউ আহত হয় নি।’
ফিলিস্তিনিদের এই অভ্যুত্থানে ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া ছিলো অত্যন্ত কঠোর। ইনতিফাদার শুরুর দিকে ইসরাইলি সেনারা অনেক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, যার বেশিরভাগই ছিলো মিছিল ও বিদ্রোহের সময়। যেহেতু বেশিরভাগ নিহত ব্যক্তিই ছিলো বেসামরিক ও যুবক, আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন প্রথমে পিছু হটে পরবর্তী সময় জবরদস্তিমূলক এবং কঠোরভাবে পাল্টা আঘাত হানার নীতি গ্রহণ করে। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের গণগ্রেফতার এবং কয়েক ধাপে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়। যেমন, পশ্চিম তীরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্দোলনের বছরগুলোতে এবং পশ্চিম তীরের স্কুলগুলো ১২ মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয়। শুধু প্রথম বছরেই ১৬০০ বারের বেশি কারফিউ জারি করা হয়। জনসাধারণ পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে।
কোনো এক সময় ২৫,০০০ ফিলিস্তিনিই গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনি খামারগুলো থেকে গাছপালা উপড়ে ফেলা হয় এবং উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রথম বছরে ১,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনির ঘরবাড়ি ধ্বংস কিংবা অবরুদ্ধ করা হয়। ইসরাইলি অধিবাসীরাও ফিলিস্তিনিদের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণে জড়িত হয় যেটা বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিরা কখনোই করে নি। ট্যাক্স দিতে অপারগ বা অস্বীকারকারী ফিলিস্তিনিদের সম্পদ এবং লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং যেসব পরিবারের সদস্যরা পাথর নিক্ষেপকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো বা কিশোর-তরুণ ছিলো, তাদের উপর সাধ্যাতীত জরিমানা আরোপ করা হয়।
সবমিলিয়ে গণহত্যার বাইরে ফিলিস্তিনিদের জীবন ও বেঁচে থাকাকে বিভীষিকাময় করে তোলার অপচেষ্টায় কোনো ত্রুটি ইসরাইলি রাখে নি। ইসরাইলি সরকার, সেনাবাহিনী কিংবা সাধারণ নাগরিক কেউ বসে থাকে নি, যে যেভাবে পেরেছে খড়গ চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রথম ইনতিফাদা ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিলো। এরপর অসলো চুক্তি হলো। চুক্তির সর্বৈব ব্যর্থতা ফিলিস্তিনিদের আবার জ্বালিয়ে দেয়। ২০০০ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ইনতিফাদা, যাকে আলআকসা ইনতিফাদাও বলা হয়। ২০০৫ সালে এটাও শেষ হয়েছে। প্রথম ইনতিফাদার তুলনায় দ্বিতীয় ইনতিফাদার ক্ষয়ক্ষতি ও ভয়াবহতা অনুমিতভাবেই ছিলো অনেক বেশি। বছরের পর বছর ধরে ইনতিফাদার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের অধিকার আন্দোলনও চলতে থাকে। চলছে এখনো। ২০১৩ সালের শেষ দিকে গাজায় ইসরাইলের ভয়াবহ আগ্রাসনের সূত্র ধরে আরো একটি ইনতিফাদা অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। প্রায় আড়াই হাজার ফিলিস্তিনি এসময় নিহত হয়। আহত হয় লাখো ফিলিস্তিনি।
ইনতিফাদার মতো স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান কখনো লক্ষ্য ঠিক করে শুরু হয় না, সেটা সম্ভবও নয়। হঠাৎ শুরু হওয়া বা গড়ে ওঠাটাই এর বৈশিষ্ট্য। যে প্রেক্ষাপটে ইনতিফাদার সূচনা এবং এর যা অর্জন সেগুলো পূর্ব নির্ধারিত বা অনুমিত না হলেও অপ্রত্যাশিত বা অবিশ্বাস্য কিছু ছিলো না। চাইলেই সেগুলোকে আমরা একটা ফ্রেমে নিয়ে আসতে পারি। মোটাদাগে সেরকম কিছু পয়েন্ট এখানে তুলে আনা যাক।
প্রধান অর্জন ছিলো একপ্রকার বিস্মৃতির আঁস্তাকুড় থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুকে আলোয় তুলে আনা। ৬৭ ’র যুদ্ধ এবং ৭৪ ’র শান্তিচুক্তি প্রস্তাবনার পর ফিলিস্তিন ইস্যুটি আন্তার্জাতিক অঙ্গনে অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, নিত্যদিন বঞ্চনার শিকার হতে থাকা ফিলিস্তিনিদের কাছে যা ছিলো নির্মম পীড়াদায়ক। ইনতিফাদার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিরা দারুণভাবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়।
স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রথমবারের মতো খোলাখুলি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন এবং ইসরাইলের প্রকাশ্য সমালোচনা করতে বাধ্য হয়, যা ইতোপূর্বে কখনো হয় নি। এটাও এক বড় অর্জন।
অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংগঠনের কোন্দল বা আঞ্চলিক রাজনীতির বাইরে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানকে জরুরি পরিকল্পনা হিসেবে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন।
ফিলিস্তিন ইস্যুর সাথে পশ্চিমাবিশ্ব বিশেষত ইউরোপকে সক্রিয় করা। ইনতিফাদার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু সমর্থন নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবেও ফিলিস্তিনের বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করতে শুরু করে।
বিশ্ববাসীর সাথে সাথে আমেরিকা ও ইহুদিদের মনেও ইসরাইলের রাজনৈতিক যথার্থতা সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করা। ফলে অনেক ইহুদি মত বদলাতে বাধ্য হয়- ইসরাইলের ইমেজ আরো সমালোচিত হওয়া থেকে বাঁচাতে হলে ফিলিস্তিনিদের অন্তত মৌলিক সুযোগ-সুবিধাগুলো দিতেই হবে।
জায়নবাদীদের অভ্যন্তরীণ অস্তিত্বের নিরাপত্তাকে হুমকিযুক্ত করা। এটাও বেশ ভালোভাবেই হয়েছিলো। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরাও যে ভেতর থেকেই এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম, ইসরাইল তা কল্পনাও করতে পারে নি।
সর্বোপরি ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মতভেদকে ম্লান করে দেয়া এবং সরকার ও আন্তর্জাতিক সমাজকে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাশার অনুসারী করা- যারা এতোদিন নিজ নিজ স্বার্থে ফিলিস্তিন ইস্যুকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার অপপ্রয়াস নিয়ে আসছিলো।
সাধারণ ফিলিস্তিনি এবং পিএলও বা হামাস নেতাদের মনোবল বাড়ানোসহ এই ইনতিফাদা পরবর্তী প্রতিটি আলোচনা ও চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপাক ভূমিকা রেখেছে। ফিলিস্তিন বলতে কোনো একটা দল বা নেতা নয়, দৃশ্যপটে উঠে এসেছিলো প্রতিটি নাগরিকের সমন্বয়ে এক সমগ্র জাতিসত্তা। আর এখানেই গো-হারা হেরে গিয়েছিলো ইসরাইলসহ পশ্চিমাবিশ্ব।
ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন দেয়ার লক্ষ্য কেবল জমি দখলই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে সা¤্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছাড়াও ফিলিস্তিন ইস্যুর ভেতর লুকিয়ে ছিলো ইসলামি উম্মাহর বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের নয়া ক্রুসেড যুদ্ধের অশুভ তৎপরতা। দ্বিতীয় সহস্রাব্দজুড়ে মুসলমানদের কাছে বারবার পরাজিত হওয়া এবং রাজ্য ও ক্ষমতা হারানোর অবমাননার প্রতিশোধ স্পৃহাও এতে শামিল রয়েছে। ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের এক নেতা বলেছিলেন, আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন পোশাক ও আকারে ক্রুসেড যুদ্ধের অবতারণা করা ছাড়া এখানকার ইস্যু অন্য কিছু নয়। পশ্চিমাবিশ্ব ও ইউরোপীয় সরকারগুলো ইসলামের কাছে অতীত পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যু আসলে ইসলামের ইস্যু আর এ বিষয়টির সাথে দেশপ্রেম ও আরব জাতীয়তার কোনো বিরোধ নেই।
যেহেতু ফিলিস্তিন ইস্যুর মূল ভিত্তি ও সারবত্তাটা ইসলামি, সুতরাং এ ভিত্তি অনুসারেই ফিলিস্তিন সমস্যার চিকিৎসা করা উচিত এবং এর ভিত্তিতেই সমাধান পেতে হবে। জায়নবাদী গোষ্ঠী ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের যাবতীয় পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকৃত ফিলিস্তিন ইস্যু। আর তাই সকল ইসলামি দেশের ইসলামি স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিলিস্তিন ইস্যুকে স্থান না দেয়া পর্যন্ত উম্মাহর জাতীয় অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা, একতা ও কালিমার পতাকা উত্তোলন নিঃসন্দেহে জটিলতর হয়ে দাঁড়াবে।
রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের অর্জন ও স্বীকৃতি
জাতিসংঘের সদস্যপদ
পর্যবেক্ষক স্ট্যাটাস : এই মর্যাদা অনুযায়ী ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র নয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আঞ্চলিক সংস্থা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে। ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সভায় বা বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। তবে কোনো প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে না।
পর্যবেক্ষক সত্তা : ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক সত্তা (অবজার্ভার এনটিটি) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ফলে দেশটি এখন অভ্যন্তরীণ ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যৌথ কিংবা এককভাবে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। তবে ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার অধিকার রাখে না।
পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র (অবজারভার স্টেট) : জাতিসংঘে একমাত্র অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র আছে ভ্যাটিকান সিটি। ২০০৪ সালের এক প্রস্তাবে এ মর্যাদার ক্ষমতা ব্যাখ্যা করা হয়, যা বর্তমানে ফিলিস্তিন যে মর্যাদা ভোগ করছে তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু ফিলিস্তিনের সঙ্গে ভ্যাটিকানের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে- জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে ভ্যাটিকানের কোনো সভা বা কর্মকা-ের প্রস্তাব বা বিবরণী সরাসরি অন্য সদস্যরাষ্ট্রের কাছে সরকারি নথি হিসেবে পাঠাতে পারে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সুযোগ নেই।
সর্বশেষ : ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেয়ায় জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোকে বার্ষিক ছয় কোটি ডলার তহবিল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ইউনেস্কোর বার্ষিক বাজেটের একপঞ্চমাংশ। অথচ সদস্যপদ দেয়া বিষয়ে ইউনেস্কোতে ভোটাভুটিতে ১৭৩টি দেশের মধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে ১০৭ ভোট ও বিপক্ষে মাত্র ১৪ ভোট পড়ে আর ৫২টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জার্মানি সদস্যপদের বিরোধিতা করে ভোট দেয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের দাবির সমর্থনে ভোট দেয় ব্রাজিল, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে ব্রিটেন থাকে নিরপেক্ষ অবস্থানে। ভোটের প্রশ্নে এই অবস্থানকে নিরপেক্ষ বলা গেলেও এটা যে মূলত ইসরাইলকেই ভোট দেওয়া তা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় কারো।
ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি
২৯ নভেম্বর ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বীকৃতি মেলে। ১৯৩ সদস্য বিশিষ্ট এই বিশ্ব সংস্থার ১৩৮টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পক্ষে ভোট দেয়। নয়টি রাষ্ট্র বিপক্ষে ভোট দেয় এবং ৪১টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। ফল ঘোষণার পরপরই সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের পেছনে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো হয়। ভোটগ্রহণের সময় ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। ফল ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিরা বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠেন। এ সময় তারা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলেন।
এখন জাতিসংঘের নন-মেম্বার স্টেট এর মর্যাদা পাবে ফিলিস্তিন। এটা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি পৃথিবীর বৃহত্তম সংস্থাটির পরোক্ষ স্বীকৃতি। পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গাজা উপত্যকা নিয়ে গঠিত ফিলিস্তিন এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হতে পারবে। ফিলিস্তিনের এই বিজয়কে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ দুটো দেশ ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির ঘোর বিরোধিতা করেছে।
ভোটগ্রহণের পর জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘আমার অবস্থান সবসময়ই ছিলো সংগতিপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি- ফিলিস্তিনিদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্রের আইনসংগত অধিকার আছে। ইসরাইলেরও আছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করার অধিকার।’ দীর্ঘ ৬৫ বছরের ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ থেকে এখন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে ফিলিস্তিন। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভেঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সূত্র : আল জাজিরা ও এপি।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র
অতীতে বহুবার জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে ভেস্তে গেলেও, এবার দেশটি নিজেই চিন্তা করছে এতে স্বাক্ষরের। মূলত, ২০১৪ সালে ইসরাইলের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময় এক প্রচারাভিযানে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যই এর অন্যতম কারণ। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে কট্টরপন্থী ভোট লাভের সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে না বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন নেতানিয়াহু! এ নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। নির্বাচনে জয়লাভের পর আগের অবস্থান থেকে সরে এসে দুই রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে কমপক্ষে তিনবার নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। তবে এবার তার মন্তব্যে কিছুতেই গলতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র। আগের মন্তব্যটিই তার চূড়ান্ত মনোভাব হিসেবে ধরে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ খবর দিয়েছে সিএনএন।
শনিবার (২২/৩/২০১৫) হাফিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, আমরা তার কথাটি ধরে নিয়েছি, যখন তিনি বলেছিলেন তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে অন্তত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে না। ওই অঞ্চলে আমরা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখতে চাই না। এটি নিশ্চিত করতে বাকি যেসব বিকল্প উপায় রয়েছে, সেসব ভেবে দেখছি আমরা। সাধারণত, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর বিজয়ীকে সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করে অভিনন্দন জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানাতে দুই দিন সময় নিয়েছেন ওবামা। ওবামা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতিদান সম্পর্কিত জাতিসংঘের প্রস্তাবটিতে স্বাক্ষরের কথা চিন্তাভাবনা করছে।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির তাৎপর্য
প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও জাতিসংঘে শুভবোধের জয় হয়েছে । সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনকে বাধ্যতামূলকভাবে বিভক্ত করার ঠিক ৬৫ বছরের মাথায় এ ঘটনা ঘটলো। এতোদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিন জাতিসংঘে ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক সত্তা’র মর্যাদা ভোগ করতো, এবার তা ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’-এর মর্যাদায় উন্নীত হলো।
বিপক্ষে ভোট দেওয়া ও ভোট না-দেয়া সদস্যরা দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে থাকা শান্তি আলোচনা শুরুর উপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তটি শান্তি আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা বিঘিœত করবে বলে কথা ছড়াতে শুরু করেছে। শান্তি আলোচনা কেনো বন্ধ হয়ে আছে, সে ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলা হচ্ছে না। স্মর্তব্য, নানান নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল কর্তৃক অবৈধ বসতবিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১০ সাল থেকে আলোচনা বন্ধ আছে।
বিরোধীরা আরো বলতে চাইছেন, এই স্বীকৃতির কোনো গুরুত্ব নেই। আসলে গুরুত্ব আছে। জাতিসংঘে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিশাল গুরুত্ব আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের নামের সঙ্গে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি যুক্ত করেছে। আর এর ফলে সাধারণ পরিষদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার না পেলেও ফিলিস্তিন এখন থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিতে পারবে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টও অন্তর্ভুক্ত। ধরে নেওয়া যায়, এটাই ইসরাইল ও ইসরাইলের বন্ধুদের চিন্তার বিষয়। উল্লেখ্য, একবার আইসিসির সদস্য হয়ে গেলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা যায় কি না তা তদন্তের জন্য সংস্থাটির প্রতি অনুরোধ জানাতে পারবে ফিলিস্তিন। পশ্চিম তীর ও গাজায় ২০০৮-০৯ ও ২০১২ সালে ইসরাইলি সামরিক তৎপরতাকে এই তদন্তের আওতায় আনা সম্ভব হতে পারে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৮ সালের শেষ থেকে ২০০৯ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত গাজায় নারকীয় হত্যাকা-, সম্পদহানি ঘটানোর অব্যবহিত পরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের তদন্ত করার জন্য আইসিসির প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। আইসিসির বক্তব্য হচ্ছে, জাতিসংঘ বা আইসিসির সদস্যরা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে তাদের কিছু করার উপায় নেই। এবার সে বাধা অতিক্রম হলো। ইসরাইলের জন্য এটা বিরাট এক সমস্যা।
সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের আরেকটি গুরুত্ব আছে। আরো একবার প্রমাণিত হলো, আজকাল আর বিশ্বের অধিকাংশ দেশ প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদামাফিক যেকোনো ইস্যুতেই ‘জি হুজুর’ নীতি অনুসরণ করছে না। এটি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বরাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে, এটা কোনোভাবেই বলা চলে না। তবে সিদ্ধান্তটির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মুখে যে কিছুটা ঝামা ঘষা হয়ে গেছে, তা বলাই বাহুল্য।
এ ছাড়া আশা করা যায়- সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের পরে, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদী আগুন বাড়িয়ে ভোট জেতার যে কায়দা ইসরাইলের ক্ষমতাসীনেরা অনুশীলন করছে, তাতে ভাটা পড়বে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি ও দাদাগিরির দিন আর থাকছে না ইসরাইলি নেতাদের জন্য। আর এসবের পুরো ও প্রত্যক্ষ সুবিধা ভোগ করবে এতোদিনের বঞ্চিত ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিনের পাশে বাংলাদেশ
অন্যায়-অবিচার, জুলুম-খুন আর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দাঁড়িয়েছেন ফিলিস্তিনের পাশে। জাপানিজ রেড আর্মি কিংবা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির মত বেশ কিছু সংগঠন ও গেরিলা গোষ্ঠীর সদস্যরা ধর্ম-বর্ণ ভুলে লড়েছিলেন ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে। এসব সংগঠন এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অবদান নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই, তৈরী হয়েছে ডকুমেন্টারি। কিন্তু বাংলাদেশের বেশ কয়েক হাজার যুবকের কাহিনী কীভাবে যেনো চাপা পড়ে গেছে কালের আবর্তে। তাদের ব্যাপারে কোন আরব-অনারব ঐতিহাসিক কিংবা সাংবাদিক অনুসন্ধানমূলক কোনো পদক্ষেপ হাতে নেন নি আজ পর্যন্ত।
ফলে এ প্রজন্মের ফিলিস্তিনীরা তো বটেই এমনকি বাংলাদেশীরাও জানেন না বীর বাংলাদেশীদের এই গৌরবময় ইতিহাস। তখনকার চরম গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামীদের সাথে অস্ত্র হাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই থেকে শুরু করে অস্ত্র-রসদ বহন এমনকি পাহারার কাজও করেছিলেন বহু বাংলাদেশী যুবক। প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশী যুবক সেসময় প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার হয়ে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
ফিলিস্তিনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটা জন্মের পর থেকেই। গোঁয়ার এবং অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসকদের সাথে ধারাবাহিক রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং একের পর এক নিপীড়ন এবং বঞ্চণামূলক পদক্ষেপের প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ এ টানা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন হয়ে যাওয়াটা মুসলিম বিশ্ব সহজভাবে নেয় নি এবং প্রথমদিকে আরবরা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেও অনীহা প্রকাশ করে ।
স্বাধীনতার স্থপতি এবং তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এই অচলাবস্থা কাটানোর উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে ওআইসিসহ আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনযোগ দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সাহসী ও আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ব্যাপারে আরবদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যেতে থাকে। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশর-সিরিয়া-ফিলিস্তিন অক্ষের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষলা করলেন, যুদ্ধে আরবদের সেবা ও সহযোগিতা দেওয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি মেডিকেল টিম এবং ত্রাণ সামগ্রীও পাঠান।
আরব-ইসরাইল যুদ্ধের কিছু দিন পর সে বছরেই আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং সেই সম্মেলনে ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায়ও মিলিত হন। সেটাই ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনী কোনো সংগঠনের অতি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। ১৯৭৪ সালে আরব রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানকে চাপ দিতে থাকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য। পাকিস্তান এক পর্যায়ে স্বীকৃতি দিতে বাধ্যও হয়।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের দরজা উম্মুক্ত করা হয় ফিলিস্তিনের জন্য এবং ঢাকায় ইয়াসির আরাফাতের পিএলও কে বঙ্গবন্ধু সরকার আমন্ত্রণ জানায় অফিস খোলার জন্য। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকায় পিএলও নেতা এবং কূটনীতিকরা আসেন এবং ফিলিস্তিনের প্রথম কোনো দপ্তর খোলা হয় । এসময় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং কূটনৈতিক প্রোগ্রামে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিকদের প্রায়ই অংশ নিতে দেখা যেতো বলে জানা যায়। ১৯৭৬ সালে ঢাকার আমেরিকান এ্যাম্বেসির পাঠানো এক বার্তার সূত্রে এ তথ্য ফাঁস করে উইকিলিকস।
মুসিলম রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন এবং তার জনগণের প্রতি সবসময়ই বাংলাদেশের মানুষের সহানুভূতি-ভালোবাসা ছিলো অফুরান। এ সম্পর্কের আরেক মাইলফলক উম্মোচিত হয় ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। এসময় ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে তা স্মরণীয় করে রাখতে সরকার প্রকাশ করে একটি স্মারক ডাকটিকিট, যেখানে একজন ফিলিস্তিনী যোদ্ধাকে দেখা যায় অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো এবং তার পেছনে কাঁটাতারে ঘেরা মসজিদুল আক্বসা। এই ডাকটিকিটে ইংরেজিতে লেখা ছিলো- ‘আমরা বীর ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের স্যালুট জানাই।’
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ সফরে আসেন পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত। মুসলিম বিশ্বে খুব কম সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া বাংলাদেশী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে উপস্থিত থেকে লাল গালিচা সংবর্ধনা জানান ফিলিস্তিনি এই নেতাকে। ফিলিস্তিন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালোবাসা এবং উৎকণ্ঠা দেখে অভিভূত হন ইয়াসির আরাফাত। রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রীয় বড় সব কর্মকর্তারা তাকে যথাযথ সম্মান জানান এবং সমাদর করেন।
১৯৮৮ সালে ইউএস লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত তার দ্বিতীয় বারের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ সরকার তাকে জানান যে এদেশের প্রায় ৮ হাজার যুবক স্বেচ্ছায় ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করছেন। এছাড়া এই রিপোর্টে আরো জানানো হয়, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের বেশ কিছু নেতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধীনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
আজকের দিনে এরকম ডকুমেন্টস খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল যেখানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, ঠিক কতজন বাংলাদেশি লেবাবনে সেইসময় ফিলিস্তিনিদের সাথে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন, কতজন শহীদ হয়েছিলেন কিংবা তারা কোন ইউনিটের সাথে ছিলেন । মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় পত্রিকা আল-আখবার বৈরুতে এ বিষয়ে বাংলাদেশ এ্যাম্বেসির সাথে যোগাযোগ করলে এ্যাম্বেসির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে এরকম ইতিহাস বা ঘটনা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের দলিলে থাকলেও খুব বিস্তারিত বা বলার মত পর্যাপ্ত তথ্য তাদের কাছে নেই। বৈরুতের ফিলিস্তিন এ্যাম্বেসিও এ বিষয়ে খুব বেশি বলতে পারে নি কারণ, লেবাননে আগ্রাসনের সময় তাদের দপ্তরে হামলা চালিয়ে ইসরাইল সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। সুতরাং এ সংক্রান্ত কোন দলিল থেকে থাকলেও তা নষ্ট হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের তৎকালীন নেতাদের স্মৃতিতে কি আছে বাংলাদেশের সেসব দুঃসাহসী তরুণদের কথা? অনেকের মনেই হয়তো এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকে ভুলে গেলেও সবাই যে ভুলে গেছেন তা কিন্তু নয়। অনেকেই মনে রেখেছেন। লেবাননে ফাতাহর সেক্রেটারী এবং তৎকালীন পিএলও নেতা ফাতহি আবু আল আরাদাতের কথায় যার প্রমাণ মেলে। তার কথা খানিকটা এমনই-
‘তারা সংখ্যায় ছিলেন প্রায় এক থেকে দেড় হাজারের মত। এমনও ব্যাটালিয়ন ছিল আমাদের যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন বাংলাদেশী। তবে তাদের বেশিরভাগই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে বিভিন্ন গ্রুপের সাথে কাজ করেছেন। আমার মনে পড়ে তারা ছিলেন খুবই সুশৃঙ্খল এবং অদম্য। যখন ইসরাইল লেবাননে হামলা করলো তখন বেশ কিছু বাংলাদেশী যুবক ইসরাইলীদের হাতে ধরা পড়েন। তারা ইসরাইলী সেনাদেরকে বলতো, ‘চখঙ, ওংৎধবষর ঘড়’! এমনকি প্রচন্ড নির্যাতন করার পরও এমন কথা বলতেন। অন্য সকল যোদ্ধাদের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিলো এবং ফিলিস্তিনের মুক্তির ব্যাপারে তাদের দৃঢ় আশা এবং বিশ্বাস ছিলো।’
যদিও সেই সময়ে ফাতাহ অর্থাৎ পিএলওই ছিলো ফিলিস্তিনী মুক্তি আন্দোলনের প্রধান গ্রুপ। তাই বিদেশী যোদ্ধাদের বেশিরভাগই তাদের সাথে কাজ করতেন। এছাড়া আরো ছোটখাটো কিছু গ্রুপ ছিলো যারা ফাতাহর কমান্ডের বাইরে লড়াই করতো। এরকমই কিছুটা বামপন্থী আদর্শের একটা গ্রুপ চধষবংঃরহরধহ ঋৎড়হঃ ভড়ৎ ঃযব খরনবৎধঃরড়হ ড়ভ চধষবংঃরহব – এবহবৎধষ ঈড়সসধহফ (চঋখচ-এঈ) । এই গ্রুপটা তাদের মূল দল চঋখচ থেকে পৃথক হয়ে যায় আদর্শগত বিরোধের কারণে এবং তারা সিরিয়ার বামপন্থী সরকার থেকে সমর্থন পেতো।
চঋখচ’র তৎকালীন একজন কমান্ডার জিয়াদ হাম্মো বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেকেই চঋখচ-এঈ’র সাথে ছিলেন। তাদের মিলিটারি ট্যালেন্ট ছিলো চমৎকার। তবে বেশিরভাগ সময়ই তারা সেবা দেওয়ার কাজ করতেন, যেমন অস্ত্র-গুলি বহন কিংবা যোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ। অফিস/ঘাঁটি পাহারাতেও তারা আমাদের সাথে কাজ করতেন। কখনও সরাসরি লড়াইয়ে অংশ নিতে চাইলে তারা ফিল্ডে চলে যেতেন। আমি তাদের মধ্য থেকে এখনও ২/৩ জনকে পরিষ্কার মনে করতে পারি। একজন বেকাতে আমাদের ঘাঁটি পাহারা দিতেন, আরেকজন বাবলেকে। তারা কেউ কেউ চমৎকার আরবীও বলতে পারতেন। এজন্য মানুষ ভুলেই গিয়েছিলো তারা বাংলাদেশি।’
১৯৮২ সালে লেবাননে জাতিসংঘের বাহিনী মোতায়েন হবার পর তারা লেবানন ছাড়া শুরু করেন। অনেকেই শহীদ হয়ে যান যুদ্ধে, অনেকে ইসরাইলের হাতে আটক হয়ে অনেকদিন পর ছাড়া পান। কেউ কেউ লেবাননেই বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে বাকি জীবনটা সেখানে কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এখনও বৈরুতের কোন গলিতে খুঁজলে হয়তো কোনো কোনো বাংলাদেশি বৃদ্ধকে পাওয়াও যেতে পারে, আর সাথে পাওয়া যেতে পারে চাপা পড়ে যাওয়া এক ইতিহাস।
দক্ষিণ লেবাননের শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পের অদূরেই একটা কবরস্থান। ১৯৭০ থেকে শহীদ হয়ে আসা ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের শহীদদের সমাধি এখানে। একটু খুঁজলেই কিছু বিদেশী ব্যক্তির কবর চোখে পড়ে। বেশ কিছু লেবানিজ, সিরিয়ান, তিউনিশিয়ান, ইরাকী বা দু একজন কুর্দি ও রাশিয়ান শহীদের কবরের মধ্যে হঠাৎ চোখ আটকে যায় ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি কবর ফলকে। বাংলাদেশি সে শহীদের নাম কামাল মুস্তাফা আলী। কামাল মুস্তাফা আলী কে, তার বাড়ি বাংলাদেশের কোথায় কিংবা তার জন্ম কবে এর কিছুই কবর ফলকে লেখা নেই ।
শুধু নাম, দেশ, শহীদ হবার স্থান-সময় এবং পবিত্র কুরআনুল কারিমের একটি আয়াত সেখানে লেখা আছে-
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে কখনো মৃত মনে করো না; বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।’ (সূরা আল-ইমরান, আয়াত- ১৬৯)
কামাল মুস্তাফা আলী শাহাদাত বরণ করেন ১৯৮২’র ২২ জুলাই এক দুঃসাহসী লড়াইয়ের সময়। দক্ষিণ লেবাননের নাবাতিয়া এলাকায় অবস্থিত হিগ রক দূর্গে ইসরাইলিদের হাতে তিনি শহীদ হন। সুপ্রাচীন এই দূর্গটি ইবধঁভড়ৎঃ ঈধংঃষব নামেও পরিচিত। অবস্থানগতভাবে এই দূর্গটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে এই দূর্গে বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে হাজার বছর ধরে। সেই ক্রুসেডার এবং সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর সময়ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক লড়াই এবং সংঘাতের সাক্ষী এই দূর্গ। ১৯৭৬ সাল থেকে এই দূর্গটি ফিলিস্তিনিরা নিয়ন্ত্রণ করতো এবং ইসরাইল সীমান্তে লড়াইয়ের জন্য এটি একটি মজবুত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
১৯৮২ সালের ৬ জুন লেবানন আক্রমণ করে ইসরাইল এবং বৈরুতে ঢোকার পথে তাদের প্রথম দফা টার্গেট ছিলো হিগ রক ক্যাসল। ইসরাইলের সুতীব্র স্থল এবং বিমান হামলার ভয়াবহতার মুখেও টানা ২ দিন এই দূর্গের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন ফিলিস্তিনিরা। কঠিন প্রতিরোধের মুখে দূর্গের পতন ঘটানোর জন্য ইসরাইলকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
কামাল মুস্তাফা আলী সেই মহান সৈনিকদেরই একজন, যারা শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার জন্য লড়েছিলেন এবং শেষ রক্তবিন্দুটিও ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলায় ঢেলে দিয়েছিলেন। আর এভাবেই প্রত্যক্ষভাবে ফিলিস্তিনের সাথে জড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের নাম। শুরু থেকে নিয়ে আজও বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশেই আছে। ভ্রাতৃত্বের পূর্ণ মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে। থাকবে চিরকাল, ইনশাআল্লাহ।
ফিলিস্তিনের দুর্গতির কারণ অনুসন্ধান : উত্তরণ কোন পথে?
এক – সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি
মুসলিম জাতির দুর্গতি বেড়েই চলেছে। চারিত্রিক অবনতিও ক্রমশ বেগবান হচ্ছে। সবরকম কাজেই বিশৃঙ্খলা ও পরিকল্পনাহীনতা প্রকট হচ্ছে। কম-বেশ অতীতেও এ সমস্যা ছিলো, তবে এতোটা ভয়ংকর কখনো নয়।। হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিক তথা ইংরেজি উনিশ শতকের শেষভাগে এসেই তারা রীতিমতো এক নিঃস্ব জাতিতে পরিণত হয়েছে , যাদের শরীরে কোনো আত্মা-হৃদয় এমনকি রক্তও যেনো নেই আর। মুসলিম জাতি ছিলো একটি বিশাল অট্টালিকাসদৃশ। জীর্ণ খুঁটি আর ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের টুকরো নিয়ে কোনোরকমে যা আজ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষকে এটি আশ্রয় দিচ্ছে ঠিক, তবে দূর থেকে তাদের শঙ্কিতও করছে। এভাবেও বলা যায়- এরা ছিলো একটি বিশাল বটগাছের মতো, যার শেকড়গুলো একটি আরেকটিকে গিলে ফেলেছে। প্রধান শেকড়েও ধরেছে পচন। সামান্য সান্তনা হলো- এখনো তা উপড়ে পড়ে নি।
মুসলিম দেশগুলো পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত সম্পদে, যে যেভাবে পারছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, বাধা দেওয়ার যেনো কেউ নেই। হিং¯্র ডাকাত আর লোভী চোরেরা ইচ্ছামতো লুটপাট চালাচ্ছে। কিছুতেই কিছু রোধ করা যাচ্ছে না। এসবের মধ্য দিয়ে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণীও পূর্ণরূপে সামনে আসছে। নবীজি ইরশাদ করেন-
‘কিছুদিনের মধ্যেই তোমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতিকে ডাকাডাকি করা হবে যেমন আহারকারীদের থালার দিকে ডাকাডাকি করা হয়।’ সাহাবীদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলেন, আমরা সেদিন সংখ্যায় কম থাকায় কি এমনটি হবে? নবীজি বললেন, ‘সেদিন তোমরা বরং সংখ্যায় প্রচুর থাকবে; তবে তোমরা হবে ¯্রােতে ভাসতে থাকা খড়কুটোর মতো। আর নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের শত্রুদের হৃদয় থেকে তোমাদের ভয় কেড়ে নেবেন এবং তোমাদের অন্তরে ‘ওহান’ ঢেলে দেবেন।’ আর একজন তখন জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল, ‘ওহান’ কী? তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার ভালোবাসা এবং মৃত্যুর ভয়’। -আবূ দাউদ : ৪২৯৯
বিগত দুই শতকে মুসলমানদের এমনতর হালতের আর উন্নতি হয় নি; বরং আরো খারাপের দিকে গেছে। এমনকি উনিশ শতাব্দীতে তাদের ওপর দৃশ্যত ভদ্র তবে আচরণে বর্বর ও লেবাসধারী খৃস্টান ইউরোপ হামলা করে বসলো। প্রতিরোধের বদলে তারা তখন নিজ দেশের চাবিগুলো তুলে দেয় খৃস্টানদের হাতে। ছেড়ে দেয় বিশ্ব-নেতৃত্বের আসন।
এ সময় মুসলমানরা নৈতিক অবক্ষয়ের সে স্তরে পতিত হয় যাতে এমন ব্যক্তির অভাব ছিলো না, স্বজাতির সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। ব্যাপার তেমনই ঘটেছিলো। এরা নামমাত্র মূল্যে বিদেশিদের কাছে নিজ দেশ বিকিয়ে দিয়েছিলো। শত্রুবাহিনীতে ঢুকে গিয়েছিলো রাজাকার হিসেবে। নিজ দেশের কোষাগার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো বিদেশি প্রভুদের খুশি করতে।
প্রাচ্যের হামলার চেয়েও পাশ্চাত্যের এ হামলা ছিলো তীব্র, প্রভাব বিস্তারকারী ও ব্যাপকতর। ফলে তাদের হৃদয়ে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা প্রতিটি অঙ্গার নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো, কয়েক শতাব্দীর লাগাতার ঝড়-ঝাপটাও যেগুলোকে নেভাতে পারেনি। যা ছিলো ছাইয়ের ভেতরে লুকোনো- একবার আড়াল হয় তো আরেকবার জিহ্বা বের করে।
তাদের বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম-হৃদয়ে সুপ্ত শক্তি নিয়ে গবেষণা করে। তারা জানতে পারে এদের শক্তি ও প্রেরণার প্রধান উৎস ঈমান। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে তারা আরো দেখেছে অতীতে এ ঈমান কী কী করেছে! পৃথিবীকে কী বিস্ময় আর চমক উপহার দিয়েছে! আর ভবিষ্যতই-বা তা কী উপহার দিতে পারে। সবকিছু বিবেচনা করে তারা সিদ্ধান্তে আসে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় দু’রকমের শত্রু, যা এদের জন্য তাতারি ও মঙ্গোলীয়দের চেয়ে, এমনকি মহামারীর চেয়েও ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
মুুসলিম জাতির অন্তরে ওরা সৃষ্টি করে সন্দেহ। নড়বড়ে করে দেয় বিশ্বাসের ভীত। মানুষকে দুর্বল ও ভীরু বানানোর জন্য এরচেয়ে কার্যকর কোনো অস্ত্র হয় না, যাকে আমরা মানসিক বশ্যতা বা দাসত্ব বলে থাকি। আজকাল লেখকরা একে বলেন থাকেন ওহভবৎরড়ৎরঃু ঈড়সঢ়ষবী। মুসলমানরা ভেতরে ভেতরে হীনতা ও দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করে। তারা হেয় মনে করতে থাকে নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে। নিজস্ব ঐতিহ্য ও কালচার চর্চায় বোধ করে লজ্জা ও সংকোচ। মুসলমানরা বিশ্বাস করতে থাকে ইউরোপীয়রা তাদের চেয়ে উন্নত। সর্বক্ষেত্রে। ভালো যা আছে সব তাদের মধ্যেই। রুচিশীল ও উন্নত সবকিছু আছে একমাত্র পাশ্চাত্যেরই। ইতিহাসের কোনো বাঁকে তাদেরকেও যে নিদারুণ পরাজয় ও অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো এবং হতে পারেও- তা মুসলমানরা অবিশ্বাস করা শুরু করলো।
মুসলিম-মানসে যখন এই দাসসুলভ মনোবৃত্তি গেড়ে বসেছে, বস্তুত তখনই তার অপমৃত্যু ঘটেছে। যদিও আমরা তাকে চলাফেরা করতে দেখি। স্বাভাবিক পানাহার ও জীবনযাপন করতে দেখি। এ পর্যায়ে মুসলমানদের বস্তুপূজা এবং দুনিয়াকে ভালোবাসার পশ্চিমা কৃষ্টি ও পাশ্চাত্য দর্শনের রোগ পেয়ে বসলো। ক’দিনের লাভের পেছনে ছোটাছুটি এবং ব্যক্তিস্বার্থ ও জাগতিক লাভকে নৈতিকতা ও চারিত্রিক মূল্যবোধের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া মূলত ইউরোপীয়দের বৈশিষ্ট্য। এই মানসিকতা ও চরিত্রই মুসলমানদের আল্লাহর পথে জিহাদ ও বিশ্বজুড়ে তাঁর কালেমা উড্ডীন করার জন্য জীবন উৎসর্গ করা, কষ্ট সহ্য করা, ভয়-ভীতি ও ক্ষয়-ক্ষতি উপেক্ষা করা এবং বিশুদ্ধ আদর্শ ও মহান আকিদার জন্য কোরবান হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
এসবের কারণে মুসলিম জাতির মধ্যে এমন এক প্রজন্মের উদ্ভব ঘটে, যাদের মস্তিষ্ক আলোকিত হলেও হৃদয় অন্ধকারাচ্ছন্ন, যাদের অন্তর পুরোপুরি শূন্য, ঈমান বড়ই দুর্বল, যাদের মধ্যে দীনদারি, ধৈর্য, উচ্চ বাসনা ও খোদাভীতির বড় অভাব। এরা দুনিয়ার বিনিময়ে নিজেদের দীন এবং বর্তমানের বিনিময়ে ভবিষ্যত বিকিয়ে দেয়ায় পিছপা হয় না। ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে, সামান্য ক্ষমতা-সম্মান ও পদ-পদবির লোভে স্বজাতি ও স্বদেশকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। নিজেদের ওপর, নিজেদের জাতির ওপর এদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি প্রচ-রকম। সম্পূর্ণরূপে এরা পরজীবী ও পরনির্ভর। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
‘এবং যখন তুমি তাদের প্রতি তাকাবে, তাদের শরীর তোমাকে মুগ্ধ করবে। আর যদি তারা কথা বলে তুমি তাদের কথা শুনবে। তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতোই। তারা মনে করে প্রতিটি আওয়াজই তাদের বিরুদ্ধে।’ -সূরা মুনাফিকুন, আয়াত ০৪।
এই বিভ্রান্ত প্রজন্মটিই মুসলমানদের মাঝে ভয় ও ভীরুতা ছড়িয়ে দিয়েছে। এরা মুসলমানদের আল্লাহ-ভরসা থেকে সরিয়ে এনেছে। তারপর নিজেদের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে পরনির্ভর হতে, পরের কাছে হাত পাততে এবং বিপদে তাদের সাহায্যপ্রার্থী হতে শিখিয়েছে।
এরা নিভিয়ে দিয়েছে মুসলিম-মানসে সুপ্ত আল্লাহর পথে লড়ার আবেগ-শিখা ও দীনের তেজ। আর এ আবেগের উন্মত্ততাকে বদলে দিয়েছে নিষ্প্রাণ দেশাত্ববোধ ও ঝিমিয়ে পড়া জাতীয়তাবাদে। যে উন্মত্ততা সমাধি থেকে তুলে এনে জ্ঞানকে দান করেছে পুনর্জীবন এবং বুদ্ধিকে দিয়েছে বন্দিদশা থেকে মুক্তি। যে উন্মত্ততা হাজার বছর ধরে বুদ্ধি ও জ্ঞান যা করতে পারে নি তা করে দেখিয়েছিলো। এই প্রজ্ঞাসম্পন্ন পাগলামিকে ওরা দুর্বল ও অসম্পূর্ণ বুদ্ধিতে রূপান্তর করে দিলো, যে বুদ্ধি উপলব্ধি করতে জানে শুধু বাধা আর প্রতিবন্ধকতা।
চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতার এ বিশাল পরিবর্তন নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে ফিলিস্তিনযুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে, রুহ ও ঈমানের নিঃস্বতায়। বিংশ শতাব্দীতে এ ছিলো আরববিশ্বের জন্য এক লাঞ্ছনা ও অপমান। যেমন তারা সপ্তম হিজরি তথা ইসলামের আবির্ভাবের মধ্য পর্যায়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও পরাজিত হয়েছিলো তাতারি বাহিনীর বিরুদ্ধে।
ফিলিস্তিনের এ যুদ্ধে সাত সাতটি আরবরাষ্ট্র জায়নবাদী ইহুদিদের মোকাবেলায় জোট বেঁধেছিলো। একাট্টা হয়েছিলো তারা আরবের পবিত্রতম ইসলামি ভূখ-, মুসলমানদের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস রক্ষায় এবং আরব রাষ্ট্রসমূহ ও আরব উপদ্বীপের উপর ইহুদিবাদের হুমকি মোকাবেলায়। হ্যাঁ, ফিলিস্তিনযুদ্ধ ছিলো জীবন রক্ষার যুদ্ধ। ছিলো দীন, আকিদা ও সম্মান রক্ষার লড়াই।
সমগ্র আরববিশ্ব ছিলো একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যা বেশিদিন টিকবার নয়। সবার দৃষ্টি ছিলো ফিলিস্তিন রণাঙ্গনের দিকে। মানুষ অপেক্ষায় ছিলো আরেকটি ইয়ারমুক যুদ্ধ দেখার জন্য। আরেক হিত্তিনের লড়াই প্রত্যক্ষ করার জন্য। আর তারা কেনইবা অপেক্ষা করবে না। এ তো সে জাতিই। একই রক্তের ধারক-বাহক তারা। আকিদা আর চেতনাও তো একই। বরং তাতে যোগ হয়েছে অধিক সংখ্যা ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। কিন্তু এরপরও কেন আরবরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারলো না? কেন পারলো না তারা শত্রুকে নাকানি-চুবানি দিতে? অথচ তারা ছিলো কেবলই একটি বাস্তুচ্যুত শরণার্থী জাতি!
তারা ভুলে গেছে যুগের শিক্ষা আরবজাতিকে কতোটা বদলে দিয়েছে। সময় তাদের কতো বদলে দিয়েছে। রাষ্ট্রসমূহ ও রাজনৈতিক নেতারা তাদের কতোটা বদলে দিয়েছে। আর বস্তুই-বা তাদের কতো বদলে দিয়েছে।
ইয়ারমুক যুদ্ধে আরবরাই বিজয়ী হয়েছিলো সত্য; কিন্তু তা প্রথম যুগে তাদের পূর্বসূরিদের বিরল ও অনন্য ঈমানের বদৌলতে। তারা এমন লড়াইয়েও বিজয় মাল্য ছিনিয়ে এনেছেন, যা ছিলো চূড়ান্ত পরাজয়ের আশংকায় বিদ্ধ। যেমন হিত্তিনের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বিজয় মাল্যে আরবরাই ভূষিত হয়েছিলো বটে; কিন্তু তা সালাহুদ্দীন আইয়ুবী ও তাঁর মুজাহিদবাহিনীর সমৃদ্ধ রুহ ও আত্মার কল্যাণে।
তাঁদের আত্মা অন্তঃসারশূন্য ছিলো না যে, তা মৃত্যুকে ভয় পাবে আর জীবনকে ভালোবাসবে। তারা বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারী কিংবা বিভিন্ন কালেমার ধারক ছিলেন না। যারা শুধু জিততে চায়; কিছু হারাতে চায় না। যারা যুদ্ধ জয় করতে চায় কোনো ঝুঁকি না নিয়ে এবং নিজেদের মর্যাদা ও বিলাস ধরে রেখেই।
সবাই বিশ্বাস করে যুদ্ধে, তবে যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের দায়-দায়িত্ব তার নয় অন্যের। তারপর তারা লড়াই করতে যায় আর তাদের লাগাম থাকে অন্যের হাতে। যখন একটু ঢিল করে, তারা এগিয়ে যায়। যখন টেনে ধরে, তারা পিছিয়ে আসে। যখন বলে- যুদ্ধ করো, তারা যুদ্ধ করে। যখন বলা হয়- তোমরা সন্ধি করো, তারা সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এভাবে না যুদ্ধ জেতা যায় আর না পরাজিত করা যায় কোনো শত্রুকে।
ইসলামি যুদ্ধের ইতিহাসে বিশ্ব যে বিস্ময়কর ঈমান, শ্বাসরুদ্ধকর বীরত্ব ও সাহসিকতা, ধৈর্য, অকৃত্রিমতা, জীবনের প্রতি অবজ্ঞা, মৃত্যুকে স্বাগত জানানো, শাহাদাতের তামান্না, শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও ত্যাগের উপাখ্যান পড়ে এসেছে, তার পুনরাবৃত্তির অপেক্ষায় থাকলো। তারা অবশ্য ঈমানের কয়েক ঝলক আর বিদ্যুতের ন্যায় কয়েক চমক ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না। এটি দেখিয়েছিলেন যুদ্ধের গুটিকয় আনুগত্যপরায়ন মুজাহিদ, যারা কেবল ঈমানের দাবি পূরণে, ইসলামের শত্রু প্রতিরোধেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। যারা আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন। ধর্মীয় আবেগ আর ঈমানি জযবাই তাদের এ অভিযানে প্রেরণা যুগিয়েছিলো। টেনে এনেছিলো রক্তপিচ্ছিল রণক্ষেত্রে। তারা দীনকে সম্মানিত করেছেন। শত্রু অন্তরে ভীতির সঞ্চার করেছেন। পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন অতীত ইতিহাসের। তাঁরা প্রমাণ করেছেন ঈমানাদারদের কাছে যে শক্তি, কর্তৃত্ব, সংগঠন এবং যুদ্ধ ও প্রতিরোধের প্রাণশক্তি রয়েছে, আজকের তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে তা নেই।
আমি এ আলোচনায় ইতিহাসের যেসব ঘটনা ও দৃষ্টান্ত বিবৃত করেছি এবং সমকালীন সাক্ষ্য তুলে ধরেছি আর ফিলিস্তিনও তো আমাদের চেয়ে বেশি দূরের নয়- তা থেকে প্রমাণিত হয়, ইসলামি ইতিহাস এবং মুসলমানদের অবস্থা-উন্নতির জোয়ার-ভাটার সম্পর্ক ঈমানের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে। ঈমান-বিধৌত আত্মিক শক্তির সঙ্গে। এই জাতির শক্তির উৎস তাদের ভেতরে। আর তা হলো, আত্মা ও অন্তর।
অতএব কলব ও হৃদয় যখন নির্মিত হবে আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং শেষ দীনের ওপর ঈমান ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে, রুহ ও আত্মা হবে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের অনলে পরিশোধিত, বক্ষ হবে দীনী জযবা ও ধর্মীয় আবেগে জ্বলন্ত উনুনের পাতিলের মতো ফুটন্ত ও টগবগে, মুসলমানরা তাদের বৈষয়িক শক্তি অর্জন সম্পন্ন করবে, শত্রু মোকাবেলায় সাধ্যমতো প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করবে, বিশ্বের বিদ্যমান অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-রক্তপাত, দুনিয়া ও আখেরাত বিষয়ে অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি সম্পর্কে অবগত হবে এবং উপলব্ধি করবে, বর্তমান সময়টি ঠিক সে যুগেই ফিরে গেছে, যাতে ইসলামের আগমন ঘটেছিলো আর বিশ্বও সে জাহিলিয়াতে প্রত্যাবর্তন করেছে, যেখানে এর সূচনা হয়েছিলো। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদের আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’
সূরা রুম, আয়াত ৪১।
বিশ্বের এই অবস্থা অবলোকনে তাদের দয়া হয় এবং তারা দেখতে পায়, বিশ্ব পুড়ে যাচ্ছে; কিন্তু তার কাছে পানি নেই। ফলে তারা এ সর্বগ্রাসী আগুন নেভাতে সচেষ্ট হয়। আর এ জন্য তারা নিজেদের ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে, তাদের চোখের ঘুম উড়ে যায় এবং তারা এ থেকে পরিত্রাণের জন্য পাগলপারা হয়ে যায়, তখনই তারা এমন এক বিস্ময়কর শক্তিতে পরিণত হবে, বিশ্ব যাদের পদানত করতে পারবে না। যদিও তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়। সব জাতি, সব বাহিনী ও রাষ্ট্র একাট্টা হয়। তখন আল্লাহর ফয়সালা ও তাঁর অলঙ্ঘনীয় ভাগ্যলিপি এবং সুউচ্চ কালেমাই বিজয়ী হবে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
‘আর নিশ্চয় আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার কথা পূর্বনির্ধারিত হয়েছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। আর নিশ্চয় আমার বাহিনীই বিজয়ী হবে।’ -সূরা সাফফাত, আয়াত ১৭১-১৭৩।
আরও ইরশাদ করেছেন-
‘তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না, আর তোমরাই বিজয়ী হবে যদি মুমিন হয়ে থাক।’ -সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৯।
দুই -মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি
শেষ নাগাদ ইসরাইলের কাছে আরবরা পরাজিত হয়েছে। সম্মিলিত আরব বাহিনী ফিলিস্তিনের হারানো ভূমি উদ্ধার করতে গিয়ে উল্টো চল্লিশ হাজার বর্গমাইল অঞ্চল খুইয়ে এসেছে। উম্মাহর প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। মসজিদে আকসা- যেখানে দিনে পাঁচবার আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হতো, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের পবিত্র যমিন- যেখানে কম-বেশি এক লাখ নবীর শ্বাস-নিঃশ্বাসের সৌরভ ছড়িয়ে আছে, আজ এমন এক সন্ত্রাসী সম্প্রদায়ের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে যাদের অভিধানে নীতি ও ভব্যতা বলে কোনো শব্দ নেই। সিনাই উপত্যকা, যা একসময় ইহুদিদের জন্য ময়দানে তীহে পরিণত হয়েছিলো আজ সেখানে ইসরাইলের উদ্ধত ট্যাংকবহর দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তূর পর্বত, যা আল্লাহর তাজাল্লি লাভে ¯œাত হয়েছিলো, আজ সেই তূর পর্বতে বর্বর ইহুদিদের পতাকা উড়ছে।
সিরিয়া, জর্ডান ও বায়তুল মুকাদ্দাসের সেই ভূমি, যাকে কুরআন সব সময় ‘বরকতময় ও পবিত্র’ শব্দে স্মরণ করেছে, আজ সেই ভূমি কুরআনে বিশ্বাসীদের রক্তে রঞ্জিত। সেখানে নিষ্ঠুর ইসরাইলিরা অস্ত্রের খোঁচায় বর্বরতা আর পশুত্বের নয়া অধ্যায় রচিত হচ্ছে। ওরা মুসলমানদের রক্তে হোলি খেলছে, তাদের ঘরবাড়ি ছিনিয়ে নিচ্ছে। লুণ্ঠন করছে তাদের ইজ্জত-আবরু। মানবতা সেখানে চরমভাবে পদদলিত হচ্ছে। জুলুম ও নির্যাতনের এই আগুনের ইন্ধন বানানো হচ্ছে জেনেভা চুক্তিকে, যে অগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়েছে তাওহিদবাদী মুসলমানদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করতে।
আট শতাব্দী পর এসে ফের বায়তুল মুকাদ্দাসের পতন নিঃসন্দেহে বর্তমান মুসলিমবিশ্বের জন্য চরম বেদনাদায়ক। প্রতিজন মুসলমানের মন আজ ভারাক্রান্ত। শব্দের মারপ্যাঁচে বাস্তবতা বদলায় না। একথা আমাদের নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে, এটা আমাদের মারাত্মক পরাজয়। এমন নজির ইসলামের ইতিহাসে নেই। মাত্র আশি ঘণ্টায় আরবরাষ্ট্রগুলোর সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। আট হাজার বর্গমাইলের দেশ চব্বিশ হাজার বর্গমাইল এলাকা ছিনিয়ে নিল। আটশ বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাস হাতছাড়া হওয়া সাধারণ কোনো আঘাত নয়, যা সহজে ভোলা যায়। পুনরায় বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের আগ পর্যন্ত এ জখম ও আঘাত প্রতিটি মুসলিমকে যন্ত্রণাদগ্ধ করতেই থাকবে।
পৃথিবীর কোনো ঘটনাই অকারণে আলোয় আসে না। সব ঘটনার পেছনেই কোনো না কোনো কারণ থাকে। দুনিয়ার প্রতিটা ঘটনাই আবার সঙ্গে করে নিয়ে আসে বড় ধরনের শিক্ষা। পদস্খলন থেকে মুক্তির জন্য এ শিক্ষাগুলোর অনেক প্রয়োজন। জীবনের পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে উন্নতির শিখরে সে জাতিই উন্নীত হতে পেরেছে, যারা হোঁচট খেয়ে সামলে নেওয়ার জ্ঞান রাখে, পরাজয়কে যারা সাময়িক দুর্ঘটনা হিসেবে না নিয়ে নিজেদের ভুলত্রুটির পরিণতি হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা করে। তাই এ বেদনাদায়ক ঘটনায় আফসোস আর অশ্রু বিসর্জন দিয়েই দায়িত্ব শেষ নয়। এ ঘটনা কিছু বিষয় ভেবে দেখার দাবি রাখে। পৃথিবীতে বসবাস করতে হলে এসব দাবি পূরণ করতে হবে। বর্তমান সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে আরবরা নিঃসন্দেহে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে হলফ করে এ কথা বলা যায়, বেদনাদায়ক এ
পরাজয় আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা। আমরা যদি এ বার্তা থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তা হলে এ পরাজয় মহাবিজয়ে রূপান্তরিত হতে পারে। এটা সংকল্পকে সতেজ এবং চেতনাকে শাণিত করে পথ অনুসন্ধানের সময়। আসুন, আজ থেকেই এ পরাজয়ের কারণ এবং এ থেকে অর্জিত শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশের চেষ্টা করি।
কুরআন-সুন্নাহ ও বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনে গভীর দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কোনো জাতি বা ধর্মের জাগতিক উন্নতি জন্মগত অধিকার নয়। আল্লাহর নিয়ম শুরু থেকেই এমন- কর্মমুখর এ পৃথিবীতে প্রত্যেককেই তার প্রচেষ্টা অনুপাতে অংশ দেওয়া হয়। মুসলমানরাও আল্লাহর এই অমোঘ নিয়মের বাইরে নয়। নিঃসন্দেহে মুসলমানরা গৌরবময় উপাধি সর্বোত্তম জাতিতে ভূষিত। এতেও কোনো সন্দেহ নেই, মুসলমানরা আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় জাতি। এটাও আপন জায়গায় সত্য যে, এই পৃথিবীতে কোনো ধর্মই ইসলামের সমমর্যাদার নয়। এ কথার অর্থ এই নয় যে, কোনো সম্প্রদায় নিজেদের মুসলমান দাবি করে হাত-পা না চালিয়েই নক্ষত্র স্পর্শ করবে। তারা পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকলেও উন্নতি আর সফলতা তাদের পায়ে এসে চুম্বন করবে!
কুরআন শরিফ ও ইসলামের ইতিহাস খুব মনোযোগ দিয়ে না পড়েও এ কথা প্রমাণ করা কষ্টকর নয় যে, মুসলমানদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সমস্ত প্রতিশ্রুতি দুটি শর্তের উপর নির্ভরশীল।
- জীবনের সর্বস্তরে ইসলামের অনুসরণ করা।
- উন্নতির সমস্ত উপায়-উপকরণ অবলম্বনের চেষ্টা করা।
এ দুয়ের মাঝেই নিহিত রয়েছে আমাদের উন্নতি-অগ্রগতি। এ বিষয়টি কুরআনে কারিমে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। একদিকে ইরশাদ হয়েছে-
‘মুমিন হয়ে থাকলে তোমরাই বিজয়ী হবে।’
-সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৯।
অপর দিকে ইরশাদ হয়েছে-
‘আর প্রস্তুত করো তোমরা তাদের মোকাবেলায় যতটা পারো শক্তি ও অশ্বদল, তোমরা সন্ত্রস্ত করবে তা দ্বারা আল্লাহর শত্রুকে এবং তোমাদের শত্রুকে।’ -সূরা তাওবা, আয়াত ৬০।
ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি দিলে কুরআনের এ বর্ণনার সত্যতা পাওয়া যায়। যেখানেই মুসলমানরা খাঁটি মুসলমান হয়ে সবধরনের উপায় উপকরণ লাভের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে সেখানেই বিজয় এসে তাদের পদচুম্বন করেছে। সাধ্যমতো চেষ্টার পর দুশমনের মোকাবেলায় তারা যত নগণ্যই হোক, বিজয়ী হয়েছে। পরাজয়ের গ্লানি মুসলমানদের তখনই বইতে হয়, তারা যখন এই দুই বিধানের কোনো একটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
প্রথম এবং মৌলিক কারণ হলো, আরবরা দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামি শিক্ষাকে অবহেলা করে আসছে। তারা স্বীকার করুক বা না করুক, তাদের চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবনযাপন, পোশাক-পরিচ্ছদ- এক কথায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত চিৎকার করে বলছে, আমরা মুখে পশ্চিমাদের মন্দ বলি কিন্তু আমাদের মন-মগজ তাদের ভালোবাসায় আচ্ছন্ন, পশ্চিমা সংস্কৃতিই আমাদের হৃদয়ে আসন গেড়ে বসেছে, তাদের চিন্তা-চেতনা আর জীবনধারাই আমাদের প্রিয়।
পরিণামে এমন হয়েছে, আরবদেশগুলোতে গেলে আজকাল ঠাহর করাই মুশকিল হয়ে যায়- এগুলো কি মুসলিমদেশ? একটা মুসলিমদেশে পশ্চিমের নগ্নতা, বেহায়াপনা, বিলাসিতা এবং আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম থেকে এমন দূরত্ব কল্পনা করা যায়! রাতের আঁধারে যখন ইসরাইলের যুদ্ধবিমানগুলো মিসরে প্রবেশ করেছিলো তখন কায়রোর হোটেলে হোটেলে উদ্যাম নৃত্যের আসর চলছিলো। কিছুদিন আগেই মিসরে ইসলামপন্থীদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়, একথা তো সবার জানা। মিসর এবং সিরিয়ায় আলেমদের উপর কী অমানবিক নির্যাতন হয়েছিলো তা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। একদিকে ইহুদি আলেমরা জনগণকে আরবদেশের বিরুদ্ধে ধর্মের নামে উজ্জীবিত করছিলো অন্যদিকে মিসর ও সিরিয়ায় আলেমদের জেলে বন্দী করে ইসলাম-প্রীতির শাস্তি দেয়া হচ্ছিল।
ইসলামি শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরিণতি হলো, আরবদেশগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইসলামের পরিবর্তে আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলছিলো। অনেক বছর ধরে তারা জাতীয়তাবাদের এই প্রতিমা আস্তিনে আগলে রেখেছিলো, যা বর্জনের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে স্পষ্ট ঘোষণা করেন, ‘কোনো আরবের অনারবরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’
ইসরাইলে বর্ণ-বংশ নির্বিশেষ বিভিন্ন দেশের ইহুদিরা এক মন এক প্রাণ হয়ে সামরিক প্রস্তুতিতে মগ্ন ছিলো। ধর্ম ব্যতীত তাদের কোনো সামগ্রিক বা একক পরিচয় ছিলো না- তাদের বংশ ভিন্ন, দেশ ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন কিন্তু ধর্মের নামে তার ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল। এজন্য জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে তাদের পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। তাদের কার্যকর মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন ছিলো ফিলিস্তিন সমস্যা শুধু আরবের সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন না করে সমগ্র মুসলিমবিশ্বের সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করা। ইন্দোনেশিয়া থেকে নিয়ে মরক্কো পর্যন্ত সমস্ত মুসলমানকে এর সাথে শরিক করা। পাকিস্তান তুরস্ক ও ইরান অতীতের তিক্ততা ভুলে আরবদের সহায়তার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছে, তা একথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, আরবরা ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে সমস্ত মুসলমানকে আন্তরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করলে তা কঠিন কিছু হত না। যদি এ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হত তা হলে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে শুধু ইসরাইলই মুছে যেত না বরং কাশ্মীর থেকে নিয়ে কবরিছ পর্যন্ত সকল মুসলমানের সমস্যা এমনি এমনি সমাধান হয়ে যেত। মুসলিমদেশগুলোকে নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য কখনো আমেরিকা, কখনো রাশিয়া, কখনো চীনের কাছে ধরনা দিতে হতো না।
পৃথিবীর মানচিত্র দেখুন, আল্লাহ তায়ালা মুসলিমবিশ্বকে ধন-সম্পদে কত সমৃদ্ধ করে রেখেছেন। স্থল-জল-আকাশসহ দুনিয়ার সব গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগপথ তাদের নিয়ন্ত্রণে, এলাহি কত উপায়-উপকরণ তাদের আয়ত্তে, মানবসম্পদে তারা কত সমৃদ্ধ। পৃথিবীর একেবারে মাঝখানে তাদের অবস্থান হওয়ার কারণে গোটা বিশ্বের হৃদপি- তাদের হাতের মুঠোয়- আল্লাহর এ দান ঐক্য ও সমঝোতার মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারলে কেন তারা প্রত্যাশিত মর্যাদা অর্জনে ব্যর্থ হবে? এ ধরনের সুস্পষ্ট বাস্তবতা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের সময় ‘শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহর’ শ্লোগানের পরিবর্তে ‘আরবের শ্রেষ্ঠত্বের’ শ্লোগান উচ্চারিত হয় কীভাবে? এটা নিজ হাতে আল্লাহর গজব ডেকে আনার ব্যবস্থা নয় কি? এই জাতীয়তাবাদকে উজ্জীবিত করার দরুন ধীরে ধীরে নানান অবক্ষয় বাসা বাঁধতে শুরু করল। একদিকে ইসরাইলের কোনো প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হলো না।
অন্যদিকে খোদ আরবদের মধ্যেই ভাঙন দেখা দিলো। যারা জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে সমবেত হওয়া ভুল মনে করতো তারা আলাদা প্লাটফর্ম তৈরি করলো। এই দুই প্লাটফর্মের মধ্যে গৃহযুদ্ধও শুরু হয়ে গেলো। উভয় শক্তি যৌথভাবে দুশমনের মোকাবেলার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে নিঃশেষ হতে লাগলো। দু’পক্ষের প্রচারমাধ্যম পারস্পরিক সমালোচনায় লিপ্ত থাকলো। ফল দাঁড়ালো এই- ইসরাইলের নামের আড়ালে আমেরিকা ও বৃটেন একযোগে যখন আরবদেশগুলোর উপর হামলার জন্য এগিয়ে এলো ঠিক তখন মিসরের সর্বোচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত পঁচিশ হাজার সেনা ইয়ামেনে মুসলিমহত্যায় লিপ্ত ছিলো। জাতীয়তাবাদের তৃতীয় আরেকটি ক্ষতি হলো, জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জিহাদের সেই প্রাণ ও প্রেরণা সেনাসদস্যদের মাঝে সঞ্চার করা সম্ভব হয়নি, যা মানুষকে মৃত্যু আলিঙ্গনে সাহসী করে তোলে।
টানা ছয়দিনের এই যুদ্ধে কায়রো ও যৌথবাহিনীর রেডিও থেকে লাগাতার এই শ্লোগানই প্রচারিত হচ্ছিলো- জাহিদু ফি সাবিলিল আরুবা অর্থাৎ আরব জাতীয়তাবাদের জন্য যুদ্ধ কর। কিন্তু এ গুনাহগারের কান ব্যাকুল ছিলো- জাহিদু ফি সাবিলিল্লাহ তথা ‘আল্লাহর জন্য যুদ্ধ কর’ এই ঐশী বাক্যটি শোনার জন্য। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ‘শ্রেষ্ঠত্ব আরবের’ শ্লোগানটি শোনা যাচ্ছিলো কিন্তু ‘শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহর’ একবারও শোনা যায়নি। চূড়ান্ত বিচারে যোদ্ধারা তো মুসলিমই। আর মুসলিম কখনো দেশ জাতির মতো ফাঁকা বুলির ভিত্তিতে জীবন বিলানো পছন্দ করে না। শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ই তাকে উজ্জীবিত করতে পারে রক্ত দিয়ে গোসল করতে, আগুনের লেলিহান শিখায় ঝাঁপিয়ে পড়তে।
প্রেসিডেন্ট নাসের এক ভাষণে পরাজয়ের একটি কারণ এও উল্লেখ করেছেন, ইসরাইলি বাহিনীর শক্তি আমাদের থেকে তিন গুণ বেশি ছিলো। তার এই বক্তব্য নিজ জায়গায় হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু ইসলামের সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। সৈন্যসংখ্যা বা সমরশক্তির বিচারে মুসলিমজাতি কখনো লড়াই করে না। করতে পারে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে যতোই তিক্ত হোক- এ কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই- এ পরাজয় ইসলাম ও মুসলমানের নয়, এ পরাজয় আরব জাতীয়তাবাদের।
আমরা ইসলামি শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। পশ্চিমা ফ্রি স্টাইল জীবনযাপন, কেবল বৈষয়িক চিন্তাচেতনা ও বল্গাহীন ভোগ-বিলাসিতাকেই অবলম্বন করেছি। শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য নতুন অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের নতুন নতুন কৌশল অবলম্বনের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই করিনি। এ শিক্ষা ইসলাম থেকে অর্জন করার বিষয় ছিলো, যার ফলে জাগতিকভাবেও আমরা কার্যকর কোনো প্রস্তুতি নিতে পারি নি। ইসরাইলের হুমকি আরবদের উপর দশকের পর দশক যাবত ঘুরছে। তাদের হিং¯্র পরিকল্পনাও কখনো পর্দার আড়ালে ছিলো না। তাদের যুদ্ধপ্রস্তুতিও আরবদের সামনে ছিলো। ইসরাইলের মোকাবেলায় নিজ পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টাও আরবরা করে নি। আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ দান করেছেন। বর্তমান পৃথিবীর গতি তেলের উপর নির্ভরশীল।
এই তরল সোনার মালিক তারাই। আল্লাহর এ মহামূল্যবান নেয়ামতকে তারা সম্পূর্ণরূপে অমুসলিমদের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে, ইসলামের বিরুদ্ধে যাদের শত্রুতা কখনোই গোপন ছিলো না। তারা এমন একটি বিশেষজ্ঞ দল এখনো তৈরি করতে পারে নি, যারা নিজেরাই পুরোপুরি তেল উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে এবং এ মহাসম্পদ বিদেশীদের কব্জা থেকে উদ্ধার করতে পারে। এ তিক্ত বাস্তবতাকে বিলাসিতা আর অলসতা ছাড়া কী বলা যেতে পারে!
শুধু তেলের রয়ালিটি থেকে প্রাপ্ত অর্থ পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর মোট আয়ের চেয়ে বেশি। এক পরিসংখ্যান মতে- ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মতো ধনী ব্যাংকগুলোর দুই তৃতীয়াংশ আয় কুয়েতের জমা করা অর্থ থেকে অর্জিত হয়। অন্য আরবদেশগুলো ইউরোপ-আমেরিকার ব্যাংকগুলোতে যে অর্থ জমা রাখে তা এ হিসেবের বাইরে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে- এত বিপুল অঙ্কের অর্থ, যার জোরে ইউরোপ-আমেরিকা সারা দুনিয়ার উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে, পশ্চিমাবিশ্বে রাখা এ অর্থের বড় একটা অংশ ব্যয় হয় মুসলিমবিশ্বে নিধনযজ্ঞ চালাবার কাজে। এই বিপুল অর্থ নিজ দেশে রেখে মুসলিমবিশ্বের উন্নয়নে ব্যয় করা যায় না?
এই সময়ে পশ্চিমাদের ব্যাংকে অর্থ জমা করার মানে দাঁড়ায়, তেলের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ পশ্চিমাদের পকেটে রেখে দেয়া- নাও এ অর্থ দিয়ে তোমরা উপকৃত হও। ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা চাঙা কর। ইসরাইলকে শক্তিশালী করতে তাকে নতুন নতুন অস্ত্র জোগান দাও। ইসরাইলের মাধ্যমে আমাদের উপর বোমা ফেলতে যুদ্ধবিমান বানাও। আমাদের কোনো উন্নয়নের প্রয়োজন হলে এরই কিছু অংশ সাহায্যের নামে আমাদের কাছে ফেরত পাঠাও। যেন দুনিয়ার অলি-গলিতে আমাদেরই কল্যাণে তোমাদের দানশীলতার স্তুতিগাঁথা পাঠ হয়। আমাদের মাথা সবসময় তোমাদের দয়ার সামনে নত থাকে।
আরেকটু অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাই, অল্প-স্বল্প যে পরিমাণ অর্থ আরব দেশগুলো নিজেদের কাছে রাখে তা-ও কম নয়, অনেক। কিন্তু এ অর্থ খরচ হচ্ছে কোথায়? এসি গাড়ি, আরাম-আয়েশের নিত্য-নতুন সামগ্রী, চলচ্চিত্র, মদ, বাচ্চাদের দামি খেলনা, ওয়ান টাইম বক্সের খাবার এবং কবিতা আবৃত্তির জন্য দরবারি কবিদের জন্য বিশল সব পার্টি! আরবদেশগুলোর অধিকাংশের অবস্থা হলো এই, সেখানে আপনি দেখবেন ঘরে ঘরে টিভি-কম্পিউটার-মোবাইল সেট, সড়কে অসংখ্য নিউ ব্র্যান্ডের গাড়ি কিন্তু তাদের সামরিক ছাউনিগুলোতে সেনাসংখ্যা রাস্তার গাড়িগুলোর চেয়ে অনেক কম। সমর শক্তিও খুব সামান্য। অস্ত্রশস্ত্র যা আছে তাও অনেক পুরনো।
তাদের সেনাসংখ্যা এবং আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রও যথেষ্ট অপ্রতুল। অথচ ইসরাইলের অবস্থা হলো, ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ইসরাইলের প্রতিটি নাগরিকই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা। এমনকি নারীরাও। আর আরবদের নিয়মিত সৈন্যদের আধুনিক সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ মোটেই সন্তোষজনক নয়। ইসরাইলে সম্পদের বেশিরভাগ অংশ প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয় হচ্ছে আর আরবের প্রত্যেকটি মানুষ তুচ্ছ আরাম-আয়েশের ব্যস্ততায় দেদার টাকা উড়াচ্ছে। ইসরাইল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ হচ্ছে আর এখানে ঘরে ঘরে ঢুকছে প্রযুক্তির নিত্য-নতুন সব ডিভাইস।
ইসরাইলের ট্যাংকবহর উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে আর এখানে গাড়িকে আরো কত বিলাসবহুল করা যায় তাই নিয়ে চলছে সীমাহীন ভাবাভাবি। ওদিকে ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার জন্য বিবদমান গোষ্ঠীগুলো একত্র হচ্ছে আর এদিকে এখনও এটাই ঠিক করা যায় নি যে, ঐক্যটা হবে কিসের ভিত্তিতে।
এ পরাজয়ের চতুর্থ কারণ, আমরা মুসলিমবিশ্বেও অভ্যন্তরীণ ঐক্যের পরিবর্তে অন্যের উপর ভরসা করে বসে আছি। ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ সমস্যা সমাধান করার পরিবর্তে আমরা কখনো রাশিয়ার দিকে তাকাচ্ছি তো কখনো আমেরিকার দিকে। অথচ সব পক্ষেরই বিশ্বাসঘাতকতা আমরা কদমে কদমে দেখেছি। দেখছি। এই যুদ্ধে আরবদের ভরসা ছিলো রাশিয়ার উপর কিন্তু এ সময়ে রাশিয়া কী ভূমিকা নিয়েছে তা দুনিয়বাসী প্রত্যক্ষ করেছে। মানা’র যুদ্ধের পর রাশিয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে বেশ কড়া বক্তব্য দিয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে ইসরাইলের নিন্দা ও আরবদের পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য দিয়েছে।
ব্যাস, তাতেই হয়ে গেলো? এই ধরনের বায়বীয় বক্তব্য দিয়ে দুনিয়ার চোখে আর কতদিন ধুলো দেয়া যাবে? পরাশক্তিগুলো দুনিয়াতে যে নিষ্ঠুর নিয়ম ও ধারার প্রচলন করতে চায় তার অব্যর্থ প্রতিষেধক তরবারি ছাড়া কিছু নয়। আঘাতের নিন্দা মুখের ভাষা দিয়ে হয় না, করতে হয় অস্ত্রের ভাষায়। মজলুমের ভোগান্তির প্রতিকার গোলটেবিলে বসে করা যায় না, সরাসরি যুদ্ধের ময়দানেই এর প্রতিকার সম্ভব। ইসরাইল যদি সভ্যতা, ভদ্রতা এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাশীল হতো তা হলে মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনের কোনো সমস্যাই থাকতো না। ইসরাইল হলো বিষধর সাপ, যাকে হত্যা করার জন্য কোনো যুক্তির দরকার পড়ে না। প্রচ-রকম আঘাতই এর প্রতিষেধক, যার ফলে সেটা আর মাথা তুলতেই সাহস না পায়।
ময়দানে প্রচ- লড়াইয়ের সময় চুপটি মেরে থাকা, মজলুমের আহাজারি থেমে যাওয়ার পর হৈচৈ করা বন্ধুর কাজ নয়। যে মজলুম এমন মানুষকে বন্ধু মনে করে তার নির্বুদ্ধিতার প্রতি আশ্চর্য হওয়া ছাড়া কী করার থাকে? রাশিয়ার চলমান শোরগোল চেচামেচির উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে এটাই- আরব ও ইসরাইলের মাঝে ঝামেলা বাধিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসকে বহুজাতিক শহর এবং উপসাগরীয় অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক মহাসড়ক ঘোষণা করা। এটাই হবে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় সফলতা।
আরবদের পরাজয়ের যেসব কারণ আমি বর্ণনা করেছি তাতে কোনো দুর্বোধ্যতা কিংবা অস্পষ্টতা নেই। এটা এমন কোনো দর্শন নয়, যা বুঝার জন্য দলিল-প্রমাণের প্রয়োজন। এগুলো সবই চোখে দেখার মতো সুস্পষ্ট ব্যাপার, যা সব মুসলমানই অনুভব করছে। এ পরাজয় অনেক বড় হোঁচট। সমগ্র মুসলিম জাতি এতে ব্যথিত। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা, যা আমাদের সবাইকে সজাগ হতে বলছে। আমরা যদি আত্মহত্যার দৃঢ় সংকল্প না করে থাকি তা হলে সমস্ত ভুল শোধরানোর জন্য এখনই কোমর বেঁধে নামতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইসরাইলের এ ভয়ানক আগ্রাসন এমনি এমনি বন্ধ হওয়ার নয়। যতক্ষণ না মুসলিমবিশ্ব ইসরাইলের সামনে এ কথা প্রমাণ করতে পারে- আমরা এমন এক শিশাঢালা সুদৃঢ় প্রাচীর, যে-ই এর সাথে টক্কর লাগাতে আসবে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কথা বলা আর নয়, এখন সময় কাজের। আজ ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাস আর সিনাই উপত্যকা দখল করেছে কাল কায়রো দামেশক বাগদাদমুখী হবে। এরপর মুসলিমবিশ্বের কোনো অংশই আল্লাহর এই আযাব থেকে রক্ষা পাবে না। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের হেফাজত কর।
যদি এ পরাজয় আমাদের কঠোর পরিশ্রমী ও সংগ্রামী করে তোলে তা হলে এ পরাজয় কিছুই না। যদি আমরা সঠিক অর্থে মুসলমান হয়ে ঐক্যবদ্ধ হই তা হলে ইসরাইল কেন দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পাবে না।
মহান রবের দরবারে প্রার্থনা- তুমি আমাদের এ ধাক্কা সামলে ওঠার যোগ্যতা দাও। যে গুনাহর কারণে আমরা আজ এ লাঞ্ছনার শিকার তা ক্ষমা করে দাও। ভবিষ্যতে খাঁটি মুসলমান হয়ে বাতিল শক্তির মোকাবেলা করার সামর্থ্য দাও। আমাদের বিবাদ ও অনৈক্য বন্ধুত্ব ও ঐক্যে রূপান্তরিত করে দাও। দুইশত বছর ধরে ভাগ্য-বিড়ম্বনার শিকার এ জাতির মাথা আবার উঁচু করে দাও।
রক্তে লেখা ইতিহাস (মূল আরবি থেকে নির্বাচিত ১০টি টুকরো গল্প)
এক.
উজ্জ্বল সকাল। ¯িœগ্ধ আলোয় চকচক করছে শিশির ভেজা সবুজ গাছপালা। পাখির কলতানে চারপাশ মুখরিত। ছোট্ট আমাল চোখ মেললো পৃথিবীর বুকে তার সবচেয়ে প্রিয় মুখটা দেখার জন্য। যেনো অপেক্ষা করছিলেন এমন ভঙ্গিতে তখনই মা অনেকটা ঝুঁকে পড়ে তার কপালে চুমু খেলেন। আমালের ঘুমজড়ানো চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়লো ভূবনজয়ী হাসি। আমাল জানে, এই হাসিটা দেখার জন্য বাসার অন্য সবাইকে মা বারণ করে দিয়েছেন তার ঘুম ভাঙাতে। আমালও তা-ই চায়। মায়ের সুন্দর মুখটা দেখে দিন শুরু হওয়াটা কী যে দারুণ লাগে তার, কাউকে সে বোঝাতে পারবে না। হঠাৎ আমালের মনে পড়লো আজ তার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। নাশতা খেয়ে সে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো। এরপর বাবার সাথে চললো শহরের পথে।
কদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলো আমাল। ডাক্তার দেখে বললেন, সেরে গেছে প্রায়, আর তেমন সমস্যা নেই। তার বাবা নানানভাবে ডাক্তারকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন- আর কোনো সমস্যা আছে কি না। মনে প্রশান্তি এলে তবেই আমালকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুলেন তিনি। চললেন বাজারের দিকে, কিছু কেনাকাটা করা প্রয়োজন। বাবার বাজার করার ফাঁকে একটা রুমালে আমালের চোখ আটকে গেলো। ছোট্ট রুমালটায় ফিলিস্তিনের পতাকা আঁকা। আমাল বাবাকে ডাকলো- বাবা, বাবা, এই রুমালটা আমায় কিনে দাও। আমি এটা মাকে উপহার দেবো। কেনা হলো রুমালটি।
টুকটাক কেনাকাটা শেষে বাবা-মেয়ে বাজার থেকে বেরুতে উদ্যোগী হলো। এসময় হঠাৎ দখলদার ইসরাইলি সেনারা গুলি ছুড়তে শুরু করলো। আমাল দেখলো দুজন যুবক মাটিতে পড়ে মুহূর্তেই নিথর হয়ে গেলো। ভয়ে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। আতংকে রীতিমতো কাঁপছিলো আমাল। বাবার দু’ বাহু শক্ত করে ধরে সে বলতে থাকলো- বাবা, আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো… আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো। আমি বাড়ি যেতে চাই।
আমালের বাবা তাকে কোলে নিয়ে দু’ বাহুর আড়ালে প্রায় ঢেকে ফেললেন। দ্রুত ছুটলেন গাড়ির স্ট্যান্ডের দিকে, যেখান থেকে গাড়িগুলো তাদের গ্রামের দিকে ছুটে যায়। তবে ওদিকে বর্বর ইসরাইলিরা তাদের আগেই গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলো। আমালদের বাড়িটা ছিলো গ্রামের একেবারে মুখেই। আমালের মাকে তারা মেরে ফেললো, তিনি যখন বাড়িটা এখান থেকে তুলে নেয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন।
আমাল তার বাবার কোলে করেই গ্রামে ফিরলো, ততক্ষণে গ্রামের শত শত মানুষ তাদের বাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন। আমাল বাবার কোল থেকে নেমেই দৌড়ে উঠোনের দিকে এগুলো। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে থাকলো- এখানে কী হয়েছে? সবাই এখানে জড়ো হয়েছেন কেনো? আমার আম্মু কোথায়? কেউ তাকে জবাব দিলো না। বাবার দিকে ফিরলো আমাল, তার দু’ চোখে অশ্রুর বন্যা। দৌড়ে সে ঘরে ঢুকলো, পেছন থেকে বাবার বারণ আর গ্রামবাসীর ডাকাডাকি কিছুই শুনলো না। আমালকে আটকে রাখতে ব্যর্থ হলো সবাই।
আমাল ভেতরে ঢুকলো। যতোটা তীব্র গতিতে ঘরে ঢুকেছিলো ঠিক ততোটাই শীতল হয়ে গেলো সে মুহূর্তেই। হায় কী ভয়ানক দৃশ্য! আমাল দেখলো তার মা এলোমেলোভাবে মাটিতে পড়ে আছেন, শরীর থেকে বের হওয়া রক্তে ভেসে গেছে পুরো মেঝে। আমাল ছুটে গেলো মায়ের কাছটায়। চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো। মায়ের নিথর দেহ থেকে কোনো সাড়া সে পেলো না। মাথাটা আলতো করে কোলে নিয়ে আবার সে ডাকতে শুরু করলো- মা, মা- জেগে ওঠো প্লিজ। এই তো আমি এখানে। আমার কারণে হলেও একটু জেগে ওঠো। প্লিজ মা প্লিজ…।
আমালদের বাড়িজুড়ে বিষণœতা ভর করলো। কারো মুখ থেকে টু শব্দটি বেরুলো না। আমালের চিৎকার তখন উচ্চ থেকে উচ্চ স্তরে পৌঁছতে লাগলো। ছোট্ট শিশুর বুকে যেনো পাহাড়ের বোঝা চেপে বসেছে। রাগ-ক্ষোভ-কান্না-হতাশায় আমালের বাবার চোখ-মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো, কীভাবে কী হয়ে গেলো তিনি বুঝতেই পারলেন না। যেমন পারে না কোনো ফিলিস্তিনি। একেকটা সকালে এভাবেই তাদের সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে আমালের দিকে এগুলেন তিনি। পকেট থেকে একটু আগে কেনা রুমলটা বের করলেন। মেয়েকে টেনে মায়ের কাছ থেকে সরালেন। এরপর ছোট্ট রুমাল দিয়ে আমালের মায়ের চেহারাটা ঢেকে দিলেন। বাবা-মেয়ে এরপর ভেঙে পড়লেন করুণ কান্নায়। এতোক্ষণে বাবার সাড়া পেয়ে ছোট্ট আমালের চিৎকার আরো বেড়ে গেলো। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে শান্ত-সুখের ছোট্ট নীড়টা ধুলোয় মিশে গেলো!
দুই.
ফিলিস্তিনের অন্যান্য গ্রামের মতোই আমার গ্রামটি। এই গ্রামের মানুষগুলো খুব সহজ-সরল। ঘর-বাড়িগুলো ছিমছাম সাজানো-গোছানো। সবুজ বৃক্ষরাজি বড় মায়াজড়ানো। সেই ছোট্টটি থেকে আমি গ্রামটিকে অত্যন্ত ভালোবাসি। কোনোদিন এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে এমন কিছু আমি ভাবতেও পারি না। সকালে ঘুম থেকে জেগেই আমি গ্রাম দেখতে বেড়িয়ে পড়ি। প্রতিদিন। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় সবুজ প্রকৃতি সোনালি আভা ধারণ করে। মোরগের ডাক শুনি। এরপর মাদরাসায় যাই। সবমিলিয়ে আমি তৃপ্ত এবং প্রশান্ত এক ফিলিস্তিনি, আমার গ্রাম ও প্রকৃতি নিয়ে।
একদিন মাদরাসা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ নাকে বিষাক্ত গ্যাসের গন্ধ পেলাম। দখলদার বর্বর ইসরাইলের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় দৌড়ে বাসায় পৌঁছে বললাম পথে কী সব দেখে এসেছি। তখনই টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পেলাম সেই সন্ত্রাসবাদী ইসরাইলি নেতাটিকে, যার নাম কোনোভাবেই আমাকে আকর্ষণ করে না। তবু খুব মনোযোগী হয়ে খবরটায় চোখ রাখলাম। কারণ, এই খুনিটা বায়তুল মুকাদ্দাস পরিদর্শনে এসেছে। খবর পেয়েই ফিলিস্তিনের যুবকেরা আলআকসা পানে ছুট লাগালো, যেমন ছোটে দমকা হাওয়া। হাতে পাথরের টুকরো। এই সেই পাথর, যেগুলো না রোখা যায়, না ধ্বংস করা যায়। ইসরাইলি নরপিশাচগুলো তৎপর রইলো যে-কোনো সময় বিষাক্ত গ্যাস ও গুলি ছোড়ার কাজে।
আলআকসায় পৌঁছার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। ফিলিস্তিনিদের কাজে যেতেও বারণ করা হলো। এমনিতেই অর্থসংকটে ভুগতে থাকা ফিলিস্তিনিরা আরো একবার সংকটের মুখে পড়লেন। একদিন কাজ করতে না পারা মানে সেদিনের খোরাকি থেকে বঞ্চিত থাকা। ঘরে রুটি-ডাল না আসা। এমন এক অবস্থায় আমরা জীবন কাটাই, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সারাক্ষণ-সর্বত্র ভয় ও শংকা। কতোবার যে আমাদের মাদরাসা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো, কতোবার যে বিষাক্ত গ্যাস ছোড়া হলো- তার হিসেব কে রাখে? আমাদের বাবা-মায়েরা ঘরে প্রায় বন্দী থাকেন। কখন দরজা খুলে বেরুনো যাবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমাদের ভাইদের ধরে ধরে ইসরাইলি কারাগারে আটকে রাখা হয়, বলা ভালো তাদের মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়া হয়। যা-ই হোক, আমি বসা থেকে উঠলাম, কী একটা প্রয়োজন সারতে। হঠাৎ বিকট আওয়াজ কানে এলো। গ্রামের বিভিন্ন দিক থেকে আওয়াজ আসতে শুরু করলো। ভাবলাম আতশবাজির আওয়াজ আসছে। প্রয়োজন সেরে দ্রুত বেরিয়ে পড়তে উদ্যত হলাম। এসময় হঠাৎ আওয়াজ আসতে শুরু করলো, চারদিক থেকে লাগাতার। মনে হলো বাসার খুব কাছেই আওয়াজ হচ্ছে। দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিলাম। টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় চারপাশ ছেয়ে যেতে দেখলাম। সাথে সাথে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর শত্রুদের ছুটোছুটি আরো বেড়ে যেতে দেখলাম। সাথে পাথর ছোড়াও তীব্রতর হলো। আমাদের গাঁয়ের ছেলেরা পাথর হাতে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে গেলো।
এভাবেই বেঁচে আছি, আমরা জলপাই-তেলের যুবকেরা। লেবুবাগানের সন্তানেরা। প্রতিনিয়ত আমরা এমন জুলুম-শোষণের মধ্য দিয়েই দিন গুজরান করছি। এসব ঘটনা এখন ফিলিস্তিনের সর্বত্র ঘটছে। প্রতিদিন। হৃদয়হীন ইসরাইলিদের জন্য এসব যেনো পানিভাতে পরিণত হয়েছে, আরো রূঢ় ও নৃশংসভাবে ফিলিস্তিনিদের উপর নিপীড়ন চালাবার জন্য এরা সদা তৎপর। যেমন ছোবলের জন্য মুখ হা করে রাখে সর্পরাজ।
এই আমার গল্প- হ্যাঁ গল্পই। হতাশা, বেদনা আর তীব্র কষ্টের; আমরা ফিলিস্তিনিরা যেসবের মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রান্ত করছি। দিন যায়। মাস পেরোয়। বছর শেষ হয়। একটি কথার পর দ্বিতীয় কথার পালা আসে। একজন শিশুর পর আরেকজন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। একজন বীরের পর আর একজন বীর শাহাদাত বরণ করে। এভাবেই, একটি গণঅভ্যুত্থান বা ইনতিফদার পর আরেকটি ইনতিফদা শুরু হয়ে যায়। আর আমরা অসহায় ফিলিস্তিনিরা এসবের পালাচক্রে আটকে দিনমান কেবল ছুটতে থাকি। ছুটতেই থাকি। মুক্তি যে নেই!
তিন .
সাবের দ্রুত বাড়ি ফিরতে চাইছিলো। দিনের দীর্ঘ সময় সে কেবল মায়ের কথাই উচ্চারণ করতো যে, মা বলেন- দ্রুত বাড়ি ফিরে এসো। কাজ সেরেই চলে আসবে, বিন্দ্রমাত্র দেরি করবে না। সাবের তাড়াহুড়ো করেই হাতের কাজ সাড়লো এবং মায়ের মুখ দর্শনের জন্য বাড়ির পথ ধরলো। মায়ের সাথে কথা শেষে যথারীতি ক্লান্ত শরীর বিছিয়ে দিলো নিজের প্রিয় খাটে। সাবের প্রতিবেলার খাবার মা-বাবার সাথেই খায়। বছর দুই আগে ইসরাইলি বর্বরতায় পঙ্গুত্ব-বরণ-করা তার বাবা প্রতিবেলায় ছেলেকে সামনে দেখতে চান। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজকাল তিনি বড় বেশি চিন্তিত। খাটের পাশে রাখা রেডিওতে সারাদিন খবর শোনেন, খারাপ কিছু কানে এলে সাথে সাথে ছেলেকে ঘরে ডেকে পাঠান। সাবের বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত চরম উদ্বিগ্নতায় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে যেতে থাকে তার চেহারার।
তবে সাবের, অল্প বয়সেই যার কাঁধে একদিকে বাবা-মায়ের দেখাশোনা আবার দিনান্তে তাদের জন্য দু’ লোকমা খাবার জোটানোর দায়িত্ব চেপেছে, বাবা-মায়ের সাথে সে প্রায়ই আলাপ করতো ইনতিফাদায় অংশ নেয়া যুবকদের বীরত্বের কথা। তাদের অসীম সাহসী কীর্তি-কলাপগুলো যদিও সে খুব ভালো করেই জানতো- মা-বাবা চান না সে ইনতিফাদায় জড়াক। তার মন বড় আনচান করতো ইনতিফাদায় অংশ নিতে। বর্বর ইসরাইলিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। সাবের ইনতিফাদায় অংশ-নেয়া-যুবকদের কথা বলতেই থাকতো। আর সুযোগ পেলেই ইসরাইল-বিরোধী কোনো-না-কোনো তৎপরতায় অংশ নিতো। ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে তার মন উত্তপ্ত হয়ে থাকতো ক্রোধ আর ক্ষোভে, যারা খুন-অপহরণ আর ধ্বংস ছাড়া কিছু জানে না।
সাবের ধীরে ধীরে বিলম্ব করে বাড়ি ফেরা শুরু করলো। একমাত্র সন্তান হিসেবে সাবেরের মায়ের মনে ভয়ও বেড়ে যেতে থাকলো। কারণ এমন সময় ছেলের চলাফেরা অদ্ভুত হতে শুরু করলো, যখন নাকি স্বপ্নটা কেবল বাস্তব হতে শুরু করেছে। সেই স্বপ্ন যা থাকে প্রতিটা বাবা-মায়ের। ছেলে বড় হয়ে পরিবারের হাল ধরবে। তাদের পরিবারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বেশি বাস্তব। সাবেরের মা বয়সের ভারে নুব্জ, বাবা পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন প্রায় দুই বছর।
একদিন ঠিকই সাবের সিদ্ধান্তটা পাকা করে ফেললো। খুনি ইসরাইলিরাই এখন তার একমাত্র টার্গেট। ইসরাইলিদের গোলাগুলি রুখে দেয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের যেগুলো বিন্দুমাত্র রেহাই দেয় না। এরপর যা হওয়ার তা-ই হলো। লড়াইয়ের কোনো এক উত্তাল দিনে সাবেরও ইসরাইলি নরপিশাচদের গুলিতে আক্রান্ত হলো। তীব্র ব্যথায় গুঙিয়ে-কঁকিয়ে উঠে মাটিতে পড়ে গেলো সে। সাবেরের পঙ্গু বাবার মাথায় রীতিমতো যেনো বাজ পড়লো। বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধ। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, আহত ছেলের সাথে সাথে তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা লাগলো।
কিছুটা সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলো সাবের। গায়ে বল ফিরে পেতেই আবার ইনতিফাদায় যোগ দিলো সাবের। এক রাতে শত্রুপক্ষের হাতে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত টানা চললো তার লড়াই। সাবেরের মায়ের আশংকা অল্প ক’দিনের মাথায় এসে বাস্তব হয়ে ধরা দিলো। ঘুম থেকে জেগে সে রাতে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আবিষ্কার করলেন- ইসরাইলি সেনারা তাদের ছেলেকে ধরতে চারপাশ থেকে বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।
ইসরাইলি আদালতে তিন বছরের জেল হলো সাবেরের। অসহায় বাবা-মা চেয়ে রইলেন একমাত্র সন্তানের ফিরে আসার পথে। ফিলিস্তিনের বুকে এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটে। সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকে রাতের আঁধার নেমে আসা পর্যন্ত চলে নিষ্ঠুর বর্বরতা। রাতেই কি রেহাই মেলে?… প্রতিটা মুহূর্তই যেনো ওরা ফিলিস্তিনিদের গিলে খেতে চায়।
দারুণ পৃথিবীর নিদারুণ মানব-কারাগার আমাদের এই দেশ। ফিলিস্তিন।
চার.
আমি পবিত্র ভূমির এক শিশু। আমি সুউচ্চ যাইতুন বৃক্ষের ডাল বহনকারী এক শিশু। আমি মহানবীর ইসরা ও মেরাজের স্মৃতিবিজড়িত ভূখ-ের শিশু। আমি সেই বরকতময় পাথর বহনকারী শিশু, যা দখলদার বর্বর রাষ্ট্রের সব প্রতিপত্তি রুখে দিতে সক্ষম।
এখনো চিনতে পারলেন না তো? শুনুন তবে আমার পরিচয়-
‘যাইতুনের ডাল আর জমিনের পাথরগুলোতে খোদাই করা আমার নাম।
আমার জন্ম এমন ভূখ-ে, হিং¯্র দানবেরা যাকে মমতায় আগলে রাখে
আমার জন্ম তো এমন দিনে, পবিত্র এই ভূমির নামে যেদিন ইনতিফাদা শুরু হয়েছিলো
আমার জীবন শুরু হলো, পরাধীন এই দেশ থেকে যেদিন গৃহহারা হতে থাকলো মানুষ…’।
এবার চিনতে পারলেন- আমি কে? আপনাদের একটু কি মনে পড়লো আমি আর আমার মতো শিশু-কিশোরদের দুর্দশা? বুঝতে পারলেন ঠিক কোন্ দেশটি আমার?
পাঁচ.
আম্মুর গলা শোনা গেলো। আমাকেই ডাকছেন। জান আমার, তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে নাও। তোমার ফুফাতো বোন সালওয়ার বাসায় যাবো। আম্মুর কথা শুনে আমি তো খুশিতে আত্মহারা। কতোদিন পর সালওয়া আপুর বাসায় যাবো! পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে ছোট বোন ও আম্মুর সাথে সালওয়া আপুর বাসার পথে রওয়ানা দিলাম।
খুব দূরে নয় আপুর বাসা, কিছুক্ষণেই পৌঁছে গেলাম। সামনে থাকায় আমিই দরজার কড়া নাড়লাম। দরজা খুলে আমাকে দেখে আপুরা তো অবাক! আহ্বানে-আনন্দে-মুগ্ধতায়-তৃপ্তিতে তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমাদেরও। সোফায় বসে হাসি-আনন্দ-গল্পে মেতে উঠলাম সবাই। সালওয়া আপুর পরীর মতো একটা মেয়ে হয়েছে। ওদিকে ফুফাতো ভাইয়েরও বিয়ে হতে যাচ্ছে। কতোসব পারিবারিক বিষয় এক এক করে উঠে আসতে লাগলো। এমন দারুণ মুহূর্তে হঠাৎ আমরা বোমা ফাটার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কাছেই কোথাও বোমা ছুড়েছে বর্বর ইসরাইলিরা। সাথে সাথে গোলাগুলিও শুরু হলো। আপুর চেহারার রঙ মুহূর্তেই বদলে যেতে দেখলাম। চারদিক থেকে সমানে নারী-পুরুষ-শিশুর চিৎকার ভেসে আসছিলো। আপুও হঠাৎ যেনো সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন- জলদি ভেতর ঘরে প্রবেশ করো। জলদি এসো। লুকাও। ওখান থেকে সরে এসো।
জলদি! আমরা দৌড়ে ভেতর ঘরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু সুরাইয়া দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ মেঝেতে পড়ে গেলো। হায় খোদা, জানালা দিয়ে ছুটে আসা একটা বুলেট ওকে মাটিতে আছড়ে ফেললো। সালওয়া আপু আবার চিৎকার করে ওঠলেন- সবাই এসো। মাটির নিচের বাংকারে ঢুকে পড়ো। জলদি যাও! জলদি যাও! দু’ মিনিটের মধ্যে নিজেদের সবাইকে আমরা মাটির নিচের সংকীর্ণ একটা কামরায় আবিষ্কার করলাম। কাঁচা মেঝে। নেই কোনো বিছানা বা আসবাব। ভয় ও আতংকে রীতিমতো বরফ হয়ে বাংকারটায় আমরা সিঁটিয়ে রইলাম। বোমা ও গোলাগুলির আওয়াজ সমানতালে শোনা যাচ্ছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সালওয়া আপুর একতলা বাড়িটি। আমার মনে তখন বারবার উঁকি দিয়ে যেতে থাকলো- হায় খোদা, আমাদের সাথে এই কি তুমি চাও? এও কি কোনো কথা যে বর্বর ইসরাইলিদের দ্বারা আল্লাহ আমাদের শাস্তি দেবেন? পরক্ষণেই মনে হলো- কী চরম বাজে চিন্তা আমি করছি। ভয় বা যে কারণেই হোক, একজন মুমিনের হৃদয়ে এসব চিন্তা কীভাবে আসতে পারে?
সাথে সাথে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলাম। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের প্রতি রহম করুন। আমাদের প্রতি আপনি দয়াশীল হোন।
আতংকে সালওয়া আপুর বাচ্চাগুলোর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো ওরা। আপু প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে থাকলেন তাদের কান্না থামাতে। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা এভাবে কাঁদলো। আধা ঘণ্টা তো নয় যেনো অর্ধযুগ। আল্লাহর শোকর। গোলাগুলি অবশেষে বন্ধ হলো। এবার অন্তত এই অসহ্য গুহা থেকে বের হই। আতংকে এতোক্ষণ সেভাবে টের না পেলেও গোলাগুলি থেমে এলে আর এক মুহূর্তও সেখানে অবস্থার করা সম্ভব হয়ে উঠছিলো না।
আমরা উপরে উঠে এলাম। আপাতত গুলি-বোমার কোনো আওয়াজ শোনা না গেলেও কোনো নিশ্চয়তা নেই- আবার যে-কোনো সময় তা শুরু হবে। তাই এবার শোবার ঘরে আশ্রয় নিলাম। ভেতরের দিকে হওয়ায় এ ঘরটাই তুলনামূলক বেশি নিরাপদ। সবাই চেষ্টা করছিলো আতংক কাটিয়ে একটু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে। নইলে যে হার্টবিট বন্ধ হয়ে এমনিতেই মরতে হবে। সালওয়া আপুর ননদ সুরাইয়া আপু তখনো বসার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। আতংকে তার কথা ততক্ষণে আর মনেও রইলো না। একটু স্বাভাবিক হয়ে সবাই টুকটাক কথা বলতে শুরু করলো। তবে স্বাভাবিকভাবেই এবারের কথাগুলো আর আনন্দের রইলো না। পরিণত হলো শোক আর হতাশার। আতংক যেনো বুক ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। সুরাইয়া আপুর কথা মনে করে সালওয়া আপু কেঁদে ফেললেন। বাড়ির চারপাশে তখন কেবল একটাই গুঞ্জন- কতোজন শহীদ হলো। কতোজন পঙ্গুত্ব বরণ করলো। কে কে বন্দী হলো। ঘর-বাড়ি ধ্বংস হলো কতোজনের।
এসব আলোচনাই আমাদের মুখে ঘুরে ফিরছিলো আর আমি ভাবছিলাম- আয় আল্লাহ, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমাদের আলোচনা কেমন বেদনাময়-রুক্ষ-শুষ্ক আর হতাশার হয়ে গেলো! এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আমার ভাই এসে উপস্থিত হলো আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। আল্লাহর শোকর আদায় করলাম- আলহামদু লিল্লাহ।
বাসায় ফিরলাম। ফেরার পথের আলোচনাটাও স্বাভাবিক কারণেই যাওয়ার পথের মতো খুশির না হয়ে তিক্ততার হলো। বাসায় ফিরেই সোজা জায়নামাযে দাঁড়ালাম। রাব্বে কারিমের কাছে শোকরিয়া আদায় করলাম- আমরা এবং আমাদের ঘরবাড়ি এখনো নিরাপদ আছে বলে। অল্পতেই এবারকার বিপদ কেটে গেছে বলে। আল্লাহর দরবারে মুক্তি চাইলাম এই পরাধীনতা এবং জাহান্নামে পরিণত হওয়া প্রিয় মাতৃভূমির দুঃসহ দুরবস্থা থেকে।
আমাদের উপর বর্বর ইসরাইলিদের দখলদারির স্বরূপ হলো কুৎসিত চেহারার দৈত্যের মতো। এমন ভয়ানক দৈত্য- জীবন উৎসর্গকারীদের মাথার খুলি হলো এর দস্তরখান। শহীদের রক্ত এদের পানীয়। নির্যাতিত জনতার গায়ের চামড়া এদের পোশাক। এতিম-বিধবাদের কান্না এদের বিনোদন। মৃত মানুষ আর শহীদের লাশে ঢাকা নতুন নতুন আকাশ বানানো এর শখ ও তৃপ্তি।
ছয়.
আহলাম শান্ত-শিষ্ট ও ঠা-া মেজাজের একজন ছাত্রী। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে সে। শিক্ষিকা ও বান্ধবীদের কাছে আহলাম খুবই প্রিয়। মেধাবী ছাত্রী হওয়ার পাশাপাশি সে সবাইকে অত্যন্ত সম্মান করে। কয়েক মুহূর্তে যে-কাউকে আপন করে নেওয়ার দারুণ ক্ষমতা আছে আহলামের। ভবিষ্যতের জন্য হৃদয়ে সে দারুণ সব স্বপ্ন লালন করে। আসছে জীবনকে ঘিরে দেখা রঙিন ছবিগুলো তার চারপাশকে সারাক্ষণ সুরভিত করে রাখে।
একদিন ভোরে আহলাম স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। বই-পত্র ও ব্যাগ গুছিয়ে সে বাবার কাছে গেলো ভাড়া চাইতে। হায় কী দুঃসময়। মেয়ে স্কুলে যাওয়ার ভাড়া চাইছে অথচ বাবা তা দিতে পারছেন না। মেয়েকে বলার মতো কোনো কথাও তিনি খুঁজে পান না। কিছু একটা বলতে চান কিন্তু জিহ্বাটা মুখের ভেতর কে যেনো আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। আহলাম ব্যাপারটা বুঝলো এবং হাসিমুখেই সে মেনে নিলো। বাবাকে সে বললো- বাবা, চিন্তার কিছু নেই। গতকালের ভাড়া থেকে কিছু মনে হয় এখনো আমার ব্যাগে রয়ে গেছে, ওতেই আজ আমার চলে যাবে। আজ আর ভাড়া দিতে হবে না। আহলাম ব্যাগ কাঁধে স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে যায় অথচ তার কাছে ভাড়া কেনো একটা কানাকড়িও নেই। আর তার বাবা নির্বাক হয়ে বাসায় বসে থাকেন। মেয়ে যাই বলুক- তিনি তো জানেন গত দু সপ্তাহ ধরে মেয়েকে তিনি ভাড়া দিতে পারছেন না। এতোদূরের স্কুলে মেয়েটা হেঁটে হেঁটেই যায় উল্টো কিনা বাবাকে সান্ত¡না দেয়! কী অবলীলায় মেয়েটা বলে গেলো গতকালের ভাড়া থেকে বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে আজ চলে যাবে! তার মনে বারবার কথাটা বেজে উঠতে থাকে- ছোট্ট মেয়েটা কী অল্পতেই কতো বড় হয়ে গেলো। নিজের মন খারাপ অবস্থা নিয়েও বাবাকে সান্ত¡না দিতে আসে!
আহলাম স্কুলে পৌঁছলো। বান্ধবীদের সাথে গিয়ে বসলো, যারা ভয়ে রীতিমতো সিঁটিয়ে আছে। ম্যাডামের দেয়া গণিতের হোমওয়ার্ক আজও কেউ করতে পারে নি। মন খারাপের অবস্থায়ও বান্ধবীদের এই অর্থহীন অস্থিরতা দেখে আহলামের হাসি পেলো। ওদের এই ভয়টা যদি বাসায়ও থাকতো তা হলে তো হোমওয়ার্কটা ঠিকই করে নিয়ে আসতো। শাস্তিটাও পেতে হতো না। অবশ্য হোমওয়ার্ক মিস করা ছাত্রীর সংখ্যা অনেক হয়ে গেলে ম্যাডাম মাঝে মধ্যে ক্ষমাও করে দেন। বান্ধবীদের সে তাই আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দিলো। শিশুদের সকালের ক্লাসের পর্ব শেষ হওয়ার পর আহলাম ও তার বান্ধবীরা ক্লাসে প্রবেশ করলো। ম্যাডামের উপস্থিত হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলো তারা সবাই। ম্যাডাম একটু পরই ক্লাসে প্রবেশ করলেন। আহলাম দেখলো ভয়ে পাশে-বসা বান্ধবীদের মুখগুলো ফ্যাকাশে হয়ে আছে। ম্যাডাম অবশ্য আজ আর হোমওয়ার্কের কথা জিজ্ঞেস করলেন না। ছাত্রীদের চেহারা দেখে তিনি হয়তো ব্যাপারটা ঠিকই অনুমান করে নিয়েছেন।
ক্লাস শেষে আহলাম বাড়ি ফিরলো। পেটে প্রচ- ক্ষুধা তার। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছুই খাওয়া হয় নি। ব্যাগটা কাঁধ থেকে রেখেই সে মাকে জিজ্ঞেস করলো- আজ কী রান্না করলে মা? মলিন মুখে মা তাকে সাজিয়ে রাখা পাতিলগুলো দেখিয়ে বললেন- এগুলোতে গতকালের খাবার রয়ে গেছে। তুমি তোমার বাবা এবং ভাইদের সাথে ভাগ করে খেয়ে নাও।… আর তুমি? তুমি কী খাবে, মা? আহলাম ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে। মা তার বলেন- বাড়তি রুটি দিয়ে আমি নিজের ক্ষুধা মিটিয়ে নেবো। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না মা আমার। এখন যাও, তোমরা জলদি খেয়ে নাও।
আহলামদের পারিবারিক অবস্থা আজকাল এভাবেই অতিক্রান্ত হচ্ছে, যেদিন থেকে তার বাবা কাজে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন। তাদের বাড়িতে কখনো বাড়তি রুটি থাকতো না। আটার বস্তাও নয়। আর আটার বস্তা থাকলেই-বা কি? তিন সপ্তাহ থেকে গ্যাসের চুলা জ্বলছে না, পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে। কাঠ আর আগুন ছাড়া রান্না করা খাবার গরম করার কোনো উপায় নেই। দুই দিন এমনকি তিন দিন আগের খাবারও কোনোরকম একটু গরম করে তাদের খেতে হচ্ছে।
খাবার রেডি করতে গিয়ে আল্লাহর কথা মনে পড়ে অসহায় নিবেদন আর অভিমানে আহলামের কান্না চলে এলো। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে সে বললো- হায় খোদা, আপনি কি দেখছেন আমাদের দুরবস্থা!
দু’ দিন পর আহলাম স্কুল থেকে ফিরে দেখলো দরজার পাশে আটার বস্তা রাখা। তার চেহারা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মায়ের কাছে ঘটনার রহস্য জানতে চাইলো আহলাম- কোত্থেকে কীভাবে বস্তাটা এলো। তার মা জানালেন- একজন রহমদিল মানুষ এটা তাদের জন্য হাদিয়া পাঠিয়েছেন। আকাশের দিকে চেয়ে আহলাম অস্ফুট স্বরে বলে ফেললো- হায় আমার প্রভু, আমার বাবা যখন কাজে যেতে পারতেন, কারো কাছে আমাদের হাত পাততে হতো না। আমরা বরং অন্যদের দান করতাম। এখন তারাও খেতে পায় না আমরাও না। মৃত্যু এবং ক্ষুধার কাছে আমরা হেরে যাচ্ছি। এমন আটার বস্তাটা তো বড়জোর এক বা দু সপ্তাহ চলবে এরপর কী হবে? ফিলিস্তিনিরা কি তখন আবার কারো দানের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে? নাকি পাকস্থলি থেকে উঠে আসা ক্ষুধার অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাবার অপেক্ষা করবে? রহম করো খোদা, কবে শেষ হবে আমাদের দুর্দিন?
সাত.
নভেম্বর মাসের শীতের এক রাত, নীরবপ্রকৃতির আবেশে সবাই তখন ঘুমিয়ে আছে। আমি আমার খাটের উপর বসা। আজই শুরু-করা একটা বই পড়ছিলাম। রাত তখন বারোটা। মা আর আমার ভাইয়েরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তবে বাবা যথারীতি সজাগ ছিলেন। একজন ডাক্তার হিসেবে নিজের কাজের প্রশ্নে তিনি খুবই সিরিয়াস। যে-কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য সবসময় প্রস্তুত রাখতেন নিজেকে, খুব কমই তাকে ঘুমুতে দেখা যায়। আমি খুবই মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ছিলাম। এসময় একধরনের মৃদু আওয়াজ শুনলাম। মনে হলো বিশেষপ্রকৃতির হেলিকপ্টার বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে গেলো। ইতোপূর্বে এ ধরনের আওয়াজ শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তবে যেমন বলা হয়- মুমিনের হৃদয়ই তার দলিল; অনুভব করলাম, নতুন এই যান হয়তো নতুন কোনো বিপদেরই দুঃসংবাদবাহী।
দ্রুত আমি খাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম এবং জানালার দিকে ছুটে গেলাম। রাতের আকাশ অন্ধকারে ঢাকা থাকলেও উজ্জ্বল চাঁদের কারণে অনেক কিছুই দেখা যায়। তবে কোথাও আমি হেলিকপ্টারটির দেখা পেলাম না। আমার হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠলো। রাতের আঁধারে এভাবে কোনো হেলিকপ্টারের ঘুরাফেরা মানেই তো শহরে আক্রমণের প্রস্তুতি। কিন্তু, কেনো? এই মুহূর্তে হামলা করার কোনো কারণ তো দেখছি না। অবশ্য ইসরাইলি বর্বর পশুদের হামলে পড়ার জন্য সময় বা কোনো কারণের দরকার হয় না। আরো গভীরভাবে আমি দেখার চেষ্টা করলাম, পারলাম না অন্ধকারের প্রাবল্যে। খুঁজতে চেষ্টা করলাম- এই মুহূর্তে হামলার কী কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আফসোস, পরক্ষণেই দেখলাম প্রায় শব্দহীন সেই হেলিকপ্টারের পেট থেকে কালো একটা বস্তু বেরিয়েই নিচের শহরের দিকে ছুটে আসতে লাগলো।
হায় আল্লাহ, এসব হচ্ছেটা কী! পাগলের মতো আমি চিৎকার করতে শুরু করলাম- মা, সায়িদ, আহমাদ…সায়িদ, মা, আহমাদ, জলদি ওঠো। জলদি করো। ওঠো, ওরা আমাদের শহর আক্রমণ করেছে। ওঠো। চিৎকার করে মা ও ভাইদের জাগিয়ে দিলাম। সেই কয়েকটি মুহূর্ত আমি জীবনেও ভুলবো না। ভয়ে আমি কুঁকড়ে গিয়েছিলাম, ভীষণরকম ভয়। হ্যাঁ, ভীষণ ও মারাত্মক ভয়। এর পরপরই প্রথম বোমা বিস্ফোরণের তীব্র আওয়াজে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হলো। তৎক্ষণাৎ আমরা বেডরুম থেকে ছুটে পাতালকক্ষে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আমার ডাক্তার বাবা ছুটলেন আক্রান্ত এলাকার দিকে, নিজের দায়িত্ব পালন করতে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে এলো। এরপর তৃতীয়, এরপর… এরপর সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ হয়ে এলো। নিঝুম নীরবতা। কিন্তু সব নীরবতাই কি শান্তি ও স্বস্তির বার্তা বহন করে? অন্তত এই মুহূর্তে নীরবতা তো কিছুতেই সে অর্থ বহন করে না।
বর্বর ইসরাইলিদের আরো একটি নৃশংস আক্রমণ শেষ হলো। ড্রোন ও হেলিকপ্টারগুলোও আকাশ ছেড়ে গা ঢাকা দিলো। আর কোনো আওয়াজ আমরা শুনতে পেলাম না। বাবাকে দেখতে ছুটে গেলাম। ডাক্তার হলে কি, তিনিও তো আক্রান্ত হতে পারেন। বাবাকে নিরাপদ দেখে মন প্রশান্ত হলো। তবে আমাকে দেখে তিনি বললেন, রিনা, এখন চলে যাও। পরে দেখা হবে। এখানে খুবই ভয়াবহ অবস্থা।
বাবার মুখ থেকে যেমন শুনলাম অবস্থা তার চেয়ে ভালো ছিলো না কোনোভাবেই। বিদ্যুতের গতিতে সারা শহরে খবর ছড়িয়ে পড়লো- এখানে এক লোক মারাত্মক জখম হয়েছেন। দ্বিতীয় বোমাটা আহমাদ হাসান নামের আরেকজনের বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আমার মামার বন্ধু তিনি, কিছুদিন আমাদের বাসাতেও ছিলেন। আরেকজনের পুরো পা-ই বোমার আঘাতে উড়ে গেছে। এতোসব দুঃসংবাদ শুনে প্রথমদিকে আমরা ভড়কে গেলাম। এরপর, এরপর আশ্চর্য নীরবতায় ছেয়ে গেলো পুরো শহর। শোক-ক্ষোভ-বিস্ময়ের তীব্রতায় কারো মুখে কথা ফুটলো না। নীরবতাও কী ভয়ংকর হতে পার ভেবে শিউরে উঠলাম আমি। কেমন লাগবে ভাবুন তো- একটা শহরবাসীর উপর রাতের অন্ধকারে এমন ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এলো তারা যেটার কল্পনাও করতে পারছিলো না। হায় বিপদ! সমবয়েসী কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কেনো এতো দুঃখিত রিনা, তোমার কাছের কেউ তো মারা যায় নি বা জখমও হয় নি?
অবাক ভাবটা চেপে রেখেই বললাম, ছোট্ট একটা শহরে আমরা তো একটা পরিবারের মতোই মিলেমিশে বাস করি। সবাই সবাইকে চেনে। কারো কারো মধ্যে বা কিছু মানুষের মতভিন্নতা বা বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু কারো বিপদে তো কেউ পিছনে বসে থাকে না। শহর আক্রান্ত হলে তো সবাই আবার হাতে হাত মিলিয়ে ছুটে আসে। এভাবেই তো আমরা একটা পরিবারে পরিণত হয়ে যাই। তোমার পরিবারের কেউ আহত হলে তুমি কষ্ট পাও না? এখানে একটা লোক পুরো পা হারিয়ে অসহায় পঙ্গুত্ব বরণ করলো তাতে কষ্ট পাওয়ায় অবাক হওয়ার তো কিছু দেখছি না। আসলে প্রতিমুহূর্তে আমাদের দেশে এতো বেশি নিষ্ঠুরতা চলে যে, মানুষ কান্নারও সুযোগ পায় না। কতো কাঁদবে, কজনের জন্য কাঁদবে?
আব্বু বাসায় ফিরলেন রাত আড়াইটারও পর। আমরা তাকে পা হারানো আংকেলের খবর জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, খুবই খারাপ অবস্থা। এমন ভয়াবহ কেসের সামনে জীবনে এই প্রথম পড়লাম আমি। তার জখম খুবই মারাত্মক… এরপর বাবাও আর কিছু বললেন না বা বলতে পারলেন না।
রাত চারটা সাড়ে চারটা নাগাদ শহরবাসী যার যার ঘরমুখো হলেন। আমি তখনও জেগে। কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। আমার ঘরের একমাত্র জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। পূর্বমুখী জানালাটায় দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম শেষ রাতের আঁধার ভেদ করে সূর্য ওঠছে। ধীরে ধীরে পূর্বাকাশ পুরোটা আলোকিত হতে থাকলো। আশ্চর্য উজ্জ্বল আলোয় ¯œাত হতে শুরু করলো পৃথিবী।
অবাক হয়ে ভাবছিলাম- আজকের সূর্য কি একটু বেশি উজ্জ্বল, একটু বেশি তেজসম্পন্ন? প্রতিদিন ভোরে সূর্য উঠবে, পৃথিবীকে আলোকিত করবে- সূর্যের কাছে মানুষের এইটুকুই তো সাধারণ আশাবাদ। তবে নতুন একটা দিনের সূচনা মানুষের মনোজগতে দারুণ আমেজ নিয়ে হাজির হয়। ফলে কাজ-বিষয়-ভাবনা খুব সহজ হয়ে যায়। গল্প-উপন্যাসসহ বিভিন্ন বইপত্রে আমি এমন পড়েছি। তবে আজকের সূর্যোদয়টা কেবল নতুন একটা দিনের সূচনা ছাড়া অমার কাছে কিছু মনে হলো না। যেই দিনটি মোড়ানো কষ্টে, মনোযাতনায়, নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসে। এমন দিন, যেটিতে নতুন করে আমার মনে ভয় জেগে উঠেছে, পুরনো সেই ভয়। একবার এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে যার শেষ হওয়ার কোনো খবর থাকে না। যেদিন বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যান, নিঃস্ব-অসহায় অবস্থায় সারাদিন আমাকে ঘরে পড়ে তড়পাতে হয়। প্রতিটি মুহূর্ত তীব্র আতংক বোধ করি এই বুঝি খবর এলো বাবা আর ঘরে ফিরবেন না। কোথাও কোনো চিৎকার শোনা গেলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সকালে, স্কুলের ড্রেস পরে রওয়ানা হয়ে গেলাম। স্কুলে যাওয়ার পথেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত একটি ভবন দেখতে পেলাম। হায় আল্লাহ, কী ভয়ংকর দৃশ্য। জানালাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। দেয়ালগুলো মাটির সাথে মিশে গেছে প্রায়। দরজাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে অছে। হায়, চমৎকার বাড়িটির কী বীভৎস পরিণতি!
বিধ্বস্ত মন নিয়ে স্কুলের পথে এগিয়ে চললাম। চারপাশ থেকে কানে যা আওয়াজ এলো সবই বিগত রাতের সব ভয়াবহতা নিয়ে। বিধ্বস্ত বাড়ি, আক্রান্ত ও হতাহত মানুষজন। প্রথম ক্লাসটা কোনোরকমে শেষ হলো। এলো দ্বিতীয় ক্লাসের পালা। আরবিভাষার ক্লাস। তবে আরবি ক্লাসের শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা আজ আসেন নি। পা হারানো লোকটি তার স্বামীর খুব কাছের বন্ধু। আরো একবার আমাদের মনে বিষাদ ছেয়ে গেলো। দুদিন পর আমাদের প্রিয় ম্যাডাম ক্লাসে এলেন। মলিন মুখ, একটু কেমন অবিন্যস্ত ও অনভ্যস্ত চলাফেরা সহজেই চোখে পড়ে।
বোঝাই যাচ্ছিলো কিছুতেই তিনি ঠিকমতো মনোনিবেশ করতে পারছেন না। আমরা পুরো ব্যাপারটা শুনতে চাইলাম। তিনি বললেন, হেলিকপ্টারের মৃদু আওয়াজ যখন কানে এলো, আমরা তখন ঘুমুবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না। কারণ এমন তো নয় যে, এই প্রথম সালফিতে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এর পরপরই বোমা ফাটার বিকট আওয়াজ হলো। প্রথমবারই ওরা ফিলিস্তিন স্বাধীনতা আন্দোলনের সালফিত অফিসে আক্রমণ করলো। দ্বিতীয় আক্রমণ ছিলো আমার স্বামীর বন্ধুর বাড়িতে। আমরা তার স্ত্রীর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। সাথে সাথে আমরা তাদের বাড়িতে ছুটে গেলাম। আমাদের বাড়ির ঠিক পরের বাড়িটাই তাদের, মাঝে শুধু একটা সংযোগ সড়কের দূরত্ব। অনেক কষ্টে ঘরে ঢুকতে পারলাম। কারণ বোমার আঘাতে দরজা এতোটাই বেঁকে গিয়েছিলো যে, সহজে ঢোকার কোনো উপায় ছিলো না। অবশেষে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম।
আমি দ্রুত ভাবীর কাছে গেলাম এবং দুজনে মিলে ভয়ে কাঁদতে থাকা বাচ্চাদের সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। আর আমার স্বামী ভেতরে গেলেন বন্ধুকে উদ্ধার করতে। আমিও একটু পর তার সাথে যোগ দিলাম। আমার স্বামী ভেতরের রুমে গিয়ে অন্ধাকারেই বন্ধুর অবস্থা অনুধাবন করতে চাইলেন। সম্ভব হলো না। হাতের টর্চ জ্বেলে পরে আবিষ্কার করলেন তার বন্ধু খাটের উপর নেই। বিচ্ছিন্ন পা খাটের উপর পড়ে আছে। রক্তে ভেসে গেছে সাদা চাদর। ডানে-বায়ে টর্চ জ্বেলে দেখা গেলো খাট থেকে বেশ খানিকটা দূরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন মাহমুদ সাহেব।
আমাদের শিক্ষিকা বলে চললেন, ঘটনার ভয়াবহতায় আমরা দুজনেই এতোটাই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম যে, কান্না তো দূরের কথা এমনকি কথা বা চিৎকার করতেও ভুলে গেলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে কেবল দাঁড়িয়ে রইলাম। পরে কোনোরকমের তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আমরা আহত আংকেলের স্ত্রী ও মায়ের অবস্থা জানতে চাইলাম। শিক্ষিকা জানালেন, স্ত্রীর অবস্থা খুবই খারাপ। কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে অসময়ে গর্ভপাতে তার একটা বাচ্চাও নষ্ট হয়ে গেছে। তবে তার মা খুবই ধৈর্যশীল। তিনি এখনো শক্ত আছেন। হ্যাঁ, এই মা খুবই ধৈর্যশীল। দৃঢ় মানসিকতার। অবাক করা তার সহ্যশক্তি। ইতোপূর্বেও তিনি এক সন্তান হারিয়েছেন। আর এখন তার দ্বিতীয় ছেলে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে অথচ তিনি এর মধ্যেও নিজেকে সামলে রেখে ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিদের সান্ত¡না দিচ্ছেন। সবাই এটা পারে না। নিরেট আল্লাহ নিবেদিত বান্দী না হলে কোনো মায়ের পক্ষে এতোটা সবর করা সম্ভব না। মানুষ তাকে সালফিতের বীরাঙ্গনা বলে। সবদিক বিবেচনায় এটাই তার যোগ্য উপাধি।
এভাবেই ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোতে একেকটা বিয়োগান্ত ঘটনার জন্ম হয়। প্রায় দিন।
মাস কয়েক পরে আমি সেই চাচাকেই স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেলাম। ততোদিনে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। দুটো লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি হাঁটছিলেন। সাথে আমাদের ম্যাডামের স্বামী তার সেই বন্ধুসহ আরো কয়েকজন প্রতিবেশী। আমি এভাবে তাকে দেখে অবাক হয়ে ভাবছিলাম- কী আশ্চর্য সহনশীল লোক। কী অসীম তার মনোবল। কতো উঁচু পর্যায়ের বীর তিনি। আমার দৃষ্টিতে এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারাই বীরত্ব। বিদ্বেষের পরিবর্তে আশাবাদ এবং হতাশার বিপরীতে প্রত্যাশা লালন করতে পারাই প্রকৃত সাহসিকতা।
আট.
এই জীবনে সে দিনটির কথা কখনো ভুলবো না। সকাল থেকেই দিনটি বেদনাজর্জরিত ছিলো, কারণ আমার ছোট ভাইটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। আম্মু তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। বাড়ি ফিরতে অনেক সময় লেগে গেলো তার। এদিকে আবার প্রচ- মানসিক চাপ শুরু হলো। মাগরিবের আজানের মাত্র ঘণ্টা তিনেক বাকি, এখনো ইফতারের কোনো ব্যবস্থাই করা যায় নি। আমরা সবাই আম্মুকে ইফতার তৈরীর কাজে সহায়তা করতে লাগলাম। সবাই মিলে কাজ করায় খুব কম সময় থাকা সত্ত্বেও আজানের আগেই সব রেডি হয়ে গেলো। আমরা সবাই দস্তরখানের চারপাশে বসে মুয়াজ্জিনের আজানের অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবার আগে আজান শোনার অপেক্ষায় আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এসময় হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার তীব্র আওয়াজে ঘর-বাড়ি কেঁপে উঠতে লাগলো। আমি দেখলাম আগুনের কু-লি যেনো আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে।
বিভিন্ন দিক থেকে এসময় গোলাগুলির আওয়াজ ছুটে আসতে লাগলো। এমন সময় হঠাৎ আমাদের কান প্রায় স্তব্ধ হয়ে এলো। কারণ কাছেই কোথাও বিকট আওয়াজে বোমা বিস্ফোরিত হতে লাগলো। আব্বু বললেন, এটা বিশেষ শ্রেণির ইসরাইলি সেনাদের হামলা। আমরা সবাই দ্রুত শোবার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। কারণ সেটাই ছিলো অধিক নিরাপদ। এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগাতার গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেলো। আমার বড় ভাই আমাদের ভয় কমানোর জন্য মজার মজার জোকস্ বলতে শুরু করলেন, যা শুনিয়ে প্রায়ই তিনি আমাদের মন ভালো করে দিতেন। তিনি সুর করে গল্প বলতে শুরু করলেন, কল্পনায় যেনো বাস্তব কোনো ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা। ভাইয়া বলতে থাকলেন, ‘এই তো সৈনিকের হাত ট্রিগারে আটকে গেলো… আর সে গুলি ছুড়তে পারবে না!… বা ট্রিগারে হাত রেখে সৈনিকটি ঘুমিয়ে গেলো ইত্যাদি ইত্যাদি।… একটু পর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে গেলে আমরা শোনতে পেলাম, মৃদু কণ্ঠে মা কুরআন তেলাওয়াত করছেন।
আমাদের সান্ত¡না দিতে প্রতিবেশী খালামণি ছুটে এলেন। জানালেন, গোলাগুলি থেমে গেছে। ইসরাইলি পশুগুলি জেরিকোর উদ্বাস্তু শিবিরের পুলিশ ফাঁড়ি আর তাঁবুগুলোতে আক্রমণ করেছে। সেখানে খুব ভয়াবহ অবস্থা। সেই রাতে ভয়ে আমার আর ঘুম এলো না। বারবার মনে হচ্ছিলো একবার যেহেতু হামলা চালিয়েছে, জেরিকো শহরের প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে না দিয়ে বর্বর ইসরাইলিরা থামবে না। তবে যে কারণেই হোক, ওরা সে রাতে আর হামলা করে নি। প্রায় দিনই ঘুরেফিরে ফিলিস্তিনের কোথাও না কোথাও এমন হামলা-জুলুম চলতেই থাকলো, যেমন আমার মায়ের মৃদু কণ্ঠের তেলাওয়াতটা প্রতিনিয়ত জারি থাকে। খারাপ কিছু ঘটা শুরু হলেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কুরআনের এই আয়াত- ‘হে নবী, আপনি বলে দিন, আমাদের ভাগ্যে মহান আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তার বাইরে কিছুই আমাদের স্পর্শ করে না।’ যে-কোনো বিপদে আম্মুর স্থিরচিত্ত আর প্রশান্ত চেহারা দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। আশ্চর্য মা আমার।
নয়.
আসরের আজান শুরু হলো, উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে লাগলো মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ। উম্মে মুহাম্মদ প্রতিবেশী নারীদের সাথে বাড়ির সামনের ছোট্ট উঠোনে বসে উলের সুতা কাটছিলেন। কথা বলছিলেন, আকসার শহীদদের নিয়ে। ছেলে মুহাম্মদকে নিয়ে। ইসরাইলিদের বোমাবাজি, অবরোধ আর নিজেদের অসহায়ত্ব নিয়ে। স্বামীর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া, তার এক প্রিয়জনের সাক্ষাতে যেতে না পারার ব্যর্থতা, মাত্র মাইল কয়েক দূরের মায়ের বাসায় পর্যন্ত না যেতে পারা এবং দিনদিন বেড়ে চলা উদ্বেগসহ নানাকিছু নিয়ে তার কথা বলা চলতে লাগলো। এসব আলাপ করতে করতেই তারা স্মরণ করছিলেন মাস কয়েক আগের পরিস্থিতিগুলো নিয়ে। বিয়েশাদির আনন্দ, সৌভাগ্য ইত্যাদি নিয়ে কী দারুণ সময়ই না কাটছিলো তাদের। অথচ আজ কী বিচ্ছিরি অবস্থা চারপাশে…।
আমরা বাইরে পুরুষদের পায়ের আওয়াজ শুনছিলাম। তারা মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। পাশেই শিশুরা বল খেলছিলো, তাদের হাসি-চিৎকারের আনন্দধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো। উম্মে মুহাম্মদ এবার তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন নিজের সন্তানদের খোঁজ করতে। হুড়োহুড়ির মধ্যেই বাচ্চাদের খোঁজ করলেন। কয়েক পলক শিশুদের দেখে তিনি মুহাম্মদের অনুপস্থিতি টের পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মুহাম্মদ কোথায়? বাচ্চারা একটু ইতস্তত করলো। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করলো। একজন এরপর বললো, মুহাম্মদ সম্ভবত বড়দের সাথে বাজারের দিকে গেছে, যেদিকটায় ঝামেলা চলছে। ইসরাইলি হায়েনারা সেখানে সমানে গুলি ছুড়ছে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করছে, বোমা ফাটাচ্ছে আর আমাদের ছেলেরা পাথর হাতে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছে।
প্রতিবেশী এক মহিলা বলে উঠলেন, আল্লাহ তাদের হেফাজত করুন। এরপর কথাবার্তা থেমে গেলো। একটু পর হঠাৎ করেই হাসপাতালের দিকের রাস্তা থেকে চিৎকার ও হুল্লোড়ের আওয়াজ ছুটে এলো, উম্মে মুহাম্মদের অন্তর মোচড় দিয়ে উঠলো, ছেলে মুহাম্মদের আবার কিছু হলো না তো? ভয়ার্ত সাদা পায়রাগুলো মসজিদের উপরে চক্কর দিতে শুরু করলো। শিশুরা সব নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশী নারীদের হাতগুলো নিস্তেজ হয়ে এলো। এসময় মোবাইল বেজে ওঠায় উম্মে মুহাম্মদের হৃদয়টা ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো। ফোন রিসিভ করে তার মনে হলো দূর থেকে ব্যস্ত গলায় কেউ যেনো বলছে তারই ছেলে মুহাম্মদ আহত হয়েছে এবং পাশের হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়েছে।
বাড়িজুড়ে হঠাৎ বিষাদ ছেয়ে গেলো। উম্মে মুহাম্মদ চরমভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন, বুঝতে পারছিলেন না তার এখন কী করা উচিত বা কী বলা উচিত। প্রতিবেশী নারীরা নানান কিছু বলে তাকে সান্ত¡না দিতে লাগলেন।
তিনি হাসপাতালে পৌঁছলেন। কর্তৃপক্ষ সাথে সাথেই তাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। তিনি ছেলের কাছে প্রায় দৌড়ে গেলেন এবং জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। কেঁদে কেঁদেই তিনি বলতে লাগলেন, জানটা আমার, কোথায় তোর গুলি লাগলো? কেমন লাগছে তোর? পুরো শরীরটা জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতরে যেনো আড়াল করে ফেলতে চাইলেন। চুমোয় চুমোয় মুহাম্মদের শরীর ভরিয়ে দিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ তো কোনো জবাব দিচ্ছে না। একটাও কথা বলছে না। নড়ছে না পর্যন্ত। উম্মে মুহাম্মদ লক্ষ করলেন, শরীর তার বরফের মতো শীতল। উজ্জ্বল হাসিতে চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। উম্মে মুহাম্মদ চিৎকার করে উঠলেন, হায় আল্লাহ, আমার ছেলে!… আমার ছেলের কী হয়ে গেলো… কোথায় হারিয়ে গেলো আমার ছেলে…।
মুহাম্মদের বন্ধুরা চারপাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্তনা দিতে লাগলেন, আমরা আপনার ছেলে। মুহাম্মদ তো মারা যায় নি। মুহাম্মদ জীবিত।
কী ভয়াবহ সেই দুঃসহ মুহূর্তগুলো। পুরুষরা চারপাশে জড়ো হয়ে শান্ত-শীতল কণ্ঠে কোরাস ধরলেন, রক্ত এবং জীবনের বিনিময়ে, আমরা তোমাকে উৎসর্গ করলাম হে মুহাম্মদ! নারীরাও গুনগুনিয়ে তাতে কণ্ঠ মেলালেন। উম্মে মুহাম্মদকে সবরের প্রতি উৎসাহিত করলেন। শীতল পবিত্র কণ্ঠের কোরাসে হাসপাতালজুড়ে অন্যরকম
এক আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না কেউ…।
প্রতিবেশী এক নারী এসময় কান্নাভেজা কণ্ঠে গান ধরলেন-
হে উম্মে মুহাম্মদের হৃদয়, তোমাকে সালাম। উম্মে মুহাম্মদের সৌভাগ্য, তোমার প্রতিও সালাম। হে ইতিহাস সৃষ্টিকারী মা, আমাদের চারপাশের এতোসব খুন-সন্ত্রাস-বোমাবাজির ত্রাস সত্ত্বেও দান ও কুরবানির ক্ষেত্রে তুমিই তো ফিলিস্তিনের আদর্শ। তুমি তোমার প্রিয় সন্তান হারিয়েছো, কিন্তু তুমিই তো তার আরশের পাশে জায়গা পাবে হে ভাগ্যবতী!