মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ এবং শ্রীলংকার সংখ্যালঘু মুসলিম

শ্রীলংকার সংখ্যালঘু মুসলিম

Date

Author

Blog Duration

45 minutes

আরবের আশা আমরা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। পরিবর্তিত দৃশ্যপটে তুরস্কের দিকে চোখ রাখছিলাম বড় আশা নিয়ে। প্রাপ্তিটা হতাশায় বদলে যায়নি, যদিও আশানুরূপ গতিতেও হচ্ছে না। ইরান যেভাবে মূল মঞ্চে চলে আসছিলো কিংবা একক রাহবার হিসেবে স্বীকৃতি নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো, আমাদের বড় বিকল্প সেখানে এরদোগানের তুরস্ক। যে সংকটের মধ্য দিয়ে আজকের মুসলিম উম্মাহকে পথ চলতে হচ্ছে, এই মুহূর্তের বড় দাবি বিক্ষিপ্ততা এবং দেশ-সমাজের সাধারণ সীমা ছাপিয়ে এক মঞ্চে সমবেত হওয়া এবং তারও আগে চিন্তার সমন্বয়।

খাদ থেকে চূড়ায় উঠে আসতে কিংবা পতনোন্মুখ হালত থেকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হতে শক্তি বা সংখ্যার চেয়েও বড় প্রয়োজন শিক্ষার। কৌশলের। নৈতিকতা এবং মনোবলের। আর এসবের মূলেই আছে চিন্তার বিকাশ ও সমন্বয়।

এক্ষেত্রে বছর কয়েক আগেও প্রায় একমাত্র দেশ হিসেবে উঠে আসতো ইরানের নাম। এখন আমরা বড় করেই তুরস্কের কথা বলতে পারছি। ধীর গতিতে হলেও অনেকাংশে যা তারা কাজে প্রমাণ করে যাচ্ছে। সামার স্কুল নামে তুরস্কের একটা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে বছর কয়েক আগে। সারাবিশ্বের মুসলিম তরুণ গবেষকদের নিয়ে কনফারেন্স আয়োজন, নিজেদের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা এবং এর আলোকে সমাধান ও কৌশল প্রণয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া- এটাই মূলত প্রজেক্টের উদ্দেশ্য।

২০১৩ সালে সামার স্কুলের প্রথম আয়োজনের স্মারকটি আমার হাতে এসেছে। এই কনফারেন্সের প্রতিপাদ্য ছিলো- ‘ট্রান্সফরমেশন অব দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড ইন ২১’স্ট সেঞ্চুরি’। পড়ছি। আরব বসন্ত পরবর্তী প্রথম আয়োজন হওয়ায় আশাবাদের কিছু ছড়াছড়ি আছে, গত ক’বছরে অনেক কিছু বদলেও গেছে। পাঠের ক্ষেত্রে সেটা একদিকে যেমন কিছুটা অস্বস্তির, ভাবনা ও বর্তমান পরিস্থিতি বিচারে যথেষ্ট সহায়কও। আমাদের তরুণদের জন্য এই রচনাগুলোর পাঠ অত্যন্ত জরুরি। এমন চিন্তা থেকেই কিছু কিছু আলোচনা ওদের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস নিলাম।

শ্রীলংকা আমাদের খুব কাছের এবং বিশেষত ক্রিকেটের সুবাদে বেশ পরিচিত একটি দেশ। শ্রীলংকার মুসলিমইস্যুটি কখনো তেমন আলোচনায় আসে নি। খুব কিছু আমরা জানিও না। তাই এই নিবন্ধটিকেই প্রথমে বেছে নিলাম। লেখক শ্রীলংকান ইসলামিক ছাত্র আন্দোলনের প্রেসিডেন্ট।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিবন্ধের শেষে যুক্ত করে দেবো ইনশাআল্লাহ। সরাসরি ইংলিশ থেকে লেখকের নিজস্ব গদ্যরীতি ঠিক রেখেই অনুবাদের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। হ্যাপি রিডিং- শাকিল আদনান

বিশ্বময় ইসলামের পুনর্জাগরণ

ডোম অব দ্য রক

বিশ্বময় ইসলামের পুনর্জাগরণে বিগত ক’বছর ধরে নতুন এক মাত্রা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংকট ও সম্ভাবনার সাধারণ আলোচনাকে পেছনে ফেলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম সমাজ নিজেদের অবস্থানকে আরো সংহতরূপে শনাক্ত করতে পারছেন। পুনর্জাগরণমূলক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য এবং কৌশল প্রণয়নের প্রয়োজনে নিজেদের পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রে তারা উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করছেন। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থাটা তাই বিগত এক দশক বা তারও পূর্বের বাস্তবতার তুলনায় নি:সন্দেহে উত্তম।

যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি মেকার- বিশ্বমঞ্চে নিজেদেরকে যারা যুগের একমাত্র সুপার পওয়ার মনে করেন, তারাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও আজ নিশ্চিতভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে- মুসলিম বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্নতা কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে জবরদস্তিমূলক অভিযান কোনো বিবেচনাতেই কাজের কাজ হচ্ছে না। বিশ্বে নিজেদের আধিপত্যবাদী স্বার্থকে নিরাপদ রাখার স্বার্থেই মুসলিম জাতির সাথে অবশ্যই তাদের সমঝোতায় আসতে হবে। বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

সেনাশাসনের কবল থেকে তুরষ্কের সাম্প্রতিক মুক্তিলাভ উম্মাহর পুনর্জাগরণের প্রশ্নে এক বিশাল অর্জন। এই ঘটনার পর ইতোমধ্যে এটাও নিশ্চিতরূপে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তুরষ্ক কামালীয় ধারার রাষ্ট্র পরিচালনায় আর ফিরে যাচ্ছে না।

ঐতিহ্যবাহী এই মুসলিম দেশটির জনসাধারণের বড় অংশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় বিধান জারির দাবি উত্থাপন করা শুরু করেছেন। তুরষ্কের জনগণের হৃদয়ে ইসলামী মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার সাফল্যের জন্য যারা নানা ধাপে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন এবং সেসব প্রতিষ্ঠান যারা কার্যকর পদক্ষেপ বা সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে এই অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন তাদের প্রতি আমাদের অভিনন্দন।

অর্থনীতি, সুশাসন, সংস্কৃতি এবং শিক্ষায় তুরষ্কের সাম্প্রতিক অগ্রগতি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। অপরাপর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটা একটা উদাহরণ হয়ে দাঁড়ালো যে, একটা সম্ভ্রান্ত ও আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্রের অবয়ব দেখতে ঠিক কেমন হয়। ধার্মিক মুসলিমেরাও অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থবির হয়ে থাকা একটি রাষ্ট্রকে কীভাবে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে পারেন। গর্বভরেই এখন এটা দাবি করা যায়- অনেক মুসলিম দেশই আজকাল নিজেদের বহুমুখি উন্নয়নের মডেল হিসেবে তুরষ্ককে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব অনুভব করছে।

আরব বসন্ত মুসলিমদের আঞ্চলিক সংকীর্ণ চিন্তা থেকে বেরিয়ে বিশ্বমঞ্চের নেতৃত্বের প্রস্তুতি নেয়ার তাগিদ দিয়ে গেছে। ইসরাইলসহ অপরাপর সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে বাধ্য হচ্ছে- মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা পুরোই বদলে গেছে এবং তারা যদি তাদের একগুঁয়েমি ত্যাগ না করে তাহলে মাঠের বাস্তবতা কখনো তাদের জন্য সুবিধেজনক হবে না। বিগত পাঁচ দশকের মধ্যে এই প্রথম আরবের যুব সমাজ প্রবলভাবে জেগে ওঠলো এবং ভেঙে চুরমার করে দিলো আরব-স্বৈরশাসনের দুর্গ। বিপুল ক্ষমতাধর আরব শাসকদের দাসত্বের বেড়িকে তারা এক ঝলকে মাটিতে আছড়ে ফেললো। আরব ও মুসলিম বিশ্বের এলিট শ্রেণীও আন্দোলনের নেতাদের নিজ নিজ দেশের জনগণের প্রকৃত ও আইনানুগ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে।

এটা অতিঅবশ্যই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। উম্মাহর সাম্প্রতিক পুনর্জাগরণ ও অগ্রগতিমূলক বিষয়-আশয় নিয়েই আমি আজকের নিবন্ধটি শুরু করতে যাচ্ছি।

১- মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের বর্তমান হাল

মুসলিম জাতি এই মুহূর্তে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। অন্তত একশত ত্রিশ কোটি মুসলিম বর্তমানে বিশ্বে বসবাস করছেন।

৫৭টি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রে বাস করছেন প্রায় নব্বই কোটি মুসলিম এবং অবশিষ্ট চল্লিশ কোটি মুসলিম বাস করছেন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য প্রায় ১০০টি দেশে।

মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার বড় অংশজুড়ে মুসলিমদের প্রধান উপস্থিতির সুবাদে বিশ্ব মানচিত্রের বড় একটা অংশ মুসলিমদের অধীনে। অন্যদিকে- ইউরোপে তিন কোটির বেশি এবং দক্ষিণ আমেরিকায় প্রায় এক কোটি মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম এখন দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত

বিশ্বের মোট ভূমির ২৩ ভাগ কেবল ৪৭টি মুসলিম দেশের অধীনেই। কৌশলগত ভূমি, আকাশ এবং সমুদ্রপথের বিশাল এবং বড় অংশই মুসলিম দেশগুলোর করায়ত্বে আছে এবং এসবে চলাচলের ক্ষেত্রে তারাই সবচে স্বাধীন।

সম্পদে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ঈর্ষণীয়রকম সমৃদ্ধ হলেও এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক এবং শিল্প-সক্ষমতায় তারা খুবই পিছিয়ে। ব্যাপক আর্থিক সক্ষমতা থাকার পরও প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা এবং উন্নত প্রডাকশন মডেলের ক্ষেত্রে তারা মারাত্মক দুর্বল।

মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য মাত্র ১৩ ভাগ, অবশিষ্ট ৮৭ ভাগ বাণিজ্য বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর সাথে। ব্যাপারটা হতাশার হলেও এটা বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের দৃঢ় সংযোগেরও বড় প্রমাণ।

এখানে আরো একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো- অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশের তকমা নিয়ে বসে আছে অথচ ৫টি মুসলিম দেশই বিশ্বের উন্নত মানব উন্নয়নের তালিকাভুক্ত, ২৫টি মধ্যম মানব উন্নয়নের তালিকায় এবং বাকি ক্ষুদ্র একটা অংশ নি¤œ মানব উন্নয়নের সূচকে আাছে। অথচ তকমাটা আসছে গণহারে এবং নি¤œ সূচক হিসেবেই। (সূত্র: ইউএনডিপি)

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মুুসলিম বিশ্ব এ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে। আর এটা পশ্চিমা বিশ্বের বিগত ৩০০ বছরের আলোকপ্রাপ্তিকালীন সময়ের ঘটনা নয় যখন অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের ব্যাপার বা সূচকগুলো চিন্হিত হওয়া শুরু করেছে। শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মুসলিম বিশ্বের পুনরুত্থান একটি সাম্প্রতিক ঘটনা।

এখানে বেশ অনেকগুলো জটিল প্রশ্ন সামনে চলে আসে যখন আমরা ঘটতে থাকা ভুলগুলো যাচাই করতে যাই এবং এবং বিবেচনা করি যে, সমাধান হিসেবে এজন্য আমাদের কী কী করণীয়। এসব বিষয়ের নৈতিক ও আদর্শিক পথ ও পদ্ধতি খুঁজে বের করতে পারাই বর্তমান সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ।

ইসলাম পৃথিবীর সকল নবী-রাসূল এবং তাদের অনুসারীদের ধর্ম

marcy to non muslim

ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম এবং মুসলিম উম্মাহ একটি বৈশ্বিক সম্প্রদায়। বিশ্বাসই হলো সেই ভিত্তি যেটা মুসলিম উম্মাহর জন্য ইসলামের সামগ্রিক গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। তাওহীদ বা একত্ববাদই পৃথিবীর একতা, মানবতার ঐক্য এবং জীবন ও আইনের বৈশ্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে।

ইসলাম কোনো বিশেষ জাতি, গোত্র, শ্রেণী বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা ভূখ-ের ধর্ম নয়, ইসলাম নতুন কোনো ধর্ম হবারও দাবি করে না। এটা বরং প্রতিনিধিত্ব করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সে নির্দেশনার, পৃথিবীর সূচনা থেকেই অসংখ্য নবী-রাসূল যেটা মানবজাতির কাছে প্রচার করে এসেছেন।

এই হিসেবে, ইসলাম পৃথিবীর সকল নবী-রাসূল এবং তাদের অনুসারীদেরও একমাত্র ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হয় এবং সেটাই বাস্তব। আজকের মুসলিম উম্মাহও তাই পূর্ণ শ্রদ্ধা সহকারেই হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে হযরত নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সা. এর নাম স্মরণ করেন এবং তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন।…

মুসলিম উম্মাহর বর্তমান রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির হালচাল

the arab world আরব বিশ্ব

বিশ্বের চলমান অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়ীক সংকটের দিকে তাকালে, যে কেউ সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন- এটা মূলত ঘটছে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ভেতরগত নানা সীমাবদ্ধতার কারণে।

আর এ সংকটের গোড়াতেই আছে ব্যক্তির মতো রাষ্ট্রগুলোরও নৈতিক অবক্ষয়, সম্পদ বাড়ানোর মানসিকতা, লোভ, স্বার্থ এবং এমন একটা সিস্টেম- যার অধীনে অর্থনীতি কাবু ও কুক্ষিগত হয়ে পড়ে স্বল্পসংখ্যক ক্ষমতাবান লোকের হাতে; যাদের মধ্যে থাকে বিনিয়োগকারী, ব্যাংকার এবং একশ্রেণীর ফটকাবাজ লোক।

সত্য বললে, এই অর্থনৈতিক ধারা এখন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া গ্যাসভর্তি বেলুনে পরিণত হয়েছে, যার কতৃত্ব দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্বের খেলোয়ারেরা। এক্ষেত্রে বিশেষ দায়টা বর্তায় আধুনিক পুঁজিবাদী ধারার নেতৃত্ব দেয়া রাষ্ট্রগুলোর ওপর, সমাধানের পথে হাঁটার বদলে এই সংকটে যারা বরাবরই তা দিয়ে যাচ্ছে। এই কারণেই একদিকে স্বল্পসংখ্যক দেশের সরকারগুলো পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির এই অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ খেলার কতৃত্ব নিয়ে বসে আছে আর বাকি দেশের সরকারগুলো মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে এর প্রতিকার সাধনে, বিশৃঙ্খল পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে একটা সিস্টেমে আনয়নে। সোজা কথায় নিজেদের বাঁচাতে।

এই বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্য এবং অপরাপর মুসলিম বিশ্ব- যারা তৃতীয় বিশ্বের ৪০ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করছে- তাদের অবস্থা এখন খাদের কিনারে এসে ঠেকেছে। এই মুহূর্তে আমরা যদি মুসলিম বিশ্বের দিকে দৃষ্টি দিই- তাহলে বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং স্বাভাবিকভাবে বাকি মুসলিমবিশ্ব অন্তত তিনটি বড়রকম সংকটের মুখে পড়েছে।

মুসলিম বিশ্বের তিনটি বড়রকম সংকট

প্রথমত- মুসলিম দেশগুলোর, বিশেষত তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর পরিমাণ টাকা বছরের পর বছর ধরে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর ডলারের লাগাতার দরপতনে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ ও সঞ্চয়কারী দেশ এবং ব্যক্তিদের মোট অর্থের চল্লিশভাগই ‘নাই’ হয়ে গেছে। কোথাও কোনো শেয়ারবাজারে যখন ধস নামে, সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেসব লোক যারা অনুমাননির্ভর বিভিন্ন মেয়াদী শেয়ারে এবং সম্ভাব্য লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ বাইরের সাধারণ বিনিয়োগকারী দেশ বা লোকজন।

কিছু পরিসংখ্যানমতে- পশ্চিমের মার্কেটগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত ৩-৪ ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন সমান এক লক্ষ কোটি)- মানে তিন থেকে চার লাখ কোটি ডলারের বিশাল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা আছে।

আর সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্ট বলছে- পাশ্চাত্যের বাজারগুলোর গত প্রায় দের বছরের (১১-১২ সালের ধস) লাগাতার গচ্ছা ৯ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যার সহজ অর্থ- মধ্যপ্রাচ্যের (যা মূলত জনগণের আমানত) মোট বিনিয়োগের বড় একটা অংশও ইতোমধ্যে নাই হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের কোমল ও চর্বিবিশিষ্ট তলপেটের শাসক ও ক্ষমতাবান এলিট শ্রেণীকে পশ্চিমের ধুরন্ধর রাষ্ট্রগুলো এজন্যই দৃশ্যত তোয়াজ করে চলে। নিপুণভাবে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগায় এবং দারুণ কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে।

লসের দ্বিতীয় বড় খাত হলো বিশ্বমার্কেটের দুদুল্যমান হাল। লাগাতার ওঠা-নামাজনিত অনিশ্চয়তা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো- যাদের আয়ের বড় একটা খাত পণ্যরপ্তানী, তাদের রপ্তানীর সূচক কমছে তো কমছেই। আমেরিকা ওদের সবচে বড় বাজার, ইউরোপ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, এখন বাজার যেহেতু ওঠা-নামা করছে তাই প্রভাবটা স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর পড়ছে খুব বাজেভাবে। বিশেষ করে যারা পণ্যরপ্তানীর ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করে।

তৃতীয় যে খাত বা ধারাটি এখন সামনে আসছে সেটি হলো- স্থানীয় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এবং শেয়ারবাজার। সাম্প্রতিক দুবাই শেয়ারবাজারের ধস (২০১২ সালের) সরাসরি সেটারই উপচে পড়া বা টেনে আনা প্রভাব। যা গোটাবিশ্বের অর্থনৈতিক খেলোয়ার, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ সঞ্চয়কারীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং করবে।

এ পর্যায়ে সামনে আসছে বৈশ্বিক অর্তনীতির চলমান সংকটের সাথে এনার্জির সম্পর্কের ব্যাপারটি। পৃথিবীর তেল-গ্যাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তি ও সম্পদের ৭০ ভাগেরই মজুদ মুসলিম দেশগুলোর ভূখণ্ডে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, সেন্ট্রাল এশিয়াতেও যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ মিলেছে। ব্যাপার আরও আছে।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ক্ষমতাচর্চার কাঠামো এবং ইরাক, আফগানিস্তান, সেন্ট্রাল এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এমনকি পাকিস্তানের ওপরও আমেরিকার অর্থনৈতিক লোলুপ দৃষ্টি এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ঠিক এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চায়- তেলের উৎপাদন, মজুদ তেলের ভাণ্ডার এবং পেট্রোলিয়ামজাতীয় পণ্যসমূহের প্রক্রিয়াজাত করণের পুরো ব্যাপারটি শুধুমাত্র তারই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকুক। যে কোনো মূল্যে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং তাদের মিত্রশক্তিগুলোর ওপর মুসলিম দেশ বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নির্ভরশীলতা বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির একরকম ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে, এটার সংযুক্তি আছে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াই, রাষ্ট্রীয় প্রেসার, ক্ষমতার ভাগাভাগি, সময়-অসময়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরির মতো নৈমিত্তিক ঘটনাগুলোর সাথে- যেগুলো পশ্চিমের বলপ্রয়োগের রাজনীতিরই একটা অংশমাত্র।

ইরান-তুরস্কের প্রক্সিযুদ্ধ

২০১২ সালটি সাক্ষী হয়ে রইলো ইরান-তুরস্কের তীব্রতর রাজনৈতিক লড়াইয়ের। ২০১৩ সালে এই ধারা আরো তীব্র হয়ে উঠতে পারে মূলত দুটো কারণে। প্রথম কারণটি স্থানীয়, যেটির জ¦ালানী হিসেবে কাজ করছে ইরাক ও সিরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ।

ইরান-তুরস্ক দুটো দেশই পাশ্ববর্তী এই দেশ দুটিতে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা বা ধরে রাখার জন্য মরিয়া, যা থেকে কৌশলগত অবস্থান তারা হারাতে বসেছে। ইরানের জন্য সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের ক্ষমতা হারানো খুবই অপ্রত্যাশিত ও হতাশাজনক একটা ব্যাপার এবং ইরান এটার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইবে ইরাকের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে আরো কঠোর ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে।

এটা তারা করবে একদিকে ইরাকে শক্তি বৃদ্ধি করে এবং অন্যদিকে অভ্যুত্থানপরবর্তী সিরিয়াকে বিভক্ত ও দুর্বল রাখার মধ্য দিয়ে। কারণ দুই পাশের দুই দেশ ইরাক-ইরানের সমর্থন ও সহায়তা ছাড়া সিরিয়ার পক্ষে কোনোভাবেই স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল একটা রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান পুনরোদ্ধার বা টিকে থাকা সম্ভব নয়।

ইরান-ইরাককে এড়িয়ে আরব ও তুরস্কের সাথে সীমান্ত যোগাযোগও সিরিয়ার জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনতে পারবে না। ফল হিসেবে ইরানই আবার চলে যেতে পারে সুবিধাজনক অবস্থানে।

ইরান-তুরস্কের রাজনৈতিক লড়াইয়ের দ্বিতীয় কারণটি আন্তর্জাতিক। ইরান-তুরস্কের এই লড়াই আরো গতি পাবে কারণ ২০১৩ সালটি সাক্ষী হতে যাচ্ছে এই অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মনোযোগ ও দৃষ্টি আরো বেশিরকম প্রত্যাহারের কারণে। অর্থনৈতক ও কৌশলগত কারণে পশ্চিমের আগ্রহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে কমে গিয়ে বাড়বে অন্যত্র।

যুক্তরাষ্ট্র ফোকাস করা শুরু করবে চীনের বাড়তে থাকা প্রভাব নিয়ন্ত্রণের ওপর, বিশেষত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর। ইতোমধ্যেই যেহেতু বিতর্কিত দ্বীপসমূহ নিয়ে চীন-জাপানের মধ্যকার উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে।

সন্দেহ নেই- মধ্যপ্রাচ্যের ওপর থেকে পশ্চিমা শক্তির দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া এ অঞ্চলের ক্ষমতাচর্চায় বিরাট একটা শূন্যতা তৈরি করবে। ফলে, আঞ্চলিক শক্তিগুলো এ শূন্যতা পূরণের লড়াইয়ের কৌশলগত খেলায় বড় একটা জায়গা পেয়ে যাবে। রাশিয়া-চীন অক্ষের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাববিস্তারের ক্ষেত্রে ইরান এটাকে দেখবে বিরাট একটা সুযোগ হিসেবে। আর ইরানের এই ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে তুরস্ককে খেপিয়ে তুলবে, কারণ নানা কারণে এতদঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারে তুরস্ক এমনিতেই উদ্বিগ্ন।

এই উদ্বেগের কিছু ব্যাপার তো ঐতিহাসিক, বাকি ব্যাপার হলো ইউরোপের বাজারে প্রাকৃতিক সম্পদ বা এনার্জি রপ্তানীতে ইতোমধ্যেই বড় হয়ে ওঠা রাশিয়া-তুরস্কের ভেতরগত লড়াই। এসব কারণ পাশ্চাত্যশক্তিগুলো আবার তুরস্ককে সাপোর্ট দিয়ে যাবে- মধ্যপ্রাচ্য থেকে আপাতত তাদের মনোযোগ প্রত্যাহারের একরকম ক্ষতিপূরণ হিসেবে। যাতে তারা পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারে চীন-রাশিয়া অক্ষকে চ্যালেঞ্জ করার এবং তাদের বাড়তে থাকা প্রভাববলয়ের গলায় রশি টেনে ধরার পেছনে।

এটা তো সত্য যে, বড় দুই প্রতিবেশী দেশ- ইরান ও তুরস্কের মধ্যকার ভৌগোলিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংযোগ খুবই গভীর। যে কারণে এই দুই রাষ্ট্রের যে কোনো সংঘাত বা মুখোমুখি অবস্থান নিঃসন্দেহে দু পক্ষের জন্যই হবে অপ্রত্যাশিত এবং চড়া মূল্যের। কিন্তু ছায়া শক্তিগুলোর ইন্ধনে এই দুই দেশের বিরোধ অনিবার্য একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবেই। প্রতিপক্ষ দুই দেশই নিজেদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাপোর্ট প্রদান করবে সেসব বিচ্ছিন্ন দল বা গ্রুপের প্রতি- যারা এই দুই দেশের জন্য নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়াবে এমনকি পরস্পরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত অনিবার্য করে তুলবে।

এখানেই দৃশ্যমান হবে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ পার্টিগুলোর ভূমিকা, যেমন তুরস্কের পিকেকে পার্টিকে টেনে আনা হবে এই প্রত্যাশিত ছায়াযুদ্ধে। ইরানের সমর্থনে পিকেকে পার্টি তুরস্ক সরকারের বিপক্ষে নিজেদের রক্তক্ষয়ী অভিযানগুলো তীব্রতর করবে।

তুরস্ক সরকার আবার ইরানবিরোধী গ্রæপগুলোকে কাজে লাগিয়ে যথোচিত জবাব দিতে চাইবে। আর এই গ্রুপগুলো মিলে দুটো দেশকে চরম সংঘাতের মুখে ফেলবে, যদিও এটা সরাসরি দুই দেশের সেনাবহিনীকে যুদ্ধে জড়ানোর মতো অবস্থায় উপনীত করবে না বলেই আমাদের অনুমান। ইরান যদি তুরস্ক ও আরব রাষ্ট্রগুলোর চাওয়া এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে তাদের প্রকৃত অংশীদারিত্বের যুক্তিকে স্বীকৃতি ও ছাড় দিতে রাজি হতো এবং সে রাষ্ট্রগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নিজের কৌশলগত অস্থিরতাবৃদ্ধির কাজগুলো না করে যেতো- তাহলে অতিঅবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যের অপ্রত্যাশিত এই অবনতি এড়ানো যেতো।

সুতরাং বলাই যায়- এই সংঘাত অনেকটাই ইরানের অনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ, যা দিনকে দিন মুসলিমবিশ্বকেই দুর্বল করে চলেছে

বৈশ্বিক রাজনীতি এবং মুসলিমবিশ্ব

মুসলিমবিশ্বের সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতির দিকে তাকালে যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা দেখি প্রধান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে, যে রাষ্ট্রটি মুসলিমবিশ্বের অভ্যন্তরীণ কিংবা বহিরাগত সবরকমের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে। এমনকি যুদ্ধ বা শান্তিপ্রতিষ্ঠার মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির রূপরেখা ও গতিধারাও ঠিক করে দিচ্ছে। মুসলিমবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের মোটাদাগের উদ্দেশ্যগুলো হলো-

  • এতদঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিশেষত তেল-গ্যাসের সাপ্লাইপথগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।
  • ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইজরাইলের সুরক্ষা এবং এর সীমানাবিস্তার অব্যাহত রাখার পথ সুগম করা।
  • যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া ও লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের পথে প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে চিন্হিত রাষ্ট্রগুলোর গতিবিধির ওপর নজরদারি।

মধ্যপ্রাচ্যে ইজরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের জেরে সংঘটিত যুদ্ধগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সরাসরি সম্পৃক্ত, তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব, অনৈতিক হস্তক্ষেপ, সরাসরি সামরিক উপস্থিতি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বিরোধে এর গোপন সম্পৃক্ততার মতো ব্যাপারগুলোই মধ্যপ্রাচ্যকে আজকের মধ্যপ্রাচ্য বানানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে।

সন্দেহ নেই- ৯/১১ বা নয়/এগারর ঘটনা গোটা বিশ্বের ভৌগোলিক রাজনীতি এবং কৌশলগত বাস্তবতার গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছে। তাৎক্ষণিক ফলস্বরূপ আমেরিকার সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হলো প্রথমে আফগানিস্তান তারপর ইরাকে এবং এর প্রত্যাশিত পরিণতি হিসেবে মুসলিমবিশ্বের আঞ্চলিক লড়াই ও সংঘাতগুলোর পুরো দৃশ্যপটই বদলে গেলো।

নতুন সূচিত বিশ্বব্যবস্থার সূত্রানুসারে- ফিলিস্তিন আন্দোলনের অগ্রসরতা, সোমালিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের জাগরণ, ইরানে কট্টরপন্থী শাসনব্যবস্থার উত্থান, সেন্ট্রাল এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে আদর্শিক সংগ্রামসমূহ এবং সৌদি-ইয়েমেন বা আফগান-পাকিস্তানের সীমান্তে সশস্ত্র গ্রুপ গুলোর স্বাধিকার আন্দোলন কোনোটাই আর একটা আরেকটা থেকে বিচ্ছিন্ন রইলো না।

বরং বলা ভালো- যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অনন্ত ‘বৈশ্বিক যুদ্ধ’ বা ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাস’ এর বিভ্রান্তিকর চর্চাগুলোর আলোকে এইসব বিচ্ছিন্ন বা আঞ্চলিক লড়াইগুলো এক কাতারে এসে একরকম বৈশ্বিক রূপ লাভ করলো। বিশ্বায়নের নতুন এই ধারণা পলিসিমেকারদের পলিসি বিশ্লেষণ বা জনসাধারণের কাছে মতামত পেশ করা ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো দেশ, অঞ্চল বা রাজ্যের নিজস্ব লড়াই বা অগ্রসরতাকে তাদের বিবেচনার বাইরে টেনে এনে নতুনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কাজকে অনিবার্য করে তুললো।

ইঁদুর মারার কল দিয়ে সিংহবধের মতো ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব মুসলিম দল বা গ্রæপের আঞ্চলিক লড়াইগুলো এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে গেলো। অদৃশ্য ও বিক্ষিপ্ত সে ‘শত্রæর’ বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে দিলো অনন্ত এক লড়াই।

ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক এবং মুসলিমবিশ্বের ইসলামী আন্দোলনসমূহ

এই সময় এবং নিকট অতীতের বেশ কিছু ঘটনা মুসলিমজাতির মনোজগতে বেশ প্রভাব সৃষ্টি করেছে এবং তাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে রাজনৈতিক ইসলামের পরিণত রূপ উপলব্ধির পথে।

সেরকম কিছু ঘটনার তালিকায় প্রথমদিকেই থাকবে- ১৯৭৯ সালে ইরানের বহুল বিতর্কিত ইসলামিক অভ্যুত্থান, ১৯৮৯ সালে সুদানের মিলিটারি অভ্যুত্থান, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আলজেরিয়ার ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের সাফল্য তবে সরকার প্রবর্তনে দেশটির সামরিক বাহিনীর অপ্রত্যাশিত ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্যাখ্যান, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে তালেবান কর্তৃক ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের অধিকাংশ ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হামাসের অভূতপূর্ব বিজয়।

হামাসের এই বিজয় যদিও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায় নি এবং জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার গড়তেও তারা সক্ষম হয় নি। উল্টো গাজার ওপর অন্যায় অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যাতে হামাসের আন্দোলন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়। মিশর ও তিউনিসিয়ায় অভাবনীয় ইসলামী পুনর্জাগরণ পরবর্তী গণতান্ত্রিক নির্বাচনেও যথাক্রমে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আন নাহদার জয় লাভ করেছিলো। এই মূহূর্তের বাস্তবতা যদিও কারো অনুকূলে নেই- না মুসলিম ব্রদারহুডের, না আন নাহদার।

এসব হতাশাজনক চিত্রের বিপরীতে আমাদের জন্য উদ্দীপনামূলক অভিজ্ঞতা হলো তুরস্কের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি), যেটি ২০০২ এর নির্বাচনে জয় লাভ করেছিলো। একেপি পার্টির এই বিজয় পরবর্তী অনেক ইসলামী আন্দোলনেরই প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। যদিও একেপি পার্টি নিজেদের ইসলামী দল বা আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করে না, তবে এর নির্জঞ্ঝাট ১০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা একটা মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। অনেক ইসলামী স্কলারই এই মডেলকে সফল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

এই মডেলের প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য হলো- ইসলামী রেফারেন্সের (ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততার) সহজ-স্বাভাবিক একটা ধারা, বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং অবশ্যই তৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

বিশ্বজুড়ে ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহ বিশেষ করে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড বর্তমানে গভীর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এর কারণ এই আন্দোলন বা দলগুলোর রাজনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠাই পেয়েছে বিরোধমূলক রাজনীতির পথ ধরে। ক্ষমতাসীন দলগুলো দশকের পর দশক ধরে এই দলগুলোকে প্রধান টার্গেট বানিয়ে রেখেছে।

ফলস্বরূপ এই দলগুলোর কর্মীদের নিবৃত ও দলছুট করতে, ওদের ভোগান্তি ও বিপদ বাড়াতে এমনকি এই দলগুলোর ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলতে সব দেশেই সমান বিরোধ ও বর্বরতা রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। তবে আরব বসন্ত হঠাৎ করে এই ইসলামী আন্দোলনগুলোকে নতুন কোনো বিপত্তি ও লড়াই ছাড়াই এবং তাদের আদর্শ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকে কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি করা ব্যতিরেকেই সরাসরি ক্ষমতার গদিতে বসিয়ে দিয়েছে।

এভাবে হঠাৎ করে কোনোরকম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া এই দলগুলো নিজেদেরকে যখন দেশের মসনদে আবিষ্কার করলো, অনভিজ্ঞতার খেসারত হিসেবে দ্রুতই চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেলো। এখন, হ্যাঁ কেবল এখনই তারা সত্যিকার অর্থে নিজেদের কার্যক্রম ও শ্লোগানগুলোর ঠিকঠাক পাঠ ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে, যা মোটেই সহজ কাজ নয়।

সার্বক্ষণিক ভাবনা-চিন্তা ও পর্যবেক্ষণই পারে চলমান ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক প্রোগ্রাম দিয়ে সবরকম হিসেব, যাচাই-বাছাই ও অডিটের বেড়াজাল ভেদ করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে। আর এটা প্রত্যাশিত যে, এই দায়িত্ববোধ ও উপলব্ধি যে ব্যক্তি বা দলগুলোর থাকবে- ইসলামের জাগ্রত বাস্তবতা তাদের উত্থানের সুযোগ দেবেই।

এক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো- মধ্যপ্রাচ্যের সালাফি মতাদর্শীদের রাজনৈতিক ভাষ্যের বিকাশ এবং প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ। এতোদিন তারা সরাসরি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন বা রাজনৈতিক কার্যক্রমের যথার্থ ভাষ্য তৈরির সুযোগ থেকে কার্যত বঞ্চিত ছিলো। অনেকটা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতোই- হঠাৎ তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করলো এমন বাস্তবতায়, যেখান থেকে অনুসারীদের জরুরি রাজনৈতিক প্রত্যাশাগুলো পূরণে তাদেরকে ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো বিকল্পই সামনে হাজির নেই।

মুসলিম ব্রদারহুড ও সালাফিদের মধ্যকার জোট (১২ ’র নির্বাচনে) মিশরের চলমান রাজনৈতিক সংকটকে হয়তো সালাফি রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে ঠেলে দেবে। (তবে আমার বিবেচনায় সেটা নিয়ে আতংকিত হবার কিছু নেই কারণ, দিনশেষে) এটাও প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ব্রদারহুডের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলোর সাথে গিয়েই মিলে যাবে। তবে আপাত দৃষ্টিতে এটি এতদঞ্চলের জন্য বেশ রক্ষণশীল বয়ানই হাজির করবে।…

মুসলিম বিশ্বের বিগত কয়েক দশকের এই বিচিত্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাগুলো বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা, পলিটিক্যাল কার্যক্রমের সামর্থ্য ও আদর্শিক ভিত্তির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে।

যাই হোক- রাজনৈতিক ইসলামের এই অগ্রযাত্রা অবশ্য স্বৈরতান্ত্রিক আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকেও প্রচুর চাপ ও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। নয়/এগার’র পর এই প্রেসার আরো বেড়েছে। এসময় ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো ভীষণরকম দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। সক্রিয় ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের গণহারে আটক করা হয়েছে, নির্মম নির্যাতন করে অনেককে শহীদ করা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো রাজনৈতিক ইসলামের অগ্রগতির পথে চরম তিক্ততা সৃষ্টি করেছে। প্রদত্ত ইতিহাসের এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হবার পরও এটাই স্বাভাবিক যে কিছু উৎসর্গপ্রাণ কর্মীর কাছ থেকে আমরা শুনবো অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী শ্লোগান ও প্রতিপক্ষকে পাত্তা না দেওয়া কিছু হুমকিও।

তাদের অনেককে (মিশরের) নির্বাচন একদম নাগের ডগায় রেখে জেলখানা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে (প্রতিনিয়ত তারা যেহেতু জুলুমের শিকার হয়ে এসেছে) তাদের কাছ থেকে প্রফেশনাল কূটনীতিকদের মতো বক্তব্য আশা করাও তো উচিত হবে না।

তিক্ত বাস্তবতার এই দিকগুলো এক পাশে রাখলে এটাও মানতে হবে যে, রাজনৈতিক ইসলামের ভাষ্য বা চিত্রটি ইতোমধ্যে একটা ব্যালেন্সে চলে এসেছে। তিউনিসিয়ার ইসলামী আন্দোলন এক্ষেত্রে ভালো একটা উদাহরণ তৈরি করেছে। আননাহদা যদিও স্বৈরশাসক বেন আলীর অধীনে চরমভাবে নিগৃহীত থেকেছে, এই দলের নেতারা ইতোমধ্যে সহনশীল রাজনীতির একটা ধারার প্রবর্তন করেছে এবং তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে আধুনিক সেক্যুলার এমনকি বামপন্থী দলগুলোর জন্যও।

এই দলের নেতারা তিউনিসিয়ার নাগরিকদের এই মর্মে পুনরায় নিশ্চয়তা প্রদান করেছে যে এই নতুন রাজনৈতিক ধারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবে না এবং এখন থেকে নিজেদের স্বাধীন চিন্তা ও সিদ্ধান্তে তারা কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হবে না। এই আন্দোলন রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও উন্নত একটা মডেল উপস্থাপন করেছে, তিউনিসিয়ার সাংবিধানিক সংসদে ইতোমধ্যে আন নাহদার ৪২ জন নারী মেম্বার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ইসলামী আন্দোলনগুলোর যোগাযোগ, সম্পর্ক বা আচরণেও এতোদিনে একটা দৃশ্যমান ব্যালেন্স তৈরি হয়েছে, এতদসত্তে¡ও যে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের এখনও একচেটিয়া সমর্থন রয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংম্পৃক্ততার গুরুত্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতারা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে কোনোরকম গ্যাপ রাখতে তারা প্রস্তুত নন

মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তন ও সাম্প্রতিক বিষয়াদির সামাজিক দৃষ্টিকোণ

আরববিশ্বের চলমান প্রতিরোধ ক্রমশ বাড়তে থাকা পশ্চিমা খবরদারি ও হস্তক্ষেপের বিপরীতে চাচ্ছে বড় একটা পরিবর্তন। এই মুহূর্তে অবশ্য পর্যবেক্ষক যে কারো পক্ষেই ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল যে, এই পরিস্থিতি মুসলিমবিশ্বকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে। আরববিশ্ব বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের ঘটিতব্য পরিবর্তনের তো অনেক কিছুই আছে।

আরব বসন্তের ফলাফল এবং এই অঞ্চলের কৌশলগত নানান অস্থিরতা ভবিষ্যৎ অনুমানের এ কাজকে আরো জটিল করে তুলছে। ব্যাপার আরও আছে। আন্তর্জাতিক বাস্তবতাসমূহ এবং সীমাহীন অর্থনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক পরিবর্তনও পরিস্থিতি জটিল করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে।

আরব বসন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে বলা যায়। সময় গড়াবার সাথে সাথে এটা আরো উন্নতি ও বিস্তার লাভ করবে। এটা শুধু সরকার পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হবে না, বরং আরববিশ্ব নিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং অন্যান্য দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে বাধ্য করবে। এটা নতুন ও সর্বব্যাপী একরকম বোধ ও সচেতনতা তৈরি করবে। আরব বসন্ত আমাদের হতাশা ও হীনমন্যতাবোধের দেয়ালগুলো ভেঙে দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক কল্পনার নতুন এক জগৎ নির্মাণ করবে, যা আমাদেরকে অনৈতিক ক্ষমতাচর্চা ও স্বার্থপরতার বিপরীতে আশাবাদী হতে শেখাবে। নতুন করে স্বপ্ন দেখাবে।

আরববিশ্ব তো সৌভাগ্যবান- কারণ এই বসন্তের সূচনা হয়েছে তিউনিসিয়ার মতো একটা দেশ থেকে। তিউনিসিয়া বিভিন্ন সমজাতীয় নৃতাত্তি¡ক ও উপদলীয় গোষ্ঠীর মিলিত একটা সমাজ হলেও একে শিক্ষার লেভেল, সামাজিক শ্রেণীবোধ এবং রাজনৈতিক সচেতনতার নানা দিক বিবেচনায় সহজেই বিভক্ত করা যায়; যে বাস্তবতাগুলো এই আন্দোলনকে সহনশীল একটা মাত্রা দিয়েছে। নয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারতো।

নিয়ন্ত্রণের রজ্জুটা কারো হাতেই থাকতো না। তিউনিসিয়ার এই অভ্যুত্থান অনর্থক বিরোধ বা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত সৃষ্টির বদলে অধিকার আদায়ের দারুণ একটা মডেল উপস্থাপন করেছে। এই মডেলের সূত্র ধরে দীর্ঘকালের জুলুম, বেপরোয়া দুঃশাসন এবং অনন্ত হতাশার নীচে দাফন হয়ে থাকা আরববিশ্ব নিয়ে আমরা নতুন করে আশাবাদী হতে পারছি।

আরব বসন্তের এই বিবর্তনধারা অব্যাহত থাকবে তিউনিসিয়ার মতোই; লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেনেও। এই দেশগুলোতে রাজনৈতিক বিরোধ এবং দলীয় লড়াই দিনকে দিন তীব্রতর হয়ে উঠার প্রেক্ষাপটে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দুর্বলতার কারণে, রাজনৈতিক অভিজ্ঞাতার অভাবজনিত কারণে এবং সুশাসনের সুদীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে এই দেশগুলোতে সামনে নানারকম সংকট এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হবে।

যে কোনো মূল্যে সবগুলো দলই চাইবে মসনদের দখল নিতে এবং ক্ষমতার রশি আঁকড়ে ধরতে। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে আশা করা অনুচিত- তবুও এমন দিন খুব দূরে নয় যে সংশ্লিষ্ট সব দল ও পার্টিগুলোই উপলব্ধি করতে শুরু করবে যে, স্থিতিশীল রাজনীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। তবেই স্বার্থক হবে তাদের আন্দোলন। সুফল আসবে আরব বসন্তের।

আরব বসন্তের ছোঁয়া পাওয়া বড় দুই দেশ সিরিয়া ও মিশরের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আমরা বিপরীতমুখী আচরণ লক্ষ করছি। বাশার আল আসাদের জুলুম ও দুঃশাসন গোপন কোনো ব্যাপার নয়। বাশার আল আসাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সিরিয়ানদের নাগরিক অধিকার।

সিরিয়ায় মডারেট শাসন গড়ার পক্ষে পশ্চিমা শক্তিগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু আরব রাষ্ট্রেরও সমর্থন আছে। তবে তারা চায় সিরিয়ায় এমন সরকার আসুক যারা ইসলামী আন্দোলন থেকে যোজন যোজন দূরে থাকবে তো বটেই, ইজরাইলের জন্য হুমকি হবে না এবং পশ্চিমেরও কাছে থাকবে।

অন্যদিকে তুরস্ক, কাতার ও মিশর চায় স্বৈরশাসনের কবল থেকে বেরিয়ে সিরিয়া নিয়মতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় আসুক। সিরিয়ানরাই নিজেদের দেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিক। তবে এসবের বিপরীতে রাশিয়ার প্রকাশ্য সমর্থনে ইরান চাচ্ছে যে কোনো মূল্যে বাশার আল আসাদকে টিকিয়ে রাখতে।

সবমিলিয়ে সিরিয়া এখন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। অনিশ্চয়তায় আটকে যাচ্ছে সিরিয়ানদের নাগরিক অধিকার।

এদিকে, মিশরের অবস্থা আরো করুণ। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা মুরসি সরকারকে ইতোমধ্যেই বিতর্কিত এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র- সারা বিশ্বে যারা গণতন্ত্রের ফেরি করে বেড়ানোর দাবি করে- অবৈধ এই সেনাঅভ্যুত্থানকে এবার তারা নির্লজ্জভাবে সমর্থন করলো।

আরবের সবচে জনবহুল এই দেশটি মাত্রই প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের রোডম্যাপ তৈরি করছিলো। পশ্চিমা শক্তিগুলোর উসকানি এবং সহযোগিতায় জেনারেল সিসি সাজানো এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিলেন। মুসলিম ব্রদারহুডের নেতাকর্মীসহ অসংখ্য নাগরিককে প্রকাশ্যে খুন ও কারান্তরীণ করলেন।

গণতন্ত্রের ঠিকাদারির দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে রা টুকু পর্যন্ত করতে দেখলাম না। তুরস্ক এই সেনাঅভ্যুত্থানকে সরাসরি অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। বিপরীত দিকে সৌদি আরব, বাহরাইন ও আরব আমিরাতকে দ্রুতই আমরা অবৈধ সেনাশাসকের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করতে দেখলাম।

আরব রাষ্ট্রগুলোতে সেনা বা স্বৈরশাসনের পক্ষে পশ্চিমের এমন সমর্থনকে বিশ্বরাজনীতির বোদ্ধামহল ও বিশ্লেষকগণ সরাসরি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ব্যক্ত করছেন, মিশরের প্রেক্ষাপটে যা নিয়ে আর লুকোছাপার কিছু নেই।

সংখ্যালঘু হিসেবে শ্রীলংকার মুসলিম সম্প্রদায়

এক দৃষ্টিতে দক্ষিণ এশিয়া

দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান বিরোধপূর্ণ আরববিশ্বের ঠিক বিপরীতে। অন্তহীন বিতর্ক, বিরোধ ও লড়াই-ই হলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রধানতম পরিচিতি।

শীতল যুদ্ধ, অযাচিত বিতর্ক, ছোট ও মাঝারি যুদ্ধ, সীমান্তসংঘাত এবং বারবার আছড়ে পড়া আফগান যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার চেহারাটাই বদলে দিয়েছে। ১৯৮৯-৯১ এর মধ্যে সোভিয়েত ব্লক যখন মুখ থুবড়ে পড়লো, (যুক্তরাষ্ট্রের কালজয়ী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী) ফ্রান্সিস ফুকিয়ামার মুখের হাসিটা আরো চওড়া করে দিতে তাকে আর তার বই ‘এন্ড অব দ্য হিস্টোরি’ (ইতিহাসের সমাপ্তি) নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।

বিভিন্ন দেশ নিজেদের পুনর্গঠন, সংস্কার ও নতুন বিশ্ববাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অবশ্য এই যুক্তিকে উপেক্ষাই কওে গেলো। কাশ্মীর সংকট, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অস্ত্র বাড়ানোর প্রতিযোগীতা এবং আফগানিস্তানের ভ্রাতৃঘাতী লড়াই এর মতো ঘটনাগুলো তাই ফিরে আসতে শুরু করলো প্রতিহিংসার চূড়ান্ত রূপ নিয়ে।

দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত পরিস্থিতি বরাবরই সংজ্ঞায়িত ও পরিচালিত হয়ে আসছে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের গতিধারা অনুসারে। এই দুটো রাষ্ট্রের যৌথ ঔপনবেশিক অতীত এবং দৃশ্যমান সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রচুর সাদৃশ্য থাকার পরও রাষ্ট্র দুটোর সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি অগ্রসর হচ্ছে শত্রুতা, অবিশ্বাস, বিরোধ ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। নিজেদের মধ্যে অনিরাপত্তা, শংকা, সংশয় ও সন্দেহের বাড়াবাড়িরকম উপস্থিতি দক্ষিণ এশিয়াকে নিউক্লিয়ার বোমার মুখোমুখি করার মতো উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

প্রতিবেশীদের মধ্যকার শান্তি ও স্থিতি, সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের মতো জরুরি ব্যাপারগুলো তো বরাবরই এখানে পলায়নপর থেকেছে। বেশিরভাগ তথ্যনির্ভর বা অনুসন্ধানী গবেষণাগুলোই দেখিয়ে চলেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার ‘অনন্ত বিরোধের’ এই বৈরী চিত্র সহসা দূর হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

এশিয়ার বিস্ময় শ্রীলংকার পরিচিতি

ভারত সাগরের তীরে অবস্থিত বহু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং বহু ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সমন্বিত এক দ্বীপরাষ্ট্র হলো শ্রীলংকা। সিনহলী শ্রীলংকার জাতীয় ভাষা, যা মূলত ব্যবহার করে এদেশের বৌদ্ধ ও খৃস্টান সম্প্রদায়। তামিল হলো প্রাদেশিক ভাষা, যা ব্যবহার করে শ্রীলংকার মুসলিম, হিন্দু এবং তামিলে বসবাসরত অল্পসংখ্যক খৃস্টান ধর্মবিশ্বাসী লোকজন। শ্রীলংকার উত্তর ও পূর্ব দিক ছাড়া বাকি পুরো দেশেই সিনহলী ভাষা ব্যবহৃত হয়। দেশজুড়ে ইংলিশের ব্যবহারও এখন ব্যাপকরকম।

শ্রীলংকায় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত, সাথে আছে বহু দলীয় গণতন্ত্র সম্বলিত স্বাধীন ও শক্তিশালী সংসদ। সমানভাবে সবার সমস্যা নিরসন ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রীলংকার সংসদে সকল জাতি-গোষ্ঠীর তাৎপর্যপূর্ণ উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং পুরো দেশকে মোট নয়টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে।

এই ব্যাপকভিত্তিক ক্ষমতাচর্চার অধিকার সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃত। তারপরও নানা কারণেই এমন ব্যতিক্রমী ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থাকেও বাস্তবতা বিবেচনায় পর্যাপ্ত মনে হয় না। স্থানীয় নির্বাচনের বিভিন্ন স্তরে মানুষের অংশগ্রহণের দুরাবস্থার দিকে নজর দিলে সহজেই বুঝে আসে বর্তমান সরকারব্যবস্থার প্রতি দেশবাসীর অনাগ্রহ বা অনাস্থার বিষয়টি। এশিয়াজুড়েই এই সমস্যা অবশ্য দিনদিন প্রকট হচ্ছে।

শ্রীলংকান মুসলিমদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

প্রাচীন লোকদের কাছে শ্রীলংকা পরিচিত ছিলো সিলন নামে। ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে শ্রীলংকার পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে এমন এক দেশ হিসেবে, যুগে যুগে যার বুকে বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত নাবিক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণপিপাসুরা যাত্রাবিরতি বা ব্যবসা করেছেন এবং দর্শন ও আতিথেয়তা লাভে মুগ্ধ হয়েছেন। শ্রীলংকার বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধ, তবে তাদের সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হিন্দু, মুসলিম, রোমান ক্যাথলিক ও খৃস্ট ধর্মের অন্যান্য ফর্মের লোকজনও রয়েছেন।

সাংস্কৃতিক দৌড়ে বাজির ঘোড়া সিনহলীদেরই; তামিল, মুসলিম বা এ্যাংলো শ্রীলংকানদের উপস্থিতি সেখানে গৌণই বলা যায়। জানসংখ্যার বিচারে শ্রীলংকায় মুসলিমদের অবস্থান ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবেই, মোট ২১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে যাদের উপস্থিতি মাত্র ১০%।

শ্রীলংকান মুসলিমরা নিজেদের আরব ব্যবসায়ীদের উত্তরাধিকারী দাবি করেন, যারা ব্যবসা পরিচালনার উদ্দেশ্যে আরব থেকে শ্রীলংকায় এসে আর ফিরে যান নি। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের আগেই আরব ব্যবসায়ীদের এমন ‘রয়ে’ যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। আর মুসলিমদের মতোই শ্রীলংকার তামিল জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও ১০%।

শ্রীলংকার মুসলিমদের দুটো উপদলে ভাগ করা যায়; মুর এবং মালয়। শ্রীলংকান মুসলিমদের প্রথম গ্রুপ- মুরদের নামকরণ করেছে পর্তুগীজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা। এরা মূলত আরববিশ্বের লোকদের মুর নামে ডাকতো, শ্রীলংকাতেও যেহেতু আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই ইসলামের প্রসার ঘটেছে তাই এখানকার মুসলিমদেরও ওরা মুর নামেই আখ্যায়িত করেছে।

আর মালয় মুসলিমরা হলেন মালয়েশিয়া ও পাশ্ববর্তী অঞ্চল থেকে আসা মুসলিমদের উত্তরাধীকারী। মালয় মুসলিমরা মুরদের থেকে স্বাভাবিকভাবেই ভিন্নরকম। শারীরিক দিক থেকে যেমন, ভাষাগত দিকে থেকেও। শ্রীলংকান মালয় মুসলিমরা তামিল ভাষা ব্যবহার করলেও তাতে প্রচুর পরিমাণ মালয় ভাষার মিশ্রণ লক্ষ করা যায়।

দেশ ও জাতির প্রতি শ্রীলংকার মুসলিমদের অবদান

শ্রীলংকান মুসলিমদের রয়েছে বর্ণিল ইতিহাস। যদিও তাদের শ্রীলংকার পর্তুগিজ ও ডাচ শাসনাধীন যুগের বঞ্চনা ও নির্যাতনের জাঁতাকলে সুদীর্ঘকাল পিষ্ট হতে হয়েছে। যুগে যুগে কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপের বিরুদ্ধে ওদেরকে নিরন্তর লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক বিচারেই অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে শ্রীলংকান মুসলিমরা পিছিয়ে তবে সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সামনে চলার এই অদম্য মানসিকতাই ওদের সালাম জানানোর জন্য যথেষ্ট।

আঠার শতকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ যখন ডাচদের কাছ থেকে শ্রীলংকার শাসনভার ছিনিয়ে নিলো, বেশিরভাগ স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীই নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে বৃটিশদের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। স্বকীয়তা বা ধর্মীয় স্বাধীনতার বদলে ওরা নিজেদের সাময়িক ভালো থাকাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। তবে মুসলিমরা খৃস্টীয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসন থেকে শুধু ধর্ম ও সংস্কৃতিই রক্ষা করেন নি, নিজেদের অর্থনীতিও পুনরুদ্ধার করেছেন। ধীরগতিতে হলেও বিরতিহীনভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

ভৌগোলিকভাবে ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল কেন্দ্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে শ্রীলংকার মুসলিম সম্প্রদায় পাশ্ববর্তী দেশ ও সংস্কৃতির মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখতে বাধ্য হয়েছেন, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই। নিজেদের প্রচেষ্টায় এই ক্ষীণতম সম্পর্কটাও যদি তারা না রাখতেন বা কোনো কারণে না পারতেন, তাহলে খুবই সম্ভাবনা ছিলো- তারা হয়তো ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগত পরিচয়ই হারিয়ে ফেলতো।

তবে এটাও পর্যবেক্ষণযোগ্য একটা ব্যাপার যে, এই চর্চার কারণে বহু অনৈসলামিক বিশেষত হিন্দুয়ানি রীতিনীতিও কালক্রমে ওদের সংস্কৃতি ও জীবনাচারে ঢুকে গেছে। এসবের মধ্যে কিছু তো সরাসরি ইসলামবিরোধী, যেগুলোর চর্চা এখনো কারো কারো জীবনে রয়ে গেছে। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার অভাব এবং ইসলামী জীবনাচারের উপলব্ধিগত দুর্বলতার কারণেই এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে শ্রীলংকান মুসলিমদের।

স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিলেমিশে বসবাস ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং শ্রীলংকার অর্থনীতিতে বড়রকম অবদান রাখার পরও উত্তর প্রদেশের হিন্দু বা তামিল জনগোষ্ঠীর তুলনায় শ্রীলংকার মুসলিমেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতির সাথে যে কোনো ধরনের সংঘাত থেকে ভালোভাবেই নিজেদের দূরে রাখতে পেরেছেন। সৎ, শিক্ষিত ও কঠোর পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী হিসেবে শ্রীলংকান মুসলিমেরা দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের যোগ্যতা অর্জন করেছেন এবং বেশ বড় সংখ্যার মাইনরিটি জনগোষ্ঠী হিসেবে শ্রীলংকার যে কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের সমর্থন আদায় করাটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

এটা মোটামুটি বলা যায় যে, শ্রীলংকার মুসলিম কমিউনিটি সেভাবে কোনো যুগেই দেশ শাসনে অংশ নেয় নি। তবে এটাও মানতে হবে যে, কোনোরকম আন্দোলন বা উচ্চবাচ্য ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে তারা দেশ ও জাতির প্রতি নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে গেছে। এর বিপরীতে আমরা অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিশেষত তামিলদের দেখেছি যুগের পর যুগ সশস্ত্র সংঘাত জারি রাখতে।

১৯৪৮ সালে বৃটিশ শাসন এবং একই সাথে প্রায় সারে চারশো বছরের ইউরোপের উপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে শ্রীলংকার মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের সমর্থন, অবদান ও কুরবানীও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই সত্য অস্বীকারের সুযোগ কারো নেই।

শ্রীলংকান মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিদ্বেষচর্চা

এটা নিছক একপ্রকার পাগলামো। ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করতে গেলে একরকম বিব্রতবোধ ও অসহায়ত্ব গ্রাস করে। কেউ একজন ঠিক কীভাবে এর ব্যাখ্যা করবেন? অথচ ব্যাপারটা বাস্তব। খুবই সামান্য সংখ্যক বিদ্বেষী লোক, একইসাথে নিম্নরুচিরও- দেশ বা জাতির প্রশ্নে যাদের আসলে কোনো ভূমিকাই নেই; এসব লোকদের দ্বারা শ্রীলংকা নামের এই বদ্বীপের শান্তিপূর্ণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আজকাল অনর্থক একটা চর্চা ছড়িয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট বিদ্বেষ ও ঘৃণাচর্চা। অহেতুক সমালোচনা ও অপপ্রচার।

এমন বৈরী বাস্তবতায় দাঁড়িয়েই মাহিয়াঙ্গনা রাজ্যে হঠাৎ আমরা বিদ্বেষপূর্ণ একটা পোস্টার দেখতে পেলাম, যাতে দেখানো হচ্ছে তরবারি হাতে ক্রোধান্ধ এবং খুন করতে উদ্যত এক লোক বলছে- ‘(শ্রীলংকা থেকে) মসজিদ হটাও।’ এই বিদ্বেষচর্চা ধীরে হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছে। আর ইদানীং ছোট হলেও বেশ সংগঠিত একটা গ্রুপের মাধ্যমে এই অপচর্চাটা হচ্ছে, যারা অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনে সিংহলি ও ইংলিশ মিলিয়ে কমবেশ প্রায় ১৯টি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায়কে হিংস্র হিসেবে চিত্রিত করতে চাইছে।

ইতোমধ্যে বড় দুটো দুর্ঘটনাও ঘটে গেছে। কিছুদিন হলো অনুরাধাপুরায় ৪০০ বছরের পুরনো একটা মুসলিম স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ঘটেছে দেশের প্রধান বৌদ্ধ উপযাজকের নেতৃত্বে দামবুল্লায় একটা মসজিদে জুমাবারদিনে আক্রমণ এবং জুমা আদায়ে বাধা দেওয়ার লজ্জাজনক ঘটনার পরপরই।

শ্রীলংকার ইতিহাসে এই প্রথম ধর্মীয় দুষ্কৃতিকারীদের হাতে কোনো মুসলিম স্থাপনা ধ্বংস এবং নামাজ আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মতো দুর্ঘটনা ঘটলো। এরপর থেকেই, সারাদেশে ছোট ও মফস্বলের মসজিদগুলোতে হামলার ছোট-বড় প্রচুর ঘটনার খবর বেরুতে দেখা যাচ্ছে।

মুসলিমদের সাথে বাণিজ্য বা অন্য কোনো উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ, বিশেষত জমি বিক্রয়ে অনুৎসাহিত করার বার্তা সম্বলিত প্রচুর লিফলেট দেশজুড়ে বিলি করা হচ্ছে। তারা কি আদৌ উপলব্ধি করে যে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রায় দশ লাখ শ্রীলংকান- যাদের বেশিরভাগই সিংহলি জাতির, শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। শুধু এটুকুই তো নয়- এই শ্রীলংকান প্রবাসীদের বার্ষিক আয় প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার- যা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বহুলাংশে ভূমিকা রাখছে।

আবার এই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোই শ্রীলংকার মোট তেলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই পূরণ করে। চা-সহ প্রচুর পরিমাণ দেশীয় পণ্য আমরা মুসলিম দেশগুলোতে রপ্তানী করি। হালাল খাবারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকায় প্রচুর মুসলিম পর্যটক শ্রীলংকাকে ভ্রমণ ও বেড়ানোর ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেন। এর বাইরেও প্রতিবছর মুসলিম দেশগুলো শ্রীলংকার উন্নয়নমূলক কাজে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দান করে।

তামিল গেরিলাদের দল (খঞঞঊ)-কে হারাতে পাকিস্তান, ইরান ও লিবিয়ার মতো মুসলিম দেশগুলোর তাৎক্ষণিক ও সময়ানুগ সহযোগিতা তো ইতোমধ্যে আমাদের জন্য অপরিহার্য প্রমাণিত হয়েছে। শ্রীলংকার এই রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়কালে খ্রিস্টান পাশ্চাত্য বা বৌদ্ধ প্রতীচ্য (এশিয়ান) কেউ এগিয়ে আসে নি। শুধু মুসলিম রাষ্ট্রগুলোই এসময় শ্রীলংকার দুর্দিনের বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- তামিল গেরিলাদের পরাজিত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় জাতিসংঘ যখন শ্রীলংকার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের প্রস্তাব পাস করতে যাচ্ছিলো, তখন বেশিরভাগ মুসলিম রাষ্ট্রকেই শ্রীলংকার পাশে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। ফলে শ্রীলংকা এড়াতে পেরেছে বড় ধরনের বিপর্যয়।

এই বাস্তবতাগুলোকে সামনে রাখলে সহজেই প্রশ্ন চলে আসে- বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচারের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে কে বা কারা বেশি উপকৃত হচ্ছে? তারা কি আদৌ জানে- ইহুদি জাতি যারা অত্যন্ত কৌশলে খিস্টান পাশ্চাত্য এবং উগ্রবাদী হিন্দু অধ্যুষিত ভারতকে মুসলিম জাতির বরিুদ্ধে খেপিয়ে রেখেছে, তারা এখন চক্রান্ত করছে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ জাতিকেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে?

বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশ- বাংলাদেশের রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে হামলাকারীরা স্থানীয় কেউ ছিলো না। বরং ওদেরকে বাইরে থেকে হায়ার করে আনা হয়েছিলো। আর এটাকে উসকানিমূলক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করলে খুব ভুল হবে বলেও মনে হয় না। কারণ, এই ঘটনা ঘটেছিলো শ্রীলংকার দামবুলায় বিখ্যাত মসজিদে বৌদ্ধদের আক্রমণের পরপরই। এদিকে বৌদ্ধজায়ার শতশত তীর্থযাত্রী যারা প্রতিবছর অন্যতম বৃহৎ বৌদ্ধবিহার (ইন্ডিয়ায় অবস্থিত) নালন্দা দর্শনে যান, ওখানকার গাইডকর্তৃক তাদের মনে মুসলিমবিরোধী ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার বিভিন্ন রিপোর্টও ইতোমধ্যে সামনে এসেছে। তারা শ্রীলংকার সিংহলি বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচার করছে- ইন্ডিয়ায় বৌদ্ধধর্ম নির্মুলে দায়ি মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন।

এমন অসংখ্য ঘটনা-নিদর্শন-প্রমাণ চারপাশে ছড়িয়ে আছে যাতে সহজেই অনুমান করা যায়- শ্রীলংকায় মুসলিমবিরোধী যে অপপ্রচার চলছে তা মূলত ওয়াশিংটন-তেলআবিব-নয়াদিল্লী জোটের উসকে দেওয়া হেট ক্যাম্পেইনেরই অংশমাত্র।

দিল্লী থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘দ্য মিল্লাত গ্যাজেট’ এর ২০০৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার সূত্রে পাওয়া খবর- ইন্ডিয়ান তথ্যমন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে-

সে বছর ইন্ডিয়ার সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংগঠনগুলো সাত হাজার আটশত সাতাত্তুর (৭৮৭৭) কোটি টাকার বিশাল অংকের বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে, ইন্ডিয়ায় মুসলিমবিরোধী অপপ্রচার ও দাঙ্গা বাধানোর খরচ ও উপাত্ত হিসেবে। ইন্ডিয়ার হিন্দু সংগঠনগুলো এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছে ইসরায়েল থেকে, ইউরোপের মাধ্যমে। ইসরায়েল সরাসরি অর্থ প্রেরণ করে না।

এনজিওগুলোর মাধ্যমে ইউরোপের বরাতে পাঠায়। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্ডিয়ান হিন্দু সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের ইসরায়েল সফরও বহুগুণে বেড়ে গেছে। তারা ইসরায়েলে গিয়ে ব্রেইনওয়াশড হচ্ছে এবং ইন্ডিয়ায় মুসলিমবিরোধী ক্যাম্পেইনের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এই ব্যাপারগুলো কি শ্রীলংকায়ও ঘটছে না? আমাদের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং অন্য অনেক পেশার লোকজনও আজকাল সমানে ইসরায়েল ভ্রমণ শুরু করেছেন। তাদের বেশিরভাগ লোকই ইসরায়েল রাষ্ট্রটির ব্যাকগ্রাউন্ড এবং এজেন্ডা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখে না।

শ্রীলংকান প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ইসরায়েলের অনুপ্রবেশ বেশ সহজেই উপলব্ধি করা যায়- কারণ সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কিছু রিপোর্ট ও আর্টিকেল সেগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে যাতে স্পষ্টতই ইসরায়েলের প্রতি সহমর্মিতা আর মুসলিমবিরোধী প্রোপাগান্ডা বেশ ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে।

ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী ক্যাম্পেইনের বৈশ্বিক উদ্যোগ

এটা সহজে অনুমেয়- যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইহুদি- যারা মিলিতভাবে সমগ্র খৃস্টান পাশ্চাত্য এবং উপমহাদেশের হিন্দুদেরকে মুসলিম উম্মাহর বিপক্ষে রাখার ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই ম্যানেজ করে আসছে আর এখন তারা মনোযোগ দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে।

এই কারণেই আমরা দেখতে পাচ্ছি- বাংলাদেশে বৌদ্ধমন্দির বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ও তাদের ঘরবাড়িতে অপ্রত্যাশিত এবং রহস্যঘেরা যেসব হামলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রচুর কলামিস্ট এবং তাদের সুযোগসন্ধানী ভক্তের দল খুব গভীরভাবে সেগুলোর অনুসরণ করছে এবং সংগঠিতভাবে সেগুলো প্রচারও করছে।

এই আক্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো- বাংলাদেশের মুসলিমদের সেখানকার সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের ওপর খেপিয়ে তোলা। যারা যুগ যুগ ধরে একটা পরিবারের মতোই বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, ইসলামের জন্য অবমাননাকর কিছু ছবি ২৫ বছর বয়সী বৌদ্ধ যুবক উত্তম কুমারের ফেসবুকে ট্যাগ করা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা চিটাগাংয়ের রামু বাজারে এই ঘটনাটি ঘটে।

ব্যাপারটা কীভাবে ঘটলো উত্তম কুমার জানতোই না। কে কখন কীভাবে তার ফেসবুকে এসব ছবি জুড়ে দিয়েছে সে খবর রাখে নি। তার ধারণা- কেউ একজন পরিকল্পিতভাবে তার ওয়ালে ছবিটি ট্যাগ করেছে যাতে বৌদ্ধ-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে।

তবে ব্যাপার ততক্ষণে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এই ঘটনার ঠিক পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর অচেনা কিছু লোক কর্তৃক কয়েকটি বৌদ্ধমন্দিরে হামলা হলো। পহেলা অক্টোবর আরো কিছু দুষ্কৃতিকারী প্রায় বারটি বৌদ্ধমন্দিরে হামলা চালালো, যেগুলোর মধ্যে তিন শতাব্দী পুরনো ঐতিহ্যবাহী সিমা বিহারটিও ছিলো। রহস্যঘেরা এই ঘটনাগুলো ঘটলো দৃশ্যত ফেসবুকে ইসলামের পক্ষে অবমাননাকর ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়ার প্রতিক্রিয়ায়।

এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে শ্রীলংকার মুসলিমদের মধ্যে ক্রমশ ভীতি সঞ্চার হচ্ছে- ইসলামবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের যে ধারা ইতোমধ্যেই দেশটিতে বিদ্যমান, বাংলাদেশের এই ঘটনার পর তাদের সে এজেন্ডা নিঃসন্দেহে তীব্রতা লাভ করবে।

এমন আশংকার বড় কারণ- বাংলাদেশে যারা আছে তারা তো প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতি দেখছে এবং যেমন হোক পেছনের কারণও উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু এখানে- শ্রীলংকায় তো খবর আসছে বা আসবে আরো রংচং ছড়িয়ে, বাস্তবতার চেয়ে উড়ো খবরকেই ওরা বরং লুফে নেবে। প্রকৃত সত্য জানা বা দু পক্ষের অবস্থা যাচাই না করে নিজেদের মতো করে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

সচেতন ও বিদ্বান মুসলিমেরা অবশ্য খেয়াল করছেন- শ্রীলংকায় এই মুসলিমবিরোধী ক্যাম্পেইন তীব্রতর হয়ে উঠেছে দেশটিতে ইসরায়েলের নানারকম উপস্থিতির পরপরই। মুভি, ব্যাঙ্গচিত্র এবং আরো নানা মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ইসলাম, ইসলামের নবী ও মুসলিম সম্প্রদায়কে হেয় করার প্রতিটি ঘটনা ও পদক্ষেপের সাথেই ইসরায়েলের সম্পৃক্ততা এখন তো আর গোপন কিছু নয়। ফলে শ্রীলংকায়ও এই আশংকাটা বাড়ছে।

যেমন আগেই বলা হয়েছে যে, বিশ্বইহুদি লবিগুলো যেসব দেশ ও শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের সমরাস্ত্র ইন্ডাস্ট্রি, তেল-বিনিময়, পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং আরো অন্যান্য বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়, তারা সেসব দেশের মাধ্যমে এই ইসলামবিরোধী ক্যাম্পেইন বা ইসলামোফোবিয়াগুলো ছড়ায়।

বিশ্বজুড়ে নিজেদের দাখলদারিত্ব, মুসলিম দেশ এবং মুসলিম জাতির সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের একরকম বৈধতা পাস করিয়ে নেওয়ার জন্য। মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে তারা যেখানে যা-ই করছে, বিশ্ববাসী যেনো সেগুলোর বিপক্ষে না যায়। সমর্থন না করলেও অন্তত যেনো নীরব থাকে।

চীন এবং ইন্ডিয়া এই ইসলামবিরোধী ক্যাম্পেইনের ব্যাপারে বরাবরই পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে এসছে। এই যুদ্ধোন্মাদনা ও দাঙ্গাবাজি কর্মকান্ডের সাথে তাদের কোনো বিরোধ বা বিপরীত প্রতিক্রিয়া নেই। কখনো ছিলোও না।

যেমন ইন্ডিয়ার বাস্তবতাই বিবেচনা করুন। ইন্ডিয়ান সরকার ও প্রশাসন ইসলামবিরোধী প্রোপাগান্ডার সাথে গভীর হৃদ্যতা লালন করেন, যেখানে এমনিতেই সাধারণ রাজনৈতিক ধারা সাংঘাতিকরকম ইসলামবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আমরা এক্ষেত্রে বরং সরাসরি ইন্ডিয়ান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট থেকেই জানতে পারি যে, ইসরায়েল ইউরোপের মাধ্যমে ইন্ডিয়ার ইসলামবিরোধী সংগঠন যেমন- রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস (জঝঝ)-এর কাছে আট হাজার দুইশত (৮২০০) কোটি টাকা পাচার করেছে।

যা আরএসএস এর দৃশ্যত উদার ও নিরপরাধ সামরিক শাখা ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’, যুব শাখা- ‘বজরং দল’ এবং রাজনৈতিক শাখা- ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ বা বিজেপি, ‘শিবসেনা’ ইত্যাদির বার্ষিক বাজেটের অংশ হিসেবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

পশ্চিমের এই ইসলামবিরোধী বৈশ্বিক ক্যাম্পেইনের সাথে চীনেরও কোনো সমস্যা নেই। বরং ৯/১১ ’র পর চীন নিজেদের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নানারকম বিধিনিষেধের বোঝা চাপিয়েছে। কোথাও কোথাও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে। এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিমপ্রধান জিংজিয়াং রাজ্যকে রীতিমতো দাস ক্যাম্পে পরিণত করেছে।

আজকের বাস্তবতায় সেখানকার উইঘুর মুসলিমদের এমন কোণঠাসা অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে যে ওরা এমনকি নিজেদের মধ্যে কথা বলতেও ভয় পায়। রমজানের রোজা, কুরবানি, দাড়ি রাখা ও ইসলামী পোশাক-আশাকসহ ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিধানের ওপর ওরা নানাবিধ বিধিনিষেধ এমনকি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে।

জিংজিয়াংয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক পলিসি ও ধর্মীয় বিষয়াদি প্রচারের জন্য সরকারিভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৮ হাজার ‘ইমাম’ নিয়োগ করেছে চীন। হাজার হাজার মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কুরআন শেখার হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এমনকি বিয়েশাদি, দাফন-কাফন, বিভিন্ন সামাজিক ও ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠান, বাড়িঘর বদলপরবর্তী প্রোগ্রাম এবং এমনকি মেয়েদের কানে দুল পরানোর মতো সামান্য ব্যাপার-স্যাপারেও উইঘুরদের বহুবিধ রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এরচে বাজে অবস্থা আর কী হতে পারে?

সমগ্র মুসলিমবিশ্বের গলা চেপে ধরতে এভাবেই যুদ্ধোন্মাদ ও দাঙ্গাবাজদের এখন প্রয়োজন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৌদ্ধদেরও ইসলামবিরোধী করে তোলা। সচেতন যে কারো উচিত হবে এই ভাবনা ও দৃষ্টিকোণ থেকেই এখানে- শ্রীলংকা, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে ঘটে চলা বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘাত এবং এ সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো পর্যবেক্ষণ করা।

শ্রীলংকান সাম্প্রতিক মুসলিমবিরোধী ইস্যুসমূহ

(ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা বিষয়ক সমস্যার ধরণ)

মোটামুটিভাবে এই তিনটি পয়েন্টেই এখানকার- শ্রীলংকান সিংহলি বৌদ্ধরা আমাদের বিপক্ষে অপপ্রচার চালায়। আপনি আরেকটু গভীরভাবে জানার চেষ্টা করলে দেখতে পাবেন- শুধু বৌদ্ধরা নয়, এখানকার সব অমুসলিমেরাই ঠিক এই পয়েন্টগুলোতেই মুসলিমদের সমালোচনায় বেশি সোচ্চার।

যে কারণগুলো তারা আমাদের দেখায়

মৌলিক যে কারণটা এক্ষেত্রে তারা প্রথমেই সামনে আনে সেটা হলো- মুসলিমদের সাথে সহাবস্থান সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ তারা বলে- কোনো মুসলিমকে বিয়ে করতে হলে প্রথমে ইসলামে কনভার্ট হয়ে নিতে হয়।

আর ইসলাম এক্ষেত্রে বলে রেখেছে- ইসলাম ধর্ম ছেড়ে কেউ অন্য ধর্মে গেলে তাকে হত্যা করতে হবে। সুতরাং মুসলিমদের সাথে বসবাস অসম্ভব। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় কারণ হলো- মাত্র ৭.৬% জনসংখ্যা নিয়েই শ্রীলংকার মুসলিমেরা দেশের বেশিরভাগ বিজনেসের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন।

প্রকৃত কারণ

এটা শুধু শ্রীলংকার মুসলিমদের জন্যই নয়, বরং বিশ্বের সকল মুসলিমদের ক্ষেত্রেই এই একই ব্যাপার ও বাস্তবতা। সেটা হলো সতর্ক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বের ৮০% অমুসলিম মিলে মাত্র ২০% মুসলিম জাতিকে একরকম ‘ক্যাম্পে’ আবদ্ধ করে রাখা। আপনি এই বাস্তবতা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, যদি সত্যিই আপনি জানেন যে এখানে শ্রীলংকায় আমাদের সাথে এবং বার্মা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশে অন্যান্য মুসলিমদের সাথে কেমন আচরণ করা হচ্ছে।

মুসলিমদের সাথে সহাবস্থান এই ধারার সূচনার ইতিহাস

রাব্বি মেইর কাহানে নামের এক ভদ্রলোক- যিনি আমেরিকায় জন্ম নেয়া একজন ইহুদি, পরে ইহুদি সংসদ সদস্য মনোনিত হন। তিনি ‘জিউস ডিফেন্স লিগ’ বা ইহুদি সুরক্ষা আন্দোলন (http://en.wikipedia.org/wiki/Jewish_Defence_League) নামে একটা কনসেপ্ট সামনে নিয়ে আসেন। যে আন্দোলনের প্রাথমিক বক্তব্যই ছিলো- ইসরায়েলের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলের পাশ্ববর্তী আরববসতিগুলোকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। এই লিংকে গিয়ে আপনি তার সম্পর্কিত ভিটিউটিও দেখতে পারেন- (http://youtube.com/watch?v=BI9PeQoa_2A)|

ব্যবহৃত পদ্ধতি

জিউস ডিফেন্স লিগ বা জেডিপির পরিকল্পনা- যে পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী এই অনিংশেষ লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে উদ্যত, এতে মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের কোনো ব্যাপার নেই। তারা শুধু চায় অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিতাড়ন করতে। জেডিপি নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে সেগুলো হলো-

  • মুসলিমদের ইসলামের প্রকৃত আকিদা থেকে সরিয়ে আনা বা ভুল ইসলামের চর্চা তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করানো।
  • সংখ্যাগুরু অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোকে এক কাতারে আনা এবং অমুসলিম দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া, যাতে প্রথম ধাপেই তারা নিজেদের ঈমান হারিয়ে ফেলে। (এই ভয়ের কারণেই মিয়ানমারের প্রচুর মুসলিম অন্যান্য ধর্মে কনভার্ট হয়ে গেছে)।
  • নিজেদের পরিচিতি ভুলিয়ে দিতে মুসলিমদেরকে সংখ্যাগুরু অমুসলিম সম্প্রদায়ের পোষাক-আশাক পরতে বাধ্য করা। এই প্রক্রিয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমদের সহজেই তাদের ঈমান থেকে দূরে সরিয়ে নিতে সক্ষম হবে। (ফ্রান্স, বৃটেইনসহ অন্য অনেক দেশই বোরখা বা অন্যান্য ইসলামী পোশাকের ওপর প্রকাশ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। )

আর মুসলিমরা এসবে রাজি না হলে বা এগুলো কোনো কারণে ঠিকঠাক কাজ না করলে- যারা প্রকৃত মুসলিম হিসেবেই বসবাস করতে চায় তাদেরকে অমুসলিম দেশগুলো থেকে নির্বাসিত করা।

ডিফেন্স লিগ বা প্রতিরক্ষা আন্দোলন

জেডিপি বিশ্বজুড়ে প্রতিটি অমুসলিম দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক পৃথক প্রতিরক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ইডিএল (EDL) বা ইংলিশ ডিফেন্স লিগ, এডিএল (ADL) বা আমেরিকান ডিফেন্স লিগ, আইডিএল (ওউখ) বা ইন্ডিয়ান ডিফেন্স লিগ এবং এমন একেরপর এক অসংখ্য ডিফেন্স লিগ। আপনি খুঁজলে ফেসবুকেই এই সকল ডিফেন্স লিগগুলোকে সারাবিশ্বে একই লোগোতে একটিভ দেখতে পাবেন। যারা নিজেদের দেশ থেকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বের করে দেয়া সংক্রান্ত নানা প্রকল্পে কাজ করছে।

আপনি ইন্ডিয়ান ডিফেন্স লিগে এমনও দেখতে পাবেন যে, হিন্দু, শিখ, খৃস্টান এবং অন্যসব অমুসলিম ধর্মের লোকেরা একত্র হয়ে কাজ করছে।

এই জেডিএল নিজেদের প্রথম প্রকাশ্য প্রচারণা পেয়েছে এনডিএল (NDL) বা নরওয়েয়ান ডিফেন্স লিগের ‘এন্ডার্স বেহরিন ব্রেইভিক’ নামের একজন লোকের মাধ্যমে যে নিজ দেশের ৯০ জনের বেশি মানুষকে একাই হত্যা করেছে এবং ‘2083 European Declaration of Independence’ নামে একপি পরিপত্র প্রকাশ করেছে যা আপনি চাইলে এই লিংক থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারেন- -(http://publicintelligence.net/anders-behring-breiviks-complete-manifesto-2083-a-european-declaration-of-independence/.

অনুগ্রহ করে আপনি পরিপত্রটির ১২৩৭নাম্বার পেজটি পড়ুন দেখতে পাবেন শ্রীলংকান মুসলিমদের নিয়ে সে কী লিখেছে। আপনি বইটি খুলে বসলে সহজেই অনুমান করতে পারবেন- ১৫১৫ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ এই রচনাটি একা একটা ব্যক্তির কাজ নয়।…

শ্রীলংকায় জেডিএলের পরিকল্পনার প্রকৃত বাস্তবতা

[জেডিএল- জিউস ডিফেন্স লিগ বা ইহুদি সুরক্ষা আন্দোলন]

২০০৪ সালে ফেরা যাক। সে বছর চারজন শ্রীলংকান নাগরিককে জেডিএলের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরায়েলে স্কলারশিপ দেওয়া হলো- তাদের কুরআনের ‘ভুল ব্যাখ্যা সম্বলিত ভার্সন’ শেখানোর জন্য। এই খবরটি তারা প্রকাশ করেছে- www.answeringislam.com এ। চারজনের নাম যথাক্রমে- জায়াবিরা, পেরামুনে রালা, উৎপলা এবং অপরজনের নাম জানা যায় নি।

ইসরায়েলে তাদের মগজধোলাই করা হয়েছে এবং শ্রীলংকায় মুসলিমবিরোধী অপপ্রচারের মিশনে নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের কার্যক্রমের কয়েকটা ধাপ নিচে তুলে ধরা হলো।

(আমাদের দেশে অনলাইনে বেশ কজন ‘নাস্তিক’ ইসলামের পণ্ডিত দেখা যায়, ইসলামের প্রত্যেকটা স্পর্শকাতর ইস্যুর অপব্যাখ্যা বিশেষ বিশেষ সময়ে তারা উৎপাদন ও প্রচার করেন। তাদের ইসলামি জ্ঞানের বহর দেখে অবাক হতে হয়। অনুমান করতে পারেন- তারা কারা? কোত্থেকে এই মহাজ্ঞান অর্জন করলো?… অনুবাদক)।

প্রধম ধাপ (তাদের উদ্ধৃতি অনুযায়ীই তুলে ধরছি)

  • অনলাইনে ইসলামবিরোধী টিম তৈরি

প্রথম ধাপ ইতোমধ্যে তারা সাফল্যের সাথেই শেষ করেছে। ইসলামবিরোধী ওয়েব সাইট, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামবিরোধী গ্রুপ তৈরি করে অপপ্রচার শুরু করেছে। অনেকগুলোর মধ্য থেকে কিছু সাইট ও পেজের এড্রেস এখানে তুলে দিচ্ছি (http://peramunerala.wordpress.comhttp://anniisa.wordpress.comhttp://musalmanuwa.wordpress.comhttp://sites.google.com/site/islamyanukumakda/lecher)

আর একই সাথে তারা শ্রীলংকায় সিংহলি ভাষায় গুগল বা উইকিপিডিয়ার যে কোনো ইসলামিক পরিভাষা বা তথ্য আপডেটের সুযোগও কুক্ষিগত করে বসে আছে। তাদের হাত হয়েই তথ্য আপডেট হচ্ছে, সুতরাং বিকৃতি বা অপব্যাখ্যার মাত্রাও তো বাড়ছে।

এটা শুধু শ্রীলংকায় বা সিংহলি ভাষাতেই নয়, ইসলামের তথ্য-পরিভাষা অনলাইনে আপডেটের এই চর্চাটা যে কোনো দেশের স্থানীয় ভাষায় ওরাই বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা বিরাট একটা প্রবলেম হয়ে দেখা দিচ্ছে।

দ্বিতীয় ধাপ

  • অনলাইন টিমগুলোকে এক কাতরে নিয়ে আসা

ইসলামবিরোধী থিমকে টার্গেটে রেখে এবং ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা সৃষ্টি করে অনলাইনে ওরা জড়ো করছে সাংবাদিক, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর-ছাত্র, ডাক্তার এবং বিশেষত বৌদ্ধ সন্নাসীদের।

তাদের বেশিরভাগই নিজেদের শিখে আসা ভুল ব্যাখ্যা সম্বলিত ইসলামী শিক্ষাটা বারবার করে তুলে ধরছে চমৎকার সব ভিডিওয়ের মাধ্যমে। খুবই পরিকল্পিত ও গোছানো এই ভিডিও সিরিজ। উপরোল্লেখিত সাইটগুলোতেও কিছু ভিডিও পাওয়া যাবে।

সম্প্রতি পয়াদায়ায় (প্রতি মাসে একবার করে আসা বিশেষ একটি বৌদ্ধ ধর্মীয় ছুটির দিন)- এ ওরা ‘বৌদ্ধ চিকিৎসক পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে স্থানীয় ডাক্তারদের এই ভিডিওগুলো প্রকাশ্যে দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। ভিডিওয়ের সূত্র- (http://dharmadveepayeiranama.blogspot.com/p/heart-breaking-sinhala-videos-of-muslim.html)

তৃতীয় ধাপ

  • অনলাইন গ্রপগুলোকে মাঠপর্যায়ে কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করা

মাঠ পর্যায়ের প্র্যাক্টিক্যাল কাজের ক্ষেত্রে ওদের প্রথম সাফল্য ছিলো অনুরাধাপুরায় ঐতিহ্যবাহী একটি মুসলিম স্থাপনা ধূলোয় মিশিয়ে দেওয়া। দেহিওয়ালা কুয়ারি রোড মসজিদ এবং নাভালা মসজিদ ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়া।

সংগঠিত এমন গ্রুপ থাকার পাশাপাশি ওদের রয়েছে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী এবং বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমন্বিত শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক- যারা এসব ঘটনার পেছনের ইতিহাস বদলে দিয়ে নতুন গল্প তৈরি করে তা প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম। সুতরাং কাজের ক্ষেত্রে তারা চাইলেই যে কোনোরকম আইনি জটিলতা এড়াতে পারে।

শ্রীলংকায় মুসলিমবিরোধী ক্যাম্পেইনের পেছনের বাস্তবতা

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার অনেক জায়গায় মসজিদ এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দরগাগুলোতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের অনাকাঙ্ক্ষিত ও উসকানিমূলক হামলা-ভাংচুর-প্রতিবাদী মিছিলের কারণে স্থানীয় মুসলিমদের মাঝে একপ্রকার ত্রাস এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।

শ্রীলংকার সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়- যারা বরাবরই অহিংস ও সাম্যের নীতি ধারণ এবং সবধরনের ঘৃণাচর্চা ও সংঘাতসৃষ্টির মানসিকতা বর্জন করার মতো আদর্শ মানবিক মূল্যবোধ লালন করে আসছে, যে উন্নত মানসিকতা অন্যান্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর সাথে যুগ যুগ ধরে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

শুধু তা-ই নয়- ৬২৭ খৃস্টাব্দে আরব ভূখণ্ডে যখন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ভার্সনের উদ্ভব ঘটলো, সে ঘটনার বিবরণও শ্রীলংকার প্রাচীন ইতিহাসে বেশ ভালোভাবেই রেকর্ড করা আছে। আরবের সাথে শ্রীলংকার যোগাযোগ ও সম্পর্ক অবশ্য আরো প্রাচীন।

ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে ৩০০ খৃস্টাব্দ থেকেই আরবের আহলে কিতাব লোকজন বিশ্বাস করতেন, প্রথম মানব এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রথম নবী হযরত আদমের আ. আগমন ঘটেছিলো এই দ্বীপদেশের পীদুরুদালাগালা নামের পাহাড়চূড়ায় এবং তিনি এই দেশে অবস্থানও করেছেন।

শ্রীলংকান মুসলিমেরা এই দেশ দখল বা উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এখানে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন নি। তরবারির জোরেও এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় নি। স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ আগমন এবং অবস্থানের মধ্য দিয়েই তারা নিজেদের আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।

উল্টো আমরা দেখি- উপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে এ দেশে খৃস্টধর্ম পাচার করা হয়েছে। এ দেশে খৃস্টান সম্প্রদায়ের যারাই আছেন, তারা সে উপনিবেশিক শাসনেরই উত্তরাধিকার বা ফলাফল।

শ্রীলংকার মুসলিমেরা জাতীয় ঐক্য এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য প্রাচীন যুগ থেকেই এই দ্বীপরাষ্ট্রের রাজা ও শাসকদের প্রতি আস্থা ও আনুগত্য বজায় রেখে এসেছেন। বৃটিশ ও ইউরোপীয় উপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সময়ও তারা সবার সাথে মিলে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছেন।

স্বাধীনতা উত্তর শ্রীলংকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধিকার আন্দোলন বা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের বহু ঘটনা ঘটলেও মুসলিম সম্প্রদায় অতীতের মতোই জাতীয় ঐক্য, শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছেন। কোথাও কোনোরকম দেশবিরোধী বা ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে তাদের সম্পৃক্ততার কোনো অভিযোগ নেই।

মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং সকল জাতির সম্মিলিত শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ব্যাপারে তারা ছিলেন বরাবরই আপোষহীন।

বৃহত্তর মুসলিমবিশ্বের অংশ হিসেবে শ্রীলংকার মুসলিমেরা এই বিষয়ে বরাবরই সজাগ ছিলেন যে, সাম্প্রতিক বিশ্বে ইসলামী বিশ্বাসের দ্রুত বিস্তারলাভের খবরে মুসলিমউম্মাহর শত্রুরা যারপরানই বিরক্ত। বৈশ্বিক বড় শক্তিগুলো মুসলিমবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে- ‘ইসলামিক জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, ইসলামিক জিহাদ, আল কায়েদা, তালেবান, আল শাবাব’ এবং এমন আরো অসংখ্য পরিভাষা ও টার্মগুলো শ্লোগান হিসেবে যতো বেশি ব্যবহার করছে, এমনকি শ্রীলংকার মতো এই ছোট্ট দেশেও; তুলনামূলকভাবে তারা সাফল্য পেয়েছে খুব সামান্যই।

জাতিগত ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়ার এই অপচর্চার ব্যাপারে শ্রীলংকার মুসলিমেরা বরাবরের মতোই নিজেদের সতর্ক অবস্থান ধরে রেখেছেন।

ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাবিশ্বের কাছে শ্রীলংকার কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। কারণ শ্রীলংকার অবস্থান একদিকে যেমন ভারত সাগরের তীরে, অন্যদিকে চেইনসিস্টেমে অনেকগুলো মুসলিমদেশের সাথেও এর রয়েছে বর্ডার সংযোগ।

পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের দোসরেরা তাই যে কোনো মূল্যে এ দেশে নিজেদের আগ্রহ ও প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চায়, বিশেষ করে জাতিগত সংঘাত (তামিল গেরিলাযুদ্ধ)- পরবর্তী শ্রীলংকায় চীন ও ভারতের প্রভাববৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে।

সবরকম হিসেবেই ইসলামী বিশ্ব এখন দ্রুত বর্ধনশীল এবং সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিশক্তির মিলিত ষড়যন্ত্রের বিপরীতে মুসলিমবিশ্ব সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বিচারিক আসনে নিজের অবস্থান সংহত করছে। আমরা আশা করবো- আমাদের মাতৃভূমি যেহেতু মুসলিমবিশ্বের সাথে বিভিন্ন জরুরি প্রেক্ষাপটসহ বরাবরই নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ রেখে আসছে, সুতরাং আজকের বাস্তবতায়ও মুসলিমবিশ্বের কাছ থেকে মর্যাদাপূর্ণ একটা অবস্থান উপভোগ করবে।

আমরা আরো আশা করবো- সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায় আরব মুসলিমবিশ্বের সাথে শ্রীলংকার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত স্থানীয় বা বৈশ্বিক কোনো শক্তিকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেবে না।

উপসংহার

এই নিবন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ এবং শ্রীলংকার সংখ্যালঘু মুসলিম ইস্যুটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুসলিম উম্মাহর রয়েছে প্রচুর সম্পদ ও শক্তি, তারপরও পুরো মুসলিম উম্মাহ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

কারণ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুসলিমউম্মাহর কর্তৃত্ব নেই, মুসলিম দেশ এবং ইসলামী আন্দোলনগুলোর মধ্যে নেই ঐক্যও। মুসলিম জাতি বড় দুটো গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে। পশ্চিমের প্রভাবে সেই দুটো গ্রুপের ভেতর তৈরি হয়ে আছে আরো অনেক গ্রুপ।

পশ্চিমাবিশ্ব বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের এক্ষেত্রে রয়েছে আরো বড় এজেন্ডা, মুসলিমবিশ্বে তারা বিরতিহীনভাবে অগ্রহণযোগ্য সব কাজ করে চলেছে। মুসলিম উম্মাহ আজ পতিত হয়ে আছে খুবই বাজে একটা পরিস্থিতিতে এবং তাদেরই উচিত- সবার আগে এই সমস্যা এবং এর পেছনের দর্শনটা বোঝা।

আরব বসন্ত যদি পুরো মুসলিমবিশ্বে সেক্যুলারদের পরাজিত করতে পারে তবে এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। (বাস্তবে সে টার্নিং পয়েন্ট সৃষ্টি হয় নি, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই গেছে- অনুবাদক।)

এখন সবার আগে আমাদের উচিত নিজেদের ব্যাপারে সৎ ও সচেতন হওয়া। নিজেদের বিশ্বনেতৃত্বের আসনে সমাসীন করার যে দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তেছে, আমরা তা পালন করতে পারি নি। উম্মাহকে গাইড করার ক্ষেত্রেও আমরা পুরোপুরি ব্যর্থ।

১৯২৪ সালে তুরস্কে আমরা ইসলামী খিলাফাহ হারিয়েছি, খুব শীঘ্র এই তুরস্ক থেকেই আমরা খিলাফার প্রত্যাবর্তন চাই। তুরস্কের দিক থেকে তেমন বহু নিদর্শন ইতোমধ্যে দেখাও যাচ্ছে। সুতরাং আল্লাহ চাহে তো আশাবাদী আমরা হতেই পারি।

সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি

সিদ্দীক মুহাম্মদ সুফিয়ান। শ্রীলংকার বেরুওয়ালায় অবস্থিত জামিয়া নালিমিয়া ইসলামিয়া থেকে ইসলামী শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। শ্রীলংকার এই জামিয়া নালিমিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী ইউনিভার্সিটি ফেডারেশনের স্থানীয় শাখা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি অনার্স করেছেন পেরাডেনিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে আর মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন কলম্বো ইউনিভার্সিটি থেকে। বর্তমানে তিনি শ্রীলংকার ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি দাওয়াহ এবং গবেষণামূলক লেখালেখিতেও নিয়োজিত রয়েছেন।


গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র

  • 2083 European Declaration of Independence
  • http://publicintelligence.net/anders-behring-breiviks-complete-manifesto-2083-a-european-declaration-of-independence/.
  • http://www.aljazeera.com/
  • http://www..ips.org.pk/
  • http://islamik-awakening.ir/
  • http://www.latheeffarook.com/
  • http://www.wadahkhanfar.com
  • http://www.wadahkhanfar.com/interviews/wadah-khanfar-discusses-iran-arab-uprisings
  • http://www.todayszaman.com/
  • http://www.eurasianet.org/node/66863
  • http://islam.uga.edu/hunwick.html
  • http://news.bbc.co.uk/2/hi/talking_point/special/islam/3136154.stm

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *