‘আলেমদের ধনসম্পদের কোনো লোভ থাকে না’

রাজনীতি

Date

Author

Blog Duration

4 minutes

নানাকে (মুফতি আমিনী রহ.) আমার মনে পড়ে। কখনো স্পষ্ট, কখনো বা অস্পষ্ট। পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ভেসে চলে কখনো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে, কখনো মেঘের আড়ালে। তবু তিনি আছেন আমার হৃদয়ের ছোট্ট ভূবনে। নূরে উদ্ভাসিত তার মুখখানা, প্রশান্ত দৃষ্টি- সবার জন্যই সান্ত¡না আর তার মন ভোলানো হাসি ছিলো সবার জন্য অমূল্য রতœ।

নানার অসুস্থতার খবর শুনামাত্রই যখন হাসপাতালে নানাকে দেখার জন্য ছুটে গেলাম, সিসিইউতে ঢুকে ছোট মামার মুখে শুনলাম, নানা আর নেই। কথাটা শুনে তখন মনে হচ্ছিলো, কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি বোধ হয়। বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছিলাম না। তবু মেনে নেওয়া ছাড়া তো কোনো উপায়ও নেই। কারণ, আল্লাহর ফয়সালার উপর তো কারো হাত নেই।

হাসপাতাল থেকে নানাকে সরাসরি বাসায় নিয়ে আসা হলো। পরিবারের সকলকে দেখানোর জন্য এম্বুলেন্সটি বাড়ির গ্যারেজে ঢুকানো হলো। সবাই একে একে উঠে দেখছে। আর আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে নানার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। সামনে থেকে দেখার জন্য গাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। কাছ থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো, নানা ঘুমিয়ে আছেন। আর মধুর কোনো স্বপ্ন দেখে মিটিমিটি হাসছেন। একবার কপালে চুমু খেতে ইচ্ছে হলো। মুখটা কপালের সামনে নিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, ছোঁয়া লাগলে হয়তো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে। তাই আর সাহস হলো না। গাড়ি থেকে নামার সময় আমি নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। নিজের কাছেই খুব অবাক লাগলো। আমি কখনো এভাবে কাঁদিনি। নানাকে কি আমি এতোটাই ভালোবাসতাম?..

নানার একটি বিষয় আমার কাছে খুব অবাক লাগতো। যতো বিপদ-আপদের ঘূর্ণিঝড় তার উপর দিয়ে বয়ে যাক, সর্বদা তিনি হাসি খুশি ও চিন্তামুক্ত থাকতেন। আমি প্রায় প্রতিদিনই এশার আগে বা পরে দেখা করতে যেতাম। স্বভাবত ইন্তেকালের আগের দিনও গিয়েছিলাম। শেষ দেখা হয়েছিলো ইন্তেকালের চার ঘন্টা পূর্বে। যখনই নানার সাথে দেখা করতে যেতাম, একটি মনভোলানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন- কি নানা, কিছু বলবি ?.. আমি না সূচক জবাব দিলে তিনি ফ্রীজ থেকে মিষ্টি খেতে বলে আবার কিতাব মুতালায়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।

নাতিদের মধ্যে আমি একটু কাছে থাকায় আমাকে বোধ হয় একটু বেশিই আদর করতেন। প্রায়ই ডেকে নিয়ে মিষ্টি, ফলমূল এটা সেটা খাওয়াতেন। তবে নানার এই মনোমুগ্ধকর হাসির মধ্যে যে কী রহস্য ছিলো তা আমি আজ পর্যন্ত উদঘাটন করতে পারিনি। মন যতোই খারাপ থাকুক, নানার এই হাসিটা দেখলে সব ভুলে যেতাম।

ঈদে আর যাই হোক, নানার সাথে দেখা করতে ভুল হতো না। নানার সাথে দেখা না করলে মনে হতো যেনো ঈদটাই অপূর্ণ রয়ে গেলো। তিনি যে কতোটা মহৎ ও উদার মনের অধিকারী ছিলেন, এটা যারা তাকে কাছ থেকে দেখেননি, তারা বুঝতে পারবেন না। পদ-পদবী ও ধনসম্পদের লোভ কখনো তাকে ছুঁতে পারেনি। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি করতে দেখে তিনি মন্তব্য করতেন,

আলেমদের রাজনীতি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদদের রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য হলো, তারা ধনসম্পদের লোভে রাজনীতি করে আর আলেমদের ধনসম্পদের কোনো লোভ থাকে না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন তিনি নিজেই।

দুই বছর আগের ঘটনা। ১৭ ই রমজান বদর দিবসে তিনি যে মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন, পুলিশ তাতে লাঠিচার্জ করে এক ছাত্রের হাতের হাড় ভেঙ্গে দেয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় চিকিৎসা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। তারপরও তিনি পুরো চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেই বহন করেন। আমি কয়েকদফায় পুরো টাকাটা এনেছি। লক্ষণীয় বিষয়টি হলো যখনই আমি টাকার জন্য যেতাম তার কাছে, যা টাকা থাকতো সব গুণেগুণে দিয়ে দিতেন। কোনো কিছু জমা করে রেখে দিতেন না। মোটকথা, এসব টাকা পয়সা থেকে সবসময় চিন্তামুক্ত থাকতেন ।

কিতাব মুতালায়ার অদম্য স্পৃহা ও গভীর মনোযোগের কারণে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। এমনকি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব আলেমদের তার সাথে মতানৈক্য ছিলো, তারাও কিতাব মুতালায়ার ক্ষেত্রে এই মুফতী আমিনীকেই উদাহরণ হিসেবে পেশ করতেন। অনেকছাত্র আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো, মাদ্রাসায় তো হুজুর সর্বদা কিতাব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাসায় তার সময় কীভাবে কাটে ?..আমি বলতাম, মাদ্রাসা আর বাসার মধ্যে পার্থক্য শুধু এতোটুকুই ছিলো যে, মাদরাসায় পাঞ্জাবী পায়জামা পরিহিত অবস্থায় মুতালায়া করেন। আর বাসায় মুতালায়া করেন লুঙ্গি গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায়।

নানার ইন্তেকালের প্রায় একমাস হয়ে গেলো। নানীও মানসিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাসায় গেলে নানির মুখে সর্বপ্রথম প্রশ্ন থাকে, তোমার নানাকে দেখে এসছো? সেখানে কোনো লোক কি কবর জিয়ারত করছিলো? কতজন লোক ছিলো? সবসময় কি মানুষ কবর জিয়ারত করতে থাকে ? তোমার নানার কবরের পাশে আর কোনো কবর খালি আছে?…

এ ধরনের আরো নানান প্রশ্ন। একে একে আমি সবগুলো প্রশ্নের উত্তরও দিই। কথা বলতে বলতে তিনি প্রায়ই আনমনা হয়ে যান। সেদিন আমাকে বলছিলেন, এক মিনিটের জন্যও মন স্থির করতে পারছি না। সবসময় অস্থির লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আল্লাহ কবে যে আমাকে তোমার নানার কাছে নিয়ে যাবেন!..বলতে বলতে তার গলা ধরে এলো। আমিও অশ্রু ধরে রাখতে পারলাম না। সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো সেই মুহূর্তটি, যখন নানা আল্লাহর দরবারে মাসুম শিশুর মতো কান্নাকাটি করতেন। তার শেখানো এই অশ্রুই এখন আমাদের শেষ হাতিয়ার।

জাতির ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে উজ্জীবিত করাই ছিলো যেনো তার প্রধানতম দায়িত্ব। বাতিলের সাথে কখনো তিনি আপোষ করেননি। ইসলাম ও জাতির স্বার্থেই তার এই আপোষহীনতা। আল্লাহ তায়ালা আমার নানার এই মুজাহাদাকে কবুল করুন, জান্নাতে তাকে সুউচ্চ মাকাম দান করুন, এই আমাদের প্রার্থনা।


লেখক- Ashraf Mahdi

নাতি, মুফতী আমিনী রহ.

শিক্ষার্থী : Al-Azhar University, جامعة الأزهر الشريف‎

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *