বাবা এমপি হওয়ার পর টানা তিন মাস বাসায় ডাল-ভাত ছাড়া কিছুই রান্না হয়নি (স্মৃতিতে মুফতি আমিনী রহ.)

mufti amini- আবুল হাসানাত আমিনী

Date

Author

Blog Duration

4 minutes

আমার বাবা (মুফতি আমিনী) কে ছিলেন, কী তার পরিচয় ছোটবেলায় এগুলো তো আমার বোঝার কথা নয়। বাবা তো বাবাই । আমি তাকে সেভাবেই পেয়েছি।

মনে আছে, মোটামুটি বড় হয়েও আমি তার কোলে গিয়ে বসে থাকতাম। সুদূর বি.বাড়িয়ায় যাওয়ার সময় পুরোটা রাস্তা তার কোলে বসে যাওয়ার কথা এখনো মনে পড়ে। বাবা বারবার বলছিলেন একটু নেমে বস না, তুই তো বড় হইসত। পাশের সিটে বস, আমার কষ্ট হয় না?… কে শুনে কার কথা!

একদম ছোট্টবেলা থেকে বাবার প্রতি অজানা কারণে এই টানটা আমার ছিলো। কিছু হলেই বাবা। পরিবারের অন্য কারো প্রতি সে তুলনায় তেমন টান কখনো অনুভব করিনি। এমনকি মায়ের প্রতিও না। এর কারণ আমিও জানি না। বাবার চোখ দেখলেই আমি ভেতরের সব খবর জেনে যেতাম। অনেক সময় নানারকম আবদার নিয়ে মাদরাসার অফিসে হাজির হতাম। তিনি বলতেন পরে নিস, এখন টাকা নেই। কিন্তু আমি তো জানি তার কাছে টাকা আছে কিনা। বলতাম-

আব্বা আপনার চোখ দেখেই আমি বুঝে ফেলতে পারি আপনার কাছে টাকা আছে কি নেই। তখন মুচকি হেসে ঠিকই বের করে দিতেন। বাবাহীন পৃথিবী আমি কখনো কল্পনা করিনি। বাবা নেই, বাবা নেই! এ প্রসঙ্গটা কী করে ভাবা যায়!

অনেকে আমাকে বলতেন একটু দায়িত্বশীল হও। বাবার পর তো তোমাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে। আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। এও কি সম্ভব, বাবা নেই! অথচ কী আশ্চর্য, সেই বাবাহীন পৃথিবীতেই আজ আমার বসবাস!

অন্যসবার মতো সবসময় বাবাকে আমরা কাছে পেতাম না ছোটবেলা থেকেই । কিন্তু এই শূন্যতাটা তিনি বুঝতে দিতেন না। কীভাবে ব্যাখ্যা করবো, এমন এক পরিবেশ তিনি গড়ে তুলেছিলেন, এমনভাবে সবাইকে প্রস্তুত করেছিলেন যে, তার অভাব-শূন্যতা আমাদের ভেতর অনুভূত হয়নি। মাদরাসার কাজ, নিয়মিত ওয়াজ-মাহফিল, ইসলামী রাজনীতি ও আন্দোলনের ব্যস্ততা এবং সর্বোপরি তার সার্বক্ষণিক কিতাব মুতালায়ার মধ্যেই তিনি ডুবে থাকতেন।

আবুল হাসানাত আমিনী
আবুল হাসানাত আমিনী

তবুও, কী এক জাদুর মায়াময়তায় যে তিনি আমাদের বেঁধে রাখতেন! কখনো মনে হতো না আমরা তাকে পাচ্ছি না, তিনি আমাদের পাশে নেই।

অসম্ভবরকম রুটিনবদ্ধ জীবন তিনি যাপন করতেন। সারাটা জীবন একই ধারায় কাজ করে গেছেন। তার কাজ শুধু বেড়েছে, ব্যস্ততার পরিধি শুধু বি¯তৃত হয়েছে। তবে পরিবর্তন হয়নি রুটিনে। রাতগুলো যথারীতি নির্ঘুম কাটাতেন । কিতাব মুতালায়া আর তাহাজ্জুদ রোনাজারিতে।

আমি যখন হেফজ বিভাগে পড়ি, রাতে ইস্তেঞ্জার জন্য উঠলে বা প্রায় প্রতিরাতেই ওঠতাম। তো ইস্তেঞ্জাখানায় যাওয়ার পথে তার রুমের দেয়ালে কান পেতে শুনতাম, তিনি অঝোর ধারায় কাঁদছেন, উচ্চ আওয়াজে।

কোনোদিন শব্দ না শুনলে দরজায় টুকা দিতাম, ভাবতাম আজ বোধ হয় ঘুমিয়ে গেছেন । কিন্তু সাথে সাথে তিনি দরজা খুলে ঠিকই সামনে দাঁড়াতেন। ভেতরে গিয়ে দেখতাম কিতাবপত্র ছড়ানো। লুঙ্গি, গেঞ্জি পড়ে আমার বাবা কিতাব মুতালায়ায় ব্যস্ত আছেন।

প্রতি মুহূর্তে এভাবে বাবাকে চ্যালেঞ্জ করে বারবারই পরাজিত হতাম। আমি করতাম মজার জন্য, কিন্তু জবাবে যা শুনতাম তা কেবল অবাক হওয়ার মতোই। একজন মানুষের পক্ষে এমনও কি সম্ভব?

অসুস্থ হলে মাঝে মধ্যে খুব বিচলিত হতেন। আল্লাহর দান বলে মাঝে মধ্যে থাকতেন স্বাভাবিক। কখনো কাঁদতেনও, ক্ষমা চেয়ে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম- আব্বা, এমন কেনো করেন? একেক সময় একেকরকম দেখা যায়! বললেন, আমাদের আকাবিরদের মধ্যে এ রকম অবস্থাই পাওয়া যায়। অমুক আকাবির এমন করতেন, অমুক আকাবির এমন। আমি তাদের অনুসরণ করছি মাত্র। এভাবেই প্রতিনিয়ত তার কাছে আমি পরাজিত হতাম। আজ তিনি কই?

ভীষনরকম ব্যস্ততার কারণে পরিবার- আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নেওয়া তার পক্ষে খুব বেশি সম্ভব হতো না। তবে সুযোগ পেলেই তিনি তাদের স্মরণ করতেন। বয়ান বা রাজনীতির কাজে সফরে গেলে সময় করে ঠিকই ওখানকার আত্মীয়দের খোঁজ নিয়ে আসতেন। দিন যতো গিয়েছে, বেড়েছে তার ব্যস্ততা। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তো আরো বেশি। বাবা আমার একরকমই ছিলেন। কখনো পরিবর্তন দেখিনি।

বাবা কাজ যেমন করেছেন, টাকাও তার কাছে এসেছে স্রোতের মতো। কিন্তু কই, কিছুই তো রেখে যাননি। বাতাসের গতিতে টাকা এলে তিনি খরচ করতেন বিদ্যুতের গতিতে। সবই ইসলামী আন্দোলনের জন্য। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আমাদের বিপুল সম্পত্তির ছিটেফোটাও তো আজ নেই। এই যে ঢাকায় বাড়িটা, এটা তো আজো ব্যাংক ঋনের ভারে ন্যুজ্ব।

টাকার প্রসঙ্গ তুললেই বলতেন, ওসব নিয়ে কখনো টানাটানি করবি না। কী হবে টাকা দিয়ে। শেষ জীবনে আমার বাবা কী দুরাবস্থার মধ্য দিয়েই না গেছেন।

অনেকে ভাবেন, বাবা এমপি হওয়ার পর আমাদের অবস্থা রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। অথচ বাবা এমপি হওয়ার পর আমাদের বাসায় টানা তিন মাস শুধু ডাল-ভাত ছাড়া কিচ্ছু রান্না হয়নি।

বাবা নীরব থেকেছেন। পরিবারের জন্য কখনো কারো কাছে কিছু চাননি। আজ এই অভাগা এতীম আমার ওপর বাবার সব দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমি কী করে এগুলো সামলাবো? বাবাহীনতার কষ্টে এমনিতেই আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে আছে। এ দায়িত্বগুলো পাওয়ার পর থেকে আমার কষ্ট আরো বেড়ে গেছে। শুধুই বাবার কথা মনে পড়ে। তবুও, কাজ তো করতেই হবে। আমাদের বড় অপ্রস্তুত রেখে বাবা চলে গেলেন। তার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেওয়াই এখন আমাদের কাজ। আমাদের একমাত্র সাধনা। এই করেই সান্ত¡না যা একটু পেতে পারি।

প্রতিরাতে শুতে যাবার আগে মনে হয়, এই বুঝি বাবা ডেকে পাঠাবেন। আদুরে গলায় বলবেন, দেখতো বাবা, প্রেসারটা কন্ট্রোলে আছে কিনা। কিন্তু না, বাবা ডাকেন না। মাত্র একবার বাবার ডাক শুনার অপেক্ষায় কাটে বুভুক্ষু আমার সকাল দুপুর।


লেখ: আবুল হাসানাত আমিনী; মুফতি আমিনী’র কনিষ্ঠ সাহেবযাদা এবং বর্তমান আমীর, খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশ

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *