মুফতি ফজলুল হক আমিনীর পরিবার

মুফতি আমিনীর পরিবার

Date

Author

Blog Duration

10 minutes

মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনীর পরিবার প্রচলিত অর্থের পরিবার ছিলো না। তার পরিবার ছিলো দেশজুড়ে পরিব্যাপ্ত। দ্বীনী শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যন্ত ছিলো এর বিস্তার।

তিনি তার কর্ম, বক্তব্য, সফর, সামাজিক ও রাজনৈতিক বহুমুখী কর্মসূচীর মাধ্যমে তার পরিবারের ব্যাপক পরিধি নির্মাণ করে গেছেন। ভাবছি তার কোনো পরিবার নিয়ে লেখবো। প্রথম কারণ, কলমের আঁচড়ে এসব ফুটিয়ে তোলার যোগ্যতা আমার নেই। তাছাড়া ইয়াতীমের মাঝে স্বভাবত যে দুর্বলতা আসে, তা আমার মাঝে অনুভব করছি অনেক গুণ বেশি।

এক সাহাবী নবীজীর ইন্তেকালের ব্যাপারে সাহাবাদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন- ‘বড়দের শূন্যতায় মনে হয় আমাদের দেহ থেকে কী যেনো উধাও হয়ে গেছে। কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে সেই অভাবটা আমরা প্রকটভাবে অনুভব করি’। হযরতের ইন্তেকালে আমার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে এমনই একটা শূন্যতা ।

দ্বীনী খেদমতকে পরিবারের উপর প্রাধান্য

হযরতের ব্যাপাারে একটি কথা প্রসিদ্ধ যে, তিনি পরিবার বিমুখ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি পরিবার বিমুখ ছিলেন না। দ্বীনী খেদমতকে পরিবারের উপর প্রাধান্য দিতেন। তাই তার সময়গুলো দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, দ্বীনী আন্দোলন, গভীর অধ্যয়ন ও মুতালায়াতে অধিক ব্যয় করতে দেখা গেছে। আকাবিরদের সুন্নত তো এমনই।

তার অর্থ-সম্পদের সিংহভাগ দ্বীনী আন্দোলনে খরচ করেছেন। এছাড়া ধনী পিতার ওয়ারিস হিসেবে প্রাপ্ত অন্যান্য সম্পত্তিগুলো ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে দ্বীনী আন্দোলনের ফাণ্ড তৈরির জন্য বিক্রি করেছেন। তাছাড়া এই পৃথিবীতে তার একমাত্র ক্রয়কৃত মূল্যবান জমিটিও ২০১১ সালে নারীনীতি ও শিক্ষানীতির ঐতিহাসিক আন্দোলন ও হরতালের জন্য ব্যায় করে গেছেন।

হরতালপরবর্তী প্রায় ৫০০-৫৫০ জনের অসংখ্য মামলায় ব্যয় মেটাতে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত নিজের টাকাই ব্যয় করেছেন। পাশাপাশি চলমান আন্দোলন ও মামলার ব্যয় মেটাতে কোটি টাকার অধিক পরিমান ঋণ নিজের কাঁধে গ্রহণ করেছেন।

‘হুজুর সংসার বিমুখ মানুষ ছিলেন’

মুজাহিদে মিল্লাতের পেছনে দায়িত্ব পালনকারী বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বিগত ৩ সরকারের আমলসহ মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। হযরতের বাসায় সান্ত¡না দিতে এসে একটি কথা বারবার আওড়াচ্ছিলেন, হুজুর সংসার বিমুখ মানুষ ছিলেন। তিনি সংসারকে গুরুত্ব দিতেন না। আসলেও তিনি সংসার বিমুখ ছিলেন…।

কথাগুলো সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে নিন্দনীয় হতে পারে। কিন্তু হযরতের ক্ষেত্রে অবশ্যই তার উল্টো। কারণ, তার সাংসারবিমুখতা ছিলো দ্বীনের খেদমতের খাতিরে। পরিবারের জন্য সময় ও অর্থ ব্যয়ে সংকোচননীতি অবলম্বন করার কারণে তাকে বাহ্যিকভাবে সংসার বিমুখ মনে হতো।

আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ.

আমার বিয়ের পরপর একবার আল্লামা ইসহাক ফরিদীর রহ. সাথে দেখা করতে গেলে বললেন,

‘সাইফুল মিয়া, তোমার শ্বশুর সাহেবের পকেটের হালতের মতোই হালত আমার পকেটের। তবে মুফতি সাহেব হুজুরের সৌভাগ্য যে, ঘরে একজন দক্ষ পরিচালক আছেন। তিনি মুফতি সাহেবের সামান্য দিয়েই ঘরের জরুরত ঘুচিয়ে দিতে পারেন। এদিক দিয়ে আমি আরো দুর্বল। তাছাড়া মুফতি সাহেবের ঘরের লোক তো বুযুর্গের আওলাদ। এমনিতেই তারা কানাআত ও তাওয়াক্কুল (অল্পেতুষ্টি ও আল্লাহ ভরসায়) অভ্যস্ত।…পরবর্তী প্রায় দশ বছরে এর যথার্থতা দেখেছি। দেখতে পাচ্ছি আজও।

হুজুরের বাসায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ

বিয়ের আগে হযরতের ঘর-দুয়ার নিয়ে দ্বিমুখী দুটো ঘটনা শুনেছি। একটি হযরতের ভাগিনা মাওলানা আশরাফুজ্জামান পাহাড়পুরী হতে শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, ২০০১ সালে খালুর অসুস্থতার সময় প্রেসিডেন্ট এরশাদ তার কিল্লার মোড়ের বাসায় আসেন।

বাসার গেইটে প্রবেশ করে ছোট-ছোট ঘর দেখে ভিতরে হয়তো কোনো বড় বাড়ি আছে ভেবে বললেন, কোন দিক দিয়ে হুজুরের বাসা? উপস্থিত লোকেরা বললেন, এটাই তো হুজুরের বাসা। ভিতরে প্রবেশ করেই এরশাদ সাহেব বললেন, ভাই কী অবস্থা! আপনি এমন বেড়ায় থাকেন! আপনার টাকার অভাব আছে নাকি? আর আমি যে বড় অংকের টাকা পাঠাতাম সেগুলোই বা কি করলেন?…খালুু বললেন, ভাই টাকা তো আপনি আমাকে দেননি। দিয়েছেন মাদরাসায়, দিয়েছেন আন্দোলনে। উত্তর শুনে এরশাদ সাহেবের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিলো তা সহজেই অনুমেয়।

আর উল্টো ধারণা দিয়েছিলো একটি বাতিল ফেরকার গুপ্তচর। ১৯৯৩ সাল থেকে কয়েকবারই আমাকে শুনিয়েছে যে, ভারত সরকারের সাথে আঁতাতের বিনিময়ে র’ ১০ কোটি মূল্যের ১টি বাড়ি আমিনী সাহেবকে গিফ্ট করেছে। নাউযুবিল্লাহ । আমাদের সহপাঠীদের প্রায় সবাই তা প্রত্যাখ্যান করলেও কেউ কেউ এতে বিভ্রান্ত হয়েছিলো বলে মনে পড়ে।

কী আশ্চর্য! এর কয়েক দিনের মধ্যেই দৈনিক ইনকিলাবের উপসম্পাদকীয়তে একটি খবর আসে। খবর হলো, র’-এর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মোস্টওয়ান্টেডের তালিকায় দ্বিতীয় নাম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর।

সেই উপসম্পাদকীয়তে এর প্রতিবাদ করা হয়। তাতে বলা হয় যে, মুফতি আমিনী দেশ ও ধর্মের স্বার্থে আপোষহীন হওয়ার কারণে এই তালিকা করা হয়েছে। বিয়ের পর কয়েকবার হযরতকে দেওবন্দ সফরের প্রস্তাব করেছিলাম। প্রতিবারই গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে অনিরাপত্তার কথা ভেবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন। দেওবন্দ ও আকাবিরদের এলাকা যিয়ারত না করার আফসোস করতেন।

মুফতি আমিনীর খাবারের মেনু

তার খাবারের মেনু অত্যন্ত সরল ছিলো। এক পিছ মাছ বা গোশত আর এক পদের সবজি ও ডাল। তার পরিবারের জন্যও এই একই মেনু ছিলো। শেষজীবনে এমনই দেখেছি। তবে স্বাভাবিক ভাত-রুটির চেয়ে সবজি-তরকারি বেশি খেতেন। মাদরাসায় অবস্থানকালে সবসময় বাসা থেকে খাবার এনে খেতেন। মাদরাসার খাবার খেতে খুব কমই তাকে কেউ দেখেছেন। খাবারের স্বাদ নিয়ে তার কখনো অনুযোগ থাকতো না।

সফরে কারো না কারো বাড়ি বা মাদরাসার মেহমান হতেন। মেজবানের সন্তুষ্টির খাতিরে হলেও তিনি যে কোনো বিস্বাদ খাবার গ্রহণ করতেন। খাবারের নোনতা, তিক্ততা, মিষ্টতা, ঝাল ইত্যাদি হওয়া নিয়ে তার কোনো বিরক্তি থাকতো না। তিনি খাবারের সময়েও যেনো দ্বীনী ফিকিরে আচ্ছন্ন থাকতেন।

তার ব্যাপারে প্রসিদ্ধি ছিলো, তাকে কোনো স্বাদহীন খাবার দেওয়ার পর সহধর্মিনী বা খাদেম বললেই হতো, ‘খাবারটা ভালো’ তিনি হেসে স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় সমর্থন করে বলতেন, আচ্ছা, খাবারটা খুব মজার। খুব ভালো। অথচ সেই খাবার অন্যদের জিহ্বায় একেবারেই অনুপযোগী প্রমাণিত হতো।

সফরে তিনি সঙ্গীদের খাবারের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতেন। বৈষম্য পছন্দ করতেন না, পুলিশ বা খাদেমদের সাথে নিয়ে বসতেন। সফরে সঙ্গীদের উন্নত খাবার নিশ্চিত করতে প্রায়ই সম্পূর্ণ পকেট খালি করতেন। অনেক সময় ঋণ করে হলেও তা অব্যাহত রাখতেন। এমনকি একবার কুমিল্লা শহরের বাইরে এক রেস্তোরায় খেতে বসে শহরের একজন শাগরেদকে ৩০০০ টাকা নিয়ে আসতে বললেন। ঋণ হিসেবে।

শাগরেদ হাজির হয়ে টাকাগুলো দিলে প্রায় দুই হাজার টাকা হুজুর সঙ্গীদের শুধু চা-নাস্তার বিল পরিশোধ করলেন। বাকি এক হাজার টাকা রেস্তোরার কর্মচারীকে হাদিয়া দিলেন।

শিয়রের পাশে কিতাবের স্তুপ

মাদরাসায় তার খানকার ন্যায় বাসায়ও বালিশের পাশে কিতাবের স্তুপ। শিয়রের সাথে লাগানো কিতাবের তাক। আর নামাজ-তিলাওয়াতের মুসল্লার সামনেই লাগানো থাকতো কিতাবের আলমারী। বাসায় প্রথমে ৬০-৭০ স্কয়ার ফিটের একটা চিলেকোঠা বানিয়েছিলেন একেবারেই নির্জন মুতালায়া ও ইবাদতের উদ্দেশ্যে।

বাসায় তিলাওয়াত করলেও জায়নামাজ পেতে কিবলামুখী হয়ে আদবের সাথে বসতেন।

১/১১ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সংবাদ দেখার উদ্দেশ্যে বাসায় কম্পিউটারের সাথে টিভি কার্ড লাগানো হয়েছিলো। হযরত কয়েকদিন খবর দেখেছেনও। কিন্তু ছোটদের কেউ কেউ টিভির অন্য প্রোগ্রাম দেখেছে জানতে পেরে অত্যন্ত নাখোশ হন। প্রচন্ড রাগে নিজ হাতে সেই কম্পিউটার ছুড়ে মেরে ভেঙে ফেলেন।

তার বাসার অতি সাদামাটা আসবাবপত্র দেখে তার অনেক রাজনৈতিক বন্ধু ও দূরাত্মীয়রা অবাক হয়েছেন। এই সাদামাটা বাড়ির জন্য বিপুল অংকের ঋণ করা হয়েছিলো। তিনি কেবল থাকার জন্য এই সামান্য আড়াই কাঠার জমিতে দুটি ফ্লোর করার পক্ষে ছিলেন। এর বেশি কাজ করতে বরাবরই সন্তানদের বারণ করতেন।

আমার গোটা পরিবারকে হত্যা করলেও কুরআনের আন্দোলনে আপোষ করবো না

সন্তানের প্রতি প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত ভালোবাসা সবাই লালন করে। কিন্তু আল্লাহ ওয়ালারা দ্বীনী মহাব্বতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। হযরত মুজাহিদে মিল্লাতের মাঝে বর্তমান যুগেও এই বিরল দ্বীনী মহাব্বত জাগ্রত ছিলো। এর প্রকাশ্য অনেক উদাহরণ রয়েছে। এদেশ ও বিশ্ববাসী ২০১১ সালে কুরআনবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রত্যক্ষ করেছে। কলিজার টুকরা সন্তানকে গুম করে হত্যার ভয় দেখিয়ে জালিম নব্য ফেরআউন হকের আন্দোলন হতে মুজাহিদে মিল্লাতকে রহ. পিছু হঁটাতে চেয়েছিলো।

কিন্তু মুজাহিদে মিল্লাত রহ. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাকে বা আমার এক ছেলে নয় আমার গোটা পরিবারকে হত্যা করলেও কুরআনের আন্দোলনে আপোষ করবো না’। গুম হওয়ার পর ৮ম দিন রাতে তাকে আমি যথাযথ আদব রক্ষা করে হাসানাত ভাইকে ফেরৎ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খায় ব্যাকুল হয়ে হযরতকে একটু নরম পন্থা অবলম্বন করতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি সেদিন কঠোর ভাষায় আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন।

সেদিনের কথাগুলো শুনে মুজাহিদে মিল্লাতের প্রতি আমার দ্বীনী শ্রদ্ধা ও আযমত কয়েক লক্ষ গুণ বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেছিলেন ‘আমার ছেলে কুরআনের ইজ্জতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না। আমার ছেলের জন্য আমার চেয়ে তোমার মায়া বেশি, এটা মনে করো নাকি। কুরআনের ইজ্জত বাঁচলে আমার সবই বাঁচবে। কুরআনের বে-ইজ্জতকারীদের সাথে আপোষ করলে আমরা আখেরাত হারাবো, দুনিয়া হারাবো। এমনকি আমার ছেলেও হারাবো। তুমি এখন যাও । দুয়া করতে থাকো।…একেই বলে আল্লাহর জন্য মহাব্বত। সন্তানদের প্রতি দ্বীনী মহাব্বতের আরো অনেক ঘটনা রয়েছে।

এমপি থাকাকালে ৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটা সুপারিশ করার আবেদন করে আমার এক পড়শী ভাই। হযরত কয়েক দিন অপেক্ষা করালেন। ইতোমধ্যে একটি সফরে আমাকে সঙ্গে নিলেন, সফরে দুটি মাহফিলেই হালাল হারামের বয়ান করেন। ফেরার পথে আমাকে বললেন, বাবা! এই সুপারিশ না হলে কোনো ক্ষতি হবে তোমার? বললাম, জ্বিনা।

বললেন আমি জানি এই সুপারিশটা বৈধ, হারাম না। কিন্তু এজাতীয় সুপারিশ মুশতাবিহাত-সন্দেহযুক্ত তাই না করাই ভালো। আর সবচে বড় ব্যাপার হলো, আমি চাই আমার তোমার আওলাদের পেটে যেনো হারাম তো দূরের কথা, সামান্য মুশতাবিহাতের দানাও না ঢুকে।

পরিবারের ছোটদের খেলার সঙ্গী

পরিবারের ছোটদেরকে ডাকার ক্ষেত্রে তার স্বর ও ভঙ্গি ছিলো মমতামাখা। পরিবারের শিশুদের প্রতি তার হৃদয়কাড়া সান্নিধ্যপ্রদান ছিলো অবিশ্বাস্য ধরনের। বাইরের কেউ দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে, সেই গম্ভীর শিক্ষক, দীর্ঘ মোনাজাতকারী সূফী, তেজস্বী বক্তা ও নিবিড় অধ্যয়নশীল ব্যক্তিটিই এই শিশুদের মাঝে একজন খেলার সঙ্গী, আনন্দের খোরাকদাতা।

আল-হামদুলিল্লাহ হযরতের চার কন্যা, দুই পুত্রের মাধ্যমে ১৭ জন নাতি-নাতনীর দাদা-নানা ছিলেন মুজাহিদে মিল্লাত রহ.। আর দুই জন প্রপৌত্রের প্রপিতামহ ছিলেন তিনি।

পরিবারের পাশাপাশি মাদরাসায়ও শিশুদেরকে শারীরিক শাস্তি দেয়ার ঘোরবিরোধী ছিলেন আমাদের হযরত।

জিন্দেগীর আখেরি বাইতুল্লাহর সফরে ভিসা না পাওয়ায় হযরতের সফর সঙ্গী হতে পারিনি । ২০১০ সনের সেই রমজানের শেষ দশকে মদীনা শরীফে অবস্থান করছিলেন।

একজন নাতি দুনিয়ায় আসার সময় তার এক কন্যার অসুস্থতার খবর পেয়ে বেহুশ হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। দুর্ঘটনার ব্যাপারে কাউকে জানাননি। কিন্তু বেহুশ হয়ে পড়ে যাওয়ার কারণে চেহারার একপাশে সম্পূর্ণ নীল হয়েছিলো। দেশে ফেরার পর রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখলেও সহধর্মিনীর চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি সেই আঘাতের চিহ্ন।

জিজ্ঞাসার পরে কারণ বলেছেন। আর আমি হতভাগা এই ঘটনা জানলাম ইন্তিকালের ১ মাস পরে। পরিবারের কাছে অসুস্থতার খবর শুনলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতেন। অসুস্থতার ক্ষেত্রে ওষুধপত্রের চেয়ে তিনি বিভিন্ন খাছ দোয়াকে প্রাধান্য দিতেন।

পারিবারিক অনেক বিষয়ে ‘তোমরাই পার্থিব বিষয়ে বেশি অবগত’ রাসূলের সা. এই বাণী অনুসারে অবস্থান নিতেন, যেমন কেউ বাচ্চার নাম চাইলে বলতেন, তোমরা দুই-তিনটা নাম বাছাই করো । আমি একটাকে পছন্দ করে দিবো। ঘর-গৃহস্থের বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত অন্যদের উপর ছেড়ে দিতেন। সবাইকে যার যার কাজের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করতেন।

দোষী ব্যক্তিকে গোপন রেখে নসীহত

কারো ব্যাপারে কোনো অভিযোগ জানালে বিশেষ হেকমত ছাড়া অন্যের সামনে তাকে নসীহতও করতেন না। অন্যের সামনে নসীহত করতে গেলে দোষ প্রকাশ করা হয়ে যাবে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি ভিন্নপন্থা অবলম্বন করতেন। হয়তো একান্তে তাকে তার ভুল ধরিয়ে দিতেন। অথবা মাদরাসায় ছাত্র বা শিক্ষকবৃন্দের মজলিসে দোষী ব্যক্তিকে গোপন রেখে নসীহত করতেন। যেমন বলতেন, আজকাল আমাদের অনেকে করে। অনেক উস্তাদের মাঝে বিষয়টি দেখা যাচ্ছে বা শোনা যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক…এভাবেই তিনি লাঠি না ভেঙে সাপ মারতেন।

রাজনৈতিক সহকর্মীদের ক্ষেত্রে এমনকি পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও তার এই নীতি ছিলো। এর গভীর হেকমত এ ছিলো যে, এই দোষে আরো কেউ দোষী হলে তাদের জন্যও এই নসীহত কার্যকর হতো। এটাই ছিলো আকাবিরের জীবনী ও তাদের মালফুজাতের অধ্যয়নে ডুবে থাকা মুজাহিদে মিল্লাতের হেকমতপূর্ণ ইসলাহী পদ্ধতি ।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সকল প্রয়োজনীয় শাস্ত্রের শিক্ষা জায়েজ এবং ক্ষেত্র বিশেষ ফরযে কেফায়া। কিন্তু আমাদের দেশে প্রয়োজন এবং অন্যান্য শাস্ত্রের তুলনায় দ্বীনী শিক্ষার্থী সংখ্যায় অনেক কম।

তাই হযরত মুজাহিদে মিল্লাত রহ. তার আওলাদবর্গের একজনকেও স্কুল-কলেজে পড়ানো পছন্দ করতেন না। ৩-৪ বছর আগে কোনো একজন আত্মীয়র সন্তানকে মাদরাসায় না পড়ানোর ব্যাপারে জেনে মনক্ষুণœ ছিলেন। তাকে সরাসরি কিছু বলেননি। বলেছেন বড় কাটারার ছাত্র-শিক্ষকদের আম জলসায়। এই নসীহতের ফলে আমার দেখা অনেক উস্তাদ সংশোধন হয়েছেন। অনেকে পূর্বের ভুল-কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন।

দ্বীনী মাদরাসার খেদমতে উদ্বুদ্ধকরন

শিক্ষার ন্যায় পরিবারের সবাইকে দ্বীনী মাদরাসার খেদমতে লেগে থাকতে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন। হযরতের একজন নিকটাত্মীয় কিছুদিন দ্বীনী খেদমতের বাইরে ছিলেন। সেসময় মদীনা শরীফে তার বন্ধুরা হযরতের সেই আত্মীয়ের কর্মস্থলের কথা জানতে চাইলে হযরত অকপটে বললেন, এখন টুকটাক ব্যবসায় আছে। ‘উস্টা’ খেয়ে কিছু দিন পরে খেদমতে ফিরে আসবে। দ্বীনী খেদমতের বাইরে কই যাইবো?

এর মাসখানেক পর একটি খাব দেখেন সেই সদস্য। হযরত খাবের তা’বীর বললেন, তোমার জন্য দ্বীনী খেদমত অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। অন্যথায় মসিবত তোমার পিছু ছাড়বে না। সেই সদস্য তখন থেকেই কারবার ছেড়ে মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত আছেন।

আসলে বড় মানুষদের কাজ বুঝতে হলেও বড় হতে হয়। চর্মচোখে যা দেখেছি, আমরা কেবল তা-ই বর্ণনা করতে পারি। হাকিকত বুঝার ক্ষমতা কি আর আছে আমাদের? শুধু এটুকু বলবো, সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন আকাবির উম্মতের নমুনা। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতবাসী করুন। আমাদেরকেও তার মতো করে কবুল করুন। আমীন!

লেখক- জামাতা, মুফতি আমিনী রহ.
মুহাদ্দিস, বড়কাটারা মাদরাসা

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *