মুফতি আমিনী রহ.: স্বপ্ন, বিপ্লব, কারাবরণ ও অন্যান্য

মুফতি আমিনীর কারাবরণ

Date

Author

Blog Duration

3 minutes


কেউ যদি তার উস্তাদকে হারায়, সে তার উস্তাদকেই হারালো। কেউ যদি তার শাইখকে হারায়, সে তার শাইখকেই হারালো। কেউ যদি তার পিতাকে হারায়, সে তার পিতাকেই হারালো। কিন্তু মুফতি আমিনীকে হারিয়ে আমরা আমাদের সব হারিয়েছি।

এ ব্যথা কী করে বরদাশত করবো?…

চলার পথে মনে হয় মাথার উপর আকাশ নেই, গাড়ির ছাদ নেই। চেয়ারে বসে অনুভূত হয় যেনো শূন্যে বসে আছি। নিজেকে দেখেও মাঝে-মধ্যে ভয় পেয়ে যাই। জীবনের সকল চাওয়া কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। ধূসর হয়ে গেছে হাজারো স্বপ্ন।

যে রুমে শুয়ে নিদ্রায় বিভোর থেকেছি অসংখ্য রাত, সে রুমে শুয়েও ঘুম আসছে না। আসলে আমি আমার প্রাণটাই হারিয়ে ফেলেছি। তিনি আমাকে ডাকতেন, ছুটে যেতাম। ছোটখাটো বিষয়েও ডাকতেন। অনেক সময় এমনিতেই ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন কী করছো, বলতাম- এই কাজটা করছি, ওই কাজটা করছি। মৃদু স্বরে বলতেন- আচ্ছা ঠিক আছে, করো।

মনে হয় দীর্ঘক্ষণ চোখের আড়ালে থাকলে ডেকে এটা ওটার বাহানায় খোঁজখবর নিতেন। কাছাকাছি রাখতে চাইতেন। তবে মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। ভাবনা হজম করার এক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তার। সবর করতেন।

ভাবতেন শুধুমাত্র ইসলাম নিয়ে, দেশকে নিয়ে

মুফতি আমিনীর পরিবার

ভুল হয়ে গেলে শুধু ক্ষমাই নয়, স্নেহের স্রোত বইয়ে দিতেন। আহ, এমন মানুষ কোথায় পাবো! ভাবতেন শুধুমাত্র দ্বীনকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে। কী করে ইসলামের প্রচার-প্রসার, কুরআনের বিধিবিধান বাস্তবায়ন হবে ইত্যাদি নিয়ে, ইসলামবিরোধী কর্মকা- প্রতিহতকরণে নানাবিধ পন্থা নিয়ে তিনি লিখতেন।

মুতালায়া করতেন। হারিয়ে যেতেন কিতাবের পাতায়। হঠাৎ কেউ প্রবেশ করে সালাম দিলে চেতন ফিরে পেতেন। বুঝার চেষ্টা করতেন কী হয়েছে। ওহ আচ্ছা, তুমি কেনো আসছো?..

তার বক্তৃতা বৃদ্ধ-যুবক-ছাত্র সকলের জন্য ছিলো আশা জাগানিয়া আহ্বান

তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, রোনাজারি, দরস-তাদরীস ছিলো তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। দরসে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যেনো শিশু বাচ্চাকে খাবার চিবিয়ে তার মা খাইয়ে দিচ্ছে। তিনি ওয়াজ করতেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তার বক্তৃতা হতাশায় নিমজ্জিত বৃদ্ধ যুবক ছাত্র সকলের জন্য ছিলো আশা জাগানিয়া আহ্বান

তিনি স্বপ্ন দেখতেন। নিজেও সে স্বপ্ন লালন করতেন। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। তার বক্তৃতা এবং তাকরীরে সে রূপরেখাই ফুটে ওঠতো। আশির দশক থেকে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু।

মুফতি আমিনীর কারাবরণ

১৯৮৪ এবং ’৮৬-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের রহ. পক্ষে নির্বাচনী কাজে এবং হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

’৯২-এ বাবরী মসজিদে লংমার্চ, ’৯৪-এ তসলিমাবিরোধী আন্দোলন, ধারাবাহিক এনজিও ও কাদিয়ানীবিরোধী আন্দোলন, ২০০১-এ ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন, কোরআনবিরোধী নারীনীতি, ইসলামবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ অসংখ্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

মিথ্যা মামলায় কারাবরণ ও মৃত্যু অবধি নজরবন্দী

মুফতি আমিনী

দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই আন্দোলনে বেশিরভাগ সময়ই তাকে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। এজন্য দুই দুইবার মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করতে হয়েছে। এবং সর্বশেষ মৃত্যু অবধি একুশ মাস নজরবন্দী থাকতে হয়েছে।

আর এই দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনে তার শক্তির উৎস ছিলো রূহানিয়্যত বা আধ্যাত্মিকতা। সকল কর্মকাণ্ডের মূলে আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসই ছিলো পুঁজি।

অন্যথায় রিক্ত হস্তে এহেন সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া কিছুতেই সম্ভব ছিলো না।

আল্লাহর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্কের প্রমাণ

আল্লাহর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্কের প্রমাণ তার রোনাজারি আর ইবাদতে শবগুজারী।

দীর্ঘ প্রায় বিশ বছর তিনি রাতে ঘুমাননি। তিলাওয়াত, দরুদ শরীফ, জিকির, নামাজ, কান্নাকাটিতেই কাটিয়েছেন।

লালবাগ মাদরাসা ও মসজিদের দ্বার-দুয়ার, ইট-বালি-কঙ্কর সে সাক্ষীই বহন করে আছে। দীর্ঘ ২৫ বছর সফরে-হজরে, ঘরে-বাইরে তার সঙ্গ পেয়ে এ অধমের অন্দরও সাক্ষী বনে গেছে।

তিনি দেশের বিভিন্ন গ্রামে ওয়াজ-মাহফিলে ও ইসলামী সম্মেলনে যোগদান করতেন এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে আবেগভরা কণ্ঠে আশাজাগানিয়া নসিহত করতেন। মুসলিম উম্মাহর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতেন, দেখাতেন। তার সে স্বপ্ন আজও দেশের লক্ষ তরুণ ছাত্রের বুকে লালিত হচ্ছে।

ইসলামী বিপ্লবের ডাক

মনে বড় সাধ ছিলো, একদিন তিনি ইসলামী বিপ্লবের ডাক দিবেন। তাতে এ অধমও কালিমার পতাকা উড্ডীনের জন্য শহীদী সুধা পান করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে। তিনি চলে গেছেন, কখনো আর ফিরে আসবেন না। অবশ্য একদিন আমাদেরকেও যেতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে।

তবে মরণ অবধি তার মিশন এগিয়ে নিতে যেনো কাজ করে যেতে পারি সেই আরজ প্রভুর দরবারে। আল্লহ পাক কবুল করুন। আমীন।


লেখক- মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন। জামাতা- মুফতি আমিনী রহ.। মুহাদ্দিস, লালবাগ জামেয়া

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *