ভারতে মুসলিম বসন্ত আসছে

Date

Author

Blog Duration

10 minutes


পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠির বাস ভারতে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশটি ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে যে সকল মুসলমান ভারতে রয়ে গিয়েছিলো, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অবিরত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। দেশটির মোট জনগোষ্ঠির ১৪% মুসলমান। কিন্তু চাকরী-বাকরি ও রাজনীতিতে তাদের বিপুল অনুপস্থিতি। তাদের অভিযোগ, তারা সুদূরপ্রসারী বৈষম্যের শিকার। ২০০৫ সালের একটি সরকারি কমিটির হিসেব মতে, দেশটির উচ্চপর্যায়ের চাকরিতে মুসলমানদের উপস্থিতি চার পার্সেন্টের নিচে।

১৯৯০-এর শুরুতে অর্থনৈতিক সংস্কার ও বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া দেশটির মুসলিম যুবকদের জন্যে আগের তুলনায় চাকরির পথ কিছুটা প্রশস্ত করে দেয়। যেখানে পূর্ববর্তী দশকে মুসলমানদের জন্য সরকারি চাকরি পাওয়া ছিলো রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। সময়ের পরিক্রমায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি ছোট ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ পেশাজীবী হিসেবে বেরিয়ে এসেছে। তারা যুক্ত হয়েছে মিডিয়া, আইটি ও ম্যানেজমেন্টে।

লন্ডনে ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক হাসান সারওয়ার সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম ‘ইনডিয়াস মুসলিম স্প্রিং : হোয়াই ইজ নোবডি টকিং এবাউট ইট?’। এ বইয়ে তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠির জেগে উঠার প্রবণতা আলোকপাত করেছেন।

ইনডিয়াস মুসলিম স্প্রিং : হোয়াই ইজ নোবডি টকিং এবাউট ইট?’
ইনডিয়াস মুসলিম স্প্রিং : হোয়াই ইজ নোবডি টকিং এবাউট ইট?’

আরেকটি বই লিখেছেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সাজ্জাদ। তাঁর বইটির নাম ‘মুসলিম পলিটিক্স ইন বিহার : চ্যাঞ্জিং কন্টুরস’। এ বইয়ে তিনি ঐতিহাসিক অতীত, বিশেষ করে দেশভাগের কালে মুসলমানদের অবস্থা তুলে ধরে তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানিয়েছেন।

ভারতের মুসলমানদের চলমান পরিবর্তনশীলতা অনুধাবন করতে সম্প্রতি (2014) আল জাজিরার সাংবাদিক সাইফ খালিদ এই দুই লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। নতুন ডাকের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করা হলো- ফায়যুর রাহমান

মুসলিম পলিটিক্স ইন বিহার : চ্যাঞ্জিং কন্টুরস
মুসলিম পলিটিক্স ইন বিহার : চ্যাঞ্জিং কন্টুরস


প্রশ্ন : ভারতের মুসলমানদের মধ্যে মূলধারায় যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা কতোটা শক্তিশালী? ‘মুসলিম বসন্তের’ উপযুক্ত হতে বর্তমান জাগরণ কি যথেষ্ট?

হাসান সারওয়ার : এটা যথেষ্ট প্রশংসনীয় অগ্রগতি, যেটা আমার বইয়ে আমি বলেছি। তবে এটা কোনো সংগঠিত আন্দোলন নয়। মানুষ কোনো তরঙ্গায়িত আন্দোলন কিংবা বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। বরং এটা নীরবে ঘটে যাচ্ছে।

আমি ‘মুসলিম বসন্ত’ টার্মটা রূপক অর্থে ব্যবহার করেছি, এ বিষয়টার দিকে জোর দিতে যে, মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত জাগছে, তাদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তনের একটা ছোঁয়া লেগেছে।

শিক্ষা ও চাকরিতে মুসলমানদের উপস্থিতির নিম্নহার অবশ্য ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ‘মুসলিম বসন্তের’ যে বিষয়টা আমি বলেছি, সেটা মূলত একটা প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়াটা মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা থেকে সৃষ্ট। এ পশ্চাদপদতার জন্য মুসলিম তরুণরা সরকারের পক্ষপাতিত্ব, মুসলিম নেতৃত্বের দুর্বলতা ও পূর্ববর্তী মুসলিম প্রজন্মকে দোষারোপ করছে। সবমিলিয়ে মুসলিম তরুণরা এখন চায়, নিজেদের দায়িত্ব নিজেরাই তুলে নেবে। যার ফলে রাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব ও নেতৃত্বের দুর্বলতার দুর্নাম ঘুচবে।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : ভারতে মুসলিম জাগরণ এখন বেশ চোখে পড়ার মতো। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার একটা গভীর আকুতি কাজ করছে।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা শক্তিশালী উপলব্ধি কাজ করেছে যে, নেতারা মুসলমানদের আবেগপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়েই কেবলই রাজনীতি করেছে। এই রাজনীতিটা এখনো চলছে।

যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে রাজনীতি, মুসলিম পার্সোনাল ল’ নিয়ে রাজনীতি, সরকারি চাকরিতে উর্দূ ভাষার সংযোজন নিয়ে রাজনীতি, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যালঘুদের স্ট্যাটাস নিয়ে রাজনীতি, আরো কতো কী। নেতাদের এই রাজনীতির ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, বিশেষত বিহারে মুসলমানরা সংগঠিত হতে শুরু করে। তারা তাদের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার আদায়ের দাবি তোলে। রাষ্ট্রের অন্যায় আচরণ ও বৈষম্য কমানোর আওয়াজ তোলে।

এ আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন জায়গায় বিশেষত বিহারের পসমন্দে, নিজেদের অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছে। নিজেদের দুঃখ ঘুচাতে এবং সরকারি চাকরিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে মুক্তকণ্ঠে আওয়াজ তুলছে।

প্রশ্ন : মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্ষণশীলতা কমে যাওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

হাসান সারওয়ার : মুসলমানদের মধ্যে একটা বোধ কাজ করছে যে, ভুল অগ্রাধিকার থেকে সরে আসতে হবে। আরেকটা উপলব্ধি এখানে কাজ করছে যে, যদি মুসলমানরা উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে চায়, তবে অবশ্যই পশ্চাদমুখি গাছের ছায়া থেকে সরে আসতে হবে।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : ভারতের স্বাধীনতাপরবর্তীকালে মুসলিম সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমাগত বেড়েছে। এটা রক্ষণশীলতা কমে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে।

ভারতীয় গণতন্ত্রের সফলতা হলো দেশের ভূমির সংস্কার, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমিয়ে আনা।

১৯৮০ সালের প্রথম দিকে ওপেন পাসপোর্ট পলিসি প্রণয়ন, যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মুসলমানদের কর্মসংস্থানের একটা পথ খুলে দিয়েছে। ১৯৯০-এর শুরুর দিকে মন্ডল কমিশনের রিপোর্টে যে সুপারিশ করা হয়, তাতে মুসলমানদেরকে সরকারি চাকরিতে অন্তর্ভূক্তির সুপারিশ ছিলো। এরকম কিছু উন্নয়ন সংবিধান ও রাষ্ট্রের প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস ও সংযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে রক্ষণশীলতা কমে গেছে।

প্রশ্ন : মুসলমানদের নতুন প্রজন্ম বেশি ধার্মিক, কিন্তু একই সঙ্গে বেশি সেক্যুলার ও বিশ্বজনীন। তবুও কেন মুসলমানদের বেশভূষা ও পোষাকআশাক অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করে? বিষয়টা কীভাবে সুরাহা হবে?

হাসান সারওয়ার : আমি আমার বইয়ে ব্যাপরটা বিস্তর বলেছি।

ভারতের মুসলিম তরুণদের মধ্যে তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটার যে প্রবণতা, এটা আসলে পশ্চিমের নাইন-ইলেভেন ডিসকোর্সের একটা অংশ।

আমেরিকান কালোদের ইতিহাসের সাথে এর বেশ মিল রয়েছে। আমেরিকান কালোরা তাদের কালোত্বকে সম্মানের প্রতীক হিসেবে গণ্য করেছিলো। ‘কালো’ পরিচয়টা দিতে তারা গর্ববোধ করতো। তারা বলতো, আমরা কালো তাতে কী, আমরা আমেরিকান, এবং কালো আমেরিকান বলে আমরা গর্বিত। আমি মনে করি, একটা সংস্কৃতিকে আরেকটা সংস্কৃতির মধ্যে গুলিয়ে ফেলা কখনোই উচিৎ নয়। সেটা যতোই প্রগতিশীল চিন্তা থেকে হোক। সবচে’ বড় কথা হচ্ছে, মুসলিম তরুণদের এই প্রবণতাটি আসলে নাইন-ইলেভেন পরবর্তী ইসলামোফোবিয়ার একটা প্রতিক্রিয়া।

এনআরসি

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : কারো ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে ‘রক্ষণশীলতা’ ‘জাতীয়তাবিরোধী’ ও ‘দেশপ্রেমহীনতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা উচিৎ নয়। ধর্ম কখনোই রক্ষণশীলতার জন্ম দেয় না কিংবা অন্য সম্প্রদায়কে ঘৃণা করতে শেখায় না।

বর্তমান বিশ্বায়নের এই যুগে, আধুনিক মুক্ত অর্থনীতির এই কালে, পৃথিবীর সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেই একটা ভয় কাজ করে। সেটা হচ্ছে, তারা মনে করে তাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়টা আজ হুমকির মুখে।

ফলে তারা আপেক্ষিকভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি লালনে বেশি মনোযোগী। বিশ্বায়ন জনগণের একটা অংশকে তাদের পরিচিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গান্ধীজী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ভারতে সবধরণের বহুত্ব প্রদর্শন করে গেছেন। ধর্মীয় প্রতীক ও অনুশীলন বজায় রেখেও যে একসঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেটা দেখিয়ে গেছেন।

প্রশ্ন : ‘মোল্লা বনাম মার্কসবাদী’- এই বাইনারিটার ব্যবহার কি আপনার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়? মুসলমানদের পশ্চাদপদতার জন্য কি শুধু মোল্লারাই দায়ি?

হাসান সারওয়ার : আমি শুধু একা মোল্লাদের দায়ি করি না। প্রগতিশীল মুসলমানরাও কম দায়ি না। কারণ এরা ইতিহাসের ডায়েরী তাদের হাতে রাখেনি। ফলে যুগে যুগে মোল্লাদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রচেষ্টা হয়েছে। এভাবে সমাজ ও মোল্লাদের মাঝখানে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে তুচ্ছ রাজনীতিকরা। তারা এই শূন্যস্থানে দাঁড়িয়ে দাবি করছে তারাই মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা, তারাই প্রতিনিধিত্ব করছে মুসলিম সমাজের। ঘটনা তো আসলে তা না।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল উপলব্ধি ও জানাশোনার অভাবের কারণেই এ ধরণের বাইনারি গণিত গজিয়ে ওঠেছে। এই ধরণের ভুল ধারণা মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থকে পরাজিত করছে। বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্যকে ব্যহত করছে। রক্ষণশীলতা তো কেবল মোল্লাদের একার নয়, অন্যরাও তো এর কম অংশীদার নয়।

আমি মনে করি রক্ষণশীল রাজনীতি শুধু মোল্লারা করে না, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও করে। করে পলিটিশিয়ানরাও।

সত্যি বলতে কী, আধুনিক শিক্ষিত নেতৃত্বের সঙ্গে যদি মোল্লাদের তুলনা করি, তাহলে দেখবো, মোল্লারাই অর্থবহভাবে সাধারণ মানুষের বেশি কাছাকাছি। সাধারণ মানুষের সাথে মোল্লাদের সম্পর্ক দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ।

উপনিবেশবাদের প্রতিরোধ ও ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগকে যদি প্রগতিশীলতাবিরোধী কর্ম বলি, তাহলেও দেখবো, এক্ষেত্রে মোল্লারা আধুনিক নেতৃত্ব থেকে অনেক এগিয়ে ছিলো। মোল্লাদের অবদানের রেকর্ড আধুনিক শিক্ষিতদের তুলনায় ঢের বেশি ছিলো। দেওবন্দের আলেমরা একই সঙ্গে কলোনিয়ালিজম ও সেপারেশনের জন্য লড়েছিলো। মুসলিম লীগ এখানে তাদের অংশীদার ছিলো শুধু অমোল্লাদের প্রতিনিধি হিসেবে।

প্রশ্ন : মুসলমানদের নির্বাচনী এজেন্ডায় কখনোই জীবনের নিরাপত্তার বাইরে শিক্ষা-চিকিৎসা ও চাকরির ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না। কেননা মুসলমানদের নিকট দাঙ্গা একটা আতংকের নাম। এই দাঙ্গা বন্ধের আকাঙ্খা কীভাবে পূর্ণ হবে বলে আপনার মনে হয়?

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : আমি মনে করি দাঙ্গাবাজদের শাস্তির আওতায় না আনাটা ভারতের রাষ্ট্র ও তার ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের একটা বড় ব্যর্থতা। ‘প্রগতিশীল’ ও ‘রক্ষণশীলের’ লেভেল লাগিয়ে এখানে মুসলমানদেরকে সবধরণের রাজনৈতিক শোষণের মধ্যে রাখা হয়েছে।

মুসলমানদেরকে নাগরিক মর্যাদা দেওয়ার বদলে একটা ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের সবধরণের বৈধ অধিকার দেওয়ার বদলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয় দেখিয়ে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাকে বড় করে দেখানো হচ্ছে।

ফলে নির্বাচনী এজেন্ডায় এটাই বড় ইস্যু হয়ে যাচ্ছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, চরমপন্থা অবলম্বন ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে ঢুকে পড়ার অভিযোগে কেবল সংখ্যালঘু মুসলমানরাই দায়ি হবে কেন? সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ডানপন্থী গ্রুপ (যেমন রামসেনা), বামপন্থী (যেমন মাওবাদী, নকশাল), এরাও তো চরমপন্থী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কই, তাদের বেলায় তো এতোটা উচ্চবাচ্য করা হয় না, যতোটা মুসলমানদের বেলায় করা হয়!

প্রশ্ন : মুসলমানরা যে বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে, এটাকে কি সংখ্যালঘু পার্সী সম্প্রদায়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়?

হাসান সারওয়ার : সংখ্যালঘু পার্সীদের সঙ্গে তুলনা করা যেতো, যদি মুসলমানরা একটি ছোট্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হতো। যারা ১৭০ মিলিয়নের শক্তিশালী একটা কমিউনিটি, যাদের রয়েছে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ও উন্নতির পথে অভিযাত্রা, তারা কেন অন্যদের সঙ্গে তুলনীয় হবে?

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : পার্সীদের ব্যাপারে আমার জানাশোনা সীমাবদ্ধ। তাই এ বিষয়ে আমি কথা বলবো না। তবে বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের ব্যাপারে যে বৈষম্য, তার সাক্ষ্য বহন করে চাকরিবাকরিতে তাদের নিম্ন উপস্থিতি।

বেশিরভাগ মুসলিম এলাকাগুলোতে সরকারি ব্যাংক, হাসপাতাল ও স্কুল নেই। সরকারি ব্যাংকগুলোতে মুসলমানদের ঋণ দেয়ার নিম্নহার চোখে পড়ার মতো।

অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় সহায়তাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থাও করুণ। বিশেষায়িত হস্তশিল্প, যেমন ভগলপুরের সিল্ক, মুরাদাবাদের পিতলের বাসনকোসন, লক্ষ্ণৌ, জরি, দিল্লির এমব্রয়ডারী, ইত্যাদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অন্যরা যেখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে রাতরাতি মার্চেন্ট বনে যাচ্ছে, মুসলিম উদ্যোক্তারা সেখানে লস অথবা মার্জিন প্রফিটে অবস্থান করছে।

প্রশ্ন : ২০০২ সালে গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গায় যিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সেই নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে কি মুসলমানরা সমর্থন দেবে? তাকে সমর্থন করার মানে কি প্রয়োগবাদের ছায়া অথবা সংকটজনক রাজনৈতিক প্রান্তিকতা নয়?

হাসান সারওয়ার : দুটোই। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ মেষপালের মতো তাড়িত না হয়ে নিজেদের বড় স্বার্থের ব্যাপারে মুক্তভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া। প্রয়োগবাদ যদি মোদিকে ভোট দেয়ার দাবি করে, তবে মুসলমানদের উচিৎ নিজস্ব চিন্তাভাবনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

একই সঙ্গে মোদিকে ভোট দেওয়ার মানে হলো মুসলমানদের অন্য কোনো বিকল্প পছন্দ নেই, যদি তারা গুজরাটে শান্তি মতো বাস করতে চায়। এটা হলো নিরাপত্তা কিনে নিয়ে শত্রুর সঙ্গে ঘুমানোর মতো।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : তথাকথিত প্রয়োগবাদ যদি মোদিকে ভোটদানে বাধ্য করে, তবে আমার মনে হয় এটা মুসলমানদের সংকুচিত করার একটা পথ তৈরি করবে। এককথায় এটা হবে সবল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতি দুর্বল অধিবাসীদের একটা অসহায়ত্বের নমুনা। এটা এমন একটা উচ্চতর রাজনৈতিক প্রান্তিকতা, যা বিভাজন প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করবে।

প্রশ্ন : মিডিয়া চিরায়তভাবে যে মুসলমানদেরকে ‘ফতোয়াবাজ’ ও ‘বই পোড়ানো’ জাতি হিসেবে উপস্থাপন করছে, এতে কি মুসলমানদের একটা ভুল ছবি সমাজে আসছে না?

হাসান সারওয়ার : অবশ্যই। আমার বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে এ বিষয়টি আমি জোর দিয়েছি। আসলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, এটা ভুল। অন্যদের ক্লোন হিসেবে মুসলমানদের বিবেচনা করলে তো হবে না।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে কোনো ছাঁচে ফেলার একটি অর্থ হলো নিজেদের গভীরে থাকা কুসংস্কার ও তথ্যের অভাবকে জানান দেওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিডিয়া শুধু তাদের খবর বিক্রির চিরায়ত লোভের প্রতি মনোযোগি থাকে।

সত্যি বলতে কী, দেশভাগের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও, ১৯৩৮ থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের উচ্চকিত কন্ঠস্বরকে দেখাতেও মিডিয়া চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

তারপরেও মুসলমানরা এগিয়ে গেছে। আর ‘বইপোড়ানো’ সংস্কৃতিটা আপনি হিন্দুদের মধ্যে পাবেন, যেমন সম্প্রতি হিন্দুইজমের ওপর প্রকাশিত পেঙ্গুইনের একটি বই হিন্দুরা পুড়িয়েছে, প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করেছে।

প্রশ্ন : পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর একটা বিশেষ অবদান ছিলো। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে থাকা সাম্প্রদায়িক লোকগুলো এদেরকে কোন দৃষ্টিতে দেখে?

হাসান সারওয়ার : দেশভাগের কারণ আমি আলোচনা করবো না, আমার বইয়েও করিনি। আমার সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ভারতের মুসলিম অভিজাত শ্রেণী কেন পাকিস্তান চলে গেলেন সম্প্রদায়ের লেজটি পেছনে রেখে?

মোহাম্মদ সাজ্জাদ : আমি আমার দুটো বইয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণাদিসহ দেশভাগের প্রাথমিক ও কাল্পনিক কারণগুলো ঐতিহাসিকভাবে মোটামুটি একটা বড় কোয়ান্টাম এক্সপ্লোরের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছি। আসলে দেশভাগটা ছিলো উপনিবেশবাদের দ্বারা সৃষ্ট একটা সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতার ফল। এ সাম্প্রদায়িকতা মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা ও আরএসএসের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠনেই সীমাবদ্ধ ছিলো না।

কংগ্রেসের প্রাদেশিক ও জেলা স্তরের নেতৃত্বের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার একটা নিজস্ব ফ্লেপ ছিলো। তারা ক্ষমতার নব্য কাঠামোর মধ্যে ভাগবাটোয়ারার বিপক্ষে ছিলো।

তবে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের প্রতিশ্রুতি ছিলো। একটা আবহ ছিলো যে, কংগ্রেসে কোনো সাম্প্রদায়িক বিভেদ গ্রাহ্য হবে না। সেই কারণে ভারত আজও কোনো হিন্দু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয়ে যায়নি। ভারতের সংবিধান ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অন্যান্য সকল বর্ণের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে।


(আলজাজিরা অনলাইন অবলম্বনে ইংরেজি থেকে অনুবাদ)

সৌজন্যে: নতুন ডাক

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *