ইউরোপের শেকড়ে ফেরা

নির্বাচিত মালফুজাত

Date

Author

Blog Duration

17 minutes

মুফতি মুহাম্মাদ শফীর নির্বাচিত মালফুজাত

উর্দু থেকে অনুবাদ- শাকিল আদনান

স্বাভাবিক সক্ষমতা হিসেবে মানুষ আমরা সবাই সমান। ইন্দ্রিয় শক্তিতে আল্লাহ পাক বান্দাদের সাধারণত সমান সামর্থ্য দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন। এরপর পরিবেশ, পরিশ্রম আর মুনাজাতের মিলিত ফল হিসেবে কেউ কেউ সাধারণের সীমা অতিক্রম করে অসাধারণ হয়ে ওঠেন। চারপাশের যে কোনো বিষয়ে তাদের পাঠ, উপলব্ধি, বিবেচনা ও বিশ্লেষণের ধারা বরাবরই ব্যতিক্রম হয়। আমি এখানে বরেণ্য সব আলেমদের কথাই বলছি।

দেশ-বিদেশের বুজুর্গশ্রেণীর এই মানুষগুলো সাধারণ আমাদের জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি। কাজ করতে গিয়ে কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হলে, ভাবতে গিয়ে হঠাৎ খেই হারালে কিংবা আল্লাহর শান আর নবীজীর প্রেমে নিজেদের সপে দেয়ার প্রস্তুতি নিতে গেলে এই মানুষগুলোই বরাবর আমাদের আশ্রয় হয়ে ওঠেন। তাদের লিখিত কিতাব বা সংকলিত বয়ানগুলো নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর অমূল্য সম্পদ।

সময়-সুযোগ পেলেই বড় আলেমদের মালফুজাত পাঠ করাটা আমার বিশেষ পছন্দ। মুহতারাম পাঠকের জন্য উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, মুফতী মুহাম্মাদ শফীর রহ. নির্বাচিত কিছু মালফুজাত এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পেলাম। হযরতের গদ্যরীতি ঠিক রেখেই অনুবাদের চেষ্টা করেছি।

এগুলোর রচনাকাল গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশের দশক, কিছু তথ্য এদিক-ওদিক হওয়া ছাড়া মূল রচনার আবেদনে এতোটুকু নড়চড় হয়নি। সম্ভাবনাও কম। বড়দের মহিমাটাই এখানে।…শুভেচ্ছাসহ- শাকিল আদনান

ইউরোপের ফতোয়া…

ইংল্যান্ডের ‘জীবন ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার আন্দোলন’ সম্প্রতি দৈনন্দিন জীবনাচার এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা রক্ষায় কিছু মূলনীতি প্রণয়ন করেছে, তাদের প্রত্যেক সদস্যের কাছে বিশেষ পুস্তকাকারে এটি সংরক্ষিত থাকা বাধ্যতামূলক। এই মূলনীতিগুলো দিল্লীর ‘চশমে হায়াত’ পত্রিকার মার্চ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। সেখান থেকে আমি এখানে কিছু মূলনীতি তুলে ধরছি যেগুলো স্পষ্টতই ইসলামী শিক্ষা ও জীবনাচারের অংশ।

পশ্চিমারা দ্বারে দ্বারে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত এবং নিদারুণ ক্ষতির শিকার হয়ে অবশেষে ইসলামী শিক্ষাগুলোকেই নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছে। বিশ্ব মুসলিমের জন্য এটা উপদেশ গ্রহণের বিশাল একটা সুযোগ। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলামী শিক্ষাগুলোকে উত্তম মনে করে এই পথে ধাবিত হচ্ছে অথচ মুসলিম জাতি আজো অন্যদের অনুসরণ করার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে ফিরছে। কবি বলেন-

‘নিজের জিনিসে বিদ্যুৎ চমকালেও তাতে মানুষের দৃষ্টি পড়ে না
অথচ
অন্যের জিনিসে মুহূর্তের আলোও তাকে বিমুগ্ধ ও উন্মাতাল করে তোলে।’

এখানে আমি পশ্চিমাদের সম্প্রতি প্রণিত জীবনধারা আর ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকেই অনুসৃত জীবনধারার কিছু নমুন পাশাপাশি তুলে দিচ্ছি। তাদের দাবি অনুযায়ী বিশেষ গবেষণায় লব্ধ জীবনাচার আর বহু শতাব্দী আগের সন্দেহমুক্ত আমাদের নবীজীর সা. বাণীগুলো বিবেচনা করে দেখুন কোথাও কোনো গরমিল খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।

পশ্চিমা সংস্কৃতি

খাবার

স্বাভাবিক খাবার খাও। যখন ক্ষুধা লাগবে কেবল তখনই খাও। উদ্দীপনা তৈরি করে এমন খাবার এড়িয়ে চলো। এমন খাবার নির্বাচন করো যেগুলো কেবল শারীরিক শক্তি ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট। সাধারণত একধরনের খাবার খাও। সবসময় খাবার ঢেকে রাখ যাতে বাতাসে ভাসমান ব্যাকটেরিয়া, ধুলোবালি, মশা-মাছি কিংবা অন্যান্য পোকা খাবারে না পড়ে। খোলা রাখা খাবার খেও না, বিশেষত যেগুলোর রঙ, স্বাদ বা ঘ্রাণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

পানি

পানির পাত্র ঢাকা থাকা উচিত। এক পাত্রে খুব বেশি সময় পানি রাখাও ঠিক না। অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় আবহাওয়াই নির্ধারণ করবে এক পাত্রে পানি রাখা কতটুকু সময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী আর কত সময় পেরিয়ে গেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে যায়। তবে সর্বাবস্থায় পানির পাত্র ঢেকে রাখা জরুরি।

বিদ্যুৎ

অপ্রাকৃতিক বিদ্যুতের ব্যবহার যতো কমানো যায় ততোই মঙ্গল। বিশেষত রাতে শোবার সময়।

গোসল

শুধুমাত্র হাত ব্যতীত শরীরের অন্যান্য অংশে সাবান ব্যবহার করা বাদ দেয়া গেলে সাস্থ্যের উন্নতি হবে দেখার মতো।

পোশাক

নিত্যব্যবহার্য জুতা, গেটিস, হাতবন্ধনী. ফিতা-বেল্ট ইত্যাদি যথাসম্ভব ঢিলেঢালাই ব্যবহার করা উচিত। রাবার, প্লাস্টিক কিংবা তৈলাক্ত পরিধেয় যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত। নীতি এটাই হওয়া উচিত যে, শরীর গরম রাখার জন্য শীতে এমন পোশাক বেছে নেয়া যা ওজনে পাতলা হবে তবে শরীরের উষ্ণতা ঠিকই ধরে রাখবে। গরমকালে এমন পোষাক পরা উচিত যা শরীরের ঘাম আটকাবে না। বরং গায়ে কাপড় থাকা সত্ত্বেও অনায়াসেই ঘাম বেরিয়ে আসতে পারবে।

নগ্ন পায়ে থাকা

আপনি যতোসময় খালি পায় থাকতে পারবেন তা স্বাস্থ্যের জন্য ততোই উত্তম। বরং উচিত হলো- সবখানেই পারলে আরাম এবং নিরাপত্তার সাথে নগ্ন পায়ে বেড়ানো। সম্ভব হলে শুধু এক জোড়া চটি, স্লিপার বা খড়ম ব্যবহার করা উচিত। বুট এবং সুজ পারতপক্ষে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

শোয়া

নরম তুলা বা ফোমের তুলতুলে বিছানায় শোয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

সূত্র: চশমে হায়াত, দিল্লী ১৯৩৮ ইং

ইসলামী সংস্কৃতি-নবীজীর সা. বাণীসমূহ

খাবার ও পানি

ভবিষ্যতে আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকও আসবে যারা একসাথে নানারকম খানা, বিভিন্নরকম শরবত ও পানীয় এবং বহুরকম পোশাক নিজের কাছে জমা করে রাখবে। এরা হলো আমার উম্মতের মধ্যে নিকৃষ্টতম লোক। (তারগীব ও তারহীব, ১১১ পৃষ্ঠা-তৃতীয় খন্ড)

নবীজীর সা. নির্দেশ হচ্ছে- শোয়ার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে দিবে এবং খাবারের পাত্রগুলোকেও ঢেকে দিবে। পানি পানের জগ ইত্যাদির মুখও ভালো করে বন্ধ করে নেবে। (মুসনাদে আহমাদ, ৩৩ পৃষ্ঠা- ৮ম খন্ড)

বিদ্যুৎ

হাদীসে বর্ণিত আছে- শোবার সময় বাতি নিভিয়ে নাও। নবীজীর সা. রাতের সাধারণ আদত ছিলো বাতি না জ্বালানো এমনকি তাহাজ্জুদ পড়ার সময়ও বাতি জ্বালাতে বলতেন না। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, সে যুগে রাত এলে ঘরে ঘরে বাতি জ্বলানোর এমন অভ্যেস ছিলো না যে বাতি ছাড়া কাজই করা যাবে না। অথচ ইউরোপীয়ান সংস্কৃতি আজকাল সর্বত্র রাতকে দিন বানিয়ে রাখার প্রয়াস পাচ্ছে। ইউরোপের অন্ধ অনুসারী এবং রাতে বাতি জ্বালিয়ে রাখাকে সভ্য ও আধুনিক সংস্কৃতি জ্ঞানকারী মানুষগুলো এখানে ইউরোপবাসীদের কথা শুনুক এবং শিক্ষা গ্রহণ করুক!

গোসল

গোসলে সাবানের ব্যবহার তো সেসব লোকদেরই আবিষ্কার যারা আজকে গোসলে সাবানের ব্যবহারকে অনুচিত বলছে এবং বারণ করছে। ইসলাম তো এক্ষেত্রেও নিজস্ব ধারা অনুযায়ী সাদাসিধে পথ অনুসরণেরই পরামর্শ দিয়েছে।

পোশাক

নবীজী সা. এবং সাহাবাদের সাধারণ পোশাক ছিলো লুঙ্গি ও কোর্তা। কখনো শুধু দুটো চাদর ব্যবহার করতেন একটাকে লুঙ্গি এবং অন্যটিকে গায়ের ওপর কোর্তা হিসেবে। কখনো জুব্বাও পরতেন। কেউ কেউ অবশ্য পাজামাও পরতেন। নবীজী সা. পাজামা পছন্দ করেছিলেন। যদিও তখনকার পোশাকগুলো খুবই ঢিলেঢালা হতো। তিনি আঁটোসাঁটো পোশাক-পরিচ্ছদ পছন্দ করতেন না।

চোস্ত ও আঁটোসাঁটো পোশাকের উদ্ভাবকেরাই আজকাল একে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বলছে। তদ্রুপ প্লাস্টিক এবং রবার জাতীয় জিনিসও তাদের বিমুগ্ধ আবিষ্কার, যা দিয়ে দিনের পর দিন প্রকৃতি ও পৃথিবীর নানাবিধ ক্ষতি সাধনের পর এখন তারা এটা স্বীকার করছে।

ইউরোপের সেই বিমুগ্ধ চিন্তাগুলোর প্রতি লক্ষ করুন যে তারা নবীজীর সা. সুন্নাতের মুকাবেলা করে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আজ এসে সেসব তাদের নিজেদেরই ভালো লাগছে না। সুতরাং হে চিন্তাশীলেরা, বিবেচনা করো। গাঢ় রঙের কাপড় আমাদের নবীজী পছন্দ করতেন না। বরং তাঁর নির্দেশ- তোমাদের উচিত কাপড়ের মধ্যে সাদাকেই বেছে নেয়া, যা দিয়ে তোমরা জীবদ্দশায় কাপড়ের প্রয়োজন মেটাবে এবং মৃত্যুর পর তোমাদের মাইয়েতদের তাতেই দাফন করবে। কারণ এটাই উত্তম কাপড়।

নগ্ন পায়ে থাকা

যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ইসলামী জীবনধারার নীতি হলো জুতা কেবল চলাফেরায় ব্যবহার করা এবং কোথাও বসলে অবশ্যই তা খুলে বসা। প্রয়োজনে বা সুযোগ খাকলে চলাফেরায়ও জুতা খুলে খালি পায়ে হাঁটাকে খুব অন্যায় মনে করা হয় না। হযরত সাহাবায় কেরামও এভাবেই জুতা ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। জুতাকে প্রায় শরীরের একটা অংশে পরিণত করে দেয়ার কৃতিত্ব ইউরোপেরই।

চেয়ারে বসে কাজের ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে যাতে বসেও জুতা খোলার কোনো প্রয়োজন না পড়ে। বরং কিছু অতি ভদ্র সাহেব তো পারলে জুতো পরেই ঘুমুতে চলে যায়। আল্লাহর শোকর, অনেকরকম ক্ষতির শিকার হয়ে অবশেষে আজকের ইউরোপ সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই ফিরতে বাধ্য হয়েছে যা ইসলাম পৃথিবীবাসীকে জানিয়েছে বহু শতাব্দী পূর্বেই। তবে দু:খের বিষয় হলো আমাদের ভাইয়েরা আজো অন্ধভাবে ওদের অনুসরণ করে চলেছে।

শোয়া

নরম বিছানায় শোয়ার ব্যাপারটিকে আজকের ইউরোপ যেভাবে ক্ষতিকর হিসেবে দেখছে ইসলাম তা নির্ণিত করে গেছে অনেক আগেই। নবীজী সা, এর বিছানা ছিলো চামড়ার, যার নিচে খেজুর গাছের ডাল-পাতা বিছানো থাকতো।

শিক্ষা

ইসলামী সংস্কৃতি এবং সাদাসিধে জীবনধারা যেভাবে মুসলিমদের দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখে বিভোর হয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখে, তদ্রুপ স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা রক্ষার পাশাপাশি শান্তি ও স্বস্তির জন্যও এটি বিকল্পহীন এক জীবনব্যবস্থা। যারা আধুনিকতা মনে করে আজো নিজের দৈনন্দিন জীবনে ইউরোপ তথা পশ্চিমের এসব নিয়ম মেনে চলেছেন তারা এবার একবার অন্তত ভাবুন।

নিজের ধর্মীয় নির্দেশনা যদি নাও মানতে পারেন তো তাদেরটাই একবার পড়ে দেখুন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যাদের অনুসরণ করে চলেছেন। নিজের ভালোটা যথাসময়ে বুঝতে পারার নামই তো সচেতনতা।

চরিত্র এবং আচরণে পোশাক ও ভাষার প্রভাব

জড় বস্তু, লতা-গুল্ম, এবং সবরকমের গাছগাছালিতে আল্লাহ পাক যেমন মানুষের জন্য কিছু ভালো, কিছু মন্দ এবং ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা রেখেছেন; তদ্রুপ মানুষের সবধরনের কাজে-কর্মেও কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা কুরআন এবং হাদীসে স্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। কিছু বিষয় এমন যেগুলো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও অর্জিত হয়েছে।
আমাদের ভাষা এবং পোশাক-আশাক হলো জীবনের এমন দুই অনিবার্য অনুষঙ্গ যেগুলোতে আল্লাহ পাক বিশেষ বিশেষ নিদর্শন রেখেছেন। অধিকাংশ ইসলামী বিধানের ক্ষেত্রেও এ দুটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে।

শত বছরের অভিজ্ঞতা এবং অসংখ্য ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করে এই ব্যাপারটি প্রায় বিশ্বাসের পর্যায়ে চলে এসেছে যে, মানুষ যে জাতির ভাষা ও পোশাকে অভ্যস্ত হয় সে জাতির আচার-আচরণই দ্রুত তাদের মগজ ও মনকে প্রভাবিত করে ফেলে। ভেতরগত অভ্যাস বা মানসিকতার ব্যাপার আপনার কাছে জটিল মনে হতেই পারে তবে বাস্তব প্রভাবের বিষয়টি তো এতোটাই অবিদিত যে অস্বীকারের কোনো উপায়ই নেই।

আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এসব বিষয়ে অবগত এবং সচেতন ছিলেন। তারা যখন হেদায়তের ইলম নিয়ে জাজিরাতুল আরব থেকে অনারবের দিকে পা বাড়ালেন, এই বিষয়ের প্রতি খুবই মনোযোগী হলেন এবং আরবী ভাষা এবং আরবদের লেবাসের দিকটিও গুরুত্বের সাথে সামনে পেশ করলেন।

তাই যেখানে যেভাবে এই দ্বীনের প্রসার ঘটেছে, সাথে এই জান্নাতী ভাষা এবং নবীজীর সা. সুন্নাতী লেবাসও ছড়িয়ে পড়েছ। একদিকে তারা যেমন পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে দিয়েছেন, অন্যদিকে দেশে দেশে মানুষের শ্রেণী ও ভাষা বদলে দিয়েছেন। আগে মিশরে ক্বিবতী ভাষা, শামে রোমী ভাষা, ইরাক ও খুরাসানে ফারসী ভাষা, ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে স্থানীয় ভাষার প্রচলন ছিলো। ইসলাম ধর্মীয় বিপ্লবের সাথে পবিত্র ভাষা নিয়ে হাজির হবার পর সব এলাকার মানুষই তাদের মাতৃভাষা ছেড়ে আরবী ভাষায় আকৃষ্ট হয়েছে।

আরবী ভাষার এই ব্যাপক বিস্তৃতির পেছনে এই ভাষার ঐতিহ্য, প্রচীনতা এবং সহজতার অবদানও কম নয়। সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সাহাবা এবং তাবেয়ীদের আমলী প্রভাব এবং আচরণগত আদর্শও এর পেছনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। এই আমলী কৌশলের ব্যাপারটা এমন যে তারা যখন নতুন কোনো দেশে পৌঁছেছেন তো সেখানে খুৎবা প্রদান করেছেন আরবীতে, যদিও শ্রোতারা ছিলেন আরবী সম্পর্কে পুরোই অজ্ঞ।

তবে তারা নিজেরা বা স্থানীয় কারো সহযোগিতায় এই খুৎবার ভাষ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। খুবই সতর্কতার সাথে তারা এটাও করেছেন যে সব বিষয়ে এমন না করে কেবল খুৎবার বেলায় আরবীটা রেখে অন্য বিষয়ে স্থানীয় ভাষায় শরীয়ত প্রচার করেছেন এবং মানুষদের দ্বীনী শিক্ষা দিয়েছেন।

এই কৌশল মানুষকে খুবই প্রভাবিত করেছে ফলে তারা নিজের ইচ্ছেতেই খুৎবা এবং আমীর ও খলীফার ভাষণ বোঝার জন্য আরবী শিখেছে।

এই চমৎকার কৌশলের পাশাপাশি সবার প্রতি সাম্যের দৃষ্টান্তও তারা রেখেছেন এবং তা পুরোপুরিভাবেই। তাই কেউ তাদের প্রতি জবরদস্তির কোনো অভিযোগ কখনো উত্থাপন করতে পারে নি। তারা চেয়েছেন যে আরবী ভাষাটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়–ক তবে জবরদস্তি বা সবার্গ্রে ভাষাবদলের ব্যাপারটিকে সামনে আনেন নি যাতে দোষ চাপানোর আশংকা তৈরি হয় বা মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছড়িয়ে পড়ে।

খুৎবা বুঝতে পারাটা এমন আহামরি কিছু নয় যে না বুঝলে ফরজ বা ওয়াজির ছুটে যাবে তবে এটা ছিলো আরবীর প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার অসাধারণ একটি পদ্ধতি।

অন্যদিকে অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীর লোকেরা এক্ষেত্রে ছিলো পুরোই ব্যতিক্রম। কোথাও তাদের বিজয়ের সংবাদ এলে বা কোথাও তাদের ভাষা প্রচলনের ইচ্ছে থাকলে তারা সরাসরি তাৎক্ষণিকভাবে ভাষা চাপিয়ে দিতো। বিশেষ উপলক্ষ ছাড়াও মানুষের দৈনন্দিন কাজও তখন নতুন ভাষা ব্যবহারের মারপ্যাচে আটকা পড়তো। মানুষের জীবন হয়ে ওঠতো বিভীষিকাময়।

তাদের কৌশলগত ব্যর্থতা এবং ভাষার দৈন্য যদি মাঝখানে বাধা হয়ে না দাঁড়াতো তাহলে নি:সন্দেহে আজ পুরো পৃথিবীবাসীর ভাষা হতো ইংলিশ। আল্লাহ পাক ইসলাম এবং ইসলামী ভাষাকেই এই মর্যাদায় উন্নীত করেছেন যে সে যে দেশেই প্রবেশ করেছে সে দেশের দ্বীন ও ভাষাকে হটিয়ে নিজেই নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।

প্রখ্যাত ইংলিশ গবেষক ড. গুস্তাদালী বান আরবী ভাষার এমন দিগি¦জয়ী বৈশিষ্ট্যে অবাক হয়ে লিখেছেন-

‘আরবী ভাষা সম্পর্কে আমাদের তা-ই বলতে হবে যা আমরা আরব সম্পর্কে বলেছি। অর্থাৎ পূর্ববর্তী দেশগুলো যেখানে বিজিত দেশগুলোতে নিজেদের ভাষা প্রচলনে ব্যর্থ হয়েছে অরবরা সেখানে সফল হয়েছে ব্যাপকরকম। এবং বিজিত দেশগুলো আরবদের অধীনতা মেনে নেয়ার পাশাপাশি আরবের ভাষাকেও গ্রহণ করে নিয়েছে। আরবী ভাষা ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে সাবেক সুরয়ানী, ক্বিতবী, ইউনানী, বারবারী ইত্যাদি ভাষা আপন আপন স্থান হারিয়েছে। ইরানেও একটা সময় পর্যন্ত আরবীর প্রচলন ছিলো। পরে ফারসী ভাষার প্রচলন শুরু হলেও ওলামায়ে কেরাম লিখতেন আরবীতেই। এশিয়ার এতদঞ্চলে আরবীর অবস্থা অনেকটা সেরকমই ছিলো যেমন অবস্থা মধ্যযুগে লাতিন ভাষার ছিলো ইউরোপে। তুরষ্কেও আরবীর ব্যাপক প্রচলন ছিলো। তারা আরবী বর্ণমালাতে সবকিছু লিখত। সুতরাং সাধারণ একজন তুর্কি ব্যক্তিও খুব সহজে কুরআন বুঝতে পারতো।

ইউরোপের লাতিন জাতিসমূহ অবশ্য একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে যেখানে আরবী ভাষা পূর্বেরগুলোর মতো স্থান নিতে পারে নি। তবে এখানেও সে প্রকাশ্য প্রভাব রেখে গেছে। মোসিউডোজি এবং মোসিউ আংলুমিন মিলে আন্দুলুস এবং পর্তুগালের ভাষায় প্রচলিত আরবী শব্দসমূহের একটা অভিধান লিখেছেন। ফ্রান্সের ভাষাতেও আরবীর প্রভাব প্রকট। এ বিষয়েও একটি অভিধান লিখিত হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে ইউরোপে আরবীর প্রভাব কতোটা ব্যাপক ছিলো।

ইতিহাস সাক্ষী, ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহে ইসলাম প্রবেশের মাত্র অর্ধ শতাব্দীর মাথায় স্থানীয় বাসিন্দাগণ প্রচলিত বারবারি এবং লাতিন ভাষা ছেড়ে আরবীর প্রতি কীভাবে ঝুঁকে পড়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে স্থানীয় খৃষ্টান পাদ্রীদের নিজ নিজ ধর্মের শিক্ষা আরবীতে অনুবাদ করে মানুষদের সামনে পেশ করতে হতো, যাতে তারা বুঝতে পারে।

মোটকথা, ইসলামের প্রতিনিধিগণ আরবী ভাষার প্রচলনের গুরুত্ব অনুধাবনের পাশাপাশি মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা এবং অধিকারের প্রতিও এতোটা সচেতন ছিলেন যে মানুষ আরবী থেকে মুখ না ফিরিয়ে বরং আরো কাছে এসেছে। ধর্ম হিসেবে ইসলাম যেমন অন্যসব ধর্মের অসারতা প্রমাণ করে চলেছিলো একইভাবে আরবী ভাষাও অন্যসব ভাষাকে হটিয়ে আপন স্থান তৈরি করে নিচ্ছিলো।

এবার ভাবনার বিষয় হলো আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেনো আরবী ভাষাটাকে এতো গুরুত্বের সাথে নিলেন এবং ধর্মের পাশে স্থান দিয়ে দিলেন। এর একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তো সহজেই বুঝে আসে যে রাজা-প্রজা এবং শাসক ও শাসিতের মধ্যে সহজ সম্পর্ক তৈরি করা এবং সাধারণ দূরত্বটা ঘুচিয়ে দেয়া। দ্বিতীয় ও অন্য উদ্দেশ্য তাদের এটা ছিলো যে, যখন লোকসমাজে আরবীর প্রচলন ব্যাপক হয়ে যাবে তো কুরআনের ভাষা হিসেবে তাদের মধ্যে ধীরে ধীর কুরআনী আচার-আচরণ এবং চারিত্রিক দিকগুলোও প্রভাব বিস্তার করবে। ফলে একসাথে দুটো কাজ হয়ে যাবে খুব সহজেই।

আজকাল ইউরোপের বাসিন্দারা নিজেদের অগ্রগতি নিয়ে গর্ব করে। নিজেদেরকে সংস্কৃতি-সভ্যতা এবং রাজনীতির প্রতিভূ মনে করে। সুফিবাদের সাতটি মূলনীতি আছে। কিতাবুল্লাহর অনুসরণ, সুন্নাতে রাসূলুল্লাহর সা. অুনগামী হওয়া, হালাল খাওয়া, মানুষের কষ্ট লাঘব করা, গোনাহ থেকে বাঁচা, তওবা করা এবং মানুষের হকসমূহ আদায় করা। বলা হয়- মানুষ তিনটি জিনিস থেকে নিরাশ হয়ে গেছে।

নিয়মিত তওবা করা, রাসূলের সা. সুন্নাতের অনুসরণ এবং মানুষকে কষ্ট থেকে বাঁচানো। রাসূলের সা. সুন্নাতই উচ্চ মাকাম হাসিলের একমাত্র পথ। কিন্তু বাস্তবতা কি তা-ই? একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক।

ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহে ভাষা এবং সভ্যতা

বিজয়ী বেশে ইসলাম যখন পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ করলো এবং আন্দুলুস ও পর্তুগাল তাদের শাসনাধীনে চলে এলো, তো অর্ধ শতাব্দী পেরোবার আগেই এখান থেকে প্রচলিত বারবারী ভাষা উঠে গেলো এবং এই অঞ্চল একটা সাধারণ আরব রাষ্ট্রেরই অংশ বনে গেলো।

শুধু ভাষাই নয় তারা ইসলামী সংস্কৃতির অনুসারী এবং ইসলামী সভ্যতার ধারক হতে পারা নিয়ে গর্ব করে ফিরতো। আর শুধু এ দুটো রাষ্ট্রই তো নয় বরং ফ্রান্সসহ আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতেও ভালো করেই এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিলো।

মিশরের মাজমায়ে ইলমীর প্রধান শায়খ মুহাম্মাদ কারদ আলী মিসরী তার আন্দুলুস এবং পর্তুগালে ভ্রমণকালে আশ্চর্য সব ঘটনার মুখোমুখি হন। তিনি সেখানকার অতীত ও বর্তমান হালাত নিয়ে তার সফরনামায় বলেন-

‘ইসলামের অধীনে চলে আসা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোই শুধু নয়, চারপাশের রাষ্ট্রগুলোও ইসলামের ভাষা এবং সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলো। লাতিন, জালালাকা এবং নারফারিউনের বোদ্ধা লোকেরাও আরবী ভাষা শিখেছিলো। মুসলিমদের সংস্কৃতি এবং জীবনধারার প্রতি তারা এতোটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলো যে নিজেদের ধর্মীয় রীতিনীতিকে ছেড়ে দিয়ে ইসলামের বিধিবিধান, অভ্যেস এমনকি তাদের নারীদেরও ইসলামী পর্দায় রাখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছিলো’।

আফসোস, আমরা কী থেকে কী হয়ে গেলাম। কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় এসে পৌঁছেছি। পূর্বপুরুষদের অযোগ্য সন্তানেরা কীভাবেই না মান-সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। অন্যদের গোলামির জিঞ্জির মাথায় বেধে নিয়েছে। তাদের স্থাপিত ভিত্তির এক একটি ইট খুলে ফেলেছে।

আফসোস, যারা এককালে আমাদের অনুসরণ করাকে নিজেদের জন্য গৌরবের বিষয় বলে ভাবতো আজ আমরা তাদের অনুসরণে মত্ত হয়ে পড়েছি। তাদের পছন্দ-অপছন্দ, তাদের ভাষা এখন আমাদের মুখে মুখে। অপ্রয়োজনেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে পারাটাকে আমরা এখন গর্বের বিষয় মনে করি। শুদ্ধ উচ্চারণ করতে না পারলেও অশুদ্ধতেই কাজ চালিয়ে যেতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করি না। আর সাহেব বাহাদুরের সাদৃশ্য ধারণ করতে পারাটা তো বিরাচ সৌভাগ্যের ব্যাপার। মেয়েদেরকে পর্দা থেকে বের করেছি। পুরুষদের বেশ-ভূষা পাল্টে দিয়েছি।

প্রথমে আমরা কেবল ভাষা এবং বেশ পরিবর্তন করেছি আর মনে মনে ভেবেছি যে ঈমানের সম্পর্ক তো ক্বলবের সাথে। বাহ্যিক পরিবর্তনে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে যে এটাই একটা বিদ্যুতের চমক ছিলো যেটা ক্বলব এবং মগজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ইংরেজি জীবনধারা এবং খৃষ্টীয় মতবাদ আমাদের মনকে প্রভাবিত করে ছেড়েছে।

নির্বাচিত মালফুজাত

এক ব্যক্তি ইংলিশদের জুতো পরিধান শুরু করলো আর ভাবলো যে এই জুতো পরার কারণে আমি তো আরবদের মতো হয়ে যাই নি। পরে দেখা গেলো জুতোর সাথে সাথে সে প্যান্টও পরা শুরু করেছে। এভাবে ইসলামী পোশাক একটা একটা কমে একটা একটা করে ওদের পোশাক গায়ে ওঠতে লাগলো। একসময় দেখা গেলো যে বাহ্যিক পরিবর্তনের পর তার ভেতরেও পরিবর্তন শুরু হয়ে গেলো এবং শরীর থেকে তার ঘরবাড়ি এবং চারপাশেও পরিবর্তন আসা শুরু হলো। ঘরের পর্দা তার ভালো লাগে না সুতরাং সেগুলো সরিয়ে ফেলা হলো। বসে খেতে পারে না সুতরাং দস্তরখান উঠে গেলো। নামাজের জন্য বারবার অজু করা কষ্টকর হয়ে গেলো সুতরাং নামাজও বাদ পড়লো। মোটকথা তার নিজের এবং তার ঘর থেকে ইসলাম পুরোপুরি ওঠে গেলো।

বাস্তবে গোনাহের একটা ধারা হলো সে একটার পর একটা বাড়তেই থাকে। একজন একটা গোনাহ করার পর অবধারিতভাবে সে অন্য একটা গোনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। হাদীসে আছে, কেউ যখন কোনো ভালো কাজ করে তো সে অন্য একটা ভালো কাজের সুযোগ পেয়ে যায়। অপর পক্ষে সে যখন কোনো মন্দ বা গোনাহের কাজ করে তো সে অন্য একটা গোনাহে জড়িয়ে পড়ে।

আজ আমরা ইংরেজদের জুলুম এবং অহংকারী আচরণ দেখে দেখে বিরক্ত। তাদের এসব আচরণে তাদের আমরা মন্দ মনে করি এবং মনে মনে তাদের বিরোধিতাও করি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো যে সমস্ত আচরণের কারণে অমরা ইংরেজদের ওপর বিরক্ত সেসব তারা আমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছে। ইংরেজদের ভারত উপমহাদেশ থেকে তাড়াতে কতো মানুষই তো জান দিলো, কিন্তু তাদের জীবনধারাকে শরীর এবং মন থেকে দূর করতে কোনো উদ্যোগই নিই না। সেটাকে বরং সামর্থ্যেরও বাইরের মনে হয়।

যদি বাস্তবেই খৃষ্টান এবং ইংরেজদের ব্যাপারে আমাদের অবাজ্ঞা থেকে থাকে তাহলে আজই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত তাদের অনুসরণ ছেড়ে দেয়া। তাদের আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং ইংরেজি ভাষার অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ থেকে নিজেকে মুক্ত করা। খুব প্রয়োজন বা বাধ্য না হলে আমরা একটা ইংরেজি শব্দও উচ্চারণ করবো না।

হাফেজে হাদীস আল্লামা ইবনে তাইমিয়া তার এক গ্রন্থে বলেন- কোনো ভাষায় অভ্যস্ত হওয়া ব্যক্তির মেধা, চরিত্র এবং দ্বীনের ব্যাপারে প্রকাশ্য প্রভাব তৈরি করে।

আফসোস, আজকে মুসলমানদের নজর এতোটাই অধগতির দিকে যে নিজেদের বুজুর্গদের প্রদর্শিত পরীক্ষিত সাফল্যের পথে সামনে এগুতে বললে তাদের ভালো লাগে না। কুরআন-হাদীসের কথা শোনালেও তাদের দিল সেটা কবুল করতে পারে না।

পূর্ববর্তী বুজুর্গদের প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা এবং নীতি বলা হলে সেগুলো তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় না। তারা আলেমদের বলে আরবী ভাষার অবশিষ্ট উপস্থিতিটুকুও মিটিয়ে দিতে। জুমার খুৎবায় যেনো আরবীর পরিবর্তে নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করা হয় এ নিয়ে তাদের আবদারের শেষ নেই। তাই বাধ্য হয়ে ওলামায়ে কেরাম খুৎবার পূর্বে মাতৃভাষায় সমসাময়িক মাসায়েল নিয়ে আলোচনার ধারা শুরু করলেন। যাতে মুসল্লিরা একেবারে মূর্খ না থেকে যায়।

একটু পেছনে গেলেই দেখবেন ইংরেজ শাসনামলে এতো প্রচেষ্টা আর প্রচারনার পরও কজন মানুষই বা আর ইংরেজি শিথেছিলো। কিন্তু সরকারি সকল কার্যক্রম তো তারা ইংরেজিতে করার জন্যই মানুষদেও বাধ্য করতো। নিজের ভাষায় মহাজ্ঞানি একজন লোককেও ইংরেজদের অফিসে অন্ধ-বধির অসহায়দের মতো ঘুরতে হতো। এতে তাদের কি লক্ষ ছিলো, কেনো তারা মানুষদের এটা করতে বাধ্য করতো তাকি কখনো ভেবেছেন? একটু ভাবলেই দেখবেন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ভারবর্ষের সব মানুষ বিশেষত মুসলিমেরা একটি মাযহাবের অনুসরণ করতে অভ্যস্ত। আর মাযহাব বা ধর্ম কখনোই একজন মানুষকে অনুমতি দেয় না অন্য কোনো ধর্ম বা জাতির গোলামে পরিণত হতে। আর ইসলাম তো অন্যকারো ভাষা বা আচার-আচরণে অভ্যস্ত হবার অনুমতিও দেয় না। তাই ইংরেজরা কৌশলে এই জাল বিছিয়ে দিলো যাতে মানুষ তাদের ভাষা শিখতে বাধ্য হয়। ভাষা শিখলে তো তাদের সংস্কৃতি আপনা-আপনি চলে আসবে। তাই হলো। এবং এই পরিবর্তনের পরপরই এই অঞ্চলের মুসলিমদের মাঝে ইসলামী কালচারের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হলো।

১৫২৬ সালে ফিলিবের আমীর হাস্পানিয়া নিজের এলাকায় সবার জন্য আরবী বলা নিষিদ্ধ করে দেয়। যাদের আরবী নাম ছিলো তাদের নাম বদলে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাতে রাজি না থাকলে রাজ্য ছাড়া করারও হুমকি দেয়া হয়। সুতরাং বাধ্যতামূলকভাবে সকল মুসলিম- প্রায় কয়েক লাখ মুসলিমকে কোনো সামান পত্র ছাড়াই রাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হয়। মোটকথা পশ্চিমা খৃষ্টানেরা সেই বিষয়টিকেই এই নিষ্ঠুর পন্থায় সমাধান করার পদ্ধতি অবলম্বন করে যে পথে মুসলিম নেতৃবৃন্দ অপরদের মন জয় করার মাধ্যমে করেছিলেন।

কী আশ্চর্য, একই বিষয় একপক্ষ করছে ভালাবাসার বার্তা ছড়িয়ে তো অপর পক্ষ করছে হিংসা ও ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

প্রভু, আপনিই মুসলিদের সুমতি দিন অন্য জাতি এবং সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি যেনো বর্জন করতে পারে। তারা যদি এখন এইটুকু অনুসরণ-অনুকরণ বর্জন করতে না পারে তাহলে কীভাবে নিজেদের শরীর ও মন থেকে তাদের দাসত্ব ও গোলামির জিঞ্জির হঠাতে সক্ষম হবে যা ইতোমধ্যেই তাদের যথেষ্ট প্রভাবিত করে রেখেছে। আমরা এটা বলছি না যে এই মুহূর্ত থেকে সর্বোতভাবে ইংলিশ বলা এবং তাদের পোষাক পরিচ্ছদ বর্জন করে দিক এবং যেসকল পজিশনে চাকরি করার জন্য ইংলিশ জানা এবং এই পোষাক পরা আবশ্যক সেগুলো থেকেও তারা বেরিয়ে আসুক। কারণ সেটা কোনো স্থায়ী বা উৎকৃষ্ট সমাধান নয়। আমরা বরং বলি যে অপ্রয়োজনে এসব থেকে সবাই বেরিয়ে আসুক এবং নিজেদের পরতর্তী প্রজন্মকে এসব বিষয়ে সতর্ক করে তুলুক।

তাতেই বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে। আসবে সাফল্য।

শাকিল আদনান- সম্পাদক, মাসিক নতুন ডাক

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *