নাসিরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুসন্ধান

ব্রাহ্মণবাড়িয়া

Date

Author

Blog Duration

16 minutes

হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রয়েছে ঘটনাবহুল ও বর্ণিল অতীত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া যার অন্যতম।

বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অবদান অসামান্য। স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধ এবং অধর্ম ও অন্যায়ের মোকাবেলায় এই জেলার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নানা ধর্মের, নানান মত ও পথের লোকজন এখানে প্রাচীনকাল থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছেন।

শান্তি-সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের লীলাভূমি এই জনপদ- ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জ্ঞানী ও গুণীর দেশ, আলেম ও মুজাহিদের দেশ। গত এক শতাব্দীতে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণীর বিভিন্ন অবদানের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া আজ উপমহাদেশ তো বটেই, বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেছে।

নামকরণ

নদীমাতৃক বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। কোনো কোনো মতে- সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাবে পূজা-অর্চনায় বিঘœ সৃষ্টি হতো। এ কারণে রাজা লক্ষণ সেন আদিসুরের কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার শহরের মৌলভীপাড়ায় বাড়ি তৈরি করে। কালক্রমে সেই ব্রাহ্মণদের বাড়ির নামেই এ এলাকার নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসেবে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় এবং সম্ভাব্য সঠিক মতানুসারে- দিল্লী থেকে আগত ইসলামের প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ নানান অভিযোগে অতিষ্ঠ হয়ে শহর থেকে এসব ব্রাহ্মণ পরিবারকে বেড়িয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন, যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। কথিত আছে- দরবেশ সাহেব ‘ব্রাহ্মণ বেড়িয়ে যাও’ বলে হুকুম করেছিলেন এবং তার সেই উক্তি থেকেই কালক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি।

ইতিহাসের এক ঝলক

এ অঞ্চল প্রাচীন বাংলার সমতট নামক জনপদের অংশ ছিলো। মধ্যযুগে আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিলো সরাইল পরগনার অর্ন্তগত। ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্তে জানা যায়- পাঠান সুলতান শেরশাহ রাজস্ব আদায় ও শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে প্রথম পরগনার সৃষ্টি করেন। সুলতানী আমলেই সরাইল পরগনার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক কারণে সরাইল পরগনা কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

বাংলার বার ভূইয়ার শ্রেষ্ঠ ভূইয়া মসনদ-এ আলা ঈসা খাঁর বংশ পরিচয় থেকে জানা যায়- ভারতের বাইশওয়ারা রাজ্যের এক যুবরাজ কালিদাস গজদানী সৈয়দ ইবরাহীম মালেকুলউলামা রহ. এর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান খাঁ নাম ধারণ করেন। সোলায়মান খাঁ ১৫৩৪ খৃস্টাব্দে এই বঙ্গ অঞ্চলে আগমন করেন। তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের পর থেকে সর্বপ্রথম সরাইল পরগনার জায়গীর প্রাপ্ত হন। সোলায়মান খাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পাঠান বাহিনী মিথ্যা সন্ধির প্রস্তাবে তাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। এসময় ঈসা খাঁর বয়স ছিলো দশ বছর।

পরবর্তীকালে স্বীয় প্রতিভাবলে তিনি ভাটীরাজ্যের এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হন। ভাটী রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষায় ঈসা খাঁর সঙ্গে মোঘল বাহিনীর যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঈসা খাঁ তখন সরাইলে অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এ শহরকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়।

১৭৯৩ খৃস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা ময়মনসিংহ জেলার অর্ন্তভুক্ত ছিলো। ১৮৩০ সালে সরাইল, দাইদপুর, হরিপুর, বেজুরা ও সতরকন্ডল পরগনা ময়মনসিংহ থেকে ত্রিপুরা জেলার অধীনে দেওয়া হয়। ১৮৬০ সালে নাসিরনগর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা এর অধীনস্থ হয়। ১৮৭৫ সালে ইংরেজ সরকার নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসেবে ঘোষণা করে। শুধু একটি থানার নাম হিসেবে মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক এ নামটি আজও টিকে আছে। তারও আগে ১৮৬৮ খৃস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরটি পৌরসভায় উন্নীত হয়। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অর্ন্তগত হয়।

১৯৬০ সালে ত্রিপুরা জেলার পূর্ব পাকিস্তান অংশেরও নামকরণ হয় কুমিল্লা। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি মহকুমা শহর হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা উত্তর বংলাদেশের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ১৮৩০ সালের পূর্বে সরাইল পরগনা ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য ও বীরত্বগাঁথা

monument-of-martyrs-of-libaration-war-brahmanbaria

ইতিহাসের নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তবেই আজকের পর্যায়ে এসেছে এক কালের নাসিরনগর ও আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া। যুগে যুগে বহু সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের সাক্ষী এই শহর। ঈসা খাঁর প্রথম ও অস্থায়ী রাজধানী ছিলো সদর এলাকা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার উত্তরে, সরাইলে।

বৃটিশ আমলে ইংরেজ ম্যানেজার মি হ্যালিডের কুঠি সরাইল থেকে শহরের মৌড়াইলে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি ভেঙে সরকারি অফিস ঘর করা হয়েছে। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ সেনাদের মুনিপুর অধিকারের সময় তাদের সামরিক সদর দফতরও ছিলো এই শহরেই। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সৃষ্ট তথাকথিত স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে উল্লাস কর দত্ত বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে আন্দামানে দীপান্তরিত হয়েছিলো, যা সেসময়ের তুমুল আলোচিত ঘটনা। ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ ও গোপাল দেব প্রমুখ প্রকাশ্য দিবালোকে তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি.সি.বি স্টিভেনসকে তারই বাসগৃহে গুলি করে হত্যা করে, পুরো উপমহাদেশে যা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।

১৯৩০ সালে কৃষক আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতা আব্দুল হাকিম খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান। শহরজুড়ে সৃষ্টি হয় তুমুল উত্তেজনা। এ সময় বৃটিশ সৈন্যদের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে চারজন বেসামরিক লোক প্রাণ হারান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল আখাউড়ার দরুইন যুদ্ধে শহীদ হন। এক কালে কাদিয়ানীদের প্রধান আখড়া ছিলো ব্রহ্মণবাড়িয়া। আলেম সমাজের নেতৃত্বে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের তুমুল প্রতিরোধে তারা একসময় নিজেদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। শায়খ আবু তাহের মুহাম্মদ ইউনুস, ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলামসহ বরেণ্য আলেমদের নেতৃত্বে বিধর্মী ও বাতিল শক্তিদের হটিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া খাঁটি মুসলিম ও আলেম সমাজের পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়।

মুফতি ফজলুল হক আমিনীর রহ. নেতৃত্বে বাবরি মসজিদ অভিমুখী লংমার্চ, নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন, ২০০১ এর ফতোয়া আন্দোলন, এরপর নারীনীতি ও শিক্ষানীতির মতো তাৎপর্যপূর্ণ এবং সফল আন্দোলনগুলোতে অসামান্য ত্যাগ ও কুরবানীর মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিণত হয়েছে সাহসিকতা ও বিপ্লবের বিস্ময়কর এক জনপদে।

অবস্থান ও আবহাওয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবস্থান বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে। আদিকাল থেকে এটি নদ-নদী অধ্যুষিত ভাটীরাজ্য হিসেবে পরিচিত। ¯্রােতস্বিনী মেঘনা অববাহিকায় কালীদহ সায়রের পলি ও বালি সঞ্চিত নীচুভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ অঞ্চল। তবে উত্তর পূর্বাঞ্চলে কিছু উঁচু ভূমির নিদর্শন রয়েছে। পাহাড়ি টিলার লালমাটি আদি স্থলভূমি ও জনপদের প্রমাণ বহন করে।

তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ পূর্বাংশের অধিকাংশ এলাকা এখনো বর্ষার পানিতে প্লাবিত হয়ে থাকে। মেঘনা, তিতাস, সালদা, হাওড়া, বুড়ি ও লোহুর নদী বষার্কালে এখনো উপচে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে কুমিল্লা, পশ্চিমে নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ এবং উত্তরে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার অবস্থান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বরেণ্য ব্যক্তিত্ব

শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষা-সাহিত্য ও ইসলামী আন্দোলনে দেশের অন্যতম অগ্রণী জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কৃতী ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, ওস্তাদ ও ইসলাম প্রচারক ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম রহ., কাজী মাসুদুর রহমান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ব্যারিস্টার এ রসুল, নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কথা সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণ, কবি আবদুল কাদির, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মুফতি ফজলুল হক রহ. এবং এই সময়ের সেরা কবি আল মাহমুদ।

জাতীয় অর্থনীতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জাতীয় অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রাখছে। তিতাস গ্যাস ফিল্ড, সালদা গ্যাস ফিল্ড, মেঘনা গ্যাস ফিল্ড দেশের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাসের সরবরাহ যোগায়। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের ২য় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আশুগঞ্জ সার কারখানা দেশের ইউরিয়া সারের অন্যতম বৃহৎ শিল্প কারখানা।

titas gas field b.baria

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং দলমত নির্বিশেষে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল মিলনস্থল হিসেবে এদেশের মানচিত্রে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কয়েক শতাব্দী ধরেই তাঁত বস্ত্রের জন্য বিখ্যাত। উনবিংশ শতাব্দীতে সরাইলে তানজেব নামক বিখ্যাত মসলিন বস্ত্র তৈরি হতো।

স্মৃতির ব্রাহ্মণবাড়িয়া- মিন্নাত আলী

এখন প্রায় বিস্মৃত হলেও মিন্নাত আলী নামটি একসময় বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে খুবই পরিচিত ছিলো। ষাটের দশকের প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে লিখেছেন- ‘স্মৃতির শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া’। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সমিতির উদ্যোগে প্রকাশিত ‘শাশ্বত ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ স্মারকটিতে তার এই স্মৃতিচারণ সংকলিত হয়।

দারুণ গদ্যে লেখক কেবল তখনকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্রই তুলে ধরেন নি; শত বর্ষের মুসলিম ঐতিহ্য, ইংরেজ শোষণ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাড়াবাড়িও তুলে এনেছেন চমৎকারভাবে। বিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জানতে হলে আপনাকে মিন্নাত আলীর কাছে ফিরতেই হবে।

মিন্নাত আলী লেখেন-

‘হিসাব করে রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। ত্রিশ ত্রিশটি বছর ধরে আমি বাহ্মণবাড়িয়া শহরে বসবাস করছি। আশ্চর্য! তিরিশটি বছরে কত বিবর্ণ দিন, কত উজ্জ্বল মুহূর্ত- কত অবিস্মরণীয় ঘটনা, কত নির্মম দুর্ঘটনা- সুখ ও শোক, ভোগ ও দুর্ভোগ, নানা শ্রী ও বিশ্রী সব স্মৃতি- বিস্মৃতি। ইতিহাসের নিষ্ঠুর কষ্টিপাথরে এসবের সত্যতা টিকুক আর না-ই টিকুক- আমার স্মৃতির সত্যতা যে ষোল আনাই ঠিক এ আমি হলফ করেই বলবো। জীবিকার জান্তব অর্থে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে আমার আর্থিক সম্পর্ক তিরিশ বছরের হলেও তার সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ কিন্তু তারো এক যুগ আগে থেকে। এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় স্বপ্নের মাধ্যমে। বাস্তব ‘স্বপ্ন’ না হলেও আজ এই মুহূর্তে পঞ্চাশ বছর আগেকার রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলি আমার কাছে স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছে।
মেঘনার উপর পুল হবে, নদীর মাঝখানে ইয়া মোটা মোটা পিলার বসানো হচ্ছে। শত শত শ্রমিক- ইঞ্জিনিয়ার রাত-দিন সমানে কাজ করে যাচ্ছে। বিচিত্র সব হৈ- চৈ, কলরোল- কলরব। মেঘনা পারের লোকদের কাছে এ এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা, কৌতূহলোদ্দীপক অনুভূতি।

আমি, আজিজ আর আতর মিয়া মেঘনা পুল তৈরি দেখার কৌতূহল নিয়ে সকালে মেঘনা পাড়ি দিয়ে আশুগঞ্জ এলাম। (নিশ্চয় গুদারা ছিল, অথবা পয়সা দিয়ে নদী পার হয়েছিলাম, এখন অত সব মনে পড়ছে না) তখন তো আশুগঞ্জে উঁচু রেললাইন হয়নি। স্টেশনটাও উপরে ওঠেনি। আমরা নদীর পাড়ে কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আশুগঞ্জ স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে রেললাইন দিয়ে হাঁটতে থাকি। তিন অবোধ বালকের সে এক উদ্দেশ্যহীন, উদ্বেগহীন, অনিশ্চিত যাত্রা।

গল্প করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন তালশহর স্টেশনে পৌঁছি, তখন অভূতপূর্ব ভয়ের সাথে আমরা সচকিত হয়ে উঠি- সব্বনাশ, আমরা যে অনেক দূর চলে এসেছি! এখন বাড়ি, ভৈরব ফিরবো কেমন করে? আতর মিয়া আশ্বাস দিয়ে বললো- ঘাবড়িও না, তালশহর স্টেশনের কাছে বড়হরণ নামে এক গ্রাম আছে শুনেছি। সেখানে নাকি আমার এক দুলাভাইয়ের বাড়ি। চলো, সেখানে গিয়ে খোঁজ করি।

তারপরের ঘটনা সব মনে নেই, তবে এটুকু এখনো পষ্ট দেখতে পাচ্ছি- রেল লাইনের পাশেই বড়হরণ গ্রামে এক মসজিদঅলা বাড়িতে আমরা উঠেছি- আতর মিয়ার ‘বুবাই’ আমাদের খুব আদর করে খাওয়ালো, সন্ধ্যার পর তার দুলাভাই আমাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে এলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে- মেলা দেখাবে বলে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেলা

এস ডি ও’র মেলা এই প্রথম দেখলাম। সেদিন বিস্ময়ভরা বড় বড় চোখ দিয়ে কৌতূহলী তিন বালক কী কী দেখেছিলাম, পঞ্চাশ বছর পরে আজ তার অনেক কিছুই মনে করতে পারছি না। চোখের সামনে ভাসছে শুধু দু’টি ছবি- আশ্চর্য এক পুতুল নাচ। পুতুল নাচ দেখে আলোয় আলোময় মেলার মাঠ থেকে ফেরার পথে জমির উপর দেখি অস্থায়ী এক ‘সিনেমা হল’। আমরা বানান করে পড়লাম, সে রজনীতে প্রদর্শিত ‘টকী’র নাম- ‘সীতা’। এন এম খানের মেলার মাঠ থেকে সেই শীতের রাতে আমরা হেঁটে হেঁটে জগৎবাজারে এক দোকানে আসি এবং গদীঘরে রাত কাটাই। এসব তো ১৯৩৫ সালে আমি যখন ভৈরব প্রাইমারী স্কুলে শিশুশ্রেণীতে পড়ি তখনকার ঘটনা।

পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সময় জগৎবাজারে ‘মোল্লা রিপেয়ারিং হাউস’টা দেখেছি। কিন্তু অধুনা, সভ্যতা ও সমৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান স্পর্শের পর সেদিন জগৎবাজারে গিয়ে দেখি, সেখানকার ইয়া আলিশান বুড়ো বটগাছটা নেই, নেই আতর মিয়ার সেই স্বাস্থ্যবান, হাস্যোজ্জ্বল দুলাভাইও- ভাঙ্গা পড়ো-পড়ো মোল্লা রিপেয়ারিং হাউসটিকে কোনমতে আগলে রেখেছে মেল্লার নাতি-পুতিরা।

দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে দেখি ১৯৪০ সালে। সারা বাংলা-আসামের হাইস্কুলগুলি তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন [অবশ্য ঢাকা শহরের স্কুলগুলি ছাড়া]। ভৈরব স্কুলের ছেলেরা বরাবর মহকুমা শহর কিশোরগঞ্জেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যায়। কিন্তু সেবার ফুটবল খেলতে গিয়ে কিশোরগঞ্জের এক স্কুল টীমের সাথে ভৈরব স্কুল টীমের দারুণ মারামারি হয়- ভৈরব স্কুল আর কিশোরগঞ্জ যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে ভৈরবের নিকটবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পরীক্ষা কেন্দ্র ঠিক করে। ১৯৪০ সালে আমার এক বড় ভাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আসে। আমি তখন ক্লাশ ফাইভের ছাত্র।

সে সময় তাঁর সাথে, কেমন করে, মনে নেই, আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছিলাম। ভৈরব স্কুলের ছাত্রদের থাকার জায়গা করা হয়েছে লোকনাথ দিঘীর দক্ষিণে রাস্তার পাশেই এক ব্রাহ্ম মন্দিরে। হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে আমি ‘ব্রাহ্ম মন্দিরে’ই এক রাত কাটিয়েছিলাম। বেশ মনে আছে, মন্দিরটার দক্ষিণে-পশ্চিমে ডোবা-গর্ত, ঝোপ-ঝাপ, পাশেই ধোপা বাড়ি। এখনো চোখের সামনে ভাসছে- ডোবাটা, ডোবার পাশে বেত ঝোপের আড়ালে ধোপার ঘরবাড়ি, উঠান, উঠানে কাপড়চোপর শুকাচ্ছে, দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে ছোট ছোট কাচ্চা-বাচ্চারা।
তখনো শহরে বিজলী বাতি নেই, নেই মানুষের ভিড়, রিকশার বিরক্তিকর অসহ্য চাপ। পুরনো সিনেমা হল (চিত্রালয়) তখন দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না- তবে ফারুকী মার্কেট বলে কোন কিছু ছিল না। রাস্তার পশ্চিমে ওই জায়গাটা ছিল দুর্গন্ধময়, এঁদো পুকুর-ডোবা। রাস্তার পশ্চিমে লাল লোহার ভাঙ্গা রেলিং, ডোবার পশ্চিমে ঘরবাড়ি। কালীবাড়ি মোড়ের পর থেকে রেল লাইন পর্যন্ত বড় রাস্তার পূব দিকটায় বড় নর্দমা খাল- পশ্চিমে ডা: নন্দলাল বাবুর চেম্বার, ক’টি ছোট ছোট দোকানঘর, উমেশবাবুর একতলা-দোতলা বাড়ি, তারপর রাস্তার পাশে নর্দমা-খাল, খালের উপর উজ্জ্বল ফার্মেসি, দক্ষিণে স্টেশন রোড পর্যন্ত ঘোষ-গোয়ালাদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি।

রেললাইন পার হলেই বাঁয়ে ‘জর্জ হাই ইংলিশ স্কুল’- টিন ও বেড়ার লম্বা ঘর। স্কুলের সামনে ছোট মাঠ, মাঠের পরে পুকুর ও গর্ত (এই মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে ১৯৪৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ করা হয়)। এই জর্জ হাই স্কুলেই ভাই ও ভৈরবের আর ছাত্রদের সাথে সন্ধ্যার পর এক ফাংশনে পল্লীকবি জসীমঊদ্দীনকে দেখেছিলাম বলে মনে পড়ছে। উৎসুক হয়ে কবির জলদ কন্ঠের বক্তৃতা শুনেছিলাম, শুনেছিলাম কবির কন্ঠে গান- ওরে ও রঙ্গিলা নায়ের মাঝি, তুমি অফর বেলায় নাও বাইয়া যাওরে…… (কবি জসীমঊদ্দীনকে জর্জ হাইস্কুলে না ভৈরব হাইস্কুলে সে সময় দেখেছিলাম এই মুহূর্তে হঠাৎ গোলমাল ঠেকছে। এ কি স্মৃতিবিভ্রম?)
তারপর বড় হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আসি ১৯৪৬ সনে- ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে। এর আগেও গলানিয়ার পথে ভৈরব থেকে রেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছি দু’য়েকবার। মনে পড়ছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে সুরকি বিছানো পথে হাঁটতে হাঁটতে এসেছি ঘোড়াপট্টি। এখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি যাবে সরাইল। গাড়িতে উঠে বসে আছি- আরো যাত্রী হলে ঘোড়া ছুটবে খট খট করে। জায়গাটা ময়লা, দুর্গন্ধময়। দোকানপাট, হোটেলঘর, ছোট ছোট ভাঙ্গা টং- সব মিলিয়ে প্রাচীনকালের জরাজীর্ণ অতীতের ক্ষয়িষ্ণু ধ্বংশাবশেষ যেনো। এখনো চোখে ভাসে- ঘোড়ার গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু যেতেই খালের উপর ইয়া বড় উঁচু লোহার পুল- দু’পাশে লোহার রেলিং। শহরে ঢুকবার পথচারী ও যানবাহন চলাচলের একমাত্র রাস্তা এই খালপাড়ের পুল।

উঁচু পুল পার হয়ে উত্তর দিকে নিচে নামছি- বামে খাল, খালের পারে লাল ঘরবাড়ি, সদর পোস্ট অফিস। ডানে এবড়ো-খেবড়ো কাঁচা রাস্তা চলে গেছে খাল বরাবর থানার দিকে; একটু সামনে যেতেই ডানে রাস্তার নিচে দেখা যায় ছোট গম্বুজঅলা সুন্দর মসজিদ- নাম আরাফিয়া মসজিদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম মসজিদ। দেড়শো বছর আগে তৈরি। জঙ্গি মা ফারাহ ও ডেঙ্গু মাই ফারাহ নামে দু’ভাই এর প্রতিষ্ঠাতা। এরা মাইমল (জেলে)। তারপর বাঁ দিকে চলে গেছে লাল সুরকির রাস্তা। এই তে-রাস্তার উপর একটা নিমগাছ- ‘নিমতলায়’ রাস্তার পূর্ব পাশে নর্দমার উপর টিন-তরজার ছোট ছোট দোকানঘর। হোটেল-রেস্টুরেন্টই বেশি। বড় রাস্তার পশ্চিমে বিরাট কাঁচারি পুকুর- পুকুর পাড়ে ‘টাউন হল’, তার পাশে মিউনিসিপ্যালিটির দোতলা অফিস; উত্তর-পশ্চিম কোনায় ইয়া বড় বটগাছ, বটগাছের পাশে মোক্তার লাইব্রেরীর একতলা দালান।

সামনে এগুচ্ছি, ডান দিকে রাস্তা চলে গেছে ‘কোর্ট রোড’ নামে; বাঁ দিকের লাল সুরকির রাস্তা গেছে এস ডি ও’র কোর্ট ওই লাল বিল্ডিংটা পর্যন্ত। আর একটু উত্তরে যেতেই যেতেই বাঁয়ে কাঁচারি পুকুর। তার পাড়ে ট্রেজারী বিল্ডিং- রাস্তার ডানদিকে বিরাট বটগাছ। বটগাছের পাশ দিয়ে সরোজিনী বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে; স্কুলের গেইটটার আর একটু সামনেই মহকুমার সদর হাসপাতাল।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে এসে আমরা উঠি অন্নদা স্কুলের বোর্ডিংয়ে। স্টেশন থেকে রিকশায়ই আসি। শহরে রিকশার চলাচলই বেশি- ঘোড়ার গাড়ি নেই, থাকলেও শহরে নয়। সরাইল বুঝি যায়। অন্নদা স্কুলের বোর্ডিং বলে পরিচিত হলেও -পরে জেনেছি- এর আসল নাম ‘আসমাতুন-নেসা মুসলিম ছাত্রাবাস’। গোকর্নের নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা (১৮৬২-১৯২২) তাঁর মা’র নামে এটি স্থাপন করেছেন। বেশ মনে আছে আমার পরীক্ষার সিট পড়েছিল অন্নদা স্কুলের বর্তমান বিল্ডিং-এর সামনে মাঠের পূর্ব দিকে একটি লম্বা বেড়ার ঘরে। ১৯৪১-৪৩ সালে যুদ্ধের সময় ফেনী কলেজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসে। তখন কলেজের ক্লাস করার জন্য এই বেড়ার শেড তৈয়ার করা হয়েছিল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তখন হিন্দুরাই প্রধান। উকিল-মোক্তার ডাক্তার-মাস্টার সবাই হিন্দু; ওদিকে দোকানপাট, ব্যবসায়-বানিজ্য, হোটেল-রেষ্টুরেন্ট এগুলোও ওদেরই হাতে। মুসলমানদের মাঝে তখন সবে আত্ম-সচেতনতার ভাব জেগে উঠছে। অন্নদা স্কুলের কাছেই লোকনাথ দীঘিটা। সকালে পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত। ওদিকে যাওয়ার ফুরসত নেই। বিকালে প্রায়ই দেখতাম দীঘিটার চার পাড় দিয়ে ধুতি পরিহিত যুবা বৃদ্ধরা হাঁটাহাঁটি করছে- বৈকালিক ভ্রমণে জায়গাটাকে নয়নাভিরাম করে তুলছে। আশ্চর্য, কোন লুঙ্গি নেই, পাজামাও নেই! (মুসলমান নেই)

দীঘির দক্ষিণ দিকে বেশ বড় মাঠ- দীঘির পাড় থেকে অনেক নিচুতে এই মাঠের পূর্বে ও পশ্চিমে ইয়া বড় বড় দুটি কড়ই গাছ। অনেক উঁচু। মাঠের পশ্চিম কোনায় খুপড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে সেখানে ধুতি পরিহিত যুবারা ভলিবল খেলছে। পূর্ব কোনায় কড়ই গাছটার পাশে ঝাঁপড়ি বেড়ার ভিতর ‘হার্ড টেনিস লন’। সেদিন আমি কোন মুসলমানকে টেনিস লন, ভলিবল খেলা বা লোকনাথ দীঘির পাড়ে সান্ধ্যভ্রমণে দেখিনি। আমরাও বিদেশি (?) মুসলমান ছেলে বলে ওদিক মাড়াতে সাহস করিনি।

সেদিন ছাত্র হয়ে যেখানে ঢুকতে সাহস করিনি, কালচক্রের ঘূর্ণনে গত এক যুগ পরে ‘প্রফেসর’ হয়ে সেখানে শুধু প্রবেশই করিনি- নিয়মিত টেনিসও খেলেছি। তখন কৌতূহলী মন ও চোখ দিয়ে ‘হার্ড টেনিস লনে’র মাঝামাঝি জায়গায় শ্বেতপাথরে খোদাই নাম ফলকটা পড়েছি- ঈড়হংঃৎঁপঃবফ ঁহফবৎ ঃযব ঢ়ধঃৎড়হধমব ড়ভ ধহফ ড়ঢ়বহবফ নু ই. ঈ. উবু, ও.চ.ঝ.উ.চ.ঙ, ইৎধযসধহনধৎরধ ড়হ ১ংঃ উবপবসনবৎ, ১৯৩৬। ১৯৩৬ এর পর কত দশক, কত যুগ পার হয়ে গেছে!

গত তিন-তিনটি দশক ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে প্রতিনিয়ত দেখে আসছি, দেখছি। চোখের সামনেই দিনে দিনে তিলে তিলে তিলোত্তমা শহরে রূপ নিচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তাহলেও ট্যাংকের পাড়ে যখন দাঁড়াই, চোখের সামনে দেখি একদিকে আল্লাহর ঘর সুরম্য মসজিদ, আরেক দিকে নগর সভ্যতার রমণীয় নিদর্শন আধুনিক ‘অডিটোরিয়াম’। কিন্তু এসব ছাপিয়ে আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ইয়া বড় বড় আকাশ-ছোঁয়া দু’টি কড়ই গাছ, কড়ই গাছের পাশে সুন্দরভাবে ঘেরাও করা ‘টেনিস লন’- যেখানটায় কোন এক মহকুমা পুলিশ অফিসার তাঁর কীর্তিকে অমর করার অভিলাষে সন-তারিখসহ পাথরে খোদাই করে নিজের নামটা লিখেছিলেন।’

দর্শনীয় স্থাপনা

mosque in b baria

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী এবং দর্শনীয় কিছু স্থাপনা হলো- সরাইলে অবস্থিত আরফাইলের মসজিদ, সদর থানার উলচাপাড়া মসজিদ, কালভৈরব মন্দির, ঐতিহাসিক হাতিরপুল, অখাউরায় খরমপুরের শাহ সূফী কেল্লা শহীদের মাজার, কসবার কৈলাঘর দুর্গ, কুল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কবর, সৌধ হিরন্ময়, শহীদ মিনার, তোফায়েল আজম মনুমেন্ট, শহীদ স্মৃতিসৌধ, ভাদুঘর মসজিদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু এবং আর্কাইব মিউজিয়াম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার বিবেচনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি বিশেষ অঞ্চলের স্বীকৃতি পেতে পারে অনায়াসেই।

গেলো শতাব্দীতে আমাদের ইলমী অঙ্গনের জন্য ১৯৮৪ সালে জেলার মর্যাদা পাওয়া এ অঞ্চলের অবদান সবিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। হাজী ইউনুস, ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম, মুফতি নুরুল্লাহ আর বড় হুজুর সিরাজুল ইসলাম সাহেবের মতো বরেণ্য আলেমদের কল্যাণে বরাবরই আলোচনায় থেকেছে এই জেলাটি। আর মুফতি ফজলুল হক আমিনীর রহ. নেতৃত্বে বিগত দুই দশকের ভূমিকায় এটি তো বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।

অনেক আগে থেকেই এখানকার মানুষেরা ধার্মিক, শান্তিপ্রিয়। এ জেলার আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সাধারণত অন্যান্য জেলায় তেমন দেখা যায় না। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এখানকার লোক হক ও হক্বানিয়্যাতের জন্য নিবেদিত। আত্মত্যাগী। জিহাদী জযবায় উদ্যমী। তাগুত ও বাতিলের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন। বাতিলের সামনে কখনও মাথা নত করে না তারা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদের ঐতিহ্য আদিকাল থেকেই। বৃটিশ কর্তৃক নবুওয়্যাতপ্রাপ্ত ভ- কাদিয়ানীর আবির্ভাব ঘটলে তার মোকাবেলায় দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. এগিয়ে আসেন। তার কুরআন-হাদীসভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ অগ্নিঝরা বক্তৃতার সামনে কাদিয়ানীর ভ-ামী মাকড়সারর জালের ন্যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এ সময় ফখরে বাঙ্গাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতী সন্তান মাওলানা তাজুল ইসলাম দারুল উলূম দেওবন্দে আল্লামা কাশ্মীরীর নিকট অধ্যয়নরত। কাদিয়ানীদের মোকাবেলায় বিভিন্ন সভা সমিতি, সেমিনার ও কনফারেন্সে আল্লামা কাশ্মীরী তার প্রখর মেধাসম্পন্ন এ তুখোড় ছাত্রটিকে পাঠিয়ে দিতেন। ছাত্রটিও তার উস্তাদের সুধারণার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হন। কথায় বলে, যেখানে বাতিল সেখানেই হক। যেখানে নমরূদ সেখানে ইবরাহীম। যেখানে আবু জাহেল সেখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

দেশে আসার পর হযরত ফখরে বাঙ্গাল তার চারপাশে কাদিয়ানীদের উৎপাত দেখতে পান। তিনি ওয়াজ-নসিহত, বাহাস-মুনাযারা তথা যুক্তি-তর্ক এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের জীবনব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাওলানা সিরাজুল ইসলাম মুফাস্সির হুজুর আজীবন সে জিহাদী সিলসিলা অব্যাহত রাখেন। প্রখ্যাত মুবাল্লিগ হযরত মাওলানা আলী আকবরের রহ. জন্ম এখানেই। প্রথিতযশা মুফতী ও শাইখুল হাদীস আল্লামা নুরুল্লাহ রহ. এখানকার এক প্রাণপুরুষ। মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ. কুরআনের খেদমতে নিবেদিত এক মহান ব্যক্তিত্ব। এ সিলসিলারই সর্বশেষ অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন মুফতী ফজলুল হক আমীনী রহ.।

২০০১ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক সব ধরণের ফতোয়া অবৈধের রায় ঘোষিত হলে ইসলামপ্রিয় জানবাজ মুসলমানেরা সারাদেশের ন্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেও প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশের নির্মম গুলিতে নয়জন মরদে মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বরাবরই আলেমদের প্রভাব ছিলো এবং আছে।

সুতরাং বড় হওয়া, গড়ে ওঠা এবং পরবর্তীকালে নিজের কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিঃশর্তভাবে এই জেলার মানুষকে মুফতী আমিনী রহ. পেয়েছেন একনিষ্ঠ সমর্থক ও সহযোগী হিসেবে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *