আশুরা ও মুহাররম: ইতিহাস, তাৎপর্য ও আহকাম

কুরবানী- makkah

Date

Author

Blog Duration

20 minutes

আশুরা

মুহাররম মাস সম্মানিত হওয়ার বিশেষ একটি কারণ হচ্ছে- আশুরা (মুহাররমের ১০ তারিখ)। পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে ফিরআউনের অত্যাচার থেকে হজরত মুসা (আ.)-এর নিষ্কৃতি লাভ। এই দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা চিরকালের জন্য লোহিত সাগরে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদার দাবিদার ফিরআউন ও তার বিশাল বাহিনীকে।

অনেকে মনে করেন, ফিরআউন নীলনদে ডুবেছিল। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী বরং তাকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়া হয়।

‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন- মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)

উপরোক্ত হাদিসের আলোকে কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়, হজরত মুসা (আ.) অভিশপ্ত ফিরআউনের কবল থেকে আশুরার দিন রক্ষা পেয়েছিলেন। তা হাদিসের প্রায় সব গ্রন্থেই (বুখারি, মুসলিমসহ) পাওয়া যায়।

আশুরা অর্থ কি

আশুরা মূলত আরবি শব্দ। আশারা শব্দমূল থেকে নির্গত। এর অর্থ দশ। আরবি শব্দ আশরুন তথা দশ শব্দটি থেকে আশুরার শব্দের উৎপত্তি। মুহাররমের দশ তারিখ সম্মানিত বলে দিনটিকে পবিত্র আশুরা বলা হয়।

আশুরা কবে: আশুরা ২০২৩

বাংলাদেশের আকাশে এ বছর (২০২৩) ৯ জুলাই মুহাররম মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। ফলে ২০ জুলাই বুধবার থেকে পবিত্র মুহাররম মাস গণনা শুরু হয়েছে। সে অনুযায়ী ২৯ জুলাই (শনিবার) সারা দেশে পবিত্র আশুরা পালিত হবে।

‘মঙ্গলবার জুলাই ১৮ সন্ধ্যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বায়তুল মোকাররম সভাকক্ষে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় ১৪৪৫ হিজরি সনের পবিত্র মুহাররম মাসের চাঁদ দেখা সম্পর্কে সব জেলা প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আকাশে মুহাররম মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ফলে ৯ জুলাই জিলহজ মাস পূর্ণ হবে এবং আগামী ২৯ জুলাই (শনিবার) পবিত্র আশুরা পালিত হবে।’

আশুরার তাৎপর্য ও আশুরার ফজিলত

মুহাররম মাসের সবচে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুহাররমের দশ তারিখ। হাদীসে আশুরার দিনের অনেক ফযীলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব আরব জাহেলী সমাজে এবং আহলে কিতাব- ইহুদী-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। 

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন-

كَانُوا يَصُومُونَ عَاشُورَاءَ قَبْلَ أَنْ يُفْرَضَ رَمَضَانُ، وَكَانَ يَوْمًا تُسْتَرُ فِيهِ الكَعْبَةُ، فَلَمّا فَرَضَ اللهُ رَمَضَانَ، قَالَ رَسُولُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: مَنْ شَاءَ أَنْ يَصُومَهُ فَلْيَصُمْهُ، وَمَنْ شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ فَلْيَتْرُكْهُ.

(জাহেলী সমাজে) লোকেরা রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোযা রাখত। এ দিন কাবায় গেলাফ জড়ানো হত। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে এ দিন রোযা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯২

এ হাদীসদ্বয় থেকে বুঝে আসে- জাহেলী সমাজে এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এ দিনে তারা কাবা শরীফে গেলাফ জড়াত। এ দিন তারা রোযা রাখত। নবীজীও এ দিন রোযা রাখতেন। হিজরতের পরও এ দিন রোযা রাখতেন। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে এ দিনের রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর এ দিন রোযা রাখা এখন মুস্তাহাব।

এরপর যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন দেখেন, মদীনার আহলে কিতাব ইহুদীরাও এ দিনে রোযা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদ্যাপন করছে। নবীজী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন-

مَا هَذَا الْيَوْمُ الّذِي تَصُومُونَهُ؟

এ দিনে তোমরা কী জন্য রোযা রাখছ? তারা বলল-

هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ، أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ، وَغَرّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا، فَنَحْنُ نَصُومُهُ

এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তাআলা এ দিনে হযরত মূসা আ. ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন। এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর হযরত মূসা আ. এ দিনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রাখতেন। তাই আমরাও রোযা রাখি।

নবীজী এ শুনে বললেন-

فَنَحْنُ أَحَقّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ

হযরত মূসা আ.-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। এরপর নবীজী নিজেও রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখতে বললেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩০; সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২৫, ৩৯৪৩

আশুরার দিনটি মহিমান্বিত। হাদীস শরীফে এসেছে-এই দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তাওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যদের তাওবা কবুল করবেন। (জামে তিরমিযী ১/১৫৭)

صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ

আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি, তিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

আশুরার ইতিহাস

এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১

তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হযরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।

এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রা.। বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’

অন্য হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’

অতএব শাহাদাতে হুসাইন রা.কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।

আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর

প্রশ্ন ১ : পেছনের যুগে আশুরার দিনে কী কী ঘটনা ঘটেছে? ভবিষ্যতে কী কী ঘটনা ঘটবে? এ বিষয়ে যে লম্বা তালিকা তাম্বীহুল গাফিলীন ও মকসুদোল মোমেনীন ইত্যাদি কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে সেগুলো কি ঠিক?

উত্তর : কিছুতেই না। ওইসব বর্ণনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই বাতিল এবং মনগড়া। মওযু রেওয়ায়েতের পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যে যেসব কিতাব লেখা হয়েছে সেগুলোতে একথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে।

প্রশ্ন ২ : একথা কি ঠিক যে, আশুরার দিনেই কিয়ামত হবে?

উত্তর : না। একথাও ওইসব মওযু রেওয়ায়েতের মধ্যে রয়েছে। নির্ভরযোগ্য কোনও রেওয়ায়েতে একথার কোনও আলোচনাই আসেনি।

প্রশ্ন ৩ : কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আমরা দেখতে পাই যে, আশুরার দিনেই হযরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা কবুল হয়েছে। এইসব রেওয়ায়েত কি সহীহ?

উত্তর : একথা আবুল কাসিম ইস্পাহানী রাহ. কর্তৃক সংকলিত ‘আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’-এর ১৮৬৮ নং রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু এই রেওয়ায়েতের সনদ খুবই দুর্বল। এছাড়া আরও কিছু রেওয়ায়েতে এই কথা এসেছে, সেগুলো মওযু।

ইস্পাহানী রাহ. কর্তৃক বর্ণিত ওই রেওয়ায়েতের সনদে দিরার ইবনে আমর নামে একজন রাবী আছেন, যার সম্পর্কে ইমাম ইবনে মায়ীন রাহ. বলেছেন- لا شيء। -লিসানুল মীযান ৪/৩৪০

অবশ্য কোনো কোনো তাবিয়ী থেকে এই কথা বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা হযরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা কবুল হওয়া সম্পর্কে আশুরার দিনের কথাই বলতেন। দেখুন- ইমাম ইবনে রজব রাহ.কৃত লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা : ১১৩-১১৫ এবং আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ রাহ.কৃত আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল, বর্ণনা নম্বর : ৩৭৯৫

প্রশ্ন ৪ : শুনেছি একথা প্রমাণিত যে, হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কিশতী যেদিন জূদী পাহাড়ে থেমেছিল সেই দিনটি ছিল আশুরার দিন। এই রেওয়ায়েতের সনদ কি সহীহ?

উত্তর : একথা মুসনাদে আহমাদের একটি রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু তার সনদ দুর্বল। দেখুন- মুসনাদে আহমাদ ১৪/৩৩৫, হাদীস ৮৭১৭ (শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা।)

প্রশ্ন ৫ : ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম কি আশুরার দিন হয়েছে?

উত্তর : একথাও প্রমাণিত নয়। আবুল কাসিম ইস্পাহানী রাহ.-এর কিতাব ‘আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’-এর পূর্বোক্ত রেওয়ায়েতেই একথা এসেছে। আগেই বলা হয়েছে, এর সনদ খুবই দুর্বল।

প্রশ্ন ৬ : তাহলে কোন্ কোন্ ঘটনা আশুরার দিন ঘটেছে বলে প্রমাণিত?

উত্তর : কেবল দুটি ঘটনা :

১. হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাথীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা; যেখানে দরিয়ায় রাস্তা বানিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন।

২. এই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদেরকে দরিয়ায় ডুবিয়ে ধ্বংস করার ঘটনা।

এই দুটি ঘটনা বিভিন্ন সহীহ হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।

আপাতত এই কয়েকটি কথা আর এই কয়েকটি প্রশ্নোত্তরের মধ্যেই আজকের আলোচনা শেষ করছি। হায়াত যদি সঙ্গ দেয় তাহলে ইনশাআল্লাহ আরও কিছু জরুরি কথা ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা আছে।

আশুরা সম্পর্কে একটি প্রসিদ্ধ ভ্রান্তির অপনোদন

আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। অনেকেই না বুঝে অথবা ভ্রান্ত প্ররোচনায় পড়ে আশুরার ঐতিহ্য বলতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয়তম দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের দলপতি হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ও নবী পরিবারের কয়েকজন সম্মানিত সদস্যের রক্তে রঞ্জিত কারবালার ইতিহাসকেই বুঝে থাকে। তাদের অবস্থা ও কার্যাদি অবলোকন করে মনে হয়, কারবালার ইতিহাসকে ঘিরেই আশুরার সব ঐতিহ্য, এতেই রয়েছে আশুরার সব রহস্য। উপরোল্লিখিত হাদিসের আলোকে প্রতীয়মান হয়, আসলে বাস্তবতা কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং আশুরার ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই।

আশুরার রোজা

মুহাররম মাসে রোজা রাখা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষভাবে আশুরা, অর্থাৎ মুহাররমের ১০ তারিখে রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই ওই বিধান রহিত হয়ে যায় এবং তা নফলে পরিণত হয়। হাদিস শরিফে হজরত জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে- ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (মুসলিম শরিফ-১১২৮)

ওই হাদিসের আলোকে আশুরার রোজার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতীয়মান হয়। বর্তমানে এই রোজা যদিও নফল, কিন্তু অন্যান্য নফল রোজার তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন না। (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত হাফসা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি কাজ কখনো ছেড়ে দিতেন না। তার মধ্যে একটি আশুরার রোজা। (নাসায়ি শরিফ)

হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) বর্ণনা করেন, আশুরার দিন ইহুদিরা ঈদ পালন করত। রাসুল (সা.) সাহাবিদের সেদিন রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন। (বুখারি-২০০৫, মুসলিম-১১৩১)

হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلّا هَذَا اليَوْمَ، يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ

অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার দিনের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে অন্য কোনো দিন রোযা রাখতে দেখিনি এবং রমযান মাস অপেক্ষা অন্য কোনো মাসে এত গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখতে দেখিনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩২

সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত  নারী সাহাবী হযরত রুবায়্যি‘ বিনতে মুআববিয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন-

যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোযা পূর্ণ করে।

ঐ নারী সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৬

হজরত ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে একটি হাদিস বর্ণিত আছে, জাহিলিয়াতের যুগে কাফেররা আশুরার দিন রোজা রাখত। তাই রাসুল (সা.) ও সাহাবায়েকেরামও সেদিন রোজা রাখতেন; কিন্তু যখন রমজানের রোজা ফরজ হয়, তখন তাঁদের রোজা রাখা না রাখার ব্যাপারে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। (মুসলিম-১১৩৬) এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, কাফেররা অন্ধকার যুগে আশুরার দিন রোজা রাখত কেন? এর উত্তর এটা হতে পারে যে তারা প্রতিবছর মহররমের ১০ তারিখে কাবা শরিফকে গেলাফ পরিধান করাত। যেমনটি বুখারি শরিফে রয়েছে (হাদিস নম্বর : ১৫৮২)

হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে, কিন্তু এর পরও প্রশ্ন রয়ে যায়, তারা গেলাপ পরিধান করানোর জন্য ওই দিনকে কেন নির্দিষ্ট করেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর (এবং প্রথম প্রশ্নের দ্বিতীয় উত্তর) দিতে গিয়ে বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত ইকরামা (রা.) বলেন- অন্ধকার যুগে কাফেররা একটি অনেক বড় অপরাধ (তাদের দৃষ্টিতে) করে বসে। তাদের বলা হলো, তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো, তাহলে তোমাদের গুনাহ মাফ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন থেকে কোরাইশ বংশের লোকেরা সেদিন রোজা রাখতে শুরু করে। (ফতহুল বারি খ.-৪ পৃ.-৭৭৩)

আশুরার রোজা কয়টি

আশুরার দিন রোযা রাখা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি আমল। এ দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। তবে এরচে উত্তম হল, দশ মুহাররমের আগে বা পরে নয় বা এগার তারিখে একদিন অতিরিক্ত রোযা রাখা। নয় তারিখে রাখতে পারলে ভালো। কারণ হাদীসে নয় তারিখের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোযা রাখছিলেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন-

يَا رَسُولَ اللهِ إِنّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنّصَارَى؟

ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দিনকে তো ইহুদী-নাসারারা (খ্রিস্টানরা) সম্মান করে? তখন নবীজী বললেন-

فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التّاسِعَ قَالَ: فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ، حَتّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ

তাহলে আগামী বছর আমরা নয় তারিখেও রোযা রাখব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সেই আগামী বছর আসার পূর্বেই নবীজীর ইন্তেকাল হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৪

‘নয় তারিখ রোযা রখব’ মানে দশ তারিখের সাথে নয় তারিখ মিলিয়ে রাখব। এজন্য ইবনে আব্বাস রা. বলতেন-

صُومُوا التّاسِعَ وَالعَاشِرَ وَخَالِفُوا اليَهُودَ

তোমরা নয় তারিখ এবং দশ তারিখ রোযা রাখ এবং ইহুদীদের বিরোধিতা কর। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৫

(একটু চিন্তা করুন তো, ইসলামী শরীয়তে বৈধ এবং কাম্য একটি ইবাদতের ক্ষেত্রে যদি এমন বিরোধিতার কথা আসে তাহলে ইহুদী-নাসারাদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং বিজাতীয় কালচারের ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করার বিধান কত কঠোর হতে পারে! )

আর সবচে উত্তম হয়, দশ তারিখের সাথে মিলিয়ে আগে-পরে আরো দুটি রোযা রাখা। নয়, দশ ও এগার সর্বমোট তিনটি রোযা রাখা। কারণ, পুরো মুহাররম মাসব্যাপি রোযার কথা তো সহীহ হাদীসেই আছে। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার রাহ. ৪/২৪৬)

আশুরার রোজার ফজিলত

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রোজা নিজে পালন করেছেন এবং উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তাই এর পূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উম্মতের কল্যাণ। এ ছাড়া অসংখ্য হাদিসে আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস শুনি-

  1. ‘হজরত আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম-১১৬২)।
  2. ‘রাসুল (সা.) বলেন- ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা-৪২১০)

মুহাররম : আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সম্মানিত মাস এবং হিজরী বর্ষের প্রথম মাস

হিজরী বর্ষের সর্বপ্রথম মাস- মুহাররামুল হারাম তথা মুহাররম মাস। হাদীসের ভাষায়- শাহরুল্লাহ আলমুহাররাম। আল্লাহ তাআলা বছরের যে ক’টি মাসকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন মুহাররম তার অন্যতম। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ. فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُم

আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সহজ-সরল দ্বীন (-এর দাবি) অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে নিজের উপর জুলুম করো না।… -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬

এ চার মাস কী কী? হাদীস শরীফে তা বলে দেওয়া হয়েছে। বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২

হাদীসে এ মাসকে শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصَلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.

রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَأَفْضَلُ الْأَشْهُرِ شَهْرُ اللهِ الَّذِي تَدْعُونَهُ الْمُحَرّمُ

(রমযানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মুহাররম বলে থাক। -সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ৪২১৬

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে হিজরী সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন-

یَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ قُلْ هِیَ مَوَاقِیْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ

লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদেরকে বলে দিন, এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) হিসাব এবং হজ্বের সময় নির্ধারণ করার জন্য। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৯

নতুন চাঁদ ও নতুন বছরের দুআ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন চাঁদ দেখে এই দুআ পড়তেন-

اللهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلامَةِ وَالْإِسْلامِ، رَبِّي وَرَبُّكَ اللهُ

আয় আল্লাহ, আপনি এই হিলালকে আমাদের জন্য ঈমান ও ইসলাম এবং শান্তি ও বরকতের সঙ্গে উদিত করুন। আমার ও তোমার রব আল্লাহ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৯৭

এ দুআটি যে কোনো মাসের নতুন চাঁদ দেখে পড়ার জন্য। এ হিসাবে যদি মুহাররমের চাঁদ দেখে এ দুআ পড়া হয় তাহলে নতুন চাঁদের সাথে সাথে নতুন বছরের দুআও হয়ে যাবে।

অবশ্য ইমাম আবুল কাছেম বাগাভী রাহ. (৩১৭ হি.) ‘মু‘জামুস সাহাবা’ কিতাবে সহীহ সনদে নতুন মাস ও নতুন বছরের শুরুতে পড়ার একটি দুআ উল্লেখ করেছেন। সাহাবী আবদুল্লাহ বিন হিশাম রা. বলেন, সাহাবায়ে কেরাম নতুন মাস বা নতুন বছর শুরুর এ দুআটি তেমন গুরুত্ব দিয়ে শিখতেন, যেভাবে কুরআনুল কারীম শিখতেন। দুআটি হল-

اللّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ وَالِإيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَالإِسْلَامِ وَجِوَارٍ مِنَ الشَّيطَانِ وَرِضوَانٍ مِنَ الرَّحْمنِ.

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে এ মাস/বছরের আগমন ঘটান- শান্তি ও নিরাপত্তা এবং ঈমান ও ইসলামের (উপর অবিচলতার) সাথে; শয়তান থেকে সুরক্ষা ও দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে। (দ্রষ্টব্য : মুজামুস সাহাবাহ ৩/৫৪৩, বর্ণনা ১৫৩৯; আলইসাবাহ ৪/২৫৬)

এ দুআর ক্ষেত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে- এটি নতুন বছরের দুআ। আর সাহাবায়ে কেরামও এ দুআটির প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন।

মুহাররম মাসে মনোযোগী হই রোযার প্রতি

পূর্বেই আমরা যে হাদীসটি উল্লেখ করে এসেছি- হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصَلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ

রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩

এ হাদীস থেকে মুহাররমের ব্যাপারে দুটি কথা পাওয়া যায় :

এক. মুহাররম মাস আল্লাহর মাস। সম্মানিত ও মহিমান্বিত মাস।

দুই. এর সম্মান রক্ষা এবং এ থেকে যথাযথ উপকৃত হওয়ার একটি মাধ্যম হচ্ছে, এ মাসে রোযা রাখার প্রতি যত্নবান হওয়া।

প্রকৃতপক্ষে সকল মাসই তো আল্লাহর মাস। তথাপি এ মাসকে বিশেষভাবে ‘আল্লাহর মাস’ বলে ব্যক্ত করার মাঝে রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। যেমন পৃথিবীর সকল মসজিদই আল্লাহর ঘর। কিন্তু কাবা শরীফকে বিশেষভাবে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলার হেকমত কী? কারণ এর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। তেমনি বছরের অন্যান্য মাস অপেক্ষা মুহাররমের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।

মুহাররম মাসে তাওবার গুরুত্ব

তাওবা-ইস্তিগফার যে কোনো সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। বান্দা আল্লাহর দরবারে ধরনা দেবে এবং নিজের অতীতের জন্য ক্ষমা চাইবে- এতেই তো তার বন্দেগীর শান। তবে কিছু কিছু মুহূর্ত এমন রয়েছে, যখন তাওবার পরিবেশ আরো অনুকূল হয়। বান্দার উচিত আল্লাহর দেওয়া সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তগুলো লুফে নেওয়া এবং আল্লাহমুখী হয়ে জীবনকে আরো সুন্দর করা। মুহাররমের এ মাসটি, বিশেষ করে এর দশ তারিখ- ‘ইয়াওমে আশুরা’ এমনই একটি উপযুক্ত সময়।

মুহাররমের ফযীলতের একটি দিক হচ্ছে, এর সাথে তাওবা কবুল হওয়া এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুক্তি, নিরাপত্তা এবং গায়েবী সাহায্য লাভ করার ইতিহাস জুড়ে আছে। এজন্য এ সময়ে এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি আরো বেশি ধাবিত হয়। বিশেষভাবে এ সময়ে তাওবা-ইস্তিগফারের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হওয়া চাই।

এক সাহাবী নবীজীর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، أَيّ شَهْرٍ تَأْمُرُنِي أَنْ أَصُومَ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَان.

ইয়া রাসূলাল্লাহ! রমযানের পর আপনি কোন্ মাসে রোযা রাখতে বলেন? নবীজী বললেন-

إِنْ كُنْتَ صَائِمًا بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ فَصُمُ الْمُحَرّمَ، فَإِنّهُ شَهْرُ اللهِ، فِيهِ يَوْمٌ تَابَ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ، وَيَتُوبُ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ آخَرِينَ.

তুমি যদি রমযানের পর রোযা রাখতে চাও তাহলে মুহাররমে রোযা রেখ। কেননা মুহাররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একদিন আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪১

মুহাদ্দিসীনে কেরাম এ দিনটি আশুরার দিন হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন। দ্রষ্টব্য : লাতাইফুল মাআরেফ, পৃ. ৭৬

হাদীসেও অনেক দুআ-ইস্তিগফার বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘সায়্যেদুল ইস্তিগফার’কে আমরা আমাদের ওজীফা বানাতে পারি।

সায়্যেদুল ইস্তিগফার হচ্ছে-

اللّهُمّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلهَ إِلّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي، فَإِنّهُ لاَ يَغْفِرُ الذّنُوبَ إِلّا أَنْتَ.

হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার বান্দা। আমি যথাসাধ্য আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার ও আপনার প্রতিশ্রুতির উপর রয়েছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আমার প্রতি আপনার নিআমতের কথা স্বীকার করছি। আপনার কাছে আমি আমার গোনাহের কথা স্বীকার করছি। কাজেই আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩০৬

মুহাররম ও আশুরা সম্পর্কে অন্যান্য আলোচনা

মুহাররম ও আশুরা কেন্দ্রিক কিছু গর্হিত রেওয়াজ

যে আয়াতটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে আল্লাহ তাআলা যে কথাটি বলেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُم …

তোমরা এ দিনগুলোতে নিজেদের উপর জুলুম করো না। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬

বস্তুত সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হওয়া। এমনিতেই যে কোনো সময়ই তা নিষিদ্ধ। তথাপি এ দিনগুলোতে আল্লাহর নাফরমানী থেকে বাঁচতে বিশেষভাবে হুকুম করা হচ্ছে। কারণ নেক ও কল্যাণের এমন মোক্ষম মুহূর্তে যে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয় তারচে হতভাগা আর কে হতে পারে!

আফসোসের বিষয় হচ্ছে, নেকীর এ সময়কে ঘিরে সমাজে রয়েছে বিভিন্ন গলত রসম রেওয়াজ এবং নানা রকমের বিদআতী কর্মকাণ্ড। এ সময়ের আমল ততটুকু, যতটুকু উপরে হাদীসের উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করা হল। মুহাররম মাসকে কেন্দ্র করে এছাড়া আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। নেই এ দিনের জন্য বিশেষ নামায, বিশেষ যিকির, বিশেষ আয়োজন এবং বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা।

বিশেষ করে দশ মুহাররমে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ মাতমের যে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির অবতারণা করা হয় তা তো খুবই গর্হিত একটি সংস্কৃতি। ইসলামের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম মাতম ও শোক প্রকাশের এমন আয়োজনকে হারাম সাব্যস্ত করেছে। এরচে জঘন্য হল, এ দিনে ‘তাযিয়া’র নামে শিরক-বিদআতের আয়োজন করা। পরিতাপের বিষয়, শিয়াদের এমন আয়োজনগুলোতে ঢালাওভাবে অনেক মুসলমান অংশগ্রহণ করে থাকে। এটা যে ঈমানের জন্য কত বড় হুমকি ও খতরা- তা কি তারা একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখেন!

[এ বিষয়ে মৌলিক কথাগুলো জানতে পড়ুন, মাসিক আলকাউসারে মুহাররম ১৪৪০/অক্টোবর ২০১৮ সনে প্রকাশিত উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ-‘মুহাররম ও আশুরা : কিছু কথা, কিছু প্রশ্নের উত্তর’]

কাজেই মুহাররম কেন্দ্রিক সকল গর্হিত কর্মকা- থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি সকল বিদআত-খুরাফাত ও রসম-রেওয়াজ থেকেও দূরে থাকা আবশ্যক। দেখা যায়, ফযীলতের সময়গুলোতে সওয়াব হাছিল করতে গিয়ে উল্টো হারামে লিপ্ত হওয়ার গুনাহ হতে থাকে। এটা তো কখনোই কাম্য নয়। আবার বিধানগতভাবে ফযীলতের এ ব্যাপারগুলো নফল হওয়ায় এ থেকে গাফেল থাকাও উচিত নয়। শরীয়ত যে বিধানকে যে স্তরে রেখেছে এবং যে সময়ের যতটুকু মূল্যায়ন করেছে ততটুকু করতে পারাই লাভ। এর কমবেশি করতে গেলেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। তাই একদিকে যেভাবে সকল খুরাফাত ও রসম-রেওয়াজ পরিত্যাজ্য, অপরদিকে ফযীলতপূর্ণ এ আমল ও উপলক্ষগুলো নফল হওয়ায় এগুলোর ব্যাপারে বিলকুল গাফেল থাকাও সচেতন মুমিনের শান নয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

বান্দার উপর আমি যে বিধান ফরয করেছি আমার নৈকট্য লাভের জন্য তারচে’ উত্তম কিছু নেই। আর বান্দা (ফরয ইবাদতের পর) নফল আমলের মাধ্যমে আমার নৈকট্যের পথে অগ্রসর হতে থাকে। একপর্যায়ে সে আমার ভালবাসা লাভ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৫০২

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ফরয বিধানের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থাকার পাশাপাশি নফল বিধানাবলির ক্ষেত্রেও মনোযোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন।

আশুরার দিনে অন্য একটি আমল

‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যে পর্যাপ্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহপাক পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দান করবেন। (তাবরানি : ৯৩০৩)

উল্লিখিত হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল জাওযিসহ অনেক মুহাদ্দিস আপত্তিজনক মন্তব্য করলেও বিভিন্ন সাহাবি থেকে ওই হাদিসটি বর্ণিত হওয়ায় আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতিসহ অনেক মুহাক্কিক আলেম হাদিসটিকে গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। (জামিউস সগির-১০১৯)

অতএব যদি কেউ উপরোক্ত হাদিসের ওপর আমল করার উদ্দেশ্যে ওই দিন উন্নত খানাপিনার ব্যবস্থা করে, তাহলে শরিয়তে নিষেধ নেই। তবে স্মরণ রাখতে হবে, কোনোক্রমেই যেন তা বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনের স্তরে না পৌঁছে।

এই ব্লগে উল্লেখিত সকল তথ্য নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগৃহীত ও যাচাইকৃত- শাকিল আদনান

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *